উত্তর হচ্ছে- কখনোই না! আরবদেশে হিন্দু বা বৌদ্ধ ধর্ম প্রচলিত ছিলো বলে কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই।আরবে কিছু স্থানীয় পৌত্তলিক বসবাস করতো,তবে তারা হিন্দু বা সনাতন ধর্মাবলম্বী ছিলো না।তাদের দেবদেবী হিন্দুদের চেয়ে ভিন্ন ছিলো.।লাত, মানাত, উযযা, হুবাল, দুশারা প্রভৃতি ছিলো এরাবিয়ানদের পূজ্য প্রধান দেবদেবী। যেগুলো হিন্দুধর্মের ৩৩ কোটি দেবদেবীর মধ্যে একটাও নয়।
এরাবিয়ানরা কিছু স্থানীয় বানোয়াট দেবদেবীর উপাসনা করতো। আর কিছু দেবদেবী ছিলো সিরিয়া ও নাবাতিয়ানদের থেকে আমদানিকৃত
সূত্র:{https://www.britannica.com/topic/Arabian-religion}।
ভারতবর্ষের পশ্চিম দিকে হিন্দুধর্ম প্রচলিত থাকার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। বরং হিন্দুধর্মের ঐতিহাসিক রেঞ্জ হচ্ছে ভারতবর্ষ থেকে পূর্বদিকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত। আরব যেহেতু ভারতের পশ্চিমে অবস্থিত, তাই স্বাভাবিকভাবে এখানেও কখনো হিন্দুধর্ম প্রচলিত ছিলো না। নিম্নে হিন্দুধর্মের বিস্তৃতির একটি ঐতিহাসিক মানচিত্র দেয়া হলো:-
এছাড়া রাম রাজত্ব বা অখন্ড ভারত প্রতিষ্ঠার জন্য ভারতে যে উগ্রবাদী কর্মসূচি চলছে,সেই অখন্ড ভারতের মানচিত্রেও আরব নেই। দেখুন:-
◾প্রাক-ইসলামিক আরব্য দেবদেবীদের বিবরণ সম্বলিত একটি প্রচুর তথ্য সমৃদ্ধ বই হলো অষ্টম শতাব্দীতে লিখিত (৭০০-৮০০) 'কিতাবুল আসনাম' বা 'Book of idols'.
বিখ্যাত হিস্টোরিয়ান ফ্রান্সিস এডওয়ার্ড পিটার্স (Francis Edward Peters) এই বইটিকে প্রাক ইসলামিক আরব্য দেবদেবী সম্পর্কে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উৎস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। বইটিতে প্রাক ইসলামিক আরবের বিভিন্ন দেবদেবীর পরিচয় ও লিস্ট উল্লেখ আছে। এই দেবদেবীগুলোর মধ্যে একটাও ভারতীয় দেবদেবী নয়।
এছাড়া প্রাক ইসলামিক আরব্য দেবদেবীদের লিস্ট পেতে এই লিঙ্কটিও দেখা যেতে পারে- https://en.m.wikipedia.org/wiki/List_of_pre-Islamic_Arabian_deities
◾মূর্তিপূজক মানেই হিন্দু নয়। হিন্দু বলা হয় ভারত অঞ্চলের আর্যভিত্তিক প্যাগানদেরকে (পৌত্তলিক)।মিশরীয় সভ্যতা, সুমেরীয় সভ্যতা, চাইনিজ সভ্যতা প্রভৃতি অঞ্চলেও মূর্তিপূজা চালু ছিলো, যাদের দেবদেবী হিন্দুদের চেয়ে আলাদা এবং যে সভ্যতাগুলো ভারতীয় আর্য সভ্যতার চেয়েও অনেক প্রাচীন। তাদেরকে তো হিন্দু বলা যায় না।
◾হিন্দুদের মাঝে একটা ভুল ধারণা কাজ করে যে, সর্বপ্রাচীন ধর্ম হওয়া মানেই বুঝি সর্ববিস্তৃত ধর্ম হওয়া।এই ধারণাটি ভুল, কারণ প্রাচীন হওয়ার জন্য ঐতিহাসিক প্রমাণ শর্ত। সর্ববিস্তৃত হওয়া শর্ত নয়।মেসোপোটেমিয়া সভ্যতাকে বলা হয় সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতা। তার মানে কি মেসোপোটেমিয়া সভ্যতা সারা পৃথিবীব্যাপী বিস্তৃত ছিলো? কখনোই নয়। মেসোপোটেমিয়া সভ্যতা ছিলো কেবল ইরাকের কিছু অঞ্চল জুড়ে।
◾হিন্দুধর্মকে প্রাচীন বলা হয় কোন দৃষ্টিকোণ থেকে?
=> পৃথিবীতে জীবিত ধর্মীয় মতবাদগুলোর মধ্যে হিন্দুধর্মই সবচেয়ে প্রাচীন, যদিও ইসলামিক থিওরিগুলো মতে ইসলাম সবচেয়ে প্রাচীন, কারণ পূর্বের নবিদেরকেও ইসলামের অংশ গণ্য করা হয়।হিন্দুধর্ম ছাড়া বাকি প্যাগানিজমগুলো খ্রিস্টানদের কঠোর হস্তে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে,নযেগুলো ভারতীয় প্যাগানিজমের চেয়েও প্রাচীন,নযেমন: মিশরীয় প্যাগানিজম,ব্যাবিলনীয় প্যাগানিজম,গ্রীক প্যাগানিজম ইত্যাদি।ভারতীয় প্যাগানিজম (হিন্দুধর্ম)-ই কেবল মুসলিম শাসকগণের দয়ায় আজও টিকে রয়েছে। বিলুপ্ত মতবাদগুলোকে গণনার বাইরে রেখে জীবিত মতবাদগুলোর মধ্যে তুলনা করে হিন্দুধর্মকে সবচেয়ে প্রাচীন বলা হয়। বিলুপ্ত মতবাদগুলোকে গণনা করা হলে হিন্দুধর্ম বহু নিচে পড়ে যাবে।
◾আরব অঞ্চল কি হিন্দুধর্ম দ্বারা প্রভাবিত ছিলো?
ইতিহাস বলে আরব অঞ্চল কখনোই হিন্দু বা আর্যদের দ্বারা প্রভাবিত ছিলো না। আরবে কখনো আর্যদের পদধূলি পড়েনি। আর্যদের বসবাসের যেই ডিএনএ ও আর্কেওলজি ভিত্তিক রেঞ্জ আছে, আরব অঞ্চল তার সম্পূর্ণ বাইরে অবস্থিত। নিম্নে আর্যদের বসবাসের রেঞ্জ দেখানো হলো:-
আরবি ভাষাটিও ইন্দো-আর্য বা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত নয়। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার রেঞ্জের মধ্যে আরব নেই।
আরবি ভাষা ও এরাবিয়ানরা মূলত সেমিটিক ভাষা ও জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত।নিচে দেখুন:-
◾আর্কেওলজি ও ইতিহাস কি বলে?
=> আরবে যদি কখনো হিন্দুধর্মের প্রচলন থাকতো,তাহলে গোটা আরব ভূমিতে হিন্দুধর্মগ্রন্থ সমূহের মধ্যে কোনো একটির পান্ডুলিপি বা স্ক্রল অবশ্যই পাওয়া যেতো। যেমনটা ভারতের অনেক স্থানে বেদ, মহাভারত, রামায়ণ, উপনিষদ, পুরাণ প্রভৃতি গ্রন্থের অনেক প্রাচীন পান্ডুলিপি, পুঁথিলিপি,ফলকলিপি ও স্ক্রল পাওয়া যায়। কিন্তু আরবদেশে বাইবেল,ভিন্ন গসপেল, কুরআন, হাদিস, আরবি কবিতার বহু প্রাচীন পান্ডুলিপি, শিলালিপি ও স্ক্রল পাওয়া গেলেও হিন্দুধর্মের কোনো কিতাবের কোনো প্রকার পান্ডুলিপি, শিলালিপি বা স্ক্রল পাওয়া যায় নি।এটাই প্রমাণে করে আরবদেশে হিন্দুধর্ম সম্পূর্ণ অনুপস্থিত ছিলো। আবার মক্কার আশপাশ দিয়ে ও গোটা আরবে যেসকল প্রাচীন মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে,সেগুলোর একটাও ভারতীয় দেবদেবীর মূর্তি নয়। যেমনঃ মক্কার নিকটস্থ তায়েফেই লাতের মূর্তি পাওয়া গেছে। লাতের সূত্র সিরিয়া থেকে।
◾আরব ও কা'বা নামের উৎপত্তি:
দাদাদের দাবি আরব শব্দটি নাকি সংস্কৃত 'অর্ভস্থান' শব্দ থেকে এসেছে,যার মানে 'ঘোড়ার ভূমি'! এটি পুরোই হাস্যকর দাবি। কারণ আরব উটের জন্য বিখ্যাত।ঘোড়ার জন্য নয়। তাছাড়া ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা সংস্কৃতের সাথে যে আরবের কোনো যোগসূত্র নেই তা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত। বরং বিশুদ্ধ মতে, আরব শব্দটি এসেছে সেমিটিক ভাষার হিব্রু শব্দ 'আরাভা' থেকে, যার অর্থ 'মরুভূমি'। বিস্তারিত দেখুন: https://en.m.wikipedia.org/wiki/Etymology_of_Arab
দাদাদের আরেকটি দাবি, কাবা নামটি নাকি কপালেশ্বর নামের বিকৃত রূপ। অথচ আরবিতে কা'বা শব্দের সুস্পষ্ট অর্থ রয়েছে। আরবি কাবা অর্থ কিউব বা ঘনক {Hans Wehr, Dictionary of Modern Written Arabic, 1994}।বাস্তবেও কাবা দেখতে কিউব আকৃতিরই।
◾দাবি: আরবে প্রাপ্ত সরস্বতীর মূর্তি,প্রাচীন আরবি পান্ডুলিপিতে ব্রহ্মার ছবি ও তুরস্কে সংরক্ষিত 'সায়ার উল ওকুল' নামক গ্রন্থে আরবে হিন্দু দেবদেবীর পূজা প্রচলিত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়।
=> খন্ডন: প্রোপাগান্ডাবাজ কিছু হিন্দু হাঁসের পিঠে চড়া এক দেবীর মূর্তি দেখিয়ে ইদানীং দাবি করা শুরু করেছে এটা নাকি প্রাক ইসলামিক আরব্য দেবী!
অথচ গবেষকগণের মতে ওটা হলো রোমান অঞ্চলে পাওয়া গ্রীকো-রোমান দেবী আফ্রোদিতির মূর্তি, যে ছিলো গ্রীকো-রোমানদের যৌনতা ও ভালোবাসার দেবী! এর সাথে আরবদের বিন্দুমাত্র কোনো যোগসূত্র নেই।
আরেকটি ছবি তারা খুব জোরেসোরে প্রচার করে।এই ছবিটি দেখিয়ে তারা প্রমাণ করতে চায় প্রাক ইসলামিক আরবে হিন্দু দেবদেবীর (ব্রহ্মার) পূজা হতো!
কিন্তু ভালোভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায় দেবতাটি ব্রহ্মা নয়। ব্রহ্মার ৪ মাথা। কিন্তু এই দেবতার ১ মাথা। ব্রহ্মার ৪ হাত,কিন্তু এই দেবতার ৭ হাত!
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো এটা কোনো প্রাক ইসলামিক আরবি কিতাবই নয়! এটা ফারসি ভাষায় লেখা নাসির উদ্দীন তুসির একটি বইয়ের অংশ বিশেষ,যা ১৩ শতাব্দীতে লিখিত।আরবি অক্ষরের সাথে মিল পেয়ে আরবি ও ফারসিকে প্রোপাগান্ডাবাজ দাদারা গুলিয়ে ফেলেছে। এই হলো তাদের জ্ঞানের নমুনা!
আর 'সায়র উল ওকুল' নামে কোনো কিতাবের অস্তিত্ব এই পৃথিবীতে নেই! অবশ্য দাদাদের কল্পনায় থাকতে পারে। সায়র উল ওকুল নামে বানোয়াট ও কল্পিত কিতাব সম্পর্কে দাদাদের দাবির খন্ডনে বিস্তারিত জবাব এখান থেকে দেখে নিতে পারেন:{https://vedkabhed.com/index.php/2015/06/24/exposing-the-reality-of-sayar-ul-okul/}
◾হাজরে আসওয়ার বা কালোপাথরের সাথে কি হিন্দুধর্মের কোনো যোগাযোগ আছে?
হাজরে আসওয়াদ আসলে কি জিনিস এটা নিয়ে খোদ প্রোপাগান্ডাবাজ দাদারাও ঐক্যমত্যে পৌঁছাতে পারেন নি। একদল বলে শিবলিঙ্গ, আরেকদল বলে যোনী, আরেকদল বলে উল্কা! প্রকৃত সত্যটি হচ্ছে হাজরে আসওয়াদ জান্নাত থেকে পতিত একটি পাথর, যা শুরুতে দুধের চেয়েও সাদা ছিলো। জান্নাতের বস্তু পাপের স্পর্শ পেয়ে কালো হয়ে গেছে।
'বিশেষজ্ঞ' দাদারা হাজরে আসওয়াদের বাইরে রূপোর ফ্রেমের গঠনটি দেখে ওটাকেই হাজরে আসওয়াদের আসল রূপ ধরে নিয়ে বসে আছে।অথচ মূল হাজরে আসওয়াদ রূপোর ফ্রেমটিরও অনেক ভেতরে অবস্থিত,৮ টুকরো অবস্থায় হাজরে আসওয়াদকে বাঁধাই করে রাখা হয়েছে। এই খন্ডিত ৮ টি টুকরোই হলো আসল হাজরে আসওয়াদ। খন্ড খন্ড ৮ টি পাথর টুকরো কিভাবে শিবলিঙ্গ হতে পারে? আর উপরে আমরা প্রমাণ করেছি আরবে কখনো হিন্দুধর্মের প্রচলন ছিলো না।তাহলে আরবে শিবলিঙ্গ আসবেই বা কোত্থেকে?
রূপোর ফ্রেমটি নিয়েও অনেকে আপত্তি তুলে।প্রোপাগান্ডাবাজ দাদারা গোলাকার রূপোর ফ্রেমকে এডিট করে চাপা বানিয়ে প্রচার করে,যাতে তা যোনীর মতো দেখতে লাগে! নাউজুবিল্লাহ।
রূপোর ফ্রেম আসলে কিছুই না।ওটা সৌদি সরকারের বসানো এবং হাজরে আসওয়াদের কোনো অংশই নয়।অতীতে কোনো ফ্রেম ছিলো না।এখন রূপোর ফ্রেম তৈরি করে হাজরে আসওয়াদের ৮ টি টুকরোকে ভেতরে বাঁধাই করে রাখা হয়েছে এবং গোলাকার গর্ত রাখা হয়েছে যাতে মানুষ মাথা ঢুকিয়ে ভেতরে চুমো দিতে পারে,কিন্তু হাত দিয়ে নড়াচড়া দিতে না পারে।কারণ হাজীদের ধাক্কায় তা পূর্বের মতো ভেঙে যাবে।
কুরআন, হাদিস,সীরাত ও ইসলামের প্রাথমিক সূত্রগুলোতে হাজরে আসওয়াদকে কখনোই যোনী বা যৌনতার সাথে সম্পৃক্ত করা হয় নি। প্রাক ইসলামিক যুগে হাজরে আসওয়াদকে পূজা করা হতো বলেও কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। কাবার এক কোণেই সেটাকে ইব্রাহিমের নিদর্শন হিসেবে রেখে দেওয়া হয়েছিলো। হাজরে আসওয়াদকে সাড়ে ১৪০০ বছর পর এসে নতুন থিওরি দাঁড় করিয়ে যৌনতার সাথে তুলনা করা হবে, এটা হয়তো রাসুল (স), সাহাবিগণ ও ইসলামপূর্ব যুগের প্যাগানরা পর্যন্তও ভাবতে পারেনি কখনো!