আমরা কিভাবে আল্লাহর রাসূল ﷺ এর আনুগত্য করব? কী দিয়ে তাঁর আনুগত্য করব? কিভাবে তাঁর অনুসরণ করব? পবিত্র কোরআন যথেষ্ট হলে সহীহ হাদিসের কী প্রয়োজন? আমরা কী এটা মানতে বাধ্য? তাহলে আসুন এ সম্পর্কে কিছু আলোচনা করা যাক ইনশাআল্লাহু তাআলা। আল্লাহর রাসূল ﷺ ভবিষ্যদ্বাণী করে বলে গেছেন যে, "জেনে রাখো! তোমাদের পূর্ববর্তী আহলে কিতাব বাহাত্তর দলে বিভক্ত হয়েছে এবং এ উম্মাত অদূর ভবিষ্যতে তিয়াত্তর দলে বিভক্ত হবে। এর মধ্যে বাহাত্তর দল জাহান্নামে যাবে এবং একটি জান্নাতে যাবে। সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহ্র রাসূল! সে দল কোনটি? তিনি বললেনঃ আমি ও আমার সাহাবীগণ যার উপর প্রতিষ্ঠিত।"
অর্থাৎ যারা আল্লাহর রাসূল ﷺ এর আনীত পবিত্র কোরআন এবং তাঁর সুন্নাহ্ কে অস্বীকার করে এর বিরোধিতা করে তারাই এ ৭২ দলের অন্তর্ভুক্ত।
এখন আসা যাক মূল আলোচনায়।
পার্ট: ১
আমি বনি। আর আমার শিক্ষক হলেন আমিন। তো আমি আমার শিক্ষকের প্রতিটি কথাই শুনি। বলতে পারেন তাঁর বাধ্যবাধকতা করি। কেননা তিনি আমার একজন সম্মানিত শিক্ষক, যিনি আমার মাথার মুকুট। তো তিনি একদিন আমাকে বললেন, "বনি, তোমাকে আমি একজনের কাছে পাঠাব, যার প্রতিটি কথা তুমি মনোযোগ সহকারে শুনবে এবং তা মান্য করবে।" এটাই ছিল আমার শিক্ষকের আদেশ তথা কমান্ড। কিন্তু আমাকে যার কাছে পাঠানো হবে, সে আমাকে কি কি করতে বলবে অথবা বলবে না, তা সম্পর্কে কিছুই জানায়নি আমার শিক্ষক। শুধু এতটুকুই জানিয়েছেন যে, "তিনি সৎ চরিত্রের অধিকারী। তো এরপর তিনি আমাকে তাঁর কাছে পাঠালেন যার নাম মুহাম্মদ। তো আমিও মুহাম্মদের কাছে আসলাম এবং তাঁর কাছেই থাকলাম। একদিন তিনি আমাকে বললেন," এই শুনো, আমি যা যা বলব তুমি ঠিক তাই মান্য করবা।
--তো আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম,"আমি কেন আপনার প্রতিটি কথা মান্য করব?
--কেন, তোমার শিক্ষক কী তোমাকে জানায়নি, আমি যা যা বলব তা মনোযোগ সহকারে শুনবে এবং মান্য করবে? "তিনি (মুহাম্মদ) বললেন"
--হ্যাঁ! অবশ্যই জানিয়েছেন।
--তাহলে ভাল। এই জন্যই তো আমি যা যা বলব তুমি ঠিক তাই মনোযোগ সহকারে শুনবা এবং পালন করবা।
তাই আমিও মুহাম্মদের সব কথাই মানি। তো একদিন তিনি আমাকে বললেন," বনি, তুমি ফুল গাছে একটু পানি দাও?" আমিও তা দিলাম। আবার বললেন,"বনি, তুমি একটু ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ এনে দাও? আমিও তা এনে দিলাম। আবার বললেন,"বনি একটা কথা শুনে রাখো, তুমি মানুষের কোন উপকার করতে না পারলেও কখনো অন্যের ক্ষতি করবা না, কেউ তোমাকে গালি দিলে তুমি তাকে পাল্টা গালি দিতে যেও না, তুমি সবার সঙ্গে তেমন আচারণ করো যেরূপ তুমি নিজের ক্ষেত্রে অন্যের থেকে আশা করো।" আর আমিও মুহাম্মদের এসব প্রতিটি কথা শুনছি এবং পালন করছি।
তো হঠাৎ-ই কোন একদিন একজন ব্যক্তি আমাকে বলল,"আচ্ছা তুমি মুহাম্মদের প্রতিটি কথা কেন শুনো ও তা পালন কর??? আমি তাকে জবাব দিলাম, "কারণ এটা আমার শিক্ষকের আদেশ যে, তুমি মুহাম্মদের প্রতিটি কথা শুনবে এবং তা মান্য করবে।"
--অথচ তোমার শিক্ষক তো বলে নাই যে, মুহাম্মদ ফুলগাছে পানি দিতে বলবে, তোমাকে ওষুধ এনে দিতে বলবে..e..t..c..আর তুমিও তাই করবা। তাহলে যা তোমার শিক্ষক বলে দেয় নাই তা কেন মানবা তুমি?
--হ্যাঁ, আমার শিক্ষক এক কথায় আদেশ করেছেন, "বনি, তোমাকে আমি একজনের কাছে পাঠাব, যার প্রতিটি কথা তুমি মনোযোগ সহকারে শুনবে এবং তা মান্য করবে।" এখন মুহাম্মদ কী বলবে অথবা বলবে না, তিনি কী আদেশ করবেন অথবা করবেন না এসব নিশ্চিত ধরে ধরে বলতে যাবেন না আমার শিক্ষক। তিনি মুহাম্মদের চরিত্রের প্রশংসা করেছেন। এর মানে তিনি এটাই জানিয়ে দিয়েছেন যে, মুহাম্মদ নিশ্চিত কোন ভুলভাল কথা বলবেন না অথবা তোমাকে রঙ কিছু শেখাবেন না বরং তিনি যা বলবেন সেটা মান্য করবা। কারণ শিক্ষক জানেন মুহাম্মদের চরিত্র সম্পর্কে।
--আচ্ছা ঠিক আছে তোমার কথাগুলো।
--হুম! এই জন্যই তো আমি আমার শিক্ষকের কথা মানতে গিয়ে মুহাম্মদের প্রতিটি কথা শুনি এবং মান্য করি।
তাহলে পাঠক বন্ধুরা, এ থেকে একটা জিনিস পরিষ্কার হলো লজিক্যালী। আর সেটা হলো শিক্ষকের কথা মানতে গিয়ে আমাকে (বনি) মুহাম্মদের প্রতিটি কথাগুলো মনোযোগ সহকারে শুনতে হয়েছে এবং তা পালন করতে হয়েছে। আর এটাই হলো আনুগত্য বা obedience.
আমার শিক্ষকের কথাগুলো হচ্ছে থিওরিটিক্যাল অর্থাৎ তুমি মুহাম্মদের প্রতিটি কথা মনোযোগ সহকারে শুনবে এবং তা মান্য করবে।" এটাই ছিল শিক্ষকের আদেশ। এখন মুহাম্মদ কী বলবে অথবা বলবে না, আর আমাকে কি মানতে হবে আর কি মানতে হবে না তা ধরে ধরে বলে দেয় নাই। কিন্তু আমি যখন মুহাম্মদের কাছে গেলাম তখন সে আমাকে বিভিন্ন কিছু বলেছে যা আমি শুনেছি + পালন করেছি। আর এটাই হলো মুহাম্মদের আনুগত্য। অর্থাৎ আমাকে শিক্ষকের আদেশ মানতে গিয়ে মুহাম্মদ যা যা বলেছে তাই মানতে হয়েছে।
তাহলে এটাকে এভাবেই বলা যেতে পারে, মুহাম্মদের আনুগত্য করা মানেই শিক্ষকের আনুগত্য। কেননা শিক্ষক বলেছেন,"তুমি মুহাম্মদের প্রতিটি কথা মনোযোগ সহকারে শুনবে এবং তা মান্য করবে।" এখন আমিও শিক্ষকের আনুগত্য করতে গিয়ে মুহাম্মদ যা যা বলেছে ঠিক তাই তাই মানতে হয়েছে + করতে হয়েছে। অর্থাৎ এটাকেও মুহাম্মদের আনুগত্য বলা যায়। তাহলে এইখানে মূল সূত্র কে? এইখানে মূল হচ্ছেন আমার শিক্ষক। আমি আমার শিক্ষকের আনুগত্য করতে গিয়ে মুহাম্মদের আনুগত্য করেছি।
আর এরুপ কথাই পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে বহু স্থানে। আল্লাহ্ বলেছেন,"রাসূলের আনুগত্য করা মানেই আল্লাহর আনুগত্য করা" [পবিত্র কোরআন ৪:৮০] এবং রাসূল ﷺ ও বলেছেন,"যে আমার আনুগত্য করল, সে মূলত আল্লাহর-ই আনুগত্য করল [সহীহ বোখারি, জিহাদ অধ্যায় অর্থাৎ ৫৬/১০৯ এর ২৯৫৭ নং হাদিস, আহকাম অধ্যায় অর্থাৎ ৯৩/১ এর ৭১৩৭; সহীহ মুসলিম, প্রশাসন ও নেতৃত্ব অধ্যায়ের অর্থাৎ ৮ এর ৪৬৪১ নং হাদিস সহ ইত্যাদি দ্রষ্টব্য] কারণ রাসূল যা বলেন নিশ্চিত সেটা নিজের থেকে বলেন না ওহী ব্যতীত [পবিত্র কোরআন ৫৩:৩-৪]।
মহামহিমান্বিত ঐশীগ্রন্থ পবিত্র কোরআন মাজীদের ৪৭ নং সূরা মুহাম্মদের ৩৩ নং আয়াতে বলা হয়েছে:
يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ أَطِيعُواْ ٱللَّهَ وَأَطِيعُواْ ٱلرَّسُولَ وَلَا تُبۡطِلُوٓاْ أَعۡمَٰلَكُمۡ
অর্থঃ হে মু’মিনগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর, রাসূলের আনুগত্য কর এবং তোমাদের কর্মফল বিনষ্ট কর না।" [অনুবাদক: মুজিবুর রহমান]
এখন আল্লাহর আনুগত্য করব কি দিয়ে? কোরআন দিয়ে। অর্থাৎ কোরআন বলেছে বলেই আমরা আল্লাহর রাসূল ﷺ কে মানি ঠিক যেভাবে বনি তার শিক্ষকের আনুগত্য করতে গিয়ে মুহাম্মদের আনুগত্য করেছে অর্থাৎ তার প্রতিটি আদেশ-নিষেধ মান্য করেছে। কেননা এটাই তাঁর শিক্ষকের আদেশ ছিল। ঠিক তেমনি রাসূল ﷺ এর ক্ষেত্রেও বনির অনুরূপ কাজ করতে হবে। এটাই আল্লাহর আনুগত্য।
এখন রাসূল ﷺ কি কি করতে বলেছেন অথবা বলেননি তা কিভাবে কোরআন থেকে জানা সম্ভব যেহেতু কোরআন রাসূলের বাণী নয়? সুতরাং আল্লাহ্ যে রাসূল ﷺ এর আনুগত্য করতে বলেছেন তাহলে আমরা কি দিয়ে রাসূলের আনুগত্য করব? নিশ্চিত হাদিস দিয়ে। কারণ হাদিস রাসূল ﷺ এর বাণী, তিনি যা আদেশ-নিষেধ করেছেন তা হাদিসে বলা হয়েছে।
নোট: আল্লাহর আনুগত্যের পাশাপাশি তাঁর রাসূল (ﷺ) এর আনুগত্য করতে বলা হয়েছে" [পবিত্র কোরআন ৩:৩২,৫০,১৩২; ৪: ১৩, ৫৯, ৬৪,৬৯,৮০; ৫:৯২; ৮:১,২০,৪৬; ৯:৭১; ২৪:৫১,৫২,৫৩,৫৪,৫৬ নং সহ ইত্যাদি আয়াত দ্রষ্টব্য]
আবার ৫৯ নং সূরা আল হাশরের ৭ নং আয়াতের মধ্যে মহামহিমান্বিত আল্লাহ্ সুবাহানাহু ওয়াতা'আলা এরশাদ করেছেন:
مَّآ أَفَآءَ ٱللَّهُ عَلَىٰ رَسُولِهِۦ مِنۡ أَهۡلِ ٱلۡقُرَىٰ فَلِلَّهِ وَلِلرَّسُولِ وَلِذِى ٱلۡقُرۡبَىٰ وَٱلۡيَتَٰمَىٰ وَٱلۡمَسَٰكِينِ وَٱبۡنِ ٱلسَّبِيلِ كَىۡ لَا يَكُونَ دُولَةًۢ بَيۡنَ ٱلۡأَغۡنِيَآءِ مِنكُمۡۚ وَمَآ ءَاتَىٰكُمُ ٱلرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَىٰكُمۡ عَنۡهُ فَٱنتَهُواْۚ وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَۖ إِنَّ ٱللَّهَ شَدِيدُ ٱلۡعِقَابِ
অর্থঃ আল্লাহ এই জনপদবাসীদের নিকট হতে তাঁর রাসূলকে যা কিছু দিয়েছেন তা আল্লাহর, তাঁর রাসূলের, রাসূলের স্বজনগণের এবং ইয়াতীমদের, অভাবগ্রস্ত ও পথচারীদের যাতে তোমাদের মধ্যে যারা বিত্তবান শুধু তাদের মধ্যেই ঐশ্বর্য আবর্তন না করে। অতএব রাসূল তোমাদেরকে যা দেয় তা তোমরা গ্রহণ কর এবং যা হতে তোমাদেরকে নিষেধ করে তা হতে বিরত থাক। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, আল্লাহ শাস্তি দানে কঠোর।" [অনুবাদক: মুজিবুর রহমান]
তাহলে এখানে আরবি বাক্য "وَمَآ ءَاتَىٰكُمُ ٱلرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَىٰكُمۡ عَنۡهُ فَٱنتَهُواْۚ/অতএব রাসূল তোমাদেরকে যা দেয় তা তোমরা গ্রহণ কর এবং যা হতে তোমাদেরকে নিষেধ করে তা হতে বিরত থাক/And whatever the Messenger has given you – take; and what he has forbidden you – refrain from. বাক্য সুস্পষ্ট আছে। এখন কোরআনের এই কথাটা হলো কেবলমাত্র থিওরিটিক্যাল। অর্থাৎ কোরআন নিজে নিজেই হচ্ছে থিওরিটিক্যাল। এটাকে বাস্তবে প্রয়োগ করার জন্য একটা রোল মডেল দরকার। আর সেটা হলেন আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ ﷺ যিনি কোরআন কে বাস্তবায়িত করেছিলেন তাঁর অনুশীলনময় জীবনের মাধ্যমে। অর্থাৎ তিনি এই থিওরিটিক্যাল কোরআন কে সরাসরি অনুশীলনের মাধ্যমে তাঁর সাহাবীগণ কে এর প্রয়োগিক পদ্ধতি সমূহ দেখিয়ে দিয়েছেন। আর তিনি কিভাবে কি করেছিলেন বা করেননি তা জানার একমাত্র মাধ্যম হলো সহীহ হাদিস। আবার আল্লাহর রাসূল ﷺ এর কাছে যেহেতু ওহী আসত, তাই তিনিও ওহীর বাণী দ্বারা উদ্বুদ্ধ হতেন, কাজেই তিনিও তাঁর সাহাবীগণের কাছে কোরআন কে বুঝিয়ে দিতেন। আর তাঁকে কোরআন বুঝিয়ে দেওয়ারও দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল [পবিত্র কোরআন ১৬:৪৪]।
উক্ত আয়াতে বলা হয়েছে, "রাসূল ﷺ যা দেয় তাই গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করে তাই মেনে নাও।" এটাই হল মহান আল্লাহর আদেশ।
এখন এইখানে তথাকথিত আহলে কোরআন দাবিদারদের কাছে আমাদের প্রশ্ন হলো:
১] আল্লাহর রাসূল ﷺ আমাদের কে কি কি দিয়েছেন এবং কি কি নিষেধ করেছেন এটা কিভাবে জানব যদি সহীহ হাদিস না মানি যেহেতু তাঁর আনুগত্য করতে বলা হয়েছে? কেননা আল্লাহর রাসূল ﷺ যা যা আদেশ-নিষেধ করেছেন তা নিশ্চিত কোরআনে থাকার কথা নয়। কারণ এটা তাঁর বাণী নয়।
২] অনেকেই হয়ত বলবেন, "এই আয়াতে আল্লাহ্ রাসূল কে সম্পদ বন্টনের আদেশ করেছেন কেবলমাত্র, যার জন্য আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, দরিদ্রদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তো এখানে সম্পদ বন্টন ছাড়া আর কিছুই নেওয়া যাবে না অর্থাৎ রাসূল যা দেয় তা গ্রহণ করতে এবং যা নিষেধ করে তাই মান্য করার আদেশ কেবলমাত্র সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ। তাদের বলি, আল্লাহর রাসূল ﷺ কিভাবে সম্পদ বন্টনের নীতিমালা জারি করেছিলেন তা কিভাবে জানব যদি সহীহ হাদিস না মানি?
৩] আবার এই আয়াতটা কী শুধুমাত্র সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নাকি যে কোন কিছুর ক্ষেত্রে রাসূল ﷺ যা কিছু দেন তা গ্রহণ করতে হবে এবং যা কিছু নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন তাই মানতে হবে? আপনি কি বলেন??? আমি তো মনে করি এই কথাটা কেবলমাত্র সম্পদ বন্টনের জন্য সীমাবদ্ধ নয়।
৪] আল্লাহর রাসূল ﷺ এর যে সম্পদ ছিল তা তাঁর মৃত্যুর পরে সেই সম্পদের ওয়ারিশ কেউ হতে পারে কী??
[নোট: "রাসূল ﷺ যা দেয় তাই গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করে তাই মেনে নাও" কথাটি হলো কোরআনের একটা মূল নীতি। এই নীতির আলোকে সব কিছুই মানতে হবে যা কিছু রাসূল রাসূল ﷺ থেকে পাওয়া যাবে, আল্লাহ্ তাঁকে এই পর্যন্ত উন্নত করেছেন। কথাটি কেবলমাত্র সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয়। ]
পার্ট: ২
"রাসূল তোমাদেরকে যা দেয় তা তোমরা গ্রহণ কর এবং যা হতে তোমাদেরকে নিষেধ করে তা হতে বিরত থাক।" [পবিত্র কোরআন ৫৯:৭]
এই আয়াত টা আহলে কোরআন দাবিদাররা ভুলভাল অপব্যাখ্যা করে বলে যে, রাসূল কেবলমাত্র কোরআন ছাড়া আর কিছুই দেয় নাই, আবার যা হতে নিষেধ করে তাও কোরআনে আছে। তাহলে তাদের বলি, আপনার এই দাবিটাই ভুল হবে। কেননা প্রথমত কোরআন নিজে নিজেই হচ্ছে থিওরিটিক্যাল। অর্থাৎ এটায় কেবলমাত্র আল্লাহর আদেশ-নিষেধ ছাড়া দ্বিতীয় কারো বক্তব্য পাওয়া যায় না। সুতরাং কোরআন মানা মানেই আল্লাহর আনুগত্য করা। এখন আল্লাহর আনুগত্য করতে গেলে রাসূল ﷺ এর হাদিস মানতে হবে। কেননা আল্লাহ্ তো এইখানে বলেই দিয়েছেন,"রাসূল যা দেয় তাই গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করে তাই মেনে নাও। এটা কেবলমাত্র থিওরি। কিন্তু এর জীবন্ত রোল মডেল হলেন স্বয়ং রাসূল ﷺ যিনি এগুলো কে বাস্তবায়িত করবেন। তাহলে এখন দেখার বিষয় তিনি কি দিয়েছেন? কি বলেছেন? কি আদেশ- নিষেধ করেছেন বা করেননি এ সম্পর্কে যাবতীয় বিষয় পাওয়া যাবে সহীহ হাদিসে। ঠিক যেমনটা আমরা পার্ট ১ এ দেখেছি, বনি তার শিক্ষকের আনুগত্য করতে গিয়ে মুহাম্মদের প্রতিটি কথা শুনেছে + তা পালন করেছে যদিও মুহাম্মদ কী কী করতে বলবে অথবা বলবে না, আর বনি কি কি শুনবে অথবা শুনবে না তাও তার শিক্ষক তাকে ধরে ধরে বলে দেয় নাই কিন্তু মুহাম্মদের সকল কিছুই মেনে নেওয়ার মূলনীতিই বনিকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর সেই মূলনীতিটা কী ছিল? সেটা ছিল:- "বনি, তোমাকে আমি একজনের কাছে পাঠাব, যার প্রতিটি কথা তুমি মনোযোগ সহকারে শুনবে এবং তা মান্য করবে (অর্থাৎ তার আনুগত্য করবে)।" এটাই ছিল মুহাম্মদের সকল কিছুই মেনে নেওয়ার মূলনীতি। আর এই জন্য বনি তাঁর শিক্ষকের আনুগত্য করতে গিয়ে মুহাম্মদের সকল কথাই বাধ্য হয়ে শুনেছে + তা পালন করেছে। আর যদি সে মুহাম্মদের কথা নাই শুনত তাহলে সে মূলত তার শিক্ষকের কথাই শুনল না।
ঠিক অনুরূপ রাসূল ﷺ কী কী আদেশ নিষেধ করবেন অথবা করবেন না তাও ধরে ধরে কোরআনে বলে দেয় নাই কেবলমাত্র তাঁর আনুগত্য করতে হবে, তাঁর অনুসরণ করতে হবে, তিনি যা দেয় তাই গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করে তা মেনে নাও" এই মর্মে আদেশ করা ছাড়া অর্থাৎ এসব-ই হলো রাসূল ﷺ এর সকল কিছুই মেনে নেওয়ার মূলনীতি। আর আমরা মুসলিমরা এই মূলনীতি ফলো করতে গিয়েই তাঁর থেকে বর্ণিত সহীহ হাদিসগুলো মানি। যদি সহীহ হাদিস নাই মানতাম তাহলে মূলত আল্লাহর আনুগত্য করাই অস্বীকার হয়ে যেত।
আচ্ছা কোরআন সবচেয়ে ভালো বুঝত কারা? নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসূল ﷺ। আর তিনি যেভাবে কোরআন বুঝতেন ঠিক সেভাবেই সাহাবীগণও কোরআন বুঝেছিলেন। কেননা সাহাবীগণ স্বয়ং আল্লাহর রাসূল ﷺ এর কাছে থেকেই হাতে কলমে ইসলাম শিখেছেন, কোরআন বুঝেছেন, আবার তাঁরাই ইসলামের জন্য সমস্ত কিছুই ত্যাগ করেছিলেন। তাহলে আমরা এর ব্যাখ্যা স্বয়ং সাহাবীগণের উদ্ধৃতি থেকেই নিব। আর বাদ-বাকি সবার মতবাদ এবং ব্যাখ্যা বাতিল। যেহেতু আমরা কেউই আল্লাহর ﷺ এর কাছ থেকে ইসলাম শিখিনি বরং শিখেছেন সাহাবীগণ।
তো এই আয়াতটা দ্বারা সাহাবীগণ সবসময়ই রাসূল ﷺ এর সুন্নাহ যে অবশ্যই পালনীয় তা বর্ণনা করতেন। এর সমর্থনে স্বয়ং সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ রাঃ থেকে বর্ণনা পাওয়া যায় সহীহ হাদিসে। সহীহ বোখারির তাফসীর অধ্যায়ের অর্থাৎ ৬৫/৫৯/৪ এর ৪৮৮৬ নং হাদিসে বলা হয়েছে:
مُحَمَّدُ بْنُ يُوْسُفَ حَدَّثَنَا سُفْيَانُ عَنْ مَنْصُوْرٍ عَنْ إِبْرَاهِيْمَ عَنْ عَلْقَمَةَ عَنْ عَبْدِ اللهِ قَالَ لَعَنَ اللهُ الْوَاشِمَاتِ وَالْمُوْتَشِمَاتِ وَالْمُتَنَمِّصَاتِ وَالْمُتَفَلِّجَاتِ لِلْحُسْنِ الْمُغَيِّرَاتِ خَلْقَ اللهِ فَبَلَغَ ذَلِكَ امْرَأَةً مِنْ بَنِيْ أَسَدٍ يُقَالُ لَهَا أُمُّ يَعْقُوْبَ فَجَاءَتْ فَقَالَتْ إِنَّهُ بَلَغَنِيْ عَنْكَ أَنَّكَ لَعَنْتَ كَيْتَ وَكَيْتَ فَقَالَ وَمَا لِيْ أَلْعَنُ مَنْ لَعَنَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم وَمَنْ هُوَ فِيْ كِتَابِ اللهِ فَقَالَتْ لَقَدْ قَرَأْتُ مَا بَيْنَ اللَّوْحَيْنِ فَمَا وَجَدْتُ فِيْهِ مَا تَقُوْلُ قَالَ لَئِنْ كُنْتِ قَرَأْتِيْهِ لَقَدْ وَجَدْتِيْهِ أَمَا قَرَأْتِ {وَمَآ اٰتَاكُمُ الرَّسُوْلُ فَخُذُوْهُ ج وَمَا نَهٰكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوْا ج} قَالَتْ بَلَى قَالَ فَإِنَّهُ قَدْ نَهَى عَنْهُ قَالَتْ فَإِنِّيْ أَرَى أَهْلَكَ يَفْعَلُوْنَهُ قَالَ فَاذْهَبِيْ فَانْظُرِيْ فَذَهَبَتْ فَنَظَرَتْ فَلَمْ تَرَ مِنْ حَاجَتِهَا شَيْئًا فَقَالَ لَوْ كَانَتْ كَذَلِكَ مَا جَامَعْتُهَا.
আবদুল্লাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ: তিনি বলেন, আল্লাহ্ লানত করেছেন ঐ সমস্ত নারীর প্রতি যারা অন্যের শরীরে উল্কি অঙ্কন করে, নিজ শরীরে উল্কি অঙ্কন করায়, যারা সৌন্দর্যের জন্য ভ্রু-চুল উপড়িয়ে ফেলে ও দাঁতের মাঝে ফাঁক সৃষ্টি করে। সে সব নারী আল্লাহ্র সৃষ্টিতে বিকৃতি আনয়ন করে। এরপর বনী আসাদ গোত্রের উম্মু ইয়াকূব নামের এক মহিলার কাছে এ সংবাদ পৌঁছলে সে এসে বলল, আমি জানতে পারলাম, আপনি এ ধরনের মহিলাদের প্রতি লানত করেছেন। তিনি বললেন, আল্লাহর রাসূল ﷺ যার প্রতি লানত করেছেন, আল্লাহর কিতাবে যার প্রতি লানত করা হয়েছে, আমি তার প্রতি লানত করব না কেন? তখন মহিলা বলল, আমি দুই ফলকের মাঝে যা আছে তা (পূর্ণ কুরআন) পড়েছি। কিন্তু আপনি যা বলেছেন, তা তো এতে পাইনি। ‘আবদুল্লাহ্ বললেন, যদি তুমি কুরআন পড়তে তাহলে অবশ্যই তা পেতে, তুমি কি পড়নি "রাসূল ﷺ তোমাদেরকে যা দেন তা তোমরা গ্রহণ কর এবং যা থেকে তোমাদেরকে নিষেধ করেন তা হতে বিরত থাক।" মহিলাটি বলল, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই পড়েছি। আবদুল্লাহ্ (রাঃ) বললেন, রাসূল ﷺ এ কাজ করতে নিষেধ করেছেন। তখন মহিলা বলল, আমার মনে হয় আপনার পরিবারও এ কাজ করে তিনি বললেন, তুমি যাও এবং ভালমত দেখে এসো। এরপর মহিলা গেল এবং ভালভাবে দেখে এলো। কিন্তু তার দেখার কিছুই দেখতে পেলো না। তখন আবদুল্লাহ্ (রাঃ) বললেন, যদি আমার স্ত্রী এমন করত, তবে সে আমার সঙ্গে একত্র থাকতে পারত না।
অনলাইন সোর্স থেকে পড়তে ক্লিক করুন:
http://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=29400
তাহলে আমরা এই হাদিসের থেকেই উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা জানতে পেরেছি সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাঃ এর থেকে। তিনি কোন একটা হাদিস বর্ণনা করেছেন যা কিনা বনু আসাদ গোত্রের একজন মহিলা জানতে পেরেছেন। অথচ আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাঃ যা বর্ণনা করেছেন তা তিনি আল্লাহর কিতাব তথা কোরআনের কোথাও এ সম্পর্কে সরাসরি বর্ণনা পায় নাই বিধায় ঐ মহিলা প্রশ্ন করলে এর জবাবে তিনি বললেন,"আল্লাহর রাসূল ﷺ যার প্রতি লানত করেছেন, আল্লাহর কিতাবে যার প্রতি লানত করা হয়েছে, আমি তার প্রতি লানত করব না কেন? আর এর দলিল হিসেবে তিনি বলেছেন, কোরআনে তো আল্লাহ্ বলেই দিয়েছেন:-"وَمَآ اٰتَاكُمُ الرَّسُوْلُ فَخُذُوْهُ ج وَمَا نَهٰكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوْا/রাসুল তোমাদেরকে যা দেয়, তা তোমরা গ্রহণ কর এবং যা থেকে তোমাদেরকে নিষেধ করে তা থেকে বিরত থাক/And whatever the Messenger has given you – take; and what he has forbidden you – refrain from. আর রাসূল-ই তো এ কাজ করতে নিষেধ করেছেন। আবার তিনি এও বলেছেন:-"আল্লাহর কিতাবে যার প্রতি লানত করা হয়েছে" - অথচ তা সরাসরি কিতাবে নেই। এর অর্থ বোঝায় রাসূল ﷺ এর কথাও কোরআনের অবিচ্ছেদ্য অংশ (অর্থাৎ তিনি আল্লাহ্ ব্যতীত ভিন্ন কোন উৎস থেকে প্রাপ্ত হয়ে এ কথা বলেননি), অন্যথায় সাহাবী আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ রাঃ কেন বলতে যাবেন আল্লাহর কিতাবে যার প্রতি লানত করা হয়েছে? তিনি কি কোরআন বুঝতেন না অথচ তিনিই ছিলেন রাসূল ﷺ এর ঘনিষ্ঠ সাহাবীগণের একজন, আবার স্বয়ং রাসূল ﷺ তাঁর তিলাওয়াত শুনে প্রশংসা করেছিলেন, তাঁর জ্ঞান-গরিমা যেন বৃদ্ধি পায় এজন্যও স্বয়ং আল্লাহর রাসূল ﷺ দোআ করেছিলেন। আসলে তিনি মূলত এই মূলনীতি টা ফলো করেছেন। আর এই মূলনীতির আলোকেই তিনি কথাগুলো বলেছেন যা মূলত স্বয়ং রাসূল ﷺ থেকে বর্ণিত কথা। আর নিশ্চিত তিনি নিজস্ব মনগড়া কোন কথা বলতেন না ওহীপ্রাপ্ত ছাড়া।
আবার ঐ মহিলাকে তিনি এও বলেছেন,"যদি তুমি কুরআন পড়তে তাহলে অবশ্যই তা পেতে" অথচ তা কোরআনের কোথাও সরাসরি উল্লেখ নেই। যদি সরাসরি উল্লেখ থাকত তাহলে উক্ত মহিলাও আর বলতেন না যে, "আপনি যা বলেছেন, তা তো এতে (কোরআনে) পাইনি।" তাহলে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাঃ কেন এই কথা বললেন? কারণ রাসূল ﷺ এর কথাও কিতাবের-ই অবিচ্ছেদ্য অংশ কারণ তিনি নিজের থেকে কোন কিছুই মনগড়া বলেন না ওহীপ্রাপ্ত হওয়া ছাড়া [পবিত্র কোরআন ৫৩:৩-৪]। যার জন্য তিনি এই দলিল দিলেন যে, "রাসূল যা দেয় তাই গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করে তাই মেনে নাও।" আর রাসূল যখন নিষেধ করেছেন তখন তো এটা মানতেই হবে। কেননা এটাই কোরআন বলেছে।
পার্ট: ৩
আমরা বিশ্বাস করি এবং মানি যে, পবিত্র কোরআন হচ্ছে মানবজাতির জন্য মৌলিক বিধিবিধান অর্থাৎ এটায় কেবলমাত্র মৌলিক নীতিমালাই বর্ণিত হয়েছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে। কাজেই এতে মানবজাতির জন্য ঢালাওভাবে বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যাবে না সকল কিছুর। ঠিক এটাকে বলা যায় মৌলিক সংবিধান। একটা দেশ বা রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য এর নিজস্ব একটা সংবিধান থাকে। আর এই সংবিধানে যেমন বলা হয়ে থাকে যে, "দেশের প্রজাগণের রাষ্ট্রের আনুগত্য করিতে হইবে।" রাষ্ট্রের আনুগত্য বলতে দেশের রাষ্ট্রপতি প্রজাগণের কল্যাণে যা যা আদেশ-নিষেধ করিবেন তাহা মানিতে হইবে।" এটাই হলো সংবিধানের মৌলিক নীতিমালার একটি। তো একজন রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ভেতরে থেকে কাজ করেন। এখন তিনি কি কি আদেশ-নিষেধ করবেন অথবা করবেন না, আর জনগণকেও তাঁর কী কী মানতে হবে অথবা হবে না এসবের সকল কিছুই ধরে ধরে বলে দেওয়া হয় নাই সংবিধানের ভেতরে। কিন্তু রাষ্ট্রপতি কে যে মানতে হবে এই মর্মে কেবলমাত্র মৌলিক নির্দেশনা বলে দেওয়া হয়েছে।
ঠিক পবিত্র কোরআনের ক্ষেত্রেও অনুরূপ, রাসূল ﷺ কী কী আদেশ- নিষেধ করবেন অথবা করবেন না তার সমস্ত কিছুই ধরে ধরে বলে দেয়া হয় নাই কেবলমাত্র তাঁর আনুগত্য করতে হবে, তাঁর অনুসরণ করতে হবে, তিনি যা দেয় তাই গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করে তাই মেনে নাও" এই মর্মে মৌলিক নির্দেশনা বলে দেওয়া ছাড়া। আর অবশ্যই রাসূল ﷺ যা যা আদেশ-নিষেধ করবেন অথবা বলবেন তা ধরে ধরে বলতে হবে না কোরআনে। কেননা কোরআন তো রাসূলের বাণী নয় বরং এটি আল্লাহর বাণী। তাই কোরআনের মাধ্যমে রাসূলের নয় বরং আল্লাহর আনুগত্য করা হয়। আর আল্লাহর আনুগত্য করতে গেলে রাসূলের প্রতিটি কথা, আদেশ-নিষেধ সহ সকল কিছুই মান্য করতে হবে। আর তাঁর এসব জানার একমাত্র উপায় হলো তাঁর সুন্নাহ তথা সহীহ হাদিস। সুতরাং সহীহ হাদিসের মাধ্যমে রাসূলের আনুগত্য করা হয়। কাজেই কোরআন ও সুন্নাহ দুটোই মানতে হবে।
এই জন্যই তো মহান আল্লাহ্ পবিত্র কোরআন মাজীদের ৪ নং সূরা আন নিসার ৬৫ নং আয়াতে এরশাদ করেছেন:
فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّىٰ يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا۟ فِىٓ أَنفُسِهِمْ حَرَجًا مِّمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا۟ تَسْلِيمًا
অর্থঃ অতএব তোমার রবের শপথ! তারা কখনই বিশ্বাস স্থাপনকারী হতে পারবে না, যে পর্যন্ত তোমাকে তাদের সৃষ্ট বিরোধের বিচারক না করে, অতঃপর তুমি যে বিচার করবে তা দ্বিধাহীন অন্তরে গ্রহণ না করে এবং ওটা সন্তষ্ট চিত্তে কবূল না করে।" [অনুবাদক: মুজিবুর রহমান]
এখানে মহান আল্লাহ্ প্রথমেই তাঁর নিজের শপথ করে কোরআন নয় বরং রাসূল ﷺ এর সিদ্ধান্তকে চুড়ান্ত বলেছেন। তাহলে রাসূল ﷺ ইসলামিক বিধিবিধানের কোন কোন ক্ষেত্রে কী কী সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন বা দেন নাই অথবা বলেছেন অথবা বলেননি সে সকল আদেশ-নিষেধ কোথায় থেকে পাব যদি সহীহ হাদিস না মানি? আর তা যদি কোরআনের ভেতরে থাকত তাহলে আল্লাহ্ রাসূল নয় বরং কোরআনের সিদ্ধান্ত কে চুড়ান্ত বলত অথচ তা তিনি বলেননি এই আয়াতের মধ্যে যা সুস্পষ্ট। কেননা যা কোরআনের ভেতরে রয়েছে তা রাসূলের উপর অর্পণ করত না মহান আল্লাহ্। আর এটাই সুস্থ স্বাভাবিক মস্তিষ্ক ব্যবহার করে লজিক্যালী বোঝা যাচ্ছে। তাহলে আমি সহীহ হাদিস বহির্ভূত এই আয়াতটা কিভাবে যৌক্তিকতার আলোকে বুঝব???? যারা আল্লাহর রাসূল ﷺ এর সহীহ হাদিস অস্বীকার করেন তাদের থেকে এর প্রামানিক জবাব চাই অত্যন্ত যৌক্তিক ভাবে। যদি মহান গ্রন্থ কোরআনের উপর ধৃষ্টতা প্রদর্শন না করেন তাহলে এর উত্তরটা আশা করি সঠিক ভাবে দিয়ে যাবেন অন্যথায় আপনাদের কেবলমাত্র কোরআন মানার মিথ্যা দাবিদার হিসেবে প্রমাণিত হবে।
এখন আসা যাক বিশ্লেষণের দিকে। মহান আল্লাহ্ পবিত্র কোরআনে বিভিন্ন বিষয়ের শপথ করেছেন যেমনটা তিনি বলেছেন, "শপথ বিজ্ঞানময় কোরআনের, শপথ আকাশের, শপথ সুস্পষ্ট কিতাবের, শপথ কলমের, শপথ ফযরের, শপথ বায়ুর, শপথ কিয়ামত দিবসের, শপথ ফেরেশতার, শপথ রাত্রির ইত্যাদি আয়াত দ্রষ্টব্য [পবিত্র কোরআন ৩৬:২; ৯১:৫; ৪২:২; ৬৮:১; ৮৯:১; ৭৭:১-৫; ৭৫:১; ৭৯:১-৫; ৭৪:৩৩ ইত্যাদি]। তিনি আরো শপথ করেছেন মক্কা নগরীর, ত্বীন ও যায়তুনের; তো মহান আল্লাহ্ এইভাবে শপথ করেছেন।
কিন্তু এটা একটা ইউনিক আয়াত যেখানে স্বয়ং মহান রব্বুল আলামীন তাঁর নিজের ব্যপারে শপথ করে বলেছেন। তিনি এখানে শপথ করলেও তিনি কিন্তু এভাবে বলেননি যে, "আমি আসমান ও যমিনের স্রস্টার শপথ করে বলছি অথবা এমনও বলেননি, "আমি সকল কিছুর মালিকের শপথ করে বলছি।" বরং এখানে মহান আল্লাহ্ এভাবে বলেছেন, "فَلَا وَرَبِّكَ/আপনার প্রতিপালকের শপথ" করে বলছি...। আর এখানে আপনি " كَ/কা" শব্দটি হলো Singular, যা সরাসরি মহানবী ﷺ কে নির্দেশ করা হয়েছে অর্থাৎ যে শপথে আল্লাহ্ স্বয়ং নিজের ব্যপারে বলছেন সে শপথে তিনি মহানবী ﷺ কেও সাথে রেখেছেন।
তো কী এমন গভীর বিষয়, যেখানে আল্লাহ্ কোন কিছু সম্পর্কে বলার আগেই তিনি নিজে শপথ করে নিচ্ছেন? আল্লাহ্ বলছেন:-"لَا يُؤْمِنُونَ/তারা বিশ্বাসী নয় অথবা তারা ঈমানদার নয়।" আল্লাহ্ তাদের বিষয়ে এখনো কোন কথাই বলেননি কিন্তু যাদের বিষয়ে বলবেন, তাদের একতোলা পর্যন্তও ইমান নেই। এবং আল্লাহ্ সুবাহানাহু ওয়াতাআ'লা এ বিষয়ে এতটাই কঠোর যে, তাদের একতোলাও ইমান নেই, তাই এ বিষয়ে শপথের জন্য তিনি তাঁর নিজেকেই ব্যবহার করলেন। কারণ বিষয়টার গভীরতা বোঝানোর জন্য যে,"আমি আমার (তোমার পালনকর্তার) শপথ করে বলছি তারা ঈমানদার নয়। তো এই লোকগুলো কারা এবং কেন তাদের ইমান নেই? এ ব্যপারে আয়াতের পরের অংশে বলা হয়েছে। তিনি বলেছেন:-"حَتَّىٰ يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيۡنَهُمۡ/তারা যে পর্যন্ত আপনাকে তাদের সৃষ্ট বিরোধের বিচারক না করে অথবা তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী হিসেবে মেনে না নেয়।"
আল্লাহ্ কিন্তু এটা বলেননি যে, "তারা বিশ্বাসী নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা কোরআন কে তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী হিসেবে মেনে না নিবে (হাত্তা-ইউহাক্কিমু কুরআন ফীমা-শাজারা বাইনাহুম)" অথবা যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা আপনার প্রতি যা নাযিল করেছি (কোরআন) সেটাকে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী হিসেবে মেনে নিবে (হাত্তা-ইউহাক্কিমু মাআনজালনা ইলাইকা...)।" কিন্তু নাহ! মহান আল্লাহ্ এমনটাও বলেননি। আল্লাহ্ বলেছেন, "যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা আপনাকে তাদের চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী হিসেবে মেনে নিবে, তাদের মধ্যে কোন কার্যকর বিবাদ বা সমস্যার বিষয়ে, ততক্ষণ পর্যন্ত তারা বিশ্বাসী নয়। তো আল্লাহ্ সুবাহানাহু ওয়াতা'আলা এই আয়াতের মাধ্যমে নবীকে এই পর্যায়ে উন্নীত করেছেন।
তো মহানবী ﷺ কে কেন, কেন কোরআনের সিদ্ধান্ত কে চুড়ান্ত বলা হয়নি? কেন নবীকে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী বলা হয়েছে? এ আয়াতের মাধ্যমে এ প্রশ্নটাই উঠে আসে। এবং মহান আল্লাহ্ তা'আলা তাঁর নিজের শপথের মাধ্যমে এই কথার গভীর তাৎপর্যটাই বুঝিয়েছেন।
যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা মহানবী ﷺ এর সিদ্ধান্ত কে মেনে না নিই অথবা সম্পূর্ণরুপে সন্তুষ্ট না হই এবং আমাদের উপরে যে সমস্যাই আসুক না কেন সে ব্যপারে অর্থাৎ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ (ফীমা-শাজারা বাইনাহুম)..। আর এখানে "شَجَرَ/শাজারা/arises" চমৎকার একটি শব্দ যার অর্থ উপরে উঠতে থাকা, উন্নীত হওয়া যেটা কিয়ামত পর্যন্ত উন্নীত হতেই থাকবে এমন কিছু কে বোঝানো হয়। এর অর্থ এই উম্মাহের কাছে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন সমস্যা আসতেই থাকবে। আর এ সকল সমস্যার সমাধানের পেছনে সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপাদান হিসেবে যিনি থাকবেন তিনি হলেন আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ ﷺ ।ثُمَّ لَا يَجِدُوا۟ فِىٓ أَنفُسِهِمْ حَرَجًا مِّمَّا قَضَيْتَ. এখানেই কিন্তু শেষ নয়। আপনার এবং আমার বিশ্বাস এখনো কিন্তু এই আয়াতের কিছু শর্তের উপর নির্ভর করছে। আমরা যদি সে শর্ত পূরণে ব্যর্থ হই তাহলে আয়াতের কথানুযায়ী আমরা কিন্তু মোটেই বিশ্বাসী নই। তিনি যেমন বলেছেন, " (ছুম্মা লাইয়াজিদূফীআনফুছিহীম হারাজাম মিম্মা-কাদাইত) এরপর তারা তাদের নিজেদের ভেতরে, তাদের একদম গভীরে কোন ধরনের সংকীর্ণতা অনুভব না করে বরং তা যেন হৃদয়ের গভীর থেকে সন্তুষ্টিচিত্তে গ্রহণ করে। অর্থাৎ তুমি যা নির্ধারণ করেছ অথবা যে সিদ্ধান্ত দিবে তাতে তারা নিজেদের মধ্যে যেন কোন দ্বিধাহীনচিত্তে না থাকে বরং তা যেন সন্তুষ্টিচিত্তে মেনে নেয়। কোন ধরণের অসন্তোষ অথবা খারাপ লাগা থাকবে না কিসের উপরে? "قَضَيْتَ/what ever you decided" আপনি যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন তার উপর। এর মানে আবারো একবার মুহাম্মদ ﷺ কে তাঁর সিদ্ধান্ত দেওয়ার, তাঁর রায় দেওয়ার অবস্থান প্রদান করা হলো।
তাহলে আমরা পাই:
১] প্রথমত তোমাদের বিচারের জন্য, তোমাদের মতামতের জন্য নবী ﷺ এর কাছে আসো অর্থাৎ يُحَكِّمُوكَ (ইউহাক্কিমু' কা)-they make you judge.
২] তারপর "مِّمَّا قَضَيۡتَ (মিম্মা ক্বদাইতা)-what about you decided। অতঃপর আপনি (নবী) যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং যে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন সেটার উপর তাদের সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট থাকতে হবে
এর মানে বোঝায় তাদের মধ্যে চুল পরিমাণও অসন্তোষ বা খারাপ লাগা থাকবে না, আপনি যে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন তার উপর। আর নবী ﷺ
এর উপর আমাদের এরুপ-ই চরম ধরনের আনুগত্য থাকা উচিত।
এই আয়াতের শেষে মহান আল্লাহ্ আরো বলেছেন যে:-"وَيُسَلِّمُواْ تَسۡلِيمًا (ওয়া ইউসাল্লিমু তাসলীমা) এবং তারা ক্রমাগত ভাবে তাঁর (নবীর) প্রতি নত থাকবে, নত থাকবে এমনভাবে যে এর চেয়ে আর অনুগত হওয়া যায় না। অর্থাৎ তারা চুড়ান্ত ভাবে, সর্বাত্মক ভাবে সব কিছু দিয়ে নবীর প্রতি অনুগত থাকবে এবং যে আনুগত্যের ধারা কখনোই শেষ হবে না।
এখানে ওয়া ইউসাল্লিমু তাসলীমান বলতে এমনটা বোঝানো হয় যে, তারা ক্রমাগত ভাবে এমনটা করতেই থাকবে অর্থাৎ আনুগত্য করতেই থাকবে but not end. আর তাদের এই আনুগত্যের উপর বার বার, বার বার চ্যালেঞ্জ আসতেই থাকবে। এই জন্যই তো আমরা মুসলিম জাতিকে রাসূল ﷺ এর আনুগত্যের জন্য বার বার চ্যালেঞ্জের মুখে পতিত হতে হচ্ছে।
আয়াতটার কথা এমন নয় যে, রাসূল ﷺ যে নির্দেশ দিয়েছেন তাঁর বিরুদ্ধে ভিন্ন কোন মত পোষণ করতে পারব। এখানে যেটা বলা হয়েছে, "আমরা সামান্যতম খারাপ বা অসন্তোষ অনুভব করতে পারব না নবী ﷺ যে নির্দেশ দিয়েছেন তার ব্যপারে।
আর মহান আল্লাহ্ তাআলা মূলত এই আয়াতের মাধ্যমে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ ﷺ এর মর্যাদা যে কত সেটা স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছেন যার জন্য তিনি এখানে নিজেকে দিয়ে শপথ করে নিয়েছেন আগে, তাঁকে উন্নত থেকে আরো উন্নতর করেছেন। তাঁকে এমন উন্নত করেছেন অথবা এমন মর্যাদা দান করেছেন যার কোন শেষ নেই।
পার্ট: ৪
আরেকটা উদাহরণ দেই, এটা বুঝানোর জন্য যে, কেন নবী ﷺ এর কথা কোরআনের আয়াত থেকে সম্পূর্ণরূপে অবিচ্ছেদ্য অংশ। আবার আমরা সবাই কম বেশি ইসলামিক হিস্ট্রি জানি। আবার কমন সেন্স ব্যবহার করে যৌক্তিকতার আলোকেও অনেক কিছুর সঠিকত্ব জানা এবং বোঝা যায়। অন্তত এই জ্ঞান টুকু সবার-ই আছে বলে মনে করি।
নবী ﷺ যখন প্রথম কোরআন পাওয়া শুরু করলেন, তখন তিনি নিশ্চয়ই এরুপটা বলেছিলেন যে, "আমি আল্লাহর তরফ থেকে ওহী পাচ্ছি।" (এসব সহীহ হাদিস ও সীরাতের গ্রন্থ গুলো পড়লে জানা এবং বোঝা যায়)। তো অনেকেই এ বিষয়ে সংশয়- সন্দেহ প্রকাশ করেছিল যে, "আমরা কিভাবে বিশ্বাস করব যে, আপনি যে বাণীগুলো পাচ্ছেন তা মূলত আল্লাহর বাণী? যে এই কথাগুলো তিনি বানিয়ে বলছেন না, সে কথাগুলো মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে? কি কারণে আমরা তাঁর উপর এত আস্থা রাখতে পারব?
মহান আল্লাহ্ তাঁকে (নবী ﷺ) কে বিশ্বাস করার জন্য অনেকগুলো কারণ দিয়েছেন। তো মহান আল্লাহ্ তাঁকে বিশ্বাস করার অনেক কারণ বলে দিয়েছেন যার মধ্যে অন্যতম একটা হলো:
وَإِنَّكَ لَعَلَىٰ خُلُقٍ عَظِيمٍ
অর্থঃ তুমি অবশ্যই মহান চরিত্রের অধিকারী।" [পবিত্র কোরআন ৬৮:৪]
অর্থাৎ নবী ﷺ এর যে মহান চরিত্র, তিনি সবার সঙ্গে যেভাবে কথা বলেন, তাঁর যে মহৎ আচারণ, সততা-সত্যবাদিতা, বিশ্বস্ততা, আমানতদারীতা তাঁর এসকল মহান গুণাবলির সমষ্টি আর এগুলোই হলো তাঁর প্রমাণ যে, তিনি সত্যিই আল্লাহর একজন সম্মানিত রাসূল। আর এর দ্বারাই বোঝা যায় আপনি কখনো মানুষের সঙ্গে মিথ্যা বলবেন না, মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করবেন না, আপনি কোন সুযোগবাদী মানুষ নন আর এমনটা আপনি আপনার জীবনে কখনোই করেননি। আর তাঁর চারিত্রিক এসব বৈশিষ্ট্যগুলিই হচ্ছে বড় একটা প্রমাণ, তিনি যখন বলছেন যে আমি আল্লাহ্ তা'আলার একজন রাসূল। তখন তাঁর আশে- পাশের লোকজন এটা বুঝতে পারবে যে, হ্যাঁ! তিনি আল্লাহ্ তা'আলার একজন রাসূল।
আরো সহজ ভাবে বলতে গেলে, তাঁর মহান চরিত্র-ই প্রমাণ করে যে, কোরআন হলো আল্লাহ্ তা'আলার বাণী। কেননা এই লোকটির দীর্ঘ চল্লিশ বছরের রেকর্ড আছে যে, তিনি কখনোই একটা মিথ্যাও বলেননি, কখনো তাঁর দ্বারা একটা খারাপ কাজও সংঘটিত হয়নি, তাঁর বিরুদ্ধে কোন একটি মানুষের অভিযোগ পর্যন্ত ছিল না। এক কথায় এই লোকটির অতীত সম্পর্কে একটা মানুষেরও পর্যন্ত নেগেটিভ কমেন্ট ছিল না। সবাই এই জন্য তাঁকে আল-আমীন উপাধি দিয়েছিল।
আপনি কি চিন্তা করতে পারছেন? একজন মানুষের পক্ষে কিভাবে সম্ভব তবুও টানা চল্লিশটি বছর পর্যন্ত একটা মিথ্যা কথাও না বলে থাকতে পারে? হ্যাঁ, এই লোকটিই যখন বলছে, তাঁর কাছে ওহী আসে এবং তিনি আল্লাহর রাসূল। তখন তাঁর কথা বিশ্বাস করাই যায়। কেননা এই লোকটির অতীতে পর্যন্ত মিথ্যা বলা সহ কোন খারাপ কাজের একটাও পর্যন্ত রেকর্ড নেই।
এর মানে আল্লাহ্ তা'আলা তাঁকে এইভাবেই গড়ে তুলেছেন আগে থেকে। যেন এই লোকটি যখন কোন কথা বলবে আল্লাহর তরফ থেকে, তখন যেন সবাই দ্বিধাহীনচিত্তে মেনে নেয়। কেননা সবাই জানে, এই লোকটি কখনোই মিথ্যা বলেন নাই, কথার বরখেলাপ করেন নাই, তাঁর পরিবার- প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয় স্বজন, গরীব- দুঃখীদের সঙ্গে যেমন আচারণ করেন, যেমন কথা বলেন, যেমন কাজ করেন তা অন্যান্য অতুলনীয়। সুতরাং তিনি যা বলবেন তা অবশ্যই সত্য হিসেবে মেনে নেওয়ার যৌক্তিকতা রয়েছে অর্থাৎ তাঁকে বিশ্বাস করা যায় যে, যখন এই লোকটি বলছে, আমি আল্লাহর রাসূল, তখন হ্যাঁ! তিনি নিশ্চিত আল্লাহর রাসূল। এই জন্য আল্লাহ্ তা'আলা নবী ﷺ যে সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী তা জানিয়ে দিয়েছেন যে, এই লোকটিকে তোমরা নিজেরাই ভাল করে চিনো, যে তোমাদের সাথেই থেকেছে, যে তোমাদের সাথে থেকে কোন পরিস্থিতিতেই মিথ্যা বলেননি, তোমরা কাছে থেকে তাঁর লাইফ স্টাইল দেখেছ। সুতরাং তাঁর লাইফ স্টাইল কিভাবে insignificant হতে পারে যেখানে স্বয়ং মহান আল্লাহ্ তা'আলাই কোরআনে বর্ণনা করেছেন তাঁর চরিত্র সম্পর্কে।
অর্থাৎ মহান আল্লাহ্ তা'আলা রাসূল ﷺ এর চরিত্রের অনেক কিছুই কোরআনের গুরত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে, এর গ্রহণযোগ্যতার জন্য ব্যবহার করেছেন। তাহলে রাসূল ﷺ এর থেকে বর্ণিত সহীহ হাদিস গুলো কেন মানব না???? আল্লাহ্-ই তো এভাবে কথার বলার মাধ্যমে মূলত তাঁর এবং রাসূলের পুরোপুরি আনুগত্য করতে বলেছেন। আমরা যেমন কোরআনের বাইরেও কথা বলি ঠিক অনুরূপ ভাবে রাসূল ﷺ ও কোরআনের বাইরে কথা বলতেন তবুও সব প্রয়োজনীয় বিষয়ে। আর তিনি যা বলতেন এটা মূলত ওহী সংশ্লিষ্ট কথা যা কোরআনের-ই অবিচ্ছেদ্য অংশ। আল্লাহ্ তাঁর এসব কে স্বীকৃতি দিয়েছেন তাঁর বান্দার জন্য। এই জন্য আল্লাহ্ তাঁর রাসূলের চরিত্রের প্রশংসা করেছেন স্বয়ং নিজেই وَإِنَّكَ لَعَلَىٰ خُلُقٍ عَظِيمٍ অর্থাৎ তুমি নিশ্চয়ই সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী; যা কোরআনের একটি ঝলক মাত্র। আর এভাবে অনেক কোরআনিক আর্গুমেন্ট রয়েছে
পার্ট: ৫
এরকম বেশ কিছু জিনিস রয়েছে যে ব্যপারে আপনি চিন্তা করতে পারবেন। তো এখান থেকে এ প্রশ্নের সাথে সম্পৃক্ত আরেকটা প্রশ্নের দিকে চলে যাচ্ছি। কোরআনে বলা হয়েছে, "এটি সুস্পষ্ট কিতাব [পবিত্র কোরআন ১২:১; ২৬:২; ২৭:১; ২৮:২; ৪৩:২; ৪২:২; ইত্যাদি আয়াত দ্রষ্টব্য]। অর্থাৎ কোরআন দাবি করছে তে, "এটা সুস্পষ্ট কিতাব।" এখন এটা যদি সুস্পষ্ট কিতাব হয় তাহলে এটাকে বোঝার জন্য বাইরের জিনিসের দরকার হয় কেন? তো আবারো এটা কিন্তু সমস্যা। তো চলুন আমরা কোরআনের অরিজিনটা বোঝার চেষ্টা করি।
যখন মানুষ প্রথম কোরআন পেয়েছিল অর্থাৎ মক্কার লোকেরা, যারা আল্লাহর রাসূল ﷺ এর সাথে দীর্ঘ চল্লিশটি বছর কাটিয়েছে তাঁর প্রতি কোন অভিযোগ ছাড়াই। যখন হঠাৎ করেই রাসূল ﷺ দাবি করলেন যে, তাঁর প্রতি আল্লাহর ওহী নাযিল হয় এবং তিনি আল্লাহর একজন রাসূল ﷺ, আর তিনি আল্লাহর এই বাণী কে প্রচার করতে শুরু করতে লাগলেন এবং মাঝে মধ্যে তিনি তাঁর নিজের কথাও বলতেন অর্থাৎ তিনি আল্লাহর বাণী দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি নিজের মতো করে মানুষকে এগুলো বোঝাতেন। কিন্তু আসল ব্যপার হচ্ছে আমাদের মতো তাদের কাছে পুস্তক আকারে কোরআন ছিল না যে, "এই হলো কোরআন আর এই হলো হাদিসের বই।
অর্থাৎ আমরা নিজেরাই যেভাবে কোরআনের বাণী দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে নিজের মতো করে অন্যকে কোরআন বুঝিয়ে দিই ঠিক অনুরূপ রাসূল ﷺ ও তাঁর নিজের মতো করে কোরআন কে বুঝিয়ে দিতেন যা মূলত আল্লাহ্-তা'আলাই তাঁকে হযরত জিব্রাইল আঃ এর মাধ্যমে শিখিয়ে দিতেন। কেননা তিনি নিজস্ব মনগড়া কোন কথাই বলতেন না।
এখন রাসূল ﷺ এর মাধ্যমে যারা ইসলামের জ্ঞান পেয়েছিলেন, এটার অনুভূতি কিন্তু অন্যরকম-ই ছিল। এটা কেবলমাত্র রাসূল-ই ছিলেন, শুধুমাত্র তাঁর কথা। যখন তিনি কথা বলেন এটাই কোরআন; আবার যখন তিনি কথা বলেন এটাই হাদিস তথা সুন্নাহ। এ দুটো মূলত একই। লোকরা ফিজিক্যালী এ দুটো কে আলাদাও করতে পারত না অর্থাৎ তাদের জন্য এ দুটো মূলত একই জিনিস ছিল। তো এখানে এই বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং লজিক্যাল কথা যে, আল্লাহ্ সুবাহানাহু ওয়াতা'আলা কেন দুটো আলাদা কিতাব পাঠাননি যে, এটা আল্লাহর বাণী তথা কোরআন, আর এটা হাদিস তথা রাসূলের সুন্নাহ। আর আপনাকে কেবলমাত্র কোরআন-ই মানতে হবে যেটা স্বয়ং আল্লাহর বাণী, আর সুন্নাহ তথা হাদিস সেটা না মানলেও হবে যেহেতু এটা রাসূলের কথা। আর আল্লাহ্ তা'আলাও তাঁর রাসূল ﷺ কে কেবলমাত্র তাঁর বাণীই পৌঁছে দেওয়ার জন্যই পাঠাননি যেমনটা ফেরেক্স, ইউপিএস, দারাজ এরা করে থাকে, এমনটা নয়। কেউ আপনাকে একটা প্যাকেজ ডেলিভারি করল, তাকে আপনার না চিনলেও চলবে, সম্মান না করলেও চলবে এমন নয়, আপনি কেবলমাত্র প্যাকেজটার অ্যাপ্রিসিয়েট তথা প্রশংসা করবেন কিন্তু যে ডেলিভারি করেছে তাকে অ্যাপ্রিসিয়েট করবেন না। কিন্তু নবী ﷺ এর দায়িত্ব কিন্তু কেবলমাত্র আল্লাহর বাণী পৌঁছে দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। কোরআন কে সুস্পষ্ট বোঝার জন্য, আল্লাহ্ এখনো যে বিষয়টাকে স্পষ্ট করছেন কোরআনকে সুস্পষ্ট বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য এটাকে ডেলিভারি করতে হবে একটা রোল মডেলের মাধ্যমে।
কারণ কোরআন কেবলমাত্র থিওরি; এটা নিজে শুধুমাত্র থিওরি। কিন্তু এটাকে কিভাবে বাস্তবে রূপ দিবেন, তার জন্য আল্লাহ্ একজন জলজ্যান্ত রোল মডেল দিলেন, যিনি হাতে কলমে সব কিছুই আমাদের করে দেখাবেন এবং তিনি ছিলেন সে, যে এটাকে বলতেন এবং যিনি এটাকে পড়ে শোনাতেন। তাই এটাও ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, এ দুটো বিষয় যেন একদম সম্পৃক্ত অবস্থায় থাকে। এবং কুরাইশরা কিন্তু এ ব্যপারেই অভিযোগ করেছিল যে, "আল্লাহর বাণী কেন আকাশ থেকে উড়ে উড়ে আসে না আমাদের কাছে? মানে কাগজের রোল কেন আকাশ উড়ে উড়ে আসে না আমাদের কাছে? যেন তারা নিজ হাত দিয়ে স্পর্শ করতে পারে আর বুঝতে পারে, হ্যাঁ! এটাই আল্লাহর বাণী কিন্তু না, এটা মোটেই কোরআন কে সুস্পষ্ট করত না এবং কী তারাও মানত না। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় আল্লাহ্ যখন বলেছেন, "তোমরা আল্লাহর ব্যপারে সতর্ক থাকো।" এর দ্বারা তিনি কি বুঝিয়েছেন? আপনি বাস্তবে এটা কিভাবে বুঝবেন? এটা বুঝতে পারতেন নবী ﷺ এর আচারণের মাধ্যমে। অর্থাৎ এই কোরআনের মধ্যে যে কথাগুলো রয়েছে, যে আইডিয়াগুলো রয়েছে সেটা বাস্তবে রূপ পেত নবী ﷺ এর আচারণ-আচারণ ও কর্মের মাধ্যমে। এই জন্য আল্লাহ্ নবী ﷺ কে সমগ্র মানবজাতির জন্য উত্তম আদর্শ হিসেবে ঘোষণা করেছেন, যেন আমরাও তাঁকে ফলো করে চলতে পারি [পবিত্র কোরআন ৩৩:২১]।
এখন তাঁকে ফলো করার জন্য আমাদের জানতে হবে তাঁর দেওয়া শিক্ষা যা মূলত সহীহ হাদিস থেকেই পাওয়া যায়।