সূর্যের ক্ষেত্রে সঠিক কথা হলো “আরশের নিচে সিজদাহ করে“, “উষ্ণ ঝরণায় অস্তমিত হয়” কথাটি সঠিক নয়।
গরম প্রস্রবণে অস্তমিত হয় – এই মর্মে যেই হাদিসটি আছে সেটি কি আলেম-ওলামাগণ সহিহ বলে গ্রহণ করেছেন?
এই মর্মে ইসলামকিউএ তে একটি মোটামুটি দীর্ঘ ফতোয়ায় উল্লেখ করা হয়েছে হাদিসটি সম্পর্কেঃ
ইসলামকিউএ প্রশ্নোত্তর নং ১৭৬৩৭৫
মূল প্রশ্নোত্তর লিংকঃ https://islamqa.info/en/176375
অনুবাদ ও সম্পাদনাঃ ফারহান হাবীব, তাহসিন আরাফাত
প্রশ্নঃ
আমি একটি হাদিস সম্পর্কে জানতে চাই।
সুনানে আবু দাউদ ৪০০২ তে,
আবূ যার (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পিছনে একই গাধার পিঠে বসা ছিলাম, তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছিল তিনি আমাকে বললেনঃ তুমি কি জানো, এটা কোথায় অস্তমিত হয়? আমি বললাম, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। তিনি বলেনঃ ‘‘এটা উষ্ণ পানির এক ঝর্ণায় অস্তমিত হয়’’ (ইন্নাহা তাঘরবু ফি ‘আয়নিন হামি’আহ)।[1]
এই হাদিসটি কি সহিহ? যদি সহিহ হয়ে থাকে, তাহলে এর অর্থ কী? অমি শুনেছি কিছু অমুসলিম এই হাদিসটি ব্যবহার করে ইসলাম সম্পর্কে সংশয় তৈরি ও কুৎসা রটানোর চেষ্টা করছে!
উত্তর:
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর।
প্রথমত, (সনদসমূহ)
আবু যার (রাঃ)-এর হাদিস যেটি সূর্যের গমনস্থল সম্পর্কে বলছে সেটি বর্ণিত হয়েছে ইবরাহিম ইবনে ইয়াজিদ আত-তায়মি, তাঁর পিতা থেকে, আবু যার থেকে, যিনি বর্ণনা করেছেন রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর থেকে।
এটি বর্ণনা করেছেন ইব্রাহিম আত-তায়মির থেকে, আল হাকাম ইবনে উতায়মার মাধ্যমে, আল-আমাশ, ফুদায়ল ইবনে গাজওয়ান, হারুন ইবনে সা’দ এবং মুসা ইবনে আল-মুসাইয়াব, যেমনটা বর্ণনা করেছেন ইবনে মানদাহ
দেখুনঃ আল-ঈমান (২/৯২৬)
তাঁরা এটিকে দুটি সনদে বর্ণনা করেছেন।
প্রথম সনদ:
আল-আ’মাশ, ইউনুস ইবনে উবায়দ, মুসা ইবনে আল মুসাইয়াব এবং হারুন ইবনে সা’দ থেকে বর্ণিত হয়েছে। এই বিবৃতিতে বলা আছে যে, সূর্য চলে এবং আরশের নীচে সিজদা করে অথবা তার মালিকের সম্মুখে সিজদা করে; এখানে “উষ্ণ পানির ঝরণা”-এর কোনো উল্লেখ নেই। এটা নানা বর্ণনার রূপেই পাওয়া যায়, যেগুলোর একটি এখন আমরা তুলে ধরবো:
আবূ যার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সূর্য অস্ত যাবার সময় আবূ যার (রাঃ)-কে বললেন, তুমি কি জান, সূর্য কোথায় যায়? আমি বললাম, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই ভাল জানেন। তিনি বললেন, তা যেতে যেতে আরশের নীচে গিয়ে সাজ্দাহয় পড়ে যায়। অতঃপর সে আবার উদিত হবার অনুমতি চায় এবং তাকে অনুমতি দেয়া হয়। আর শীঘ্রই এমন সময় আসবে যে, সিজ্দা করবে কিন্তু তা কবূল করা হবে না এবং সে অনুমতি চাইবে কিন্তু তাকে অনুমতি দেয়া হবে না। তাকে বলা হবে, যে পথ দিয়ে আসলে ঐ পথেই ফিরে যাও। তখন সে পশ্চিম দিক হতে উদিত হয়— এটাই মর্ম হল মহান আল্লাহর বাণীরঃ ‘‘আর সূর্য নিজ গন্তব্যে (অথবা) কক্ষ পথে চলতে থাকে। এটা পরাক্রমশালী, সর্বজ্ঞের নিয়ন্ত্রণ।’’ (কুরআন, সূরা ইয়াসীন ৩৬:৩৮)
এই হাদিসটি সুলাইমান আল-আ’মাশের (আবু মুহাম্মদ নামে পরিচিত) সূত্রে বর্ণনা করেছেন/বর্ণিত হয়েছে:
সহিহুল বুখারীতে (হাদিস নং ৩১৯৯, ৪৮০২ এবং ৭৪২৪);
সহিহ মুসলিম (159c,d);
মুসনাদে আবু দাউদ আল-তায়ালিসি (১/৩৬৮);
মুসনাদে আহমাদ (৩৫/২৮২, ৪২৯);
সুনানে তিরমিজি (নাম্বার ২১৮৬, ৩২২৭)– ইমাম তিরমিজি৷ হাদিসটিকে হাসান সহীহ বলেছেন;
ইমাম নাসাঈ বর্ণনা করেছেন আস-সুনান উল-কুবরাতে (১০/২২৯);
আত-তাবারী বর্ণনা করেছেন জামিউল বয়ানে (২০/৫১৬);
আল-বাজ্জার বর্ণনা করেছেন আল-বাহার আল-জুখারে (৯/৪০৯);
আবু ‘আওয়ানাহ বর্ণনা করেছেন আল-মুসতাখারাজে (১/১০০-১০১);
আত-তহাবী বর্ণনা করেছেন মুশকিল আল-আছারে (১/২৫৪);
সহীহ ইবনে হিব্বান (১৪/২৪);
আল-কুতায়’ইয় বর্ণনা করেছেন জুয’ আল-আলফ দিনারে (পৃষ্ঠা ১৮৩),
আবু নুয়া’ইম বর্ণনা করেছেন আল-মুসনাদ আল-মুস্তাখারাজ ‘আলা সহীহ মুসলিমে (১/২২২);
তাফসিরে বাঘাভী (৪/১৪);
আবু আশ-শায়খ বর্ণনা করেছেন আল-‘আযামাহে (৪/১১৯২);
ইবনে মানদাহ বর্ণনা করেছেন আল-ঈমানে (২/৯২৪) এবং আত-তাওহীদ এ (১/১৩৪, ১৩৫);
ইবনে বাশরান বর্ণনা করেছেন আল-আমালি তে (পৃ ১৫৯);
আল-বায়হাক্বী বর্ণনা করেছেন আল-আসমা ওয়া আস-সিফাত (২/২৭৩);
ইবনে আসাকীর বর্ণনা করেছেন আল-মুজামে (২/১০১৫);
আবু নুয়াইমের হিল্যত আল-আউলিয়া (৪/২১৬) ইত্যাদি।
ইউনুস ইবনে ‘উবায়দের মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে,
সহিহ মুসলিম (নম্বর ১৫৯);
আন-নাসাঈয়ের আস-সুনান উল-কুবরায় (১০/৯৬);
আত-তাবারীর জামে আল বায়ানে (১২/২৪৯);
আবু আওয়ানাহর আল-মুস্তাখারাজে (১/১০০),
আবু আল-আব্বাস আস-সিরাজের হাদিস আস-সিরাজে (৩/২৫৮);
সহীহ ইবনে হিব্বান (১৪/২১);
আবু আশ-শায়খের আল-আযামাহে (৪/১১৮৯);
ইবনে মানদাহের আল-ঈমানে (২/৯২৫-৯২৬) এবং আত-তাওহীদে (১/১৩৬); আবু নুয়াইমের আল-মুস্তাখারাজে (১/১২১)।
মূসা ইবনে আল-মুসাইয়াব-এর মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছ,
আবু আশ-শায়খ আল-আসবাহানীর আল-আযামাহে (৪/১১৮৮);
এবং হারুন ইবনে সা’দের মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে,
আত-তাবারানীর আল-মুজামুল কবীরে (৪/৩৭৩); আবু আশ-শায়খ আল-আসবাহানীর আল-আযামাহে (৪/১১৯০)।
আবু নুয়াইম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
“তাঁরা (মুহাদ্দিসীনগণ) একমত হয়েছেন যে এটি একটি সহিহ হাদিস, আল-আ’মাশের হাদিস থেকে যা এসেছে সুফিয়ান আত-তাবারী এবং অন্যদের সূত্রে। এটি বর্ণিত হয়েছে আত-তায়মী আল-হাকাম ইবনে উতায়বাহ, ফুদায়ল ইবনে উমায়ের, হারুন ইবনে সা’দ, মুসা ইবনে আল-মুসাইয়াব, হাবীব ইবনে আল-আশরাস এবং বসরীদের মধ্যে ইউনুস ইবনে উমায়েদ থেকে।”
– হিল্লত আল-আউলিয়াহ (৪/২১৬)
দ্বিতীয় সনদ:
এটি বর্ণিত হয়েছে “শুধুমাত্র” আল-হাকাম ইবনে উতায়বাহর সূত্রে (আবু মুহাম্মদ এবং আবু উমর নামেও পরিচিত), ইব্রাহিম আত-তায়মির থেকে। এই বিবৃতিতে বলা হয় যে সূর্য উষ্ণ ঝরণায় অস্ত যায়।
আবূ যার (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পিছনে একই গাধার পিঠে বসা ছিলাম, তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছিল তিনি আমাকে বললেনঃ তুমি কি জানো, এটা কোথায় অস্তমিত হয়? আমি বললাম, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। তিনি বলেনঃ ‘‘এটা উষ্ণ পানির এক ঝর্ণায় অস্তমিত হয়’’ (ইন্নাহা তাঘরবু ফি ‘আয়নিন হামি’আহ)।
এটি বর্ণিত হয়েছে মুসনাদে আহমাদ (৩৫/৩৬৩); আবু দাঊদের আস-সুনানে (নাম্বার ৪০০২); হাস আদ-দূরির জুয কিরাত আন-নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামে (পৃষ্ঠা ১২৩); আল-বাযযারের আল-বাহার আল-যাখারে (৯/৪০৭); আস-সিরাজের হাদিসে (৩/২৫৮); আল-হাকিমের আল-মুস্তাদারাকে (২/২৬৭)-তিনি বলেন, এটি একটি সহীহ সনদযুক্ত হাদিস, যদিও তাঁরা (বুখারী ও মুসলিম) বর্ণনা করেন নি। তাঁরা প্রত্যেকেই (উপর্যুক্ত বর্ণনাকারীগণ) বর্ণনা করেছেন ইয়াজিদ ইবনে হারুনের মাধ্যমে, সুফিয়ান ইবনে হুসায়ন থেকে, আল-হাকাম থেকে।
আল-বাজ্জার বলেন:
সুফিয়ান ইবনে হুসায়ন ব্যতীত আর কাউকে আমরা চিনি না যে এই হাদিসটি বর্ণনা করেছেন আল-হাকাম ইবনে উতায়বা থেকে, ইব্রাহীম থেকে, তার বাবা থেকে, আবু যার থেকে।
ইউনূস ইবনে উবায়েদ এটি বর্ণনা করেছেন ইব্রাহীম আত-তায়মী থেকে ও সুলাইমান আল আমাশ থেকে এবং হারুল ইবনে সাদ থেকে।
দ্বিতীয়ত, (উষ্ণ ঝরণায় অস্তমিত হওয়ার হাদিসের অগ্রহণযোগ্যতা)
উপরের আলোচনা থেকে এটা পরিষ্কার যে প্রথম ভাগে বর্ণিত হাদিসটি সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, যেখানে বলা “এটি গিয়ে আরশের নীচে সিজদায় অবনত হয়”, যেখানে “উষ্ণ ঝরণায় অস্ত যাওয়ার” কোনো উল্লেখই নেই। এটি বেশ কয়েকটি কারণের উপর ভিত্তি করে আছে:
এক
প্রথম বর্ণনাটির উপর বেশিরভাগ বর্ণনাকারী এবং সর্বোত্তম স্মৃতির অধিকারীরা একমত, যেটা ইব্রাহিম আত-তায়মির বর্ণনায় বলা হয়েছে।
দুই
দ্বিতীয় বর্ণনার রূপটি (উষ্ণ ঝরণা) শুধুমাত্র আল-হাকাম ইবনে উতায়বাহ বর্ণনা করেছেন ইব্রাহিম থেকে।
এবং আল-হাকাম, যদিও তিনি বিশ্বাসযোগ্য, তবুও আন-নাসাঈ তাঁকে মুদাল্লিস (যেমনঃ তিনি একটি ভুল ভাবার্থ দিতে অস্পষ্ট শব্দ ব্যবহার করেছেন) হিসেবে যিকর আল-মুদাল্লিসীনে উল্লেখ করেছেন।
দেখুনঃ যিকর আল-মুদাল্লিসীন ১১
ইবনে হিব্বান বলেছেন:
তিনি তাদলিসে[2] জড়িত থাকতেন। – আস-সিক্বাত (৪/১৪৪)
যারা তাঁর হাদিস বর্ণনা করেছেন তাঁদের মধ্যে কেউই বলেন নি, যে আল-হাকাম পরিষ্কারভাবে বিবৃত করেছেন যে তিনি হাদিস পূর্বের বর্ণনাকারী থেকে শুনেছেন;
বরং তাঁরা প্রত্যেকেই বলেছেন যে তাঁর বর্ণনায় ‘আন শব্দটি ছিল (‘আমি শুনেছি’ না বলে বলা হতো ‘অমুকের থেকে’)।
ইবনে হাজার মারাতিব আল-মুদাল্লিসীনে তাঁকে দ্বিতীয় পর্যায়ের মুদাল্লিসীন হিসেবে অভিহিত করেছেন (পৃষ্ঠা ৩০), এরা তাঁরা, যাঁদের তাদলীসকে ইমামরা (নেতৃস্থানীয় আলেমগণ) সহনীয় হিসেবে নিয়েছেন এবং যাদেরকে তারা বর্ণনা করেছে যে তারা হাসান বলে গণ্য করেছে, তাঁদের বিশিষ্টতা ও অন্যদের তুলনায় তাদলীসে খুব কম যুক্ত থাকার কারণে, যেমন আত-সাওরী;
অথবা তাদের তাদলিস সহনীয় ছিলো এই কারণে যে, তারা বিশ্বাসযোগ্য উৎস থেকে বর্ণনা করার সময় ছাড়া তাঁরা তাদলীস করতেন না, যেমন ইবনে উয়ায়নাহ।
মূল কথা হচ্ছে এই বর্ণনাটি বিশ্বস্ত বর্ণনাকারীদের বর্ণনা(প্রথমে উল্লেখিত বর্ণনার)-এর বিপরীত হওয়ায় এটি বিশেষ করে এই হাদিসে তাদলীস হওয়ার সম্ভাবনা নিশ্চিত করে।
আর তাদলিসকৃত হাদিস পরিত্যাজ্য।
তিন
প্রথম বর্ণনার রূপটি ইমাম বুখারি ও মুসলিম উভয়েই বর্ণনা করেছেন, যেখানে দ্বিতীয় রূপটি এই দুজনের কেউই বর্ণনা করেন নি।
তার কারণ তাঁরা মনে করেছেন প্রথম রূপটি অন্য যেকোনোটির চেয়ে সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
আলেমদের এবং সেই সাথে সমালোচকদের মতেও নিঃসন্দেহে বুখারি ও মুসলিমের বর্ণনা অন্যান্য কিতাব ও মুসনাদের চেয়ে অগ্রাধিকার পায়।
চার
এই দুই রূপের মধ্যে একটি বড় পার্থক্য আছে।
হাদিসটির বিভিন্ন রূপ অনুযায়ী প্রথমটি সূর্যাস্তের সময় হোক বা না হোক, আরশের নীচে সূর্যের সিজদা করার বিষয়টি বর্ণনা করে।
আরশের নীচে সিজদার বিষয়টি গায়েবের বিষয় এবং কীভাবে হয় সেটি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা ছাড়া কেউ জানে না। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা আমাদের বলেছেন সকল সৃষ্টি তাঁর নিকট সিজদাবনত হয়,
“তুমি কি দেখ না যে আল্লাহকে সেজদা করে যারা আকাশে আছে, আর যারা পৃথিবীতে আছে আর সূর্য, চন্দ্র, তারকারাজি, পর্বতসমূহ, বৃক্ষরাজি, জীবজন্তু এবং মানুষের মধ্যে অনেকে? আর অনেকের প্রতি শাস্তি সাব্যস্ত হয়ে গেছে। আল্লাহ যাকে লাঞ্ছিত করতে চান, তাকে সম্মানিত করার কেউ নেই। আল্লাহ যা ইচ্ছে করেন তাই করেন।[সাজদাহ]” – কুরআন ২২:১৮ – তাইসীরুল কুরআন অনুবাদ
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা ছাড়া আর কেউই জানে না এই সিজদা কেমন বা তা কখন হয় বা তার প্রকৃতি কেমন। একইভাবে, আবু যারের হাদিস কোনোভাবেই এই আয়াত থেকে ভিন্ন কিছু নয় এবং এতে আপত্তি তোলার কিছু নেই।
আল-খাত্তাবি রাহিমাহুল্লাহ বলেন,
কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না যে এটি (সূর্য) আরশের নীচে থামে, এমনভাবে যা আমরা দেখতে বা অনুভব করতে পারি না। বরং এটি একটি গায়েবী ব্যাপারের কথা বলে। তাই আমাদের এটিকে অবিশ্বাস কিংবা একে প্রশ্ন করা উচিত নয় যে কীভাবে তা ঘটলো, কারণ আমাদের জ্ঞান, বোধবুদ্ধি তা অনুভব করতে পারবে না।- আ’লাম আল-হাদিস শারহে সহীহ আল বুখারী (পৃষ্ঠা ১৮৯৩)
দ্বিতীয় রূপটির ব্যাপারে, “উষ্ণ ঝরনায় অস্ত যায়”, এটি সমস্যাযুক্ত কারণ সূর্যাস্ত তখনই ঘটে যখন এটির চাকতিটি দিগন্তের নীচে অদৃশ্য হয়ে যায় এবং পৃথিবীর আহ্নিক গতির জন্য এটি কিছু মানুষের জন্য অস্ত যায় এবং কিছু মানুষের জন্য উদিত হয়।
তাই এটি সম্ভব নয় যে সূর্য, যার আকার এত বিশাল, কোনোভাবে উষ্ণ ঝরনায় অদৃশ্য হবে।
যুলকারনাইনের ব্যাপারে আল্লাহর বাণী সম্পর্কে,
“চলতে চলতে সে যখন সূর্যের অস্ত গমন স্থানে পৌছল তখন সে সূর্যকে এক পংকিল জলাশয়ে অস্তগমন করতে দেখলো” [কুরআন ১৮:৮৬],
মুফাসসিরগণ বলেছেন এখানে সে কী দেখেছে তা বর্ণনা করা হয়েছে, কারণ সে সমুদ্রের দিগন্তে এটি দেখেছে, যেন এটি অস্ত যাওয়ার সময় ডুবে যাচ্ছিলো। পবিত্র কুরআন আমাদেরকে এটা বলে না যে বাস্তবিকভাবেই এটি ঘটেছিল, তাই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা বলেন “অস্তগমন করতে দেখলো” এবং তিনি বলেন নি “এটি পঙ্কিল জলাশয়ে অস্ত যাচ্ছিলো”
ইবনে কাসীর রাহিমাহুল্লাহ বলেন,
মোট কথা, যখন তিনি পশ্চিম দিকের শেষ সীমা পর্যন্ত পৌঁছে যান তখন এরূপ মনে হলো যে, যেন। সূর্য প্রশান্ত মহাসাগরে অস্ত যাচ্ছে। কেউ যদি সমুদ্রের তীরে দাড়িয়ে সূর্যকে অস্ত যেতে দেখে তবে বাহ্যিক দৃষ্টিতে তার এরূপই মনে হবে যে, ওটা যেন পানির মধ্যেই ডুবে যাচ্ছে।
– তাফসীরে ইবনে কাসীর বঙ্গানুবাদ, ১৮:৮৬ এর তাফসীর
সারসংক্ষেপ: যে ব্যক্তি এই শব্দচয়নের কারণে সুন্নতের উপর সন্দেহ পোষণ করে, সে হাদিসের বিভিন্ন সংস্করণ পরীক্ষা করার ও প্রমাণিত-অপ্রমাণিত এমন বর্ণনার মধ্যে পার্থক্য করার ক্ষেত্রে মুহাদ্দিসীনদের নির্ভুলতা সম্পর্কে অজ্ঞ। কিছু আলেম এই বর্ণনাটিকে সহিহ বলার ব্যপারটি সমস্যাযুক্ত। বরং তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল হাদিসের ভিত্তিতে একে সহীহ বলা, এটি বলা নয় যে এই সংস্করণটি সহীহাইনে বর্ণিত “এটি চলে এবং আরশের নীচে সিজদা করে” থেকে অধিক সঠিক।
এই নির্দিষ্ট যুক্তিটি খণ্ডন করার জন্য এটুকু দেখিয়ে দেয়াই যথেষ্ট যে মুসলিম আলেমরা সর্বসম্মতভাবে একমত ছিলেন যে পৃথিবী গোল ও সকল মহাজাগতিক বস্তুও গোল। পৃথিবী ও সূর্যের নড়াচড়া ও ঘূর্ণনের কারণেই পর্যায়ক্রমে দিন ও রাত হয়, এটি কুরআন ও হাদিস থেকে স্পষ্ট।
ইবনে তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহ বলেন,
সাহাবায়ে কেরাম ও যাঁরা হেদায়েতের জন্য তাঁদের অনুসরণ করতেন, তাঁদের মধ্যকার মুসলিম আলেমগণের মতে মহাজাগতিক বস্তুসমূহ গোলাকার; যথাযথ স্থানে উল্লিখিত সনদ দ্বারাও এটি প্রমাণিত। প্রকৃতপক্ষে, একাধিক আলেম বর্ণনা করেছেন যে এ ব্যপারে মুসলমানদের মধ্যে ঐক্যমত ছিলো। – মিনহাজ আন-সুন্নাহ আন-নববীয়া (৫/৪৪২)[3]
মুসলমানরা জ্যোতির্বিদ্যার জ্ঞানে অন্যদের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিল। যদি এই হাদিসের আপাত অর্থের সাথে সাংঘর্ষিক হতো, তাহলে এই ব্যপারে ঐক্যমত সৃষ্টি হতো না। কিন্তু সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি হলো হাদিসটি বৈজ্ঞানিক, জ্যোতির্বিজ্ঞানের তথ্যের সাথে সাংঘর্ষিক নয়।
আল্লাহই ভালো জানেন।
ইসলামকিউএ ফাতাওয়ার অনুবাদ সমাপ্ত।
অতিরিক্তঃ তাদলিসের অভিযোগ ছাড়াও এই হাদিস শাযের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে।
“আল-আ’মাশ, ইউনুস বিন উবাইদ, মুসা ইবনুল মুসাইব, হারুন বিন সা’দ” – এনারা ৪ জন ও “আল-হাকাম বিন উতাইবাহ” এই একজন, একই হাদিসের দুইটি সংস্করন বা ভার্শন বর্ননা করেছেন। এই ৪ জনের বর্ননায় কোথাও “উত্তপ্ত জলাশয় ” কথাটাই নেই, তবে শুধুমাত্র “আল-হাকাম বিন উতাইবাহ” এর বর্ননাতেই বলা আছে যে সুর্য উত্তপ্ত জলাশয়ে অস্ত যায়। অপরদিকে “আল-আ’মাশ” ও “ইউনুস বিন উবাইদ” হলেন “আল-হাকাম বিন উতাইবাহ ” অপেক্ষা অধিক শক্তিশালি রাবি। সুতরাং মুলনীতি অনুযায়ি আল-হাকাম বিন উতাইবাহর বর্নিত এই উত্তপ্ত জলাশয়ের বর্ননাটি “শায”, এবং “শায ” বর্ননার হুকুম হলো তা প্রত্যাখ্যাত।[4]
দেখুনঃ সাইদ আব্দুল-মাজিদ আল-গাওরি রচিত “মুজামুল মুস্তালাহাতিল হাদিসিয়াহ ” (পৃ/৪১৩-৪১৫)
– সামিঈ আল হাসান আল তবিব আল ইনফিরাদী
আরো দেখুনঃ
- The earth is round in shape, Islamweb Fatwa No: 87767
- Does the Quran Say the Earth is Flat? – Islamqa Q&A 211655
- Consensus that the Earth is round – Islamqa 118698
- Does the Qur’an say the earth is flat? Islamic scholarship & the multiplicity of readings approach – Sapience Institute (Sapience Education US)
Footnotes
⇧1 | সুনানে আবু দাঊদ (3991 English), বাংলা ৪০০২ http://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=61370 |
---|---|
⇧2 | তাদলীসঃ তাদলিস এবং তাদলিসকৃত হাদিসের অগ্রহণযোগ্য সম্পর্কে দেখুন https://www.hadithbd.com/books/link/?id=8634 |
⇧3 | https://shamela.ws/book/927/2750 |
⇧4 | শায হাদিস পরিত্যাজ্যঃ দেখুন https://www.hadithbd.com/books/link/?id=8635 |