Are you sure?

কুরআন »  ভাষা শৈলী

ইলতিফাত (التفات) প্রাক-ইসলামি আরবি সাহিত্যে: ঐতিহাসিক প্রমাণ ও ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ও অভিযোগের জবাব ।

ভূমিকা:

ইলতিফাত (التفات), আক্ষরিক অর্থে "ফিরে তাকানো" বা আলঙ্কারিক পরিভাষায় "দৃষ্টিকোণ পরিবর্তন", আরবি ভাষা ও সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সুপ্রতিষ্ঠিত আলঙ্কারিক কৌশল। এই শৈলীতে বক্তা বা লেখক বক্তব্যের মাঝখানে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ব্যাকরণিক দৃষ্টিকোণ (পুরুষ, বচন, কাল বা সম্বোধনের ধরন) পরিবর্তন করেন, যা বক্তব্যকে গতিশীলতা ও গভীরতা প্রদান করে। পবিত্র কুরআনে এর বহু উদাহরণ বিদ্যমান, যেমন সূরা আল-আন’আমের (৬:৯৯) আয়াতে দেখা যায়:
أَنزَلَ مِنَ ٱلسَّمَآءِ مَآءً فَأَخْرَجْنَا بِهِۦ نَبَاتَ كُلِّ شَىْءٍ
(“তিনি আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেন, অতঃপর আমরা তা দ্বারা সকল প্রকার উদ্ভিদ উৎপন্ন করি।”)
এখানে সৃষ্টিকর্তার প্রসঙ্গে একবচন নাম পুরুষ (هُوَ - তিনি) থেকে উত্তম পুরুষ বহুবচনে (نَحْنُ - আমরা) রূপান্তর ঘটেছে, যা ইলতিফাতের একটি পরিচিত উদাহরণ। প্রশ্ন উত্থাপিত হয়: এই আলঙ্কারিক কৌশলটি কি কেবল কুরআনের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য, নাকি এর শিকড় প্রাক-ইসলামি আরবি ভাষাতেই প্রোথিত ছিল? এই প্রবন্ধে জাহেলি যুগের কবিতা, প্রাচীন আরবি গদ্য এবং ধ্রুপদী আরবি ব্যাকরণবিদদের পর্যালোচনার ভিত্তিতে ইলতিফাতের ঐতিহাসিক অস্তিত্ব প্রমাণ করা হবে। পাশাপাশি, অন্যান্য বিশ্বসাহিত্যের অনুরূপ কৌশলগুলোর সঙ্গে এর তুলনামূলক আলোচনা উপস্থাপন করা হবে।

১. জাহেলি কবিতায় ইলতিফাতের প্রয়োগ:

প্রাক-ইসলামি যুগের আরব কবিরা তাদের রচনায় ইলতিফাত ব্যবহার করতেন মনোযোগ আকর্ষণ, আবেগ সঞ্চার বা বর্ণনায় নাটকীয়তা আনার জন্য। উল্লেখযোগ্য কিছু উদাহরণ:
(ক) ইমরুল কায়েস (امرؤ القيس):

তাঁর বিখ্যাত মু'আল্লাকার (معلقة) শুরুতে তিনি সঙ্গীদের সম্বোধন করে নিজের বেদনা প্রকাশ করেছেন:
قِفَا نَبْكِ مِنْ ذِكْرَى حَبِيبٍ وَمَنْزِلِ
بِسِقْطِ اللِّوَى بَيْنَ الدَّخُولِ فَحَوْمَلِ
“(হে আমার দুই সঙ্গী) দাঁড়াও, আমরা প্রিয়তম ও তার আবাসের স্মৃতিতে কাঁদি… সিক্ত বালুকার মাঝে, দাখুল ও হাওমালের সীমান্তে।”
ইলতিফাতের ধরন: এখানে দ্বিবচনে দ্বিতীয় পুরুষে আদেশসূচক ক্রিয়া “قِفَا” (তোমরা দুজন দাঁড়াও) থেকে উত্তম পুরুষ বহুবচনের ক্রিয়াপদ “نَبْكِ” (আমরা কাঁদি)-তে রূপান্তর ঘটেছে। কবি এখানে ব্যক্তিগত বেদনাকে সামষ্টিক অনুভূতির রূপ দিয়েছেন।
সূত্র: Diwan Imru’ al-Qais, Cairo: Dar al-Ma‘arif, 1958, p. 12.

(খ) আল-আশা (الأعشى):

অতিথিপরায়ণতা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন:
وَجَاؤُوا يَسْعَوْنَ إِلَى الضَّيْفِ يَبْتَغُونَ القِرَى
فَأَنَا أُطْعِمُهُمْ وَأَسْقِيهِمْ بِالمَاءِ
(“তারা অতিথির জন্য ছুটে এলো, আপ্যায়নের আশায়… আর আমি তাদের আহার ও পানীয় সরবরাহ করলাম।”)
ইলতিফাতের ধরন: এখানে নাম পুরুষ বহুবচন (هُمْ - তারা) থেকে উত্তম পুরুষ একবচনে (أنا - আমি) দৃষ্টিকোণ পরিবর্তিত হয়েছে, যা বক্তার ব্যক্তিগত সম্পৃক্ততা ও গর্বকে ফুটিয়ে তোলে।
সূত্র: Al-Asha’s Diwan, Beirut: Dar Sadir, 1964, p. 45.


২. ইসলাম-পূর্ব আরবি গদ্যে ইলতিফাত:
জাহেলি যুগের গদ্য সাহিত্যেও, বিশেষত খুতবা বা বক্তৃতায়, ইলতিফাতের ব্যবহার লক্ষ করা যায়।
(ক) কুস ইবনে সাইদা আল-ইয়াদি (خطبة قس بن ساعدة الأيادي):

 উকাজের মেলায় প্রদত্ত তাঁর বিখ্যাত খুতবায় তিনি বলেন:
أَيُّهَا النَّاسُ، اجْتَمِعُوا وَاسْمَعُوا وَعُوا!
إِنَّهُ مَنْ عَاشَ مَاتَ، وَمَنْ مَاتَ فَاتَ…
(“হে মানুষ! তোমরা একত্র হও, শোনো ও অনুধাবন করো! নিশ্চয়ই যে জীবিত আছে, সে মারা যাবে, আর যে মারা যায়, সে বিগত হয়…”)
ইলতিফাতের ধরন: এখানে সরাসরি শ্রোতাদের (দ্বিতীয় পুরুষ – الناس) সম্বোধন করার পর বাক্যটি নাম পুরুষে (তৃতীয় পুরুষ - مَنْ) পরিবর্তিত হয়েছে, যা বক্তব্যকে একটি সাধারণ সত্য বা নীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে।
সূত্র: Ibn Qutayba, ‘Uyun al-Akhbar, vol. 2, Cairo: Dar al-Kutub al-Misriyya, 1925, p. 167.

৩. প্রাচীন আরবি ব্যাকরণবিদদের স্বীকৃতি:

আরবি ভাষার প্রাচীন বৈয়াকরণ ও আলঙ্কারিকগণ ইলতিফাতকে একটি পরিচিত ও স্বীকৃত শৈলী হিসেবে গণ্য করেছেন।


(ক) সিবাওয়াইহ (سيبويه, মৃত্যু ৭৯৬ খ্রি.): আরবি ব্যাকরণের ইমাম হিসেবে পরিচিত সিবাওয়াইহ তাঁর কালজয়ী গ্রন্থ "আল-কিতাব"-এ সরাসরি "ইলতিফাত" শব্দটি ব্যবহার না করলেও দৃষ্টিকোণ পরিবর্তনের ধারণার প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি একে "কালামের পরিবর্তন" (تغير الكلام) হিসেবে উল্লেখ করে বলেন:
“وَإِنَّمَا يَتَغَيَّرُ الْكَلَامُ لِلتَّنْبِيهِ وَالتَّأْكِيدِ”
(“বক্তব্য পরিবর্তন করা হয় (শ্রোতার) মনোযোগ আকর্ষণ ও গুরুত্বারোপের জন্য।”)
সূত্র: Sibawayh, Al-Kitab, vol. 1, Bulaq Edition, 1898, p. 78.বিশ্লেষণ: সিবাওয়াইহের এই পর্যবেক্ষণ প্রমাণ করে যে, কুরআনের অলঙ্কার শাস্ত্র পূর্ণাঙ্গরূপে বিকশিত হওয়ার পূর্বেই আরবি ভাষায় এ ধরনের শৈলীগত পরিবর্তন স্বীকৃত ছিল।


(খ) আল-জাহিজ (الجاحظ, ৭৭৬–৮৬৮ খ্রি.): আরবি গদ্য ও অলঙ্কার শাস্ত্রের প্রখ্যাত পণ্ডিত আল-জাহিজ তাঁর "আল-বায়ান ওয়া আত-তাবয়িন" গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন:
“كَانَتِ الْعَرَبُ تَصْنَعُ ذَلِكَ فِي كَلَامِهَا لِلتَّوْسِيعِ وَالتَّفَنُّنِ وَالتَّأْكِيدِ”
(“আরবরা তাদের বক্তব্যে (অর্থের) ব্যপ্তি, শৈল্পিক বৈচিত্র্য ও গুরুত্বারোপের জন্য এরূপ (দৃষ্টিকোণ পরিবর্তন) করত।”)
সূত্র: Al-Jahiz, Al-Bayan wa al-Tabyin, vol. 1, Cairo: Maktaba al-Khanji, 1948, p. 203.
বিশ্লেষণ: আল-জাহিজ স্পষ্টভাবে আরবদের মধ্যে এই কৌশলের সচেতন ব্যবহার সম্পর্কে বলেছেন, যা এর প্রাচীনত্ব নির্দেশ করে।


৪. ইলতিফাতের প্রাচীনত্ব ও অলঙ্কারিক মর্যাদা প্রসঙ্গে:
কিছু মত প্রচলিত আছে যে, ইলতিফাত কুরআনের একটি উদ্ভাবিত শৈলী অথবা এটি কেবলই একটি ব্যাকরণিক অসঙ্গতি। এই ধারণাগুলো ঐতিহাসিক ও ভাষাতাত্ত্বিক প্রমাণের নিরিখে টেকে না।

(ক) দাবি: "ইলতিফাত কুরআনের জন্য উদ্ভাবিত":
খণ্ডন: পূর্ববর্তী আলোচনায় উপস্থাপিত ইমরুল কায়েস, আল-আশা এবং কুস ইবনে সাইদার উদাহরণ প্রমাণ করে যে, ইসলাম-পূর্ব যুগেই এই কৌশল আরবি সাহিত্যে প্রচলিত ছিল। সিবাওয়াইহ ও আল-জাহিজের মতো প্রাথমিক যুগের ভাষাবিদদের স্বীকৃতি এর প্রাচীনত্বকে আরও দৃঢ় করে। কুরআন এই বিদ্যমান শৈলীকে ব্যবহার করে এর শৈল্পিক সম্ভাবনাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত করেছে, কিন্তু এর উদ্ভাবক নয়।


(খ) দাবি: "এটি ব্যাকরণগত ত্রুটি":
খণ্ডন: ইলতিফাতকে ব্যাকরণগত ত্রুটি মনে করা অলঙ্কার শাস্ত্রের উদ্দেশ্য ও প্রয়োগ সম্পর্কে অজ্ঞতার পরিচায়ক। আল-জুরজানির (عبد القاهر الجرجاني, মৃত্যু ১০৭৮ খ্রি.) মতো পরবর্তী যুগের আলঙ্কারিকগণ তাঁদের "দালায়িল আল-ই‘জাজ"-এর মতো গ্রন্থে প্রমাণ করেছেন যে, ইলতিফাত একটি অত্যন্ত সচেতন ও উদ্দেশ্যমূলক আলঙ্কারিক পদ্ধতি। এটি অর্থের গভীরতা বৃদ্ধি, মনোযোগ আকর্ষণ এবং বক্তব্যের একঘেয়েমি দূর করার জন্য ব্যবহৃত হয়, যা ভাষার স্বাভাবিক বিচ্যুতি নয়, বরং শৈল্পিক উৎকর্ষ।


৫. আন্তঃভাষিক পর্যালোচনা: বিশ্বসাহিত্যে ইলতিফাত-সদৃশ কৌশল:
ইলতিফাতের মূলনীতি – অর্থাৎ দৃষ্টিকোণ পরিবর্তন – কেবল আরবি সাহিত্যের একচেটিয়া বৈশিষ্ট্য নয়। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় ও সাহিত্যে এর সমান্তরাল বা অনুরূপ আলঙ্কারিক কৌশল লক্ষ করা যায়। এটি প্রমাণ করে যে, যোগাযোগকে কার্যকর ও শৈল্পিক করার জন্য দৃষ্টিকোণ পরিবর্তন একটি সার্বজনীন ভাষিক প্রবণতা।

(ক) ইংরেজি সাহিত্য:
Apostrophe (সম্বোধন): বক্তা বা লেখক অনুপস্থিত ব্যক্তি, বিমূর্ত ধারণা বা জড় বস্তুকে সরাসরি সম্বোধন করেন। যেমন, শেক্সপিয়রের ম্যাকবেথ-এ লেডি ম্যাকবেথ বলেন: "Come, you spirits / That tend on mortal thoughts, unsex me here!" এখানে অনুপস্থিত 'spirits'-কে সরাসরি সম্বোধন করা হয়েছে, যা ইলতিফাতের সম্বোধন পরিবর্তনের (যেমন, পরোক্ষ বর্ণনা থেকে প্রত্যক্ষ সম্বোধন) অনুরূপ।
সূত্র: Lanham, R. A. (1991). A Handlist of Rhetorical Terms (2nd ed.). University of California Press, p. 20.
Free Indirect Speech/Discourse: বর্ণনায় তৃতীয় পুরুষ ও প্রথম পুরুষের দৃষ্টিকোণ বা বাচনের মিশ্রণ ঘটানো হয়, যেখানে চরিত্রের চিন্তা বা অনুভূতি বর্ণনাকারীর বয়ানে মিশে যায়। যেমন, জেন অস্টেনের প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস-এ এলিজাবেথের চিন্তার বর্ণনা: "Elizabeth wondered: could he really be so arrogant?" এটি কাল ও ব্যক্তির সূক্ষ্ম পরিবর্তনের মাধ্যমে চরিত্রেরの内জগতকে তুলে ধরে, যা ইলতিফাতের একটি ভিন্ন রূপ।
সূত্র: Cohn, D. (1978). Transparent Minds: Narrative Modes for Presenting Consciousness in Fiction. Princeton University Press.

(খ) লাতিন সাহিত্য:
Temporal Shift (কাল পরিবর্তন): বর্ণনার মধ্যে অতীত কাল থেকে বর্তমান কালে আকস্মিক রূপান্তর, যা ঘটনাকে জীবন্ত করে তোলে। যেমন, ওভিডের মেটামরফোসিস-এ দেখা যায়: "Dixit, et... (তিনি বললেন, এবং...)" এর পরেই হয়তো বর্তমান কালের ক্রিয়া ব্যবহৃত হয় ঘটনাকে তাৎক্ষণিক করার জন্য। এটি ইলতিফাতের কাল পরিবর্তনের (التفات في الزمن) ধারণার সাথে তুলনীয়।
সূত্র: Wheeler, S. M. (1999). A Discourse of Wonders: Audience and Performance in Ovid’s Metamorphoses. University of Pennsylvania Press.

(গ) সংস্কৃত সাহিত্য:
Ākhyāyikā (আখ্যায়িকা) ও বর্ণনাকারীর সম্বোধন: মহাকাব্য বা পুরাণে বর্ণনাকারী (যেমন, সূত বা ব্যাস) কখনও কখনও সরাসরি শ্রোতাদের সম্বোধন করেন। মহাভারত-এ প্রায়শই বর্ণনাকারী বলেন, "হে ভরতশ্রেষ্ঠ, শ্রবণ করুন..."। এটি বর্ণনার প্রথাগত তৃতীয় পুরুষ থেকে দ্বিতীয় পুরুষে স্থানান্তর, যা ইলতিফাতের একটি দিক।
সূত্র: Van Buitenen, J. A. B. (Trans. & Ed.). (1973). The Mahabharata, Volume 1: Book 1: The Book of the Beginning. University of Chicago Press.

(ঘ) ফার্সি সাহিত্য:
গায়েবি খিতাব (غیبی خطاب - অদৃশ্যকে সম্বোধন) বা দৃষ্টিকোণ পরিবর্তন: সুফি কবিতায়, বিশেষত রুমির মসনবি-তে, প্রায়শই আল্লাহ বা প্রেমাস্পদের প্রসঙ্গে নাম পুরুষ থেকে মধ্যম পুরুষে রূপান্তর দেখা যায়। যেমন: "او گفت... اکنون تو برخیز!" ("সে (হৃদয়) বলল... এখন তুমি জাগো!")। এটি ইলতিফাতের মতোই ভাব ও আবেগ প্রকাশের শক্তিশালী মাধ্যম।
সূত্র: Schimmel, A. (1993). The Triumphal Sun: A Study of the Works of Jalāloddin Rumi. SUNY Press.

(ঙ) জাপানি সাহিত্য:
বুনশো নো টেঙ্কো (文章の転向 - রচনার মোড় পরিবর্তন) / ন্যারেটিভ পার্সপেক্টিভ শিফট: আধুনিক জাপানি উপন্যাসে, বিশেষত হারুকি মুরাকামির কাজে, একই ঘটনা বা পরিস্থিতিকে একাধিক চরিত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে বর্ণনা করা হয়, যা পাঠকের উপলব্ধিকে বহুস্তরীয় করে তোলে। এটি ইলতিফাতের মতো দৃষ্টিকোণ পরিবর্তনের একটি বিস্তৃত রূপ।
সূত্র: Rubin, J. (2002). Haruki Murakami and the Music of Words. Vintage.

(চ) বাংলা সাহিত্য:
সম্বোধন ও বাচ্য পরিবর্তন: বাংলা কবিতায়, বিশেষত গীতি কবিতায়, কবি প্রায়শই ঈশ্বর, প্রিয়জন বা কোনো বিমূর্ত সত্তাকে সরাসরি সম্বোধন করেন, যা বর্ণনার স্বাভাবিক গতি পরিবর্তন করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতাঞ্জলি-তে এর অজস্র উদাহরণ রয়েছে: "তুমি কেমন করে গান কর যে গুণী, / আমি অবাক্‌ হয়ে শুনি কেবল শুনি।" এখানে 'তুমি' (ঈশ্বর) ও 'আমি' (কবি)-র মধ্যে সংলাপধর্মী রূপান্তর ঘটে। এছাড়া, বাচ্য পরিবর্তনও (কর্তৃবাচ্য থেকে কর্মবাচ্য বা ভাববাচ্য) দৃষ্টিকোণ পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে।
সূত্র: ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ। (১৯১০)। গীতাঞ্জলি।

৬. তুলনামূলক সারণী:
      

ভাষা/সাহিত্য   কৌশল ইলতিফাতের সাথে সাদৃশ্য
আরবি ইলতিফাত (التفات) ব্যক্তি (Person), বচন (Number), কাল (Tense), সম্বোধন (Address) পরিবর্তন
ইংরেজি  Apostrophe‌‌ সম্বোধনের আকস্মিক পরিবর্তন (ব্যক্তি/সত্তা)
ইংরেজি  Free Indirect Speech বর্ণনাকারী ও চরিত্রের দৃষ্টিকোণের মিশ্রণ (ব্যক্তি/স্বর)
লাতিন Temporal Shift কাল পরিবর্তন (অতীত থেকে বর্তমান)
সংস্কৃত   Ākhyāyikā Address বর্ণনাকারী কর্তৃক সরাসরি শ্রোতা সম্বোধন (ব্যক্তি পরিবর্তন)
ফার্সি   গায়েবি খিতাব  নাম পুরুষ থেকে মধ্যম পুরুষে রূপান্তর (ব্যক্তি পরিবর্তন)
জাপানি  বুনশো নো টেঙ্কো (文章の転向 - রচনার মোড় পরিবর্তন)  একাধিক চরিত্রের দৃষ্টিকোণ উপস্থাপন
বাংলা  সম্বোধন/বাচ্য পরিবর্তন  সরাসরি সম্বোধন, বাচ্যের মাধ্যমে দৃষ্টিকোণ পরিবর্তন‌

 

উপসংহার:
ঐতিহাসিক ও ভাষাতাত্ত্বিক প্রমাণ স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে যে, ইলতিফাত (التفات) পবিত্র কুরআন কর্তৃক উদ্ভাবিত কোনো নতুন শৈলী নয়, বরং এটি প্রাক-ইসলামি আরবি ভাষার গভীরে প্রোথিত একটি শক্তিশালী ও কার্যকর আলঙ্কারিক কৌশল। জাহেলি যুগের কবিতা, প্রাচীন গদ্য এবং সিবাওয়াইহ ও আল-জাহিজের মতো ধ্রুপদী ভাষাবিদদের পর্যবেক্ষণ এর প্রাচীনত্ব ও সচেতন ব্যবহারকে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে। কুরআন এই কৌশলটিকে ব্যবহার করে এর শৈল্পিক ও আধ্যাত্মিক ব্যঞ্জনা চূড়ান্ত মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে।
পাশাপাশি, বিশ্ব সাহিত্যের বিভিন্ন ভাষায় ইলতিফাত-সদৃশ কৌশলের উপস্থিতি প্রমাণ করে যে, দৃষ্টিকোণ পরিবর্তন একটি সার্বজনীন আলঙ্কারিক প্রবণতা। প্রতিটি ভাষার নিজস্ব ব্যাকরণ ও সংস্কৃতিতে এর প্রকাশ ভিন্ন হলেও, মূল উদ্দেশ্য এক—বক্তব্যকে প্রাণবন্ত, আকর্ষণীয়, আবেগময় ও বহুমাত্রিক করে তোলা। সুতরাং, ইলতিফাত কেবল আরবি অলঙ্কার শাস্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদানই নয়, এটি মানব ভাষার শৈল্পিক অভিব্যক্তির এক বিশ্বজনীন হাতিয়ারও বটে।