বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম
বিষয়: কোরআনে ভবিষ্যদ্বাণীর সত্যতা সিরিজ।
আসসালামু আলাইকুম ওয়ারহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতাহু প্রিয় ভাই ও বোনেরা। আশা করি অবশ্যই সবাই মহান আল্লাহ্ সুবাহানাহু ওয়াতা'আলার অশেষ রহমত ও দয়ায় ভালো এবং সুস্থ আছেন। আজ আমরা পবিত্র কোরআনের ভবিষ্যদ্বাণীর সত্যতা-২ পর্ব আলোচনা করব ইনশাআল্লাহু তা'আলা। মহামহিমান্বিত আল্লাহ্ সুবাহানাহু ওয়াতা'আলা পবিত্র কোরআন মাজীদের ২৪ নং সূরা আন নূর (النّور), আয়াত: ৫৫ তে এরশাদ করেছেন:-
وَعَدَ ٱللَّهُ ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ مِنكُمْ وَعَمِلُوا۟ ٱلصَّٰلِحَٰتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِى ٱلْأَرْضِ كَمَا ٱسْتَخْلَفَ ٱلَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ وَلَيُمَكِّنَنَّ لَهُمْ دِينَهُمُ ٱلَّذِى ٱرْتَضَىٰ لَهُمْ وَلَيُبَدِّلَنَّهُم مِّنۢ بَعْدِ خَوْفِهِمْ أَمْنًا يَعْبُدُونَنِى لَا يُشْرِكُونَ بِى شَيْـًٔا وَمَن كَفَرَ بَعْدَ ذَٰلِكَ فَأُو۟لَٰٓئِكَ هُمُ ٱلْفَٰسِقُونَ
তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে ও সৎ কাজ করে আল্লাহ তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন যে, তিনি তাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিনিধিত্ব দান করবেনই, যেমন তিনি প্রতিনিধিত্ব দান করেছিলেন তাদের পূর্ববর্তীদেরকে এবং তিনি অবশ্যই তাদের জন্য সুদৃঢ় করবেন তাদের দীনকে যা তিনি তাদের জন্য মনোনীত করেছেন এবং তাদের ভয় ভীতির পরিবর্তে তাদেরকে অবশ্যই নিরাপত্তা দান করবেন; তারা আমার ইবাদাত করবে, আমার সাথে কোন শরীক করবেনা, অতঃপর যারা অকৃতজ্ঞ হবে তারা তো সত্যত্যাগী।" [অনুবাদক: মুজিবুর রহমান] তাফসীর পড়তে ক্লিক করুন
আয়াত নাযিলের প্রেক্ষাপট:
উবাই ইবনে কা'ব রাঃ হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এবং তার সাথীরা যখন মদীনায় তাশরীফ আনলেন এবং আনসারগণ তাদেরকে আশ্রয় দিলেন, তখন সমস্ত আরব এক বাক্যে তাদের শক্রতে পরিণত হলো। সাহাবাগণ তখন রাতদিন অস্ত্ৰ নিয়ে থাকতেন। তখন তারা বললোঃ আমরা কি কখনো এমনভাবে বাঁচতে পারবো যে, আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় না করে সন্তুষ্ট চিত্তে ঘুমাতে পারবো? তখন এ আয়াত নাযিল হয়” [ত্ববারানী, মুজামুল আওসাত ৭/১১৯, হাদীস ৭০২৯, হাকীম- মুস্তাদরাকঃ ২/৪০১, দ্বিয়া আল-মাকদেসীঃ মুখতারাহঃ ১১৪৫]
এ আয়াতে মহান আল্লাহ্ সুবাহানাহু ওয়াতা‘আলা রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) কে তিনটি বিষয়ের ওয়াদা দিয়েছেন:
- আপনার উম্মতকে যমীনের বুকে খলীফা ও শাসনকর্তা করা হবে;
- আল্লাহ্র মনোনীত দীন ইসলামকে প্রবল করা হবে এবং
- মুসলিমদেরকে এমন শক্তি ও শৌর্যবীর্য দান করা হবে যে, তাদের অন্তরে শক্রর কোনো ভয়ভীতি থাকবে না।"
মহান আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর এই ওয়াদা পূর্ণ করেছেন খুবই অল্প সময়ের মধ্যে। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর পূণ্যময় আমলে মক্কা, খাইবার, বাহরাইন, সমগ্র আরব উপদ্বীপ ও সমগ্ৰ ইয়ামান তারই হাতে বিজিত হয় এবং তিনি হিজরের অগ্নিপূজারী ও শাম (বর্তমান সিরিয়া) দেশের কতিপয় অঞ্চল থেকে জিযিয়া কর আদায় করেন। রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াস মিসর ও আলেকজান্দ্ৰিয়ার সম্রাট মুকাউকিস, আম্মান ও আবিসিনিয়ার সম্রাট নাজ্জাসী প্রমুখ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর কাছে উপঢৌকন প্রেরণ করেন ও তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন। বাদশাহ নাজ্জাশী পরে ইসলাম গ্রহণ করার কারণে ইথিওপিয়াও ইসলামের ছায়াতলে চলে আসে।" [সিরাতুন নবী--ড.আলী মুহাম্মদ আস সাল্লাবি]
এছাড়া রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর ওফাতের পর হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাঃ খলীফা হন ৬৩২-৬৩৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর ওফাতের পর সমগ্র আরব-সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহের আগুন, দ্বন্দ্ব-সংঘাত মাথাচাড়া দিয়ে উঠে, তিনি তা খতম করেন। তিনি মুসান্না ও খালিদ বিন ওয়ালীদ রাঃ এর নেতৃত্বে পারস্যে অভিযান চালিয়ে কালদিয়া ও হীরা রাজ্য জয় করেন। অপরদিকে শুরাহবিল, আমর ইবনুল আস, ইয়াজীদ এবং আবু ওবায়দুল্লার নেতৃত্বে আজনাদাইনের যুদ্ধে শক্তিশালী গ্রিক বাহিনীকে ভীষণভাবে পরাজিত করে। এভাবে হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাঃ বহিঃশত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করে দুই শক্তিশালী রাজ্য পারস্য এবং শক্তিশালী রোমান বিজয়ের পথ সুপ্রশস্ত করেন।" [A History of the Arabs---P.K. Hitti]
তার সময়ে এই বিজয়, ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা, ও নিরাপত্তার অবয়ব বৃদ্ধি পেতে থাকে। বসরা ও দামেস্ক তারই আমলে বিজিত হয় এবং অন্যান্য দেশেরও কতক অংশ করতলগত হয়। তিনি খিলাফতের সীমানা ইরাক ও সিরিয়ার ভূখণ্ড পর্যন্ত বিস্তৃত করেন। এইভাবে আরো বিস্তারিত জানতে পড়ুন [কর্ম ও জীবন: আবু বকর সিদ্দিক রাঃ--ড. আলী মুহাম্মদ আস সাল্লাবি]
আবু বকর সিদ্দীক রাঃ এর ওফাতের সময় নিকটবর্তী হলে মহান আল্লাহ্ তা‘আলা তার অন্তরে ওমর ইবনুল খাত্তাব রাঃ কে পরবর্তী খলীফা নিযুক্ত করার ইলহাম করেন। ওমর ইবনুল খাত্তাব রাঃ খলীফা (৬৩৪-৬৪৪ খ্রিস্টাব্দ) নিযুক্ত হয়ে শাসনব্যবস্থা এমনভাবে সুবিন্যস্ত করলেন যে, নবীগণের পর পৃথিবী এমন সুন্দর ও সুশৃংখল শাসন ব্যবস্থা আর প্রত্যক্ষ করেনি। মহানবী মুহাম্মদ সাঃ আরবে যে সাধারণতন্ত্রের সূচনা করেছিলেন হযরত ওমর ফারুক রাঃ সেটিকে একটি বৃহৎ ও শক্তিশালী সাম্রাজ্যে পরিণত করেছিলেন। তাঁর দশ বছরের শাসনামলে মুসলিমরা অসাধারণ রণনৈপুণ্য ও যোগ্যতায় পরাক্রমশালী রোমান ও পারস্য সাম্রাজ্যদ্বয় কে সম্পূর্ণরূপে করায়ত্ত করেন। তাঁর শাসনামলে মুসলিম সাম্রাজ্যের সীমানা পারস্য, সিরিয়া ও মিসর পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। তার হাতে কায়সার ও কিসরা সমূলে নিশ্চিহ্ন হয়। এরপরে তাঁর ইন্তেকালের পরে উসমান ইবনে আফফান রাঃ মুসলিম বিশ্বের খলিফা হন।
হযরত উসমান ইবনে আফফান রাঃ (৬৪৪-৬৫৬ খ্রিস্টাব্দ) খিলাফত সম্প্রসারণে কৃতিত্ব ভুমিকা রেখেছেন। তিনি বেলুচিস্তান দখল করে ভারতের প্রান্তসীমা পর্যন্ত নব-প্রতিষ্ঠিত ইসলামি সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটান। তাঁর শাসনামলে মুসলিমরা সাইপ্রাস, রোডস সহ ভূমধ্যসাগরের কয়েকটি দ্বীপে আধিপত্যের বিস্তার এবং ত্রিপলী সাম্রাজ্য দখল করেন। এ সময় তুর্কিস্তান, মার্ভ, নিশাপুর, সিরিয়া প্রভৃতি অঞ্চল দখল করে মুসলিম শাসন সুদৃঢ় করেন। এভাবে সময়ে সময়ে ইসলামী বিজয়ের পরিধি পাশ্চাত্য দেশসমূহ, আন্দালুস ও সাইপ্রাস পর্যন্ত, দূরপ্রাচ্য চীন ভূখণ্ড পর্যন্ত এবং ইরাক, খোরাসান ও আহওয়ায ইত্যাদি সব তার আমলেই মুসলিমদের অধিকারভুক্ত হয়"[দেখুন-কুরতুবী]। খলিফা উসমান রাঃ এর শাসনামলে খিলাফতের সীমানা উত্তরে কৃঞ্চসাগর এবং পূর্বে গজনী পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়।
উসমান রাঃ এর ইন্তেকালের পর সমগ্র মুসলিম বিশ্বের খলিফা হন হযরত আলী রাঃ ৬৫৬-৬৬১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। এভাবে মাত্র ত্রিশ বছরের মধ্যে মুসলিমগণ তৎকালীন পরিচিত বিশ্বের পায় পুরোটাই অধিকার করেন। সহীহ হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:-“আমাকে সমগ্ৰ ভূখণ্ডের পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্ত একত্রিত করে দেখানো হয়েছে” [সহীহ মুসলিম ২৮৮৯]।
মহান আল্লাহ্ তা‘আলা এই প্রতিশ্রুতি উসমান ইবন আফফান রাঃ এর আমলেই পূর্ণ করে দেন। অন্য এক হাদীসে বলা হয়েছে: “খেলাফত আমার পরে ত্রিশ বছর থাকবে” [আবু দাউদ ৪৬৪৬, তিরমিযী ২২২৬, আহমাদ ৫/২২১]
আর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর ইন্তেকালের পরে ইসলামের প্রধান চারজন খলিফাগণ তথা মহান আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল সাঃ এর প্রতিনিধিগণ ৬৩২ – ৬৬১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অর্থাৎ মোট ৩০ বছর পর্যন্ত খেলাফত পরিচালনা করেছিলেন যা পূর্ব-পশ্চিম পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল অর্থাৎ রাসূল সাঃ এর ভবিষ্যদ্বাণী মহান আল্লাহ্ সত্যে পরিণত করেছেন। এই খিলাফত সর্বোচ্চ সীমায় উপনীত হওয়ার পর এটি সমগ্র আরব উপদ্বীপ, লেভান্ট থেকে উত্তর ককেসাস, পশ্চিমে মিসর থেকে বর্তমান তিউনিসিয়া ও পূর্বে ইরানীয় মালভূমি থেকে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত।
এভাবে মহান আল্লাহর মনোনীত জীবন ব্যবস্থা এ সকল দেশের সকল দ্বীনের উপরে বিজয় লাভ করে। ফলে মুসলিমগণ নিরাপদে ভয়-ভীতি থেকে মুক্ত থাকে এবং মহান আল্লাহর ইবাদত করতে পারেন। আলী রাঃ এর সময়ে নতুন বিজয় সাধিত না হলেও তাঁর যুগে মুসলিম মিল্লাতের প্রতিষ্ঠা ও উন্নতির ধারা অব্যাহত থাকে।
সুতরাং এটা নিঃসন্দিগ্ধ ভাবে বলা যায় যে,"এই পবিত্র কোরআন হলো মহান আল্লাহর বাণী এবং রাসূল (ﷺ) একজন সত্য নবী।"