আস্তিকদের সাথে যুক্তি-তর্ক করে তেমন একটা মজা পাওয়া যায় না। তাদের নাকি শেষ একটা ‘অস্ত্র’ আছে, আর সেটি হচ্ছে ‘বিশ্বাস।’ কতই না সুবিধা, তাই না! যখনই কেউ যুক্তি-তর্কের এক পর্যায়ে ‘বিশ্বাস’ নামক অস্ত্রের আশ্রয় নেয় তখন আর এগোনো সম্ভব হয় না। নাস্তিকদেরও সে'রকম কোন ‘অস্ত্র’ আছে কি-না, কে জানে! দেখা যাক দেখি… এই মহাবিশ্বের স্রষ্টায় বিশ্বাস একটি 'অন্ধ বিশ্বাস' কি-না – একজন সংশয়বাদী ও সত্য সন্ধানী হিসেবে বিষয়টা নিয়ে এক বন্ধুর সরণাপন্ন হয়েছিলাম। বন্ধুটি যা বলেছে তার সারমর্ম প্রথমে পাঁচ তারার মধ্যে তুলে ধরা হলো। বন্ধুর ভাষায়…
*****
ছোট্ট একটা গল্প দিয়েই শুরু করা যাক তাহলে। এক সংশয়বাদী বন্ধুকে একদিন গল্পটি বলছিলাম। গল্পটি এ'রকম- একদা কিছুই ছিল না। এমনকি মহাশূন্যও না। হঠাৎ করে একদিন মহা বিস্ফোরণের মাধ্যমে মহাশূন্য, বস্তু, ও শক্তি ইভল্ভ (!) করলো। তারপর ধীরে ধীরে বিলিয়ন বিলিয়ন গ্যালাক্সি ও গ্রহ-নক্ষত্র ইভল্ভ (!) করলো। দৈবক্রমে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন ইভল্ভ (!) করলো। দৈবক্রমে পানি ইভল্ভ (!) করলো। দৈবক্রমে আলো-বাতাস ইভল্ভ (!) করলো। সেই সাথে দৈবক্রমে অনেক রাসায়নিক পদার্থও ইভল্ভ (!) করলো। দৈবক্রমে বিভিন্ন প্রাকৃতিক নিয়ম ইভল্ভ (!) করলো। তারপর হঠাৎ করে একদিন মিউট বিস্ফোরণের মাধ্যমে কোনো এক পুকুর থেকে এককোষী একটি ব্যাকটেরিয়া ইভল্ভ (!) করলো। সেই ব্যাকটেরিয়া থেকে ধীরে ধীরে পুরো জীবজগত ইভল্ভ (!) করলো। সকল প্রকার জীবের বেঁচে থাকার জন্য বিভিন্ন প্রকার খাদ্যদ্রব্যও ইভল্ভ (!) করলো। গল্পটা শেষ না হতেই বন্ধুর প্রতিক্রিয়া – থামলে ভালো লাগে! এই ধরণের আজগুবি কল্পকাহিনী তোকে কে শুনালো-রে? ওয়েল, এক নাস্তিক বন্ধু। হুমম! তোর বন্ধু তো দেখা যাচ্ছে দৈব ঘটনায় একজন মহা অন্ধ বিশ্বাসী! ওয়েল, তাহলে একটা কৌতুক শোন। চার বন্ধু নিজ নিজ দেশ নিয়ে গর্ব করছে… আমেরিকান বন্ধু: জানিস, আমাদের দেশ এমন একটি মেশিন বানিয়েছে যেটা কিনা একেবারে মেঘের উপর দিয়ে যায়! {এরোপ্লেন} জার্মান বন্ধু: আরে মেঘের উপর দিয়ে যাওয়া এ যুগে আর নতুন কী? আমাদের দেশ এমন একটি মেশিন বানিয়েছে যেটা কিনা একদম সাগরের তলদেশ দিয়ে যায়! {সাবমেরিন} ভারতীয় বন্ধু: তোদের মতো আমাদের দেশ অতটা উন্নত কিছু না করতে পারলেও তারা একটি মেশিন বানিয়েছে, যার এক দিক দিয়ে ডিম ঢুকিয়ে দিলে অপর দিক দিয়ে হাঁস-মুরগির ছানা বেরিয়ে আসে! {ইনকিউবেটর} বাংলাদেশী বন্ধু: ওয়েল! তোরা তো ভালো করেই জানিস যে, আমাদের দেশ খুবই গরীব! মেঘের উপর কিংবা সাগরের তলদেশ দিয়ে যাওয়ার মতো মেশিন তৈরীর কোনোই সামর্থ্য তাদের নেই! আর আস্ত ডিমই বা পাবে কোথা থেকে? বললেই হলো নাকি! তবে তারা একটি রি-সায়ক্লিং মেশিন বানিয়েছে, যার এক দিক দিয়ে হোটেলের উচ্ছিষ্ট খাবার ঢুকিয়ে দিলে অপর দিক দিয়ে ভ্যাঁ-ভ্যাঁ, হাম্বা-হাম্বা, কক-কক করতে করতে গরু-মহিষ, ছাগল-ভেড়া, হাঁস-মুরগি থেকে শুরু করে তাজা শাকসব্জি এবং রিচার্ড ডকিন্সের মতো লেজবিহীন প্রাণী পর্যন্ত বেরিয়ে আসে! {বিবর্তন মেশিন}
এবার মূল প্রসঙ্গে আসা যাক। নাস্তিকরা 'বিশ্বাস' শব্দটাকে মাপকাঠি ধরে নিয়ে মহা উপসংহার টানেন। যেমন:
১. ঘোড়ার ডিমে বিশ্বাস একটি অন্ধ বিশ্বাস; কিন্তু বাস্তবে ঘোড়ার ডিম বলে কিছু নেই !
২. ভূত-প্রেতে বিশ্বাস একটি অন্ধ বিশ্বাস; কিন্তু বাস্তবে ভূত্-প্রেত্ বলে কিছু নেই!
৩. ইউনিকর্নে বিশ্বাস একটি অন্ধ বিশ্বাস; কিন্তু বাস্তবে ইউনিকর্ন বলে কিছু নেই!
৪. রাক্ষস-খোক্কসে বিশ্বাস একটি অন্ধ বিশ্বাস; কিন্তু বাস্তবে রাক্ষস-খোক্কস বলে কিছু নেই ।
n. এই মহাবিশ্বের স্রষ্টায় বিশ্বাসও একটি অন্ধ বিশ্বাস; সুতরাং, বাস্তবে স্রষ্টা বলেও কিছু নেই !
এবার তুই-ই বল, কোনো যুক্তিবাদী মানুষ কি ১,২,৩,৪,… নং বিশ্বাসের সাথে n-নং বিশ্বাসকে গুলিয়ে ফেলবেন বলে মনে হয়? গুলিয়ে ফেলাটা কি যুক্তিবিদ্যার চরম সীমাবদ্ধতাকেই প্রকাশ করবে না? এ তো অ্যাপেলের সাথে অরেঞ্জের তুলনার চেয়েও বেশী ভয়াবহ। মূলার সাথে কলার তুলনাও মনে হয় অনেক বেশী যুক্তিসম্মত।
একেবারে মাকাল ফলের সাথে স্ট্র্যবেরির তুলনা হয়ে গেল না ?!
নাস্তিকরা ভেবে বা না ভেবে পুনঃ পুনঃ একটি বুলি আউড়ায় এই বলে যে, আর দশটা বিশ্বাসের মতো এই মহাবিশ্বের স্রষ্টায় বিশ্বাসও একটি অন্ধ বিশ্বাস। একটু-আধটু চিন্তা করা তো দূরে থাক, অন্ধ বিশ্বাস কাহাকে বলে তাহা যেমন জানার প্রয়োজন মনে করে না তেমনি আবার অন্যদেরকে জানানোর প্রয়োজনও বোধ করে না । মানুষ তাহলে কীভাবে বুঝবে অন্ধ বিশ্বাস কাহাকে বলে ?
নিম্নের পয়েন্টগুলো আগে বিবেচনা করে দ্যাখ :
চোখের সামনেই অসীম একটি মহাশূন্য আছে (Where did the space come from?)। সেই মহাশূন্যের মধ্যে প্রায় অসীম পরিমাণ বস্তু ও শক্তি আছে (Where did all these energy and matter come from? Did they evolve from nothingness?)। ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন গ্যালাক্সি ও গ্রহ-নক্ষত্র আছে। মিলিয়ন মিলিয়ন প্রজাতি আছে। প্রত্যেক প্রজাতির মধ্যে আবার বিচিত্র রকমের ও বিচিত্র বর্ণের উপ-প্রজাতি আছে। বিচিত্র রকমের ও বিচিত্র বর্ণের উদ্ভিদ, খাদ্যশস্য, ও ফল-মূল আছে।
আজ পর্যন্তও কেউ শূন্য থেকে কিছু সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়নি। আজ পর্যন্তও কেউ নির্জীব বস্তু থেকে সামান্য একটি জীবও সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়নি।
বিজ্ঞানীরা কিছু ফিজিক্যাল ও কেমিক্যাল ল্য’ আবিষ্কার করেছেন (Where did the physical laws come from? Did they also evolve?)।
কার্য-কারণ সূত্রের প্রচলিত একটি যুক্তি, “Whatever begins to exist has a cause of its existence; The Natural Universe began to exist; Therefore, the Natural Universe has a cause of its existence.”
বিগ ব্যাং তত্ত্ব অনুযায়ী এই মহাবিশ্বের একটি শুরু আছে। এই তত্ত্ব আবিষ্কারের আগ পর্যন্ত বস্তুবাদী নাস্তিকরা এই মহাবিশ্বকে 'চিরস্থায়ী' বলে বিশ্বাস করতেন। সাধারণ বোধ অনুযায়ী কোনো কিছুর শুরু থাকা মানে তার পেছনে কারণও থাকতে হবে। কেউ কেউ হয়তো বলতে পারেন, কারণ ছাড়াও কিছু কিছু ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু বিগ ব্যাং যে কোনো কারণ ছাড়াই ঘটেছে, তার পক্ষে প্রমাণ কী? প্রকৃতিতে যেহেতু প্রায় প্রত্যেক ঘটনার পেছনেই কারণ থাকে, সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বিগ ব্যাং-এর পেছনেও কারণ থাকাটাই স্বাভাবিক। কারণ হিসেবে কেউ আকস্মিক দুর্ঘটনাকেও ধরে নিতে পারেন কিন্তু সেটা কতটুকু সন্তোষজনক ও যুক্তিসম্মত হবে? এমনি এমনি কি কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে! বিগ ব্যাং-এর অর্থ হচ্ছে মহা বিস্ফোরণ (What exploded and what triggered the Big Bang?)। কোনো রকম নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই কোনো কিছু বিস্ফোরিত হয়ে চারিদিকে বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে পড়ে পুনরায় একত্রিত হয়ে বিলিয়ন বিলিয়ন গ্যালাক্সি ও গ্রহ-নক্ষত্রসহ প্রাণীজগত ও উদ্ভিদজগত তৈরী হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু? কেন ও কোন্ শক্তিবলেই বা এই মহাবিশ্ব সম্প্রসারণ করলো এবং এখনো করছে?
বিজ্ঞান হচ্ছে মানুষেরই আবিষ্কৃত সীমিত একটি টুল। বিজ্ঞান নিজে থেকে যেমন কিছু করতে পারে না তেমনি আবার কিছু সৃষ্টিও করতে পারে না। বিজ্ঞানীরা এই টুলকে ব্যবহার করে সৃষ্টি জগতের কিছু মেকানিজমকে ব্যাখ্যা করেন মাত্র।
নাস্তিকরা বলে থাকেন বিজ্ঞান নাকি ‘গড এর গ্যাপ’ পূরণ করছে। এটি একটি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধরণা। বিজ্ঞান মানুষের প্রচলিত বিশ্বাসের কিছু কিছু গ্যাপ পূরণ করতে পারে কিন্তু এই মহাবিশ্বের স্রষ্টার গ্যাপ যে কীভাবে পূরণ করে সেটা একমাত্র নাস্তিকরাই ভালো জানেন! তবে প্রত্যেকটি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের মাধ্যমে কিছু অজানা তথ্য যেমন উন্মোচিত হয় তেমনি আবার অনেক নতুন নতুন গ্যাপেরও সৃষ্টি হয়। যত বড় বিজ্ঞানী, তাঁর কাছে কিন্তু ততই গ্যাপ বেশী। তবে যারা নিজেদেরকে সীমাবদ্ধ প্রশ্নের গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ রাখতে চায় তাদের কথা আলাদা। সত্যি বলতে কি, বিজ্ঞান আসলে নাস্তিকদের বিশ্বাসের গ্যাপই পূরণ করছে।
এই মহাবিশ্বটা শুধুই আকস্মিক ও দৈব ঘটনার ফলাফল হলে অনেক প্রক্রিয়া বিলিয়ন বিলিয়ন বছর ধরে নির্ধারিতভাবে চলার কথা না। যেমন, মহাবিশ্বের শুরু থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন বছর ধরে বিলিয়ন বিলিয়ন গ্রহ-নক্ষত্র নিজ নিজ অক্ষে সুবোধ বালকের মতো ঘুরছে! একটি শক্তি (?) বিস্ফোরিত হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে পুনরায় একত্রিত হয়ে ছোট ছোট বল তৈরী করে নিজ নিজ অক্ষে শূন্যে ঘোরা শুরু করে দেয় নাকি? কেন ও কী এমন শক্তিবলে ঘুরছে যে একদমই থামছে না! সুতরাং খুব জোর দিয়েই বিষয়টিকে একটি নির্ধারিত প্রক্রিয়া বলা যেতে পারে। অনুরূপভাবে, সৃষ্টির শুরু থেকে মিলিয়ন মিলিয়ন বছর ধরে এ পর্যন্ত একটি প্রাণীও বেঁচে থাকেনি। অতএব, খুব জোর দিয়েই বলা যায় যে, মৃত্যু একটি ধ্রুব সত্য। কোনো রকম নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই বিলিয়ন বিলিয়ন বছর ধরে অনেক প্রক্রিয়া নির্ধারিতভাবে চলার আদৌ কোনো সম্ভাবনা আছে কি?
বিজ্ঞানীদের মতে লাইফ ফর্ম করার জন্য নাকি ‘বিশেষ’ একটি পরিবেশের দরকার। অর্থাৎ যেকোনো পরিবেশে লাইফ ফর্ম করতে পারে না। আজ থেকে মিলিয়ন মিলিয়ন বছর আগে একটি বিশেষ পরিবেশে নাকি লাইফ ফর্ম করেছে। তার মানে বিষয়টি নির্ধারিত। অনির্ধারিত হলে যেকোনো পরিবেশে ও যেকোনো সময় লাইফ ফর্ম করার কথা। আজ থেকে কয়েক দশক আগ পর্যন্তও ডিএনএ-র গঠন প্রণালী সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের কোনো ধারণা ছিল না। কিন্তু আজ ডিএনএ-র অত্যন্ত জটিল গঠন প্রণালী ও জীবের আরো কিছু তথ্যের উপর ভিত্তি করে বিষয়টিকে স্রেফ অন্ধ-অচেতন ও উদ্দেশ্যহীন প্রকৃতির কারসাজি বলে যুক্তিবাদী মন মেনে নিতে পারে না।
মানুষের বিভিন্ন ইন্দ্রিয় কেন ও কীভাবে ইভল্ভ করলো? ডিএনএ বৃদ্ধির সাথে ইন্দ্রিয় বৃদ্ধির সম্পর্কই বা কী? এ থেকে অত্যন্ত পরিষ্কার যে, ডিএনএ তথ্য বহনকারী একটি চালক হিসেবে কাজ করে। তাছাড়া প্রত্যেক মানুষের ডিএনএ ইউনিক, অর্থাৎ কারো সাথে কারো মিল নেই। সত্যিই এ এক বিস্ময়! তা-ই যদি হয় তাহলে এটি নিঃসন্দেহে একটি নির্ধারিত বিষয়। অন্ধ-অচেতন ও উদ্দেশ্যহীন প্রকৃতির পক্ষে এই ধরণের ইউনিক ও নির্ধারিত নির্বাচন সত্যিই হাস্যকর। সবকিছুই বোবা-কালা-অন্ধ প্রকৃতির কারসাজি হলে এই অসাধারণ ইউনিকনেস বজায় থাকার কথা না। মানুষের ফিঙ্গার প্রিন্টের ক্ষেত্রেও একই যুক্তি প্রযোজ্য। শুধু তা-ই নয়, সবকিছুই বোবা-কালা-অন্ধ প্রকৃতির কাজ হলে মাঝে মধ্যে মানুষের পেট থেকে বানর, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদির বাচ্চা কিংবা বানর, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদির পেট থেকে মানুষের বাচ্চা বের হয়ে আসার কথা। তা কিন্তু হচ্ছে না। অতএব, এগুলোর পেছনে একটি স্বজ্ঞাত নিয়ন্ত্রিত শক্তি যে কাজ করছে তাতে কোনোই সন্দেহ নেই।
কেউ কি কখনো শুনেছেন আম গাছে হঠাৎ করে জাম ধরেছে? কচু গাছে লিচু? অ্যাপেল গাছে কাঁঠাল? কুমড়া গাছে জাম্বুরা? ঝাউ গাছে লাউ? পান গাছে ধান? মূলা গাছে কলা? এ'রকম কিছু কখনোই শোনা বা দেখা যায় না। আজ থেকে হাজার হাজার বছর আগে চড়ুই পাখি যে'রকম বাসা বানাতো, আজও ঠিক সে'রকমই বাসা বানাচ্ছে! কোনো উন্নতি যেমন নেই, তেমনি আবার নেই কোনো অবনতি। আজ থেকে লক্ষ লক্ষ বছর আগে পশু-পাখিদের যে কাজ ছিল, আজও তারা ঠিক একই কাজ করছে। তার মানে এগুলো সবই আগে থেকে নির্ধারিত। আর নির্ধারিত কোনো বিষয়ে নিয়ন্ত্রিত শক্তির প্রশ্ন আসাটাই স্বাভাবিক।
জীবজগতের দিকে সূক্ষ্মভাবে দৃষ্টি দিলে তাদের শারীরিক গঠনের মধ্যে একটা সমরূপতা লক্ষ্য করা যায়। সবকিছুই অন্ধ-অচেতন ও উদ্দেশ্যহীন প্রকৃতির কারসাজি হলে দীর্ঘদিন ধরে এই সমরূপতা বজায় থাকার কথা না। কিছু কিছু প্রাণীর লেজের মাথায় এক গোছা কেশ কেন ও কীভাবে ইভল্ভ (!) করলো, যেখানে অন্যান্য প্রাণীদের নেই! পশু-পাখিদের শিং ও জিহবা কেন ও কীভাবে ইভল্ভ করলো। হাতির লম্বা শুঁড় কেন ও কীভাবে ইভল্ভ (!) করলো। একই পশু-পাখির গায়ে একাধিক রং-ই বা কেন ও কীভাবে ইভল্ভ (!) করলো। প্রত্যেকটি প্রাণীর জন্মের পর ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠা থেকে শুরু করে তাদের গতি-প্রকৃতি, জীবন-যাপন প্রণালী, ও বুদ্ধিমত্তার দিকে সূক্ষ্মভাবে দৃষ্টি দিলেও মনে হবে যেন তারা কোনো স্বজ্ঞাত শক্তি দ্বারা পরিচালিত এবং কোনো-না-কোনো ভাবে শিক্ষাপ্রাপ্ত। এগুলোকে শুধুই অন্ধ-অচেতন ও উদ্দেশ্যহীন প্রকৃতির কারসাজি বলে বিশ্বাস করাটাই আসলে অন্ধ বিশ্বাস।
ব্যতিক্রম ছাড়া প্রত্যেকটি জাতির মধ্যে যদি সমীক্ষা চালানো হয় তাহলে দেখা যাবে নারীদের তুলনায় পুরুষরা উচ্চতায় বেশী এবং সেই সাথে বেশী শক্তিশালী ও সাহসী। এমনকি বেশী উচ্চতার নারীরাও পুরুষদের তুলনায় কম শক্তিশালী ও সাহসী হয়। বিষয়টাকে পূর্ব নির্ধারিত মনে হয় না ? বিবর্তন তত্ত্ব এ বিষয়ে কী বলে? নাস্তিকদের অন্ধ-অচেতন ও উদ্দেশ্যহীন প্রকৃতিও নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্যমূলক আচরণ করে নাকি!
পৃথিবীতে জীবজগতের বিকাশের পাশাপাশি খাদ্যদ্রব্যও ইভল্ভ (!) করেছে। অন্যান্য গ্রহে যেমন জীব-জন্তু নেই তেমনি আবার কোনো খাদ্যদ্রব্যও নেই! সুতরাং স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে যে, জীবজগৎ ও খাদ্যদ্রব্য একে অপরের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বিষয়টাকে সু-পরিকল্পিত বলে মনে হয় না ? প্রাকৃতিক খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে বিভিন্ন ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ কেন ও কীভাবে ইভল্ভ করলো? কোনো পাগলেও কি বিশ্বাস করবে যে, মিলিয়ন মিলিয়ন ফল-মূল ও শস্য-উদ্ভিদ একটি ব্যাকটেরিয়া থেকে ইভল্ভ (!) করেছে ! কোনো গাধাও কি বিশ্বাস করবে যে, তিল গাছ থেকে তাল গাছ ইভল্ভ করতে পারে ! ঘাস থেকে বট গাছ ইভল্ভ করতে পারে ! বিবর্তনবাদের আলোকে অ্যাপেল ও কাঁঠালের মধ্যে কোনো সম্পর্ক আছে কি-না ? আখের সাথে তরমুজের-ই বা কী সম্পর্ক, যদিও দুটোতেই পানি আছে !? স্রেফ অন্ধ-অচেতন ও উদ্দেশ্যহীন প্রকৃতির মাধ্যমে এগুলো ইভল্ভ করা আদৌ কি সম্ভব !?
আধুনিক নাস্তিকরা ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’ নামে একটি অস্পষ্ট পারিভাষিক শব্দের উপর জোর দিয়ে থাকেন। তাদের মতে প্রকৃতি নাকি বোবা-কালা-অন্ধ-অচেতন এবং সামনে-পেছনে কোনো কিছু দেখে না! কিন্তু প্রকৃতি যে বোবা-কালা-অন্ধ-অচেতন এবং সামনে-পেছনে দেখে কি-না, সেটা তারা জানলেন কী করে !? উদাহরণস্বরূপ, ছাগলের আগের ও পরের ধাপ কি নির্ধারিত নির্বাচন নাকি অনির্ধারিত নির্বাচন – সেটা তারা কীভাবে নিশ্চিত হলেন ?! এ-কি স্রেফ অন্ধ বিশ্বাস নয় ! ?
মানুষের ব্রেন কেন ও কীভাবে ইভল্ভ করলো যে, সেখানে আবার অসংখ্য তথ্য সংরক্ষণ করে রাখা যায় ? অনির্ধারিতভাবে ইভল্ভ করে মানুষ ও পশু-পাখি আবার কীভাবে নির্ধারিতভাবে কাজ করতে পারে এবং ভবিষ্যতের জন্য সিদ্ধান্তও নিতে পারে ! নাস্তিকরা নিজেরা বুদ্ধিমান হয়ে বুদ্ধিমত্তার অস্তিত্বকে আবার অস্বীকার করে আসছেন। অর্থাৎ তারা বলতে চাইছেন যে, এই মহাবিশ্বের সবকিছুই বোবা-কালা-অন্ধ-অচেতন ও উদ্দেশ্যহীন প্রকৃতির মাধ্যমে ইভল্ভ করেছে এবং এর মধ্যে কোনো রকম বুদ্ধিমত্তা কাজ করেনি। তবে বুদ্ধিমত্তা কাজ না করার স্বপক্ষেও কিন্তু কোনো প্রমাণ নাই ! এটিও একটি অন্ধ বিশ্বাস ? বুদ্ধিমত্তাকে অস্বীকার করার পেছনে একমাত্র কারণ হচ্ছে স্রষ্টায় অবিশ্বাস। স্রষ্টাকে এড়াতে যেয়ে এই মহাবিশ্বের সবকিছুকেই 'বুদ্ধিমত্তাশূন্য' ও 'অন্ধ' বানিয়ে দেওয়া হচ্ছে! ভালো কথা। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে তারা নিজেদেরকে আবার বুদ্ধিমত্তাশূন্য ও অন্ধ মেনে নিতেও নারাজ! তারা একই সাথে গাছেরও খাইতে চায় আবার তলারও কুড়াইতে চায় । তারা অদৃশ্য সবকিছুকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিলেও নিজেদের বুদ্ধিমত্তায় এসে হঠাৎ করে থেমে যায়! তার মানে কোনো এক জায়গাতে থেমে যেতে হয় তাহলে!
ডঃ রিচার্ড ডকিন্স তার 'না-বিশ্বাস'কে সমর্থন করার জন্য বিবর্তনবাদকে যেহেতু বোবা-কালা-অন্ধ-অচেতন ও উদ্দেশ্যহীন প্রকৃতির কারসাজি বলেছেন সেহেতু অনেকেই তার কথাকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করে! সবচেয়ে হাস্যকর যেটা মনে হয়েছে সেটা হচ্ছে, ডঃ ডকিন্স চোখ বন্ধ করে নিজে মাঙ্কি সেজে বিলিয়ন বিলিয়ন বছরের কোনো এক সম্ভাবনাকে কীবোর্ডের এক ঠেলায় মাত্র কয়েক বছরে নিয়ে আসতে চান! অর্থাৎ ধরা যাক, উনি মাঙ্কি সেজে সেক্সপিয়ারের হ্যামলেট নাটক হুবহু লিখতে চান এবং তাতে একশত ট্রিলিয়ন বছর সময় লাগবে। প্রকৃতপক্ষে আদৌ সম্ভব না। যাহোক, উনি একটি প্রোগ্র্যাম লিখেছেন যেটার কাজ হচ্ছে হ্যামলেট নাটক অনুযায়ী অর্থবহ একটি বর্ণ বা শব্দ টাইপ হওয়ার সাথে সাথে সেটা আলাদা করে সংরক্ষণ করে রাখা। মজার ব্যাপার হচ্ছে একবারও কিন্তু ভুল হওয়া চলবে না। মাত্র একবার ভুল হলেই পুরো প্রক্রিয়া আবার নতুন করে শুরু করতে হবে। ডঃ ডকিন্স যে প্রশ্নটা নিজেকে করছেন না সেটা হচ্ছে বোবা-কালা-অন্ধ-অচেতন ও উদ্দেশ্যহীন প্রকৃতি এরকম প্রোগ্র্যাম কোথা থেকে পায়, কীভাবে যথাযথভাবে নির্বাচন করে, এবং কোথায়-ই বা তা সংরক্ষণ করে রাখে! উনি নিজে মাঙ্কি সেজে কীবোর্ডে দুই ঠেলা দিয়ে পুরো মহাবিশ্বকে সৃষ্টি করতে চান! বাস্তব মাঙ্কি থাকতে নিজেকে মাঙ্কি সাজতে হবে কেন বাবা! একটি মাঙ্কি ধরে নিয়ে এসে কম্পুটারের সামনে বসিয়ে দিলেই তো ল্যাটা চুকে যায়! উনি আসলে বৃত্তাকার যুক্তির মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছেন। স্রষ্টাকে আগেই ‘নাই’ ধরে নিয়ে নিজে মাঙ্কি সেজে কম্পুটারের কীবোর্ড ঠেলে আমজনতাকে বোকা বানানোর চেষ্টা করছেন। যখনই কেউ বিভিন্ন শর্ত দিয়ে প্রোগ্র্যাম লিখবেন তখন সেটা সেই শর্তগুলোর মধ্যে নির্ধারিত হয়ে যাবে। অর্থাৎ প্রোগ্র্যামারের ঈশারা-ইঙ্গিত অনুযায়ীই প্রোগ্র্যাম চলবে। ডঃ ডকিন্স একদিকে প্রকৃতিকে বোবা-কালা-অন্ধ-অচেতন বলছেন অন্যদিকে আবার নির্ধারিত প্রোগ্র্যাম দ্বারা সেই বোবা-কালা-অন্ধ-অচেতন প্রক্রিয়াকে সমর্থন করার চেষ্টা করছেন! হয় তিনি নিজেই নিজেকে বোকা বানাচ্ছেন অথবা আমজনতাকে বোকা বানানোর চেষ্টায় আছেন।
ঘুমকে কার্যত মৃত অবস্থা ধরা হয়। এই যে একটি নিদ্রিষ্ট সময় ঘুমের পর মানুষ স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুনঃ পুনঃ চেতন পায়, সেটা কি কোনোই সংকেত বহন করে না? স্বপ্নকেও রহস্যময় কিছু একটা সংকেত বলেই মনে হয়। কার্যত মৃত অবস্থায় দূর-দূরান্তের সিনারিও কীভাবে দেখা সম্ভব? কীভাবে চোখের পলকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়া সম্ভব? কথাবার্তা এবং বিভিন্ন ঘটনাই বা কীভাবে স্মরণ রাখা সম্ভব!
একটি শিশু মায়ের পেটে থাকা অবস্থায় (মায়ের পেটকে ধরা যাক প্রথম মহাবিশ্ব) কখনো কি কল্পনা করতে পারে অতি সামান্য একটু জায়গার বাইরে বিশাল এক মহাবিশ্ব অপেক্ষা করছে! যারা ইতোমধ্যে মায়ের অন্ধকার পেট থেকে বেরিয়ে আলোকিত দ্বিতীয় মহাবিশ্বে পদার্পন করেছে তাদের কাছে প্রথম মহাবিশ্ব (মায়ের পেট) একটি বাস্তবতা। সেই বাস্তবতার উপর ভিত্তি করে কেউ যদি আরো অনেক বিস্ময়কর তৃতীয় একটি মহাবিশ্ব অনুমান করে তবে সেই অনুমান অযৌক্তিক বা অন্ধ হবে কেন? এই অনুমান তো একটি বাস্তব তথ্যের উপর ভিত্তি করে করা হচ্ছে।
বাস্তব জগতের অনেক কিছুই সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না – যেমন ন্যায়বিচার। তবে যারা ন্যায়বিচার এড়িয়ে যেতে চায় তাদের কথা আলাদা। ধরা যাক, একজন খুনী এক হাজার মানুষকে হত্যা করলো। এই হত্যার ন্যায়বিচার এই পৃথিবীতে কীভাবে করা সম্ভব? বাস্তব জগতে সেই খুনীকে বড়জোর একবার মাত্র হত্যা করা সম্ভব। তাহলেই কি ন্যায়বিচার হয়ে যাবে? তাছাড়া যাদেরকে হত্যা করা হলো তাদেরকে জীবিত করাও তো অসম্ভব। নাস্তিকরা কি এই প্রশ্নের যৌক্তিক ও সন্তোষজনক জবাব দিতে পারবেন? প্রচলিত নিয়মে যেটা করা হয় সেটা হচ্ছে এক ধরণের ক্ষতিপূরণ, ন্যায়বিচার নয়। আর খুনীকে যদি চিহ্নিত করা না যায় সেক্ষেত্রেই বা কী হবে? এরকম আরো অনেক বিষয় আছে যার যৌক্তিক ও সন্তোষজনক ব্যাখ্যা এই জগতে দেওয়া অসম্ভব। নাস্তিকরা আসলে ন্যায়বিচার ও অপরাধের শাস্তি এড়িয়ে যেতে চায়। চুরি-ডাকাতি-হত্যা-ধর্ষণ করে অপরাধীর শাস্তি হবে না – এ আবার কেমন মামার বাড়ির আবদার!
স্যার আইজ্যাক নিউটনের একটি উক্তি, The most beautiful system of the sun, planets, and comets, could only proceed from the counsel and dominion on an intelligent and powerful Being.
স্যার ফ্র্যানসিস ব্যাকন বলেন:
It is true, that a little philosophy inclineth man’s mind to atheism, but depth in philosophy bringeth men’s minds about to religion; for while the mind of man looketh upon second causes scattered, it may sometimes rest in them, and go no further; but when it beholdeth the chain of them confederate, and linked together, it must needs fly to Providence and Deity.
আকস্মিকভাবে লাইফ ফর্ম করার ব্যাপারে রজার পেনরোজ নামের এক বৃটিশ ম্যাথেমেটিশিয়ান বলেন, “This now tells how precise the Creator’s aim must have been, namely to an accuracy of one part in 10^10^123. This is an extraordinaryfigure. One could not possibly even write the number down in full in the ordinary denary notation: it would be 1 followed by 10^123 successive 0’s. Taiconchavetyt . Even if we were to write a 0 on each separate proton and on each separate neutron in the entire universe- and we could throw in all the other particles for good measure- we should fall far short of writing down the figure needed. ”
বিখ্যাত জ্যোতির্বেত্তা কার্ল স্যাগান বলেন, “An [dogmatic] atheist is someone who is certain that God does not exist, someone who has compelling evidence against the existence of God. I know of no such compelling evidence. Because God can be relegated to remote times and places and to ultimate causes, we would have to know a great deal more about the universe than we do now to be sure that no such God exists.”
বিখ্যাত দার্শনিক সক্রেটিস, প্লেটো, ও অ্যারিস্টটলও বিশ্বাসী ছিলেন। যুগে যুগে কিছু মহা মানব স্রষ্টার ছোঁয়া উপলব্ধি করারও দাবী করেছেন। তাঁদের মধ্যে সকলেই মিথ্যাবাদী হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। এক্ষেত্রে কিন্তু একজন সত্যবাদী হওয়াই যথেষ্ট।
জন্মের পূর্বে আমরা কোথায় ছিলাম আর মৃত্যুর পরই বা কোথায় যাবো – বিষয় দুটি এখন পর্যন্তও রহস্যপূর্ণই রয়ে গেছে। জীবিত ও মৃত মানুষের মধ্যে যে কিছু একটা পার্থক্য আছে সেটা সবাই এক-বাক্যে স্বীকার করতে বাধ্য। গণিতের সমীকরণের সাহায্যে পার্থক্যটাকে এভাবে লিখা যেতে পারে: জীবিত মানুষ = মৃত মানুষ (জড় বস্তু) + x. যারা বিশ্বাস করে মৃত্যুর পর জড় বস্তু ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না, তাদের ক্ষেত্রে x-এর মান হবে শূন্য। অর্থাৎ তাদের কাছে জীবিত ও মৃত মানুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই! মৃত্যুর সাথে সাথে x-এর মান শূন্য হয়ে যাওয়া কি সম্ভব? শক্তির নিত্যতা সূত্র অনুসারে কোনো কিছুরই ধ্বংস বা বিনাশ নেই, শুধু এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় রূপান্তরিত হয় মাত্র। কাজেই জড় বস্তু না হয় জৈব সারে রূপান্তরিত হলো, কিন্তু x-এর কী হবে। x তো কোনো বস্তু নয় যে সেটাও জৈব সারে রূপান্তরিত হবে। x তাহলে যাবে কোথায়?
স্রষ্টাকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য নাস্তিকরা অত্যন্ত যৌক্তিক একটি প্রশ্নকে কৌশলে ‘নাই’ করে দিতে চায়। ধরা যাক, একজন বিজ্ঞানী অজানা কোনো গ্রহে যেয়ে একটি মেশিন দেখতে পেলেন। খুব স্বাভাবিকভাবেই বিজ্ঞানীর মনে দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উদয় হবে:
১. মেশিনটির নির্মাণকারী কে?
২. মেশিনটি কীভাবে তৈরী করা হয়েছে এবং কীভাবেই বা কাজ করে?
নাস্তিকরা বিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে প্রথম প্রশ্নকে (যেটা বেশী গুরুত্বপূর্ণ) বেমালুম ‘নাই’ করে দিতে চায়! বিজ্ঞানের বাইরে কোনো প্রশ্নে না যাওয়া মানে কিন্তু বিজ্ঞানকেই পরোক্ষভাবে 'গড' হিসেবে মেনে নেওয়া । ধরা যাক, একজন বিজ্ঞানী একটি রোবট ও একটি মেশিন তৈরী করলেন । এবার রোবট-টা যদি বিজ্ঞানী থেকে সরাসরি কোনো সাহায্য না নিয়েও মেশিনের কার্যপ্রণালী কোনো ভাবে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হয় তাহলেই কি সেই বিজ্ঞানীর অস্তিত্ব ‘নাই’ হয়ে যাবে ? তাহলেই কি রোবট ও মেশিনের উপর বিজ্ঞানীর অবদান হাওয়া হয়ে যাবে ? তা কিন্তু মোটেও নয়। কোনো একটি মেশিনের কার্যপ্রণালী ব্যাখ্যা করতে পারা মানে এই নয় যে, সেই মেশিনের কোনো নির্মাণকারী নেই; যদিও নাস্তিকরা এমনটাই বলার চেষ্টা করেন !
এওবিন্দুর মতো কিছু একটা। অধিকন্তু, বিলিয়ন বিলিয়ন গ্রহ-উপগ্রহের মধ্যে একমাত্র পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব থাকা মানে প্রমাণ হয় না যে এই মহাবিশ্বের কোনো স্রষ্টা নাই!
নিউটন ও আইনস্টাইন যথাক্রমে গতিসূত্র ও আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্ব আবিষ্কার করলেও মানবতার উপর সেগুলোর অবদান তাঁদের জীবদ্দশায় দেখে যেতে পারেননি। এমনকি অন্যান্য মানুষ তাঁদের আবিষ্কারের সুফল ভোগ করলেও তাঁরা নিজেরাই কোনো সুফল ভোগ করে যেতে পারেননি। মৃত্যুর সাথে সাথে সবকিছুর অবসান হলে নিউটন ও আইনস্টাইনের কাছে গতিসূত্র ও আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্বের আর কোনোই মূল্য নেই! তাঁদের আবিষ্কার মানবতার কোনো উপকার বা অপকারে আসছে কিনা – সেটাও তাঁরা আর কোনো কালেই জানতে পারবেন না! এমনও তো হতে পারতো যে, আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্ব আবিষ্কারের পরের দিনই পৃথিবীটা কোনো কারণে ধ্বংস হয়ে গেল। সেক্ষেত্রে আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্বেরই বা কী মূল্য থাকতো! কিন্তু এমন যদি হয় যে, তাঁরা অন্য কোনো মাত্রা থেকে সবকিছু জানতে পারছেন বা কোনো একদিন জানবেন – তাহলেই কেবল তাঁদের অবদান স্বার্থক বলে মনে হয়।
আগামীকালই যদি কোনো এক দৈব দূর্বিপাকে পৃথিবীটা ধ্বংস হয়ে যায় সেক্ষেত্রে জ্ঞান-বিজ্ঞান, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় ইত্যাদির কী মূল্য থাকবে! তাহলে কীসের আশায়-নেশায় মানুষ ছুটছে! সবই কি তাহলে পার্থিব মায়া! মানুষের দর্শন কি এতটাই সংকীর্ণ! মানুষের একটি সুদূর-প্রসারী ভিশন থাকাটা অযৌক্তিক হবে কেন? সুতরাং এমন যদি হয় যে, এই মহাবিশ্ব ধ্বংস হয়ে গেলেও এমন একজন আছেন যিনি আবারো সবকিছুকে নতুন করে তৈরী করতে সক্ষম হবেন – তাহলেই কেবল সবকিছু যথাযথভাবে অর্থবহ মনে হয়। অপ্রমাণিত কোনো কিছুকে ‘আছে’ ধরে নিয়ে তার সন্ধান করাটাই হচ্ছে যুক্তিসম্মত পন্থা। কিন্তু আগেই ‘নাই’ ধরে নিয়ে আবার ‘নাই’ প্রমাণ করতে যাওয়াটা শুধু অযৌক্তিক-ই নয় সেই সাথে চরম বোকামীও বটে! মজার ব্যাপার হচ্ছে নাস্তিকরা স্রষ্টার অস্তিত্বে অবিশ্বাস করেও যুক্তিতর্ক দিয়ে আবার তার অনস্তিত্ব প্রমাণ করার চেষ্টা করেন! তার মানে হয় স্রষ্টা তাদের পিছু ছাড়ছেন না অথবা তারাই স্রষ্টার পিছু ছাড়তে পারছেন না! এ-কি এক ধরণের মানসিক অস্থিরতা নয়? মানুষ কিন্তু ঘোড়ার ডিমে অবিশ্বাস করে আবার তার অনস্তিত্ব প্রমাণ করার চেষ্টা করে না! প্রকৃতপক্ষে, মানুষ যেমন কখনোই ঘোড়ার ডিমের অস্তিত্ব প্রমাণ করার চেষ্টা করে না তেমনি আবার কোনো দিনই কেউ ঘোড়ার ডিমের অনস্তিত্বও প্রমাণ করার চেষ্টা করেনি। এখানেই স্রষ্টা ও ঘোড়ার ডিমের মধ্যে তফাৎ, যেটা বোঝার মতো জিনিস নাস্তিকদের মাথায় নাই!
বেঁচে থাকা অবস্থায় একজন মানুষ মৃত্যুর পর মাত্র দুটি অপশন উপলব্ধি করতে সক্ষম: স্রষ্টা ও মহাশূন্যতা। যেকোনো যুক্তিবাদী মানুষ প্রথম অপশনকেই বেছে নেওয়ার কথা। এখানে ভয়-ভীতি বা লোভ-লালসার কারণ খুঁজতে যাওয়াটা কিন্তু মূর্খতারই নামান্তর। তার কারণ হচ্ছে এটিই একমাত্র যুক্তিসম্মত অপশন। এক্ষেত্রে দ্বিতীয় অপশনকে বেছে নেওয়াটাই কিন্তু চরম নির্বুদ্ধিতার মধ্যে পড়ে।
এ'রকম আরো অনেক পয়েন্ট তুলে ধরা সম্ভব।
এই মহাবিশ্ব-সহ সবকিছুকে বোবা-কালা-অন্ধ-অচেতন ও উদ্দেশ্যহীন প্রকৃতির ফলাফল বলে বিশ্বাস করাটাই আসলে স্রেফ অন্ধ বিশ্বাস ।
উপরোল্লেখিত তথ্যের উপর ভিত্তি করে স্রষ্টায় বিশ্বাসকেই অনেক বেশী যৌক্তিক মনে হয়।
এই বিশ্বাস অবশেষে ভুল প্রমাণিতও হতে পারে, যদিও প্রমাণ করা অসম্ভব, কিন্তু এ'রকম একটি বিশ্বাসকে কি কোনো যুক্তিবাদী মানুষ 'অন্ধ বিশ্বাস' বলতে পারে?
এ'রকম একটি বিশ্বাসকে কি ঘোড়ার ডিমের সাথে তুলনা করা যায়?
বরঞ্চ যারা এমন উদ্ভট কথাবার্তা বলে তারাই কি প্রকৃতপক্ষে অযুক্তিবাদী ও অন্ধ নয়?
ঘোড়ার ডিম, ভূত-প্রেত, রাক্ষস-খোক্কস, ইউনিকর্ন ইত্যাদি নিয়ে তো জ্ঞানী-গুণী মানুষেরা কখনো মাথা ঘামান না। নাস্তিকরাও কখনো এগুলোর অনস্তিত্ব প্রমাণের জন্য উঠে-পড়ে লাগেনি। তাছাড়া সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে এগুলোর অস্তিত্ব বা অনস্তিত্বের সাথে মানুষের কী-ই বা আসে যায়!
বার্ডেন-অব-প্রুফ
বিশ্বাস নামক 'ঝুট'কে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য অনেকেই একটি কৌশলের আশ্রয় নেওয়া শুরু করেছেন। তাদের ভাষায় সেটা হচ্ছে: “ওয়েল, আমরা বলি না যে আমরা গডের অস্তিত্বে বিশ্বাস করি না, বা না-গডে বিশ্বাস করি; আস্তিকরা যা বলে তার সামনে আমরা শুধু একটা ‘না’ সূচক উপসর্গ বসিয়ে দেই।” বিশ্বাস নামক 'ঝুট'কে এড়িয়ে যাওয়ার এটি একটি মোক্ষম কৌশল। যেন স্রষ্টা নিয়ে নাস্তিকদের নিজস্ব কোনো চিন্তা-ভাবনাই নেই! তাদের চিন্তা-ভাবনা সম্পূর্ণরূপে আস্তিকদের উপর নির্ভরশীল। তারা শুধু একটি ‘না’ হাতে করে নিয়ে বসে আছে। আস্তিকরা কিছু বলার সাথে সাথে তারা সেই ‘না’-কে তাদের (আস্তিকদের) কথার সম্মুখভাগে ছুঁড়ে মারবে! অর্থাৎ আস্তিকরা যদি বলে ‘ক’, নাস্তিকরা সাথে সাথে বলবে ‘না-ক’! আস্তিকরা যদি বলে ‘খাবো’, নাস্তিকরা সাথে সাথে বলবে ‘না-খাবো’! আমার এক নাস্তিক বন্ধুকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম: আচ্ছা এই পৃথিবীতে যদি কোনো আস্তিক না থাকতো সেক্ষেত্রে তুই স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাস করতিস কি-না। বন্ধু ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ সূচক কোনো জবাব দিতে পারেনি!
“স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাস করি না, বা আস্তিকদের যুক্তি অপর্যাপ্ত” বলে নাস্তিকরা কিন্তু চুপ-চাপ থাকতে পারে না। বরঞ্চ বিভিন্নভাবে তাদের না-বিশ্বাসকে যুক্তি দিয়ে সমর্থন করারই চেষ্টা করা হয়। প্রকৃতপক্ষে, স্রষ্টার অনস্তিত্বের পক্ষে কেউ যুক্তি উপস্থাপন করার সাথে সাথে তার কাছে সেটা একটা ধনাত্মক বিশ্বাস হয়ে যায়। ফলে বার্ডেন-অব-প্রুফ তার ঘাড়েও বর্তায়।
প্রত্যেকেই একটি নিদ্রিষ্ট বয়স পর্যন্ত আস্তিক থাকার পর নাস্তিক হয়। ফলে বার্ডেন-অব-প্রুফ স্বাভাবিকভাবেই নাস্তিকদের ঘাড়ে বর্তাবে, যেহেতু তারাই বিশ্বাস পরিবর্তন করেছে। ধরা যাক, একটি কোম্পানিতে একশ’ জন লোক একসাথে যোগ দিলেন। দশ বছর চাকরি করার পর পাঁচ জন অব্যাহতি দিলেন। যে পাঁচ জন অব্যাহতি দিলেন তাদেরকেই কিন্তু অব্যাহতির কারণ দর্শাতে হবে। এখন এই পাঁচ জন লোক যদি উল্টোদিকে বাকি পঁচানব্বই জনকে "কেন তারা চাকরি করছেন" তার কারণ দর্শাতে বলে তাহলে ব্যাপারটা হাস্যকর শুনাবে নিশ্চয়। পাঁচ জন লোক কী কারণে বিশ্বাস পরিবর্তন করলেন, সেটা তাদেরকেই ব্যাখ্যা করতে হবে। তারা যদি ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হয় সেক্ষেত্রে তাদের সামনে কিছু পথ খোলা আছে: আস্তিকদেরকে বিজয়ী হিসেবে মেনে নিতে হবে; অথবা স্রষ্টার অস্তিত্বকে মেনে নিতে হবে; অথবা না-স্রষ্টায় বিশ্বাসকে মেনে নিতে হবে। অন্যদিকে আস্তিকরা যেহেতু জন্মগতভাবে স্রষ্টায় বিশ্বাস করে আসছে সেহেতু তাদেরকে স্রষ্টার অস্তিত্ব প্রমাণ করার দরকার নাই। সুতরাং আস্তিকরা স্রষ্টায় বিশ্বাস অব্যাহত রেখে নাস্তিকদের কোর্টে বল ছুঁড়ে দিয়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমাতে পারে, যে সুযোগ কিন্তু নাস্তিকদের নেই। অর্থাৎ নাস্তিকদেরকেই সবসময় চাপের মুখে থাকতে হবে।
স্রষ্টার অস্তিত্ব যে পরীক্ষামূলকভাবে প্রমাণ করা সম্ভব নয় সেটা যুক্তিবাদী মানুষ মাত্রই বোঝার কথা। নাস্তিকরা যদি এ'রকম কোনো প্রমাণের জন্য অপেক্ষা করে থাকেন তাহলে তারা নিঃসন্দেহে বোকার স্বর্গে বাস করছেন। তারা যে কার জন্য অপেক্ষা করছেন, কে জানে! কে তাদেরকে স্রষ্টার অস্তিত্ব পরীক্ষামূলকভাবে প্রমাণ করে দেখাবে! রোবট কী করে মানুষের অস্তিত্ব প্রমাণ করবে! তার মানে কি মানুষ বলে কিছু নাই?! বেশীরভাগ নাস্তিক দুর্বল চিত্তের কিছু আস্তিকদের সাথে বিতর্কে প্রচলিত কিছু বিশ্বাস ও ধর্মকে টেনে এনে প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করার চেষ্টা করেন। কিন্তু দুর্বল চিত্তের কিছু আস্তিককে বিতর্কে হারিয়ে দিলেই স্রষ্টা ‘নাই’ হয়ে যায় না! প্রচলিত বিশ্বাস ও আস্তিকদের যুক্তি ছাড়াই নাস্তিকরা কি স্বতন্ত্রভাবে স্রষ্টার অনস্তিত্বের স্বপক্ষে যুক্তি-প্রমাণ দাঁড় করাতে পারবেন? নাস্তিকদের আরেকটি অজ্ঞতা হচ্ছে স্রষ্টার প্রসঙ্গ উঠলেই তারা ইতিহাস থেকে বিভিন্ন গড ও দেব-দেবীর নাম টেনে নিয়ে এসে পানি ঘোলা করার চেষ্টা করেন। কেউ কেউ আবার ভূ-কেন্দ্রিক বিশ্বের উদাহরণ নিয়ে এসে বলেন, “পৃথিবীর তাবৎ মানুষ একটা সময় পর্যন্ত ভূ-কেন্দ্রিকতাকে বিশ্বাস করতো। কিন্তু পরবর্তীতে কিছু বিজ্ঞানী এসে তাদের সেই বিশ্বাসকে ভুল প্রমাণ করেছেন।” এ'রকম একটি তুলনাকে কীসের সাথে কীসের তুলনা বলা যাবে, কে জানে! তার মানে তারা স্রষ্টাকেও বিজ্ঞানের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছেন। তা-ই যদি হয়, তাহলে তাদের ঘাড়েই কিন্তু স্রষ্টার অনস্তিত্ব প্রমাণ করার দায়িত্ব থেকে যাচ্ছে। অধিকন্তু, তাদের এই ‘যুক্তি’ দিয়েই কিন্তু তাদের যুক্তিকে খণ্ডন করা সম্ভব। যেমন, তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী এই মহাবিশ্বের কোনো স্রষ্টা নাই। কিন্তু বিজ্ঞান তো আজ বাদে কাল স্রষ্টার অস্তিত্ব প্রমাণ করতেও পারে! স্রষ্টায় বিশ্বাস যেহেতু আস্তিকদের তত্ত্ব সেহেতু নাস্তিকরা যদি এই তত্ত্বের উপর আস্থা রাখতে না পারে সেক্ষেত্রে এই বিতর্কের কোনোই শেষ নেই। ফলে আস্তিকরাই কিন্তু চূড়ান্ত বিজয়ী হিসেবে থেকে যাবে। অকাট্য প্রমাণ ছাড়া মানুষ কোন্ দুঃখে এ'রকম একটি তত্ত্বকে পরিত্যাগ করবে? যুক্তিবাদী মানুষ জেনে-শুনে কেনই বা এতবড় ঝুঁকি নিতে যাবে? নাস্তিকরা কি অধিকতর ভালো কোনো তত্ত্ব অফার করতে পেরেছেন? স্রষ্টায় বিশ্বাসের একমাত্র বিকল্প তত্ত্ব হচ্ছে না-স্রষ্টায় বিশ্বাস – মানে নাস্তিকতা। এ ছাড়া আসলে অন্য কোনো তত্ত্ব দাঁড় করানোও অসম্ভব। এই সুস্পষ্ট সীমাবদ্ধতা তারা যেন বুঝতেই চায় না। তবে হ্যাঁ, বিকল্প একটি তত্ত্ব আছে আর সেটি হচ্ছে মানুষকে অমরত্ব অর্জন করতে হবে। নাস্তিকরা কি অমরত্ব অর্জনের ফর্মুলা আবিষ্কার করতে পারবেন? বিতর্কের চূড়ান্ত অবসানকল্পে নাস্তিকদের জন্য এটি একটি ফলসিফিকেশন টেস্ট হতে পারে। আস্তিকদের কোনো তাড়াহুড়া নেই, যেহেতু তারা সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত স্রষ্টার স্বপক্ষে তাদের নিজস্ব যুক্তিকেই তারা যথেষ্ট বলে মনে করে। নাস্তিকরা তাতে দ্বিমত পোষণ করলে তাদেরকেই বলতে হবে আর কীভাবে প্রমাণ দেখালে তারা স্রষ্টায় বিশ্বাস করবেন, এবং কেন। এক্ষেত্রেও কিন্তু বার্ডেন নাস্তিকদের ঘাড়েই থাকছে।
*****
আমি, “হুমম…আমি তো এতদিন ধরে শুনে এসেছি স্রষ্টায় বিশ্বাস নিছকই একটি অন্ধ বিশ্বাস! তুই আবার এসব কী আবল-তাবল বলছিস?”
আমি বন্ধুর প্রশ্ন ও যুক্তিগুলোর তেমন কোনো পাল্টা যুক্তিসম্মত জবাব দিতে পারিনি। দর্শনশাস্ত্রের কিছু প্রচলিত যুক্তি দিয়েও তাকে বাঁটে আনতে পারলাম না।
অর্থাৎ আমার বন্ধু বলতে চাইছে,
“তুই যা-ই বলিস না কেন, স্রষ্টায় বিশ্বাস কোনোভাবেই অন্ধ বিশ্বাস হতে পারে না। তার কারণ হচ্ছে এই বিশ্বাস অসংখ্য যুক্তি ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে যেগুলোকে কেউ অস্বীকার করতে পারে না। বিশ্বাস মানেই অন্ধ বিশ্বাস নহে। অনেকেই বিষয়টা নিয়ে সেভাবে ভাবে না।”
প্রশ্নোত্তর পর্ব:
বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম, “ ইহুদী, খ্রীষ্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম,… শিখদের তো আবার আলাদা-আলাদা স্রষ্টা ! তাহলে কোন্ স্রষ্টায় মানুষ বিশ্বাস করবে? ”
বন্ধু আমার এহেন ‘যৌক্তিক ও বুদ্ধিদীপ্ত’ প্রশ্নে কিছুটা ভ্যাবা-চ্যাকা খেয়ে বলে,
“তুই তো দেখি একজন বোকার হদ্দই রয়ে গেছিস! এই মহাবিশ্বের স্রষ্টা থেকে থাকলে কতগুলো থাকা উচিৎ বলে তুই মনে করিস? এই একবিংশ শতাব্দীতে তোর এই ‘যৌক্তিক ও বুদ্ধিদীপ্ত’ প্রশ্ন আসলে কোনো প্রশ্নই না। তোর এই প্রশ্ন শুনে গ্রামের লোকজনও হয়তো হাসিঠাট্টা করে বলবে, ‘উনি মনে হয় বান্দর ও মানুষের মাঝামাঝি কোনো এক প্রজাতি হবে!’ আমাকে বলেছিস ভালো কথা, অন্য কাউকে যেন মনের ভুলেও এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস না করিস। তবে তোর সন্দেহ থাকলে একাধিক স্রষ্টায়ও বিশ্বাস করতে পারিস! সেক্ষেত্রে আবার কিন্তু স্রষ্টার প্রকৃত সংখ্যা এবং তারা একে অপর থেকে স্বতন্ত্র কি-না – এরূপ অনেক জটিল প্রশ্ন চলে আসবে! আর তোকেই বা কোন্ স্রষ্টা সৃষ্টি করেছে সেটা জানবি কী করে? তাছাড়া গাছ-পালা-জীব-জন্তুর স্রষ্টা? পৃথিবীর স্রষ্টা? চন্দ্রের স্রষ্টা? সূর্যের স্রষ্টা? ন্যাচারাল ল্য’র স্রষ্টা? পানির স্রষ্টা? বাতাসের স্রষ্টা? নাস্তিকদের তো তাহলে কোনো স্রষ্টাই থাকবে না, যেহেতু তারা স্রষ্টার অস্তিত্বেই বিশ্বাস করে না! একজন স্রষ্টা সম্পূর্ণ মহাবিশ্বের জন্য যথেষ্ট হলে একাধিক স্রষ্টা কেন দরকার সেটা তোকেই ব্যাখ্যা করতে হবে। তাছাড়া একাধিক স্রষ্টার ক্ষেত্রে কিন্তু ‘দুর্বল স্রষ্টা’ ইসুও চলে আসবে! যারা একাধিক স্রষ্টার সম্ভাবনার কথা বলেন তাদেরকে প্রথমে স্রষ্টার প্রকৃত সংখ্যা নিশ্চিত হওয়ার পরই কেবল ‘স্রষ্টা আছে কি নেই’ বিতর্কে নামা উচিৎ। ধরা যাক, এই মহাবিশ্বের এক হাজার স্রষ্টা ধরে নিয়ে রিচার্ড ডকিন্স যুক্তি দিয়ে বা কম্পুটারের কীবোর্ড ঠেলে সবাইকে ‘নাই’ করে দিলেন। তারপর তিনি কীভাবে নিশ্চিত হবেন যে, আর কোনো স্রষ্টা নাই! একাধিক স্রষ্টার ক্ষেত্রে নাস্তিকরাই কিন্তু মহা বিপদে পড়ে যাবেন। কেননা তারা কতগুলো স্রষ্টাকে যুক্তি দিয়ে ‘নাই’ করে দেবেন সেটা তারা নিজেরাই জানেন না! প্রকৃতি না করুক, ভুলে-ভালে যদি একজন স্রষ্টা বাকি রয়ে যায় তাহলে কিন্তু তাদের খবর আছে! অতএব দেখা যাচ্ছে যে ‘একাধিক স্রষ্টা’ একটি অখণ্ডনযোগ্য এবং সেই সাথে অযৌক্তিক ও অবৈজ্ঞানিক বিশ্বাস।”
ছেদ
এবার তুই বল, “স্রষ্টা-ই যদি সবকিছু সৃষ্টি করে থাকে তাহলে স্রষ্টাকে আবার কে সৃষ্টি করেছে? ”
বন্ধু বলে,
“গুরুত্বপূর্ণ তবে গতানুগতিক একটি প্রশ্ন। আমার কথার উদ্দেশ্য কিন্তু স্রষ্টার সৃষ্টি নিয়ে নয়। তোর মূল প্রশ্ন অনুযায়ী আমি শুধু স্রষ্টায় বিশ্বাস একটি অন্ধ বিশ্বাস কি-না সেটাই দেখানোর চেষ্টা করছি। তবে নাস্তিকরাও কিন্তু আকস্মিক ঘটনায় বিশ্বাস করে। কেউ যদি প্রশ্ন করে আকস্মিক ঘটনাকে কে সৃষ্টি করেছে? – এর উত্তর কি তারা দিতে পারবে? নাস্তিকদের যেখানে ধাপে-ধাপে আকস্মিক ঘটনার উপর বিশ্বাস রাখতে হয় সেখানে এই মহাবিশ্বের নাড়ি-নক্ষত্র ব্যাখ্যার জন্য একমাত্র স্রষ্টায় বিশ্বাস কি বেশী যৌক্তিক নয়? সৃষ্টির কিছু কিছু বিষয়ের বাস্তবসম্মত ব্যাখ্যার জন্য বিজ্ঞান আছে। বিজ্ঞান এখানে সাহায্যকারী একটি টুল হিসেবে কাজ করবে। তাছাড়া ব্যাপারটা এভাবেও চিন্তা করতে পারিস: (ক) স্বয়ংক্রিয়ভাবে মানুষ সৃষ্টি হয়ে প্রাকৃতিক বস্তু দিয়ে কম্পুটার ও রোবটের মতো কিছু মেশিন বানিয়েছে; (খ) স্বয়ংক্রিয়ভাবে স্রষ্টা সৃষ্টি হয়ে মানুষ-সহ বিলিয়ন বিলিয়ন মেশিন সৃষ্টি করেছে। ‘ক’ যদি সত্য হয় তাহলে ‘খ’ সত্য হবে না কেন? নাস্তিকদের বিশ্বাস অনুযায়ী স্বয়ংক্রিয়ভাবে মানুষের মতো বুদ্ধিমান প্রাণী সৃষ্টি হয়ে যদি কিছু করতে পারে, তাহলে একই যুক্তি অনুযায়ী স্বয়ংক্রিয়ভাবে স্রষ্টা সৃষ্টি হয়ে মানুষের চেয়ে অ-নে-ক বেশী কিছু করতে পারবে না কেন? সর্বোপরি, সংজ্ঞা অনুযায়ী স্রষ্টার কোনো স্রষ্টা থাকতে পারে না। ইট ডাজ নট মেক এনি সেন্স!”
* “ আচ্ছা, স্রষ্টায় বিশ্বাসের প্রশ্ন আসছেই বা কেন? মানুষ কি তাহলে আবেগ দিয়ে স্রষ্টায় বিশ্বাস করে?”
বন্ধুর উত্তর,
“আরে হোঁদল, এতক্ষণ ধরে তাহলে কী বক-বক করলাম? স্রষ্টা ছাড়া বিলিয়ন বিলিয়ন বছর ধরে বিলিয়ন বিলিয়ন প্রক্রিয়া নির্ধারিতভাবে কাজ করার সম্ভাবনা একেবারেই শূন্য। শুধুই বোবা-কালা-অন্ধ-অচেতন প্রকৃতি দিয়ে এই অসাধারণ ও বিস্ময়কর ফিনমিন্যানকে ব্যাখ্যা করা যায় না। এ জন্যই অনেকে স্রষ্টায় বিশ্বাস করে। কেউ কেউ আবেগ দিয়েও বিশ্বাস করতে পারে, যারা এভাবে চিন্তা করে না।”
* “আচ্ছা, সবকিছুতেই যদি স্রষ্টার ‘পরম হাতের ছোঁয়া’ থাকে তাহলে বিজ্ঞানীরা আবার কী করবেন? তারা কি বসে বসে ঘোড়ার ঘাস কাটবেন? তাদের গবেষণায় বাধার সৃষ্টি হবে না? ”
বন্ধু কিছুটা রাগান্বিত স্বরে,
“এমন আজগুবি কথা কে বলে-রে? বিজ্ঞানীদের কাজ করতে সমস্যা হবে কেন? মনে কর, মাইক্রোসফট কোম্পানি থেকে কিছু ইলেকট্রনিক্স আইটেম বানিয়ে একটি ইউনিভার্সিটির ল্যাবে পাঠানো হলো। এবার ছাত্র-শিক্ষকরা কি এগুলো নিয়ে বসে বসে ঘোড়ার ঘাস কাটবে? তারা যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে পারবে না কেন? যন্ত্রপাতি খুলে তাদের কার্যপ্রণালীই বা জানতে পারবে না কেন? যন্ত্রপাতির উপর মাইক্রোসফট কোম্পানির ‘হাতের ছোঁয়া’ আছে বলে কোনো কাজ কি বন্ধ থাকবে? এটা কারো কারো যুক্তির সীমাবদ্ধতা অথবা স্রষ্টাকে এড়ানোর একটি ছুতাও হতে পারে। তবে গ্যালিলিও, নিউটন, লুই পাস্তুর, ও আব্দুস সালাম প্রমুখদের কিন্তু কোনো সমস্যা হয়নি। কেউ কেউ অযাচিতভাবে বিজ্ঞান বিষয়ক গবেষণার মধ্যে স্রষ্টাকে টেনে এনে বোকার মতো কথাবার্তা বলেন।”
*, ” আচ্ছা, স্রষ্টা থেকে থাকলে সুনামি, ভূমিকম্প, রোগ-আপদ ইত্যাদিতে যে হাজার-হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে তার ব্যাখ্যা কী? ”
বন্ধুর জবাব,
“ওয়েল, প্রথমত, এর কোনো সদুত্তর আমার জানা নেই। দ্বিতীয়ত, তুই-আমি এ বিষয়ে প্রশ্ন করার কে? আমরাই বা তাদের রক্ষা করতে পারছি না কেন? তোর-আমারই বা নিশ্চয়তা কোথায়! যেকোনো মুহূর্তে তুই-আমিও তো তাদের মতো ‘দূর্ভাগা’ হতে পারি! তৃতীয়ত, এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে মাত্রা পরিবর্তন করতে হবে। অর্থাৎ পার্থিব জগৎ থেকে জানা সম্ভব নয়। শুধুই পার্থিব দৃষ্টিকোণ থেকে সবকিছু বিচার না করে অপার্থিব দৃষ্টিকোণ থেকেও ভাবতে হবে। তবে একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। মনে কর, ঢাকার এক বাড়িতে তুই ভালো ভাবেই বাস করছিস। হঠাৎ করে কোনো এক দৈব দূর্বিপাক এসে তোর বাড়ির পাশের বস্তির লোকগুলোকে তুলে নিয়ে গিয়ে উন্নত বিশ্বের কিছু শহরে রেখে দিল। সেখানে তারা তোর চেয়ে অনেক উন্নত জীবনা-যাপন করছে। তুই এ বিষয়ে কিছুই জানিস না। তুই হয়তো মনে করছিস যে তারা মরে ভূত হয়ে গেছে! তাদের জন্য হয়তো করুণাও হচ্ছে এই ভেবে যে, একে তো বস্তির লোকজন তারপর আবার তাদের উপরই এমন মহা বিপদ নেমে এলো! এবার বিষয়টা ভেবে দ্যাখ। ”
* সেদিনের মতো বন্ধুকে আমার শেষ প্রশ্ন, “আচ্ছা স্রষ্টায় বিশ্বাসকে কি ডগম্যাটিক বলা যেতে পারে?”
বন্ধুর সোজা-সাপ্টা জবাব, “অসম্ভব! তা হতেই পারে না! এমন বে-আক্কল কথা কে বলেছে? এতক্ষণ ধরে তাহলে কী বক-বক করলাম?
স্রষ্টা ছাড়া বিলিয়ন বিলিয়ন বছর ধরে বিলিয়ন বিলিয়ন প্রক্রিয়া নির্ধারিতভাবে কাজ করার সম্ভাবনা একেবারেই শূন্য। শুধুই বোবা-কালা-অন্ধ-অচেতন প্রকৃতি দিয়ে এই অসাধারণ ও বিস্ময়কর ফিনমিন্যানকে ব্যাখ্যা করা যায় না। এ জন্যই অনেকে স্রষ্টায় বিশ্বাস করে। কেউ কেউ আবেগ দিয়েও বিশ্বাস করতে পারে, যারা এভাবে চিন্তা করে না।” নাস্তিকরা এ পর্যন্ত তাদের বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের স্বপক্ষে স্বতন্ত্র কোনো তত্ত্ব দাঁড় করাতে সক্ষম হয়নি। এই অস্বস্থিকর অবস্থা এড়াতে তারা বিজ্ঞানের মধ্যে মাথা গোঁজা শুরু করেছেন। অর্থাৎ বিজ্ঞানকে স্রষ্টার ‘বিকল্প তত্ত্ব’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে উঠে-পড়ে লেগেছেন। কিন্তু তারা যেটা বুঝতে চায় না সেটা হচ্ছে বিজ্ঞান নিজে যেমন ‘বিকল্প স্রষ্টা’ নয় তেমনি আবার বিজ্ঞানীরা স্রষ্টা নিয়ে গবেষণাও করেন না! তাছাড়া বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার যত বেশী হবে, যত বেশী জটিল হবে, যত বেশী বিস্ময়কর হবে, সেটা তত বেশী স্রষ্টার অস্তিত্বের প্রতিই দিক নির্দেশ করবে, অনস্তিত্বের দিকে নয়। ফলে প্রত্যেকটি বিস্ময়কর আবিষ্কার স্রষ্টার অস্তিত্বের সাগরে একেকটি মূল্যবান বিন্দু। কেননা প্রত্যেকটি আবিষ্কার একেকটি তথ্য বহন করে। এই মহাবিশ্বে তথ্যের পরিমাণ যত বেশী হবে, সেটা তত বেশী একজন স্বজ্ঞাত সত্তার প্রতিই দিক নির্দেশ করবে, অকস্মিক ঘটনার দিকে নয়। একটি বিশ্বাসকে তখনই অন্ধ বিশ্বাস বলা যাবে যখন তার স্বপক্ষে বিশ্বাসযোগ্য কোনো যুক্তিই দাঁড় করানো সম্ভব হবে না। স্রষ্টার অস্তিত্ব পরীক্ষামূলকভাবে প্রমাণ করা সম্ভব না হলেও তার স্বপক্ষে অনেক জোরালো যুক্তি আছে। সবচেয়ে বড় যুক্তি হচ্ছে জীবজগত-সহ এই বিশাল মহাবিশ্ব। ওহ্ হ্যাঁ, আমি এ পর্যন্ত যা বলেছি তার সবকিছুই কিন্তু বোবা-কালা-অন্ধ-অচেতন ও উদ্দেশ্যহীন বিবর্তনের ফলাফল। লেখার মধ্যে কোনো রকম বুদ্ধিমত্তা কাজ করেনি! আর বোবা-কালা-অন্ধ-অচেতন ও উদ্দেশ্যহীন বিবর্তনের ফলাফল হওয়াতে আমার কোনো কথায় মন খারাপ করতেও পারবি না কিন্তু! তবে মন খারাপ করলে সেটাও হবে বোবা-কালা-অন্ধ-অচেতন ও উদ্দেশ্যহীন বিবর্তনের ফলাফল!”
*****
ও-য়া-ও! বন্ধুর এমন দাঁতভাঙ্গা ঝাড়ির যে কী জবাব দেব বুঝতে পারছি না! তার বেশীরভাগ কথাবার্তাই মাথার উপর দিয়ে গেছে ! কোনো স্বহৃদয় নাস্তিক কি এ যাত্রা থেকে আমাকে রক্ষা করতে পারবেন?
কৃতজ্ঞতা:এস.এম.রায়হান,সদালাপ ব্লগ।
প্রথম প্রকাশ:২০০৯