এক.
মুসলিম মাত্রই বিশ্বাস করেন যে কুরআন আল্লাহ প্রেরিত গ্রন্থ। তারা এও বিশ্বাস করেন, কুরআনে যেহেতু আল্লাহপাক বলেছেন তিনি কুরআনকে সংরক্ষণ করবেন, কাজেই কুরআন অবশ্যই অবিকৃত ও অপরিবর্তিত আছে এবং থাকবে। কিন্তু কথা হলো, এই যে কুরআনে বলা আছে যে, কুরআন আল্লাহপাক সংরক্ষণ করবেন, এই কথাটিই যে অবিকৃত ও অপরিবর্তিত আছে, তার প্রমাণ কী? পূর্ববর্তী কোন আসমানী কিতাবই তো অবিকৃত ও অপরিবর্তিত নেই। বলা হতে পারে, উসমান(রা.) যে কুরআনের কপি তৈরি করেছিলেন, সেটা তো অদ্যাবধি সংরক্ষিত আছে। সেই কপির সাথে বর্তমানে আমাদের হাতে যে কুরআন আছে তার কোন পার্থক্য সেই। কাজেই আমরা বলতে পারি কুরআন অবিকৃত ও অপরিবর্তিত আছে। কিন্তু আমাদের এটাও জানা থাকা উচিত যে উসমান(রা.) এর কপিতে যের, যবর, পেশ তো নেইই; নুকতা পর্যন্ত নেই।
চিত্র: উসমানী মূসহাফ ।
মনেকরুন, উসমানী(রা.) কপিতে নিচের শব্দটা পাওয়া গেল
নুকতাবিহীন অবস্থায় ছবি তে দেখুন ।
তাহলে এটার উচ্চারণ কী হবে? فنبينوا,فنثبتوا,فيبينوا,فيثبتوا,فتبينوا,فتثبتوا,….না অন্য কিছু… সবগুলোই উসমানী(রা.) কপির নুকতাবিহীন স্ট্রাকচারের সাথে খাপে খাপে মিলে যায় । এমনকি আপনি যদি আরবী পড়তে জানা আরবীও হন তবু আপনি এখান থেকে আসল শব্দটা উদ্ধার করতে পারবেন না । এজন্য আপনাকে জানতে হবে ক্বিরাআত । ক্বিরাআত জানা ছাড়া উসমানী(রা.) কপি হতে কুরআনের আসল উচ্চারণ বের করা সম্ভব নয়। আমাদের পূর্বসূরীগণ ক্বিরাআত গ্রহণের ক্ষেত্রে যে পদ্ধতি অবলম্বন করতেন তা হলো,
তাঁরা কখনো উসমানী (রা.) কপির সাথে মিলে এবং ব্যকরণগতভাবে সঠিক এমন যে কোন ক্বিরাআতই গ্রহণ করতেন না, বরং কেবলমাত্র সহিহ বর্ণনাসূত্রে প্রাপ্ত মুতাওয়াতির বর্ণনাই গ্রহণ করেছেন।
“সহিহ বর্ণনাসূত্র” এবং “মুতাওয়াতির বর্ণনা” কুরআন সংরক্ষণের দুটি অপরিহার্য হাতিয়ার।
প্রকৃতপক্ষে উসমানী(রা.) কপির সাথে সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে কুরআনের শত শত নয় বরং হাজার হাজার রূপ দাঁড় করানো সম্ভব। কিন্তু আল্লাহপাক কুরআন সংরক্ষণের এমন দুইটি হাতিয়ার (“সহিহ বর্ণনাসূত্র” এবং “মুতাওয়াতির বর্ণনা”) আমাদের দান করলেন যার ফলে আমরা কেবলমাত্র রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে বর্ণিত অবিকৃত ও অপরিবর্তিত ক্বিরাআত (সমূহ)-ই পাই । [ সাত হরফ ও সাত ক্বিরাআত সম্পর্কে জানুন এখানে ] পৃথিবীতে সবচেয়ে প্রচলিত ক্বিরাআত হচ্ছে “হাফস”, এছাড়া কম প্রচলিত ক্বিরাআতের মধ্যে রয়েছে “ওয়ারশ” এবং “ক্বলুন”।
হাফস ক্বিরাআত আমরা কার কাছ থেকে কীভাবে পেলাম?
চিত্র: হাফস কুরআনের বর্ণনা সুত্র ।
“হাফস” ক্বিরাআত আমরা যার থেকে পেয়েছি তিনি হলেন হাফস ইবনে সুলাইমান (মৃত্যু ১৮০ হিজরিতে) উনি যার নিকট হতে পেয়েছেন তিনি হলেন ১. আসিম ইবনে (বাহদালাহ ইবনে)আবি আন নাজুদ (মৃত্যু ১২৭ হিজরিতে) ২. উনি দু'জন হতে পেয়েছেন ২.১ আবু আব্দুর রহমান আস সুলামমি ২.২ জির ইবনে হুবাইশ আবু আব্দুর রহমান আস সুলামমি যাদের থেকে পেয়েছেন তারা হলেন: ২.১.১ উসমান (রা.), ২.১.২ আলি ইবনে আবি তালিব(রা.) ২.১.৩ উবাই ইবনে কা'ব (রা.) ২.১.৪ যায়িদ ইবনে সাবিত (রা.) উনারা প্রত্যেকে পেয়েছেন ৩. রাসূলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে । জির ইবনে হুবাইশ যার থেকে পেয়েছেন তিনি হলেন ২.২.১ ইবনে মাসউদ উনি পেয়েছেন ৩. রাসূলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে ১<২.১<২.১.১<৩ ১<২.১<২.১.২<৩ ১<২.১<২.১.৩<৩ ১<২.১<২.১.৪<৩ ১<২.২<২.২.১<৩ । এই বর্ণনাসূত্রগুলো প্রত্যেকটি সহিহ । কারণ প্রতিটি চেইনের বর্ণনাকারিগণ সকলেই বিশ্বস্ত, আমানতদার, সত্যবাদি এবং কোন চেইনে কোন অসামঞ্জস্যতা/অসম্ভাব্যতা নেই ।
আবার এই বর্ণনা মুতাওয়াতির কারণ ২.x লেভেলে দুইজন আছেন আর ২.x.y লেভেলে আছেন ৫ জন এবং উনাদের পক্ষে একইসাথে কোন মিথ্যার ওপর একমত হওয়া অসম্ভব। একই কথা অনান্য বিশুদ্ধ কিরআতের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
চিত্র: ওয়ারশ ও ক্বালুন কিরআত এর বর্ণনা সুত্র।
কাজেই একই সাথে আল-কুরআনের বোধগম্য পূর্ণরূপের জন্য আমরা যেমন ক্বিরাআতের ওপর নির্ভরশীল তেমনি ক্বিরআতের নির্ভুলতা সহিহ বর্ণনাসূত্র এবং মুতাওয়াতির বর্ণনার ওপর প্রতিষ্ঠিত ।
দুই.
আল-কুরআনকে পূর্ণরূপে পাবার জন্য 'মুতাওয়াতির বর্ণনা' এবং 'সহিহ বর্ণনা সূত্র' দুইটি গুরুত্বপূর্ণ টুল। আপনার কাছে যত প্রকারের দলিলই থাক না কেন, এই মুতাওয়াতির বর্ণনাকে পাশ কাটিয়ে আপনি আল-কুরআনের কোন বোধগম্য একক পূর্ণরূপ পেতে পারেন না।
মোটামুটিভাবে আমরা বলতে পারি,
আল-কুরআনের যে কোন আয়াতের বোধগম্য একক পূর্ণরূপের সঠিকত্ব = উসমানী(রা.) কপির সাথে সামঞ্জস্যতা + আয়াতের ক্বিরাআতের পক্ষে 'মুতাওয়াতির বর্ণনা' + আয়াতের ক্বিরাআতের পক্ষে 'সহিহ বর্ণনাসূত্র' ।
এখন 'মুতাওয়াতির বর্ণনা' এবং 'সহিহ বর্ণনাসূত্র' এই গুরুত্বপূর্ণ দুইটি টুলকে যদি প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়, তবে তা আল-কুরআনের সঠিকত্বকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলবে।
নোট: সঠিকত্ব বলতে 'নাযিলকৃত আল–কুরআন' এর সাপেক্ষে 'আমাদের প্রচলিত আল–কুরআন' এর সঠিকত্বকে বুঝাচ্ছি ।
তিন.
'মুতাওয়াতির বর্ণনা' এবং 'সহিহ বর্ণনাসূত্র' এই টুল দুটোকে যেমন আল-কুরআনের সঠিকত্ব যাচাইয়ের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে, তেমনি 'মুতাওয়াতির বর্ণনা' এবং 'সহিহ বর্ণনাসূত্র' এই টুল দুটোকে হাদিসের সঠিকত্ব যাচাইয়ের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা হয়েছে ।
হাদিসের ক্ষেত্রে এই টুল দুটোকে সন্দেহযুক্ত মনে করে কুরআনের ক্ষেত্রে বিশ্বাসযোগ্য মনে করা অথবা যেসকল সাহাবী, তাবেঈন ও তাবে তাবেঈন হতে আমরা কুরআনের কিরাআত পেলাম; কুরআনের ব্যাপারে তাদেরকে বিশ্বস্ত মনে করে হাদিসের ব্যাপারে অবিশ্বস্ত মনে করা- কেবল অযৌক্তিকই নয় সুস্হ চিন্তাধারারও বিপরীত।
চার.
আল-কুরআনের বর্ণনা মুতাওয়াতির এবং বর্ণনাসূত্র সহিহ। সোজা করে বললে কুরআনের প্রতিটি আয়াত সহিহ এবং মুতাওয়াতির।
অন্য দিকে সকল হাদিস মুতাওয়াতির নয়, সহিহ নয় বা একইসাথে মুতাওয়াতির ও সহিহ নয়। তবে সহিহ সূত্রের মুতাওয়াতির বর্ণনার হাদিসও কিন্তু রয়েছে। (উল্লেখ্য, রজমের পক্ষে সহিহ বর্ণনাসূত্রের মুতাওয়াতির বর্ণনা রয়েছে।) আল-কুরআনের এক আয়াতকে আরেক আয়াতের আপাতবিরোধি মনে হলেই, আমরা যেমন একটি সহিহ এবং মুতাওয়াতির আয়াত রেখে অন্য সহিহ এবং মুতাওয়াতির আয়াতটি ছুঁড়ে ফেলতে পারি না, বরং আয়াত দুটোর মাঝের সামঞ্জস্যতা বুঝবার চেষ্টা করি; তেমনি আল-কুরআনের কোন আয়াতকে হাদিসের কোন সহিহ এবং মুতাওয়াতির বর্ণনার সাথে আপাতবিরোধি মনে হলেই, আমরা সহিহ এবং মুতাওয়াতির বর্ণনার হাদিসটিকে ছুঁড়ে ফেলতে পারি না। বরং একই পদ্ধতিতে দুটি বর্ণনার মধ্যে সামঞ্জস্যতা বুঝবার চেষ্টা করাটাই যৌক্তিক। কুরআনের কোন একটি আয়াতের ব্যাপক নির্দেশকে কুরআনের অন্য কোন আয়াত সীমিত বা সুনির্দিষ্ট করার যতটুকু যৌক্তিক অধিকার রাখে, সহিহ-মুতাওয়াতির সুন্নাহও ঠিক ততটুকুই যৌক্তিক অধিকার রাখে।
নোট: এই লেখায় কোন ভাবেই কুরআন ও সুন্নাহকে সমকক্ষ দেখাবার চেষ্টা করা হয় নাই। এখানে শুধু দেখাতে চেষ্টা করা হয়েছে, কুরআনের অবিকৃতি যে বিষয়গুলোর ওপর নির্ভরশীল; সেই বিষয়গুলোকে হাদিসের ক্ষেত্রে বিতর্কিত করা বস্তুত কুরআনের সঠিকত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করারই নামান্তর ।
আনুসাঙ্গিক প্রয়োজনীয় পাঠ:
Conditions For The Validity Of Different Qirâ'ât:
Conditions were formulated by the scholars of the Qur'anic recitation to facilitate critical analysis of the above mentioned recitations. For any given recitation to be accepted as authentic (Sahih), it had to fulfill three conditions and if any of the conditions were missing such a recitation was classified as Shâdhdh (unusual). The first condition was that the recitation have an authentic chain of narration in which the chain of narrators was continuous, the narrators were all known to be righteous and they were all knwon to possess good memories. It was also required that the recitation be conveyed by a large number of narrators on each level of the chain of narration below the level of Sahaabah (the condition of Tawaatur). Narrations which had authentic chains but lacked the condition of Tawaatur were accepted as explanations (Tafseer) of the Sahaabah but were not considered as methods of reciting the Qur'an. As for the narrations which did not even have an authentic chain of narration, they were classified as Baatil (false) and rejected totally.
The seond condition was that the variations in recitations match known Arabic grammatical constructions. Unusual constructions could be verified by their existence in passages of pre-Islamic prose or poetry.
The third condition required the recitation to coincide with the script of one of the copies of the Qur'an distributed during the era of Caliph cUthmân. Hence differences which result from dot placement (i.e., ta'lamoon and ya'lamoon) are considered acceptable provided the other conditions are met. A recitation of a construction for which no evidence could be found would be classified Shaadhdh. This classification did not mean that all aspects of the recitation was considered Shaadhdh. it only meant that the unverified constructions were considered Shaadhdh.
কৃতজ্ঞতা: মুহাম্মদ সাদাত , সদালাপ ব্লগ ।
২০১৩