বেশ কিছু দিন ধরে নাস্তিকরা বলে আসছে কুরআনের সূরা কলম আয়াত ১০ এ আল্লাহ বলেছেন, যারা অধিক শপথ গ্রহণ করে তাদের আনুগত্য না করতে। অথচ আল্লাহ তায়ালা কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন বস্তুর শপথ করেছেন।
আনুগত্য অর্থ:- মান্য করা, মেনে চলা, আদেশ ও নিষেধ পালন করা।
এ অভিযোগের জবাব :-
আসুন দেখি সূরা কলমে ঠিক কী বলা হয়েছে,
وَلَا تُطِعْ كُلَّ حَلَّافٍ مَّهِينٍ
তুমি তার আনুগত্য করবে না যে অধিক শপথ করে, আর যে (বার বার কসম খাওয়ার কারণে মানুষের কাছে) লাঞ্ছিত। (সূরা কলম আয়াত ১০)
মূর্খ নাস্তিক ইসলাম-বিদ্বেশীরা মূলত জানেই না এই আয়াত কোন প্রসঙ্গে বলা হয়েছে।
সূরা কলম আয়াত ১০ বলা হয়েছে, যারা বার বার মিথ্যা শপথ/কসম খাওয়ার কারণে মানুষের কাছে লাঞ্ছিত তাদের আনুগত্য না করতে। এই সূরাতে কখনো এটা বলা হয়নি যে, যারাই শপথ করে তাদের আনুগত্য না করতে।
সূরা কলম আয়াত ১০ এর আগে থেকে পড়ুন,
আপনার পালনকর্তা সম্যক জানেন কে তাঁর পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে এবং তিনি জানেন যারা সৎপথ প্রাপ্ত। (সূরা: আল কলম, আয়াত: ৭)
অতএব, আপনি মিথ্যারোপকারীদের আনুগত্য করবেন না। (সূরা: আল কলম, আয়াত: ৮)
তারা চায় যদি আপনি নমনীয় হন, তবে তারাও নমনীয় হবে। (সূরা: আল কলম, আয়াত: ৯)
যে অধিক শপথ করে, যে লাঞ্ছিত, আপনি তার আনুগত্য করবেন না। (সূরা: আল কলম, আয়াত: ১০)
যে পশ্চাতে নিন্দা করে একের কথা অপরের নিকট লাগিয়ে ফিরে। (সূরা: আল কলম, আয়াত: ১১)
যে ভাল কাজে বাধা দেয়, সে সীমালংঘন করে, সে পাপিষ্ঠ, (সূরা: আল কলম, আয়াত: ১২)
দেখলেনই তো এখানে কাদের কথা বলা হয়েছে। যারা কথায়-কথায় মিথ্যা শপথ/কসম করে তাদের আনুগত্য না করতে এই আয়াতে বলা হয়েছে৷
আবারো বলছি, এই সূরার আয়াত ১০ এ কখনো এটা বলা হয়নি যে, যারাই শপথ করে তাদের আনুগত্য করো না বলা হয়েছে মিথ্যাবাদীরা যে শপথ করে তাদের আনুগত্য না করতে। এ বিষয়ে আপনারা বিভিন্ন তাফসির দেখতে পারেন।
And do not obey every Hallaf (one who swears much) Mahin (liar or worthless person). This is because the liar, due to his weakness and his disgracefulness, only seeks protection in his false oaths which he boldly swears to while using Allah's Names, and he uses them (false oaths) all the time and out of place (i.e., unnecessarily).
Ibn `Abbas said, "Al-Mahin means the liar."
তুমি তার অনুসরণ কর না, যে বেশি বেশি কসম খায় আর যে (বার বার মিথ্যা কসম খাওয়ার কারণে মানুষের কাছে) লাঞ্ছিত। ৮-১২ নং আয়াতের তাফসীর আল্লাহ তা'আলা বলেন: হে নবী (সঃ)! আমি তো তোমাকে বহু নিয়ামত, সরল-সঠিক পথ মহান চরিত্র দান করেছি, সুতরাং তোমার জন্যে এখন উচিত যে, যারা আমাকে অস্বীকার করছে তুমি তাদের অনুসরণ করবে না। তারা তো চায় যে, তুমি নমনীয় হবে, তাহলে তারাও নমনীয় হবে। ভাবার্থ এই যে, তুমি তাদের বাতিল মাবুদের দিকে কিছুটা ঝুঁকে পড়বে এবং সত্য পথ হতে কিছু এদিক ওদিক হয়ে যাবে। এরূপ করলে তারা খুশী হবে। মহাপ্রতাপান্বিত আল্লাহ বলেনঃ হে নবী (সঃ)! তুমি অধিক শপথকারী ইতর প্রকৃতির লোকদেরও অনুসরণ করবে না। যারা ভ্রান্ত পথে রয়েছে তাদের লাঞ্ছনা ও মিথ্যা বর্ণনা প্রকাশ হয়ে পড়ার সদা ভয় থাকে। তাই তারা মিথ্যা শপথ করে অন্যদের মনে নিজেদের সম্পর্কে ভাল ধারণা জন্মাতে চায়। তারা নিঃসঙ্কোচে মিথ্যা কসম খেতে থাকে এবং আল্লাহর পবিত্র নামগুলোকে অনুপযুক্ত স্থানে ব্যবহার করে। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, (আরবি)-এর অর্থ হলো মিথ্যাবাদী। হযরত মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, এর অর্থ হচ্ছে দুর্বল চিত্ত লোক। হযরত হাসান (রঃ) বলেন যে, (আরবি)-এর অর্থ ‘মুকাবির' এবং (আরবি) এর অর্থ দুর্বল। (আরবি) এর অর্থ গীবতকারী, চুগলখোর, যে বিবাদ লাগাবার জন্যে এর কথা ওকে এবং ওর কথা একে লাগিয়ে থাকে। সহীহ বুখারী ও সহীহ্ মুসলিমে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একদা রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) দু’টি কবরের পার্শ্ব দিয়ে গমন করার সময় বলেনঃ “এই দুই কবরবাসীকে শাস্তি দেয়া হচ্ছে, আর এদেরকে খুব বড় (পাপের) কারণে শাস্তি দেয়া হচ্ছে না। এদের একজন প্রস্রাব করার সময় পর্দা করতো না এবং অপরজন ছিল চুগলখোর।" মুসনাদে আহমাদে হযরত হুযাইফা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলতে শুনেছেনঃ “চুগলখোর জান্নাতে প্রবেশ করবে না।” অন্য রিওয়াইয়াতে আছে যে, হযরত হুযাইফা (রাঃ) এ হাদীসটি ঐ সময় শুনিয়েছিলেন যখন তাঁকে বলা হয় যে, এ লোকটি আমীর-উমারার নিকট (গোয়েন্দারূপে) কথা পৌঁছিয়ে থাকে। মুসনাদে আহমাদে হযরত আসমা বিনতু ইয়াযীদ ইবনে সাকন (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম লোক কারা এ খবর কি আমি তোমাদেরকে দিবো না?” সাহাবীগণ উত্তরে বলেনঃ “হ্যাঁ, হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমাদেরকে এ খবর দিন!” তিনি তখন বললেনঃ “তারা হলো ঐ সব লোক যাদেরকে দেখলে মহামহিমান্বিত আল্লাহকে স্মরণ হয়!” তারপর তিনি বললেনঃ “আমি কি তোমাদেরকে তোমাদের নিকৃষ্ট লোকদের সংবাদ দিবো না? তারা হলো চুগলখোর, যারা বন্ধুদের মধ্যে বিবাদ বাধিয়ে থাকে এবং সৎ ও পবিত্র লোকদের উপর মিথ্যা অপবাদ দিয়ে থাকে।” (ইমাম ইবন মাজাহও (রঃ) এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন) এরপর আল্লাহ তা'আলা ঐ সব লোকের আরো বদ অভ্যাসের বর্ণনা দিচ্ছেন যে, তারা কল্যাণের কার্যে বাধা দান করে, তারা সীমালংঘনকারী ও পাপিষ্ঠ। অর্থাৎ তারা নিজেরা ভাল কাজ করা হতে বিরত থাকে এবং অন্যদেরকেও বিরত রাখে, হালাল জিনিস ও হালাল কাজ হতে সরে গিয়ে হারাম ভক্ষণে ও হারাম কার্যে লিপ্ত হয়ে পড়ে। তারা পাপী, দুষ্কর্মপরায়ণ ও হারাম ভক্ষণকারী। তারা দুশ্চরিত্র, রূঢ় স্বভাব এবং তদুপরি কুখ্যাত। তারা শুধু সম্পদ জমা করে এবং কাউকেও কিছুই দেয় না।
এবার প্রশ্ন, আল্লাহ কেনো কোরআনে এতো অধিক পরিমাণ শপথ/কসম করেছেন?
আমরা সাধারণত শপথ করি আমাদের কোনও কথার বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে, আমরা যে সত্যি বলছি সেটা বোঝাতে। আল্লাহ্র ক্ষেত্রে সেটা প্রযোজ্য নয়। কারণ তিনি নিজেই আল-হাক্ক, তিনি কখনো মিথ্যে বলেন না। তাহলে এতো শপথ কেন নিলেন? যখন আল্লাহ্ কুরআনে কোনও কিছুর নামে শপথ নেন তখন বুঝতে হবে যে আল্লাহ গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলতে যাচ্ছেন। নিজের কোন কথা বিশ্বাস করানোর জন্য আল্লাহ তা’আলার কোন শপথ/কসম করার প্রয়োজন নেই। কুরআন মাজীদে বিভিন্ন স্থানে যে বিভিন্ন কসম করা হয়েছে তার উদ্দেশ্য কথাকে সৌন্দর্যমন্ডীত, অলংকারপূর্ণ ও বলিষ্ঠ করে তোলা। অনেক সময় এ দিকটার প্রতি লক্ষ্য থাকে যে, যেই জিনিসটার কসম করা হচ্ছে, তার দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যাবে তার পরবর্তীতে যে বক্তব্য আসছে তা তার সত্যতার প্রমান বহন করে। কুরআনে উল্লেখিত আল্লাহর এই শপথগুলো দ্বারা শপথকৃত বস্তুকে শ্রদ্ধা বা সম্মান জানানো হয়না বরং কোনো দাবির স্বপক্ষে প্রমান উপস্থাপন করা হয়ে থাকে। স্কলারদের মতে শপথ এর দ্বারা কথাগুলো শক্তিশালী ও গুরুত্বপূর্ণ বুঝানো হয়। এখানে মনে রাখতে হবে এই যে, আল্লাহর শপথ/কসম আর আমাদের কসম/শপথ এক না। কারণ আমরা কেবল আল্লাহর নামে কসম বা শপথ করতে পারবো অন্য কোন বস্তুর নামে করতো পারবো না। কিন্তু আল্লাহ যেকোন বস্তুর নামেই করতে পারবেন। সুতরাং, মানুষের কসম করার সাথে আল্লাহর কসম করার তুলনা করাটা হাস্যকর। কারণ যা কিছু আছে সব কিছুই আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টি। তিনি সব বস্তুর নামেই শপথ করতে পারেন কারণ সব কিছুই তার। কিন্তু আমরা মানুষরা কোন বস্তুর নামে শপথ বা কসম করতে পারবো না। আমরা কেবল আল্লাহর নামে শপথ বা কসম করতে পারবো। সূরা কলম আয়াত ১০ এ মিথ্যাবাদী লোক যারা কথায়-কথায় শপথ নেয় তাদের আনুগত্য করতে নিষেধ করা হয়েছে। আনুগত্য অর্থ মান্য করা, মেনে চলা, আদেশ ও নিষেধ পালন করা। সুতরাং যারা কথায়-কথায় মিথ্যা বলে শপথ নেয় তাদের আদেশ, নিষেধ না মানতে বলা হয়েছে। কিন্তু আল্লাহর ক্ষেত্র তিনি হলেন আল-হাক্ব (পরম সত্যবাদী)। আল্লাহর ৯৯টি নামের মধ্যে একটি হলো আল-হাক্ব। আল্লাহর আনুগত্য মানে তার আদেশ-নিষেধ অবশ্যই আমাদের মেনে চলতে হবে। সুতরাং মানুষের আনুগত্য ও শপথ এবং স্রষ্টার আনুগত্য ও শপথ এক নয় এটা বুঝতে হবে।