গরুর মাংস নিয়ে ভারতে মুসলিমদের উপর নির্যাতন নতুন কিছু নয়। গরুর মাংস খাওয়া-কে কেন্দ্র করে মুসলিমদেরকে প্রতিনিয়ত হয়রানি করা হচ্ছে। এমনকি উগ্রবাদী হিন্দুরা গরুর মাংস-কে কেন্দ্র করে মুসলিমদের হত্যা পর্যন্ত করেছে। তাই এই বিষয়ে কথা না বললেই নয়, তো আজ আমরা দেখবো হিন্দুধর্মে কী সত্যিই গরুর মাংস খেতে নিষিদ্ধ করে?
বিভিন্ন পণ্ডিতদের মতামত –
গরুর মাংস খাওয়া হিন্দুধর্মে বৈধ কি অবৈধ তা নিয়ে নানা মতামত রয়েছে। আজ আমরা দেখবো প্রাচীনকালে হিন্দুদের গরুর মাংস খাওয়া নিয়ে আধুনিককালের কিছু অত্যন্ত গণমান্য ও উচ্চবিদ্বান ব্যাক্তিগণ কী বলেছেন!
রোমিলা থাপার: রোমিলা থাপার ছিলেন একজন ঐতিহাসিক। বেদ আসার সময় লোকদের খাদ্যাভাস নিয়ে তিনি লিখেছেন, "প্রধান খাদ্যদ্রব্য ছিলো দুধ, ঘি, শাকসবজি, ফল ও যব। কোনো কোনো ধর্মীয় উৎসব বা অতিথি সমাগমের সময় খাদ্যতালিকা পরিবর্তন হতো। ষাঁড়, ছাগল ও ভেড়ার মাংস আর মাদকদ্রব্য হিসেবে সুরা বা মধুর ব্যাবস্থা থাকতো। [ভারতবর্ষের ইতিহাস- পৃষ্ঠা:১৪৪]
মহাত্মা গান্ধী: "বেদে অশ্ব, গো ইত্যাদির বলির যে কথা পাই তা আমি অন্যায় মনে করি।" [হিন্দুধর্ম কী, মহাত্মা গান্ধী অনুবাদে মহাশ্বেতা দেবী। ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট, ইন্ডিয়া]
দ্বিজেন্দ্র নারায়ণ ঝা: ডি.এন জাহ হলেন একজন ভারতীয় ইতিহাসবিদ। তিনি ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ হিস্টরিকাল রিসার্চ এর সদস্য। উইকিপিডিয়া তিনি তার 'Myth of the Holy Cow' নামক বইয়ে প্রাচীনকালে গরু খাওয়া নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন। বিস্তারিত দেখে নিতে পারেন। বিস্তারিত দেখুন এছাড়া তিনি ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে এই বিষয়ে কিছু কথা বলেছেন। যা নিচে উল্লেখ করা হলো:
কথোপকথন –
ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল: গরুর পবিত্রতা ধারণাটি হিন্দু বিশ্বাসে কোথা থেকে এলো?
দ্বিজেন্দ্র নারায়ণ ঝা: ভারতে বৈদিক যুগে (আনুমানিক খিস্ট্রপূর্ব ৮০০-১৫০০ সাল) পবিত্র গরু ধারণাটি ছিল না। বৈদিক আর্যরা গরু বলিদান করত এবং এর গোশত খেত। বৈদিক লেখায় গরুকে সবচেয়ে বেশি উপমা ও রূপক হিসেবে ব্যবহার হয়েছে এবং সময়ের পরিক্রমায় এগুলোকে আক্ষরিক অর্থে ধরে নেওয়া হয়। পরের কয়েক শতকে গরুর পবিত্রতার আংশিকভাবে ধারণা তৈরি হয় এবং প্রাচীন ভারতীয় লেখায় উল্লিখিত বলিদানের উদ্দেশে গরু হত্যা—দুটো বিষয়ই পাশাপাশি চলতে থাকে।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল: হিন্দুরা কখন গরু খাওয়া ছেড়ে দিল?
দ্বিজেন্দ্র নারায়ণ ঝা: খ্রিস্ট শতকের শুরুর দিক থেকে, প্রথম সহস্রাব্দের মধ্যভাগে ব্রাহ্মণদের লেখায় গরু খাওয়ায় নিরুৎসাহ এবং গরু জবাই নিষিদ্ধ করা আরম্ভ করে। মৌর্যযুগ-পরবর্তী গ্রামীণ সমাজে, বিশেষ করে প্রথম সহস্রাব্দের মধ্যভাগে অভূতপূর্ব কৃষি সম্প্রসারণ হয়েছিল; আর এই সময়ে রূপান্তর ঘটে—এ থেকে মানুষের আচরণ পরিবর্তনের প্রেক্ষাপট তৈরির বিষয়টি বোঝা যাবে। ভূমির মালিক ব্রাহ্মণদের সামন্তপ্রভু হিসেবে উদ্ভব হয়, তারা আরো বেশি কৃষিকাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে, যা আগের সময়ে ছিল না। ব্রাহ্মণদের হাতে গরু হত্যা নিষিদ্ধ এবং প্রাণীরক্ষার ক্ষেত্রে এই বিষয়টিই কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল: আজকাল গরুর গোশত খাওয়া কি হিন্দুধর্মের মানানসই নয়?
দ্বিজেন্দ্র নারায়ণ ঝা: প্রাচীন ভারতে বহু শতক ধরে গরুর গোশত খাওয়ার রেওয়াজ চালু ছিল, তার প্রমাণ প্রাচীন ভারতীয় লেখায় বলিষ্ঠ প্রমাণ রয়েছে। ‘গরু-বলয়’ নামে পরিচিতি এসব অঞ্চল থেকে ক্রমেই এ রেওয়াজ উঠে যায়। তবে দেশের অনেক অংশে যেমন কেরালা ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে এখনো এই অভ্যাস (গরু খাওয়া) চালু আছে। কেরালায় ৭২টি সম্প্রদায় গরু খায় এবং এদের অনেকেই হিন্দু। সুতরাং আমি বলব না যে, গরুর গোশত খাওয়া হিন্দু-আদর্শের সঙ্গে বেমানান। তবে একই সঙ্গে অনেক হিন্দু আছে যারা গরু স্পর্শ করে না। এমনকি কোনো মাছ-গোশতও খায় না। যা এক শ্রেণির হিন্দুর কাছে গ্রহণযোগ্য, আরেক শ্রেণির কাছে নয়।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল: ভারতে গরু রক্ষা নিয়ে যে বিতর্ক চলছে সে বিষয়ে কী মনে কর?
দ্বিজেন্দ্র নারায়ণ ঝা: নাগরিকদের খাদ্য অভিরুচি নিয়ে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ করার অধিকার নেই। এই নিষেধাজ্ঞায় একটি বিষয় অবজ্ঞা করা হয়েছে যে, নিম্ন বর্ণ ও দরিদ্রদের জন্য আমিষের সস্তা উৎস হচ্ছে গরু। এ ছাড়া গোশতশিল্পের সঙ্গে জড়িত লোকজনের জীবন-জীবিকার ওপরও নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে এবং এটা ভারতের অর্থনীতিতে নানাভাবে জড়িয়ে আছে। বিস্তারিত
এবার আসি স্বামী বিবেকানন্দ এর কথায়। এটা আমরা সবাই জানি যে, স্বামী বিবেকানন্দ কে? তাকে নিয়ে বেশি কিছু বলছি না। তো দেখুন তিনি এ বিষয়ে কি বলেছেন। "ভারতে এমন এক সময় ছিলো, যখন গোমাংস না খেয়ে কোনো ব্রাক্ষণ ব্রাক্ষণ থাকতে পারতো না। [দ্যা কমপ্লিট ওয়াকার্স অফ স্বামী বিবেকানন্দ, পৃষ্ঠা ১৭৪]
আপনারা শুনে অবাক হবেন, প্রাচীন রীতি অনুযায়ী গরু না খেলে ভালো হিন্দু হওয়া যেত না। তাকে কিছু অনুষ্ঠানে অবশ্যই বৃষ বলি হিসেবে হত্যা করা হতো। [দ্যা কমপ্লিট ওয়াকার্স অফ স্বামী বিবেকানন্দ, পৃষ্ঠা: ৫৩৬]
স্বামী বিবেকানন্দ পুরানপন্থী ব্রাক্ষণদের উৎসাহের সাথে বলেছিলেন যে, বৈদিক যুগে গোমাংস ভক্ষণ প্রচলিত ছিলো। যখন একদিন তাকে জিজ্ঞাস করা হলো, ভারতবর্ষে ইতিহাসের কোন সময়টি স্বর্ণযুগ ছিলো? তিনি বলেছিলেন বৈদিক যুগ যখন ৫ ব্রাক্ষণ একসাথে হয়ে একটা গোটা গরু কেটে খেয়ে ফেলতো। [বিবেকানন্দ এর বায়গ্রাফি পৃষ্ঠা: ৯৬]
এখান থেকে আমরা দেখতেই পাচ্ছি আধুনিক যুগের অতিজ্ঞানী পণ্ডিতরাও একমত যে, প্রাচীন ভারতে হিন্দুরা গরুর মাংস খেতো কিন্তু কালের পরিক্রমায় তা আজ হারিয়ে গিয়েছে।