Are you sure?

কুরআন »  বিবিধ

পর্ব: ২] হিকমা কি? কিতাব এবং হিকমার প্রভেদ বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা।

মহামহিমান্বিত আল্লাহ্ সুবাহানাহু ওয়াতা'আলা সকল মানবজাতির হেদায়েতের জন্য অর্থাৎ সত্য ও শাশ্বত পথ নির্দেশনা দানের জন্য মহান একটা গ্রন্থ পাঠিয়েছেন সকল যুগের উপযোগী করে, যাতে রয়েছে জ্ঞানের দিক থেকে পরিপূর্ণ সত্য বাণী, আদেশ-নিষেধ, উপদেশ, উপমা আর নিদর্শন সমূহ। এটা নির্দিষ্ট ভাবে নয় কোন বিজ্ঞান অথবা ভূগোল গ্রন্থের ন্যায় কোন বই। বরং এটা হলো পরিপূর্ণ হেদায়েত গ্রন্থ। তো মহান আল্লাহর প্রতিটি কথাই সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ভাবেই উত্তম বাণী এবং বহুত গভীর ও তাৎপর্যময়। তিনি একটি অক্ষর, শব্দ, বাক্যের মাধ্যমে বহু কিছুই জানিয়ে দিয়েছেন মানব জাতিকে। তিনি একটি অক্ষর বা শব্দের মাধ্যমে কোরআনের অলৌকিকতা, একটা বাক্যের মাধ্যমে কোন জাতির সমগ্র ইতিহাসকে তুলে ধরেছেন। এটাই কোরআনের সৌন্দর্য্য, কোরআনের অলৌকিকতা/রহস্য, কোরআনের উপস্থাপন ভঙ্গি। হ্যাঁ, তিনিই সেই অধিপতি যিনি কোরআন নাযিলের পেছনে বহু কারণ রেখেছেন, তাঁর প্রতিটি কথা নাযিলের পেছনে বহু যৌক্তিক এবং যথার্থ কারণ রয়েছে। তিনিই কোরআনে দুই ধরনের কথা উপস্থাপন করেছেন; একটা সরাসরি সুস্পষ্ট আরেকটা অস্পষ্ট। তবে স্পষ্ট আয়াতের সংখ্যাই সর্বাধিক। এর পেছনেও অবশ্যই জ্ঞানীদের জন্য চিন্তা ভাবনার বিষয় রেখে দিয়েছেন তিনি।

আবার উল্লেখ্য যে মহান আল্লাহর প্রতিটি আয়াত নাযিলের পেছনে বিশেষ কোন কারণ ছিল; কেননা তিনি কারণ বহিভূর্ত কোন কিছুই অযথা নাযিল করতেন না। আবার মানব জীবনের সাথে ওৎপ্রোৎভাবে জড়িত প্রত্যেক কিছুই উদ্দেশ্যপূর্ণ অর্থাৎ যা কিছুই আপনি করেন না কেন, এর প্রত্যেকটির পেছনে আপনার বিশেষ একটা কারণ বা উদ্দেশ্য থাকে। আবার আপনি কোন কথা বলবেন, নিশ্চিত কোন কারণের জন্যই তা বলেন। আর কারণ ছাড়া যে কোন কিছুই অর্থহীন প্রলাপে পরিণত হয়। তাহলে এটাই প্রমাণ হয় যে, এই মহাবিশ্বে যে কোন কিছু ঘটার পেছনে অবশ্যই একটা কারণ বা উদ্দেশ্য দায়ী থাকে যাকে বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় বলে Laws of Causality. সুতরাং এই হিসেবে পবিত্র কোরআনের প্রতিটি আয়াত নাযিলের অবশ্যই প্রেক্ষাপট রয়েছে। আর প্রেক্ষাপট হলো উক্ত আয়াত নাযিলের পেছনে বিশেষ কোন ঘটনা সমূহ যাকে আমরা "কারণ" হিসেবে চিহ্নিত করে থাকি। এর মানে মহান আল্লাহ্ বিশেষ কোন ঘটনা কে কেন্দ্র করেই আয়াত নাযিল করেছিলেন যেটা যৌক্তিক দৃষ্টিকোণ থেকেই বোঝা যায়, যা কমন সেন্সের ব্যাপার। আর পবিত্র কোরআনের আয়াত নাযিলের প্রেক্ষাপট কোরআন থেকে জানা সম্ভব নয় কেবলমাত্র সহীহ হাদিস/তাফসীর ছাড়া। কেননা পবিত্র কোরআন হলো সরাসরি ওহী যা কোন বিষয় কে কেন্দ্র করে বিধিবিধান নাযিল হতো; আর এসব বিধিবিধান নাযিলের ঘটনা সমূহ সরাসরি সহীহ হাদিস/তাফসীরে বর্ণিত হয়েছে। আর সহীহ হাদিস হলো রাসূল ﷺ থেকে বর্ণিত তাঁর কাজ-কর্ম, কথা-বার্তা, আদেশ নিষেধ, উপদেশ, উপমা যা মূলত কোরআন সংশ্লিষ্ট কমেন্টারী। আর এসব বর্ণিত হয়েছে স্বয়ং রাসূল ﷺ এর ঘনিষ্ঠ সহচর তথা বিশ্বস্ত সাহাবীগণের থেকে তবুও ধারাবাহিক সনদ আকারে।

এই যেমন আমরা গণিত, পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়নের সূত্র বা যে কোন কিছু বোঝার জন্য শিক্ষককে প্রশ্ন করে সেসব বিষয়ে ভাল করে জেনে নিই, ঠিক তদ্রুপ সাহাবীগণও কোরআন বা তৎসংশ্লিষ্ট কোন কিছু বোঝার জন্য, জানার জন্য রাসূল ﷺ কে প্রশ্ন করতেন। কেননা মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট্য হলো নতুন কোন কিছু সম্পর্কে বেশি বেশি প্রশ্ন করে জেনে নেওয়া, তা বুঝা; যেহেতু তাঁদের কাছে কোরআনের বিধিবিধান, আহকামগুলো ছিল নতুন এবং অজানা। তাই তারা জীবনের সাথে ওৎপ্রোৎভাবে জড়িত প্রত্যেক বিষয়-বস্তু সম্পর্কে রাসূল ﷺ কে প্রশ্ন করতেন যা কিনা আমরা সহীহ হাদিস পড়লেই জানতে পারি, আবার পবিত্র কোরআনের বর্ণনাভঙ্গিও সেটাই বলে। পবিত্র কোরআন সব বিষয়ে ঢালাওভাবে নাযিলকৃত বিস্তারিত বর্ণনামূলক কোন গ্রন্থ নয় বরং এটি হলো বিস্তারিত নির্দেশনা মূলক মৌলিক গ্রন্থ অর্থাৎ Code of life. কাজেই এতে সব বিষয়ের বিস্তারিত নির্দেশনা থাকলেও ঢালাওভাবে বিস্তারিত বর্ণনা ও পদ্ধতি সমূহের বর্ণনা নেই; এই যেমন সালাত কিভাবে কোন পদ্ধতিতে আদায় করতে হবে, যাকাত কতটুকু আদায় করতে হবে, হজ পালনের বিস্তারিত পদ্ধতি সমূহ কেমন হবে তা কোরআনে বিস্তারিত নেই। কাজেই কোরআনের এসব বিধিবিধান পালন করার জন্য আমাদের কে অবশ্যই রাসূল ﷺ এর সহীহ হাদিস মানতে হবে, অন্যথায় কোরআনের এসব বিষয় পালন করা যাবে না। এই জন্য আরববাসীর মাতৃভাষা আরবি হওয়া সত্বেও মহান আল্লাহ্ তাঁকে পবিত্র কোরআন বুঝিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন [পবিত্র কোরআন ১৬:৪৪]। আর রাসূল ﷺ ও সেটাই করেছিলেন যার জন্য তিনি সাহাবীগণের প্রত্যেকটি প্রশ্নের জবাব দিতেন।

তো যারা সহীহ হাদিস অথবা তাফসীর মানে না তাদের থেকে প্রতিটি আয়াত নাযিলের প্রেক্ষাপট কোরআন থেকেই জানতে চাই? আর হ্যাঁ মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম আঃ এবং তাঁর বড় ছেলে হযরত ইসমাইল আঃ কাবা ঘরের ভিত্তি স্থাপনের [পবিত্র কোরআন ২:১২৪-১২৯] পর একটা দোআ করেছিলেন যা পবিত্র কোরআনে এইভাবে এসেছে: সূরা আল বাকারার ১২৯ নং আয়াতে:

رَبَّنَا وَٱبْعَثْ فِيهِمْ رَسُولًا مِّنْهُمْ يَتْلُوا۟ عَلَيْهِمْ ءَايَٰتِكَ وَيُعَلِّمُهُمُ ٱلْكِتَٰبَ وَٱلْحِكْمَةَ وَيُزَكِّيهِمْۚ إِنَّكَ أَنتَ ٱلْعَزِيزُ ٱلْحَكِيمُ

হে আমাদের রাব্ব! তাদেরই মধ্য হতে এমন একজন রাসূল প্রেরণ করুন যিনি তাদেরকে আপনার নিদর্শনাবলী পাঠ করে শুনাবেন এবং তাদেরকে গ্রন্থ ও বিজ্ঞান শিক্ষা দান করবেন ও তাদেরকে পবিত্র করবেন। নিশ্চয়ই আপনি পরাক্রান্ত, বিজ্ঞানময়।" [অনুবাদক: মুজিবুর রহমান]

Our Lord, and send among them a messenger from themselves who will recite to them Your verses and teach them the Book and wisdom and purify them. Indeed, You are the Exalted in Might, the Wise." [Translator: Sahih International]

এটাই হলো মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম আঃ এবং তাঁর সন্তান ইসমাইল আঃ এর দোআ। এখন মহান আল্লাহও তাঁদের এই দোআ কবুল করেছিলেন যা কিনা আমরা পবিত্র কোরআন থেকেই জানতে পারি। তো পবিত্র কোরআন মাজীদের ২ নং সূরা আল বাকারার ১৫১ নং আয়াতে এরশাদ করেছেন:

كَمَآ أَرْسَلْنَا فِيكُمْ رَسُولًا مِّنكُمْ يَتْلُوا۟ عَلَيْكُمْ ءَايَٰتِنَا وَيُزَكِّيكُمْ وَيُعَلِّمُكُمُ ٱلْكِتَٰبَ وَٱلْحِكْمَةَ وَيُعَلِّمُكُم مَّا لَمْ تَكُونُوا۟ تَعْلَمُونَ
আমি তোমাদের মধ্য হতে এরূপ রাসূল প্রেরণ করেছি যে তোমাদের নিকট আমার নিদর্শনাবলী পাঠ করে এবং তোমাদেরকে পবিত্র করে, তোমাদেরকে গ্রন্থ ও বিজ্ঞান শিক্ষা দেয় এবং তোমরা যা অবগত ছিলেনা তা শিক্ষা দান করে।[অনুবাদক: মুজিবুর রহমান] (এই একই কথা বলা হয়েছে অন্যত্রে ৩:১৬৪ নং আয়াতে)
Just as We have sent among you a messenger from yourselves reciting to you Our verses and purifying you and teaching you the Book and wisdom and teaching you that which you did not know." [Translator: Sahih International]

এই আয়াতের তাফসীর পড়তে ক্লিক করুন  

এখন আমরা এই [২:১৫১] আয়াতটাকে পয়েন্ট আকারে উপস্থাপন করি:
i) আমি তোমাদের মধ্য হতে এরূপ রাসূল প্রেরণ করেছি/كَمَآ أَرۡسَلۡنَا فِيكُمۡ رَسُولًا مِّنكُمۡ/Just as We have sent among you a messenger from yourselves.
ii) যে তোমাদের নিকট আমার নিদর্শনাবলী পাঠ করে এবং তোমাদেরকে পবিত্র করে/يَتۡلُواْ عَلَيۡكُمۡ ءَايَٰتِنَا وَيُزَكِّيكُمۡ /reciting to you Our verses and purifying you.
iii) এবং তোমাদেরকে গ্রন্থ/কিতাব (কোরআন) ও বিজ্ঞান শিক্ষা দেয়/প্রজ্ঞা/وَيُعَلِّمُكُمُ ٱلۡكِتَٰبَ وَٱلۡحِكۡمَةَ/and teaching you the Book and wisdom.
iv) এবং তোমরা যা অবগত ছিলেনা তা শিক্ষা দান করে/وَيُعَلِّمُكُم مَّا لَمۡ تَكُونُواْ تَعۡلَمُونَ/and teaching you that which you did not know.

উল্লেখ্য যে আরবি ব্যাকরণের নিয়ম অনুযায়ী, দুটো Noun বা বিশেষ্যের মাঝে যখন ওয়াও (و-এর অর্থ "এবং" হবে) শব্দ আসবে, তখন এর আগের এবং পরের জিনিসটি সম্পূর্ণ ভিন্ন হবে। আর এই আয়াতে "ٱلۡكِتَٰبَ/কিতাব" এবং "حِكۡمَةَ/হিকমত" শব্দ দুটো হলো Noun বা বিশেষ্য, যার মাঝে "و/ওয়াও" শব্দ বসে দুটো জিনিস-ই সম্পূর্ণ ভিন্ন হয়ে গেছে যা অর্থাৎ- ٱلۡكِتَٰبَ وَٱلۡحِكۡمَةَ (আল কিতাবা ওয়া'ল হিকমাতা) তাহলে এইখানে নিশ্চিত "ٱلۡكِتَٰبَ/কিতাব" মানেই হলো পবিত্র কোরআন (যা নিজেই জ্ঞানে পরিপূর্ণ) যা আমরা সকলেই একমত।

কিন্তু "حِكۡمَةَ/হিকমত" মানে কোনটাকে বোঝানো হয়েছে? এটা শিওর যে, হিকমত বলতে পবিত্র কোরআনকে বোঝানো হয় নাই। কেননা পবিত্র কোরআন নিজেই জ্ঞানে স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং পরিপূর্ণ সত্য একটা আসমানি গ্রন্থ। আর হিকমত বলতে যদি পবিত্র কোরআনকে বোঝানো হতো তাহলে এইখানে উভয় বিশেষ্যের মাঝে "ওয়াও" শব্দ এসে কিতাব তথা কোরআন কে হিকমত থেকে সম্পূর্ণরূপে পৃথক করত না। তো আমরা ধারাবাহিকভাবে এটা অবশ্যই জেনে নিব এর ব্যাখ্যার মধ্যে ইনশাআল্লাহু তাআলা।

ভিডিও দেখতে পারেন:

কোরআনে বর্ণিত হিকমাই কি সুন্নাহ- জানতে ক্লিক করুন এখানে

আমরা এই চারটি পয়েন্ট কে ব্যাখ্যা আকারে উপস্থাপন করব:
i) আমি তোমাদের মধ্য হতে এরূপ রাসূল প্রেরণ করেছি: উল্লেখ্য যে, পবিত্র কাবা গৃহের ভিত্তি উঠানোর সময় হযরত ইব্রাহিম আঃ এর কাছে তাঁর একমাত্র পুত্র হযরত ইসমাইল আঃ উপস্থিত ছিলেন, যা পবিত্র কোরআন এবং সহীহ হাদিস ও বিভিন্ন তাফসীর গ্রন্থ সহ ইসলামিক ইতিহাসের মধ্যে পাওয়া যায়। আবার বাইবেলের মধ্যেও এটা রয়েছে। তাহলে ইব্রাহিম আঃ এবং তাঁর পুত্র ইসমাইল আঃ পবিত্র কাবা ঘরের ভিত্তি স্থাপনের শেষে মহান আল্লাহর কাছে একটা দোআ করেছিলেন যা আমরা ২:১২৯ নং আয়াতে দেখতে পাই এবং মহান আল্লাহও তাঁদের এই দোআ কবুল করেছিলেন যা সূরা বাকারার ২:১৫১ এবং সূরা আলে ইমরানের ৩:১৬৪ নং আয়াতে দেখতে পাই। তাহলে এইখানে "فِيكُمۡ/তোমাদের মধ্যে (among you)" যা কেবলমাত্র দুইয়ের অধিক জনের মধ্যে সম্পর্ক বোঝায় অর্থাৎ এটা একটি Preposition যা মূলত Personal pronoun. দুইয়ের অধিক জন বলতে ইব্রাহিম আঃ, ইসমাইল আঃ এবং তাঁর বংশধর. তাহলে এইখানে হযরত ইব্রাহিম আঃ এর ঔরসজাত সন্তান হলেন ইসমাইল আঃ। আর উনিই যেহেতু ইব্রাহিম আঃ এর দোআর সময় উপস্থিত ছিলেন কাজেই এইখানে "তোমাদের মধ্যে থেকে" বলতে ইসমাইল আঃ এর বংশে একজন রাসূল আসার কথা বলা হয়েছে অর্থাৎ ইব্রাহিম আঃ এর দোআ ছিল, ইসমাইলের বংশে যেন একজন রাসূল পাঠানো হয়, যা ছিল মূলত ইব্রাহিম আঃ এর ইচ্ছা [এমন ব্যাখ্যা করা হয়েছে তাফসীরে ফাতহুল মাজীদের ২:১৫১ নং আয়াতের ব্যাখ্যার শুরুতেই, ইবনে কাসীরের শেষাংশেও প্রায় এমন ব্যাখ্যা করা হয়েছে]। আর মহান আল্লাহ তাঁর দোআ কবুল করেছিলেন যা আমরা জানতে পেরেছি ২:১৫১ এবং ৩:১৬৪ নং আয়াতে। আর ইসমাইল আঃ এর বংশে মাত্র একজন নবীর আবির্ভাব হয়েছে যিনি হলেন আমাদের বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ ﷺ।

ii) যে তোমাদের নিকট আমার নিদর্শনাবলী পাঠ করে এবং তোমাদের- কে পবিত্র করে:
ইব্রাহিম আঃ এর দোআর মধ্যে কী ছিল? তিনি দোআ করেছিলেন ইসমাইলের বংশে এমন একজন রাসূল পাঠাও,"যিনি তাদেরকে আপনার নিদর্শনাবলী পাঠ করে শুনাবেন এবং তাদেরকে গ্রন্থ ও বিজ্ঞান শিক্ষা দান করবেন ও তাদেরকে পবিত্র করবেন/يَتۡلُواْ عَلَيۡهِمۡ ءَايَٰتِكَ وَيُعَلِّمُهُمُ ٱلۡكِتَٰبَ وَٱلۡحِكۡمَةَ وَيُزَكِّيهِمۡۚ/who will recite to them Your verses and teach them the Book and wisdom and purify them. তাহলে ইব্রাহিম আঃ তাঁর দোআর মধ্যে সেই রাসূলের জন্য কয়টি বিশেষ গুণাবলির কথা ব্যক্ত করেছিলেন? তাহলে আসুন তা আবার পুনরাবৃত্তি করে জানা যাক [২:১২৯] :
১] يَتۡلُواْ عَلَيۡهِمۡ ءَايَٰتِكَ/তাদের কাছে আপনার আয়াতী তথা নিদর্শনাবলী পাঠ করবেন/who will recite to them Your verses.
২] وَيُعَلِّمُهُمُ ٱلۡكِتَٰبَ/ এবং তাদের বিজ্ঞান-(علم) ও কিতাব শিক্ষা দিবেন/and teach them the Book
৩] وَٱلۡحِكۡمَةَ وَيُزَكِّيهِمۡۚ/ এবং তাদের কে শেখাবেন হিকমা (প্রজ্ঞা/জ্ঞান) ও পবিত্র করবেন/and wisdom and purify them.

তাহলে আমরা পাই সেই নবীর কয়টি বৈশিষ্ট্য পাই:

  • তাদের কাছে আয়াত পাঠ করবেন,
  •  বিজ্ঞান ও কিতাব শেখাবেন,
  •  হিকমা তথা প্রজ্ঞা শেখাবেন এবং
  •  শির্ক-কুফরিমূলক আচারণ তথা অপবিত্রতা থেকে পবিত্র করবেন।

এই ছিল মহান আল্লাহর কাছে ইব্রাহিম আঃ এর চাওয়া, যা তিনি তাঁর দোআর মধ্যে বলেছিলেন। তো মহান আল্লাহ কী তাঁর এসব চাওয়া পূরণ করেছেন? অবশ্যই। কেননা মহান আল্লাহ্-ই এসব বৈশিষ্ট্যের কথা বর্ণনা করেছেন সেই রাসূলের মধ্যে (২:১৫১; ৩:১৬৪), যা কিনা ইব্রাহিম আঃ চেয়েছিলেন তাঁর দোআর মধ্যে (২:১২৯)। তাহলে ইব্রাহিম আঃ এর দোআর কারণে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ ﷺ কে প্রেরণের মূল কারণ তিনটি। এর মধ্যে প্রথমটাই হচ্ছে সর্বোত্তম রব মহান আল্লাহ্ সুবাহানাহু ওয়াতা'আলার আয়াত সমূহ তেলাওয়াত করা। আর তিলাওয়াতের আসল অর্থ অনুসরণ করা। কোরআন এবং হাদিসের পরিভাষায় এ শব্দটি কোরআন ও অন্যান্য আসমানি কিতাব পাঠ করার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কারণ যে লোক এসব কালাম পাঠ করে এর অনুসরণ করাও কর্তব্য। আসমানি গ্রন্থসমূহ যেভাবে মহান আল্লাহর তরফ থেকে নাযিল হয় হুবহু ঠিক সেভাবেই পাঠ করা জরুরি। ইমাম রাগিব বলেছেন,"আল্লাহর কালাম ছাড়া অন্যান্য গ্রন্থ পাঠ করাকে সাধারণ পরিভাষায় তিলাওয়াত বলা যায় না "[মুফরাদাতুল কুরআন]

তিনি পরিশুদ্ধি তথা পবিত্রকরণ করেন এখানে আয়াতে وَيُزَكِّيهِمۡۚ শব্দটি زكو শব্দ থেকে উদ্ভূত যার অর্থ পবিত্রতা। বাহ্যিক ও আত্মিক সকল প্রকার পবিত্রতার অর্থে এই শব্দটি ব্যবহৃত হয়। বাহ্যিক নাপাক বলতে কোন অপবিত্র জিনিসের দিকে ধাবিত হওয়া। আর আত্মিক নাপাকী হচ্ছে শির্ক-কুফরি, আল্লাহ্ ব্যতীত অন্যের ওপর ভরসা করা, অহংকার, হিংসা-বিদ্বেষী, শত্রুতা পোষণ ইত্যাদি। এখন প্রশ্ন হলো বাহ্যিক ভাবে একজন মানুষ কিভাবে পরিপূর্ণ পবিত্র হবে? কেননা মহান আল্লাহ্ বলেছেন:-"রাসূল তোমাদের কে পবিত্র করবেন।" এখন বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ ভাবে পরিপূর্ণ পবিত্র হবার উপায় কিভাবে শিক্ষা দিয়েছেন রাসূল ﷺ??? সেই সব পদ্ধতিগুলো কী কী??? পবিত্র কোরআনে এর কিছু কিছু উল্লেখ থাকলেও ঢালাওভাবে বিস্তারিত নেই।

iii) এবং তোমাদেরকে গ্রন্থ ও বিজ্ঞান শিক্ষা দেয় এবং হিকমত: এখানে ২:১৫১ নং আয়াতে "وَيُعَلِّمُكُمُ (ওয়া ইউআল্লিমুকুম)" শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করা হয়েছে যা মূলত علم শব্দ থেকে উদ্ভূত। আর এর অর্থ হলো বিজ্ঞান। আর বিজ্ঞান মানেই হচ্ছে আল্লাহ্ প্রদত্ত বিশেষ জ্ঞান। এর মানে রাসূল ﷺ আমাদের কে বিজ্ঞানও শিক্ষা দেয়। আর كِتَٰبَ (কিতাব) বলতে পবিত্র কোরআন-কেই বোঝানো হয়েছে। আর [২:১২৯ ও ১৫১] নং আয়াতে "ٱلۡكِتَٰبَ/কিতাব" এবং "حِكۡمَةَ/হিকমত" শব্দ দুটোর মাঝে و শব্দ বসে Noun দুটোকে সম্পূর্ণ পৃথক করে ভিন্ন জিনিসে পরিণত করেছে। পবিত্র কোরআন নিজেই জ্ঞানের দিক থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থাৎ এটি একটি পরিপূর্ণ কিতাব। কাজেই এইখানে "حِكۡمَةَ/হিকমত" অর্থে পবিত্র কোরআন উদ্দেশ্য নয় বরং ভিন্ন আরেকটা জিনিস হবে। আর যদি পবিত্র কোরআন উদ্দেশ্য হয় তাহলে "হিকমত" এর জায়গায় কোরআন তথা কিতাব উল্লেখ করে নিলে বাক্যটি এমন হতো:

"...যে তোমাদের নিকট আমার নিদর্শনাবলী পাঠ করে এবং তোমাদেরকে পবিত্র করে, তোমাদেরকে শিক্ষা দেয় "কিতাব ওয়াল কিতাব-(كتب والكتب)" কিতাব এবং কিতাব।

এর মানে এইখানে একবার কিতাব বলার পরেও আরেকবার "কিতাব" শব্দের উল্লেখ করা মানেই অযথা শব্দের অপচয় করা যা মহান আল্লাহ্ কখনোই করবেন না। কেননা মহামহিমান্বিত রব কখনোই অযথা শব্দের অপচয় করেন না। কিন্তু আমরা আয়াতে ভিন্ন কিছু দেখতে পাই। কিন্তু একই সাথে দুই টা বিশেষ্য শব্দ ব্যবহার করেছেন তবুও মাঝখানে ওয়াও ব্যবহার করে। আবার ভিন্ন দুটো শব্দ ইউজ করেছেন। এর অর্থ বোঝায় "হিকমত" বলতে কখনোই কোরআন বা কোরআনের ভেতরে থাকা জ্ঞান (যা সরাসরি ওহী) উদ্দেশ্য নয়। নিশ্চিত এটা হবে ভিন্ন কিছু। কিন্তু সেটা কী? তাহলে আসুন নিচের অংশটুকুও মনোযোগ সহকারে পড়ে ফেলি ইনশাআল্লাহু তাআলা।

নোট: একই জিনিস বোঝাতে একই বাক্যে অতিরিক্ত তথা অপ্রয়োজনীয় শব্দের প্রয়োগ যেটাকে বাহুল্য দোষ বলা হয়।

iv) এবং তোমরা যা অবগত ছিলেনা তা শিক্ষা দান করে: তাহলে এই বাক্যটি বলা হয়েছে কখন? এই বাক্যটি বলা হয়েছে"... এবং তোমাদেরকে গ্রন্থ/কিতাব (কোরআন), বিজ্ঞান শিক্ষা দেয় এবং প্রজ্ঞা/وَيُعَلِّمُكُمُ ٱلۡكِتَٰبَ وَٱلۡحِكۡمَةَ/and teaching you the Book and wisdom" এর পরের লাইনে [পবিত্র কোরআন ২:১৫১ এবং ৩:১৬৪]তাহলে এইখানে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ভাবে খেয়াল করুন তো? মহান আল্লাহ কী কী শিক্ষা দেবার কথা বলেছেন?

  • কিতাব (ٱلۡكِتَٰبَ)
  • হিকমত (لۡحِكۡمَةَ)
  • এবং তোমরা যা অবগত ছিলেনা (وَيُعَلِّمُكُم مَّا لَمۡ تَكُونُواْ تَعۡلَمُونَ)

তাহলে মহান আল্লাহ্ রাসূল ﷺ কে শিক্ষা দেবার ক্ষেত্রে তিনটা বিষয়ের কথা উল্লেখ করেছেন, যার একটা হলো আল-কিতাব অর্থাৎ নির্দিষ্ট ভাবে কোরআন। আরেকটা হলো হিকমত তথা প্রজ্ঞা। সেই সাথে আরেকটা বিষয় হলো এমন কিছু যা আমরা জানতাম না। একটা কথা বলে রাখি। নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ্ একক আয়াতের মধ্যে কোন একটা কিছু একক ভাবে বোঝানোর জন্য বার বার অর্থাৎ পুনরাবৃত্তি করবেন না। অন্যথায় এটা করা মানেই বাক্যের অলংকার নষ্ট হওয়া সহ অতিরিক্ত শব্দের অপচয় হবে এবং সেই সাথে কুরআন পুনরাবৃত্তির দোষে দুষ্ট (নাউজুবিল্লাহ; আস্তাগফিরুল্লাহ)। 

কিতাবের ক্ষেত্রে: আল কিতাব (ٱلۡكِتَٰبَ) বলতে নির্দিষ্ট ভাবে কোরআন মাজীদকেই বোঝানো হয়েছে যা আমরা সকলেই একমত এবং এটা কমন সেন্স থেকেই বোঝা যায়। আর কোরআনের বৈশিষ্ট্য কী? এটা নিজেই নিজে হচ্ছে পরিপূর্ণ জ্ঞান।

প্রজ্ঞার ক্ষেত্রে: এটা দ্বারা এমন কিছু বোঝানো হয়েছে যার জ্ঞান সহ এর প্রয়োগিক বিষয়-বস্তু, রীতি নীতি এবং এর পদ্ধতি সমূহ ইত্যাদি রাসূল ﷺ আমাদের কে শিক্ষা দিবেন। আর এটাই হলো "لۡحِكۡمَةَ/প্রজ্ঞা" যেটাকে ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়েছে (wisdom) বলে যা আরবি শব্দের যথার্থ অর্থ প্রকাশ করে না। কেননা ইংরেজি শব্দ wisdom এর অর্থ হলো জ্ঞান, অপরদিকে আরবি শব্দ হিকমতের অর্থ ব্যাপক। হিকমত শব্দটি আরবি অভিধানে একাধিক অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে, যেমন সত্যে উপনীত হওয়া, ন্যায় ও সুবিচার, জ্ঞান ও প্রজ্ঞা ইত্যাদি। আবার জ্ঞান ও প্রজ্ঞার মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে। ইমাম রাগিব বলেছেন, এ শব্দটি মহান আল্লাহর জন্য ব্যবহৃত হলে এর অর্থ হয় সকল বস্তুর পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান ও সুদৃঢ় উদ্ভবন। অন্যের জন্য ব্যবহৃত হলে এর অর্থ হয় বিদ্যমান বিষয় বস্তু সমূহের বিশুদ্ধ জ্ঞান, সৎ কর্ম, ন্যায়, সুবিচার, সত্য কথা ইত্যাদি। তো পবিত্র কোরআনে এই শব্দটি বহু কিছুর জন্য ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। এখন লক্ষ্য করা দরকার এই আয়াতে হিকমতের অর্থ কী? এটা দ্বারা কোরআন কে বুঝিয়েছে নাকি অন্য কিছু? কেননা ২:১৫১ নং আয়াতে কিতাব (কোরআন) এবং হিকমা কে নির্দিষ্ট করে আলাদা করা হয়েছে و-ওয়া দ্বারা যা বারংবার বলেছি। উল্লেখ্য যে পবিত্র কোরআন নিজেই জ্ঞানে পরিপূর্ণ। এইখানে যদি হিকমা দ্বারা কোরআন কে বোঝানো হতো তাহলে ওয়া দ্বারা আলাদা করা হতো না এবং কি কেবলমাত্র কিতাব উল্লেখ করলেই যথেষ্ট হয়ে যেত; আবার মহান আল্লাহ্ অযথা শব্দের অথচয় করেন না। কিন্তু মহান আল্লাহ্ সেটাও বলেননি। তিনি কিতাব এবং হিকমা দুটো শব্দই উল্লেখ করেছেন তবুও "ওয়া" দ্বারা আলাদা করে

এখন এইখানে হিকমত দ্বারা কী উদ্দেশ্য নেওয়া হয়েছে? আসলে হিকমত দ্বারা রাসূল ﷺ এর সুন্নাহ কে বোঝানো হয়েছে। বিখ্যাত মুহাদ্দিস আবুল ফিদা হাফিজ ইবনে কাসীর রহঃ ও ইবনে জারির রাহিঃ কাতাদা রাঃ থেকে এ ব্যাখ্যাই গ্রহণ করেছেন। হাসান বসরী রহঃ, মুকাতিল ইবনে হিব্বান রহঃ, আবু মালিক রহঃও এ কথাই বলেছেন "[তাফসীর ইবনে আবী হাতিম ১/১৯০]।

আবার কেউ "وَٱلۡحِكۡمَةَ/হিকমত" বলতে কোরআনের তাফসীর, কেউ দ্বীনের গভীর জ্ঞান, কেউ ইসলামী শরিয়তের যাবতীয় বিধিবিধানের পরিপূর্ণ প্রয়োগিক জ্ঞান বলেছেন অর্থাৎ নিশ্চয়ই এসব উক্তির মূল সারমর্ম হলো রাসূল ﷺ এর সুন্নাহ তথা হাদিস। তাহলে আয়াতের অর্থ দাঁড়ায়:

"...তিনি তোমাদের নিকট আমার নিদর্শনাবলী পাঠ করে এবং তোমাদেরকে পবিত্র করে, তোমাদেরকে শিক্ষা দেয় কিতাব তথা কোরআন এবং হিকমা তথা দ্বীন ইসলামের পূর্ণাঙ্গ প্রয়োগিক জ্ঞান, এর ব্যাখ্যা, রীতি নীতি, পদ্ধতি ইত্যাদিএটার স্বীকৃতিও কোরআনের মধ্যে আছে।

...(হে মুহাম্মদ সাঃ) তোমার প্রতি কোরআন- (ٱلذِّكۡرَ/যিকর্) অবতীর্ণ করেছি মানুষকে স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য- (لِتُبَيِّنَ/that you may make clear)." [পবিত্র কোরআন ১৬:৪৪]

নোট: যতগুলো তাফসীর আছে এর সবগুলোতেই "হিকমত" বলতে আল্লাহর রাসূল ﷺ এর সুন্নাহ কে বোঝানো হয়েছে।

তাহলে এইখানে মহান আল্লাহ্ বলেছেন, "রাসূল "তোমাদেরকে গ্রন্থ> (i. কোরআন) এবং হিকমা> (ii. দ্বীন ইসলামের পূর্ণাঙ্গ প্রয়োগিক জ্ঞান, রীতি-নীতি, কর্ম-পদ্ধতি, বাস্তবে প্রয়োগ করার জ্ঞান) শিক্ষা দেন। অর্থাৎ হিকমা বলতে বোঝায় জ্ঞানকে হৃদয়ঙ্গম করে, নিজের অভিজ্ঞতা দ্বারা এর সুফলকে, বাস্তবে প্রয়োগ করার মতো শক্তির সমন্বিত রুপকে বোঝায় যা রাসূল ﷺ নিজের কর্মময় জীবনে প্রয়োগ করে দেখিয়ে দিয়েছেন আমাদের কে। আর উনার এই কর্মময় জীবনের আদেশ-নিষেধ, উপদেশ, রীতি নীতি, প্রয়োগিক শিক্ষাটাই হলো কোরআন সংশ্লিষ্ট এবং এর উত্তম ব্যাখ্যা যাকে বলতে পারি রাসূল ﷺ এর অভিজ্ঞতা লদ্ধ প্রয়োগিক জ্ঞান যা তিনি আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন। জানি এটাও নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ করতে গিয়ে অস্বীকার করবেই তথাকথিত আহলে কোরআন দাবিদাররা। সমস্যা নেই। এবার নিচে আসুন।

তোমরা যা অবগত ছিলেনা: তো পবিত্র কোরআন মাজীদের ২:১৫১ ও ৩:১৬৪ নং আয়াতের মধ্যে মধ্যে মহান আল্লাহ্ কী বলেছেন? তিনি বলেছেন, রাসূল সেটাই শিক্ষা দিবে: 

তোমরা যা অবগত ছিলেনা (وَيُعَلِّمُكُم مَّا لَمۡ تَكُونُواْ تَعۡلَمُونَ).

তাহলে এর আগে আমরা কী জেনেছি? আল্লাহ্ বলেছেন, রাসূল শিক্ষা দিবেন: কিতাব, প্রজ্ঞা; এরপরে তোমরা যা জানো না সেটা শেখাবে।" এখন তথাকথিত আহলে কোরআন দাবিদাররা বলবে যে, নাহ! এইখানে হিকমা মানেও শুধুমাত্র কোরআনকেই বোঝানো হয়েছে। আবার রাসূল সেটাই শেখাবেন যা আমরা জানতাম না অর্থাৎ এটাও কোরআন- কে বোঝানো হয়েছে। কেননা আমরা তো আসলেই কোরআন সম্পর্কে জানতাম না, যা রাসূল ﷺ আমাদের কে জানিয়েছেন। তাহলে তাদের বলি, আমরা না জানতাম কিতাব/কোরআন, আর না জানতাম হিকমত অর্থাৎ আমরা কিতাব এবং হিকমতের কিছুই জানতাম না। এখন আল্লাহ্ কী শুধুমাত্র কোরআন বোঝাতে গিয়ে একই আয়াতের মধ্যে বারংবার পুনরাবৃত্তি করবেন নাকি যে রাসূল তোমাদের কে কোরআন এবং কোরআন ও কোরআন ই শেখাবে। তাহলে তো এটা অর্থহীন প্রলাপের ন্যায়, অতিরঞ্জিত শব্দের প্রয়োগ এবং বারবার পুনরাবৃত্তির দোষে দুষ্ট হয়ে যায়; সেই সাথে বাক্যের অলংকার শূন্য হয়ে যায় আবার বর্ণনাভঙ্গিও যথার্থ রুপে উপস্থাপন হবে না। কেননা আল্লাহ্ কেবলমাত্র "কোরআন বা কিতাব" বললেই যথেষ্ট হয়ে যেত। কিন্তু না! তিনি সেটাও বলেননি। তিনি পরপর বলেছেন কিতাব, হিকমত এবং যা জানো না তাই-ই শেখাবেন। আর আমরা সহীহ হাদিস পড়লেই জানতে পারি রাসূল ﷺ কোরআন ছাড়াও আরো একটি জিনিস আমাদের কে শিক্ষা দিয়েছেন। কেননা কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ শরীয়তের মূল উৎস এবং একটি অপরটির পরিপূরক। সহীহ হাদীস ছাড়া কখনো শরীয়ত পূর্ণভাবে চলতে পারে না। যারা বলে- আমরা কুরআনে যা কিছু পেয়েছি তা-ই আমাদের জন্য যথেষ্ট; তারা পথভ্রষ্ট ছাড়া কিছুই নয়। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছে:

أَلَا إِنِّي أُوتِيتُ الْقُرْآنَ وَمِثْلَهُ مَعَهُ

সাবধান! জেনে রেখ! আমি কুরআন ও অনুরূপ আরো পেয়েছি।" [মুসনাদ আহমাদ হা. ১৭১৭, সহীহ]

আর এই অনুরূপ জিনিসটাই হলো রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সুন্নাহ হাদিস, যার কথা বলা হয়েছে ২:১৫১ ও ৩:১৬৪ নং আয়াতের মধ্যে রাসূল সেটাই শিক্ষা দিবে:... তোমরা যা অবগত ছিলেনা (وَيُعَلِّمُكُم مَّا لَمۡ تَكُونُواْ تَعۡلَمُونَ). এখন কোরআন বহির্ভূত কেন তাঁর কথা মানব? কারণ পবিত্র কোরআনের ৫৩ নং সূরা আন-নাজমের ৩ নং আয়াতে এরশাদ করা হয়েছে :

وَمَا يَنطِقُ عَنِ ٱلۡهَوَىٰٓ

এবং সে মনগড়া কথাও বলে না।" [অনুবাদক: মুজিবুর রহমান]

এ আয়াত থেকে এটাও প্রমাণিত হয় যে, দীনের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) নিজস্ব মনগড়া কোন কথা বলতেন না। যা বলতেন ওহী প্রাপ্ত হয়েই বলতেন। এই জন্য আমরা হাদিস শাস্ত্রকে এত বড় দেখি যাতে মানবজাতির জন্য জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে রাসূল ﷺ এর নির্দেশনা পাই। আপনি পানির গ্লাস ডান হাতে না বাম হাতে ধরবেন, দাঁড়িয়ে নাকি বসে পান করবেন, পান করার সময় পানির পাত্রে নিঃশ্বাস ছাড়বেন কি ছাড়বেন না, এসবেরও পর্যন্ত রাসূল ﷺ এর নির্দেশনা রয়েছে। এক কথায় মানব জীবনের সঙ্গে ওৎপ্রোৎভাবে জড়িত প্রত্যেকটি বিষয় সম্পর্কে তিনি আমাদের কে অবগত করেছেন যা কিনা সহীহ হাদিস পাঠ করলে অহরহ জানা যায়। কোন একজন ইহুদি বলেছিল, মুহাম্মদ তাঁর অনুসারীদের সব কিছুই শেখায় এবং কি পায়খানায় যাওয়ার নিয়মটাও। যা হযরত সালমান ফার্সি রাঃ এর কাছে এইভাবে মন্তব্য করেছিলেন যার প্রমাণ নিচে দেওয়া হল:

حَدَّثَنَا مُسَدَّدُ بْنُ مُسَرْهَدٍ، حَدَّثَنَا أَبُو مُعَاوِيَةَ، عَنِ الأَعْمَشِ، عَنْ إِبْرَاهِيمَ، عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ يَزِيدَ، عَنْ سَلْمَانَ، قَالَ قِيلَ لَهُ لَقَدْ عَلَّمَكُمْ نَبِيُّكُمْ كُلَّ شَىْءٍ حَتَّى الْخِرَاءَةَ ‏.‏ قَالَ أَجَلْ لَقَدْ نَهَانَا صلى الله عليه وسلم أَنْ نَسْتَقْبِلَ الْقِبْلَةَ بِغَائِطٍ أَوْ بَوْلٍ وَأَنْ لاَ نَسْتَنْجِيَ بِالْيَمِينِ وَأَنْ لاَ يَسْتَنْجِيَ أَحَدُنَا بِأَقَلَّ مِنْ ثَلاَثَةِ أَحْجَارٍ أَوْ يَسْتَنْجِيَ بِرَجِيعٍ أَوْ عَظْمٍ ‏.

সালমান (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ বর্ণনাকারী আবদুর রহমান বলেন, সালমান (রাঃ) কে বলা হলো, তোমাদের নবী (ﷺ) তোমাদেরকে সবকিছুই শিক্ষা দিয়েছেন, এমন কি পায়খানা করার নিয়মও। সালমান (রাঃ) বললেন, হ্যাঁ। রসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদেরকে নিষেধ করেছেন ক্বিবলাহমুখী হয়ে পেশাব-পায়খানা করতে, ডান হাতে শৌচ করতে, শৌচকার্যে আমাদের কারো তিনটি ঢিলার কম ব্যবহার করতে এবং গোবর অথবা হাড় দ্বারা শৌচ করতে।" [সুনানে আবু দাউদ, পবিত্রতা অধ্যায়ের ৭ নং হাদিস]

অনলাইন সোর্স থেকে পড়তে ক্লিক করুন

অর্থাৎ এই হাদিস থেকেই প্রমাণিত রাসূল ﷺ মহান আল্লাহ্ থেকে শুধু কুরআন-ই ওহী পাননি; বরং ওহীর মাধ্যমে আমাদের জন্য বিভিন্ন নির্দেশনাও পেয়েছেন যা তিনি আমাদের কে অবগত করেছেন। এই জন্যই তো মহান আল্লাহ বলেছেন, রাসূল কোরান এবং হিকমত- সহ আরো কিছু শেখাবেন যা তোমরা জানতে না [পবিত্র কোরআন ২:১২৯ ও ৩:১৬৪]। আল্লাহ্ তাঁর রাসূল ﷺ কে সব কিছুই অবগত করিয়ে দিয়েছেন বিধায় আমরাও তা জানতে পেরেছি সহীহ হাদিসের মাধ্যমে। এরপরেও তথাকথিত আহলে কোরআন দাবিদাররা অস্বীকার করে বলবে যে, না, এটাও হাদিস না বরং কোরআন কে বোঝানো হয়েছে। আচ্ছা ঠিক আছে। তাদের বুঝ অনুযায়ী আমরা উক্ত বাক্যের স্থলে কোরআন বসিয়ে বাক্য তৈরি করে দেখি অর্থ কিরুপ হয়? সেই আয়াতটার উদ্ধৃতি: ২ নং সূরা আল বাকারার ১৫১ নং আয়াতে এরশাদ করেছেন:

 وَيُزَكِّيكُمْ وَيُعَلِّمُكُمُ ٱلْكِتَٰبَ وَٱلْحِكْمَةَ وَيُعَلِّمُكُم مَّا لَمْ تَكُونُوا۟ تَعْلَمُونَ

আমি তোমাদের মধ্য হতে এরূপ রাসূল প্রেরণ করেছি যে তোমাদের নিকট আমার নিদর্শনাবলী পাঠ করে এবং তোমাদেরকে পবিত্র করে, তোমাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেয় এবং তোমরা যা অবগত ছিলে না তা শিক্ষা দান করে।" (এই একই কথা বলা হয়েছে অন্যত্রে ৩:১৬৪ নং আয়াতে)
Just as We have sent among you a messenger from yourselves reciting to you Our verses and purifying you and teaching you the Book and wisdom and teaching you that which you did not know.

এইখানে রাসূল ﷺ যা শিক্ষা দিবেন আল্লাহ্ তা উল্লেখ করেছেন:

  • গ্রন্থ/কিতাব;
  • এবং হিকমত/প্রজ্ঞা;
  •  এবং যা তোমরা জানতে না তাই শিক্ষা দান করে

এখন কিতাব বলতে পবিত্র কোরআন কেই বোঝানো হয়েছে যা আমরা সবাই এক বাক্যে স্বীকার করি। কিন্তু তথাকথিত আহলে কোরআন মিথ্যা দাবিদাররা আবার হাদিস মানে না। তো তাদের দাবি অনুযায়ী এর সব কিছুই শুধুমাত্র কোরআনকেই বোঝানো হয়েছে। আচ্ছা তাদের দাবি মেনে নিয়ে "হিকমত এবং যা তোমরা জানতে না তাই অবগত করে" স্থলে "কিতাব/কোরআন" বসাই তাহলে বাক্যটি কিভাবে অতিরঞ্জিত শব্দের প্রয়োগ হয়ে অলংকার শূন্যে পরিণত হয় তা দেখা যাক:

"আমি তোমাদের মধ্য হতে এরুপ রাসূল প্রেরণ করেছি যে তোমাদের নিকট আমার নিদর্শনাবলী পাঠ করে এবং তোমাদেরকে পবিত্র করে, তোমাদেরকে শিক্ষা দেয় কোরআন এবং কোরআন এবং কোরআন যা তোমরা জানতে না।"

আচ্ছা ভাই, কিতাব মানেই তো কোরআন যেটা বললেই হয়ে যেত। কিন্ত এইখান আল্লাহ্ যদি সত্যিই সবগুলো দ্বারা শুধুমাত্র কোরআন- কেই বোঝাতো, তাহলে তো তিনি এত শব্দের অপচয় করতেন না, যা কিনা বাক্যের অলংকারকেই নষ্ট করে দেয়, আবার অতিরিক্ত শব্দের প্রয়োগ হয়ে বাক্যের ভাবধারা নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু আল্লাহর বাক্য তো শ্রুতিমধুর, অলংকারপূর্ণ, গভীর তাৎপর্যময়। কাজেই তিনি অতিরিক্ত শব্দের প্রয়োগ করেন নাই তাঁর বাক্যে। সুতরাং কিতাব বলার পরে আবার নতুন করে কোরআন কে বোঝানোর জন্য তিনি হিকমত এবং এরপরের শব্দ গুলো নাযিল করতেন না।

কিন্তু তিনি তো নাযিল করেই ফেলেছেন। এখন কী হবে? আসলে আহলে কোরআন মিথ্যা দাবিদারদের মনগড়া বুঝ-ই সম্পূর্ণটাই ভুল সকল দিক থেকে। আল্লাহ্ "কিতাবের" পরে হিকমত এবং এরপরের শব্দগুলো দ্বারা কোরআনকে বোঝান নাই। বরং রাসূল ﷺ এর শিক্ষা তথা হাদিসকেই বুঝিয়েছেন (আল্লাহু আলাম)। আর রাসূল ﷺ এর কাছে কেবলমাত্র কোরআন-ই ওহী আসত না বরং বিভিন্ন বিষয়ে নির্দেশনাও ওহী নাযিল হতো কোরআনের বাইরে, যার প্রমাণ [পবিত্র কোরআন ৪২:৫১]

সুতরাং পবিত্র কোরআনের ২:১২৯ ও ৩:১৬৪ নং আয়াতে "الكتب/কিতাব" বলার পরে "حكمت/হিকমত" দ্বারা উদ্দেশ্য হলো রাসূল ﷺ নিজের অভিজ্ঞতা দ্বারা এর সুফলকে বাস্তবে প্রয়োগ করার রীতি-নীতি ও এর পদ্ধতি সমূহ তাঁর নিজের অনুশীলনের দ্বারা শিখিয়ে দিবেন সরাসরি যে, কিভাবে মহান আল্লাহর বিধিবিধান কে বাস্তবে পরিণত করতে হবে তাঁর প্রয়োগিক শিক্ষা যা আমরা জানতে পারি তাঁর দেওয়া হাদিস থেকে।

অর্থাৎ নিজস্ব অর্জিত জ্ঞান > বাস্তব অভিজ্ঞতা = হিকমত। এর মানে নিজের জ্ঞান কে বাস্তবে সঠিক ভাবে প্রয়োগ করাটাই হচ্ছে হিকমত বা প্রজ্ঞা

এই যেমন অনেকেই বলে থাকে, লোকটি প্রজ্ঞা সম্পন্ন। এর অর্থ কী? আসলে এর অর্থ হলো, "যে কোন পরিস্থিতিতে লোকটা তাঁর জ্ঞান কে সঠিক ভাবে সঠিক জায়গায় প্রয়োগ করতে পারেন। আর সঠিক ভাবে প্রয়োগ করতে হলে এর সঠিক পদ্ধতি, রীতি-নীতি, কায়দা-কানুন সমূহও জানতে হবে।

এখন কোরআন হলো জড় বস্তু। কোরআন নিজে নিজেই হচ্ছে জ্ঞান, এটা কেবলমাত্র তাত্ত্বিক জ্ঞান। তো কোরআন জড়-বস্তু হয়ে এটা নিজেই নিজের জ্ঞানকে সঠিক ভাবে সঠিক জায়গায় প্রয়োগ করতে পারবে কী? অবশ্যই না। এরমানে এর জ্ঞানকে প্রয়োগ করার জন্য একটা জলজ্যান্ত বুদ্ধিসম্পন্ন রোল মডল দরকার। আর সেই লোকটিই হলেন প্রিয় রাসূল ﷺ। আর তিনি এর জ্ঞানকে সঠিক ভাবে প্রয়োগ করে নিজের অভিজ্ঞতা দ্বারা তাঁর সাহাবীগণকে শিক্ষা দিয়েছিলেন যা আমরা সহীহ হাদিস পড়লেই জানতে পারি।

আর "তোমরা যা অবগত ছিলে না তা শিক্ষা দান করে" এর অর্থ হলো হাদিসের জ্ঞান। কেননা মহান আল্লাহ্ রাসূল ﷺ এর উপর শুধুমাত্র কোরআন-ই ওহী করেননি বরং তিনি কোরআন ব্যতীত বহু নির্দেশনা, শিক্ষার জ্ঞান ওহী করেছেন যেটাও আমরা হাদিস থেকেই জানতে পারি অর্থাৎ আমরা কেবলমাত্র পবিত্র কোরআন পাঠের মাধ্যমে যা কিছু সরাসরি জানতে পারি না, তার অনেক কিছুই সহীহ হাদিস থেকেই জানতে পেরেছি আলহামদুলিল্লাহ। আর এই জন্যই তো হাদিস শাস্ত্র এত বিশাল।

জানি এত দলিল প্রমাণ দেওয়ার পরেও তারা অজ্ঞতাবশত নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ করতে গিয়ে কোরআনের আয়াতকে সঠিক ভাবে উপলব্ধি করতে পারবে না যতক্ষণ না আল্লাহ্ তাদের সঠিক বুঝ দেন। আচ্ছা আরো কিছু দেখা যাক। তো তাদের উচিত মেনে না নিলে আমাদের দলিল প্রমাণের আলোকে যৌক্তিক ভাবে খন্ডন করে দেওয়া যেন আমরাও সঠিক-বেঠিক সম্পর্কে জানতে পারি ইনশাআল্লাহ। এছাড়া পবিত্র কোরআনে এই হিকমত শব্দটি বহুবার ব্যবহৃত হয়েছে। তো পবিত্র কোরআনের ২ নং সূরা আল বাকারার ২৬৯ নং আয়াতে বলা হয়েছে:

يُؤۡتِى ٱلۡحِكۡمَةَ مَن يَشَآءُۚ وَمَن يُؤۡتَ ٱلۡحِكۡمَةَ فَقَدۡ أُوتِىَ خَيۡرًا كَثِيرًاۗ وَمَا يَذَّكَّرُ إِلَّآ أُوْلُواْ ٱلۡأَلۡبَٰبِ

তিনি যাকে ইচ্ছা প্রজ্ঞা দান করেন এবং যাকে প্রজ্ঞা দান করা হয় সে নিশ্চয়ই প্রচুর কল্যাণ লাভ করে; বস্ত্ততঃ জ্ঞানবান ব্যক্তিগণ ব্যতীত কেহই উপলদ্ধি করতে পারেনা।" [অনুবাদক: মুজিবুর রহমান]

এই আয়াতেও "ٱلۡحِكۡمَةَ/হিকমত" শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে যার অর্থ হলো "প্রজ্ঞা"। তো এখানে আল্লাহ্ বলেছেন,"তিনি যাঁকে ইচ্ছে প্রজ্ঞা দান করেন...।"এইখানে কী তাহলে প্রজ্ঞা মানে কিতাব তথা গ্রন্থ বোঝানো হয়েছে নাকি? ঠিক যেমনটা ২:১২৯ ও ১৫১ নং আয়াতের ক্ষেত্রে তথাকথিত আহলে কোরআন দাবিদাররা বলে যে, ঐখানে প্রজ্ঞা বলতে কোরআন উদ্দেশ্যে অথচ ২:১২৯, ১৫১ নং আয়াতে কিতাব শব্দের পরেই و দ্বারা বিভক্ত করা হয়েছে হিকমত শব্দ কে। তাদের দাবিনানুযায়ী যদি প্রজ্ঞা বলতে কোরআন ধরে নেই তাহলে তো ২:২৬৯ নং আয়াতে তো "প্রজ্ঞা" বলতে কিতাব হয়ে গেল অর্থাৎ আল্লাহ্ যাঁকে ইচ্ছে কিতাব দান করেন এবং যাঁকে কিতাব দান করা হয় সে নিশ্চয়ই প্রচুর কল্যাণ লাভ করে।" যদি এমনটা হয় তাহলে আমরা বলব, এটা অবশ্যই ভুল। কেননা এইখানে কোন রাসূল সম্পর্কেও কথা বলা হয় নাই। আবার আল্লাহ্ রাসূল ব্যতীত কাউকে কিতাব দেনও না। অর্থাৎ তাদের পুরো দাবিটাই অসাড় অযৌক্তিকতাপূর্ণ। আবার পবিত্র কোরআনের ৩১ নং সূরা লুকমানের ১২ নং আয়াতে এরশাদ করেছেন:

وَلَقَدْ ءَاتَيْنَا لُقْمَٰنَ ٱلْحِكْمَةَ أَنِ ٱشْكُرْ لِلَّهِۚ وَمَن يَشْكُرْ فَإِنَّمَا يَشْكُرُ لِنَفْسِهِۦۖ وَمَن كَفَرَ فَإِنَّ ٱللَّهَ غَنِىٌّ حَمِيدٌ

আর আমি তো লুকমানকে হিকমাত দিয়েছিলাম (এবং বলেছিলাম) যে, ‘আল্লাহর শুকরিয়া আদায় কর। আর যে শুকরিয়া আদায় করে সে তো নিজের জন্যই শুকরিয়া আদায় করে এবং যে অকৃতজ্ঞ হয় (তার জেনে রাখা উচিত) আল্লাহ অমুখাপেক্ষী, প্রশংসিত’।" [অনুবাদক: মুজিবুর রহমান]

তো এই আয়াতে আবার মহান আল্লাহ্ লুকমান (আল্লাহ রহম করুন তাঁকে) কে " ٱلْحِكْمَةَ/হিকমত" দিয়েছিল। তো সাধারণ অর্থে এইখানে বোঝাই যাচ্ছে আল্লাহ্ তাঁকে জ্ঞান দান করেছিলেন but not the holy book. এখানে আমার প্রশ্ন হলো পবিত্র কোরআনের ২:১২৯ ও ১৫১ নং আয়াতে "الكتب/কিতাব" বলতে নিশ্চিত পবিত্র কোরআনকেই বোঝানো হয়েছে। তো পবিত্র কোরআন নিজেই জ্ঞানে পরিপূর্ণ যাকে বলতে পারি এটা নিজেই জ্ঞান। তাহলে এরপর আবার و (ওয়া) শব্দের পরে কেন আলাদা করে "حكمت/হিকমত" (প্রজ্ঞা) বলতে যাবে আল্লাহ্, যদি হিকমত দ্বারা কোরআন উদ্দেশ্য হয়? জানি এর কোন লজিক্যাল উত্তর দিতে পারবে না তথাকথিত আহলে কোরআন দাবিদাররা। কারণ অপব্যাখ্যার আশ্রয় নিলে কোন উত্তর দিতে না পারার-ই কথা। আসলে ২:১২৯, ১৫১ নং আয়াতে জ্ঞানগর্ভ কিতাব (কোরআন) এর উল্লেখ করার পরে و-(ওয়া) দ্বারা আলাদা করা হয়েছে "حكمت/হিকমত কে। আর এটা দ্বারা রাসূল ﷺ এর সুন্নাহ তথা হাদিসকেই বোঝানো হয়েছে।

হিকমত এবং জ্ঞানের পার্থক্য: আসুন আমরা একটা হাদিস দেখি। তো হাদিসটা বর্ণিত হয়েছে সুনানে আন নাসাই এর সালাত অধ্যায়, সালাত কোথায় ফরজ হয়েছে পরিচ্ছেদের ৪৫২ নং হাদিসে:

أَخْبَرَنَا سُلَيْمَانُ بْنُ دَاوُدَ، عَنِ ابْنِ وَهْبٍ قَالَ: أَخْبَرَنِي عَمْرُو بْنُ الْحَارِثِ، أَنَّ عَبْدَ رَبِّهِ بْنَ سَعِيدٍ حَدَّثَهُ، أَنَّ الْبُنَانِيَّ حَدَّثَهُ، عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ، أَنَّ «الصَّلَوَاتِ فُرِضَتْ بِمَكَّةَ»
وَأَنَّ «مَلَكَيْنِ أَتَيَا رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ , فَذَهَبَا بِهِ إِلَى زَمْزَمَ، فَشَقَّا بَطْنَهُ , وَأَخْرَجَا حَشْوهُ فِي طَسْتٍ مِنْ ذَهَبٍ، فَغَسَّلَاهُ بِمَاءِ زَمْزَمَ، ثُمَّ كَبَسَا جَوْفَهُ حِكْمَةً وَعِلْمًا»

আনাস ইব্‌ন মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ: সালাত মক্কায় ফরয হয়েছে। দু‘জন ফেরেশতা রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) -এর নিকট আসেন। ফেরেশতাদ্বয় তাঁকে নিয়ে যমযমের নিকট যান। তারা তাঁর পেট বিদীর্ণ করেন এবং তাঁর ভেতরের বস্তু বের করে স্বর্ণের পাত্রে রাখেন ও যমযমের পানি দ্বারা ধৌত করেন। তারপর তাঁর মধ্যে ইলম ও হিকমত পূর্ণ করে দেন।

তাহলে আমরা এই হাদিসটির একদম শেষে দেখি "ইলম্ ও হিকমত'' কে ওয়া দ্বারা পৃথক করা হয়েছে অর্থাৎ দুটো শব্দই ভিন্ন জিনিস তা বোঝা যাচ্ছে। অর্থাৎ আল্লাহর রাসূল ﷺ কে ইলম্ তথা জ্ঞানে এবং হিকমত তথা প্রজ্ঞায় পূর্ণ করে দিয়েছেন। এইখানে "عِلْمًا/ইলম্" মানেই হলো জ্ঞান এবং "حِكْمَةً/হিকমত" শব্দের অর্থ হলো প্রজ্ঞা। এখন আগেই বলেছি জ্ঞান এবং হিকমতের মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে। কোন কিছু সম্পর্কে সম্যক ধারণা করার মতো শক্তি বা বোধকেই জ্ঞান বলে অথবা যে কোন কিছু সম্পর্কে জানাটাই জ্ঞান। আর প্রজ্ঞা জিনিসটা কী? প্রজ্ঞা হলো এই জ্ঞানকে হৃদয়ঙ্গম করে, নিজের অভিজ্ঞতা দ্বারা এর সুফলকে, বাস্তবে প্রয়োগ করার মতো শক্তিকে বোঝায়।

তাহলে পবিত্র কোরআনের ২:১২৯ ও ১৫১ নং আয়াতে "الكتب/কিতাব" বলতে পবিত্র কোরআনকে বোঝানো হয়েছে যা নিজেই হচ্ছে জ্ঞান অর্থাৎ ইলমী গ্রন্থ। যদি তাই হয় তাহলে তথাকথিত আহলে কোরআন দাবিদারদের কাছে প্রশ্ন সেখানে কিভাবে হিকমত দ্বারা আল্লাহর রাসূল এর রীতি-নীতি বা কর্মপদ্ধতি তথা হাদিস-সুন্নাহ্ হতে পারে না??? কেননা রাসূল ই সেই ইলমী গ্রন্থ তথা কোরআনের জ্ঞানকে হৃদয়ঙ্গম করে, নিজের অভিজ্ঞতা দ্বারা এর সুফলকে, বাস্তবে প্রয়োগ করেছিলেন যেটা হলো প্রজ্ঞা। আর রাসূল কিভাবে এই কিতাবের জ্ঞান কে ধারণ করে তা তাঁর পবিত্র কর্মময় জীবনে অনুশীলনের মাধ্যমে প্রয়োগ করে আমাদের কে দেখিয়ে দিয়েছেন সেটাই হচ্ছে সুন্নাহ তথা আল হাদিস। অর্থাৎ রাসূল কোরআন মানার তরিকা-পদ্ধতিসমূহ তাঁর অনুশীলনময় জীবনের মাধ্যমে শিক্ষা দিয়ে গেছেন যেটাকে বলা হয়েছে প্রজ্ঞা অর্থাৎ তিনিই তোমাদের কে হিকমাহ শিক্ষা দিবেন। আর রাসূল সেটাই করেছিলেন।

একটা বিষয় দেখা যাক: "তারপর তাঁর মধ্যে ইলম ও হিকমত পূর্ণ করে দেন।"

ইলম = জ্ঞান (কোন কিছু জানাটাই হলো জ্ঞান)
হিকমত = প্রজ্ঞা (এই জ্ঞানকে নিজের অভিজ্ঞতা দ্বারা বাস্তবে সঠিক ভাবে প্রয়োগ করাটাই হচ্ছে প্রজ্ঞা) অর্থাৎ এতে বাস্তবিক প্রয়োগিক পদ্ধতি সমূহ থাকতে হবে

যদি তথাকথিত আহলে কোরআন দাবিদারদের মতো বলি তাহলে ব্যাপারটা এরুপ হয়ে যায়:

ইলম = জ্ঞান
হিকমত = প্রজ্ঞা
যদি হিকমত এবং প্রজ্ঞাকে এক করে ফেলি তাহলে ২:১২৯ ও ১৫১ নং আয়াতের ভাবার্থ এমনটা হবে যদি হিকমতের স্থলে কিতাব ধরি:

"তোমাদেরকে শিক্ষা দেয় "কিতাব ওয়াল কিতাবা-(كتب والكتب)" কিতাব এবং কিতাব। অর্থাৎ বাক্যটাই আলংকারিক শূণ্য হবে। এতে একটা শব্দের পরে আবার সেম শব্দের প্রয়োগ করা মানেই অতিরিক্ত শব্দ ব্যবহার করা যা তাও আবার و-(ওয়া) ব্যবহার করে, যা বাক্যের অলংকার কে নষ্ট করে দেয়। আর মহামহিমান্বিত আল্লাহ্ও পবিত্র কোরআনে একটা শব্দেরও অথচয় করেননি অযথা।

সর্বোপরি পবিত্র কোরআন বোঝানোর দায়িত্ব মহান আল্লাহ্ তাঁর রাসূল ﷺ কে দিয়েছেন ১৬:৪৪]; আর তিনিও তা বুঝিয়ে দিয়েছেন বিধায় আমরা তাঁর সুন্নাহ তথা হাদিস মানি। তো সেখানে নিশ্চিত তথাকথিত আহলে কোরআন দাবিদাররা আমার এই লেখা খন্ডন করতে অথবা এর বিরুদ্ধে কিছু বলতে অথবা এইসব আয়াত বুঝিয়ে দেবার জন্য তারা নিজেরাই নিজের মতো ব্যাখ্যা শুরু করবে। অথচ তাদের দাবি, কোরআনের ব্যাখ্যা কোরআন নিজেই। তো তাদের উদ্দেশ্যে বলি, আমি কোরআনের আলোকে এই আয়াতের যৌক্তিক ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিয়েছি হাদিস মানার গুরত্ব, আবার সহীহ হাদিসের আলোকেও বুঝিয়ে দিয়েছি কোরআনের রেফারেন্স ব্যবহার করে। এরপরেও আপনার দাবি অনুযায়ী কোরআন কে নূন্যতম ব্যাখ্যা করার অধিকার আপনার নেই যেহেতু কোরআনের ব্যাখ্যা কোরআন নিজেই। আর যদি ব্যাখ্যা করতে যান তাহলে তো সেখানে আপনাদের অবশ্যই রাসূল ﷺ এর হাদিস মানতে বাধ্য। কেননা যেখানে আপনাদের দাবি মতো রাসূল ﷺ যদি ব্যাখ্যা করার অধিকার নাই রাখে তাহলে সেখানে আপনি বুঝিয়ে দেবার জন্য ব্যাখ্যা করার কে?

এরপরও আপনারা ঘাড় ত্যাড়ার মতো উল্টো বলবেন, ভাই আপনি তো কোরআন ই বোঝেন না। উল্টো পাল্টা ব্যাখ্যা করেছেন। তাহলে আবার বলি আপনাকে আমার ব্যাখ্যাও মানতে হবে না, আবার আমিও আপনার ভুলভাল ব্যাখ্যা মানব না। যেখানে উভয়ের দাবি মতে, উভয়ের ব্যাখ্যাই উভয়ের কাছে ভুল তাহলে এইখানে আমাদের একটাই পথ আছে সঠিকতা মেনে নেওয়ার। আর সেটাই হলো আল্লাহর রাসূল ﷺ কী বলেছেন এ সম্পর্কে? তিনি কী বুঝিয়ে দিয়েছেন সেটা থেকেই আমাদের বলেন? এখন পারবেন কী কোরআন থেকেই এর সঠিকতা বোঝাতে তবুও রাসূল ﷺ এর হাদিস ছাড়াই???

এছাড়া আরো জানতে নিচে ক্লিক করুন:

The Quran defends the Sunnah - Nouman Ali Khan