ইসলামের ইতিহাসে কিছু ভুল ও বিকৃত তথ্য প্রচলিত রয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম হলো আসমা বিনত মারওয়ানের হত্যার কাহিনি। এই বর্ণনাটি মূলত নির্ভরযোগ্য ইসলামিক স্কলারগণের গবেষণায় জাল (মাওযু) এবং বানোয়াট বলে প্রমাণিত হয়েছে। গবেষণালব্ধ বিশ্লেষণ অনুযায়ী, এই ঘটনার কোনো গ্রহণযোগ্য সূত্র নেই, বরং এটি দুর্বল ও অবিশ্বস্ত ব্যক্তিদের বর্ণনার ওপর ভিত্তি করে গঠিত একটি মিথ্যা কাহিনি।
প্রচলিত বর্ণনার বিশ্লেষণ:
কিছু বর্ণনায় বলা হয় যে নবী মুহাম্মাদ (ﷺ) এক নারী কবিকে হত্যা করার নির্দেশ দেন, যিনি ইসলামের বিরোধিতা করে কবিতা লিখতেন। এই বর্ণনা আল ক্বাদাঈ (মুসনাদুশ শিহাব: ৮৫৬), আল খতিব আল বাগদাদি (তারিখ বাগদাদ: ১৩/৯৯), ইবন আসাকির (তারিখ দামিশক: ৫১/২৪৪) এবং ইবন উমার আল হারবি (ফাওয়াইদ: ৫০)–এর মতো সংকলনে পাওয়া যায়। তবে এই বর্ণনার সনদ (বর্ণনার শৃঙ্খল) পরীক্ষা করলে দেখা যায়, এটি সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য এবং জাল।
প্রচলিত বর্ণনার সনদের বিশ্লেষণ:
প্রথম বর্ণনার সনদ:
العربية: مُحَمَّد بْنُ حَجَّاجٍ الْلَخْمِي أَبُو إِبْرَاهِيمَ الْوَاسِطِي → مُجَالِد بْنُ سَعِيدٍ → الشَّعْبِي → ابن عباس (رضي الله عنه)
বাংলা: মুহাম্মাদ ইবন হাজ্জাজ আল লাখমী আবু ইব্রাহিম আল ওয়াসিতি → মুজালিদ ইবন সাঈদ → আশ শাবি → ইবন আব্বাস (রা.)।
এই বর্ণনায় মুহাম্মাদ ইবন হাজ্জাজ প্রধান বর্ণনাকারী, যাকে প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিসগণ জালিয়াত ও মিথ্যাবাদী বলেছেন:
• ইমাম বুখারী (رَحِمَهُ ٱللَّٰهُ) – "هو منكر الحديث" (সে মুনকারুল হাদিস, অর্থাৎ তার বর্ণিত হাদিস পরিত্যাজ্য)। (মিযানুল ই’তিদাল: ৩/৫০৯)
• ইবন মাঈন (رَحِمَهُ ٱللَّٰهُ) – "كذاب خبيث" (সে একজন মিথ্যাবাদী এবং নরাধম)।
• দারাকুতনী (رَحِمَهُ ٱللَّٰهُ) – "كذاب" (মিথ্যাবাদী)।
• ইবন ‘আদি (رَحِمَهُ ٱللَّٰهُ) – "هذا الحديث وضعه محمد بن الحجاج" (এই হাদিসটি মুহাম্মাদ ইবন হাজ্জাজ জাল করেছে)। (আল মাওযুআত: ৩/১৮)
দ্বিতীয় বর্ণনার সনদ:
العربية: مُحَمَّد بْنُ عُمَر الْوَاقِدِي → عَبْدُ اللَّهِ بْنُ حَارِثٍ → أَبُوهُ
বাংলা: মুহাম্মাদ ইবন উমার আল ওয়াকিদি → আবদুল্লাহ ইবন হারিস → তার পিতা।
এই বর্ণনার প্রধান বর্ণনাকারী ওয়াকিদি, যিনি প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিসদের দৃষ্টিতে অবিশ্বস্ত:
• ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল (رَحِمَهُ ٱللَّٰهُ) – "هو كذاب، يغير الحديث" (সে একজন মিথ্যাবাদী, সে হাদিস পরিবর্তন করে)।
• ইবন মাঈন (رَحِمَهُ ٱللَّٰهُ) – "ليس بثقة ولا مأمون" (সে বিশ্বস্ত নয় এবং তার বর্ণনা গ্রহণযোগ্য নয়)।
• ইমাম বুখারী (رَحِمَهُ ٱللَّٰهُ) – "متروك الحديث" (সে মাতরুক, তার বর্ণনা গ্রহণযোগ্য নয়)।
• আবু হাতিম ও নাসাঈ (رَحِمَهُ ٱللَّٰهُ) – "يضع الحديث" (সে হাদিস জাল করে)।
(তথ্যসূত্র: মিযানুল ই’তিদাল: ৩/৬৬৩, তাহযিব আত তাহযিব: ৯/১৬৩)
উপর্যুক্ত বিশ্লেষণ থেকে স্পষ্ট হয় যে, আসমা বিনত মারওয়ানের হত্যার কাহিনি একটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এবং জাল রচনা। এই ঘটনা বিশ্বাসযোগ্য কোনো ইসলামিক গ্রন্থে বা নির্ভরযোগ্য কোনো মুহাদ্দিসের সনদে নেই। বরং এটি মূলত ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক প্রচারণার অংশ হিসেবে সময়ের সাথে সাথে প্রচারিত হয়েছে।
অতএব, ইসলাম ও নবী মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর ইতিহাস সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অর্জনের জন্য নির্ভরযোগ্য ও স্বীকৃত ইসলামিক গ্রন্থ ও স্কলারদের ব্যাখ্যার দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত।
তথ্যসূত্র:
• ইমাম বুখারী, মিযানুল ই’তিদাল, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ৫০৯
• ইবন মাঈন, আল জারহ ওয়াত তাদীল
• ইমাম দারাকুতনী, আল ইলাল
• ইবনুল জাওযী, আল মাওযুআত, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ১৮
• শায়খ আলবানী, সিলসিলা আদ-দ্বইফাহ, হাদিস ৬০১৩
• ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল, আল ইলাল
• ইবন আসাকির, তারিখ দামিশক, খণ্ড ৫১, পৃষ্ঠা ২৪৪
• ইবন হিববান, আল মাজরুহিন, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ২৬৯
• আল ক্বাদাঈ, মুসনাদুশ শিহাব, হাদিস ৮৫৬
©আবদুল্লাহ আল আসিফ
-০২/১১/২০১৬