মুহাম্মাদ ﷺ ইসমাইল (আ.) এর বংশধর হওয়া প্রসঙ্গে একটি যৌক্তিক পর্যালোচনা:
প্রথমেই জানিয়ে রাখা ভালো, মুহাম্মাদ (স) ইসমাইলের বংশধর হওয়ার নতুন কোনো দাবি নিয়ে হাজির হননি, বরং তৎকালীন সমাজের সবাই জানতো কুরাইশগণ হযরত ইব্রাহিম (আ) এর বংশধর। কুরাইশরা নিজেরাও এ নিয়ে গর্ব করতো [আর রাহিকুল মাখতুম,পৃষ্ঠা ৬২]।মুহাম্মাদ (স) যেহেতু কুরাইশ বংশের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, সুতরাং, তিনিও স্বাভাবিক ভাবেই ইসমাইল (আ) এর বংশধর।
মুহাম্মাদ (স) সত্যিই ইসমাইল (আ) এর বংশধর কিনা ধর্মীয় ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে আসুন যাচাই করে দেখি।
◾কুরআন থেকে প্রমাণ:-
আল-কুরআন মুহাম্মাদ(স) এর সময়কার ঘটনাবলির একটি ঐতিহাসিক স্বাক্ষ্যরূপে গণ্য হতে পারে।কুরআন থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে,মুহাম্মাদ(স) হলেন ইসমাইল(আ) এর বংশধর।
সূরাঃ আল-বাকারা [2:127-129]
وَإِذْ يَرْفَعُ إِبْرَٰهِۦمُ ٱلْقَوَاعِدَ مِنَ ٱلْبَيْتِ وَإِسْمَٰعِيلُ رَبَّنَا تَقَبَّلْ مِنَّآ إِنَّكَ أَنتَ ٱلسَّمِيعُ ٱلْعَلِيمُ
رَبَّنَا وَٱجْعَلْنَا مُسْلِمَيْنِ لَكَ وَمِن ذُرِّيَّتِنَآ أُمَّةً مُّسْلِمَةً لَّكَ وَأَرِنَا مَنَاسِكَنَا وَتُبْ عَلَيْنَآ إِنَّكَ أَنتَ ٱلتَّوَّابُ ٱلرَّحِيمُ
رَبَّنَا وَٱبْعَثْ فِيهِمْ رَسُولًا مِّنْهُمْ يَتْلُوا۟ عَلَيْهِمْ ءَايَٰتِكَ وَيُعَلِّمُهُمُ ٱلْكِتَٰبَ وَٱلْحِكْمَةَ وَيُزَكِّيهِمْ إِنَّكَ أَنتَ ٱلْعَزِيزُ ٱلْحَكِيمُ
এবং যখন ইব্রাহীম ও ইসমাঈল কা’বাগৃহের ভিত্তি স্থাপন করছিলো,তাঁরা দোয়া করেছিলো: হে আমাদের পালনকর্তা!আমাদের থেকে (এই কাজ) কবুল করো। নিশ্চয়ই তুমি শ্রবণকারী,সর্বজ্ঞ।
হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদের উভয়কে তোমার আজ্ঞাবহ করো এবং আমাদের বংশধর থেকেও একটি অনুগত দল সৃষ্টি করো, আমাদের হজ্বের রীতিনীতি বলে দাও এবং আমাদের ক্ষমা করো। নিশ্চয়ই তুমি তওবা কবুলকারী, দয়ালু। হে আমাদের পালনকর্তা! তাদের মধ্যে থেকেই তাদের মাঝে একজন রাসুল প্রেরণ করুন যে তাদের কাছে তোমার আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করবে, তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দিবে এবং তাদের পবিত্র করবে। নিশ্চয়ই তুমিই পরাক্রমশালী,প্রজ্ঞাবান।
এটা ইব্রাহীম (আ.)-এর শেষ দোয়া। তাঁর এ দোয়াও আল্লাহ তা'আলা কবুল করেন এবং ইসমাঈল (আ.)-এর সন্তানদের মধ্য থেকে মুহাম্মাদ (সা.)-কে প্রেরণ করেন।
রাসূল (সা.) বলেছেন, আমি হলাম আমার পিতা ইব্রাহীম (আ.)-এর দোয়া, ঈসা (আ.)-এর দেওয়া সুসংবাদ এবং আমার মায়ের স্বপ্ন। [মুসনাদে আহমাদঃ ৫/২৬২,ফাতহুররাব্বানী ২০/১৮১-১৮৯]
কুরআনে দোয়াটির প্রতিফলন প্রায় একই বাক্যে ও একই শব্দে মুহাম্মাদ (স.) এর উপর প্রযুক্ত হয়। যেমন:-
সূরাঃ আল-জুমুআহ [62:2]
هُوَ ٱلَّذِى بَعَثَ فِى ٱلْأُمِّيِّۦنَ رَسُولًا مِّنْهُمْ يَتْلُوا۟ عَلَيْهِمْ ءَايَٰتِهِۦ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ ٱلْكِتَٰبَ وَٱلْحِكْمَةَ وَإِن كَانُوا۟ مِن قَبْلُ لَفِى ضَلَٰلٍ مُّبِينٍ
তিনিই উম্মীদের মাঝে তাদের মধ্য থেকে একজন রাসুল (মুহাম্মাদ ﷺ) প্রেরণ করেছেন, যে তাদের কাছে তিলাওয়াত করে তাঁর আয়াতসমূহ, তাদেরকে পবিত্র করে এবং তাদেরকে শিক্ষা দেয় কিতাব ও হিকমাত। যদিও ইতঃপূর্বে তারা স্পষ্ট পথভ্রষ্টতায় ছিলো।
সূরাঃ আল-ইমরান [3:164]
لَقَدْ مَنَّ ٱللَّهُ عَلَى ٱلْمُؤْمِنِينَ إِذْ بَعَثَ فِيهِمْ رَسُولًا مِّنْ أَنفُسِهِمْ يَتْلُوا۟ عَلَيْهِمْ ءَايَٰتِهِۦ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ ٱلْكِتَٰبَ وَٱلْحِكْمَةَ وَإِن كَانُوا۟ مِن قَبْلُ لَفِى ضَلَٰلٍ مُّبِينٍ
আল্লাহ মুমিনদের উপর বড় অনুগ্রহ করেছেন যে তিনি তাদের মাঝে তাদের মধ্য থেকে একজন রাসুল প্রেরণ করেছেন, যে তাদের কাছে তাঁর আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করে এবং তাদেরকে পরিশুদ্ধ করে আর তাদেরকে কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দেয়। যদিও তারা ইতঃপূর্বে স্পষ্ট ভ্রান্তিতে ছিলো।
◾হাদিস থেকে প্রমাণ:-
ওয়াসিলাহ্ ইবনুল আস্ক্বা' (রা.) থেকে বর্ণিত-রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ আল্লাহ তা’আলা ইসমাঈল (আ.) এর বংশধর হতে কিনানাহ্ গোত্রকে বাছাই করেছেন, কিনানাহ্ গোত্র হতে কুরাইশকে বাছাই করেছেন, আবার কুরাইশদের মধ্য হতে হাশিমকে বাছাই করেছেন এবং বনূ হাশিম হতে আমাকে বাছাই করেছেন। [সূত্র:- জামে' আত-তিরমিজি,হাদিস নং-৩৬০৬,সহিহ মুসলিম(ইফা),হাদিস নং-৫৭৩৯,সহীহাহ্ -৩০২] হাদিসের মান: সহিহ হাদিস
◾ইহুদি-খ্রিষ্টীয় উৎস থেকে প্রমাণ:-
বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্ট অংশটি ইহুদি ও খ্রিস্টান উভয় সম্প্রদায়ের নিকটই ঐশীবাণী হিসেবে স্বীকৃত। ইহুদিগণ ওল্ড টেস্টামেন্টকে 'তানাখ' নামে অভিহিত করে থাকেন। ওল্ড টেস্টামেন্টমতে, ইশ্মায়েল হলো ইশ্বরের আশীর্বাদধন্য এবং তাঁর বংশ থেকে এক মহান জাতি সৃষ্টি করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন স্বয়ং ইশ্বর।
আদিপুস্তক ১৭:২০
ולישמעאל שמעתיך הנה ׀ ברכתי אתו והפריתי אתו והרביתי אתו במאד מאד שנים־עשר נשיאם יוליד ונתתיו לגוי גדול׃
20. “তুমি ইশ্মায়েলের কথা বলেছো এবং আমি সে কথা শুনেছি।আমি তাকে আশীর্বাদ করবো।তার বহু সন্তানসন্ততি হবে।সে বারোজন মহান নেতার পিতা হবে। তার পরিবার থেকে সৃষ্টি হবে এক মহান জাতির।
ওল্ড টেস্টামেন্ট স্বীকার করে যে, ইসমাইল (আ) মক্কা বা আরবে বসবাস করতেন এবং ইসমাইলের সন্তানগণও আরবের বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে ঘাঁটি স্থাপন করে। সুতরাং, নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দেখতে গেলে, মুহাম্মাদ ﷺ ইসমাইলের বংশধর হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।
বাইবেল অনুযায়ী ইশ্মায়েল/ইসমাইল (আ.) এর বসবাসস্থান ছিলো পারাণ। [আদিপুস্তক ২১:২১]
এই পারাণ প্রান্তর আসলে কোথায়? কুরআন ও হাদিস অনুযায়ী ইসমাইল (আ.) মক্কায় বসবাস করতেন, যা হেজাজ অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ,পারাণ দ্বারা স্বাভাবিকভাবেই হেজাজ অঞ্চলের বৃহত্তর মক্কা অঞ্চলকে বোঝানো হয়েছে।
◾এবার, ইতিহাসের আলোকে দেখি পারাণ আসলে কোথায়?
মুহাম্মাদ (ﷺ) এর সমসাময়িক যুগের একজন আর্মেনিয়ান দার্শনিক Anania Shirakatsi (610 AD - 685 AD) লিখেছেন:
"It (Arabia) has five small districts near Egypt,Tackastan, the Munuchiatis Gulf by the Red Sea, and Pharanitis, where the town of Pharan [is located], which I think the Arabs call Mecca."
মিশর ,তাকাস্তান, লোহিত সাগরের তীরে মুনুচিয়াটিস উপসাগর এবং পারাণাইটিস, যেখানে পারাণ শহর [অবস্থিত]। শহরটিকে আমি ধারণা করি আরবরা মক্কা বলে। এগুলোর নিকটে এটির (আরবের) পাঁচটি ছোট জেলা রয়েছে।.......[সূত্র:- Robert, H. Hewsen (1992). The Geography of Ananias of Sirak The Long and the Short Recensions. Wiesbaden. p. 71.]
বিশ্ববিখ্যাত ভূগোলবিদ আল-মুকাদ্দাসি (945 AD-991AD) তাঁর বইতে লিখেছেন: "লোহিত সাগরের তীরে হিজাজ অঞ্চলের প্রান্তসীমা হলো ফারাণ(পারাণ) নামক স্থানে।" [সূত্র:-Al-Muqaddasi, Muhammad (1994). The Best Divisions for Knowledge of the Regions. The United Kingdom: Garnet Pub. p. 11. ISBN 1873938144.]
অর্থাৎ, পারাণের অবস্থান হলো লোহিত সাগরের তীরে হিজাজের প্রান্তসীমায়। মক্কাও লোহিত সাগরের তীরে হিজাজের প্রান্তসীমায় অবস্থিত।
আরেকজন প্রাচীন ভূগোলবিদ ইয়াকুত আল হাওয়ামি(1179 AD–1229 AD) বলেছেন, "ফারাণ,একটি হিব্রু শব্দের আরবি রূপ,যা তাওরাতে বর্ণিত মক্কার অপর নাম।" [সূত্র:- Reuven Firestone (1990). Title Journeys in holy lands: the evolution of the Abraham-Ishmael legends in Islamic exegesis. SUNY Press. pp. 65, 205. ISBN 0585076294.]
ঐতিহাসিক ওয়াহাব ইবনে মুনাব্বিহ (654 AD-725 AD) তাঁর কিতাব আল তিজানে "তাল ফারান (Hill of Faran)" নামে একটি পাহাড়ের নাম উল্লেখ করে বলেছেন এটি মক্কার উপকন্ঠে অবস্থিত। [সূত্র:- ঐ]
২০০ খ্রি-৪০০ খ্রি এর মধ্যকার মিদরাসের পান্ডুলিপিতে রয়েছে-
The link between Paran and the Arabs (actually the Arabic language), who are also called Ishmaelites after Ishmael (among other names), is very early although somewhat vague."
অর্থাৎ, পারাণ অঞ্চল ও আরবরা একে অপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত।এদের মাঝে ইসমায়েলীয়দের মাধ্যমে যোগসূত্র রয়েছে। [সূত্র:-Haggai Mazuz, "Tracing possible Jewish influence on a common Islamic commentary on Deuteronomy 33:2" in Journal of Jewish Studies, Autumn 2016, vol. 67, no. 2, p. 294]
সুতরাং, পারাণ যে আরবে অবস্থিত, তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। ইতিহাসের আলোকে পারাণ দ্বারা হেজাজের বৃহত্তর মক্কা অঞ্চলকে বোঝানো হতো।
◾অনেক খ্রিস্টান দাবি করে পারাণ নাকি মিশরের সিনাই অঞ্চলের অংশ, আবার অনেকে দাবি করে পারাণ নাকি ইস্রায়েলের কাছাকাছি কোনো অঞ্চল। ইনশাআল্লাহ, দুটোকেই ভুল প্রমাণ করবো খোদ বাইবেল থেকেই।
ইহুদি-খ্রিষ্টানদের ধর্মগ্রন্থে স্পষ্টতই বলা হয়েছে যে ইসমায়েলীয়রা [Ishmaelites, ইসমাঈল (আ.) এর বংশধর] মিসরে থাকত না।
“তারা যখন খাবার জন্য বসল তখন তারা দেখতে পেল, গিলিয়দ থেকে ইসমায়েলীয়দের একটা কাফেলা আসছে। তাদের উটগুলো মশলা, সুগন্ধি তেল এবং গন্ধরস দ্বারা পূর্ণ ছিল। তারা সেগুলো মিসরে নিয়ে যাচ্ছিল।” [আদিপুস্তক ৩৭:২৫]
ইসমাঈল (আ.) এবং তাঁর বংশধররা যদি মিসরের সিনাই পেনিনসুলাতেই থাকত, তাহলে তারা আবার কীভাবে মিসরে উটে করে জিনিসপত্র নিয়ে যাচ্ছিলো?
"অতঃপর ইস্রায়েলীয়রা সিনাই এর মরুভূমি থেকে যাত্রা করল এবং বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে লাগল যতক্ষণ না মেখখণ্ড তাদেরকে পারাণের মরুভূমিতে নিয়ে এলো"। (গণনা পুস্তক ১০:১২)
এ থেকে বোঝা গেল যে, পারাণ ও মিসরের সিনাই মরুভূমি মোটেও এক জায়গা নয়; বরং ভিন্ন জায়গা। ইহুদিরা সিনাই এর মরুভূমি থেকে যাত্রা করে পারাণে গিয়েছিলো।
১ রাজাবলি ১১:১৪-১৮
14. সে সময় প্রভু ইদোমীয় হদদকে শলোমনের শত্রু করে তুললেন। হদদ ছিলো ইদোমের রাজপরিবারের সন্তান।
15. এক সময় দায়ূদ ইদোমকে পরাজিত করেছিলেন। তাঁর সেনাবাহিনীর প্রধান য়োয়াব তখন ইদোমে নিহতদের কবর দিতে যান। সে সময় ইদোমে অবশিষ্ট যারা জীবিত ছিলো যোয়াব তাদেরও হত্যা করেছিলেন।
16. যোয়াব ও ইস্রায়েলের লোকরা সে সময়ে 6 মাস ইদোমে ছিলেন। এইসময়ে তারা সমস্ত ইদোমীয়দের হত্যা করেন।
17. সে সময়ে হদদ ছিল নেহাতই শিশু। সে মিশরে পালিয়ে যায়। তার পিতার কিছু ভৃত্যও তখন তার সঙ্গে গিয়েছিল।
18. মিদিয়ন পার হয়ে তারা পারণে গিয়ে পৌঁছলে আরো কিছু লোক তাদের সঙ্গে যোগ দেয়।"
উক্ত আয়াতগুলো থেকে আরো স্পষ্ট হয়ে যায় যে পারাণ আসলে মক্কা অঞ্চলই। কারণ খ্রিস্টানদের দাবি অনুযায়ী পারাণ হলো ইস্রায়েল/ফিলিস্তিনভুক্ত কোনো জায়গা। তাই যদি হয়, তাহলে ইদোম থেকে মিদিয়ন পার হয়ে কিভাবে পারাণ যাওয়া সম্ভব? বরং ইদোম থেকে পারাণ পার হয়ে মিদিয়ন যাওয়ার কথা ছিলো।কারণ ইদোম ও খ্রিস্টানদের দাবিকৃত পারাণ, উভয়ই মিদিয়ানের উত্তর দিকে অবস্থিত। মিদিয়ন সৌদি আরবের একটি অঞ্চল। মিদিয়ন পার হলেই মক্কা-মদিনা। বাইবেল অনুযায়ীও মিদিয়ন পার হয়ে পারাণ যেতে হয়। পাঠকগণ ইদোম ও মিদিয়নের মানচিত্র দেখলে ব্যাপারটা খুব সহজেই বুঝতে পারবেন। কাজেই, প্রমাণিত হয় যে, মক্কা সংলগ্ন হেজাজ অঞ্চলই আসলে পারাণ।
বাইবেলে বারংবার ইসমাইল (আ.) ও তাঁর বংশকে আরবের সাথে সম্পর্কযুক্ত করা হয়েছে। ঐতিহাসিক ও সিরাতকারকদের মতে, মুহাম্মাদ (ﷺ) এর পূর্বপুরুষ ছিলেন ইসমাঈল (আ.) এর ছেলে কেদার (কাইদার) [আর রাহীকুল মাখতুম]।
বাইবেল বলছে যে, কেদারের বংশধরেরা আরবে বসবাস করতো।
"আরব দেশ এবং কেদার বংশের সমস্ত নেতারা ছিলো তোমার ক্রেতা। তারা মেষশাবক, ভেড়া ও ছাগল এগুলোর ব্যাপারে তোমার সাথে বাণিজ্য করত।” [বাইবেল, যিহিষ্কেল (Ezekiel/হিজকিল) ২৭: ২১]
যীশাইয় (Isaiah) :২১/১৩-১৮
আরবের প্রতি ঈশ্বরের বার্তা
13. আরব সম্বন্ধে দুঃখের বার্তা:
দেদান থেকে এক দল ব্যবসায়ী তাদের ব্যবসার জিনিসপত্র পশুর টানা গাড়িতে চাপিয়ে নিয়ে আসছে। আরবের মরুভূমিতে কিছু গাছের কাছে তারা রাত কাটালো।
14. তারা কিছু তৃষ্ণার্ত ভ্রমণকারীদের জল পান করালো। তেমার (তিহামা: লোহিত সাগরের তীরে অবস্থিত জনপদ) লোকরা ঐ ভ্রমণকারীদের খাদ্যও দিলো।
15. ঐসব লোক তরবারির নাগাল এড়িয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। তীরের আওতা থেকে তারা পালিয়ে বেড়াচ্ছে। বিধ্বংসী যুদ্ধের হাত থেকে বাঁচতে তারা পালিয়ে যাচ্ছিল।
16. সদাপ্রভু আমায় বলেছিলেন যে এই সব ঘটবে। প্রভু বলেছিলেন, “এক বছরের মধ্যেই, যে ভাবে একজন ভাড়াটে সহকারী সময় গোনে, কেদারের সমস্ত গৌরব অদৃশ্য হয়ে যাবে।17 সে সময় শুধু কয়েকজন তীরন্দাজ, কেদারের মহান সৈন্যরা বেঁচে থাকবে।” কারণ প্রভু, ইস্রায়েলের ইশ্বর বলেছেন!
এখানেও কেদারকে আরবের বাসিন্দা বলা হয়েছে।আরবের আরো বেশ কয়েকটি জনপদ ইসমায়েলীয়দের হাতে গড়ে উঠেছে। যেমন:-মাদইয়ান, দুমাহ তুল জান্দাল, দেদান প্রভৃতি।
◾অন্যান্য সেমিটিক উৎস থেকে প্রমাণ:-
ইহুদিদের মিদরাস (Midrash) Pirkei DeRabbi Eliezer এর ৩০ নং অধ্যায়ে ইসমাঈল (আ.) এর মরুভূমিতে বসবাসের বিস্তারিত বিবরণ আছে। ইসমাঈল(আ.) এর ২ জন স্ত্রীর নাম সেখানে পাওয়া যায়—আয়িশাহ ও ফাতিমাহ। নবী মুহাম্মাদ(ﷺ) এর একজন স্ত্রী ও কন্যার নামের সাথে হুবহু মিল। এই মিলের কথা যদি কাকতালীয়ও ধরে নিই, তারপরেও লক্ষণীয় যে, ‘আয়িশাহ’ ও ‘ফাতিমাহ’এই দুইটি নামই বিশুদ্ধ আরবি নাম। আয়িশাহ (عائشة) অর্থ প্রাণময়/জীবন্ত (alive) এবং ফাতিমাহ ( فاطمة) অর্থ ‘বিরত থাকা’ (to abstain)। ইসমাঈল(আ.) এর স্ত্রীদের আরবি নাম সহীহ বুখারীর হাদিসের তথ্যকেই সমর্থন করছে যে, ইসমাঈল(আ.) আরবভূমিতে ছিলেন, আরবদের সাথে তাঁর বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিলো। আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি যে, বাইবেল অনুযায়ী সেই আরবভূমি ছিল মক্কা-মদীনা।
ইহুদিদের একটি দল সামেরিদের 'আসাতির' গ্রন্থে সরাসরি উল্লেখ আছে,
“And after the death of Abraham, Ishmael reigned twenty seven years. And all the children of Nebaot [ইসমাঈল(আ.) এর পুত্র] ruled for one year in the lifetime of Ishmael, And for thirty years after his death from the river of Egypt to the river Euphrates; and they built Mecca.” [The Asatir – The Samaritan Book of The “Secret of Moses; Gaster, Moses (1927). VIII,page 262]
অর্থাৎ ইসমাঈল (আ.) এর বংশধরেরা তাঁর জীবদ্দশাতেই রাজত্ব করা শুরু করে। তাঁরা মক্কা নগরী নির্মাণ করেছে।
ঐ বইতেই প্রখ্যাত ইহুদি ঐতিহাসিক যোসেফাস (৩৭ খ্রি.-১০০ খ্রি.) এর উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে-
Josephus I. 12. 3. 221: "These inhabited all the countries from Euphrates to the Red Sea, and called it Nabatene." Gen. 25. 18. Pal.Targ.: "And they dwelled from Hindikia (Indian Ocean) to Palusa (Pelusiumt which is before Egypt as thou goest to Atur (Assyria). In Kebra Ch. 83: many countries are enumerated over which Ishmael ruled. "Built Mecca."
অর্থাৎ যোসেফাস এর মতে ইসমায়েলীয়রা মক্কা নির্মাণ করেছিলো।
সেই সাথে প্রখ্যাত গ্রিক ভূগোলবিদ টলেমির (১০০ খ্রি.-১৭০খ্রি.) উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে,
Already known to Ptolemy as Makoraba. Pitron has preserved the original reading באכה (ibid) Which they read Baka and took it to meana local name. Hence מכה (Maka/Makkah)into which it was afterwards changed.
টলেমির কাছে নগরটি ‘মাকোরাবা’ নামে পরিচিত ছিলো। এই নগরীর একটি স্থানীয় নাম ছিলো ‘বাকা’(বাক্কা)।
◾বাইবেলে কাবাঘরের বর্ণনা:-
বাইবেল,গীতসংহিতা/অধ্যায় ৮৪
1. হে সর্বশক্তিমান প্রভু, আপনার মন্দির সত্যিই অমূল্য!
2. আপনার মন্দিরে ঢুকতে গেলে আমি প্রতীক্ষা করতে পারি না। আমি অত্যন্ত উত্তেজিত! আমার প্রত্যেকটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ জীবন্ত ঈশ্বরের সঙ্গে থাকতে চায়।
3. হে সর্বশক্তিমান প্রভু, আমার রাজা, আমার ঈশ্বর, চড়ুই পাখিরা পর্যন্ত আপনার মন্দিরে তাদের আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে। আপনার বেদীর কাছেই ওরা বাসা বেঁধেছে এবং ওদের শাবকও আছে।
4. যারা আপনার মন্দিরে বাস করছে তারা খুবই ভাগ্যবান। ওরা এখনও আপনার প্রশংসা করছে।
5. হৃদয়ে সঙ্গীত নিয়ে যেসব লোকেরা আপনার মন্দিরে তীর্থ করতে আসছে তারা খুব খুশী!
6. তারা নির্ঝরের মত, বাক্কা উপত্যকা, যেটি ঈশ্বর তৈরী করেছিলেন, সেটি দিয়ে যাত্রা করে। শরতের বৃষ্টিতে পুকুরগুলো ভরে রয়েছে।
7 লোকরা যত ঈশ্বরের কাছে যায় তত শক্তিশালী হয়।
8. হে সর্বশক্তিমান প্রভু, আমার প্রার্থনা শুনুন। হে যাকোবের ঈশ্বর, আমার কথা শুনুন।
9. হে ঈশ্বর, আমাদের রক্ষাকর্তাকে সুরক্ষা দিন।আপনার মনোনীত রাজার প্রতি সদয় হোন।
10. অন্য জায়গায় এক হাজার দিন কাটানোর চেয়ে আপনার মন্দিরে একদিন কাটানো অনেক ভালো।একজন দুষ্ট লোকের ঘরে বাস করার চেয়ে আমার ঈশ্বরের গৃহের দ্বারে দাঁড়িয়ে থাকা অনেক ভালো।
11. প্রভুই আমাদের রক্ষাকারী ও মহিমময় রাজা।ঈশ্বর দয়া ও মহিমার সঙ্গে আমাদের আশীর্বাদ করেন। যে সব লোক তাঁকে অনুসরণ করে ও মান্য করে ঈশ্বর তাদের ভালো জিনিসগুলি দেন।
12. হে সর্বশক্তিমান প্রভু, যারা আপনাকে বিশ্বাস করে তারা প্রকৃতই সুখী!'
এই অধ্যায় পুরোটাই কাবাঘরকে নিয়ে। তা এখন প্রমাণ করা হবে। ৫ — ৬ নং আয়াতে বলা হয়েছে-
- "5. হৃদয়ে সঙ্গীত নিয়ে যেসব লোকেরা আপনার মন্দিরে তীর্থ করতে আসছে তারা খুব খুশী!
- 6. তারা নির্ঝরের মত, বাক্কা উপত্যকা, যেটি ঈশ্বর তৈরী করেছিলেন, সেটি হয়ে যাত্রা করে।"
বাকা বা বাক্কা হচ্ছে মক্কার হারাম অঞ্চলের প্রাচীন নাম। বাইবেলের গীতসংহিতা হচ্ছে দাউদ আ. এর ওপর নাযিলকৃত কিতাব {যাবুর} এর বিকৃত রূপ। এটি বাইবেলের পুরাতন নিয়ম {Old Testament} অংশে আছে এবং এটি ইহুদি ও খ্রিষ্টান উভয় ধর্মাবলম্বীদের স্বীকৃত গ্রন্থ। এই কিতাবে আমরা বাকায় তীর্থযাত্রী / হজ কাফেলাদের বিবরণ পাই। বাইবেলের পদটিতে আরও বলা হয়েছে যে , সেখানে আশীর্বাদ {blessings} বা বরকত আছে। আল কুরআনেও মক্কার বাক্কা নামের উল্লেখ পাওয়া যায় এবং এখানকার বরকতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কোনো কোনো অনুবাদে ওই স্থানে জলাশয়ের উল্লেখ পাওয়া যায় । এটিও বলা হয়েছে যে , তারা একে পানির নহরের স্থান গণ্য করে। মক্কায় কাবার নিকটেও জলাশয় আছে , বিপুল পানির সুপ্রাচীন আধার — যমযম কূপ।
আল কুরআনে সূরা ইমরানের ৯৬ ও ৯৭ নাম্বার আয়াতে বলা হয়েছে -
إِنَّ أَوَّلَ بَيْتٍ وُضِعَ لِلنَّاسِ لَلَّذِي بِبَكَّةَ مُبَارَكًا وَهُدًى لِّلْعَالَمِينَ ﴿٩٦﴾ فِيهِ آيَاتٌ بَيِّنَاتٌ مَّقَامُ إِبْرَاهِيمَ ۖ وَمَن دَخَلَهُ كَانَ آمِنًا ۗ وَلِلَّـهِ عَلَى النَّاسِ حِجُّ الْبَيْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ إِلَيْهِ سَبِيلًا ۚ وَمَن كَفَرَ فَإِنَّ اللَّـهَ غَنِيٌّ عَنِ الْعَالَمِينَ ﴿٩٧﴾
অর্থঃ নিঃসন্দেহে সর্বপ্রথম ঘর যা মানুষের জন্যে নির্ধারিত হয়েছে, সেটাই হচ্ছে এ ঘর, যা বাক্কা তে {মক্কা} অবস্থিত এবং সারা জাহানের মানুষের জন্য হেদায়েত ও বরকতময়। এতে রয়েছে মাকামে ইব্রাহিমের মত প্রকৃষ্ট নিদর্শন। আর যে লোক এর ভেতরে প্রবেশ করেছে, সে নিরাপত্তা লাভ করেছে। আর এ ঘরের হজ করা হলো মানুষের ওপর আল্লাহর প্রাপ্য, যে লোকের সামর্থ্য রয়েছে এ পর্যন্ত পৌঁছার। আর যে লোক তা মানে না — আল্লাহ সারা বিশ্বের কোনো কিছুরই পরোয়া করেন না।
এর থেকে সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায় দাউদ আ. এর আমলেও ইহুদিরা কাবায় হজ্ব করতো। এমনকি স্বয়ং দাউদ আ. ও তাদেরকে আশীর্বাদধন্য বলেছেন।
উল্লেখ্য যে, অনেক খ্রিস্টান দাবি করে থাকেন এই বাকা উপত্যকা হলো ইস্রায়েল কিংবা ফিলিস্তিন অঞ্চলভুক্ত কোনো জায়গা। কিন্তু গীতসংহিতা { Psalms } গ্রন্থের ৮৪ অধ্যায়ের ৫ — ৬ নং আয়াতে বাকার পাশাপাশি তীর্থযাত্রার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। ইতিহাসের আলোকে দাউদের আমলে কস্মিণকালেও ফিলিস্তিন/ইস্রায়েল অঞ্চলে ইহুদিদের কিংবা একত্ববাদী কোনো জাতির কোনোপ্রকার তীর্থযাত্রা হতো না। কাজেই বোঝা যাচ্ছে এখানে ইশ্বরের গৃহ দ্বারা কাবাঘরকে বোঝানো হয়েছে, বাক্কা দ্বারা মাক্কাকে বোঝানো হয়েছে এবং তীর্থযাত্রা দ্বারা হাজ্জকে বোঝানো হয়েছে।
বাইবেলের গীতসংহিতার( Psalms) ওই ৮৪ নং অধ্যায়েই ৩ নং পদে বলা হয়েছে -
- “3. হে সর্বশক্তিমান প্রভু, আমার রাজা, আমার ঈশ্বর, চড়ুই পাখিরা পর্যন্ত আপনার মন্দিরে তাদের আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে| আপনার বেদীর কাছেই ওরা বাসা বেঁধেছে এবং ওদের শাবকও আছে।"
অপর দিকে, ইবন হিশামের সীরাতুন নবী (ﷺ)-এ মক্কার কা’বা গৃহ সম্পর্কে একজন প্রাচীন আরব কবির কবিতা উল্লেখ করা হয়েছে:
"সেই পবিত্র ভূমির স্মরণে আমার চোখ থেকে অশ্রু ঝরে, শান্তির 'হারাম' ও হজের পবিত্র স্মৃতিসমূহ তার পরে, সেই পবিত্র ঘরের জন্য আমার প্রাণ কাঁদে, যেথায় কবুতর ও চড়ুই পাখিকে কষ্ট দেয়া হয়না ফাঁদে, বাস করে তারা সেথায় অবলীলায়, বন্য পশুরাও লক্ষ্যবস্তু হয়না শিকারীর খেলায়। [সূত্র:-সীরাতুন নবী(সা.) - ইবনে হিশাম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ), ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১২৬] ইবনে হিশাম উল্লেখ করেছেন যে, কোনো কোনো কবিতা-বিশারদের মতে এটাই আরবি ভাষায় রচিত প্রথম কবিতা।
বাইবেলের গীতসংহিতার (Psalms) ওই একই অধ্যায়ের ৮-১০ নং পদে বলা হয়েছে:
“হে সর্বশক্তিমান প্রভু, আমার প্রার্থনা শুনুন। হে যাকোবের [ইয়াকুব(আ.)] ঈশ্বর, আমার কথা শুনুন। হে ঈশ্বর, আমাদের রক্ষাকর্তাকে সুরক্ষা দিন। আপনার মনোনীত রাজার প্রতি সদয় হোন। অন্য জায়গায় এক হাজার দিনের চেয়ে আপনার মন্দিরের এক দিন অনেক ভালো। একজন দুষ্ট লোকের ঘরে বাস করার চেয়ে আমার ঈশ্বরের গৃহের দ্বারে দাঁড়িয়ে থাকা অনেক ভালো।”
এবার আমরা মক্কার মসজিদুল হারামে সলাত বা নামাজের ফযিলতের একটি হাদিস দেখি-
রাসুলুল্লাহ(ﷺ) বলেছেন, “মসজিদুল হারাম ছাড়া অন্যান্য মসজিদের তুলনায় আমার এই মসজিদে (মসজিদুন নববী) একটি সলাত (নামাজ) হাজার সলাত অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। আর অন্যান্য মসজিদের তুলনায় মসজিদুল হারামের একটি সলাত এক শত হাজার (১ লক্ষ) সলাত অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। [মুসনাদ আহমাদ; ইবন মাজাহ ১৪০৬, সহীহ]
অর্থাৎ,গীতসংহিতা ৮৪ অধ্যায় পুরোটাই কাবাঘরকে নিয়ে। দাউদের আমলে সলোমনের মন্দিরও ছিলো না।ফলে দাউদের পক্ষে সলোমনের মন্দির সম্পর্কে উক্তি করাও সম্ভব নয়। কাজেই গীতসংহিতা ৮৪ অধ্যায়ে ইশ্বরের গৃহ, বাক্কা,তীর্থযাত্রা সবগুলোই কাবাঘরের সাথে সম্পর্কিত।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে যে, দাউদ কেনো হঠাৎ করে মক্কা ও কাবাঘরের কথা বলতে যাবেন? উত্তরটা বাইবেলেই আছে। বাইবেল অনুযায়ী দাউদ বেশ কিছু সময় পারাণ প্রান্তরে কাটিয়েছেন। তাই পারাণ (মক্কা) অঞ্চলের বিভিন্ন জিনিস দ্বারা দাউদ আ. প্রভাবিত ছিলেন।
"1 এই সময়ে শমুয়েল মারা গেলেন ইসরায়েলের সমস্ত লোক সমবেত হয়ে তাঁর জন্য শোক প্রকাশ করল, আর রামায় তাঁর নিজের বাড়ীতে তাঁকে সমাধিস্থ করলো। এরপর দাউদ পারাণ প্রান্তরে চলে গেলেন।"{১ স্যামুয়েল ২৫:১}
অতএব, সকল তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় বাইবেলে বর্ণিত পারাণ আসলে মক্কা অঞ্চল এবং দাউদ (আ.) মক্কায় গিয়েছেন,কাবাঘর দেখেছেন,কাবাঘরের বিবরণ দিয়েছেন এবং কাবার তীর্থযাত্রীদের আশীর্বাদধন্য বলেছেন।
◾একটি প্রতিশ্রুতি:
আদিপুস্তক ১৫:১৮-২১ঃ-
ביום ההוא כרת יהוה את אברם ברית לאמר לזרעך נתתי את הארץ הזאת מנהר מצרים עד הנהר הגדל נהר פר
"সুতরাং ঐদিন প্রভু আব্রামকে একটা প্রতিশ্রুতি দিলেন এবং সেই অনুসারে আব্রামের সঙ্গে একটা চুক্তি করলেন। প্রভু বললেন, “এই দেশ আমি তোমার উত্তরপুরুষদের দেব।মিশর নদ এবং ফোরাৎ নদের মধ্যবর্তী বিশাল ভূভাগ আমি তাদের দেব। 19 এটা হল কেনীয়, কনিষীয়, কদ্মোনীয়, 20 হিত্তীয়, পরিষীয়, রফায়ীয়, 21 ইমোরীয়, কনানীয়, গির্গাশীয় এবং যিবুষীয় বংশগুলির দেশ।"
ইশ্বর আব্রাহামের উত্তরপুরুষদেরকে মিশরের নীলনদ ও ফোরাত নদের মধ্যবর্তী বিশাল ভূভাগ প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিলেন। এই অংশের মধ্যে পড়ে মিশর, ফিলিস্তিন, জর্ডান, লেবানন, সিরিয়া, তুরস্ক, ইরাক, সৌদি আরব প্রভৃতি অঞ্চল।
ইতিহাস স্বাক্ষী,আর পর্যন্ত মুসলিম (খেলাফতে রাশেদা:আব্রাহামের রক্তের বংশধর, যারা কুরাইশ বংশীয় ছিলেন) ব্যাতীত কোনো ইহুদি, খ্রিস্টান,হিন্দুরা মিশর থেকে ফোরাত নদ অবধি জায়গার মালিক হতে পারেনি।বরং মুসলিমরা দীর্ঘকাল এই অঞ্চলের একচ্ছত্র অধিপতি ছিলো এবং বর্তমানেও এই অঞ্চলের অধিকাংশ জনগণই মুসলিম।
কাজেই ,মুহাম্মাদ ﷺ ও কুরাইশ বংশ যে, আব্রাহামের বংশধর, তা বাইবেলের এই ভার্স থেকে প্রমাণিত হলো।
লনীয়ান রাজকীয় শিলালিপি এবং উত্তর আরবের শিলালিপিগুলোতে ৯ম থেকে ৬ষ্ঠ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে কেদারের রাজার উল্লেখ আছে, কখনো আরব হিসেবে আবার কখনো ইসমায়েলীয় হিসেবে। [সূত্র:- Delitzsche (1912). Assyriesche Lesestuche. Leipzig. OCLC 2008786. Montgomery (1934). Arabia and the Bible. Philadelphia: U of Pennsylvania. OCLC 639516. Winnet (1970). Ancient Records from North Arabia. pp. 51, 52. ISBN 9780802052193. OCLC 79767. king of kedar (Qedarites) is named alternatively as king of Ishmaelites and king of Arabs in Assyrian Inscriptions Stetkevychc (2000). Muhammad and the Golden Bough. Indiana University Press. ISBN 0253332087. Assyrian records document Ishmaelites as Qedarites and as Arabs]
অ্যাসিরীয় রাজকীয় শিলালিপিতে "নবোয়ত, কেদার, অদ্বেল, দুমাহ, মাসা এবং তিমান" নামগুলি আরবীয় জাতি হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছিলো। এগুলো আসলে ইসমাইল (আ.) এর পুত্রদের নাম, যা আদিপুস্তক ২৫:১২-১৬ তেও উল্লেখিত হয়েছে।
◾মুহাম্মাদ (ﷺ) এর সমসাময়িক অমুসলিম উৎস থেকে ঐতিহাসিক প্রমাণ:-
৭ম শতাব্দীর একজন আর্মেনিয়ান খ্রিস্টান চার্চ-বিশপ,ইতিহাসবিদ ও বংশতত্ত্ববিদ ছিলেন সেবেওস (৬০০ খ্রি.-৬৬১ খ্রি.)। তিনিও মুহাম্মাদ (স.) কে ইসমাইলের বংশধর হিসেবেই স্বীকৃতি দিচ্ছেন। এ সম্পর্কে তিনি উল্লেখ করেছেন-
"At that time a certain man from along those same sons of Ismael, whose name was Mahmet [i.e., Muḥammad], a merchant, as if by God's command appeared to them as a preacher [and] the path of truth. He taught them to recognize the God of Abraham, especially because he was learnt and informed in the history of Moses. Now because the command was from on high, at a single order they all came together in unity of religion. Abandoning their vain cults, they turned to the living God who had appeared to their father Abraham. So, Mahmet legislated for them: not to eat carrion, not to drink wine, not to speak falsely, and not to engage in fornication.
অর্থ:- ঐ সময় ইসমাইলের একই পুত্রদের মধ্য হতে একজন নির্দিষ্ট ব্যক্তি,যাঁর নাম ছিলো মাহমেত (মুহাম্মাদ স.),যিনি একজন ব্যবসায়ী,ইশ্বরের নির্দেশে তাদের সামনে একজন ধর্মপ্রচারক ও সত্যপথ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন।তিনি তাদের আব্রাহামের ইশ্বরকে চিনতে শিখিয়েছিলেন।বিশেষ করে যেহেতু তিনি মোশির (মুসা আ.) ইতিহাস সম্পর্কে দীক্ষিত ও অবগত ছিলেন।যেহেতু আজ্ঞাটি অনেক উচ্চ হতে ছিলো,এক আজ্ঞাতেই তারা সবাই ধর্মীয় বন্ধনে একতাবদ্ধ হয়েছিলো।তাদের নিরর্থক ধর্ম ত্যাগ করে তারা জীবন্ত ইশ্বরের দিকে ফিরে এসেছিলো,যেই ইশ্বর তাদের পিতা আব্রাহামের কাছে আবির্ভূত হয়েছিলেন।তাই,মাহমেত (মুহাম্মাদ স.) তাদের জন্য আইন করেছিলেন : গলিত বা পঁচা মাংস খাওয়া যাবে না,মদ্যপান করা যাবে না,মিথ্যা বলা যাবে না,ব্যাভিচারে লিপ্ত হওয়া যাবে না।
{Hacikyan 2002, p. 82, R. W. Thomson (with contributions from J. Howard-Johnson & T. Greenwood), The Armenian History Attributed To Sebeos Part - I: Translation and Notes, 1999, Translated Texts For Historians - Volume 31, Liverpool University Press, pp. 95-96. Other translations can also be seen in P. Crone & M. Cook, Hagarism: The Making Of The Islamic World, 1977, Cambridge University Press: Cambridge, pp. 6-7; R. G. Hoyland, Seeing Islam As Others Saw It: A Survey And Evaluation Of Christian, Jewish And Zoroastrian Writings On Early Islam, 1997, op. cit., p. 129; idem., "Sebeos, The Jews And The Rise Of Islam" in R. L. Nettler (Ed.), Medieval And Modern Perspectives On Muslim-Jewish Relations, 1995, Harwood Academic Publishers GmbH in cooperation with the Oxford Centre for Postgraduate Hebrew Studies, p. 89}
৭ম শতাব্দীতে লিখিত আরেকটি বিখ্যাত ঐতিহাসিক নথিঁ খুজিস্তান ক্রনিকল, যেটি কোনোভাবেই ৬৬০ খ্রিস্টাব্দের পরে লেখা হয়নি, সেখানে মুহাম্মাদ (স)কে ইসমাইলের বংশধর বলা হচ্ছে:-
Then God raised up against them the sons of Ishmael, [numerous] as the sand on the sea shore, whose leader was Mḥmd (Muhammad). Neither walls nor gates, armour or shield, withstood them, and they gained control over the entire land of the Persians. Yazdgird sent against them countless troops, but the Arabs routed them all and even killed Rustam. Yazdgird shut himself up in the walls of Mahoze and finally escaped by flight. He reached the country of the Huzaye and Mrwnaye, where he ended his life. The Arabs gained countrol of Mahoze and all the territory. They also came to Byzantine territory, plundering and ravaging the entire region of Syria. Heraclius, the Byzantine king, sent armies against them, but the Arabs killed more than 100,000 of them.
অর্থ:- অতঃপর ঈশ্বর তাদের বিরুদ্ধে ইসমাইলের পুত্রদের উত্থান করলেন যারা ছিলো সমদ্র তীরের বালির মতো,যাদের নেতা ছিলেন মহমদ (মুহাম্মাদ)। প্রাচীর বা দ্বার,বর্ম বা ঢাল কোনটাই তাদের প্রতিরোধ করতে পারেনি এবং তারা পারস্যদের সমগ্র ভূমির উপর নিয়ন্ত্রণ অর্জন করেছিলো। ইয়াজদগিরদ (পারস্য সম্রাট) তাদের বিরুদ্ধে অগণিত সৈন্য পাঠায়, কিন্তু আরবরা তাদের সবাইকে পরাজিত করে,এমনকি তাদের সেনাপতি রুস্তমকেও হত্যা করে। ইয়াজদগিরদ নিজেকে মাহোজের দেয়ালে লুকিয়ে রাখে এবং অবশেষে পালিয়ে যায়।তিনি হুজায়ে ও ম্রোনায়ের দেশে পৌঁছেছিলেন, যেখানে তিনি তার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন।আরবরা মাহোজে এবং সমস্ত অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ লাভ করে। তারা বাইজেন্টাইন অঞ্চলেও এসেছিলো,সেখানে লুণ্ঠন করে এবং সিরিয়ার পুরো অঞ্চলকে ধ্বংস করে। বাইজেন্টাইন রাজা হেরাক্লিয়াস তাদের বিরুদ্ধে সৈন্য প্রেরণ করেছিলেন,কিন্তু আরবরা তাদের ১ লাখেরও বেশি সৈন্যকে হত্যা করে।
{R. G. Hoyland, Seeing Islam As Others Saw It: A Survey And Evaluation Of Christian, Jewish And Zoroastrian Writings On Early Islam, 1997, op. cit., p. 186. A brief translation of this text is also present in J. W. Watt, "The Portrayal Of Heraclius In Syriac Historical Sources", in G. J. Reinink & B. H. Stolte (Eds.), The Reign Of Heraclius (610-641): Crisis And Confrontation, 2002, Groningen Studies in Cultural Change, Peeters Publishers, p. 71}
খুজিস্তান ক্রনিকলে কাবাঘরের সাথে আব্রাহামকে জড়িয়ে আরো বলা হচ্ছে:-
Regarding the K'bta (Ka'aba) of Ibrahim, we have been unable to discover what it is except that, because the blessed Abraham grew rich in property and wanted to get away from the envy of the Canaanites, he chose to live in the distant and spacious parts of the desert. Since he lived in tents, he built that place for the worship of God and for the offering of sacrifices. It took its present name from what it had been, since the memory of the place was preserved with the generations of their race. Indeed, it was no new thing for the Arabs to worship there, but goes back to antiquity, to their early days,in that they show honor to the father of the head of their people.
অর্থ:- ইব্রাহীমের কাবতা (কাবা) সম্পর্কে আমরা সেটি ছাড়া আর কিছু আবিষ্কার করতে পারিনি, কারণ আশীর্বাদধন্য ইব্রাহীম সম্পদে সমৃদ্ধ হয়েছিলেন এবং কেনানীয়দের হিংসা থেকে দূরে থাকতে চেয়েছিলেন। তিনি দূরবর্তী অঞ্চলে বসবাস করতে পছন্দ করেছিলেন, যেটি মরুভূমির প্রশস্ত অংশ।যেহেতু তিনি তাঁবুতে থাকতেন, তাই তিনি ঈশ্বরের উপাসনা এবং বলি উৎসর্গের জন্য সেই জায়গাটি তৈরি করেছিলেন।এটি যা ছিলো তার থেকে এটির বর্তমান নাম নেওয়া হয়েছে, যেহেতু স্থানটির স্মৃতি তাদের বংশের প্রজন্মের সাথে সংরক্ষিত ছিলো।প্রকৃতপক্ষে, আরবদের জন্য সেখানে উপাসনা করা কোনো নতুন বিষয় ছিলো না,বরং এটি অত্যন্ত প্রাচীন। তাদের প্রাথমিক যুগে,যেখানে তারা তাদের জনগণের মুখ্য পিতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে। {Robert G., Hoyland (1997). Seeing Islam as others saw it. THE DARWIN PRESS. p. 187}।
যদিও মুহাম্মাদ (স) ইসমাইল (আ) এর বংশধর এটি একটি সর্বজনবিদিত কথা,তথাপি এত তথ্য-প্রমাণ থেকে এটা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে মুহাম্মাদ (স) প্রকৃতপক্ষেই ইসমাইল (আ) এর বংশধর।
(সমাপ্ত)