Are you sure?

কুরআন »  বিবিধ

পর্ব: ৩] কোরআনে ভবিষ্যদ্বাণীর সত্যতা: রাসূল (ﷺ) এর জন্য আল্লাহই যথেষ্ট" [১৫:৯৫]

বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম
বিষয়: কোরআনের ভবিষ্যদ্বাণীর সত্যতা সিরিজ।

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতাহু প্রিয় ভাই ও বোনেরা। আশা করি অবশ্যই সবাই মহান আল্লাহ্ সুবাহানাহু ওয়াতা'আলার অশেষ রহমত ও দয়ায় ভালো এবং সুস্থ আছেন। আজকে পবিত্র কোরআন মাজীদের ভবিষ্যদ্বাণীর সত্যতা সিরিজ ১০ম পর্ব আলোচনা করতে যাচ্ছি। ইনশাআল্লাহু তা'আলা অবশ্যই সবাই ধৈর্য্য সহকারে মনোযোগ দিয়ে পড়বেন।

পবিত্র কোরআনের ১৫ নং সূরা আল হিজর (الحجر), আয়াত: ৯৫ তে সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ্ সুবহানু ওয়াতা'আলা এরশাদ করেছেন:-

إِنَّا كَفَيْنَٰكَ ٱلْمُسْتَهْزِءِينَ
অর্থঃ আমিই যথেষ্ট তোমার জন্য, বিদ্রুপকারীদের বিরুদ্ধে।" [অনুবাদক: মুজিবুর রহমান]
"Indeed, We are sufficient for you against the mockers." [Translator: Sahih International]

অর্থাৎ মহান আল্লাহ্ তা'আলা এই আয়াতে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (ﷺ) কে শান্তনা প্রদান করে বলেছেন যে,"রাসূল (ﷺ) এর পক্ষ হয়ে তিনিই বিদ্রুপকারীদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট অর্থাৎ তাদেরকে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া এবং পাকড়াও করার জন্য যথার্থ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।" এই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পরে রাসূল (ﷺ) সাহাবীদের সুসংবাদ জানিয়ে বলেন যে:-"এ সকল বিদ্রুপকারীদের বিষয়ে আমাদের আর চিন্তা করতে হবে না। আল্লাহ্ শীঘ্রই এর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।"

এখানে প্রশ্ন হলো, আল্লাহ্ কেন এই রকম আয়াত নাযিল করে রাসূল (ﷺ) কে শান্তনা প্রদান করলেন? কী এর যথার্থ কারণ?

কারণটা হলো রাসূল (ﷺ) নবুয়্যত প্রাপ্ত হওয়ার পর প্রথমদিকে বেশ কয়েক বছর গোপনে ইসলাম প্রচারের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। এরপরে মহান আল্লাহ্ তাআলা প্রকাশ্যে তাঁর বাণী প্রচার করার জন্য সূরা আল হিজর (الحجر), আয়াত: ৯৪ নং আয়াত নাযিল করে বলে দিলেন যে:-

فَٱصْدَعْ بِمَا تُؤْمَرُ وَأَعْرِضْ عَنِ ٱلْمُشْرِكِينَ
অর্থঃ অতএব তুমি যে বিষয়ে আদিষ্ট হয়েছ তা প্রকাশ্যে প্রচার কর এবং মুশরিকদের উপেক্ষা কর।" [অনুবাদক: মুজিবুর রহমান]
"Then declare what you are commanded and turn away from the polytheists." [Translator: Sahih International]

আর এই আয়াত নাযিল হওয়ার পরে রাসূল (ﷺ) এবং তাঁর সাহাবীগণ প্রকাশ্যভাবে পবিত্র কোরআনের বাণী উচ্চস্বরে পাঠ করাসহ মহান আল্লাহর একত্ববাদ প্রচারের কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন। কিন্তু রাসূল (ﷺ) সহ তাঁর সাহাবীগণ এ কার্যক্রম শুরু করার পরে মক্কার কতিপয় মানুষ একত্রিত হয়ে মক্কার সর্বত্র রাসূল (ﷺ) এর বিরুদ্ধে বিদ্রুপ করে বেড়াত, তাঁর মহান চরিত্রে মিথ্যার মিশ্রণ ঘটিয়ে অপবাদ দিত, আল্লাহ্ সম্পর্কে মিথ্যারোপ করত, মানুষদের সামনে তাঁর, তাঁর দ্বীনের ও অনুসারীদের নিন্দা করত এবং তাঁকে ও তাঁর অনুসারীদের সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করে বিভিন্ন কষ্ট দিত, তাঁর অনুসারীদের অত্যাচার করত, এমনকি তাঁকে হত্যা করার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল ইত্যাদি। এতে রাসূল (ﷺ) খুবই কষ্ট পেয়ে মর্মাহত হতেন। যার ফলে তাঁর মন ভারাক্রান্ত হতো। আর এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার যৌক্তিকতাও ছিল। কেননা কেউ যদি প্রচলিত প্রথাগত বিশ্বাসের বিপরীতে নতুন মতবাদ প্রচার করে তখন জনসাধারণ ক্ষ্যাপবে এটাই স্বাভাবিক একটা বিষয় ছিল যা রাসূল (ﷺ) এর ক্ষেত্রেও হয়েছিল। তবে তারা শেষ পর্যন্ত তাঁকে হত্যা করার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল।

আর এ বাক্যে যেসব "ٱلْمُسْتَهْزِءِينَ (আলমুস্তাহঝিঈনা)/against the mockers" বা বিদ্রূপকারীদের কথা বলা হয়েছে, তাদের নেতা ছিল পাঁচজন। তারা হলেন:-
১) আসওয়াদ ইবনে আব্দে এয়াগুস/ইয়াস [বানু যাহরা গোত্রের] ;
২) ওলীদ ইবনে মুগিরা [বানু মাখযুম গোত্রের] ;
৩) আস ইবনু ওয়ায়েল [বানু সাহম গোত্রের] ;
৪) হারিস ইবনে তালাতিলা [খুযাআ গোত্রের] এবং
৫) আসওয়াদ ইবনে আব্দুল মুত্তালিব আবু যামআ [বানু আসাদ গোত্রভুক্ত এবং এ ছিল রাসূল (ﷺ) এর চরম শত্রু] (বাগভী)।

এরা ছিল বয়স্ক ব্যক্তি ও মুশরিকদের বড় বড় নেতা এবং এদের কে সম্ভ্রান্ত মনে করা হতো। তারা সবসময়ই রাসূল (ﷺ) এর ক্ষতি করতে চাইত। এজন্য তারা জনগণকে রাসূল (ﷺ) এর বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি করত এবং তারা রাসূল (ﷺ) কে বিভিন্ন ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করে ইসলাম প্রচারের কাজ থেকে মনোযোগ সরাতে চাইত। এক কথায় যতদূর কষ্ট দেওয়ার শক্তি তাদের ছিল তা করতে তারা মোটেই ত্রুটি করত না। তাদের উৎপীড়ন চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেল এবং কথায় কথায় রাসূল (ﷺ) কে বিদ্রুপ করতে থাকল। কিন্তু মহান আল্লাহ তাআ'লা জানেন যে, কাফের মুশরিকদের এরুপ ঠাট্টা-বিদ্রুপের কারণে রাসূল (ﷺ) এর মন সংকীর্ণ হয়ে যায়। এজন্য মহান আল্লাহ্ তা'আলা ৬ নং সূরা আল আনআম (الانعام), আয়াত: ৩৩ এ বলেছেন:-

قَدْ نَعْلَمُ إِنَّه۫ لَيَحْزُنُكَ الَّذِيْ يَقُوْلُوْنَ
অর্থঃ তাদের কথাবার্তায় তোমার যে দুঃখ ও মনঃকষ্ট হয় তা আমি খুব ভাল ভাবেই জানি...।" [অনুবাদক: মুজিবুর রহমান]

উক্ত আয়াতের তাফসীর পড়তে ক্লিক করুন:

https://hadithbd.com/quran/link/?id=822

 

আর মহান আল্লাহ্ এরুপ দুঃখ-কষ্ট থেকে রাসূল (ﷺ) কে শান্তনা প্রদান করে উপরোল্লিখিত ১৫ নাম্বার সূরা আল হিজর (الحجر) এর ৯৫ নং আয়াত নাযিল করেন। এর ফলে রাসূল (ﷺ) এর মনে প্রশান্তি আসে।

হাফেজ আবু বকর (রঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে,"একদা রাসূল (ﷺ) বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করছিলেন। এ সময় হযরত জিব্রাইল আঃ এসে তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে যান। আর এমন সময় আসওয়াদ ইবনে আব্দে ইয়াস/ইয়াগুস তাঁর পাশ দিয়ে গমন করে। তখন জিব্রাইল আঃ তার পেটের দিকে ইশারা করেন। আর এর ফলে তার পেটে চরম অসুখ হয়। এতেই তার মৃত্যু ঘটে [1]

ইতিমধ্যে ওলীদ ইবনে মুগিরা গমন করে। খুযাআ গোত্রের একটি লোকের তীরের ফলকের সামান্য আঘাতে তার পায়ের গোড়ালি কিছুটা আহত হয়েছিল। এরপর সুদীর্ঘ দুবছর কেটে গিয়েছিল। হযরত জিব্রাইল আঃ এদিকে ইশারা করেন। এর ফলে ঐ ক্ষতস্থানটুকু ফুলে ফেঁপে উঠে, যার কারণে তার মৃত্যু হয় [2]

এরপর গমন করে আস ইবনু ওয়ায়েল। হযরত জিব্রাইল আঃ তার পায়ের পাতার দিকে ইশারা করেন। আস ইবনু ওয়ায়েল তায়েফ গমনের উদ্দেশ্যে তার গাধার উপরে আরোহণ করে। পথে সে গাধার পিঠ থেকে পড়ে যায় এবং তার পায়ের পাতায় কাঁটা ঢুকে যায়। তাতেই তার জীবনলীলা শেষ হয়ে যায় [3]

হযরত জিব্রাইল আঃ হারিস ইবনে তালাতিলার মাথার দিকে ইশারা করলেন। এরফলে তার মাথা দিয়ে রক্ত পড়তে শুরু করে। এতেই তার মৃত্যু হয় [4]

আবার হযরত আনাস রাঃ থেকে বর্ণিত হয়েছে: একদা রাসূল (ﷺ) পথ দিয়ে গমন করছিলেন। এমন অবস্থায় কতিপয় মুশরিকরা তাঁকে ঠাট্টা বিদ্রুপ করে জ্বালাতন করছিল। তখন আল্লাহর ফেরেশতা হযরত জিব্রাইল আঃ তাঁর রক্ষক হিসেবে আগমন করেন এবং তাদেরকে চওকা মারেন। ফলে তাদের দেহ এমন ক্ষত বিক্ষত হয় যে, যেন তাতে বর্শা দ্বারা আঘাত করা হয়েছে। তাতেই তারা মৃত্যুমুখে পতিত হয়।" (তাফসীরে ইবনে কাসীর; পবিত্র কোরআন ১৫:৯৭ নং আয়াত দ্রষ্টব্য)

আর মহান আল্লাহ্ তাআলা এসব বিদ্রুপকারীদের বিরুদ্ধে এভাবেই যথার্থ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন, যার ফলে বিদ্রুপকারীগণ বিভিন্ন বিপদে নিপতিত হয়ে কিছুদিনের মধ্যেই ধ্বংস হয়ে যায় অর্থাৎ রাসূল (ﷺ) এর পক্ষ হয়ে মহান আল্লাহ্ সুবহানু ওয়াতা'আলাই এসব বিদ্রুপকারীদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট ছিলেন এবং তাঁর পক্ষ হয়ে কাফের মুশরিকদের জবাব দিতেন।

নোট: إِنَّا كَفَيْنٰكَ الْمُسْتَهْزِئيْنَ (ইন্না কাফাইনাকা আলমুস্তাহঝিঈনা) অর্থাৎ যারা রাসূল (ﷺ) কে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ, ব্যঙ্গ ও উপহাস করে তাদের জন্য আল্লাহ তা‘আলাই যথেষ্ট অর্থাৎ তাদেরকে উপযুক্ত শাস্তি দেয়া এবং পাকড়াও করার জন্য আল্লাহ তা‘আলাই ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

أَلَيْسَ اللّٰهُ بِكَافٍ عَبْدَه

আল্লাহ কি তাঁর বান্দার জন্য যথেষ্ট নন?” [সূরা যুমার ৩৯:৩৬]

তবে উপহাসকারীদের মাঝেই কেবলমাত্র সীমাবদ্ধ নয় বরং কিয়ামত পর্যন্ত যত ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ ও উপহাসকারী আসবে সবাই এতে শামিল। আর আল্লাহর রাসূল (ﷺ) এর বিরুদ্ধাচরণ করা মানেই আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণ করা এবং এর পরিণতি গজবে পতিত হতে হবে তাকে।

আবার আপনারা যদি সিরাত গ্রন্থগুলো সহ সহীহ হাদিসগুলো পড়েন তাহলে দেখবেন রাসূল (ﷺ) কে অবিশ্বাসী কাফের মুশরিকরা বারংবার ষড়যন্ত্র করেও হত্যা করতে ব্যর্থ হয়েছিল, তাঁকে হত্যা করার জন্য প্রকাশ্যে ঘোষণা দেওয়া সত্বেও তাঁর এক চুলও ক্ষতি করতে পারেনি; এমনকি বিভিন্ন যুদ্ধ ক্ষেত্রেও তাঁকে হত্যা করার জন্য কাফের মুশরিক ইহুদিরা একজোট হয়ে মরিয়া হয়ে উঠেছিল, যেভাবেই হোক না কেন তাঁকে হত্যা করতেই হবে কিন্তু এ ছিল তাদের আশায় গুঁড়েবালি। আর এভাবেই মহামহিমান্বিত আল্লাহ্ সুবাহানাহু ওয়াতা'আলা তাঁর রাসূল (ﷺ) এর পক্ষ অবলম্বন করে সর্বোপরি হেফাজত করেছিলেন এবং তাঁর ক্ষতি হতে দেননি। আর এভাবেই তিনি তাঁর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করেন।