বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম
খ্রিস্টান বনাম মুসলিম সংলাপ
বিষয়: যীশু কতৃক বিঘোষিত সেই সাহায্যকারী কে? মুহাম্মদ ﷺ নাকি পবিত্র আত্মা?
এই পৃথিবীতে অন্তত ৮৫% + মানুষ বিভিন্ন ধর্মে বিশ্বাসী। আর এসব ধর্মের মধ্যে সবচেয়ে বৃহত্তমের তালিকায় রয়েছে ইসলাম, খ্রিস্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ, শিক, অগ্নিপূজক অন্যান্য ধর্মীয় লোক তথা অমুসলিম সম্প্রদায়। তো এসব ধর্মে বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের সবার-ই দাবি, যদি ধর্ম-কর্ম পালন করলে জান্নাত পাওয়া যায়, তাহলে আমরাও যেতে পারব। কারণ আমরাও ধর্ম পালন করি। তাদের মতে তাদের এ দাবি যুক্তিপূর্ণ। কারণ প্রত্যেক জাতি বা সম্প্রদায়ই মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে যে, তাদের ধর্মই সত্য। আসলে মহান আল্লাহর নিকট জাতিগত বা বংশগত আভিজাত্যের কোন মূল্য নেই। তাঁর কাছে জন্মগত ভাবে ইয়াহুদি, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ মুসলিম অমুসলিম সবাই সমান, তিনিই তাদের সকলকে সৃষ্টি করেছেন। মুসলিম ঘরে জন্মগ্রহণ করেও অনেকেই আল্লাহর শত্রু হতে পারে, পক্ষান্তরে অমুসলিম ঘরে জন্মগ্রহণ করেও ঈমান এনে, সৎকর্ম করে তাঁর বন্ধু হতে পারে [কোরআন ২:৬২,১১২ দ্রষ্টব্য]। যে কেউই মহান আল্লাহর উপর ইমান এনে তাঁর বিধিবিধান পরিপূর্ণ পালন করবে, হোক সে যেই ধর্মের লোক, আল্লাহ্ তাঁকে পুরস্কার দিবেন। [পবিত্র কোরআন ১৬:৯৭]
পক্ষান্তরে যে অবাধ্য হবে সে শাস্তি পাবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই সত্য ধর্ম কোনটি? জান্নাতে কারা যাবে? অমুসলিম বিশেষ করে ইয়াহুদি ও খ্রিস্টানরা যথাক্রমে দাবি করত, যা পবিত্র কোরআনে এইভাবে বলা হয়েছে:
Al-Baqarah 2:111
وَ قَالُوۡا لَنۡ یَّدۡخُلَ الۡجَنَّۃَ اِلَّا مَنۡ کَانَ هُوۡدًا اَوۡ نَصٰرٰی ؕ تِلۡکَ اَمَانِیُّهُمۡ ؕ قُلۡ
هَاتُوۡا بُرۡهَانَکُمۡ اِنۡ کُنۡتُمۡ صٰدِقِیۡنَBengali - Mujibur Rahman
এবং তারা বলেঃ ইয়াহুদী বা খৃষ্টান ছাড়া আর কেহই জান্নাতে প্রবেশ করবেনা; এটা তাদের মিথ্যা আশা। তুমি বলঃ যদি তোমরা সত্যবাদী হও তাহলে তোমাদের প্রমাণ উপস্থিত কর।"
▪︎ অর্থাৎ ইহুদি- খ্রিস্টানরা যে দাবি করত, আল্লাহ্ তার সমর্থনে দলিল প্রমাণ উপস্থাপন করতে বলেছেন যদি তারা সত্যবাদি হয়। এছাড়া ইহুদি ও খ্রিস্টানরা মাঝে-মধ্যেই ইসলাম ও মহানবী হযরত মুহাম্মদ ﷺ কে আক্রমণ করে। আল্লাহ্ ও তাঁর কিতাব এবং তাঁর রাসূলের সুন্নাহের সমালোচনা করে। আর ইসলাম বিদ্বেষী অমুসলিমসহ নাস্তিকদের বলছি, "যদি তোমরা সত্যবাদী হও তাহলে তোমাদের প্রমাণ উপস্থিত কর।"মহামহিমান্বিত আল্লাহ্ তা'আলা বলেছেন:
Al-Baqarah 2:146
ٱلَّذِينَ ءَاتَيْنَٰهُمُ ٱلْكِتَٰبَ يَعْرِفُونَهُۥ كَمَا يَعْرِفُونَ أَبْنَآءَهُمْۖ وَإِنَّ فَرِيقًا مِّنْهُمْ لَيَكْتُمُونَ ٱلْحَقَّ وَهُمْ يَعْلَمُونَBengali - Mujibur Rahman
যাদেরকে আমি কিতাব প্রদান করেছি তারা তাঁকে এরূপভাবে চিনে, যেমন চিনে তারা আপন সন্তানদেরকে এবং নিশ্চয়ই তাদের এক দল জ্ঞাতসারে সত্যকে গোপন করছে।"
▪︎ এইখানে ইহুদি- খ্রিস্টানদের উদ্দেশ্যে মহান আল্লাহ্ বলেছেন যে, "তারা মহানবী হযরত মুহাম্মদ ﷺ কে সেভাবেই চিনে, যেভাবে চিনে তাদের নিজেদের সন্তানদেরকে।" অর্থাৎ নিজের সন্তানকে চেনার সাথে তুলনা করার কারণ হলো পিতা-মাতাই সন্তানকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে চিনে ঠিক অনুরূপভাবে ইহুদি- খ্রিস্টানদের মধ্যে যারা তাদের কিতাব সম্পর্কে জ্ঞানী ছিল তারাও নবীজি ﷺ এর সম্পর্কে তাদের কিতাব থেকে জানতে পেরেছিল; কেননা ইহুদি- খ্রিস্টানদের কিতাবের মধ্যে রাসূল ﷺ এর সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে তাঁর বৈশিষ্ট্য, গুণাবলীর কথা বিদ্যমান ছিল; এবং কি বর্তমান বাইবেলের মধ্যেও তাঁর গুণাবলীর সম্পর্কে পাওয়া যায় যদিও তার অনেক কিছুই বিকৃত। তবুও কোরআন হাদিসের সঙ্গে এর অনেকাংশ-ই মিলে যায়। আর ইহুদি- খ্রিস্টানরা তাদের কিতাবের মাধ্যমে নবী ﷺ এর সম্পর্কে অবগত ছিল বিশেষ করে আহলে কিতাবী পন্ডিতগণ এ সম্পর্কে আরো ভাল জানত। এরপরেও অনেকেই তাঁকে অস্বীকার করত যারা ছিল মূলত সত্যত্যাগী। সহীহ হাদিসের মধ্যেও এমন অনেক প্রমাণ পাওয়া যায়। তো এদের মধ্যে একজন সাহাবী ছিলেন যিনি পূর্বে ছিল ইহুদিদের মধ্যে অন্যতম একজন ধর্মীয়পন্ডিত তথা রাব্বী যার নাম আবদুল্লাহ ইবনু সালাম (রাঃ)। তিনি বলেন, তাওরাত কিতাবে মুহাম্মাদ (ﷺ) -এর গুণাবলি লিপিবদ্ধ রয়েছে।
তাফসীরে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে: হযরত উমর বিন খাত্তাব (রাঃ) বলেন: আবদুল্লাহ বিন সালামকে বললাম: তোমার সন্তানের মত মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে চেনো? তিনি বললেন, "হ্যাঁ, বরং তার চেয়েও বেশি। আব্দুল্লাহ বিন উমর (রাঃ) হতে বর্ণিত, ইয়াহূদীরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খিদমতে এসে বলল: তাদের একজন পুরুষ ও একজন মহিলা ব্যভিচার করেছে। নবী (ﷺ) জিজ্ঞাসা করলেন, প্রস্তর নিক্ষেপ করে হত্যা করা সম্পর্কে তাওরাতে কী বিধান পেয়েছো? তারা বলল: আমরা এদেরকে অপমানিত করব এবং বেত্রাঘাত করব। আবদুল্লাহ বিন সালাম (রাঃ) বললেন: তোমরা মিথ্যা বলছো। তাওরাতে প্রস্তর নিক্ষেপের বিধান রয়েছে। তারা তাওরাত নিয়ে এসে বের করল এবং প্রস্তর নিক্ষেপে হত্যা করা সম্পর্কীয় আয়াতের ওপর হাত রেখে তার আগে ও পরের আয়াতগুলো পাঠ করল। আবদুল্লাহ বিন সালাম বললেন, তোমার হাত সরাও। সে হাত সরাল। তখন দেখা গেল প্রস্তর নিক্ষেপে হত্যা করার আয়াত আছে। তখন ইয়াহূদীরা বলল: হে মুহাম্মাদ! তিনি সত্যই বলেছেন" [1]।
এছাড়া তৎকালীন সময়ে অসংখ্য সাহাবী পূর্বে ইহুদি ছিলেন, যারা পরে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তাওরাতের মধ্যে নবী ﷺ এর গুণাবলি দেখে। আবার মহান আল্লাহ্ সুবাহানাহু ওয়া'তাআলা অন্যত্রে বলেছেন:
Al-A'raf 7:157
ٱلَّذِينَ يَتَّبِعُونَ ٱلرَّسُولَ ٱلنَّبِىَّ ٱلْأُمِّىَّ ٱلَّذِى يَجِدُونَهُۥ مَكْتُوبًا عِندَهُمْ فِى ٱلتَّوْرَىٰةِ وَٱلْإِنجِيلِ يَأْمُرُهُم بِٱلْمَعْرُوفِ وَيَنْهَىٰهُمْ عَنِ ٱلْمُنكَرِ وَيُحِلُّ لَهُمُ ٱلطَّيِّبَٰتِ وَيُحَرِّمُ عَلَيْهِمُ ٱلْخَبَٰٓئِثَ وَيَضَعُ عَنْهُمْ إِصْرَهُمْ وَٱلْأَغْلَٰلَ ٱلَّتِى كَانَتْ عَلَيْهِمْۚ فَٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ بِهِۦ وَعَزَّرُوهُ وَنَصَرُوهُ وَٱتَّبَعُوا۟ ٱلنُّورَ ٱلَّذِىٓ أُنزِلَ مَعَهُۥٓۙ أُو۟لَٰٓئِكَ هُمُ ٱلْمُفْلِحُونَBengali - Bayaan Foundation
যারা অনুসরণ করে রাসূলের, যে উম্মী নবী; যার গুণাবলী তারা নিজদের কাছে তাওরাত ও ইঞ্জিলে লিখিত পায়, যে তাদেরকে সৎ কাজের আদেশ দেয় ও বারণ করে অসৎ কাজ থেকে এবং তাদের জন্য পবিত্র বস্তু হালাল করে আর অপবিত্র বস্তু হারাম করে। আর তাদের থেকে বোঝা ও শৃংখল- যা তাদের উপরে ছিল- অপসারণ করে। সুতরাং যারা তার প্রতি ঈমান আনে, তাকে সম্মান করে, তাকে সাহায্য করে এবং তার সাথে যে নূর নাযিল করা হয়েছে তা অনুসরণ করে তারাই সফলকাম।"
▪︎ এইখানে মহামহিমান্বিত আল্লাহ্ বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ ﷺ এর সম্পর্কে কথা বলেছেন যে, তাঁর গুণ-বৈশিষ্ট্যের সম্পর্কে পূর্ববর্তী কিতাব তথা তাওরাত-ইঞ্জিলের মধ্যে অগ্রিম জানিয়ে দিয়েছিলেন, যার জন্য আহলে কিতাবী পন্ডিতগণ তাঁর আবির্ভাবের পূর্ব থেকেই জানতে পেরেছিল; এবং কি তাঁর সম্পর্কে তাওরাত-ইঞ্জিলের মধ্যে যেসব গুণাবলীর কথা বলা হয়েছিল সেসবও প্রকাশ্যে তাঁর (নবী) দ্বারা বাস্তবায়িত হয়েছে। সহীহ হাদিসের মধ্যেও রয়েছে, কোন এক ইহুদি বালককে নবী ﷺ বললেনঃ হে ইয়াহুদী (পিতা), আমি তোমাকে কসম দিচ্ছি সে মহান সত্তার যিনি মূসা আলাইহিস সালামের প্রতি তাওরাত নাযিল করেছেন, তুমি কি তাওরাতে আমার অবস্থা ও গুণ-বৈশিষ্ট্য এবং আবির্ভাব সম্পর্কে কোন বর্ণনা পেয়েছ? সে অস্বীকার করল। তখন তার ছেলে বললঃ হে আল্লাহর রাসূল! তিনি (পিতা) ভুল বলছেন। তাওরাতে আমরা আপনার আলোচনা এবং আপনার গুণবৈশিষ্ট্য দেখতে পাই।" [2]
অন্যত্র সহীহ হাদিসের মধ্যে আরো এসেছে যে, আতা ইবনু ইয়াসার (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি ‘আবদুল্লাহ ইবনু আমর ইবনু আস (রাঃ)-কে বললাম, আপনি আমাদের কাছে তাওরাতে বর্ণিত আল্লাহর রাসূল ﷺ এর গুণাবলী বর্ণনা করুন। তিনি বললেন, আচ্ছা। আল্লাহর কসম! কুরআনে বর্ণিত তাঁর কিছু গুণাবলী তাওরাতেও উল্লেখ করা হয়েছেঃ ‘‘হে নবী! আমি আপনাকে সাক্ষীরূপে, সুসংবাদদাতা ও ভয় প্রদর্শনকারীরূপে প্রেরণ করেছি’’ এবং উম্মীদের রক্ষক হিসাবেও। আপনি আমার বান্দা ও আমার রাসূল। আমি আপনার নাম মুতাওয়াক্কিল (আল্লাহর উপর ভরসাকারী) রেখেছি। তিনি বাজারে কঠোর রূঢ় ও নির্দয় স্বভাবের ছিলেন না। তিনি মন্দর প্রতিশোধ মন্দ দ্বারা নিতেন না বরং মাফ করে দিতেন, ক্ষমা করে দিতেন। আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে ততক্ষণ মৃত্যু দিবেন না যতক্ষণ না তাঁর দ্বারা বিকৃত মিল্লাতকে ঠিক পথে আনেন অর্থাৎ যতক্ষণ না তারা (আরববাসীরা) ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর ঘোষণা দিবে। আর এ কালিমার মাধ্যমে অন্ধ-চক্ষু, বধির-কর্ণ ও আচ্ছাদিত হৃদয় খুলে যাবে।
অর্থাৎ তাওরাত-ইঞ্জিলে বর্ণিত রাসূলের সুসংবাদ, প্রকৃত লক্ষণ এবং নির্দেশনাবলীর মাধ্যমে ইয়াহুদি-খ্রিস্টানরা প্রিয় নবীকে চিনে। ব্রিটেন, কানাডা, আমেরিকার ইয়াহুদি-খ্রিস্টান পন্ডিতগণ মিলে বৃট্যানিকা বিশ্বকোষে লিখেছেন-:
"Muhammad _marched on Mecca in January 630 A.C. with 10,000 men Muhammad promised a general amnesty......Two Muslims & 28 of the enemy were killed. A score of person's were specially excluded from the amnesty,but some were later pardoned.
মুহাম্মদ ﷺ ৬৩০ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে ১০,০০০ সৈন্য নিয়ে মদিনা থেকে যাত্রা করলেন এবং মক্কা বিজয় করলেন। মুহাম্মদ সাঃ সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলেন।.....দুইজন মুসলিম শহিদ হলেন এবং ২৮ জন শত্রু সেনা নিহত হলো" [3]।
এখানে "দশহাজার সৈন্য নিয়ে" যিনি এলেন তাঁর সম্বন্ধে খ্রিস্টানদের বাইবেলে দুই স্থানে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে হযরত মুসা আঃ এবং হযরত দাউদ আঃ থেকে।
[ক] প্রথম স্থানে মুসা আঃ বলেছেন:
Deuteronomy 33:2 KJV
2. And he said, The LORD came from Sinai, And rose up from Seir unto them; He shined forth from mount Paran, And he came with ten thousands of saints: From his right hand went a fiery law for them.
কেরি ভার্সনে এর অনুবাদ করা হয়েছে:
দ্বিতীয় বিবরণ ৩৩:২
২. সদাপ্রভু সীনয় হইতে আসিলেন, সেয়ীর হইতে তাহাদের প্রতি উদিত হইলেন; পারণ পর্বত হইতে আপন তেজ প্রকাশ করিলেন, অযুত অযুত পবিত্রের নিকট হইতে আসিলেন; তাহাদের জন্য তাঁহার দক্ষিণ হস্তে অগ্নিময় ব্যবস্থা ছিল।
▪︎ এখানে সদাপ্রভু ঈশ্বরের আগমনের অর্থ এই না যে, তিনি আসলেই সীনয়, সেয়ীর এবং পারাণ পর্বতে এসেছেন বরং এখানে তাঁর আগমন রুপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। সদাপ্রভু....হইতে আসিলেন ও উদিত হইলেন এবং তাঁর আপন তেজ প্রকাশ করিলেন এর অর্থ হলো, "তিনি এখানে তাঁর প্রত্যাদেশ প্রকাশ করিলেন নবীগণের উপর।" উল্লেখ্য যে এখানে আবার তিনটা কথা বিশেষভাবে গুরত্বপূর্ণ।
- সীনয় পর্বত : এখানে "সীনয় হইতে সদাপ্রভুর আগমনের" অর্থ হলো মোশি/মুসা আঃ কে তোরাহ (তাওরাত) প্রদান করা। উল্লেখ্য যে পবিত্র কোরআনের মধ্যে এই সীনয় পর্বতের শপথ করা হয়েছে ৯৫:২
- সেয়ীর পর্বত: এখানে "সেয়ীর হইতে উদিত হওয়া" মানে যীশু/ঈসা আঃ কে সুসমাচার তথা ইঞ্জিল প্রদান করা।
- পারণ পর্বত: আর "পারণ পর্বত হইতে আপন তেজ প্রকাশ করা" অর্থ সর্বশেষ নবী মুহাম্মদ ﷺ এর উপর পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ করা। কারণ পারণ পর্বত মক্কায় অবস্থিত একটি পর্বত।
নোট: পারণ বা ফারান হিব্রু ভাষায় মক্কাস্থিত হেরা পর্বতের নাম। প্রচলিত ভাষায় একে "জাবাল আল নূর" বলে যা হেরা পর্বত নামেই পরিচিত। আর এখানেই নবী মুহাম্মদ ﷺ এর উপর প্রথম ওহী অবতীর্ণ হয়েছিল।
এছাড়া উল্লেখ্য যে, এখানে মূল উদ্ধৃতিতে মহানবী হযরত মুহাম্মদ ﷺ এর আবির্ভাবের ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে। খ্রিস্টান অনুবাদকগণ কত বড় ধোঁকাবাজ যে, মহানবী হযরত মুহাম্মদ ﷺ কে যেন মানুষ চিনতে না পারে এই জন্য তারা অনুবাদের মধ্যে কারসাজি করেছেন অর্থাৎ মিথ্যা অনুবাদ করেছেন ইচ্ছাকৃতভাবে। প্রমাণ নিচে:
i] হিব্রু বাইবেলের মধ্যে מֵרִבְבֹ֣ת শব্দটা রয়েছে যার অর্থ হলো ten thousand.
ii] বাংলা কেরির অনুবাদে ten thousand এর মিথ্যা অনুবাদ করা হয়েছে অযুত অযুত।
iii] "অযুত অযুত পবিত্রের সহিত অথবা অযুত অযুত পবিত্রকে" সঙ্গে নিয়ে এলেন বললেও শ্রুতিমধুর একটি অর্থ হতো কিন্তু তা না বলে বলা হয়েছে, "অযুত অযুত পবিত্রের নিকট হইতে আসিলেন।
iv] আবার উর্দু বাইবেলের মধ্যেও মিথ্যা বলা হয়েছে। সেখানে "ten thousand" এর মিথ্যা অনুবাদ করা হয়েছে "لاکھوں/লক্ষাধিক/millions.
এখানে আরো দুটি বিষয় লক্ষ্যণীয়ঃ
প্রথমত এখানে বলা হয়েছে, he came with ten thousands of saints অর্থাৎ দশ সহস্র পবিত্র ব্যক্তিসহ আগমন মোশি বা যীশুর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় বরং নবী মুহাম্মদ ﷺ এর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কারণ ইতিহাস সাক্ষী দেয় যে, মক্কা বিজয়ের সময় তিনি দশ সহস্র/হাজার সাথীসহ মক্কায় আগমন করেন যাঁরা ছিলেন মূলত তাঁর সাহাবী" [4]। দ্বিতীয়ত অগ্নিময় ব্যবস্থা বা শরিয়তও তিনি প্রদান করেছেন।
নোট: এখানে fiery law বা অগ্নিময় ব্যবস্থা/আইন বলতে ঈশ্বরের ওহী প্রত্যাদেশ বোঝানো হয়েছে যা নবীদের উপর নাযিল হতো। অর্থাৎ অগ্নিময় ব্যবস্থা হলো নবীদের উপর নাযিলকৃত ঈশ্বরের আইন শাস্ত্র।
আদিপুস্তকের ২১ অধ্যায়ে ইশ্মায়েলের অবস্থা বর্ণনায় বলা হয়েছে:
আদিপুস্তক ২১:২০-২১
২০. পরে ঈশ্বর বালকটির সহবর্তী হইলেন, আর সে বড় হইয়া উঠিল, এবং প্রান্তরে থাকিয়া ধনুর্ধর হইল।
২১. সে পারণ প্রান্তরে বসতি করিল (And he dwelt in the wilderness of Paran- فازان).আর তাহার মাতা তাহার বিবাহার্থে মিসর দেশ হইতে এক কন্যা আনিল।
▪︎ নিঃসন্দিগ্ধভাবে ইশ্মায়েলের (ইসমাইল আঃ) অবস্থান মক্কায় ছিল; যদ্বারা জানা যায় যে, পারণ প্রান্তর বলতে মক্কাকেই বোঝানো হয়েছে এবং পারণ, আরবিতে فازان মক্কার একটি পর্বতের নাম যেটাকে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে জাবাল আল নূর। এই জাবাল আল নূরেই হেরা গুহা অবস্থিত।
বাইবেলের দ্বিতীয় বিবরণ ৩৩:২ নং ভার্সের অর্থ এই নয় যে, অগ্নি যখন সীনয়ে প্রকাশ পেয়েছিল, তখনই সেয়ীর ও পারণ পর্বতেও প্রকাশ পেয়েছিল এবং এভাবে এই তিন স্থানে একই সময়ে অগ্নি প্রকাশিত বা প্রসারিত হয়েছিল। কারণ যদি ঈশ্বর অগ্নি সৃষ্টি করেন, তবে বলা হয় না যে "ঈশ্বর তথা হইতে আসিলেন" বরং "ঈশ্বরের আগমন" বা প্রকাশের অর্থ সেখানে ওহী বা প্রত্যাদেশ প্রকাশ পেয়েছে যেটাকে আমরা বলি ওহী নাযিল হয়েছে; অথবা সেখানে কোন শাস্তি অবতীর্ণ হয়েছে অথবা অনুরুপ কোন "ঐশ্বরিক প্রতাপ" প্রকাশিত হয়েছে। ইহুদি- খ্রিস্টানগণ এক বাক্যে স্বীকার করেন যে, সীনয়ে মোশির (মুসা আঃ) উপর ওহী প্রত্যাদেশ এসেছিল। তাহলে সেরীয় ও পারণেও এরুপ কিছু অবশ্যই হতে হবে। কিন্তু তারা দুটোর ব্যাখ্যা এইভাবে দিলেও পারণের ক্ষেত্রে এসে থেমে যায় এবং উল্টো ব্যাখ্যা করে ভিন্ন দিকে নিয়ে যায়। কিন্তু তারা এমনটি করে কেন? আসলে নবী ﷺ কে যেন মানুষ চিনতে না পারে এই জন্য তারা এমনটি করেছে। উল্লেখ্য যে, এই সীনয় পর্বত মিশরে অবস্থিত।
[খ] দ্বিতীয় স্থানে দাউদ আঃ বলেছেন:
পরমগীত ৫:১০,১৬ ROVU
১০. আমার প্রিয়তম শ্বেত ও রক্তবর্ণ; তিনি দশ সহস্রের (ten thousand) মধ্যে অগ্রগণ্য।
১৬. তাঁহার মুখ অতীব মধুর; হাঁ, তিনি সর্বতোভাবে মনোহর। অয়ি যিরূশালেমের কন্যাগণ! এই আমার প্রিয়, এই আমার সখা।
▪︎ এখানেও সুলাইমান আঃ "দশ সহস্রের" মধ্যে অগ্রগণ্য বলেছেন তাঁকে। এখন তিনি কেন "দশ সহস্র/হাজারের" কথা উল্লেখ করেছেন? কারণ একটাই। যেন তাঁকে চেনা সহজ হয়। আর এই তিনি কে যিনি দশ সহস্রের মধ্যে অগ্রগণ্য ব্যক্তি? মূল হিব্রুতে বলা হয়েছে এই তিনি হলেন מַחֲמַדִּ֑ים
যা আরবিতে محمد অর্থাৎ মুহাম্মদ যেটা হলো Masculine Noun বা পুরুষবাচক বিশেষ্য। এটা ইংরেজিতে Proper Noun.
গুগল ট্রান্সলেশন: হিব্রু מַחֲמַדִּ֑ים শব্দের আরবি শব্দ محمد- মুহাম্মদ
আর এই নামের অর্থ- প্রশংসনীয়, Altogether lovely- সর্বতোভাবে মনোহর অর্থাৎ যিনি কথা-বার্তায়, আচার-আচারণে এবং কাজে-কর্মে সব মিলিয়ে উত্তম তথা সুন্দর। আর মুহাম্মদ নামটা এসেছে passive participle of the Arabic verb حَمَّدَ যার অর্থ to praise অর্থাৎ প্রশংসা করে যে বা প্রশংসিত থেকে। উল্লেখ্য যে, "hammada/حَمَّدَ" শব্দটি এসেছে triconsonan al Semitic root থেকে অর্থাৎ আরবি ح-م-د (হা-মিম-দাল) ও হিব্রু ח-מ-ד (gh -H, men -M, dalt-D) এবং ইংরেজি Ḥ-M-D (এইচ-এম-ডি)। আর এসব শব্দের বেশির ভাগই নাম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তবে এই মূল শব্দের মৌলিক অর্থ হলো যেটা আরবিতে ব্যবহার করা হয় সেটা হলো প্রশংসা করা। আরবি আর হিব্রু উভয়েই সেমেটিক ভাষা। কাজেই অনেকটা মিল পাওয়া যায়।
তাহলে পরমগীত ৫:১০,১৬ নং ভার্সে সুলাইমান আঃ দশ সহস্রের (ten thousand) মধ্যে অগ্রগণ্য বলেছেন কাকে? যিনি সর্বতোভাবে মনোহর তাঁকে। অর্থাৎ এইখানে এই ব্যক্তি হলেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ ﷺ, যাঁকে বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে: সর্বতোভাবে মনোহর/তাঁর সবই সুন্দর। আর ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়েছে altogether lovely তার মানে যাঁর সব কিছুই সুন্দর আর আরবিতে মুহাম্মদ, যার অর্থ প্রশংসিত। আর প্রকৃত পক্ষেও নবী মুহাম্মদ ﷺ সকল উত্তম গুণে ভূষিত ছিলেন অর্থাৎ তাঁর সকল কিছুই সুন্দর ছিল, যা আমরা তাঁর সিরাত গ্রন্থগুলো পাঠ করলে জানতে পারি। আবার উল্লেখ্য যে, এই নবী মুহাম্মদ ﷺ ই দশ সহস্র মানুষ নিয়ে মক্কা বিজয় করার পরে সকলকে সাধারণভাবে ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু যীশু বা মুসা আঃ এর জন্য প্রযোজ্য নয়। কারণ মুসা আঃ এসেছিলেন দাউদ আঃ এরও আগে। আবার যীশু জীবিতকালীন অবস্থায় তাঁর দশ সহস্র শিষ্যও ছিল না। কাজেই এখানে নবী মুহাম্মদ ﷺ ই হলেন সেই ব্যক্তি যাঁর সম্পর্কে মুসা আঃ এবং দাউদ আঃ বলেছেন।
বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টের মধ্যে আরো বলা হয়েছে যে:
হবক্কুক ৩:৩ SBCL
৩. ঈশ্বর তৈমন থেকে আসছেন, সেই পবিত্রজন পারণ পাহাড় থেকে আসছেন।[সেলা] তাঁর মহিমা আকাশ ছেয়ে যায়; পৃথিবী তাঁর প্রশংসায় পরিপূর্ণ (Selah. His glory covered the heavens, And the earth was full of his praise)." (এই অধ্যায় সম্পূর্ণ পড়তে পারেন)।
▪︎ এইখানে ঈশ্বরের তৈমন থেকে আসা এবং সেই পবিত্রজন তথা ভাব্বাদীর (নবী) পারণ পাহাড় থেকে আসা বলতে বোঝানো হয়েছে যে, তাঁর উপর আল্লাহ্ ওহী প্রত্যাদেশ করবেন এই পাহাড়ে, যেটা মক্কার নিকটবর্তী স্থানে অবস্থিত। আর আমরা এও জানি যে, বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ ﷺ মক্কার নিকটবর্তী ফারাণ পর্বত যেটাকে পবিত্র কোরআনে জাবাল আল নূর (এখানে প্রথম ওহী নাযিল হয় বিধায় একে নূরের পাহাড় বলা হয়) তথা নূরের পর্বত বলা হয়েছে। এই পর্বতে অবস্থিত হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন থাকাকালীন সময়ে তাঁর কাছে প্রথম ওহী প্রত্যাদেশ হয় আল্লাহর তরফ থেকে। আবার উল্লেখ্য যে, যীশুর সাথে পারণ পর্বতের কোন সংযোগ নেই, তাই মূলত এটা "ইশমায়েলের পর্বত" এবং "পবিত্র একজন" এখানে মূলত মুহাম্মাদ ﷺ হবেন। আবার মুহাম্মদ ﷺ এর প্রশংসা আসমান যমিনে করা হয়েছে এবং পৃথিবীবাসীও যা কিনা আমরা সহীহ হাদিস, সিরাত তাফসীর গ্রন্থগুলো পড়লে জানতে পারি।
নোট: পবিত্র একজন বলতে ঈশ্বরের মনোনীত ভাব্বাদীকে(নবী) বোঝানো হয়েছে যাঁর উপর তিনি ওহী নাযিল করেন। মুহাম্মদ অর্থ প্রশংসিত বা Praised, যিনি পৃথিবীবাসীর কাছে প্রশংসায় পরিপূর্ণ।
আবার এদিকে আপনি যদি মহিমান্বিত গ্রন্থ পবিত্র আল কোরআন পড়েন তাহলে সেখানে দেখবেন যে, মহান আল্লাহ্ সুবাহানাহু ওয়াতা আলা তিন আয়াতের মধ্যে চারটি বিষয়ের শপথ করেছেন। প্রমাণ:
At-Tin 95:1-3
وَٱلتِّينِ وَٱلزَّيْتُونِ
শপথ ‘তীন’ ও যাইতূন’ এর
وَطُورِ سِينِينَ
শপথ ‘সিনাই’ পর্বতের
وَهَٰذَا ٱلْبَلَدِ ٱلْأَمِينِ
এবং শপথ এই নিরাপদ বা শান্তিময় নগরীর।" [অনুবাদক: মুজিবুর রহমান]
▪︎ এখন চিন্তা ভাবনা করেন, এখানে মহান আল্লাহ্ কেন এই চারটি বিষয়ের জন্য নিজে শপথ করলেন? তিনি কি বোঝাতে চান? তিনি চাইলে তো অন্য কিছুর শপথ করতে পারতেন কিন্তু তা করেননি। আসলে এর গুরত্বপূর্ণ তাৎপর্য বোঝানোর জন্য তিনি এসব বিষয়ে নিজে শপথ করে নিয়েছেন আগে। হতে পারে এসব বিষয়ে শপথ করার মাধ্যমে তিনি সত্যান্বেষী আহলে কিতাবীদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চেয়েছেন (ওয়াল্লাহু আলাম)। তো তিনি কয়টি বিষয়ের শপথ করেছেন? তিন আয়াতে মোট চারটি বিষয়ে শপথ করেছেন। সেগুলো হলো:
- ত্বীন ও যায়তুন ফল: এটা হচ্ছে ডুমুর জাতীয় এক ধরনের ফল। আর হিন্দি, মারাঠি, ফার্সি ও উর্দু ভাষায় এই ফলকে আঞ্জির বলা হয় এবং আরবি ভাষায় এর নাম ত্বীন। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে এই ফলটি বেশি উৎপাদন হয়। অপরদিকে যায়তুন হচ্ছে একধরনের ফল যার গুরত্ব তেলের কারণে বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। এটাও একই অঞ্চলে উৎপাদন বেশি।
- সিনাই পর্বত: এটা হলো হযরত মুসা আঃ এর স্মৃতিবিজড়িত একটি পর্বত যেটা মিশরে অবস্থিত। এটাকে ইহুদিরা মুসা আঃ এর পর্বত বা পাহাড় বলে, কারণ এখানে তাঁর সাথে মহান আল্লাহর কথোপকথন হয়েছিল এবং পবিত্র তাওরাত কিতাব নাযিল হয়েছিল। বাইবেলের মধ্যে এটাকে ঈশ্বরের পর্বতও বলা হয়েছে।
- নিরাপদ নগর/মক্কা: এটি বর্তমান সৌদি আরবের হেজাজ প্রদেশের একটি শহর। আর এখানেই বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ ﷺ জন্মগ্রহণ করেন। এর নিকটবর্তী স্থানে অবস্থিত জাবাল আল নূর যেখানে তিনি প্রথম ওহী পান।
এই আয়াতের ব্যাখ্যায়: অধিকাংশ মুফাসসির বলেছেন, "ত্বীন ও যাইতুন" হলো দুটি প্রসিদ্ধ ফল যা মানুষ খায়। আল্লাহ তা‘আলা এ দুটি গাছের শপথ করেছেন কারণ এ দুটি গাছ অন্যান্য গাছের তুলনায় অধিক উপকারী। এ বিষয়ে অনেক চিকিৎসাবিদ আলোচনা রয়েছে।
যহহাক রহঃ বলেছেন: ত্বীন হলো, মসজীদ আল হারাম আর যাইতুন হলো মাসজিদে আকসা।
ইবনু জায়েদ (রহঃ) বলেন: তীন হলো দামেস্কের মাসজিদ আর যাইতুন হলো মাসজিদে আকসা। এছাড়াও অনেক মতামত পাওয়া যায়। (وَطُوْرِ سِيْنِيْنَ) তুরে সিনাই হলো সেই পাহাড় যার ওপর আল্লাহ তা‘আলা মূসা আঃ এর সাথে কথা বলেছেন। (الْبَلَدِ الْأَمِيْنِ) নিরাপদ শহর হলো মক্কা।
আবার কতক আলেম বলেছেন: প্রকৃতপক্ষে এ হচ্ছে তিনটি জায়গা যার প্রত্যেকটিতে আল্লাহ তা‘আলা একজন করে “উলূল আযম” রাসূল প্রেরণ করেছেন। ত্বীন ও যাইতুন দ্বারা বাইতুল মাকদিস এলাকাকে বুঝানো হয়েছে, যেখানে ঈসা আঃ কে প্রেরণ করা হয়েছে। সিনাই পর্বত দ্বারা আল্লাহ তা‘আলার সাথে মুসা আঃ এর যে পর্বতে কথা বলেছেন তা বুঝানো হয়েছে। “নিরাপদ শহর” দ্বারা মক্কাকে বুঝানো হয়েছে যেখানে শেষ নবী মুহাম্মাদ ﷺ কে প্রেরণ করা হয়েছে।" [5]
অত্র আয়াতের তাফসীরে ইবনে কাসীরে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, "তাওরাতের শেষেও এ তিনটি জায়গার নাম উল্লিখিত রয়েছে। তাতে রয়েছে যে, তূরে সীনয় থেকে আল্লাহ তা'আলা এসেছেন অর্থাৎ তিনি হযরত মূসার আঃ সাথে কথা বলেছেন। আর সেয়ীর অর্থাৎ বায়তুল মুকাদ্দাসের পাহাড় থেকে তিনি নুর চমকিত করেছেন অর্থাৎ হযরত ঈসা আঃ কে সেখানে প্রেরণ করেছেন এবং ফারানের শীর্ষে তিনি উন্নীত হয়েছেন অর্থাৎ মক্কার পাহাড় থেকে হযরত মুহাম্মদ ﷺ কে প্রেরণ করেছেন। অতঃপর এই তিনজন বিশিষ্ট নবীর ভাষা এবং সত্তা সম্পর্কে পর্যায়ক্রমেই উল্লেখ করা হয়েছে।" আর আমরা এই কথাগুলোই কিন্তু বাইবেলের দ্বিতীয় বিবরণ ৩৩:২ এ পেয়েছি যার প্রমাণ উপরে দেওয়া হয়েছে। হতে পারে মহান রব এইভাবে কথা বলার মাধ্যমে কৌশলে জানিয়ে দিলেন যে, মুহাম্মদ ﷺ এর সম্পর্কেও তিনি পূর্ববর্তী কিতাবের মধ্যে জানিয়ে দিয়েছিলেন। অন্যথায় তিনি কেন এসবের নাম ধরে ধরে বলতে যাবেন? তিনি মূলত এসব বলার মাধ্যমে ঐ জায়গা সম্পর্কে ফোকাস করেছেন। আর ঐসব জায়গায় নবী আগমনের ভবিষ্যদ্বাণীই জানানো হয়েছিল পূর্ববর্তী কিতাবের মাধ্যমে। আর এই বিষয়টাই আমরা বাইবেলের মধ্যে মিল পাই।
আর স্যামুয়েল আল মাগরিবী যিনি একজন ইহুদি গণিতজ্ঞ এবং পন্ডিত ছিলেন। তিনি দ্বিতীয় বিবরণ ৩৩:২ নং উদ্ধৃতি নিজের বইয়ে উপস্থাপন করে এটি মুহাম্মদ ﷺ এর নবীত্ব বিষয়ক ভবিষ্যদ্বাণী বলে উল্লেখ করেছেন, যিনি পরবর্তীকে ইসলাম গ্রহণ করেন।" [6]
কিছু মুসলিম পন্ডিত আবার দ্বিতীয় বিবরণ ৩৩:২ এর সাথে পবিত্র কোরআনের ৯৫:১-৩ এর মিল খুঁজে পান। যেখানে "ডূমুর ও জলপাই" দ্বারা যীশু/ঈসা আঃ, "সিনাই পর্বত" দ্বারা মূসা আঃ এবং "মক্কা" দ্বারা মুহাম্মদকে বোঝানো হয়েছে।" [7]
আর "he came with ten thousands of saints বা....দশ হাজার পবিত্র ব্যক্তি" দ্বারা মুহাম্মদ ﷺ এর দশ হাজার সঙ্গীর কথা বলা হয়েছে। কারণ তিনি মক্কা বিজয়ের জন্য দশ হাজার সঙ্গীর সাথে এসেছিলেন।" [8]
আর এইভাবে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ ﷺ এর সম্পর্কে পূর্ববর্তী কিতাবের মধ্যে সুস্পষ্ট গুণ-বৈশিষ্ট্যের বর্ণনাবলি ব্যক্ত করা হয়েছে যার অনেক প্রমাণ বর্তমান বাইবেলের মধ্যেও পাওয়া যায়। এছাড়া খ্রিস্টান মিশনারিরা তাঁর গুণ-বৈশিষ্ট্যের কথা মুছে দেওয়ার জন্য তাদের কিতাবের মধ্যে হস্তক্ষেপ করেছে যেন সহজ সরল সত্যান্বেষী কিছু খ্রিস্টানগণ মহানবী হযরত মুহাম্মদ ﷺ কে চিনতে না পারে। কিন্তু মহামহিমান্বিত আল্লাহ্ সত্যকে লুকিয়ে রাখতে দেননি বলেই তা কোরআনের মাধ্যমে সারা বিশ্বের সামনে প্রকাশ করে দিয়েছেন। এরপরেও তারা মহানবী হযরত মুহাম্মদ ﷺ কে অস্বীকার করে। আর এসব অস্বীকারকারী ব্যক্তিদের উদ্দেশ্য মহান আল্লাহ্ বলেছেন:
As-Saf 61:8
يُرِيدُونَ لِيُطْفِـُٔوا۟ نُورَ ٱللَّهِ بِأَفْوَٰهِهِمْ وَٱللَّهُ مُتِمُّ نُورِهِۦ وَلَوْ كَرِهَ ٱلْكَٰفِرُونَ
Bengali - Mujibur Rahman
তারা আল্লাহর নূর ফুৎকারে নিভিয়ে দিতে চায়, কিন্তু আল্লাহ তাঁর নূর পূর্ণরূপে উদ্ভাসিত করবেন, যদিও কাফিরেরা তা অপছন্দ করে।
▪︎ তারা অর্থাৎ সত্য অস্বীকারকারী অবিশ্বাসীরা আল্লাহর নূর তথা আলো বা সত্যকে নিভিয়ে দিতে চায়। কিভাবে? بِأَفْوَٰهِهِمْ বা with their mouths- তাদের মুখের ফুৎকারের মাধ্যমে। এখন "মুখের ফুৎকার কী?" মিথ্যা, অপপ্রচার। ইসলাম, মুসলিম ও মুসলমানদের নবী সম্পর্কে অপপ্রচার, অপবাদ, মিথ্যা প্রচার ও প্রপ্যাগন্ডা চালানো। কিভাবে? তাদের পৃথিবী জোড়া শক্তিশালী প্রচার মাধ্যমগুলোকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে; পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে, রেডিও-টেলিভিশনের সাহায্যে, বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে তারা তাদের মিথ্যা প্রচার করে মানুষদের নিকটে পৌঁছে দেয়। মুসলিমদের ধ্বংস করতে চায়। কিন্তু আল্লাহ্ প্রতিজ্ঞা করেছেন,"তিনি তাঁর আলোকে পূর্ণরুপে বিকশিত করবেন।"
ইহুদি- খ্রিস্টানরা 9/11 (নাইন ইলেভেন) এ টুইন টাওয়ার ধ্বংস করে ইসলামের ক্ষতি করতে চেয়েছিল, কিন্তু পারেনি। ইসলামেরই লাভ হয়েছে। আগের বছর পাশ্চাত্য জগতে ষাট হাজার অমুসলিম ইসলাম কবুল করেছিল; টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পরের বছর এক লক্ষ ষোল হাজার লোক ইসলাম কবুল করল। বাবরি মসজিদ শহিদ করার ক্ষেত্রে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিল বলবীর সিং ও যোগীন্দর ছিল তাদের মধ্যে অন্যতম। এক অলৌকিক কারণে তারাও ইসলাম কবুল করল; তাদের বর্তমান নাম উমার ও আমের। তারা তাদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ মসজিদ নির্মাণ করার প্রতিজ্ঞা করলেন। এ যাবৎ বিশটিরও বেশি মসজিদ নির্মাণ করেছেন। আমরণ করতেই থাকবেন। শুধু কি তাই? তাদের হাতে অনেকেই ইসলাম কবুল করে ধন্য হয়েছে। পৃথিবীতে প্রতি চব্বিশ ঘণ্টায় গড়ে শত শত লোক স্বেচ্ছায় ইসলাম কবুল করে ধন্য হচ্ছে। এভাবে ইসলাম প্রত্যেক কাঁচা পাকা ঘরে পৌঁছে যাবে। প্রিয় রাসূল ﷺ বলেছেন: ভূপৃষ্ঠে এমন কোন স্থান থাকবে না যেখানে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছবে না" [9]। অর্থাৎ কিয়ামতের পূর্বে প্রত্যেক কাঁচা-পাকা ঘরে ইসলাম পৌঁছে যাবে। মহান আল্লাহ্ সুবাহানাহু ওয়াতা'আলার আরো এরশাদ করেছেন যে:
Al-Ma'idah 5:66
وَلَوْ أَنَّهُمْ أَقَامُوا۟ ٱلتَّوْرَىٰةَ وَٱلْإِنجِيلَ وَمَآ أُنزِلَ إِلَيْهِم مِّن رَّبِّهِمْ لَأَكَلُوا۟ مِن فَوْقِهِمْ وَمِن تَحْتِ أَرْجُلِهِمۚ مِّنْهُمْ أُمَّةٌ مُّقْتَصِدَةٌۖ وَكَثِيرٌ مِّنْهُمْ سَآءَ مَا يَعْمَلُونَBengali - Mujibur Rahman
আর যদি তারা তাওরাত ও ইঞ্জিলের এবং যে কিতাব (অর্থাৎ কুরআন) তাদের রবের পক্ষ হতে তাদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে, ওর থেকে যথারীতি ‘আমলকারী হত তাহলে তারা উপর (অর্থাৎ আকাশ) হতে এবং নিম্ন (অর্থাৎ যমীন) হতে প্রাচুর্যের সাথে আহার পেত; তাদের এক দলতো সরল পথের অনুগামী; আর তাদের অধিকাংশই এরূপ যে, তাদের কার্যকলাপ অতি জঘন্য।
▪︎ ইয়াহুদি-খ্রিস্টানদের মধ্যে সকলেই অন্ধবিশ্বাসী নয়। তাদের মধ্যে অনেকেই ভালো আছেন অর্থাৎ প্রকৃত সত্যান্বেষী ব্যক্তি। আসলে সহজ-সরল, নিরপেক্ষ ও অকপট ইয়াহুদি-খ্রিস্টানরা বাইবেল বেছে বেছে ঈসা আঃ এবং মুসা আঃ এর দেওয়া শিক্ষা অনুসরণ করায় আগ্রহী। তারা তাদের ধর্মগ্রন্থে নতুন আমদানিকৃত ত্রিত্ববাদ, যীশুর ঈশ্বরত্ব, পাপের প্রায়শ্চিত্ত, খাৎনা না করানো ইত্যাদি মানতে চায় না। যিনা করা, মদ পান করা ইত্যাদি অসৎ কর্ম অপছন্দ করে। সৌভাগ্যবশত: বাইবেলে শেষ নবীর আবির্ভাবের শুভ সংবাদ যখন তারা অবগত হয়, তখন অবিলম্বে তারা তাঁর উপর ইমান আনে এব তাঁর যথাযথ অনুসরণ করে। আর কোরআন ৫:৬৬ নং আয়াতে এসব ব্যক্তিদের "সরল পথের পথিক" বলেছে। ইসলামের প্রাথমিক যুগে আবিসিনিয়ার সম্রাট নাজ্জাশী এবং মদিনার অধিবাসী আব্দুল্লাহ্ ইবনে সালাম রাঃ এর কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পূর্বে নাজ্জাশী ছিলেন একজন খ্রিস্টান আর আব্দুল্লাহ্ ইবনে সালাম রাঃ ছিলেন ইহুদি আলেম। সরল, নিরপেক্ষ ও অকপট ইয়হুদি-খ্রিস্টানদের মধ্যে থেকে পরবর্তী যুগে বাদশাহ নাজ্জাশী ও আব্দুল্লাহ্ ইবনে সালাম রাঃ এর পদাংক অনুসরণকারীদের অভাব নেই। উল্লিখিত আয়াতে অমুসলিমদের যে দলটি "সরল পথের পথিক" হতে আগ্রহী, ন্যায়-পরায়ণ ও নিরপেক্ষ তাদের সমীপেই আমি আমার এ লেখাটি পেশ করছি। আমি আমার অমুসলিম প্রতিবেশীদের কাছে নবীদের সঠিক বার্তা পৌঁছে দিতে চাই। এটা আমাদের উপর আল্লাহ্ কতৃক অর্পিত দায়িত্ব। আমি তাদের সাথে অপ্রয়োজনীয় বাক-বিতণ্ডা করে গোলমাল বাধাতে চাই না অথবা তিক্ততা বা উত্তেজনার উদ্রেক করাও আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি শুধু তাদেরকে সত্যের অনুসন্ধান করা, শান্তি ও মুক্তি পাওয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রীতিকর ও বন্ধুত্বপূর্ণ অনুসন্ধান করার আমন্ত্রণ জানাই। আপনারা নিরপেক্ষ ভাবে অনুসন্ধান করে দেখুন, ঈসা আঃ যাঁর ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন, তিনি কি পাক-রুহ নাকি নবী মুহাম্মদ ﷺ?
-- কৃতজ্ঞতায়: শেখ মুহাম্মদ আব্দুল হাই এবং আল্লামা কীরানবি রহঃ
তথ্যসূত্রঃ-
➤[০১] তাফসীরে ফাতহুল মাজীদের ২:১৪৬ নং আয়াত দ্রষ্টব্য। এছাড়া আরো পড়তে পারেন তাফসীরে ইবনে কাসীর।
➤[০২] তাফসীরে আবু বকর জাকারিয়া দ্রষ্টব্য ৭:১৫৭। এছাড়া আরো দেখতে পারেন তাফসীরে ফাতহুল মাজীদ, তাফসীরে ইবনে কাসীর।
➤[০৩] নতুন বৃট্যানিকা বিশ্বকোষ, ১৫ ই সংকলন, মুহাম্মদ প্রসঙ্গে দেখা যেতে পারে।
➤[০৪] সিরাতুন নবী ৩য় খন্ড- পঞ্চদশ অধ্যায়, মক্কা বিজয়; লেখক: ড.আলী মুহাম্মদ আস সাল্লাবী (লিবিয়া)
➤[০৫] ৯৫:১-৩ এর তাফসীরে ফাতহুল মাজীদ দ্রষ্টব্য। এছাড়া আরো পড়তে পারেন তাফসীরে ইবনে কাসীর।
➤[০৬] Samawal al Maghribi, Confuting the Jews (in Arabic) (1st 1989 ed.). Syria: Dar Al Qalam. p 67.
➤[০৭] Kais Al-Kalby, 2005, p 223.
➤[০৮] যে কোন সীরাত গ্রন্থের "মক্কা বিজয়" এর ইতিহাস পড়ুন
➤[০৯] মুসনাদে আহমাদ হা: ২৩৩৬৫