Are you sure?

ইতিহাস »  সিরাত

কেমন দেখতে ছিলেন আমাদের প্রিয় রাসূল ﷺ ?

কেমন দেখতে ছিলেন আমাদের প্রিয় রাসূল ﷺ ? কেমন ছিল তাঁর পবিত্র চেহারা মোবারক? তাঁর হাঁটা চলা, কথা বলার ভাব-ভঙ্গি, চুলের গেটাপ, পোশাক-আশাক ইত্যাদি কেমন ছিল? আসলে আমরা মুসলিমরা তাঁর উম্মত হিসেবে এসব জানতে আগ্রহী কিন্তু আমরা তা জানি না। কিন্তু জানার মাধ্যম কী? সহীহ হাদিস; যা মূলত সাহাবীগণের থেকে বর্ণিত প্রিয় রাসূল ﷺ এর জীবন বৃত্তান্তের বিবরণ। যাঁরাই তাঁকে খুব কাছে থেকে দেখেছেন, তাঁরাই নবী ﷺ এর সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন।

তিনি দেখতে আসলে কেমন ছিলেন? সহীহ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, তিনি দেখতে ছিলেন হযরত ইব্রাহিম আঃ এর মতো। অর্থাৎ নবীজি ﷺ কে দেখা মানেই ঠিক ইব্রাহিম আঃ কে দেখা। আবার উল্লেখ্য যে, এই দুই জনকেই মহান আল্লাহ্ বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তো ইব্রাহিম আঃ কে উপাধি দেওয়া হয়েছিল খলিল অপরদিকে মুহাম্মদ ﷺ এর উপাধি হাবিব; উভয়ের অর্থ-ই এক- বন্ধু।
শরীরের বিবরণ ও উচ্চতা:
তিনি দৈহিক উচ্চতায় খুব দীর্ঘ ছিলেন না আবার খাটোও ছিলেন না অর্থাৎ মধ্যমাকৃতি অপেক্ষা সামান্য লম্বা ছিলেন। তাঁর শারীরিক গঠন ছিল আকর্ষণীয় এবং শক্তিশালী দেখতে। তিনি ছিলেন শুভ্রকায় ও লাবণ্যময় সুসামঞ্জস্যপূর্ণ এক সুদর্শন যুবক। তাঁকে যেই দেখত তার-ই কাছে ভাল লাগত। অনেক সাহাবীগণের থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তাঁরা রাসূল ﷺ এর মতো সুদর্শন হ্যান্ডসাম ব্যক্তি আর কাউকেই দেখেননি।
মস্তক:
আলী ইবনে আবু তালেব রাঃ থেকে বলা হয়েছে যে, রাসূল ﷺ এর পবিত্র মস্তক ছিল কিছুটা বড়। যারাই তাঁকে একবার দেখেছে দূর হতেই তাঁকে চিনতে পারত। আমর বিন হুরায়স রাঃ থেকে বর্ণিত," আমি রাসূল ﷺ কে তাঁর মাথায় কালো পাগড়ি পরিহিত অবস্থায় দেখেছি এবং তিনি তাঁর পাগড়ির উভয় প্রান্ত তাঁর দু’কাঁধের উপর ঝুলিয়ে দিতেন। তিনি সবসময়ই পাগড়ি দ্বারা মাথা ঢেকে রাখতেন।
চুলের বর্ণনা:
রাসূল ﷺ সবসময়ই তাঁর শরীরের যত্ন নিতেন যার মধ্যে চুল ছিল অন্যতম। তিনি চিরুণী দিয়ে চুল ঠিকঠাক করতেন। আম্মাজান আয়েশা রাঃ তাঁর মাথায় চিরুণী করে দিতেন। তাহলে দুনিয়ার এই সর্বশ্রেষ্ঠ সুদর্শন মানুষের হেয়ার স্টাইল কেমন ছিল? হাদিসে বর্ণিত হয়েছে যে, তাঁর পবিত্র চুলগুলো ছিল ঘন যা কোকড়ানোও ছিল না আবার একেবারে সোজাও ছিল না। এখন তাঁর চুল কত বড় বা ছোট ছিল? এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, তাঁর চুলগুলো কখনো কখনো কানের লতি পর্যন্ত লম্বা, আবার কখনো কখনো কাঁধ পর্যন্ত ছুঁয়ে যেত; এমনকি অনেক সময় তাঁর চুল কাঁধ ছাড়িয়ে আরো লম্বা হত বলে জানা যায়, যার জন্য তাঁকে চুলগুলো গুচ্ছ করে রাখতে দেখা গেছে। এখন তিনি কি কখনো মাথা মুন্ডন করেছেন? আসলে হজ্জ ওমরার সময় ব্যতীত তাঁকে চুল মুন্ডানো দেখা যায়নি।
তো তিনি কোনদিকে চুল সিঁথি করতেন? প্রথমদিকে তিনি তাঁর চুলগুলো কপালের সামনে ঝুলিয়ে রাখতেন কেননা আহলে কিতাবীরাও এমন রাখত। তিনি সুস্পষ্ট ওহী না পাওয়া পর্যন্ত আহলে কিতাবীদের নিয়মগুলো অনুসরণ করতে পছন্দ করতেন। এছাড়া রাসূল ﷺ আবার অনেক সময় চুলগুলো আঁচড়িয়ে সিঁথি না কেটে সোজা পিছনে দিতেন। আবার আম্মাজান আয়েশা রাঃ থেকে বলা হয়েছে যে, আমি রাসূল ﷺ এর মাথার চুলে সিঁথি করতে চাইলে মাথার মাঝ বরাবর দু’ভাগ করে সিঁথি করতাম এবং তাঁর দু’চোখের মাঝখান হতে সোজা কপালের দু’দিকে চুল ছেড়ে দিতাম। তিনি মাথার চুলের সিঁথিতে সুগন্ধি ব্যবহার করতেন; যার জন্য তিনি যেখানে সিজদা দিতেন সেখানেই সেই ঘ্রাণ লেগে থাকত।
রাসূল ﷺ প্রতিনিয়ত ঘন ঘন চুল আচঁড়াতেন না। তিনি এটা নিষেধ করেছেন। সাহাবীগণ রাসূল ﷺ কে তীক্ষ্ম দৃষ্টি দিয়ে দেখতেন, তাঁকে ফলো করতেন। তাঁদের থেকে পাওয়া যায় যে, তিনি ষাটোর্ধ্ব হয়েও তাঁর মাথায় সাদা চুলের সংখ্যা ছিল ১৭ থেকে ২০ টার মত। তিনি যখন মাথায় তেল ব্যবহার করতেন অনেক সময় এসব সাদা চুলগুলো না দেখার মতোই ছিল। তাঁর চুল সাদা হওয়ার সম্পর্কে একজন সাহাবী প্রশ্ন করেছিলেন যিনি ছিলেন আবু বকর সিদ্দিক রাঃ তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনার চুল তো সাদা হয়ে গিয়েছে। আপনি বার্ধক্যে পৌছে গেছেন। রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, সূরা হূদ, ওয়াকিয়া, মুরসালাত, আম্মা ইয়াতাসা-আলূন, ইযাশ-শামসু কুভভিরাত আমাকে বৃদ্ধ বানিয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ তাঁর এসব চুল সাদা হওয়ার পেছনে এসব সূরার প্রভাব পড়েছিল চিন্তার জন্য। কারণ এতে কিয়ামতের ভয়াবহতা, জাহান্নাম ইত্যাদি ভীতি প্রদর্শন বিষয়ক আলোচনা করা হয়েছে। আর তিনি এসব নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার ফলে তাঁর পবিত্র চুলগুলোও পর্যন্ত সাদা হয়ে গেছে।

তো বর্তমান সমাজে অনেকের-ই দেখা যায়, বয়স হবার আগেই চুল সাদা হয়ে যায় যেটা অনেকের কাছে লজ্জার বিষয়। তো তারা এটা ঢাকতে তাদের চুলে কালো কলপ করে। আর নবী ﷺ এটা নিষেধ করেছেন। তবে তারা চাইলে মেহেদী পাতা নিতে পারে। আর পাকা চুল আল্লাহর বিশেষ নিয়ামত। কাজেই এটাকে ঢাকতে কালো কলপ ব্যবহার করা জায়েজ নেই বরং এটা নিষেধ করেছেন নবী ﷺ।
কপাল:
নবী ﷺ এর কপাল ছিল শুভ্র, প্রশস্ত এবং সুন্দর।
মুখ:
নবী ﷺ এর প্রফুল্ল মুখ ছিল প্রশস্ত এবং অতি সুন্দর। তো আমরা এই সুন্দর মুখ দিয়ে কত কিছুই করি। মানুষের সাথে ভাল মন্দ কথা বলি; রেগে গেলে গালাগালিও করি। কিন্তু নবী ﷺ কি এরুপ করতেন নাকি কারো প্রতি অসন্তুষ্ট হলে? অবশ্যই না। তাহলে তিনি কি করতেন? আসলে তিনি কারো প্রতি অসন্তুষ্ট হলে তাঁর দিক হতে মুখ ফিরিয়ে নিতেন এবং অমনোযোগী হতেন। এছাড়াও তিনি অধিকাংশ সময় নীরব থাকতেন। বিনা প্রয়োজনে কথা বলতেন না। আর যা বলতেন তা হতো ব্যাপক অর্থবোধক।
গাল:
তাঁর গাল ভর্তি পবিত্র দাঁড়ি ছিল ঘন এবং দেখতে সুন্দর, যা বুক পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। ষাটোর্ধ্ব বয়সে তাঁর দাঁড়ির সামনের কিছু অংশ সাদা হয়ে গিয়েছিল। তিনি দাড়িতে খিযাব লাগাতেন। এছাড়া তিনি সর্বদাই হাস্যজ্জল চেহারার অধিকারী ছিলেন।
চোখ:
রাসূল ﷺ এর চোখ দুটো দেখতে ছিল সুন্দর এবং আকর্ষণীয়, তাঁর মণি খুব কালো ছিল অর্থাৎ ডাগর চক্ষুবিশিষ্ট। চোখের পাতা ছিল বড় এবং সর্বদা সুরমা লাগানোর মতো দেখাত; তাঁর দুচোখের শুভ্রতার মাঝে কিছুটা লালিমা ছিল। এছাড়া তাঁর দৃষ্টি শক্তি ছিল অত্যন্ত প্রখর। তিনি যার সাথে কথা বলতেন, তার দিকে সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে তার দিকে ঝুঁকে থাকতেন এবং তাকে দেখতেন। তার কথা শেষ না হওয়া পর্যন্ত নবী ﷺ কথাও বলতেন না। আবার উল্লেখ্য যে, হাদিসের মধ্যে এসেছে যে, তিনি অনেক সময় তাঁর পেছনেও দেখতে পেতেন। মূলত এটি ছিল তাঁর মুজিজা। রাসূল ﷺ কি চোখে কিছু ব্যবহার করতেন? হ্যাঁ! অবশ্যই, তিনি চোখে ইছমিদ সুরমা ব্যবহার করতেন এবং সাহাবীগণকেও ব্যবহার করতে বলতেন। প্রত্যেক রাতে ঘুমানোর পূর্বে তিনি দু'চোখে তিনবার তিনবার করে মোট ছয়বার সুরমা লাগাতেন। এটার উপকারীতাও অনেক। তাঁর আইভ্রু ছিল ঘন। যখন তিনি আনন্দ-উৎফুল্ল হতেন তখন তাঁর চোখের কিনারা নিম্নমুখী করতেন।
কান:
তাঁর শ্রবণশক্তি ছিল অত্যাধিক। তিনি অতি দূরের শব্দও শুনতে পেতেন।
নাক:
রাসূল ﷺ এর নাক ছিল অতীব সুন্দর ও উন্নত।
মুখগহ্বর:
তিনি বড় মুখ গহ্বরবিশিষ্ট ছিলেন।
দাঁত:
অতীব সুন্দর রজতশুভ্র দাঁত ছিল রাসূল ﷺ এর। দাঁতের মাঝে সামান্য একটু ফাঁকা ছিল। তিনি প্রায়ই সালাতে যাওয়ার আগে মিসওয়াক ব্যবহার করতেন। তো তিনি কিভাবে হাঁসতেন? তিনি প্রায়ই মুচকি হাঁসি দিতেন, কখনোই অট্টোহাসি দেননি। জারীর ইবনে আবদুল্লাহ রাঃ বলেন, "আমার ইসলাম গ্রহণের পর হতে রাসূল ﷺ আমাকে দেখা মাত্রই হাসতেন। তখন তাঁর দাঁতগুলো বরফের ন্যায় উজ্জ্বল সাদারূপে শোভা পেত।" তখন তাঁকে আরো আকর্ষণীয় লাগত। অনেক সাহাবীগণ তাঁর মুচকি হাসির দিকে তাকিয়ে থাকত। না জানি তাদের মনে তখন কত ভাল লাগত। কাউকে দেখে মুচকি হাসি দেওয়া সুন্নত। এর মাধ্যমে পরস্পরের মধ্যে ভালবাসার বন্ধন গভীর হয়।
কন্ঠ বা কথার ধরণ:
প্রিয় রাসূল ﷺ এর কথা-বার্তা বলার ধরণ কেমন ছিল? তিনি কিভাবে কথা বলতেন? তিনি মূলত তৎকালীন যুগে বিশুদ্ধ আরবিতে কথা বলতেন, তাঁর উচ্চারণ, শব্দ প্রয়োগ ও বাচনভঙ্গি সবই ছিল বিশুদ্ধতার মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ; তাঁর কথা বলার যে স্টাইল, যে গেটাপ, তা ছিল অত্যন্ত চমৎকার এবং সুস্পষ্ট, বাগ্মিতাপূর্ণ, শ্রুতিমধুর যা সকলের কাছেই বোধগম্য হতো। তাঁর কথা ছিল একটি থেকে অপরটি পৃথক। তাঁর কথা-বার্তা অধিক বিস্তারিত ছিল না কিংবা অতি সংক্ষিপ্তও ছিল না। অর্থাৎ তাঁর কথার মর্মার্থ অনুধাবনে কোন প্রকার অসুবিধা হতো না। তাঁর কথায় কঠোরতার ছাপ ছিল না, থাকত না তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের ভাব। আর তাঁর এইভাবে কথা বলার দরুন সবাই তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হতো; আর এটাকেই মক্কার তৎকালীন কাফের মুশরিকরা যাদু হিসেবে আখ্যায়িত করে বলত যে, মুহাম্মদ তাদেরকে যাদু করেছে, যার জন্য তারা তাঁর কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনে। আবার উল্লেখ্য যে, তিনি যার সঙ্গে কথা বলতেন, তাঁর প্রতি পূর্ণ লক্ষ্য রেখেই প্রয়োজনীয় শব্দগুলো উচ্চারণ করতেন, তিনি ধীরে ধীরে কথা বলতেন যেন কারো বুঝতে অসুবিধা না হয়, গুরত্বপূর্ণ কথাগুলো তিনি পরপর অর্থাৎ তিনবার করে বলতেন ব্যক্তির মনোযোগ আকর্ষণের জন্য এবং শ্রোতারা হৃদয়ঙ্গম করতে পারে এই জন্য। সাহাবীগণের থেকে আরো বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি সবসময়ই নরম সুরে কথা বলতেন, কারো সাথে রাগান্বিত সুরে কথা বলতেন না, কথা বলার সময় প্রয়োজনীয় শব্দাবলি ছাড়া অতিরিক্ত বলতেন না। আর রাসূল ﷺ এর এমন বৈশিষ্ট্য মানুষকে বরাবরই আকর্ষণ করত। ফলে যারাই তাঁর সংস্পর্শে আসত তারাই তাঁর কথার প্রেমে পড়ে যেত। ফলে ইসলাম গ্রহণ করত। আর এসব দেখেই মক্কার মুশরিক এবং কাফেররা তাঁর সঙ্গে বাইরের লোকদের যোগাযোগ বন্ধ করতে ব্যর্থ চেষ্টা করেছিল; কিন্তু তা না পেরে অবশেষে প্রিয় রাসূল ﷺ কে কবি, যাদুকর ইত্যাদি বলে আখ্যায়িত করত। আর তাঁর এমন গুণ- বৈশিষ্ট্যের জন্য মহান আল্লাহ্ বলেছেন, "আপনি যদি কঠোর হৃদয়ের হতেন, তবে মানুষ আপনার থেকে দূরে চলে যেত।"
কাঁধের বর্ণনা:
রাসূল ﷺ এর দু'কাঁধের মধ্যবর্তী স্থান অন্যান্যদের অপেক্ষা প্রশস্ত ছিল। উল্লেখ্য যে, তাঁর পবিত্র কাঁধের মাঝখানে একগুচ্ছ কেশ তথা চুল ছিল। আর এখানের মাংসপিন্ড ছিল হালকা হাল রঙের। আর এটিই ছিল মোহরে নবুয়্যত যেটা সম্পর্কে পূর্ববর্তী কিতাবের মধ্যেও বর্ণিত ছিল। আর সালমান ফার্সি নামক এক খ্রিস্টান এই নিদর্শন দেখে তাঁর উপর ইমান আনেন।
হাত:
রাসূল ﷺ এর হাত কেমন ছিল? তাঁর হাত নরম, প্রশস্ত তালু আর মাংসল ছিল। যে কেউই তাঁর সাথে মোসাফাহা (করমর্দন) করত, তারাই আরাম অনুভব করত। এছাড়াও সাহাবীগণের থেকে আরো বর্ণিত হয়েছে যে, তাঁর হাতের পেশিগুলো দেখে শক্তপোক্ত মনে হলেও সেগুলো ছিল অত্যন্ত নরম। আনাস রাঃ থেকে বর্ণিত হয়েছে যেখানে তিনি বলেছেন,"আমি নরম কাপড় বা রেশমকেও তাঁর হাতের তালুর মতো নরম পাইনি। আবার তাঁর কিছু অভ্যাস ছিল। তিনি কোন বিষয়ের প্রতি ইশারা করলে সম্পূর্ণ হাত দ্বারা ইশারা করতেন। তিনি কোন বিস্ময় প্রকাশ করলে হাত উল্টাতেন। যখন কথাবার্তা বলতেন তখন ডান হাতের তালুতে বাম হাতের আঙ্গুলের অভ্যন্তরীণ ভাগ দ্বারা আঘাত করতেন।
পা:
হাতের মতো তাঁর পাও ছিল সুন্দর। তাঁর মাথা থেকে পা পর্যন্ত পুরো দেহই যেমনটা মানানসই হওয়া প্রয়োজন, ঠিক তেমনই ছিল। তাঁর পায়ের তালু ও আঙ্গুল সমূহ মাংসল ছিল। তো কিভাবে তিনি হাঁটতেন? এ সম্পর্কেও বলা হয়েছে যে, তিনি সামনের দিকে ঝুঁকে হাঁটতেন, যেন তিনি উচ্চ স্থান থেকে নিচে আবতরণ করছেন। তিনি কারো দিকে দৃষ্টি দিলে পূর্ণরুপে তার দিকে ঘুরে দাঁড়াতেন।
বক্ষ:
রাসূল ﷺ এর বক্ষ ছিল কিছুটা উঁচু ও বীর বাহাদুরের মতো প্রশস্ত। বক্ষস্থল থেকে নাভি পর্যন্ত চুলের সরু একটা রেখা ছিল।
ঘাম:
রাসূল ﷺ এর পবিত্র দেহ থেকে যে ঘাম ঝরত এর সুগন্ধ ছিল এতটাই যে, সাহাবীগণের অনেকেই তা সংরক্ষণ করতেন। আনাস রাঃ থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেন, রাসূল ﷺ আমাদের গৃহে আসলেন এবং আরাম করলেন। তিনি ঘর্মাক্ত হলেন, আর আমার মা একটি ছোট বোতল নিয়ে মুছে তাতে ভরতে লাগলেন। রাসূল ﷺ জাগ্রত হলেন। তিনি প্রশ্ন করলেন, হে উম্মু সুলায়ম! একি করছ? আমার মা বললেন, এ হচ্ছে আপনার ঘাম, যা আমরা সুগন্ধির সাথে মেশাই, আর এ তো সব সুগন্ধির সেরা সুগন্ধি। তিনি হেসে দিলেন। বলেছিলেন, ভাল করেছ। আরেকজন সাহাবী থেকে বর্ণিত যিনি বলেছেন,"আমি মৃগনাভির গন্ধও গ্রহণ করেছি এবং আতরের গন্ধও গ্রহণ করেছি কিন্তু রাসূল ﷺ-এর শরীরের ঘামের চেয়ে অধিক সুগন্ধ কোন কিছুতেই পাইনি।

তাঁর মেজাজ কেমন ছিল?
এক কথায় রাসূল ﷺ এর মেজাজ ছিল মানুষের মধ্যে সর্বোত্তম। আমরা মানুষ সাধারণত অনেক সময়ই রেগে যাই। রেগে গেলে মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। আর মানুষ হিসেবে তিনিও এর ঊর্ধ্বে থাকার কথা নয়। এরপরেও তিনি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন। আর এটাই ছিল তাঁর সর্বোত্তম একটা গুণ। তিনি কখনো কারো প্রতি ব্যক্তিগত রাগ দেখাননি বা রাগান্বিত স্বরে কথাও বলেননি। বরং তাঁর যারা চরম শত্রু ছিল এরাও এক বাক্যে স্বীকার করত, মুহাম্মদ কখনোই মেজাজ হারিয়ে ফেলে না, আবার তিনি যেটাই বলেন ওটাই করেন যদিও শত বাঁধা তাঁর সামনে উপস্থিত হোক। আনাস রা. বলেন, “আমি দশ বছর রাসূল ﷺ এর খিদমত করেছি, আল্লাহর কসম! তিনি কখনও আমাকে ‘উহ্’ শব্দও বলেননি এবং কখনও কোনো বিষয়ে আমাকে বলেননি, "তুমি কেন এটা করলে? কেন ওটা করলে না?”

আবার তিনি কখনোই কারো দোষ-ত্রুটি খুঁজতেন না, পার্থিব কোন বিষয় বা কাজের উপর ক্রোধ প্রকাশ করতেন না এবং তাঁর জন্য আক্ষেপও করতেন না। এক কথায় এই লোকটির জীবনী তথা সিরাত না পড়লে আপনি ভাল করে অনুধাবন করতে পারবেন না যে, আসলেই তিনি কতটাই মহান ছিলেন। কয়েক লাইনের বাক্যে এ তুলে ধরা সম্ভব নয়। মহান আল্লাহ তাঁর সম্পর্কে ঘোষণা করেছেন, "নিশ্চয়ই তুমি মহান চরিত্রের অধিকারী।" আর তিনি এতটাই মহান চরিত্রের অধিকারী যে, আল্লাহ্ অবশেষে তাঁকে অনুসরণীয় হিসেবে, আইডল হিসেবে ঘোষণা করেছেন সমগ্র মানবজাতির জন্য।

পোশাক-আশাক:
প্রিয় রাসূল ﷺ বিভিন্ন সময়ে নানা রকমের পোশাক পরিধান করতেন। তিনি আস্তিন বিশিষ্ট একটি রুমি জুব্বা পরিধান করেছিলেন। আনাস রাঃ বলেন, তাঁর সর্বাধিক প্রিয় ছিল ইয়েমেনের তৈরি হিবারা বা চাদর। মূলত তৎকালীন যুগে মক্কা মদিনায় কোন পোশাক-আশাক তৈরি হতো না। এসব সরাসরি ইয়েমেন, সিরিয়া অঞ্চল থেকে আসত। আর ইয়েমেন ছিল পোশাক তৈরির বিখ্যাত অঞ্চল। উম্মে সালামা রাঃ বলেন, রাসূল ﷺ পোষাক হিসেবে জামা সর্বাধিক পছন্দ করতেন। বিভিন্ন হাদীসের ভিত্তিতে বুঝা যায় যে, রাসূল ﷺ বিভিন্ন ধরনের জামা পরিধান করতেন। তার কোনটির দৈর্ঘ্য ছিল টাখনু অবধি। কোনটি কিছুটা ছোট, যা হাটুর নিন্মভাগ পর্যন্ত ছিল। আবার কোনটির হাতা ছিল হাতের আঙ্গুলের প্রান্ত পর্যন্ত লম্বা। কোনটির হাতা কিছুটা ছোট, যা কব্জি পর্যন্ত ছিল। এছাড়া পুরুষের পোশাক পরিধানের ব্যাপারে রাসূল ﷺ একটি বিশেষ দিক অত্যন্ত গুরুত্ব প্রদান করেছেন। তিনি পুরুষের পোশাকের নিচের অংশ পায়ের গোড়ালী থেকে উপরে রাখার আদেশ করেছেন এবং গোড়ালীর নিচে পাজামা, লুঙ্গি, জামা বা কোন পোশাক পরিধান করতে হারাম ঘোষণা করেছেন। সর্বদা রাসূল ﷺ এর লুঙ্গি ও জামা টাখনুর' উপরে থাকত। সাধারণত তিনি পোশাকের নিচের অংশ হাটু ও গোড়ালীর বরাবর বা নিসফে সাক’ পর্যন্ত পরিধান করতেন। বিভিন্ন হাদীসে তিনি মুসলিম উম্মাহর পুরুষগণকে এভাবে পোশাক পরিধান করতে আদেশ দিয়েছেন। সুতরাং মুসলিম পুরুষের জন্য স্বেচ্ছায় টাখনুর নিচে পোশাক পরিধান করা হারাম। আবু হুরায়রা, আবদুল্লাহ ইবনে উমর ও অন্যান্য সাহাবী কর্তৃক বর্ণিত হাদীসে রাসূল ﷺ বলেন, যে ব্যাক্তি দাম্ভিকতার সাথে নিজের পোশাক ঝুলিয়ে পরিধান করবে , আল্লাহ তা’আলা কিয়ামতের দিন তার দিকে রহমতের দৃষ্টিতে তাকাবেন না।

তো তিনি কিভাবে কাপড় পড়তেন? এ সম্পর্কে আবু সাঈদ খুদরী রাঃ বলেন, "রাসূল ﷺ যখন নতুন কাপড় পরিধান করতেন তখন কাপড়ের নাম পাগড়ি অথবা কামীস অথবা চাদর ইত্যাদি উচ্চারণ করতেন। তারপর তিনি এ দুআ পড়তেন, "হে আল্লাহ! তোমারই জন্য যাবতীয় প্রশংসা। যেহেতু তুমিই আমাকে তা পরিধান করিয়েছ। আমি তোমার কাছে এর কল্যাণ প্রার্থনা করছি, আরো কল্যাণ চাচ্ছি, যে উদ্দেশে এটা তৈরি করা হয়েছে তার। আর আমি তোমার স্মরণাপন্ন হচ্ছি এর যাবতীয় অনিষ্ট হতে এবং যে উদ্দেশে তৈরি করা হয়েছে তার অনিষ্ট হতে।

তাহলে তাঁর পোশাকের রঙ কেমন ছিল? রাসূল ﷺ তৎকালীন সময়ে প্রচলিত বিভিন্ন রংয়ের পোশাক পরিধান করেছেন। বিভিন্ন হাদীসের আলোকে প্রমাণিত হয় যে, তার মধ্যে সবুজ, সাদা ও মিশ্রিত রং তিনি পছন্দ করতেন, কখনো তাঁকে কালো চাদর পরিহিত অবস্থায় দেখা গেছে। আবু রিমছা রাঃ বলেন, আমি রাসূল ﷺ কে দুটি সবুজ চাদর পরিহিত অবস্থায় দেখেছি। এছাড়াও ইবনে আব্বাস রাঃ, সামুরা ইবনে জুনদুব রাঃ থেকে বলা হয়েছে যে, "রাসূল ﷺ বলেছেন, তোমরা সাদা রঙের কাপড় পরিধান করবে। কারণ, তা সর্বাধিক পবিত্র ও উত্তম। আর তা দিয়েই তোমরা মৃতদের কাফন দাও।

আবার উল্লেখ্য যে, রাসূল ﷺ পুরুষদের রেশমি জুব্বা অথবা এই রঙের কাপড় পরিধান করতে নিষেধ করেছেন। এটা মুত্তাকিদের জন্য সমীচীন পোশাক নয়। তিনি সম্পূর্ণ লাল পোশাক পড়তেন না তবে লালের মাঝে ডোরাকাটা রয়েছে এমন পোশাক পড়েছেন অনেক সময়। 

তথ্যসূত্র:

শামায়েলে তিরমিজি, সিরাত ইবনে হিশাম দ্রষ্টব্য