বাইবেলে যে বৈপরিত্য ও অবান্তর তথ্য রয়েছে, এ বিষয়ে তার প্রচারকগণও বেশ ওয়াকিবহাল। কোন একটা ভুল তথ্য পেলে, একটা বৈপরিত্য আবিষ্কার করলে মনে করবেন, আপনার এ তথ্য জানার নিদেনপক্ষে পাঁচ বছর আগে হলেও তারা তা জানে। তবে আপনার ও তাদের এ জানার মধ্যেকার তখাৎখানি হচ্ছে, আপনি সেই ভুলকে উন্মোচিত করতে তৎপর, আর তারা সর্বদা সে একই ভুলকে ‘সংশোধন’ করে হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে অগ্রসর। বাইবেলে অযৌক্তিক ও গোঁজামিলে তথ্য আছে— এটা আপনিও জানেন, বাইবেলের প্রচারকরাও জানে। কিন্তু আপনার ও তাদের এ জানার মাঝে ফারাক হচ্ছে, আপনি আপনার এ জানার বিষয়টাকে কথার মাধ্যমে সাক্ষ্য দেন, আর তারা তাদের এ জানা বিষয়টাকেই তাদের কর্মের মাঝ দিয়ে প্রতিফলন করে। আজ এ মজলিসে আমরা এমনই কিছু উপাত্তের মুখোমুখি হতে চলেছি, যেগুলো জানার ফলে বাইবেল যে সংশোধিত হয় কিংবা বাইবেলের ভুলগুলো যে খোদ তার প্রচারকরাই সংশোধন করে, তা আমাদের নিকট দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে যাবে। বিআওনিহী তাআলা।
আজকের আলোচনাটিতে আমরা বাইবেলের দুটো বাংলা অনুবাদের সাহায্য নিব:—
১/ উইলিয়াম কেরীর অনুবাদ (২০০১ এর সংস্করণ)
২/ বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটির অনুবাদ (২০০৬ এর সংস্করণ)
একই সাথে বাইবেলের দুটো পুস্তিকা হতে তথ্যাবলী নিবো:—
১/ ২ রাজাবলি
২/ ২ বংশাবলি
পুস্তিকা দুটোই বাইবেলের পুরাতন নিয়ম বা Old Testament এর অন্তর্গত। ২ রাজাবলিতে কি বর্ণিত আছে তা জানার জন্য আমাদের ১ রাজাবলিতে একখান ‘ঢুঁ’ মারতে হবে। কেরীর অনুবাদে ১ রাজাবলির ভূমিকায় আমরা দেখতে পাই,
শমূয়েলের পুস্তকে ইস্রায়েল জাতির মধ্যে রাজতন্ত্রের গোড়াপত্তনের যে ইতিহাস বর্ণিত হইয়াছে, রাজাবলির প্রথম পুস্তকে সেই ইতিহাসেরই ধারা অগ্রসর হইয়াছে।
এমনিভাবে ২ রাজাবলির ভূমিকাতে আমরা পাই,
প্রথম রাজাবলির ইতিহাস যেখানে শেষ হইয়াছে, তার পরবর্তী সময়ের ইতিহাস দ্বিতীয় রাজাবলিতে বর্ণিত হইয়াছে।
আর বংশাবলির টপিক শমূয়েল ও রাজাবলির টপিকই ধরতে গেলে। বলতে গেলে তা শমূয়েল ও রাজাবলিরই পুনরাবৃত্তি। কেননা, তার প্রথম খণ্ডের ভূমিকাতেই আমরা দেখি,
বংশাবলির পুস্তক দুইটিতে শমূয়েলের প্রথম ও দ্বিতীয় পুস্তক এবং রাজাবলির প্রথম ও দ্বিতীয় পুস্তকে লিপিবদ্ধ সমস্ত ঘটনার পুনরাবৃত্তি করা হইয়াছে...
আপাতত পাঠ পরিচিতি শেষ। এখন মূলপাঠে ঢোকা যাক।
২ রাজাবলির ৮ম অধ্যায়ের ২৫ ও ২৬ পদে কেরীর অনুবাদে লেখা আছে,
ইস্রায়েল-রাজ আহাবের পুত্র যোরামের দ্বাদশ বৎসরে যিহুদা-রাজ যিহোরামের পুত্র অহসিয় রাজত্ব করিতে আরম্ভ করেন। অহসিয় বাইশ বৎসর বয়সে রাজত্ব করিতে আরম্ভ করিয়া যিরূশালেমে এক বৎসর রাজত্ব করেন।
অর্থাৎ, অহসিয় কত বছর বয়সে রাজত্ব শুরু করেন?
=⟩ বাইশ (২২) বছর বয়সে।
এখন শুনুন, ২ বংশাবলির কথা। উইলিয়াম কেরীর অনুবাদেই সে পুস্তিকার ২২তম অধ্যায়ের ১ ও ২ পদে লেখা,
অতএব যিহুদা-রাজ যিহোরামের পুত্র অহসিয় রাজত্ব করিতে লাগিলেন। অহসিয় বিয়াল্লিশ বৎসর বয়সে রাজত্ব করিতে আরম্ভ করেন।
অতএব, অহসিয় কত বছর বয়সে রাজত্ব শুরু করেন?
=⟩ বিয়াল্লিশ (৪২) বছর বয়সে।
এখন সবার মনেই প্রশ্ন জাগবে, কোনটা ঠিক? ২২ না ৪২? সে ব্যক্তি বাইবেলে বিশ্বাসী হোক চাই না হোক, এমন খটকা লাগবেই। প্রশ্নটা আবার লক্ষ্য করুন। এটা এভাবে উত্থাপিত হচ্ছে, কোনটা ঠিক? অর্থাৎ মানুষের সহজাত ভাবনাই বলে দিচ্ছে, যে কোনো একটা ঠিক, অপরটা ভুল। তাই না?
এই যে একটা বৈপরীত্য, এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বাইবেলের প্রচারকরা যে কী ধরনের মেন্টালি ডিপ্রেশনে পড়ে যায়, তা তারাই উপলব্ধি করতে পারে। পিতা, পুত্র, পবিত্র আত্মা এই তিনকে এক বানাতে গিয়েই[১] তো তাদের ‘উরাধুরা’ গলদঘর্ম হতে হয়। তো, তিনকে এক বানাতে গিয়েই যারা ‘কাহিল’, বিয়াল্লিশকে বাইশ অথবা বাইশকে বিয়াল্লিশ বানাতে গেলে তো তাদের মাথার চুল সবকটা পড়ে যাবে!
তবুও ভাল হত যদি এখানকার ভুলভ্রান্তির ব্যাপারটা এটুকুতেই স্তিমিত থাকত। বাইবেল প্রচারকরা হয়তো এটাকে বাইবেলের ‘রূহানী কারিশমা’ বলে চালিয়ে দিতে পারতো। কিন্তু সমস্যা বাধল আরেক জায়গায়। কেরীর অনুবাদে ২ বংশাবলির ২২ অধ্যায়ের ২ পদে অহসিয় রাজার ব্যাপারে লেখা আছে, তিনি কিনা ৪২ বছর বয়সে রাজা হয়েছিলেন, যেখানে সে পুস্তিকারই তথ্যমতে অহসিয়ের পিতা যিহোরামের ক্ষেত্রে লেখা হয়েছে, তিনি মারা গিয়েছিলেন ৪০ বছর বয়সে! এবারে দেখুন তো, এটা কেমন দেখায়, পিতা যখন ৪০ বছর বয়সে মারা যায়, পুত্রের বয়স কিনা তখন ৪২ বছর! অর্থাৎ, পুত্র পিতার চেয়ে দুই বছরের বড়!?
খটকা লাগে ভাই?
থাক, এটা ব্যাপার না। বাইবেলে এসব ছোটখাটো ভুল থাকবেই। এসব ভুল না থাকলে এটা বাইবেল হলো নাকি? আরে ভাই, এটাই তো বাইবেলের একটা ‘রুহানী বৈশিষ্ট্য’!
কেরীর অনুবাদ হতে ২ বংশাবলি/২১/২০ নিচে উদ্ধৃত করছি,
তিনি বত্রিশ বৎসর বয়সে রাজত্ব করিতে আরম্ভ করেন, এবং যিরূশালেমে আট বৎসর কাল রাজত্ব করেন। তিনি চলিয়া গেলেন, কেহ শোক করিল না।
৩২+৮=৪০
কথায় কোনো ভেজাল আছে?
একে তো গোঁজামিল, তার ওপর আবার ভুল তথ্য। ভাবুন তো, যারা এসবের প্রচারক, তারা কতই না প্রশ্নবানে জর্জরিত হয়েছে এসব ভুলের জন্য!
তারা আসলে অনেক প্রশ্নের সম্মুখীনই হয়েছে এ ভুলের জন্য। বছর পেরিয়ে বছরে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলশ্রুতিতে বাইবেল যতো বেশি প্রচারিত হয়েছে, ততো বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে তাদের প্রশ্নের সম্মুখীন হবার বাৎসরিক গড়পরতার। যে কারণে কেরীর অনুবাদের সর্বশেষ সংস্করণ প্রকাশ হবার পাঁচ বছরের মাথায় অর্থাৎ ২০০৬ সালেই বাংলাদশ বাইবেল সোসাইটি (বিবিএস) তাদের করা অনুবাদে ২ বংশাবলি/২২/২—তে ৪২ এর স্থলে ২২ লিখে দেয়। ব্যস, এক ঢিলে দুই পাখি মারা হয়ে গেল! বৈপরীত্যও চুকলো, অবান্তর তথ্যও ঘুচলো!
পাশাপাশি তারা হাঁফ ছেড়েও বাঁচলো!
রাজা অহসিয় কত বছর বয়সে রাজত্ব শুরু করেন এ নিয়ে কোনো বৈপরীত্যও থাকল না, আবার পিতা পুত্রের চেয়ে দুই বছরের ছোটও হল না। চমৎকার সংশোধনী! তারিফ পাবার যোগ্য!
এখন তারা যে বাইবেল প্রচার করে, তাতে আর ৪২ লেখা নেই। তাতে লেখা,
অহসিয় বাইশ বছর বয়সে রাজা হয়েছিলেন...[২]
তারা হয়ত এখন এ সংশোধনীর পেছনে বহু কারণ দর্শাবে। কিন্তু সত্যি কথা হল, ‘ইতিহাস কখনো বদলায় না’। যে কারণে আমরা দেখতে পাই, বাইবেলের সুপ্রাচীন এবং নির্ভরযোগ্য দুটি ভার্সন KJV এবং RSV—তে এবং বাইবেলের হিব্রু, অ্যারামাইক, গ্রীক, ল্যাটিন, সিরীয়াক প্রত্যেকটি প্রাচীন অনুবাদের কোনটিতেই ২ বংশাবলি/২২/২—তে ৪২ এর স্থলে ২২ লেখা নেই।
প্রামাণ্যতার খাতিরে আমরা নিজ চোখেই দেখার চেষ্টা করবো, সেখানে কী লেখা আছে।
প্রথমেই দেখবো বাইবেলের সুপ্রাচীন সংস্করণ King James Version (KJV)—তে কী লেখা আছে। সেখানে লেখা আছে,
Forty and two years old [was] Ahaziah when he began to reign, and he reigned one year in Jerusalem.
King James Version এর পরিশোধিত সংস্করণ New King James Version (NKJV)—তেও সেই পদটি প্রায় অপরিবর্তিতই রয়েছে। নিচে দেখুন,
Ahaziah was forty–two years old when he became king, and he reigned one year in Jerusalem.
এবারে দেখা যাক বাইবেলের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য বলে ধরা হয়ে থাকে যে সংস্করণকে; অর্থাৎ Revised Standerd Version (RSV)—তে কী লেখা আছে,
Ahazi'ah was forty-two years old when he began to reign, and he reigned one year in Jerusalem.
Revised Standerd Version এর সংশোধিত সংস্করণ New Revised Standerd Version (NRSV)—তেও এ সংখ্যার পরিবর্তন ঘটেনি। লেখা হয়েছে,
Ahaziah was forty-two years old when he began to reign; he reigned one year in Jerusalem.
তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি, KJV, NKJV, RSV, NRSV বাইবেলীয় প্রত্যেকটা সংস্করণেই ২ বংশাবলি/২২/২—তে ৪২ লেখা রয়েছে। কোথাও ২২ লেখা নেই। এবারে চলুন দেখি বাইবেলের প্রাচীনতম অনুবাদগুলোয় কী লেখা আছে।
ইয়াহুদীদের তানাখে লেখা আছে,
בֶּן־אַרְבָּעִ֨ים וּשְׁתַּ֤יִם שָׁנָה֙ אֲחַזְיָ֣הוּ בְמׇלְכ֔וֹ וְשָׁנָ֣ה אַחַ֔ת מָלַ֖ךְ בִּירוּשָׁלָ֑͏ִם וְשֵׁ֣ם
Forty and two years old was Ahaziah when he began to reign; and he reigned one year in Jerusalem;
এখানেও ৪২ লেখা আছে, ২২ নয়। হিব্রুতে বিয়াল্লিশ אַרְבָּעִ֨ים וּשְׁתַּ֤יִם এভাবে লেখে[৩], যেখানে বাইশ লেখা হয় עשרים ושתיים এভাবে[৩]। লক্ষ্য করুন, হিব্রু টেক্সটে אַרְבָּעִ֨ים וּשְׁתַּ֤יִם (৪২) লেখা আছে।
এমনিভাবে ল্যাটিন ট্রান্সলেশানে আমরা দেখি,
filius quadraginta duo annorum erat Ochozias cum regnare coepisset et uno anno regnavit in Hierusalem.
Ahaziah was forty-two years old he began to reign and reigned for one year in Jerusalem
quadraginta duo দ্বারা ল্যাটিনে বিয়াল্লিশকে বোঝানো হয়[৪]। বাইশ বোঝাতে vigintiduo ওয়ার্ড ইউজ করা হয়ে থাকে[৪]। আর, ল্যাটিনদের করা বাইবেলিক্যাল ট্রান্সলেটে quadraginta duo ওয়ার্ড ব্যবহৃত হয়েছে, যা বিয়াল্লিশকেই বোঝায়।
তাহলে আমরা দেখতে পেলাম বাইবেলের পুরানা অনুবাদগুলোয়ও ২ বংশাবলি/২২/২—তে অহসিয়ের বয়স ৪২—ই লেখা, ২২ নয়। পুরাতন অনুবাদগুলো প্রদর্শন করার ক্ষেত্রে গ্রীক সেপ্টুআজিন্ট এবং সিরীয়াক ট্রান্সলেইশানকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। অচিরেই আমরা এ দুটোয় কী লেখা আছে তা-ও জানতে পারবো, বিআওনিহী তাআলা।
আমরা তাহলে জানতে পারছি, বাইবেলীয় এ বৈপরীত্য প্রাচীনকাল থেকেই ছিল। এটা অনুবাদ কৃত/মুদ্রণ জনিত ভুল নয়। যদি এটা এমন অনিচ্ছাকৃত কোন ভুল হতই, তাহলে এটা পূর্বেকার বিভিন্ন অনুবাদকদের কারো না কারোর চোখে পড়তোই। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। অতএব যদি কেউ এখন এটাকে অনুবাদ কৃত/মুদ্রণ জনিত ভুল বলে, তাহলে বুঝতে হবে সে এই ভুলটিকে মানুষের মুখ থেকে শুনে সংশোধন করেছে, পাণ্ডুলিপি বা প্রাচীন কোন অনুবাদ দেখে নয়।
এটা যে বাইবেলের বিশুদ্ধতার ক্ষেত্রে ক্রিটিক্যাল একটা কেইস, তা হাল জমানার তাবৎ বাইবেল বিশেষজ্ঞদেরও অভিমত। নিচে আমরা এমনই কিছু লেখনী দেখতে চলেছি। চলুন, দেখে আসা যাক,
বহির্বিশ্বের বাইবেল বিশ্বাসীদের পরিচালিত নামকরা একটা ওয়েবসাইট হচ্ছে, /?https://enduringword.com। ২ বংশাবলি/২২/২ এর ক্ষেত্রে বাইবেলের উপর তাদের বিশ্বাসকে টিকাতে গিয়ে সু-বিশিষ্ট বাইবেল ভাষ্যকার অ্যাডাম ক্লার্কের উদ্বৃতি দিয়ে তারা লিখেছেন,
Forty-two years old: This is at odds with 2 Kings 8:26 which says that Ahaziah took the throne when 22 years old. “I am satisfied the reading in 2 Chronicles 22:2, is a mistake; and that we should read…twenty-two instead of forty-two years…. ... ... whose works have been transmitted to us free of similar errors, owing to the negligence of transcribers?” (Clarke on 2 Kings 8:26)
এরপরে সেখানে তারা আরো লিখেছেন,
“The reading found in the LXX and 2 Kings 8:26 for Ahaziah’s age of ‘twenty-two years’ is to be adopted, rather than the MT’s ‘forty-two,’ which would make him older than his father (cf. 2 Chronicles 21:20).” (Payne)[৫]
তাহলে, দেখা যাচ্ছে, খ্রিষ্টধর্মীয় বাইবেল গবেষকরাও এই বৈপরীত্য, এর অবান্তরতা এবং বিভ্রান্ততাকে অকপটে স্বীকার করে নিচ্ছেন। বলছেন এগুলোকে এটা কিনা লিপিকারের অনিচ্ছাকৃত ‘ত্রুটি’। (!) তাদের এ জাতীয় নিরেট ফাঁকা বুলি আরো বেশকিছু ওয়েবসাইটেই আমরা দেখতে পাই। প্রামাণ্যতার খাতিরে এর আরো কয়েকটা আমরা নিচ থেকে পড়বো, বিইযনিল্লাহ।
বাইবেল বিশ্বাসীদের পরিচালিত অপরাপর এক ওয়েবসাইট https://bibleresources.info তে এ সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে,
...that is a scribal error rendered forty where it should have been twenty. It seems most reasonable that Ahaziah was 22 years old and his treacherous murdering mother around forty years old.[৬]
আচ্ছা, যদি কিনা এটা অনুবাদক/লিপিকারের ত্রুটিই হয়ে থাকে, তাহলে বাইবেলের একদম সব অনুবাদক/লিপিকারই কি এ ত্রুটি করেছিলেন? সবাই, একদম সবাই-ই কি ঠিক একই ভুল করতে পারেন? বিষয়টা তো এমন কখনই নয় যে, সে যুগে বাইবেল কেবল একটি অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ ছিল যদ্দরূণ নতুন করে অনুবাদ করা হলে কেবলমাত্র একজনই করবেন! তার বেশি কারোর অনুবাদ করা লাগেনা বা অনুবাদ করেনি! এমন কি ছিল? বলুন?!
বরং বিষয়টা তো ছিল এমন, বাইবেল যেহেতু বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত ছিল, তাই বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন মানুষের অনুবাদও একইভাবে প্রচলিত ছিল। যে জন্যে এক অনুবাদক একটা ভুল করে থাকলে ভিন্ন কারোর অনুবাদে তা উঠে আসবে। কিন্তু এমনটা কি হয়েছিল? প্রাচীন কারোর অনুবাদে কথিত সেই ভুলের স্থলে সঠিকটি দেখা দিয়েছিল?
না, দেখা দেয়নি।
তাহলে এর দ্বারা কি এটা বুঝা যায়না, মূল পাণ্ডুলিপিগুলোতেই ছিল ৪২ বছর লেখা ছিল, ২২ বছর নয়?
এবার আসুন, আরো একটা লেখার সাথে পরিচিত হয়ে আসি। বাইবেল বিশ্বাসীদেরই ভিন্ন একটা লেখা থেকে।
https://www.febc.edu.sg ওয়েবসাইটের গবেষকগণের লেখনীতে আমরা দেখি তারা লিখেছেন,
The “scholarly” statement of this “explanation” is: “The number ‘forty and two’ in 2 Chron 22:2 is evidently the mistake of a copyist.” In other words, since Ahaziah’s father Jehoram died at age 40 (2 Chron 21:20), it would have been impossible for Ahaziah to succeed him at an age of 42! Therefore, somewhere in the history of the transmission of the Hebrew text, a careless scribe committed a transcriptional error.
The problem with this easy solution is: if there is one error in the Bible (albeit an innocent slip of the pen), who is to say there are not other errors in the Bible? How could we be absolutely certain that the precious verses God used to speak to our heart and save our soul are not among those containing errors? Can we really trust our Bible?[৭]
শেষের বাক্যটা আবারও পড়ুন,
Can we really trust our Bible?
আসলেই তো, আমরা কি সত্যিকারার্থেই আমাদের বাইবেলের উপর আস্থা রাখতে পারি?
এখানেও আমরা দেখতে পাচ্ছি এ ভুল তথ্যটাকে তারা লেখকের ‘লিপিকৃত ভুল’ বলেই আখ্যায়িত করছেন। এ পর্যন্ত আমরা এটা যে লিপিকৃত ভুল— এটুকুই জেনেছি। এখন ভিন্ন এক ওয়েবসাইটের (https://answersingenesis.org) বরাতে জানবো, লিপিকারের সেই কথিত ভুলটা কতোটা (ইল)লজিক্যালি বা কোন ভুল ছিল সেটা।
লেখা হয়েছে,
Had the 42 and 22 been written in number form prior to being spelled out, this discrepancy could easily creep in as מ (mem, forty) and כ (caph, twenty) are very similar. We know for certain that as of about AD 900, the Masoretes have it spelled out (e.g., “two and forty” or “two and twenty”).[৮]
তো, দেখা যাচ্ছে, তারা এখানে বলছে, হিব্রুর ৪০—কে অংকে প্রকাশ করতে হলে מ দ্বারা এবং ২০—কে অংকে প্রকাশ করতে হলে כ দ্বারা লেখা হয়। তাদের দাবি, যেহেতু מ (৪০) এবং כ (২০) এর চেহারা প্রায় একই (!), সেহেতু তারা হয়তো অনুলিপি করতে গিয়ে ২০—কে ৪০ লিখে ভুল করেছিলো।
তাদের এ জাতীয় বাল্যসূলভ ধ্যান-ধারণার অপনোদনে আমরা বলবো,
প্রথম কথা, চোখের জ্যোতি থাকা প্রতিটা ব্যক্তিই জানে, হিব্রুর ৪০ এবং ২০ এর সাংখ্যিক মান (מ এবং כ) দেখতে কখনই একই রকমের নয়। বিশ্বাস নাহয় আপনিই যাচাই করে দেখুন আমার কথা!
দ্বিতীয় কথা, এই দাবিটাকে তখনই মেনে নেয়া যাবে, যখন কিনা আমরা মূল পাঠে ৪০ এবং ২০ সংখ্যা দুটো কথায় ছিল নাকি অংকে ছিল তা নিয়ে নিশ্চিত হতে পারবো। কেননা, এ ধরণের সন্দেহ তখনই প্রযোজ্য হবে যখন কিনা আমরা জানতে পারবো, সংখ্যাগুলো অংকেই প্রকাশ করা ছিল, কথায় নয়। কিন্তু এক্ষেত্রে কি আমরা নিশ্চিত? নিশ্চয়তার সাথে বলতে পারি, সংখ্যাগুলো কীভাবে লেখা ছিল? তাহলে কীভাবে আমরা একে নিরেট বলে মেনে নিতে পারি?!
তৃতীয় কথা, এমন মিস্টেক হলে তো একজন বা সর্বোচ্চ তিনজনের হতে পারে— একনাগাড়ে সবার হতে পারার কথা নয়। কিন্তু, এখানে তো দেখা যাচ্ছে তাদের দাবিনুসারে সবাই ভুলই লিখেছে। হাজার হাজার বছর ধরে সকল ট্রান্সলেটর ভুলই লিখে আসছেন। এমন কি হওয়া সম্ভব? কী মনে হয়? নাকি বিষয়টা এমন, অনুবাদকদের সবাই পাণ্ডুলিপি অনুসারে ঠিকই অনুবাদ করেছিলেন, কিন্তু হাজার বছর পর তারা এসে গা জুড়ে বসে অপপ্রলাপ করছে!
চতুর্থ কথা, যদি দাবিদারদের দাবিকে সঠিক বলে মেনেও নেই, তাহলেও বলতে হবে, লিপিকারদের ক্ষেত্রে যদি ৪২ এর ৪ এবং ২২ এর ২ লিখতে গিয়েই তালগোল পাকিয়ে ফেলার ভয় থাকে, তাহলে এই সমস্ত লিপিকারদের থেকে তামাম বাইবেলের অনুবাদকে ‘বিশ্বস্ত’ ভেবে গ্রহণ করা কতোটা বোকামি হবে?
এবারে খ্রিষ্টান মিশনারিদের আন্তর্জাতিক একটা ওয়েবসাইটের লেখা দেখে আসা যাক। https://www.unchangingword.com/ এর এক লেখক এ বৈপরীত্যের খণ্ডন করতে গিয়ে লিখেছে,
কিছু কিছু প্রাচীন পাণ্ডুলিপিতে (সেপ্টুয়াজিন্ট এবং সীরিয়) লেখা আছে “২২”, যেটা ২ বাদশাহ্নামার সঙ্গে মিলে যায়; অন্য কিছু পাণ্ডুলিপিতে লেখা আছে “৪২”। এটা অবশ্যই একটি কপি করার ভুল।[৯]
জবাবদাতা এখানে বলছেন, বাইবেলের সিরীয় এবং সেপ্টুআজিন্ট ম্যানুস্ক্রিপ্টে নাকি ৪২ এর স্থলে ২২ লেখা আছে। আমরা দেখার চেষ্টা করবো, তার এ জবাব সঠিক কিনা। আমরা জানার চেষ্টা করবো, তিনি কি সঠিক জবাবই দিয়েছেন নাকি পিঠ বাঁচাতে এরূপ কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন— তা।
প্রথমেই দেখে আসি সেপ্টুআজিন্টে কী লেখা আছে।
ὢν εἴκοσι ἐτῶν Οχοζιας ἐβασίλευσεν καὶ ἐνιαυτὸν ἕνα ἐβασίλευσεν ἐν Ιερουσαλημ
Ochozias began to reign when he was twenty years old, and he reigned one year in Jerusalem:
আমরা দেখতে পাচ্ছি, এখানে রাজা অহসিয়ের বয়সের মানের ক্ষেত্রে যা লেখা হয়েছে, তা হলো εἴκοσι। গ্রীক নিয়ে স্বল্পবিস্তর জ্ঞান রাখেন এমন প্রতিটা ব্যক্তিই জানেন, εἴκοσι এর অর্থ হলো বিশ[১০]। বাইশ নয়। যদি সেখানে বিশ (εἴκοσι) এর সাথে দুই (δύο) লেখা থাকতো, তাহলে নাহয় বলা যেত, এখানে বাইশ লেখা আছে। কিন্তু, δύο শব্দটা কি সেই পদটাতে তন্ন তন্ন করে খুঁজলেও পাওয়া যাবে?
মিথ্যাচারেরও একটা শেষ আছে। একটা মাত্রা আছে। কিন্তু এ-যে সীমাহীন! যেখানে ব্লগে তাদের দায়িত্ব ছিল বাইবেলীয় বৈপরীত্যের জবাব দিয়ে মানুষের মনকে সংশয়মুক্ত করা, সেখানে তারা কিনা এমন কিছু জবাব দিয়েছে, যার ফলে কিনা সংশয় আরো ঘণীভূত হয়!? আগে তো সংশয় ছিল অহসিয়ের বয়স ২২ নাকি ৪২ কত ছিল— এটা। কিন্তু তাদের এ জবাব পড়বার পর দেখি সংশয়ের আরো বিস্তৃতি ঘটলো! নতুন সংশয় দেখা দিলো! অহসিয়ের বয়স কতো ছিল— ২০ নাকি ২২ নাকি ৪২?
আচ্ছা, সেপ্টুআজিন্টে কী আছে তা-তো দেখলাম। এবারে সিরীয়াক ম্যানুস্ক্রিপ্টে কী আছে তা দেখে আসা যাক।
ܒܰܪ ܥܶܣܪܺܝܢ ܘܬܰܪܬܶܝܢ ܫܢܺܝ̈ܢ ܗܘܳܐ ܐܶܚܰܙܝܳܐ. ܟܰܕ݂ ܩܳܡ ܒܡܰܠܟܽܘܬ݂ܳܐ ܘܫܰܢ̱ܬܳܐ ܚܕ݂ܳܐ ܐܰܡ̣ܠܶܟ݂ ܒܽܐܘܪܺܫܠܶܡ ܘܰܫܡܳܐ ܕܶܐܡܶܗ ܥܬܰܠܝܳܐ ܒܰܪܬ݂ ܥܰܡܪܺܝ.
এখানেও ঠিক একই কথা লেখা, ২০ বছর কিনা ছিল রাজার। অহসিয়ের বয়স বুঝাতে ܥܶܣܪܺܝܢ লেখা আছে, যার অর্থ বিশ[১১]; বাইশ নয়। এর সাথেও দুই লেখা নেই, যা দেখে বাইশ বলা যেতে পারে।
দেখেন কাণ্ড!
অতএব আমরা বলতে পারি, এখানে মূলত ৪২—ই লেখা ছিল, পরবর্তীতে বাইবেলের সেপ্টুআজিন্ট এবং সিরীয়াক ট্রান্সলেশনের ট্রান্সলেটর ভুলে/স্বেচ্ছায় এখানে ২০ লিখেছিলেন।
তারপর তারা বলছে,
এটা অবশ্যই একটি কপি করার ভুল।
আহা! বড়ই বেদনার কথা! বাইবেলের প্রচারকরাই এতে থাকা ভুলের কথা স্বীকার করে নিচ্ছেন। এর চেয়ে বড়ো ব্যর্থতার সংবাদ আর কী হতে পারে? তবুও যদি একটুখানি সুবুদ্ধি হয়...
তো, এমন গোমড়ামুখো উত্তর দেবার পরও তারা বাইবেলকে নিরেট সহীহ বলে বিবেচনা করেন কীভাবে? সবচেয়ে বড়ো প্রশ্ন হচ্ছে, যেসব অনুলিপিকারীদের থেকে কিনা ২২ আর ৪২ এরই সঠিক অনুলিপন প্রত্যাশা করা যায়না, সেসব অনুলিপিকারীদের থেকে কীভাবে তামাম বাইবেলের নির্ভুল অনুবাদ আশা করা যেতে পারে? খটকা কি লাগে না?!
এতো এতো জবাব দেবার পরও, এতো খণ্ডনের পরও যদি কেউ তর্ক বৃদ্ধি করতে চায়, দেখাতে চায় এ পরিবর্তনের পেছনে অমুক-তমুক বিভিন্ন কারণ, তাহলে তার কাছে আমাদের প্রশ্ন হবে,
‘আপনি কি KJV, RSV—র মতো অথেন্টিক ও বিচক্ষণ অনুবাদকের চেয়েও বাইবেলীয় হিব্রু নিয়ে বেশি জ্ঞান রাখেন?’
যুগে যুগে বাইবেলের সত্যতা এভাবেই প্রকাশ পাবে।
চিল্লায়ে কন ঠিক কিনা!!!
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর...
মহিমাহিম প্রভু আল্লাহ বলেন,
তারা কি কুরআন নিয়ে চিন্তা করেনা? যদি তা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো পক্ষ হতে হতো, তাহলে অবশ্যই তারা এতে অনেক বৈপরীত্য পেতো।[১২]
তথ্যসূত্র
[১] ‘How is the doctrine of the Trinity not tritheism?’— Got Questions https://www.gotquestions.org/Tritheism-Trinity.html
[২] ২ বংশাবলি/২২/২ বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটির অনুবাদ
https://www.wordproject.org/bibles/ben/14/22.htm
[৩] লিঙ্কে ক্লিক করে উল্লেখিত শব্দ লিখে সার্চ করুন।
https://www.translate.com/hebrew-english
[৪] লিঙ্কে ক্লিক করে উল্লেখিত শব্দ লিখে সার্চ করুন।
https://www.translate.com/latin-english
[৫] ‘2 Chronicles 22 – The Evil Reigns of Ahaziah and Athaliah’— Enduring Word
[৬] ‘2 Kings 8:26 and 2 Chronicles 22:2, please mistake clear.’— Bible Resources
https://bibleresources.info/2-kings-826-and-2-chronicles-222-please-mistake-clear/
[৭] ‘A Scribal Error in 2 Chronicles 22:2? No!’ by Robert J Sargent
https://www.febc.edu.sg/v15/article/def_scribal_error_in_2chron22
[৮] ‘Two Ages at Once’ by Stacia McKeever and Bodie Hodge
https://answersingenesis.org/bible-timeline/genealogy/two-ages-at-once/
[৯] ‘২ খান্দাননামা ২২:২ – বাদশাহ্ অহসিয় ৪২ বছর বয়সে নাকি ২২ বছর বয়সে বাদশাহ্ হলেন?’ আল্লাহর অপরিবর্তনীয় কালাম
[১০] লিঙ্কে ক্লিক করে উল্লেখিত শব্দ লিখে সার্চ করুন।
https://www.translate.com/greek-english
[১১] লিঙ্কে ক্লিক করে উল্লেখিত শব্দ লিখে সার্চ করুন।
[১২] কুরআন/ সূরা নিসা (৪)/৮২ https://www.hadithbd.net/quran/link/?id=575