◾নবী মুহাম্মদﷺ তার ৬৩ বছরের জীবনে মোট ১১টি বিবাহ করেন। রাসূলﷺ এর ১১ জন স্ত্রী-দের মধ্যে দশ জনই ছিলেন হয় বিধবা না হয় তালাক প্রাপ্তা। যথাক্রমে,
- খাদিজা ﷻ
- সওদা বিনতে জামআ ﷻ
- আয়েশা বিনতে আবু বকর ﷻ
- হাফসা বিনতে ওমর ﷻ
- যয়নব বিনতে খোযায়মা ﷻ
- উম্মে সালমা হিন্দ বিনতে আবু উমাইয়া ﷻ
- যয়নব বিনতে জাহাশ ইবনে রিয়াব ﷻ
- যুয়াইরিয়া বিনতে হারেস ﷻ
- উম্মে হাবিবা বিনতে আবু সুফিয়ান ﷻ
- সাফিয়া বিনতে হুয়াই ﷻ
- মায়মুনা বিনতে হারেস ﷻ
খাদিজা ﷻ : মদিনায় হিজরতের আগে একবারে শুরুর দিকে মুহাম্মদﷺ যখন মক্কায় জীবন-যাপন করতেন, তখন তিনি খাদিজাﷻ কে বিবাহ করেন। এই বিয়ের সময় মুহাম্মদﷺ এর বয়স ছিলো ২৫ বছর ও খাদিজাﷻ এর বয়স ছিলো ৪০ বছর। রাসূলﷺ খাদিজাﷻ এর ব্যবসা দেখভাল করার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। খাদিজাﷻ সিরিয়ায় ব্যবসার কাজে মুহাম্মদﷺ কে দায়িত্ব দেন৷ রাসূলﷺ এর সাথে খাদিজাﷻ তার একজন দাসীকেও পাঠিয়ে দেন৷ ব্যবসার কাজ শেষ করে সিরিয়া থেকে ফেরার পর সেই দাসী রাসূলﷺ এর সততা তার আখলাক-তার মহৎগুণ সম্পর্কে খাদিজাﷻ কে অবহিত করেন। খাদিজাﷻ রাসূলﷺ এর সততা ও তার মহৎ চরিত্রের জন্য তাকে-কে বিবাহের প্রস্তাব দেন। তিনি তখনও নবুয়াত লাভ করেনি। এটা নবুয়াত লাভের আগের ঘটনা। খাদিজাﷻ মুহাম্মদﷺ বিবাহের প্রস্তাব দেয়ার জন্য তার বান্ধবী নাফিসা বিনতে মনব্বিহরকে পাঠান। রাসূলﷺ সেই প্রস্তাবে রাজি হন। খাদিজাﷻ এর স্বামী ইন্তেকালের পর অনেকেই তাকে বিবাহের জন্য প্রস্তাব দেন। কিন্তু কারো প্রস্তাবেই তিনি রাজি হননি। অবশেষে খাদিজাﷻ ৪০ বছর বয়সে রাসূল-কে বিবাহ করার প্রস্তাব পাঠান। রাসূলﷺ তার চাচার সাথে পরামর্শ করেন। তার চাচা খাদিজাﷻ এর চাচার সাথে আলোচনা করে বিয়ের পয়গাম পাঠান। এরপর বিয়ে হয়ে যায়। এ বিয়েতে বনি হাশেম এবং মুজার গোত্রের নেতৃস্তানীয় ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। সিরিয়া থেকে বাণিজ্য করে ফিরে আসার প্রায় ২ মাস পর এই বিবাহ হয়৷ খাদিজাﷻ ছিলেন রাসূলﷺ এর প্রথম স্ত্রী। রাসূলﷺ এর পুত্র ইব্রাহিম ব্যতীত সবাইই ছিলেন খাদিজাﷻ এর গর্ভজাত সন্তান৷
সাওদা বিনতে জামআ ﷻ : রাসূলﷺ এর নবুওয়াত লাভের পর খাদিজাﷻ ইন্তেকাল করেন। উনার ইন্তেকালের পরে রাসূলﷺ সাওদা বিনতে জামআﷻ কে বিবাহ করেন। সাওদাﷻ তার চাচাতো ভাই সাকরান ইবনে আমরের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। সাওদাﷻ এর স্বামী সাকরান ইন্তেকার করেন। অতপর বিধবা সাওদাﷻ এর সাথে নবুওয়াতের দশম বছরের শাওয়াল মাসে দুই পরিবারের সম্মতিতে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। সাওদাﷻ এর বিবাহের সময় তার বয়স ছিলো তখন ৬৫ বছর। এই বিবাহের মাধ্যমে রাসূলﷺ উনার দায়িত্ব নেন।
আয়েশা ﷻ : নবুওয়াতের একাদশ বছরের শাওয়াল মাসে আয়েশাﷻ এর সাথে রাসূল ﷺ এর বিবাহ হয়৷ সাওদাﷻ এর সাথে নবিজির বিবাহের ১ বছর পর এই বিবাহ হয়৷ বিবাহের সময় আয়েশাﷻ এর বয়স ছিলো মাত্র ৬ বছর। শাওয়াল মাসের প্রথম তারিখে আয়েশাﷻ ৯ বছর বয়সে রাসূল ﷺ এর বাড়িতে স্ত্রী হিসেবে পা রাখেন। রাসূল ﷺ ১১ জন্য স্ত্রীর মধ্যে একমাত্র আয়েশাﷻ ছিলেন কুমারী। বাকি সবাই হয় ছিলেন তালাকপ্রাপ্তা না হয় বিধবা। উম্মতে মুহাম্মদীর মধ্যে মহিলাদের মাঝে মা আয়েশাﷻ ছিলেন সর্বাধিক জ্ঞানসম্পূর্ণ মহিলা। ৬ বছর বয়সে আয়েশাﷻ এর সাথে রাসূলﷺ এর বিবাহ হলেও তিনি তখনই নবিজিﷺ এর ঘরে স্ত্রী হিসেবে যাননি। বরং যখন আয়েশাﷻ এর বয়স ৯ বছর হয়; তখন তিনি নবিজিﷺ এর ঘরে স্ত্রী হিসেবে প্রবেশ করেন। এই বিবাহ আয়েশাﷻ এর অনুমতিতে দুই পরিবারের সম্মতিতে সম্পূর্ণ হয়৷ এ ছাড়াও এই বিবাহ রাসূলﷺ আল্লাহ তাআলার আদেশে করেছেন। আল্লাহ তায়ালা রাসূলﷺ-কে এই বিবাহ করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। [সহী বুখারী হাদিস ৩৮৯৫]
হাফসা বিনতে ওমর ﷻ : হাফসাﷻ ছিলেন ইসলামের অন্যতম খলিফা উমরﷻ এর কন্যা। হাফসাﷻ এর প্রথম স্বামী ছিলেন খুনায়েস ইবনে হাযাফা সাহমিﷻ৷ বদর ও ওহুদ যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে হাফসাﷻ এর স্বামী ইন্তেকাল করেন। উমরﷻ মেয়ের বিবাহ নিয়ে চিন্তায় পড়ে যান। তিনি প্রথমে আবু বকর; অতঃপর উসমানﷻ-কে বিবাহে প্রস্তাব দেন। কিন্তু তারা উভয়ই ওজর পেশ করে এবং রাজি হয়নি; এতে উমর রা. খুবই ব্যতীত হন। অবশেষে বিধবা হাফসাﷻ-কে তখন নবিজিﷺ বিবাহ করেন। হাফসাﷻ এর অনুমতিতে দুই পরিবারের সম্মতিতে এই বিবাহ সম্পূর্ণ হয়। পরে হিজরী ২য় বা ৩য় হিজরি সালে নবিজি তাকে বিবাহ করেন৷ নবিজিﷺ এর সাথে বিবাহ হওয়ায় উমর রা: তখন খুব খুশি হন।
যয়নব বিনতে খুযায়মা ﷻ : তিনি ছিলেন খুবই দরদী একজন মহিলা। পর-পর দুই স্বামীর ইন্তেকালের পর তিনি বিয়ে করেন রাসূলﷺ-এর ফুফাতো ভাই আব্দুল্লাহ বিন জাহশﷻ-কে। তিনিও উহুদ যুদ্ধে প্রাণ হারালে নবিজি তাঁকে বিবাহ করেন। রাসূলﷺ ছিলেন তাঁর চতুর্থ স্বামী। রাসূলﷺ উনাকে হিজরতের একত্রিশ মাস পরে ৩য় হিজরীর রমজান মাসে বিবাহ করেন। মাত্র আটমাস তার বিবাহাধীনে থেকে বিয়ের পরবর্তী বৎসরেই ৪র্থ হিজরীর রবিউস সানি মাসে তার মৃত্যু হয়। শুধুমাত্র তিনি এবং খাদিজাﷻ; এই দুজনই রাসূলﷺ এর জীবদ্দশায় মারা যান। বিভিন্ন বর্ণনামতে, তিনি অত্যন্ত দানশীল মহিলা ছিলেন ইসলাম-পূর্ব যুগেও। একারণে তাকে উন্মুল মাসাকীন (গরিবের মা) বলে ডাকা হতো।
উম্মে সালমা হিন্দ বিনতে উমাইয়া ﷻ : তিনি ছিলেন আবু সালমাﷻ এর স্ত্রী। ৪র্থ হিজরির জামাদিউস সানিতে তার স্বামী যুদ্ধে শহিদ হন। শহিদ হওয়া অবস্থায় রেখে যান দুই ছেলে ও দুই মেয়েকে। দুই ছেলে ও দুই মেয়ে থাকা অবস্থায়ও রাসূলﷺ তাকে বিবাহ করে সবার দায়িত্ব নিজ কাঁধে নেন।
যয়নব বিনতে জাহাশ ﷻ : এই বিয়ের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা সমাজ থেকে একটি কুসংস্কার দূর করেন। যয়নবﷻ: প্রথমে যায়েদ ইবনে হারেসাﷻ কে বিবাহ করেন। কিন্তু তাদের দাম্পত্য জীবনে বনিবনা না হওয়াই যায়েদﷻ তাকে তালাক দেন। যয়নবﷻ এর ইদ্দত শেষ হওয়ার পর স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা সূরা আহযাব আয়াত ৩৭ এ রাসূলﷺ-কে বিবাহ করার আদেশ দেন।
وَإِذْ تَقُولُ لِلَّذِي أَنْعَمَ اللَّهُ عَلَيْهِ وَأَنْعَمْتَ عَلَيْهِ أَمْسِكْ عَلَيْكَ زَوْجَكَ وَاتَّقِ اللَّهَ وَتُخْفِي فِي نَفْسِكَ مَا اللَّهُ مُبْدِيهِ وَتَخْشَى النَّاسَ وَاللَّهُ أَحَقُّ أَنْ تَخْشَاهُ ۖ فَلَمَّا قَضَىٰ زَيْدٌ مِنْهَا وَطَرًا زَوَّجْنَاكَهَا لِكَيْ لَا يَكُونَ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ حَرَجٌ فِي أَزْوَاجِ أَدْعِيَائِهِمْ إِذَا قَضَوْا مِنْهُنَّ وَطَرًا ۚ وَكَانَ أَمْرُ اللَّهِ مَفْعُولًاআল্লাহ যাকে অনুগ্রহ করেছেন; আপনিও যাকে অনুগ্রহ করেছেন; তাকে যখন আপনি বলেছিলেন, তোমার স্ত্রীকে তোমার কাছেই থাকতে দাও এবং আল্লাহকে ভয় কর। আপনি অন্তরে এমন বিষয় গোপন করছিলেন, যা আল্লাহ প্রকাশ করে দেবেন আপনি লোক-নিন্দার ভয় করেছিলেন অথচ আল্লাহকেই অধিক ভয় করা উচিত। অতঃপর যায়েদ যখন যয়নবের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করল, তখন আমি তাকে আপনার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করলাম যাতে মুমিনদের পোষ্যপুত্ররা তাদের স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলে সেসব স্ত্রীকে বিবাহ করার ব্যাপারে মুমিনদের কোন অসুবিধা না থাকে। আল্লাহর নির্দেশ কার্যে পরিণত হয়েই থাকে। (সূরা: আল আহযাব, আয়াত: ৩৭)
مَا كَانَ عَلَى النَّبِيِّ مِنْ حَرَجٍ فِيمَا فَرَضَ اللَّهُ لَهُ ۖ سُنَّةَ اللَّهِ فِي الَّذِينَ خَلَوْا مِنْ قَبْلُ ۚ وَكَانَ أَمْرُ اللَّهِ قَدَرًا مَقْدُورًاআল্লাহ নবীর জন্যে যা নির্ধারণ করেন, তাতে তাঁর কোন বাধা নেই পূর্ববর্তী নবীগণের ক্ষেত্রে এটাই ছিল আল্লাহর চিরাচরিত বিধান। আল্লাহর আদেশ নির্ধারিত, অবধারিত। (সূরা: আল আহযাব, আয়াত: ৩৮)
مَا كَانَ مُحَمَّدٌ أَبَا أَحَدٍ مِنْ رِجَالِكُمْ وَلَٰكِنْ رَسُولَ اللَّهِ وَخَاتَمَ النَّبِيِّينَ ۗ وَكَانَ اللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمًاমুহাম্মদ তোমাদের কোন ব্যক্তির পিতা নন; বরং তিনি আল্লাহর রাসূল এবং শেষ নবী। আল্লাহ সব বিষয়ে জ্ঞাত। (সূরা: আল আহযাব, আয়াত: ৪০)
ইদ্দত শেষ হওয়ার পর আল্লাহর রাসূল উনাকে ৫ম হিজরির জিলকদ মাসে অথবা এর আরো আগে বিবাহ করেন।
একটি কুসংস্কার দূর : ইসলামে পালক পুত্র বলে কোন পুত্র নেই৷ যায়েদﷻ কে আরববাসী রাসূলﷺ এর পালক পুত্র বলে জানতো। আরব সমাজে এ কুসংস্কার যুগ-যুগ ধরে চলে আসছিলো। নিয়ম ছিলো যে,পালকপুত্র হিসেবে কাউকে গ্রহণ করলে সে আসল পুত্রের মর্যাদা ও অধিকার ভোগ করবে। এ নিয়ম আরব সমাজে ভয়াবহ আকারে বিস্তার লাভ করেছিলো। এই কুসংস্কার বিলুপ্ত করা খুবই কঠিন ছিলো। অথচ এ নিয়মে ইসলামের বিয়ে, তালাক, সম্পত্তি-আইন এবং অন্যান্য বিষয়ের সাথে ছিলো মারাত্মকভাবে সংঘাতপূর্ণ। এ ছাড়াও জাহেলি যুগে এ কুসংস্কার এমন সব নির্লজ্জ কার্যকলাপ এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছিলো যে, সেসব থেকে সমাজকে মুক্ত করা ছিলো ইসলামের অন্যতম দায়িত্ব। জাহেলি যুগের এ কুসংস্কার দূর করতে আল্লাহ তায়ালা যায়েদ ﷻ এর তালাক প্রাপ্তা স্ত্রী যয়নবﷻ কে বিবাহ করতে নবিজি-কে আদেশ দেন। অতপর রাসূলﷺ যয়নবﷻ কে বিবাহ করেন। কারণ ইসলামে পালক পুত্র বলে কোন কিছু নেই।
مُحَمَّدُ بْنُ بَشَّارٍ حَدَّثَنَا غُنْدَرٌ حَدَّثَنَا شُعْبَةُ عَنْ عَاصِمٍ قَالَ سَمِعْتُ أَبَا عُثْمَانَ قَالَ سَمِعْتُ سَعْدًا وَهُوَ أَوَّلُ مَنْ رَمَى بِسَهْمٍ فِيْ سَبِيْلِ اللهِ وَأَبَا بَكْرَةَ وَكَانَ تَسَوَّرَ حِصْنَ الطَّائِفِ فِيْ أُنَاسٍ فَجَاءَ إِلَى النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَا سَمِعْنَا النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم يَقُوْلُ مَنْ ادَّعَى إِلَى غَيْرِ أَبِيْهِ وَهُوَ يَعْلَمُ فَالْجَنَّةُ عَلَيْهِ حَرَامٌ.وَقَالَ هِشَامٌ وَأَخْبَرَنَا مَعْمَرٌ عَنْ عَاصِمٍ عَن أَبِي الْعَالِيَةِ أَوْ أَبِيْ عُثْمَانَ النَّهْدِيِّ قَالَ سَمِعْتُ سَعْدًا وَأَبَا بَكْرَةَ عَنْ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ عَاصِمٌ قُلْتُ لَقَدْ شَهِدَ عِنْدَكَ رَجُلَانِ حَسْبُكَ بِهِمَا قَالَ أَجَلْ أَمَّا أَحَدُهُمَا فَأَوَّلُ مَنْ رَمَى بِسَهْمٍ فِيْ سَبِيْلِ اللهِ وَأَمَّا الْآخَرُ فَنَزَلَ إِلَى النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم ثَالِثَ ثَلَاثَةٍ وَعِشْرِيْنَ مِنْ الطَّائِفِ.আমরা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শুনেছি, তিনি বলেছেন, যে ব্যক্তি জেনে শুনে অন্যকে নিজের পিতা বলে দাবী করে, তার জন্য জান্নাত হারাম।[৬৭৬৬, ৬৭৬৭] (আধুনিক প্রকাশনীঃ ৩৯৮৪, ইসলামী ফাউন্ডেশনঃ ৩৯৮৮) সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৪৩২৬। হাদিসের মান: সহিহ হাদিস
مَا كَانَ مُحَمَّدٌ أَبَا أَحَدٍ مِنْ رِجَالِكُمْ وَلَٰكِنْ رَسُولَ اللَّهِ وَخَاتَمَ النَّبِيِّينَ ۗ وَكَانَ اللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمًاমুহাম্মদ তোমাদের কোন ব্যক্তির পিতা নন; বরং তিনি আল্লাহর রাসূল এবং শেষ নবী। আল্লাহ সব বিষয়ে জ্ঞাত। (সূরা: আল আহযাব, আয়াত: ৪০)
তাই আল্লাহ তায়ালা যয়নবﷻ এর সাথে রাসূলﷺ এর বিয়ে দিয়ে এই কুসংস্কার দূর করেন। যয়নবﷻ অত্যন্ত দানশীলা ছিলেন বলে খ্যতিমান ছিলেন। ২০ হিজরিতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
তার পিতা ছিলেন খোযআ গোত্রের শাখা বনু মুস্তালিকের সর্দার। বন্দু মুস্তালিকের যুদ্ধবন্দীদের সাথে যুয়াইরিয়াﷻ-কে হাজির করা হয়। তিনি শাবেত ইবনে কয়েস ইবনে শাম্মাস ﷻ এর ভাগে পড়েন। বন্দী অবস্থাতেই, যুয়াইরিয়াﷻ রাসূলﷺ এর কাছে গিয়ে অনুরোধ করেন, গোত্রপ্রধানের কন্যা হিসেবে তাকে যেন মুক্তি দেয়া হয়, রাসূলﷺ তার এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। অতঃপর, তার বাবা তাকে মুক্ত করতে নবিজির কাছে মুক্তিপণ দেয়ার প্রস্তাব করলেন, কিন্তু তিনি উক্ত প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করলেন। এরপর রাসূলﷺ যুয়াইরিয়াﷻ বিয়ের প্রস্তাব দিলেন এবং যুয়াইরিয়াﷻ এতে রাজি হলেন। রাসূলﷺ অর্থ প্রদান করে যুয়াইরিয়াﷻ কে মুক্ত করে বিবাহ করেন। এ বিবাহের গুরুত্ব ছিলো ব্যাপক। এটি ৫ম হিজরির শাবান মাসের ঘটনা। যুয়াইরিয়াﷻ কে বিবাহের ফলে সাহাবারা উক্ত গোত্রের ১০০ জনকে বিনা-শর্তে মুক্তি দেন। সাহাবারা বলেছিলেন এরা তো রাসূলﷺ এর শ্বশুর পক্ষের লোক, কাজেই তাদের মুক্ত করা দেয়া উচিত বলে মনে করে; সাহাবারা তাদের একে-একে সবাইকে মুক্ত করে দেন৷ দুই গোত্রের জন্য এই বিবাহ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিলো।
উম্মে হাবিবা বিনতে আবু সুফিয়ান ﷻ : তিনি ছিলেন উবায়দুল্লাহ ইবনে জাহাশের স্ত্রী। তিনি স্বামীর সাথে হিজরত করে হাবশা অর্থাৎ আবিসিনিয়া গমন করেন। সেখানে যাওয়ার পর উবায়দুল্লাহ ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেন। পরে সেখানে তার মৃত্যু হয়। কিন্তু উম্মে হাবিবাﷻ ইসলাম ধর্ম বিশ্বাসে ছিলেন অটল। পিতা আবু সুফিয়ানের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তিনি মুসলিম হয়েছিলেন। ৭ম হিজরির মুহররম মাসে রাসূলﷺ আমর ইবনে উমাইয়া জামিরিকে একটি চিঠি সহ আবিসিনিয়ার বাদশাহ নাজ্জাশির কাছে পেরণ করেন। সে চিঠিতে রাসূলﷺ উম্মে হাবিবাﷻ কে বিয়ে করার ইচ্ছা ব্যক্ত করলে; তিনি অতন্ত আনন্দের সাথে রাজি হন। বিয়ের প্রস্তাবে তিনি প্রচণ্ড খুশী হন। এতোটাই খুশি হন যে, বাদশাহ নাজ্জাশির যে দূত বিয়ের সংবাদ নিয়ে গিয়েছিল তার কাছে, তিনি সেই দূতকে পুরস্কার দিয়েছিলেন। উম্মে হাবিবাﷻ নবিজি-কে খুবই সম্মান ও শ্রদ্ধা করতেন। নাজ্জাশি শরহাবিল ইবনে হাসানার সাথে তাকে রাসূলﷺ এর কাছে পেরণ করেন। এই বিবাহের সময় আবু সুফিয়ান তখনো মুসলিম হয়নি। আবু সুফিয়ান তখন ছিলো ইসলামের ঘোর শত্রু। এই বিবাহ তখন অনেক বড় একটি প্রভাব ফেলেছিল। আবু সুফিয়ান মদিনায় যাওয়া পর তখন ভয়ে উম্মে হাবিবাﷻ এর ঘরে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
সাফিয়া বিনতে হুয়াই ﷻ : তিনি ছিলেন বনি ইসরাঈল সম্প্রাদায়ের মহিলা। তিনি খায়বর যুদ্ধে বন্দী হন। রাসূলﷺ তাকে বিবাহের প্রস্তাব দিলে তিনি রাজি হন। তখন নবিজি তাকে মুক্ত করে বিবাহ করেন। ৭ম হিজরিতে খাইবার বিজয়ের পর এই ঘটনা ঘটে। খন্দকের যুদ্ধে সাফিয়াﷻ এর পিতা নিহত হন। তার প্রথম স্বামীর নাম সাল্লাম ইবনে মিশকাম। তার কাছ থেকে তালাকপ্রাপ্ত হয়ে তিনি বনু নাদিরের সেনাপতি কেনানা ইবনে রাবিকে বিয়ে করেন। খাইবার যুদ্ধে বনু নাদির গোত্র পরাজিত হলে কেনানাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় এবং সাফিয়াﷻ কে যুদ্ধবন্দীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। নবিজিﷺ তাকে তার মালিক দিহইয়া এর কাছ থেকে মুক্ত করেন এবং তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। সাফিয়াﷻ নবিজির প্রস্তাব গ্রহণ করেন ও বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
তিনবা বিনতে হারেসের বোন। ৭ম হিজরির যিলকদ মাসে ওমরায়ে কাযা শেষ হওয়ার পর এবং সঠিক তথ্য অনুযায়ী ইহরাম থেকে হালাল হওয়ার পর প্রিয় নবিজিﷺ তাকে বিয়ে করেন। মায়মুনাﷻ প্রথমে মাসউদ ইবনে আমরকে বিয়ে করেন এবং তালাকপ্রাপ্তা হন। পরে, তিনি আবু রাহেমকে বিয়ে করেন এবং এ স্বামী মারা যায়। ফলে, তিনি বিধবা এবং তালাকপ্রাপ্তা হন। অতপর নবিজিﷺ কে তিনি বিবাহের প্রস্তাব দেন, এতে রাসূলﷺ রাজি হন এবং তাকে বিবাহ করেন।
পর্যালোচনা: প্রিয় পাঠক বর্বর-মূর্খ নাস্তিকরা রাসূলﷺ এর বহু বিবাহ্ নিয়ে যেসব প্রোপাগাণ্ডা চালায়; তা অতন্ত ঘৃণ্য ও নিন্দনীয় মিথ্যাচার। রাসূলﷺ এর উপর এসব মিথ্যা অপবাদ ও মিথ্যাাচার ছাড়া বৈ কিছু নয়। নবিজিﷺ এর ১১ জন স্ত্রীদের মধ্যে দশজনই ছিলেন হয় বিধবা; না হয় তালাক প্রাপ্তা। এখানে আমরা রাসূলﷺ এর জীবনে একটি বিশেষ দিক সম্পর্কে আলোকপাত করা খুবই প্রয়োজন মনে করছি। যৌবনের এক বিরাট অংশ অর্থাৎ প্রায় ৩০ বছরকাল নবিজিﷺ মাত্র একজন স্ত্রীর সাথে অতিবাহিত করেন অথাৎ খাদিজাﷻ-এর সাথে। ১১টি বিয়ের ১০টি বিয়েই রাসূলﷺ তার ৫০ বছর অতিক্রম হওয়ার পরে করেন। খাদিজাﷻ এর মৃত্যুর সময় নবিজিﷺ এর বয়স ছিলো ৫০ এর উপরে৷ বাকি ১০ বিয়েই তিনি তার ৫০ বছরের পরে করেন। ৩০ বছর তিনি একজন মহিলার সাথে কাটিয়ে দেন। খাদিজাﷻ এর মৃতুর পর নবিজিﷺ সাওদা রাঃ কে বিবাহ করেন। যাকে তখন বলা হতো বৃদ্ধা। প্রথমে খাদিজাﷻ ও এরপর সাওদাﷻ। নবিজিﷺ এভাবে জীবন কাটানোর পর বার্ধক্যে উপনীত হওয়ার পর তিনি পরবর্তী বিবাহগুলো বিভিন্ন কারণ ও পরিস্থিতি মোকাবেলায় করেন।
রাসূলﷺ এর বৈবাহিক জীবনের দিকে দৃষ্টিপাত করলে জ্ঞান-সম্পূর্ণ যেকোন মানুষই এমন অপবাদ দিতে পারবে না। রাসূলﷺ বিশেষ-বিশেষ কারণের প্রেক্ষিতে এই বিবাহ গুলো করেছিলেন। সাধারণ বিয়ের নিদিষ্ট সংখ্যার উদ্দেশ্যের চাইতে রাসূলﷺ এর উদ্দেশ্য ছিলো অনেক মহৎ। আরবের নিয়ম ছিলো যে, তারা আত্মীয়তার সম্পর্ককে বিশেষ গুরুত্ব দিতো৷ জামাতা সম্পর্ক আরবদের দৃষ্টিতে বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে সম্পর্ক সুদৃঢ় করার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। জামাতার গোত্রের সাথে যুদ্ধা করাকে আরবরা বিষণ-লজ্জার চোখে দেখতো। এ নিয়মের কারণে নবিজিﷺ বিভিন্ন গোত্রের ইসলামের প্রতি শত্রুতার শক্তি খর্ব করতে বিভিন্ন গোত্রের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। নবিজিﷺ যাদের বিবাহ করেন তাদের বেশীর ভাগই ছিলো গোত্র প্রধানের কন্যা। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, উম্মে সালমাﷻ ছিলেন বনু মাখযুম গোত্রের অধিবাসী। এ গোত্রের অধিবাসী ছিলো ইসলামের অন্যতম শত্রু আবু জাহেল। এ গোত্রে রাসূলﷺ সম্পর্ক স্থাপনের পর খালিদ বিন ওয়ালিদের মধ্যে আর তেমন শত্রুতা দেখা যায়নি। পরে খালিদ বিন ওয়ালিদ স্বেচ্ছায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। একই ভাবে রাসূলﷺ আবু সুফিয়ানের কন্যা উম্মে হাবিবাﷻ কে বিবাহ করেন। এ বিবাহের ফলে আবু সুফিয়ান ইসলামের শত্রুতা করলেও কখনো রাসূলﷺ এর চোখের সামনে লজ্জায় যায়নি। যুয়াইরিয়াﷻ ও সাফিয়াﷻ কে বিবাহের ফলে বনু মুস্তালেক এবং বনু নাযির গোত্র ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ছেড়ে দেয়। এ দুটি গোত্রে রাসূলﷺ বিবাহের পর তারা কখনো ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার চেষ্টা করেনি। এছাড়াও যুহাইরিয়াﷻ তো তার গোত্রের মধ্যে সকল মহিলার চেয়ে অধিক কল্যাণকর মহিলা বলে বিবেচিত হন। প্রিয় রাসূলﷺ উনাকে বিবাহ করার ফলে সাহাবারা উক্ত গোত্রের সকলকে বিনা-শর্তে বন্দী থেকে মুক্ত করে দেন। উপরে আলোচনা করা হয়েছে যে, যয়নব বিনতে জাহাশﷻ ও আয়েশাﷻ কে রাসূলﷺ আল্লাহর আদেশে বিবাহ করেন। এ দুটি বিবাহ ইসলামের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিবাহ বলে বিবেচিত। উপরে আমরা আলোচনা করেছি যে, যয়নব বিনতে জাহাশﷻএর বিবাহের মাধ্যমে আল্লাহ পালক পুত্রের কুসংস্কার দূর করেন। যয়নব বিনতে জাহাশﷻ এর বিবাহের চেয়েও আয়েশাﷻ এর বিবাহ ছিলো ইসলামে আরো বেশী গুরুত্বপূর্ণ।
◾রাসূলﷺ সম্পর্কে নাস্তিকদের দেয়া অপবাদ মিথ্যা ছাড়া কিছুই না। উদাহরণ, নবিজিﷺ কে অনেকেই বিবাহের জন্য প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি রাজি হননি। যেমন অন্যতম হচ্ছেন, উম্মে হানীﷻ। তিনি রাসূলﷺ এর একজন চাচাতো বোন ছিলেন। নবিজির বয়স তখন ৬০ বছর ছিলো। রাসূলﷺ-কে উম্মে হানী বিবাহের প্রস্তাব করলে; তিনি এতে রাজি হননি।
লেখা আর বড় করবো না। লিখলে শেষ হবে না। আশা রাখি পাঠকগণ বুঝতে পেরেছেন।
রেফারেন্সঃ
1. সীরাত আর-রাহীকুল মাখতূম।
2. সীরাত বিশ্বকোষ।
3. সীরাত ইবনে হিশাম।
4. ইসলামী বিশ্বকোষ।
5. সীরাতুর রাসূল(ছাঃ)- মুহাম্মদ আসাদুল্লাহ আল গালিব।
6. সীরাতুল মোস্তফা (স.)।
7. সীরাত ইবনে ইসহাক।
8. উইকিপিডিয়া।