Contents
মহান আল্লাহ বলেন,
وَّ جَعَلَ الۡقَمَرَ فِیۡہِنَّ نُوۡرًا وَّ جَعَلَ الشَّمۡسَ سِرَاجًا
“আর চন্দ্রকে স্থাপন করেছেন আলোক রূপে আর সূর্যকে প্রদীপরূপে”। (কুরআন, ৭১ঃ১৬)
উপরের আয়াত নিয়ে অভিযোগ হল, ‘নূর’ শব্দের অনুবাদ ‘প্রতিফলিত আলো’ করা নাকি ভুল! তো আমি বেশ কিছু ধাপে জবাব দিব।
ভুল কোথায়?
শুধু উপর্যুক্ত আয়াতের উপর ভিত্তি করে: ‘আত-তাহরীর ওয়াত-তানওয়ীর’ কিতাবে ‘নূর’ শব্দ নিয়ে বলা আছে, “সূর্যের ‘দ্বীয়া’-কে এক প্রকার নূর বলা যায়, কিন্তু চাঁদের ‘নূর’-কে ‘দ্বীয়া’ বলা যায় না।”
মানে, ‘নূর’ শব্দটি ব্যাপক অর্থবহন করে। সুতরাং একজন ব্যক্তি খুব বেশি হলে এই তর্ক করতে পারে যে, চাঁদের আলো প্রতিফলিত হয় নাকি হয় না, তা আল্লাহ তাঁর কিতাবে উল্লেখ করেন নি। তাই সততা অবলম্বন করলে বলা যায়, কুরআন চাঁদের আলো নিয়ে কোন অবৈজ্ঞানিক তথ্য পেশ করে নি। কিন্তু আমরা জানি, কথিত মুক্তমনারা সৎ নয়; তারা গায়ের জোরে ‘নূর’ শব্দের অর্থ ‘আলো প্রদানকারী’ বলে দাবি করে থাকে এবং কুরআনকে অবৈজ্ঞানিক বলে থাকে। তাই বাধ্য হয়েই আমাকে তাদের অসততা প্রমাণের দায়িত্ব নিতে হল।
সূর্য প্রদীপ, চাঁদ নয়
অন্যান্য আয়াত আলোচনায় এনে: শাইখ আব্দুল্লাহ আল ফক্বীহ [হাফি:] তাফসীর করতে গিয়ে বলেন যে, পদার্থবিজ্ঞান থেকে জানি, আলোর উত্স সাধারণত দুই ভাগে বিভক্ত:
প্রত্যক্ষ উত্স: নক্ষত্র, প্রদীপ, মোমবাতি ইত্যাদি
অপ্রত্যক্ষ উত্স: চাঁদ এবং গ্রহ।
এই শেষ বিভাগটি হল তা, যা সূর্যের মতো অন্য উত্স থেকে তার আলো নেয় এবং তারপরে এটি আমাদের কাছে [আলোক] প্রতিবিম্বিত করে। সূর্য এবং প্রদীপ উভয়ে একই বৈশিষ্ট্য বহন করে, তাই তারা আলোর প্রত্যক্ষ উত্স হিসাবে বিবেচিত হয়। এ কারণেই আল্লাহ তাআলা সূর্যকে জ্বলজ্বল প্রদীপের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ বললেও, তিনি কোন আয়াতে চাঁদকে প্রদীপের সাথে তুলনা করেন নি। এছাড়াও, আল্লাহ সূর্যকে ‘দ্বীয়া’ বলেছেন, আর চাঁদের আলোকে নূর বলে পার্থক্য করেছেন। মানে, চাঁদের আলো সূর্যের মত নয়।
এখন সূর্য যদি প্রত্যক্ষ উত্স হয়, তাহলে যুক্তি অনুসারে চাঁদ ২য় বিভাগ, অর্থাৎ পরোক্ষ উত্স-ই হবে।
অতএব, নূর হল প্রতিফলিত আলো।[i] উপরন্তু, শব্দ ব্যবহারের ভিন্নতাকে ভিত্তি করে তাফসীর করার এই পদ্ধতি প্রখ্যাত মুফাসসির আল-আলুসি [রাহ:] গ্রহণীয় মনে করতেন।
ফাতহুল মাজীদ: চাঁদকে বলা হয়েছে الْقَمَرَ (কামার), একে منير (মুনির) ও বলা হয়েছে। যার অর্থ স্নিগ্ধ আলো দানকারী। তাছাড়া চাঁদ হচ্ছে একটি নিষ্ক্রিয় জিনিস, যা সূর্যের আলোকে প্রতিফলিত করে, চাঁদের এ বৈশিষ্ট্যের সাথে কুরআনের বর্ণনা হুবহু মিলে যায়। কুরআনে একবারের জন্যও চাঁদকে السراج (সিরাজ) وهاج (ওয়াহহাজ) বা ضِيَا۬ءً (জিয়া) হিসেবে এবং সূর্যকে نُوْرً (নূর) منير (মুনীর) হিসেবে উল্লেখ করা হয়নি। এর দ্বারা বুঝা যায় যে, কুরআন সূর্যের আলো এবং চন্দ্রের আলোর পার্থক্যকে স্বীকার করে। এরূপ আয়াত সূরা ফুরকানের ৬১ নং এবং সূরা নূহের ১৬ নং এ উল্লেখ রয়েছে। সুতরাং চাঁদের আলো প্রতিফলিত আলো [সূরা ১০]
তাফসীর ও আলোর শ্রেণিভেদ
জনতাকে ধোঁকা দিতে তারা বলতে পারে যে, অতীতের কোন তাফসীরের কিতাবে আলোকে তীব্র ও তীব্রতা বিহীন, এই ২ ভাগে বিভক্ত করেছেন; প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষ বলে ভাগ করেন নি।
- - তো? এটা মুফাসসিরদের অদূরদর্শিতা হতে পারে, কিন্তু কুরআনের ভুল কিভাবে হয়?
কিন্তু আজকাল কথিত মুক্তমনারা নিজেদের মুফাসসির মনে করে থাকেন। এসকল সনদহীন মুফাসসিররা শর্তারোপ করে থাকেন যে, অতীতের কোন তাফসীরের কিতাবের দলিল দিতে না পারলে সেই তাফসীর বাতিল!
আল্লাহ-র রহমতে ‘আল ফাউযুল কাবীর’ সম্পূর্ণ পড়ার সুযোগ হয়েছে। আমি সেখানে এমন শর্তের উল্লেখ পাই নি। এসব বানোয়াট শর্ত প্রমাণ করে যে, নাস্তিকরা ভীষণভাবে গোড়া ও বদ্ধমনা। তাই তারা গায়ের জোরে বলতেই থাকে যে, সাহাবীরা চাঁদের নিজস্ব আলো আছে বলেই বিশ্বাস করত।
- - কিন্তু সেই প্রমাণ কি? কোন সাহাবীর বক্তব্য আছে কি? মোটেও নেই। তাহলে, অযথা তর্কের কোন মানে হয় না।
আরও একটা যুক্তি আমি অনলাইনে দেখেছি যে, চাঁদের আলো নাকি রেডিয়ামের আলোর মত! এটা প্রদীপের [সূর্যের] মত দহন হয় না। আর মুফফাসসিররা এটাই বুঝিয়েছে!
- - নাস্তিকরা কুরআনের অপব্যাখ্যা করার জন্য এতটাই বেপরোয়া হয়ে গেছে যে, তারা বিজ্ঞানকেও অপব্যাখ্যা করা শুরু করেছে। কারন, রেডিয়ামের আলো ও সূর্যের আলো উভয়ে তেজস্ক্রিয় নিউক্লিয় বিকিরণ থেকে উদ্ভূত। সুতরাং, সূর্যে যে অর্থে হাইড্রোজেন দহন হয়, সেই অর্থে রেডিয়ামও দহন হয়। তাই রেডিয়ামের আলোকে চাঁদের নূরের অনুরূপ বলা যায় না।
নূর শব্দের অর্থ
ইমাম গাজ্জালী [র.] রচিত ‘মিশকাতুল আনওয়ার’ বা ‘আলোর দীপাধার’ কিতাবের ১ম অধ্যায় ‘আলোর শ্রেণীভেদ’-এর ‘সাধারণের দৃষ্টিতে আলো’ অনুচ্ছেদে ‘নূর’ শব্দের বিভিন্ন অর্থ উল্লেখ করেছেন, যার একটি হল,
“কখনো কখনো উজ্জ্বল বস্তু হতে বস্তুর উপর প্রতিফলিত আলোকে ‘আলো’[নূর] বলা হয়। যেমন- বলা হয়, পৃথিবী আলোকিত হয়েছে অথবা সূর্যালোক পৃথিবীকে উজ্জ্বল করেছে। এগুলোকে ‘আলো’ বলা হয়।”[ii]
মিশকাতুল আনওয়ার কিতাব থেকে
সম্ভাব্য কুযুক্তি
এখন সম্ভাব্য কুযুক্তি যা আসতে পারে তা হল, আল্লাহ বিভিন্ন স্থানে নিজেকে ‘নূর’ বলেছেন, তাহলে আল্লাহ কি প্রতিফলিত কিনা?
শাইখ সালিহ আল মুনাজ্জিদ [হাফি:] বলেন,
وكلمة "النور"، تتفاوت دلالتها، ويختلف إطلاقها في اللغة العربية بحسب سياقها وما أضيفت إليه، فنور الوجه مثلا ليس كنور القمر من حيث السطوع والإشراق، ونور العلم والعقل ليس كنور الحس والضوء، فالأول معنوي والثاني مرئي. ونور المصباح ليس كنور الشمعة قوة ووضوحا.
ونور الخالق صفة كمال لا تحتمل النقص بوجه من الوجوه، فلا تحتمل أبدا ما يطرأ على النور الكوني المخلوق، من كونه انعكاسا، أو عرضيا، أو ضعيفا، بل هو نور تام كامل غير مخلوق ولا ناقص، يليق بكمال الله وجلاله. ولا يليق أن يقارن "النور" الكوني، بـ"النور الإلهي".
“আরবিতে নূর শব্দের অর্থ ব্যবহারের প্রেক্ষাপট অনুসারে এবং এর সাথে উল্লিখিত অব্যয় ভিন্ন অনুসারে হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ: কোনও ব্যক্তির মুখের নূর, চকচকে এবং আলোকসজ্জার দিক থেকে চাঁদের নুরের মতো নয়; জ্ঞান এবং যুক্তির নূর শারীরিক নুর মতো নয়, কারণ পূর্ববর্তীটি রূপক এবং পরবর্তীটি দৃশ্যমান। প্রদীপের নূর শক্তি এবং স্পষ্টতার দিক থেকে একটি মোমবাতির নুরের মতো নয়। স্রষ্টার নূর তাঁর পরিপূর্ণতার একটি বৈশিষ্ট্য, যার কোনও ত্রুটি বা অপূর্ণতা থাকতে পারে না। সুতরাং এটি কোনওভাবেই মাখলুক আলোর বিভিন্ন রূপের সমান হতে পারে না, যেমন প্রতিফলিত বা ক্ষণস্থায়ী বা দুর্বল হওয়া। বরং এটি নিখুঁত আলো, যা সৃষ্টি হয় না এবং অসম্পূর্ণ নয়, কারণ তা আল্লাহর পূর্ণতা ও মহিমার উপযোগী। এবং সৃষ্ট আলোকে ঐশি আলোর সাথে তুলনা করা ঠিক নয়।” [ইসলামকিউএ]
শাইখ আব্দুল্লাহ আল ফক্বীহ [হাফি:] বলেন,
“চাঁদের আলো একটি প্রতিফলিত আলো প্রমাণিত হলেই, মহান আল্লাহ তায়ালা-র নূরও প্রতিফলিত প্রমাণ হয় না, কারণ তাঁর মতো কিছুই নেই।
মানুষ হিসাবে আমাদের জ্ঞান হল অর্জিত জ্ঞান, যা অর্জনের পূর্বে মানুষ অজ্ঞ ছিল; এর অর্থ কি এই যে, আল্লাহর জ্ঞানও অর্জিত জ্ঞান এবং তা অর্জনের পূর্বে আল্লাহ অজ্ঞ ছিলেন? উত্তর হল, না। আল্লাহ উচ্চ ও পরাক্রমশালী।
আমাদের জীবন পূর্বে অনস্তিত্বে ছিল, অথচ আল্লাহর জীবন এমন নয়। একইভাবে, চাঁদের আলো অর্জিত বা প্রতিবিম্বিত, এবং চাঁদ নিজে আলো তৈরি করে না বলে, আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের আলো ’প্রতিফলিত’ প্রমাণ হয় না।”[iii]
ইবনুল কাইয়িম (রাহ:) বলেছেন:
فيا عجبا لكم: أنكرتم أن يكون الله سبحانه نور السماوات والأرض حقيقة، وأن يكون لوجهه نور حقيقة، ثم جعلتم نور الشمس والقمر والمصابيح نوره حقيقة، وقد علم الناس بالضرورة فساد هذا، وأن نوره المضاف إليه يختص به لا يقوم بغيره، فإن نور المصباح قام بالفتيلة منبسطا على السقوف والجدران، وليس ذلك هو نور الرب تعالى الذي هو نور ذاته ووجهه الأعلى، بل ذلك هو المضاف إليه حقيقة، كما أن نور الشمس والقمر والمصابيح مضاف إليها حقيقة، قال تعالى: هو الذي جعل الشمس ضياء والقمر نورا [يونس: 5] وقال تعالى: وجعل فيها سراجا وقمرا منيرا [الفرقان: 61] وقال تعالى: الذي خلق السماوات والأرض وجعل الظلمات والنور [الأنعام: 1] .
فهذا نور مخلوق قائم بجرم مخلوق لا يسمى به الرب تعالى ولا يوصف به ولا يضاف إليه إلا على جهة أنه مخلوق له ، مجعول ، لا على أنه وصف له قائم به .
فالتسوية بين هذا وبين نور وجهه الذي أشرقت له الظلمات، وصلح عليه أمر الدنيا والآخرة واستعاذ به العائذون : من أبطل الباطل. " [iv]
সত্যিই আশ্চর্যের বিষয় যে আপনি অস্বীকার করেছেন, মহিমান্বিত আল্লাহ প্রকৃত অর্থেই আসমান ও যমীনের আলো (নূর) এবং তাঁর মুখাবয়বে প্রকৃত অর্থেই আলো রয়েছে, অতঃপর আপনি সূর্য, চাঁদ এবং নক্ষত্রের আলোকে সত্য অর্থে তাঁর আলো বুঝালেন, যখন মানুষ নিশ্চিতভাবেই জানে যে এটি সঠিক নয়, এবং তারা জানে যে তাঁর দিকে আরোপিত আলো একমাত্র তাঁরই এবং অন্য কোনও কিছুর আলো নয়। প্রদীপের আলো পলিতা থেকে উদ্ভূত হয় এবং ছাদ এবং দেয়াল জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এবং এটা মহিমান্বিত আল্লাহ-র আলো নয়, তাঁর সত্ত্বাগত এবং পবিত্র চেহারার আলো নয়। বরং এটি তাঁর দিকে (সম্বন্ধবাচক পদ) যেমন প্রকৃত অর্থে আরোপিত হয়, ঠিক তেমনি সূর্য, চাঁদ এবং প্রদীপের আলোও তাদের দিকে প্রকৃত অর্থে আরোপিত হয়। মহিমান্বিত আল্লাহ বলেছেন (অর্থের ব্যাখ্যা):
" তিনিই সেই সত্তা যিনি সূর্যকে দীপ্তিমান [দিয়া’] এবং চন্দ্রকে আলোকময় [নূর] হিসাবে তৈরি করেছেন " [ইউনূস 10: 5]
" কতই না কল্যাণময় তিনি যিনি আসমানে নক্ষত্ররাজির সমাবেশ ঘটিয়েছেন আর তাতে স্থাপন করেছেন প্রদীপ আর আলো বিকিরণকারী চন্দ্র [মুনিরা]" [আল-ফুরকান 25:61][v]
“প্রশংসা আল্লাহরই যিনি আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, আর সৃষ্টি করেছেন অন্ধকার ও আলো [নূর]” [আল-আন‘আম 6: 1]।
এটা (সূর্যের আলো ইত্যাদি) হল সৃষ্ট আলো [মাখলুক], যা শারীরিক সত্তা থেকে উদ্ভূত হয়, এবং আল্লাহ-র মাখলুক ব্যতীত ভিন্ন অর্থে তাঁর দিকে আরোপ করা যায় না, তাঁর সত্ত্বাগত ’নূর’ বলা যায় না।
তাঁর চেহারার নূর, যার কারণে অন্ধকার দূর হয় এবং দুনিয়া ও আখেরাতের মঙ্গল বজায় থাকে; এবং যার দ্বারা যারা আশ্রয় প্রার্থনা করে, তাদেরকে আশ্রয় দেওয়া হয়; সেই নূরকে মাখলুক নূরের সমান মনে করা, মিথ্যাসমূহের মধ্যে অন্যতম মিথ্যা।”
সত্যান্বেষীদের জন্য এতটুকু আলোচনা-ই যথেষ্ট হবে ইনশাআল্লাহ।
[i] Difference between Dhiyaa and Noor - Islamweb - Fatwas. (2010). Retrieved 24 October 2020, from https://www.islamweb.net/en/fatwa/131810/difference-between-dhiyaa-and-noor
[ii] গাজ্জালী, ম., n.d. মিশকাতুল আনওয়ার. ঢাকা: ইসলামিয়া কুরআন মহল, p.32.
[iii] Light of Allah Noor not like light of moon - Islamweb - Fatwas. (2017). Retrieved 24 October 2020, from https://www.islamweb.net/en/fatwa/343072/light-of-allah-noor-not-like-light-of-moon
[iv] আস-সাওয়ায়ি’ক আল-মুরসালাহ (424)
[v] সূরা ইউনুসের ১০;৫ নং আয়াতের মত এ আয়াতেও প্রমাণ হয় যে, চাঁদের নিজস্ব কোন আলো নেই। সুতরাং বিজ্ঞানের এ কথা বহু পূর্বেই কুরআনে প্রমাণিত হয়েছে। [আহসানুল বায়ান]