জিহাদ বলতে অমুসলিমরা সাধারণত "যুদ্ধ" বুঝে থাকে। খ্রিস্টান মিশনারীরা যখনই বিতর্কে হেরে যায়, তখনই আলোচনা ঘুরাতে ইসলামের জিহাদ নিয়ে মিথ্যাচার করা শুরু করে। আজ আমরা বাইবেলের আলোকে "যুদ্ধ" সম্পর্কে জানবো। যুদ্ধ নিয়ে বাইবেলে কী কিছু বলা আছে? বাইবেলের কিছু যুদ্ধের চিত্র আপনাদের সামনে তুলে ধরছি।
ঈশ্বর নিজেকে, ঈশ্বর প্রমান করতে ১ লক্ষ ২৭ হাজার মানুষকে হত্যা করে:
23. রাজা বিন্হদদের রাজকর্মচারীরা তাঁকে বললেন, “ইস্রায়েলের দেবতারা আসলে পর্বতের দেবতা| আর আমরা পর্বতে গিয়ে যুদ্ধ করেছি তাই ইস্রায়েলের লোকরা জিতে গিয়েছে| ওদের সঙ্গে এবার সমতল ভূমিতে যুদ্ধ করা যাক, তাহলে আমরা জিতে যাবো|(রাজাবলি ১ 20:23) এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ঈশ্বর ১ লক্ষ ২৭ হাজার মানুষকে হত্যা করে।
29. সাত দিনের দিন যুদ্ধ শুরু হল| এক দিনেই ইস্রায়েলীয়রা অরামীয়দের ১০০০০০ সৈন্যকে হত্যা করল। (রাজাবলি ১ 20:29)
30. যারা বেঁচে থাকল তারা পালিয়ে অফেক শহরে আশ্রয় নিল| কিন্তু শহরের দেওয়াল ভেঙ্গে পড়ায সেই সেনাবাহিনীর আরো ২৭০০০ সৈন্যের মৃত্যু হল| বিন্হদদ ও অফেকে পালিয়ে গিয়ে একটি বাড়িতে লুকিয়ে ছিলেন|(রাজাবলি ১ 20:30)
এক রাতে ১ লক্ষ ৮৫ হাজার বিধর্মীকে হত্যা:
35. সেই রাতেই প্রভুর পাঠানো দূত গিয়ে অশূর-রাজের ১৮৫০০০ সেনা ধ্বংস করলেন| সকালে উঠে সবাই শুধু মৃতদেহ দেখতে পেল। (রাজাবলি ২ 19:35)
লক্ষ-লক্ষ মানুষকে হত্যা করতে ঈশ্বর বাধ্য করলেন:
30. “কিন্তু সীহোন, হিষ্বোনের রাজা, আমাদের তার দেশের মধ্য দিয়ে য়েতে দেননি| কারণ প্রভু তোমাদের ঈশ্বর তার মন কঠিন ও একগুঁযে করলেন যেন তিনি তাকে তোমাদের হাতে সমর্পণ করেন, য়েমন আজ পর্য়ন্ত রয়েছে!(দ্বিতীয় বিবরণ 2:30)
33. কিন্তু প্রভু আমাদের ঈশ্বর সীহোনকে আমাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন| আমরা রাজা সীহোন, তার পুত্রদের এবং তার সমস্ত লোকদের পরাজিত করেছিলাম|(দ্বিতীয় বিবরণ 2:33)
34. সেই সময় রাজা সীহোনের সব শহরগুলোই আমরা অধিকার করেছিলাম| প্রত্যেক শহরের সমস্ত লোকদের, সকল পুরুষদের, স্ত্রীলোকদের এবং ছোট ছোট শিশুদের আমরা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করেছিলাম| আমরা কাউকেই জীবিত ছেড়ে দিই নি!(দ্বিতীয় বিবরণ 2:34)
ঈশ্বরের কাছে অভিযোগ করাই ঈশ্বর সবাইকে মেরে ফেললেন:
1. লোকরা তাদের সমস্যা সম্পর্কে অভিয়োগ করা শুরু করলে প্রভু তাদের অভিযোগ শুনলেন এবং ক্ষুদ্ধ হলেন| প্রভুর কাছ থেকে আগুন এসে লোকদের মধ্যে জ্বলে উঠল| আগুন শিবিরের বাইরের দিকে কিছু কিছু এলাকা গ্রাস করল|(গণনা পুস্তক 11:1)
অন্য দেশ সম্পর্কে মন্দ কথা বলাই! ঈশ্বর তাদের হত্যা করলেন:
36. মোশি যাদের নতুন দেশ অনুসন্ধান করতে পাঠিয়েছিল তারাই ফিরে এসে ইস্রায়েলের সমস্ত লোকদের মধ্যে অভিয়োগ ছড়িয়ে দিয়েছিল| তারা বলেছিল, যে লোকরা ঐ দেশে প্রবেশ করার পক্ষে যথেষ্ট শক্তিশালী নয়, (গণনা পুস্তক 14:36)
37. সেই দেশের অখ্যাতিকারী এই লোকরাই মহামারীতে মারা পড়ল - প্রভুর ইচ্ছা অনুসারেই তা হল|(গণনা পুস্তক 14:37)
প্রশ্ন করাই ঈশ্বর তাদের হত্যা করলেন:
5. তারা প্রভু এবং মোশির বিরুদ্ধে অভিয়োগ করতে শুরু করল| লোকরা বলল, “কেন তুমি আমাদের মিশর থেকে বের করে নিয়ে এসেছো? আমরা এখানে মরুভূমিতে মারা যাবো| এখানো কোনো রুটি নেই! জল নেই! আর আমরা এই সাংঘাতিক খাদ্যকে ঘৃণা করি|”(গণনা পুস্তক 21:5)
6. এই কারণে প্রভু লোকদের মধ্যে বিষাক্ত সাপ পাঠালেন| সাপগুলো লোকদের দংশন করলে ইস্রায়েলের বহু সংখ্য়ক লোক মারা গেল|(গণনা পুস্তক 21:6)
দায়ূদের অপরাধে ঈশ্বর ৭০ হাজার লোক হত্যা করলেন মহামারি দিয়ে:
1. প্রভু ইস্রায়েলের বিরুদ্ধে আবার ক্রুদ্ধ হলেন| প্রভু দায়ূদকে ইস্রায়েলীয়দের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করলেন| দায়ূদ বললেন, “যাও, গিয়ে ইস্রাযেল এবং যিহূদার লোকসংখ্যা গণনা কর|”(সামুয়েল ২ 24:1 -15)
10. লোকসংখ্যা গণনার পর দায়ূদ লজ্জিত হলেন| দায়ূদ প্রভুকে বললেন, “আমি যা করেছি তাতে আমার মস্ত বড় পাপ হয়েছে| হে প্রভু, মিনতি করি, আপনি আমার পাপ ক্ষমা করে দিন| আমি সত্যি বোকার মত কাজ করেছি|(সামুয়েল ২ 24:10)
13. গাদ দায়ূদের কাছে এসে বলল, “তিনটি বিষযের মধ্যে থেকে একটা বেছে নাও:1. তোমার রাজ্যে সাত বছরের দুর্ভিক্ষ|2. তোমার শত্রুরা তিন মাস ধরে তোমায় তাড়া করবে|3. তোমার দেশে তিন দিনের মহামারী আসবে|এ বিষযে চিন্তা করে, তিনটের মধ্যে একটা বিষয বেছে নাও| তোমার কোনটা পছন্দ হল সে সম্পর্কে আমি প্রভুকে বলব| প্রভু আমাকে তোমার কাছে পাঠিয়েছেন|”(সামুয়েল ২ 24:13)
15. অতএব প্রভু ইস্রায়েলে একটি মহামারী পাঠালেন| এই মহামারী সকালে শুরু হল এবং মনোনীত সময় পর্য়ন্ত চলল| দান থেকে বের্-শেবা পর্য়ন্ত সারা ইস্রায়েলের 70,000 লোক মারা গেল|(সামুয়েল ২ 24:15) এই লোকগুলোর অপরাধ কী ছিলো?
ঈশ্বর ভালো মানুষদের অকারণে হত্যা করেন:
3. ইস্রায়েল দেশের প্রতি বল, ‘প্রভু এই সব কথা বলেন: আমি তোমার বিরুদ্ধে! আমি খাপ থেকে তরবারি খুলে ভাল - মন্দ সব লোককেই তোমার কাছ থেকে দূর করব!(এজেকিয়েল 21:3)
4. আমি যখন ভাল - মন্দ উভয় প্রকার লোককেই তোমা হতে উচ্ছেদ করি তখন খাপ থেকে তরবারি বের করে তা দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকের লোকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করব|(এজেকিয়েল 21:4)
5. তখন সমস্ত লোক জানবে যে আমিই প্রভু| আর এও জানবে যে আমিই খাপ থেকে তরবারি বের করেছি| আমার তরবারি কাজ শেষ না করা পর্য়ন্ত তার খাপে ফিরে যাবে না|”‘(এজেকিয়েল 21:5)
ঈশ্বর শহর পাওয়ার আশায় মানুষ হত্যা করতে সাহায্য করলেন :
1. কনানীয় রাজার নাম ছিলো অরাদ| তিনি নেগেভে বাস করতেন| রাজা অরাদ শুনেছিলেন, যে, ইস্রায়েলের লোকরা অথারীম যাওয়ার পথ ধরে এগিয়ে আসছে| এই কারণে রাজা বেরিয়ে এসে ইস্রায়েলের লোকদের ওপর আক্রমণ করলেন| অরাদ কযেকজন লোককে বন্দী করে রাখলেন|(গণনা পুস্তক 21:1)
2. তখন ইস্রায়েলের লোকরা প্রভুর কাছে এক বিশেষ শপথ করে বললেন: “প্রভু দয়া করে এইসব লোকদের পরাজিত করতে আমাদের সাহায্য করুন| যদি আপনি এটা করেন তাহলে আমরা তাদের শহরগুলো আপনাকে দেবো| আমরা তাদের সম্পূর্ণ ধ্বংস করবো|”(গণনা পুস্তক 21:2)
3. প্রভু ইস্রায়েলের লোকদের কথা শুনলেন এবং কনানীয লোকদের পরাজিত করার জন্য প্রভু ইস্রায়েলের লোকদের সাহায্য করলেন| ইস্রায়েলীয়রা কনানীযদের এবং তাদের শহরগুলো সম্পূর্ণ ধ্বংস করেছিল| |(গণনা পুস্তক 21:3)
উস্কানি দিয়ে হলেও শত্রুদের যুদ্ধ করতে বাধ্য করতে হবে! এটাই ঈশ্বরের আদেশ:
24. “প্রভু আমাকে বলেছিলেন, ‘অর্ণোন উপত্যকা অতিক্রম করে যাওয়ার জন্য তৈরী হও| হিষ্বোনে ইমোরীয়দের রাজা সীহোনকে পরাজিত করতে আমি তোমাদের সাহায্য করবো| তার দেশ অধিগ্রহণ করতে আমি তোমাদের সাহায্য করবো| সুতরাং তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হও এবং তার দেশ অধিগ্রহণ করো|(দ্বিতীয় বিবরণ 2:24)
যুদ্ধে কোন দয়া করা যাবে না তা যে কেউই হোক না কেন:
16. প্রভু, তোমাদের ঈশ্বর, যাদের পরাজিত করার জন্য তোমাদের সাহায্য করেন, তোমরা সেই সমস্ত লোকদের অবশ্যই ধ্বংস করবে| তোমার চোখ তাদের প্রতি দয়া করবে না এবং তাদের দেবতার পূজা করো না, কারণ তা তোমাদের পক্ষে ফাঁদে পড়ার মতো হবে|(দ্বিতীয় বিবরণ 7:16)
হত্যাই সব কিছু:
7. “তোমরা তোমাদের শত্রুদের তাড়া করে পরাজিত করবে এবং তরবারি দিয়ে তাদের হত্যা করবে|(লেবীয় পুস্তক 26:7)
8. তোমাদের পাঁচ জন তাদের 100 জনকে ধাওয়া করবে এবং 100 জন ধাওয়া করবে 10,000 জনকে| তোমরা তোমাদের শত্রুদের পরাজিত করবে এবং তোমাদের অস্ত্র দিয়ে তাদের হত্যা করবে|(লেবীয় পুস্তক 26:8)
শত্রু মানেই হত্যা করতে হবে অমানবিকভাবে:
6. প্রভু, আপনিই আমার ঈশ্বর| প্রভু আমার প্রার্থনা শুনুন|(সামসঙ্গীত 140:6)
8. প্রভু, ঐ লোকরা দুষ্ট| ওরা যা চায় তা ওদের পেতে দেবেন না| ওদের পরিকল্পনাকে সফল হতে দেবেন না| নতুবা ওরা শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে|(সামসঙ্গীত 140:8)
9. হে প্রভু, আমার শত্রুকে জয়ী হতে দেবেন না। (সামসঙ্গীত 140:9)
10.ওদের মাথায় জ্বলন্ত কয়লা ঢেলে দিন| আমার শত্রুদের আগুনে ফেলে দিন| ওদের কবরের মধ্যে নিক্ষেপ করুন যাতে ওরা আর ওখান থেকে উঠতে না পারে|(সামসঙ্গীত 140:10)
যুদ্ধে শত্রুদের হত্যা করে তাদের রক্ত কুকুর দিয়ে খাওয়াতে হবে:
23. তোমরা তাদের রক্তের ওপর দিয়ে হাঁটতে পারবে| তোমাদের কুকুর ওদের রক্ত চেটে খাবে|(সামসঙ্গীত 68:23)
শিশুদের টুকরো-টুকরো করে কেটে হত্যা করতে হবে:
16. শমরিয়া অবশ্যই শাস্তি পাবে| কারণ সে তার ঈশ্বরের বিরুদ্ধে গেছে| ইস্রায়েল জাতি তরবারির সাহায্যেই নিহত হবে| তাদের সন্তানদের টুকরো টুকরো করে ছিন্ন করে দেওয়া হবে| তাদের গর্ভবতী মেয়েদের ছিঁড়ে ফেলা হবে|”(হোসেয়া 13:16)
লেখা আর লম্বা করছি না, এরকম আরও আছে বাইবেলে।
ইসলাম ধর্মে জিহাদ
ইসলামে শুধু রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার জন্যই যুদ্ধ বৈধ করা হয়েছে, ধর্ম প্রচারের জন্য নয়। ইসলামে যুদ্ধের ময়দান ছাড়া কখনোই অমুসলিম হওয়ার কারণে কাউকে হত্যা করা হয়নি বা জোরপূর্বক মুসলিম বানানো হয়নি। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- এর মদীনায় আগমনের পূর্বে তথাকার অনেকের সন্তান ইহূদী ধর্ম গ্রহণ করেছিল। এরা ইসলাম গ্রহণের পরে তাদের সন্তানদেরকে ইসলাম গ্রহণের জন্য চাপ প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাদেরকে এরূপ চাপ প্রয়োগ থেকে নিষেধ করেন এবং তাদেরকে তাদের পছন্দের ধর্ম পালনের অধিকার প্রদান করেন। দীন প্রতিষ্ঠা বা দীন প্রচারের জন্য হত্যা, জিহাদ বা যুদ্ধ তো দূরের কথা কোনোরূপ শক্তিপ্রয়োগও নিষিদ্ধ।
আল্লাহ বলেছেন: لَا إِكْرَاهَ فِي الدِّينِ قَدْ تَبَيَّنَ الرُّشْدُ مِنَ الْغَيِّ فَمَنْ يَكْفُرْ بِالطَّاغُوتِ وَيُؤْمِنْ بِاللَّهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَىٰ لَا انْفِصَامَ لَهَا وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ
‘‘দীনে কোনো জবরদস্তি নেই। ভ্রান্তি থেকে সত্য সুস্পষ্ট হয়েছে। যে তাগূতকে অবিশ্বাস করবে এবং আল্লাহকে বিশ্বাস করবে সে এমন এক মযবুত হাতল ধরবে যা কখনো ভাঙ্গবে না। আল্লাহ সর্বশ্রোতা প্রজ্ঞাময়।’’[1]
মহানবী (ﷺ)-এর সময়কার ইতিহাস পড়লে যে কেউ এটা বুঝতে পারবে, ইসলামের বেশীরভাগ যুদ্ধ হয়েছে আত্মারক্ষার জন্য। মক্কার কাফেররা যখন মুসলিমদের উপর বারবার অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছিল, তখন মুসলিমরা মদিনায় আশ্রয় নেয়। মুহাম্মদ (ﷺ) যখন মক্কা বিজয় করলেন, তখন তিনি চাইলেই তার সব শত্রুকে হত্যা করতে পারতেন। অথচ তিনি তাদেরকে ক্ষমা করে দেন। আবু সুফিয়ানের মতো ব্যক্তি যে পরে মুসলিম হয়েছিল, তাকে পর্যন্ত মুহাম্মদ (ﷺ) ক্ষমা করে দেন। রাসূল (ﷺ) তাদের কারো প্রতি কোনরূপ প্রতিশোধ নিলেন না। সবাইকে উদারতা ও ক্ষমার চাদরে ঢেকে দিয়ে বললেন, ‘আজ তোমাদের উপরে কোনরূপ অভিযোগ নেই, তোমরা মুক্ত’।[2] ধর্ম প্রচারের জন্য ইসলাম কখনোই জিহাদ করতে বলেনি। কাউকে জোর করে ইসলাম গ্রহণ করানো ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। জিহাদের নামে ইসলাম কখনোই অমুসলিমদের হত্যা করতে বলেনি।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: من قتل نفسًا معاهدًا لم يَرَحْ رائحةَ الجنةِ ، وإنَّ رِيحَها ليُوجدُ من مسيرةِ أربعين عامًا
‘‘যদি কোনো ব্যক্তি মুসলিম রাষ্ট্রের মধ্যে বসবাসকারী অমুসলিম নাগরিক বা মুসলিম দেশে অবস্থানকারী অমুসলিম দেশের কোনো অমুসলিম নাগরিককে হত্যা করে তবে সে জান্নাতের সুগন্ধও লাভ করতে পারবে না, যদিও জান্নাতের সুগন্ধ ৪০ বৎসরের দুরত্ব থেকে লাভ করা যায়।’’[3]
প্রায় দেড় হাজার বৎসর ধরে মুসলিমগণ আরববিশ্ব শাসন করেছেন। সেখানে দেড় কোটিরও বেশি খৃস্টান ও কয়েক লক্ষ ইহূদী এখন পর্যন্ত বংশপরম্পরায় বসবাস করছে। ভারতে মুসলিমগণ প্রায় একহাজার বছর শাসন করেছেন, সেখানে প্রায় শতকরা ৮০ জন হিন্দু। অথচ খৃস্টানগণ যে দেশই দখল করেছেন, জোরযবরদস্তি করে বা ছলে-বলে সেদেশের মানুষদের ধর্মান্তরিত করেছেন অথবা হত্যা ও বিতাড়ন করেছেন।
বিনা কারণে নারী শিশুদের ইসলাম কখনোই হত্যা করতে বলে না–
ইব্নু ‘উমর রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর এক যুদ্ধে এক নারীকে নিহত অবস্থায় পাওয়া যায়। তখন আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নারী ও শিশুদের হত্যায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন। [4]
নারী শিশুদের হত্যা নিষেধ –
ইব্নু ‘উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, কোন এক যুদ্ধে জনৈকা মহিলাকে নিহত অবস্থায় পাওয়া যায়। তখন আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মহিলা ও শিশুদের হত্যা করতে নিষেধ করেন।[5]
রাসূলুল্লাহ্ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কোন এক যুদ্ধে একজন স্ত্রীলোককে নিহত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখতে পেয়ে এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করেন এবং যুদ্ধে নারী ও শিশুহত্যা নিষিদ্ধ করেন। (বুখারী ৩০১৫, মুসলিম ১৭৪৪) [মুয়াত্তা ইমাম মালিক, হাদিস নং ৯৫৯]
আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা) বলেন: "তোমরা নারীদের, শিশুদের ও বৃদ্ধদের হত্যা করবেনা, এমন কাওকে হত্যা করবেনা যে, শান্তি চায় ও যুদ্ধ হতে নিজ হাতকে বিরত রাখে। আর যদি তোমরা তা করে ফেল, এর মানে তোমরা সিমালংঘন করেছ " (সনদের মান : হাসান) আত-তাফসিরুস সহিহ (1/299), তাফসির ইবন আবি হাতিম (1/325) , তাফসিরুত তাবারী (3/562)।
মুসলিমরা নারী শিশুদের হত্যা করে না –
আবদুর রহমান ইবনু কা’ব (রা) থেকে বর্ণিত: ইবনু আবুল হুকাইককে যারা হত্যা করতে গিয়েছিলেন, নবী (ﷺ) তাদেরকে নারী ও শিশু হত্যা করতে নিষেধ করে দিয়েছিলেন। ইবনু কা’ব বলেন, ঐ কার্যে নিয়োজিতদের একজন বলেছেন ইবনু আবুল হুকাইকের স্ত্রী চিৎকার করে আমাদের তৎপরতা ফাঁস করে দিয়েছিল। আমি তাকে হত্যা করার জন্য তলোয়ার উঠিয়েছিলাম। কিন্তু নবী (ﷺ)-এর নিষেধাজ্ঞা মনে পড়তেই আবার নামিয়ে ফেলেছিলাম। আর তা না হলে তাকেও সেখানে শেষ করে আসতাম। [মুয়াত্তা ইমাম মালিক, হাদিস নং ৯৫৮]
জিহাদে নাক কান কেটে বিকৃত করা নিষেধ –
মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, উমার ইবনু আবদুল আযীয (রা) তাঁর জনৈক শাসনকর্তাকে লিখেছিলেন: আমি জানতে পেরেছি রাসূল (ﷺ) যখন কোন দিকে সৈন্যদল প্রেরণ করতেন তখন তাদেরকে উপদেশ দিয়ে বলতেন, কারো নাক-কান কেটে বিকৃত করো না, শিশু ও নারীদেরকে হত্যা করো না। অন্য সেনাদল ও বাহিনীকেও এই কথাগুলো শুনিয়ে দিও। [মুয়াত্তা ইমাম মালিক, হাদিস নং ৯৬১]
বিশ্বঘাতকতার জন্য বনু কুরাইযার যুদ্ধে মুসলিমরা ইহুদিদের হত্যা করা হলেও, শিশু ও নারীদের হত্যা করা হয়নি। বিনা অপরাধে ইসলাম কাউকেই হত্যা করতে বলে না; বরং উল্টো কঠোর ভাবে নিষেধ করে। জিহাদের নামে ইসলামে কোন সন্ত্রাসবাদ নেই। জিহাদ করতে হলে মুসলিম শাসকের অনুমতির প্রয়োজন হয়।
আবূ হুরাইরাহ (রা.) –এর সুত্র থেকে বর্ণিত, নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইমাম বা শাসক ঢাল সরূপ। তার নেতৃত্বে যুদ্ধ করা হয় এবং শত্রুর ক্ষতি থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়। [6]
আবূ হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, إِنَّمَ ا الإِمَامُ جُنَّةٌ يُقَاتَلُ مِنْ وَرَائِهِ
‘‘রাষ্টপ্রধান ঢাল, যাকে সামনে রেখে যুদ্ধ পরিচালিত হবে।’’[7]
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এবং খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগে রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের বাইরে মুসলিমগণ কোনো যুদ্ধ পরিচালনা করেন নি।
আল্লাহ বলেন: أُذِنَ لِلَّذِينَ يُقَاتَلُونَ بِأَنَّهُمْ ظُلِمُوا
'‘যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হলো তাদেরকে যারা আক্রান্ত হয়েছে; কারণ তাদের প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে।’’[8]
জিহাদের উদ্দেশ্য শুধু প্রাণহানি নয়, বরং জিহাদের উদ্দেশ্য যথাসাধ্য কম প্রাণহানির মাধ্যমে সর্বোচ্চ বিজয় ও শান্তি প্রতিষ্ঠা। শত্রুর শক্তি ও দুর্বলতা বিষয়ক তথ্যাদি রাষ্ট্র প্রধান যেভাবে সংগ্রহ করতে পারেন অন্য কেউ তা পারে না। ফলে তার তত্ত্বাবধানে জিহাদ কাঙ্ক্ষিত বিজয় ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়ক। এজন্য প্রসিদ্ধ মালিকী ফকীহ ও মুহাদ্দিস আল্লামা মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল্লাহ ইবনুল আরাবী (৫৪৩ হি) বলেন, ‘‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা তোমাদের সতর্কতা গ্রহণ কর এবং দলে দলে বিভক্ত হয়ে বেরিয়ে যাও অথবা একযোগে বেরিয়ে যাও। [9] এই আয়াতে মহান আল্লাহ মানুষদেরকে বিভিন্ন বাহিনীতে বিভক্ত হয়ে অথবা আমীরের (শাসকের) নেতৃত্বে একত্রিত হয়ে জিহাদে বের হওয়ার নির্দেশ দিলেন। বাহিনীতে বিভক্ত হয়ে জিহাদে গমন করলে আমীরের (শাসকের) অনুমতি ছাড়া বের হবে না। কারণ শাসক মুজাহিদদের খোঁজখবর রাখবেন এবং তাদেরকে পিছন থেকে সহায়তা করবেন। মুজাহিদগণ অনেক সময় শাসকের প্রতিরক্ষার মুখাপেক্ষী হয়ে পড়েন।’’[10]
ইমাম কুরতুবী (৬৭১ হি) একই কথা বলেছেন। তিনি বলেন:ولا تخرج السرايا إلا بإذن الإمام ليكون متجسسا لهم ، عضدا من ورائهم، وربما احتاجوا إلى درئه.– রাষ্ট্রপ্রধানের অনুমতি ছাড়া কোনো বাহিনী যুদ্ধে বের হবে না। কারণ শাসক মুজাহিদদের খোঁজখবর রাখবেন এবং তাদেরকে পিছন থেকে সহায়তা করবেন। মুজাহিদগণ অনেক সময় শাসকের প্রতিরক্ষার মুখাপেক্ষী হয়ে পড়েন।’’[11]
প্রসিদ্ধ হাম্বালী ফকীহ ইবন কুদামা আব্দুল্লাহ ইবন আহমদ (৬২০ হি) বলেন: وأمر الجهاد موكول إلى الإمام واجتهاده ويلزم الرعية طاعته فيما يراه من ذلك– ‘‘জিহাদের বিষয়টি ইমাম বা রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্বে অর্পিত এবং তার ইজতিহাদের উপর নির্ভরশীল। এ বিষয়ে রাষ্ট্রপ্রধান যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন সে বিষয়ে তার আনুগত্য করা জনগণের জন্য জরুরী।’’[12]
উপরের আলোচনা থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, কোন ব্যক্তি কাউকে হত্যা করলেই জিহাদ হয়ে পড়ে না। ইসলামে জিহাদের অন্যতম শর্ত রাষ্ট্রপ্রধানের অনুমতি। মদীনার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নেতৃত্বে মুসলিমগণ অনেক ‘কিতাল বা যুদ্ধ’ করেছেন। যুদ্ধের ময়দান ছাড়া কাফিরদের দেশে যেয়ে গোপনে হত্যা, সন্ত্রাস, অগ্নি সংযোগ, বিষ প্রয়োগ ইত্যাদি কখনোই তিনি করেননি বা করার অনুমতি প্রদান করেননি। ইসলামের চাইতে ভালো জিহাদের মূলনীতি অন্যকোন ধর্মে নেই।
রেফারেন্স:
- [1] সূরা বাকারা। ২৫৬ আয়াত।
- [2] আর-রাহীখূল মাখতূম পৃষ্ঠা: ৪০১।
- [3] বুখারী, আস-সহীহ ৩/১১৫৫, ৬/২৫৩৩; মুসলিম, আস-সহীহ ৪/২২৭৮।
- [4] সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৩০১৪।
- [5] সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৩০১৫।
- [6] সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ৪৬৬৬।
- [7] বুখারী, আস-সহীহ ৩/১০৮০ (কিতাবুল জিহাদ, বাবু উকাতালু মিন ওয়ারায়িল ইমাম); মুসলিম, আস-সহীহ ৩/১৪৭১ (কিতাবুল ইমারাহ, বাবুন ফিল ইমামি ইযা আমারা..)
- [8] সূরা (২২) হজ্জ, আয়াত ৩৯।
- [9] সূরা (৪) নিসা: ৭১ আয়াত।
- [10] ইবনুল আরাবী, আহকামুল কুরআন ২/৪১৪।
- [10] ইবন কুদামা, লুমআতুল ই’তিকাদ, পৃষ্ঠা ৩০।
- [12] ইবন উসাইমীন, আশ-শারহুল মুমতি’ আলা যাদিল মুসতানকী ৮/২২।