ভুমিকা:
দাসপ্রথা ইতিহাসের ন্যাক্কারজনক কর্মকাণ্ডের এক জঘন্যতম উদাহরণ। মুসলিম নব্য শিক্ষিতদেরকে ইসলামের প্রতি বিরূপ ও শত্রুতাভাবাপন্ন করে তোলার জন্যে ইসলামবিদ্বেষীরা সাধারণত এই অস্ত্রটিই বেশী ব্যবহার করে থাকে।
তাদের বক্তব্য হলো,
“ ইসলাম যদি সকল যুগের জন্যেই গ্রহণযোগ্য হতো এবং মানুষের সকল প্রয়োজনই মেটাতে পারত তাহলে কস্মিনকালে মানুষকে দাস বানানোর অনুমতি দিত না। এমনকি দাসপ্রথাকে বরদাশতও করতে পারত না। এই দাস সমস্যাই একথা সুস্পষ্টরূপে প্রমাণ করে যে, এই জীবনব্যবস্থা কেবল একটি বিশেষ যুগের জন্যেই উপযুক্ত ছিল; এখন উহার কোন প্রয়োজন নেই। স্বীয় লক্ষ্য অর্জিত হওয়ার পর উহা আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। ”
সন্দেহের আবর্তে সংশয়ের এই বাস্তব পরিবেশে মুসিলম যুবকেরাও দিশেহারা হয়ে পড়ছে। তারাও আজ দ্বিধা ও সংকোচের শিকার হয়ে ভাবতে শুরু করেছে,
ইসলাম দাসপ্রথার অনুমতি কেমন করে দিল?
ইসলাম আল্লাহর দেয়া জীবনব্যবস্থা। সকল যুগের সকল এলাকার মানুষের উন্নতিই ইসলামের লক্ষ্য। কিন্তু ইহা দাসপ্রথাকে কেমন করে সমর্থন করলো?
পরিপূর্ণ সাম্যের মূলনীতির উপর ইসলাম সুপ্রতিষ্ঠিত- যা বিশ্বের সকল মানুষকেই একই পিতা-মাতার সন্তান হিসেবে গণ্য করে যা এই পূর্ণাংগ সাম্যের ভিত্তিতে একটি নবতর আদর্শ মানবসমজা বাস্তবেই গঠন করে দেখিয়েছে সেই ইসলাম উহার সমাজব্যবস্থায় দাসপ্রথাকে কেমন করে গ্রহণ করলো এবং কেমন করেই বা উহার জন্যে বিভিন্ন আইন-কানুন নির্ধারণ করলো?
আল্লাহ কি এ-ই চান যে, মানবজাতি প্রভু ও দাস নামে দু’টি চিরস্থায়ী শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে থাকুক? তিনি কি ইহা কামনা করেন যে, মানুষের একটি শ্রেণী ইতবর বা বোবা জন্তুর ন্যায় হাটে-বাজারে বেচা-কেনা হতে থাকুক? –অথচ তিনিই তো তার পবিত্র গ্রন্থে ঘোষণা করেছেন:
(وَلَقَدْ كَرَّمْنَا بَنِىٓ ءَادَمَ) –“এবং নিশ্চয়ই আমি বনি আদমকে সম্মানিত করেছি।” (প্রাসঙ্গিক অংশ , আল কুরআন, সূরা বানি ঈসরাঈল: ১৭:৭০)
আর তিনি যদি ইহা কামনা না করে থাকেন তাহলে তিনি তাঁর গ্রন্থে কেন ইহাকে মদ, জুয়া, সুদ ইত্যাদির ন্যায় স্পষ্ট ভাষায় নিষিদ্ধ ঘোষণা করেননি?
মোটকথা আজকের মুসলমান যুবকরা একথা তো অবশ্যই জানে যে, ইসলামই প্রকৃত দ্বীন। কিন্তু তারা হযরত ইব্রাহীম (আ)-এর ন্যায় দারুণ উৎকণ্ঠা ও অস্থিরতার শিকার।
এই অবস্থারই নিখুঁত চিত্র নিম্ন আয়াতে পরিস্ফুট হয়ে উঠছে:
(وَإِذْ قَالَ إِبْرَٰهِۦمُ رَبِّ أَرِنِى كَيْفَ تُحْىِ ٱلْمَوْتَىٰۖ قَالَ أَوَلَمْ تُؤْمِنۖ قَالَ بَلَىٰ وَلَٰكِن لِّيَطْمَئِنَّ قَلْبِىۖ) “যখন ইব্রাহীম বলেছিলেন: হে আমার প্রবু, তুমি আমাকে দেখিয়ে দাও কিরূপে তুমি মৃতকে জীবিত কর। তিনি বললেন: তুমি কি বিশ্বাস কর না? সে বলল: বিশ্বাস তো অবশ্যই করি; তবে আমার আত্মা যেন সন্তোষ লাভ করে।” –(প্রাসঙ্গিক অংশ , আল কুরআন, আল বাকারা: ২:২৬০)
পক্ষান্তরে সাম্রাজীবাদী শক্তিগুলোর ইতরামি ও ষড়যন্ত্রের ফলে যাদের ধীশক্তি আজ আচ্ছন্ন- প্রত্যয় ও চিন্তধারা দিগভ্রষ্ট তারা কোন কিছুর মর্ম বা হাকীকত পর্যন্ত পৌঁছার চেষ্টা করতেই নারাজ। কোন সত্য উদঘাটনের জন্যে যে ন্যূনতম ধৈর্য ও উৎসাহের প্রয়োজন তাও তাদের নেই। বস্তুত তারা আবেগ ও প্রবৃত্তির স্রোতে ভেসে চলেছে; কোনরূপ চিন্তা-ভাবনা ব্যতিরেকেই তারা রায় দিচ্ছে: ইসলাম একটি পুরানো কাহিনী মাত্র। এখন উহার কোন প্রয়োজন নেই।
সমাজতান্ত্রিক প্রবঞ্চনার রহস্য:
সমাজতন্ত্রের প্রচারকরা মানুষকে এই বলে ধোঁকা দিচ্ছে যে, তারা হলো এক বৈজ্ঞানিক মতবাদের ধারক ও বাহক। কিন্তু তাদের বৈজ্ঞানিক মতাদর্শের প্রকৃত মর্ম হলো: উহা তাদের নিজস্ব চিন্তাধারার ফসল নয়, বরং তারা উহা ভিন দেশীয় প্রভুদের নিকট থেকে ধার করে এনেছে। অথচ এই ধার করা চিন্তাধারাকে তারা এমন ভাব-ভঙ্গিতে প্রচার করছে যে, যেন উহা এক অপরিবর্তনীয় চিরন্তন সত্য, উহার আবিষ্ককর্তা কেবল তারাই; উহার কোথাও দ্বিমতের অবকাশ নেই। তাদের সে সত্যটি (!) হলো ‘দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ’ (Dialectical Materalism)।
এই মতাদর্শ অনুযায়ী মানুষের জীবন কয়েকটি নির্দিষ্ট ও অপরিহার্য অর্থনৈতিক স্তর অতিক্রম করছে। প্রথম স্তর হলো সমাজবাদ। দ্বিতীয় স্তরে হলো দাসপ্রথা, সামন্তবাদ ও ধনতন্ত্র। আর তৃতীয এবং শেষ স্তর হলো দ্বিতীয় সমাজবাদ। এই মতাদর্শের দৃষ্টিতে এটাই হলো মানবেতিহাসের শেষ অধ্যায়। যে সকল প্রত্যয় ও চিন্তধারা এবং ব্যবস্থাপনা ও মতাদর্শের সাথে মানবেতিহাসের সম্পর্ক বিরাজমান উহা তাদের নিজ নিজ যুগের নির্দিষ্ট অর্থনীতি ও সামাজিক ঘটনাবলীর প্রতিধ্বনি মাত্র। এছাড়া আর কিছুই নয়। অতীতের জন্মলব্ধ বিশ্বাস ও মতাদর্শ এবং জীবনব্যবস্থাসমূহ নিজ নিজ যুগের জন্যে অবশ্যই কার্যকরী ছিল। কেননা তৎকালীন অর্থনৈতিক কাঠামো ও পরিবেশের সাথে উহার পরিপূর্ণ সামঞ্জস্য বর্তমান ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে অধিকতর উন্নত যুগের জন্যে উহা গ্রহণযাগ্য হতে পারেনি। কেননা প্রত্যেক যুগের অর্থনীতি ও পরিবেশ সম্পূর্ণ আলাদা; আর এই নীতি ও পরিবেশই হলো মতাদর্শ ও জীবনব্যবস্থার মূল ভিত্তি। অনস্বীকার্য যে, প্রত্যেক নতুন যুগের মতাদর্শ উহার পূর্ববর্তী যুগের চেয়ে উৎকৃষ্ট ও উন্নত। সুতরাং প্রমাণিত হলো যে, মানবজীবনের জন্যে এমন কোন একক চিরস্থায়ী জীবনব্যবস্থা রচিত হতে পারে না যা পরবর্তী সকল যুগের জন্যেই সমানভাবে কার্যকরী ও গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হবে।
ইসলাম এমন এক যুগে এসেছিল যখন দাস যুগের পরিসমাপ্তি ছিল আসন্ন এবং সামন্ত যুগ ছিল আগত প্রায়।
এ কারণেই ইসলাম এমন আইন-কানুন, বিম্বাস ও চিন্তাধারা উপস্থাপিত করেছে যাতে সেই যুগের অর্থব্যবস্থার পটভূমি ও পরিবেশ পূর্ণমাত্রায় প্রতিফলিত হয়েছে। তৎকালীণ প্রচলিত দাসপ্রথার সত্যায়ন এবং সামন্তবাদী ‘সমাজ ব্যবস্থার স্থায়ীকরণের কারণ ইহাই।
কেননা মহান (!) কালমার্কসের হৃদয়গ্রাহী ফরমান অনুযায়ী ইহা কখনো সম্ভবই ছিল না যে, পরবর্তী সময়ের অধিকতর উন্নত অর্থনৈতিক পরিবেশের অনুপস্থিতিতে ইসলাম তৎকালে উপযোগী আইন-কানুন ও জীবন পদ্ধতি রচনা করতে সক্ষম। সমাজতন্ত্রীদের এই প্রবঞ্চনার রহস্য কোথায়? এর উত্তর পেতে হলে আসুন, দাস সমস্যার সঠিক ইতিহাস এবং উহার সামাজিক ও মনস্তাত্বিক পটভূীম বিশ্লেষণ করে দেখি যে এর মূল কারণ কোথায়।
ইতিহাসের চোঁখে দাসপ্রথার ভয়ঙ্কর চিত্র :
আজ যদি কেউ বিংশ শতাব্দীর মন-মানসিকতার পটভূমিতে দাসপ্রথার কথা চিন্তা করে এবং মানুষের ক্রয়-বিক্রয় ও রোমকদের ন্যাক্কারজনক অপরাধের কথা স্মরণ করে তাহলে তার সম্মুখে দাসপ্রথার এক ভয়ঙ্কর চিত্র পরিস্ফুট হয়ে উঠবে। তখন সে একথা কিছুতেই মেনে নিতে পারবে না যে, কোন ধর্ম বা জীবনব্যবস্থা একে বৈধ বলে গণ্য করতে পারে কিংবা ইসলাম –যার বেশীর ভাগ আইন-কানুন ও নিয়ম-নীতিই মানুষকে দাসত্বের যাবতীয় শৃংখল থেকে মুক্তি প্রদানের উপর নির্ভরশীল –একে নির্দোষ বলে ফতুয়া দিতে পারে। কিন্তু এই চিন্তাধারার মূলে রয়েছে ইসলাম সংক্রান্ত সঠিক জ্ঞানের অভাব। কেননা দাস প্রথার এই ভয়ঙ্কর চিত্রের সাথে ইসলামের আদৌ কোন সম্পর্ক নেই। ইসলামের কীর্তি এই পর্যায়ে ঐতিহাসিক সাক্ষ্যের প্রতি আমরা একবার দৃকপাত করি। এ একটি ঐতিহাসিক সত্য যে, রোমকদের ইতিহাসের অন্ধকার ও ভয়ঙ্কর অপরাধের সাথে ইসলামী ইতহিাসের আদৌ কোন সম্পর্ক নেই। রোম সাম্রাজ্যে দাসেরা যে ধরনের জীবনযাপন করত তার বিস্তৃত সাক্ষ্য-প্রমাণ আমাদের নিকট বর্তমান। উহার আলোকে ইসলামের কারণে দাসদের জগতে যে অভাবনীয় বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল তা আমরা সহজেই উপলব্ধি করতে পারি। উহা ইসলামের এমন এক ভাস্বর ও অক্ষয় কীর্তি যে উহার পর দাসপ্রথা বিলোপের জন্য অন্য কিছুর প্রয়োজন হয়নি। ইসলাম শুধু এতটুকু করেই ক্ষান্ত হয়নি; বরং মানবীয় স্বাধীনতার প্রকৃত ধারণা তুলে ধরার সাথে সাথে বাস্তব ক্ষেত্রে উহাকে কার্যকরী করে দেখিয়েছে।
রোম সাম্রাজ্যে দাসপ্রথা:
রোমকদের রাজত্বকালে দাসদেরকে মানুষ বলেই গণ্য করা হতো না। তারা ছিল নিছক পণ্য সামগ্রী। অধিকার বলতে তাদের কিছুই ছিল না। অথচ তাদের পালন করতে হতো দুঃসহ ও কঠিনতম দায়িত্ব। এই দাসেরা আসত কোত্থেকে? এর সবচে’ বড় মাধ্যম ছিল যুদ্ধ। মহান কোন উদ্দেশ্য বা নীতির জন্যে এ সকল যুদ্ধ সংঘটিত হতো না। বরং অন্যকে দাস বানিয়ে নিজেদের হীনতম স্বার্থ উদ্ধারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার জন্যেই এ যুদ্ধগুলো করা হতো। এ সকল যুদ্ধে যাদেরকে বন্দী করা হতো তাদের সবাইকেই দাস বানানো হতো। রোমকরা এই সকল যুদ্ধের মাধ্যমে নিজেদের আরাম-আয়েশ, ভোগ-বিলাস ও সুখ-ঐশ্বর্যের দ্রব্য সামগ্রী, ঠাণ্ডা ও গরম গোছলখানা ও বহুমূল্য পোশাক-পরিচ্ছদ, মজাদার পানাহার ও আমোদ-প্রমোদের পথ প্রশস্ত করত। পতিতাবৃত্তি, মদ্যপান, নাচ-গান, ক্রীড়া-কৌতুক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছাড়া তারা যেন চলতে পারত না। জৈবিক আনন্দ, যৌন ব্যভিচার ও বিলাস-ব্যসনের উপায়-উপাদান হাসিল করার জন্যেই আনন্দ, যৌন ব্যভিচার ও বিলাস-ব্যসনের উপায়-উপাদান হাসিল করার জন্যেই তারা বাইরের এলাকাসমূহ আক্রমণ করত এবং সেখানকার নারী-পুরুষদেরকে গোলাম বানিয়ে তাদের ভয়ঙ্কর পশুপ্রবৃত্তির চরিতার্থ করত। ইসলাম যে মিসরকে রোমকদের সাম্রাজ্যবাদী পাঞ্জা থেকে মুক্ত করেছিল তা ছিল জঘন্যতম পাশবিকতার নিষ্ঠুর শিকার। মিসর ছিল তাদের যব উৎপাদনের প্রধান বাজার এবং ভোগ-বিলাসের দ্রব্য সামগ্রী সরবরাহের একটি উল্লেখযোগ্য মাধ্যম।
সেইখানে ছিলো দাসদের অন্যতম করুণ অবস্থা ।
রোমকদের সাম্রাজ্যবাদী লোভ-লালসা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে তাদের জৈবিক আনন্দ ও ভোগ-বিলাসের সামগ্রী সরবরাহ করার জন্যে দাসদেরকে পালে পালে পশুর মতো মাঠে নেয়া হতো। সেখানে (চতুষ্পদ প্রাণীর মত) তাদের সারাদিন পরিশ্রম করতে হতো। কিন্তু এ সত্ত্বেও পেট ভরে দু’ মুঠো খাবার তাদের নসীবে হতো না। বরং এত সামান্য খাবার তাদের সামনে ফেলে দেয়া হতো যে, তা খেয়ে কোন মতে তাদের প্রাণটি রক্ষা পেত এবং তাদের প্রবুদের কাজ করতে পারত। নিষ্প্রাণ বৃক্ষ এবং অন্য প্রাণীর চেয়েও তাদের অবস্থা নিকৃষ্ট ছিল্ দিনে যখন তাদেরকে কাজে খাটানো হতো তখন যাতে করে তারা রক্ষক বা প্রহরীদেরকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যেতে না পারে সেজন্যে তাদের পায়ে ও মাজায় লোহার বেড়ি পরিয়ে দেয়া হতো। কারণে-অকারণে তাদের পিঠে বৃষ্টির মত চাবুক মারা হতো। কেননা তাদের প্রভুরা কিংবা তাদের স্থানীয় কর্মীরা তাদেরকে ইতর জীবের মত প্রহার করতে বড়ই আনন্দ অনুভব করত। সন্ধ্যায় যখন তাদের কাজ শেষ হয়ে যেত তখন তাদেরকে দশ-দশ, বিশ-বিশ বা পঞ্চাশ-পঞ্চাশজন করে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে খুপরীর মধ্যে আটকিয়ে রাখা হতো। যে খুপরীগুলো এতদূর অপরিষ্কার ও পূতিগন্ধময় থাকতো যে, পোকা-মাকড়, ইঁদুর-ছুঁচো ছাড়া অন্য কিছুই সেখানে স্বাভাবিক বাস করতে পারত না। এই খুপরীর মধ্যেও তাদের হাত-পাগুলোকে বেড়ি মুক্ত করা হতো না। ইতর ও চতুষ্পদ জন্তুগুলোকে তারা খোলা ও প্রশস্ত ঘরে রাখার ব্যবস্থা করত, কিন্তু এই বনী আদমদেরকে সেই সুবিধাটুকু থেকেও বঞ্চিত করে রাখত। রোমকদের জীবনের জঘন্য দিক দাসদের প্রতি রোমকদের সবচে’ জঘন্য ও রোমাঞ্চকর ব্যবহার আমরা তাদের চিত্তবিনোদন তথা আনন্দ উপভোগের প্রক্রিয়ার মধ্যে দেখতে পাই। উহার মাধ্যমেই তাদের সেই বন্য স্বভাব, নিকৃষ্টতম বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতম হিংস্রতার পরিচয় পাওয়া যায় যা রোমক সংস্কৃতির ভাবধারার সাথে অংগাঅংগি ভাবে জড়িত ছিল। এবং উহাই বর্তমান যুগের ইউরোপ ও আমেরিকা তাদের যাবতীয় সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র ও উপায়-উপকরণের সাথে উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছে। এমনি একটি পাশবিক খেলা হলো, প্রভুদের চিত্তবিনোদন ও মনোরঞ্জনের জন্য কিছু সংখ্যক দাসের হাতে তরবারি ও বল্লম দিয়ে জোর করে একটি আসরে ঢুকিয়ে দেয়া হতো। তার চারদিকে তাদের প্রভুরা এবং অনেক সময়ে রোম সাম্রাজ্যের শাহনশাহও উপস্থিত হতেন। তারপর নির্দিষ্ট সময়ে দাসদেরকে হুকুম দেয়া হতো প্রত্যেকেই যেন অন্যান্য সকলকে ক্ষতিবিক্ষত ও টুকরা টুকরা করে ফেলে। তখন শুরু হয়ে যেত তাদের পারস্পরিক মরণ পণ যুদ্ধ। এমনি করে যুদ্ধ যখন শেষ হতো তখন দেখা যেত, হয়ত দু’ একটি প্রাণীই কোন রকমে ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় বেঁচে আছে এবং আর সবাই শত-সহস্র ভাগে বিভক্ত হয়ে সমস্ত আসরে ছড়িয়ে আছে। জীবিত দাসদেরকে তারা বিজয়ী বলে ঘোষণা করত এবং বিকট অট্টহাসি ও মুহূর্মুহু হাততালি দিয়ে তাদেরকে অভিনন্দ জানাতো । গোটা রোম সাম্রাজ্য এ-ই ছিল দাসদের সামাজিক অবস্থা। এখানে রোমকদের আইন দাসদের কী মর্যাদা ছিল তা বোঝা যায়। তাদের যে প্রভুদের হাতে ছিল তাদের জীবন-মরণ –যারা তাদের হীনস্বার্থ উদ্ধারের জন্যে এই প্রাণীগুলোর উপর চালাতো লোমহর্ষক অত্যাচার কেননা তাদের ছিলো একচ্ছত্র অধিকার । এই হতভাগ্য দাসেরা সমাজের কোন শ্রেণীর নিকট থেকেই কোন প্রকার সহানুভীত পেত না।
ইরান, ভারত ও অন্যান্য দেশের দাসরাও ছিল একই রূপ মজলুম ও অসহায়। রোমক দাসদের তুলনায় তাদের অবস্থা কোন দিক থেকেই ভালো ছিল না। খুঁটিনাটি বিষয়ে তারতম্য থাকলেও দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে দাসদের অবস্থান ও সামাজিক মর্যাদার ক্ষেত্রে কোন পার্থক্য ছিল না। তাদের জীবনের কোন মূল্যই ছিল না। কোন নিরপরাধ দাসকে হত্যা করা এমন কোন অপরাধ ছিল না যাতে করে তাকেও প্রাণদণ্ড ভোগ করতে হয়। অথচ তাদের উপর দায়িত্ব ও কর্তব্যের বোঝা এত পরিমাণ চাপানো হতো যে, তাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে যেত। কিন্তু তাদের অধিকার বলতে কিছুই ছিল না।
তৎকালীন দুনিয়াতে খুবই নগন্য কিছু ব্যাতিক্রম ছাড়া সমগ্র বিশ্বের সকল দেশেই দাসদের ব্যাপারে সকলের দৃষ্টিভংগি ছিল এক ও অভিন্ন। এবং সামাজিক অধিকার সম্পর্কেও কোন পার্থক্য ছিল না। -পার্থক্য ছিল কেবল নিষ্ঠুরতার পরিমাণ ও উৎপীড়নের পদ্ধতির ক্ষেত্রে। কোথাও উৎপীড়ন চলতো জঘন্যতম প্রদর্শনীর মাধ্যমে, আবার কোথাও চলতো কিছুটা হালকাভাবে।
ইসলামের বৈপ্লবিক ঘোষণা:
বিশ্ব মানবতার এই অধঃপতনের যুগেই ইসলামের আবির্ভাব ঘটে: ইসলাম দাসদেরকে তাদের হারানো মর্যাদা পুনরায় ফিরিয়ে দিল। প্রভু ও দাস উভয় শ্রেণীকে সম্বোধন করে ইসলাম দ্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করল,
(আরবী************) –“তোমরা সবাই একই গোত্রের লোক।” –(সূরা আন নিসা: ২৫)
ইসলাম স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিল:
যে আমাদের কোন দাসকে হত্যা করবে তাকে উহার বদলা হিসেবে হত্যা করা হবে। যে তার নাক কেটে দিবে তার নাকও কেটে দেয়া হবে। যে তাকে খাসী (বা পুরুষত্বহীন) করে দেবে তাকেও তদ্রুপ করে দেয়া হবে।” [বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী ও নাসা’ঈ।]
উহা দাস ও মুনিবদের নিকট সমস্ত মানুষের একই উৎস্থল, একই আবাসভূমি এবং একই প্রত্যাবর্তনস্থলের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে:
“তোমরা সকলেই আদমের সন্তান এবং আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছে মৃত্তিকা থেকে।” [মুসলিম ও আবু দাউদ]
ইসলাম প্রভুকে কখনো প্রভু হিসেবে মর্যাদা দেয়নি; বরং মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব দেয়ার জন্যে তাকওয়া বা আল্লাহরভীতিকেই একমাত্র ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছে। বলা হয়েছে:
“তাকওয়া ছাড়া কোন আরব কোন আজমীর চেয়ে, কোন শ্বেতাংগের চেয়ে কোন কৃষ্ণাংগ কিংবা কোন কৃষ্ণাংগের চেয়ে কোন শ্বেতাংগ মর্যাদা হাসিল করতে পারে না।” [আল বুখারী]
ন্যায়বিচার ভিত্তিক ব্যবহারের শিক্ষা ইসলাম প্রভুদেরকে তাদের অধীনস্ত দাসদের সাথে ন্যায়বিচার ভিত্তিক ব্যবহারের জন্যে নির্দেশ দিয়েছে। আল্লাহ বলেন:
(আরবী************) “মাতা-পিতার সাথে সদ্ব্যবহার কর, আত্মীয়, ইয়াতিম ও মিসকীনদের সাথে সদাচরণ কর এবং প্রতিবেশী আত্মীয়, অপরিচিত নিকটবর্তী জন, পার্শ্ববর্তী সহচর, মুসাফির (ভ্রমণকারী) এবং তোমাদের অধীনস্ত দাস-দাসীদের প্রতি এহ্সান ও বদান্যতা প্রদর্শন কর। নিশ্চিতভাবে জেনে রাখ যে, আল্লাহ এমন ব্যক্তিকে পসন্দ করেন না, যে অহংকারী ও গর্বিত।” –(সূরা আন নিসা: ৩৬)
পারস্পরিক সম্পর্কে মূলভিত্তি ইসলাম মানুষের নিকট এই সত্যও তুলে ধরেছে যে, প্রভু ও দাসের মূল সম্পর্ক মুনিব ও গোলাম কিংবা হুকুমদাতা ও হুকুম পালনকারীর সম্পর্ক নয়। বরং তা হচ্ছে ভ্রাতৃত্ব ও ঘনিষ্ঠতার সম্পর্ক। এ কারণেই ইসলাম প্রভুকে তার অধীনস্থ দাসীদের বিবাহ করারও অনুমতি দিয়েছে। আল্লাহ বলেন:
(আরবী***************) “তোমাদের ভেতর যে ব্যক্তি খান্দানী মুসলমান নারীকে বিবাহ করার সামর্থ রাখে না সে যেন তোমাদের সেই সকল দাসীদের ভেতর থেকে কাউকে বিবাহ করে নেয়- যারা তোমাদের অধীন এবং আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী। আল্লাহ তোমাদের ঈমানের অবস্থা ভালো করেই অবগত আছেন। তোমরা সবাই একই গোত্রের লোক। সুতরাং তোমরা তাদের অভিভাকদের অনুমতি নিয়ে তাদেরকে বিবাহ কর এবং উৎকৃষ্ট পন্থায় তাদের দেনমোহর পরিশোধ কর।” –(সূরা আন নিসা: ২৫)
দাসদের মানবীয় ধারণা ইসলাম প্রভুদেরকে এই ধারণা দিতে সক্ষম হয়েছে যে, দাসরা তাদের ভাই। বিশ্বনী (স) বলেন:
“তোমাদের দাসরা তোমাদের ভাই। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যার অধীনে তার কোন ভাই থাকবে সে যেন তার জন্য সেইরূপ খাওয়া পরার ব্যবস্থা করে যেরূপ সে নিজের জন্যে করবে। এবং যে কাজ করার মত শক্তি তার নেই সে কাজ করার হুকুম যেন সে না দেয়। আর একান্তই যদি সে সেইরূপ কাজের হুকুম দেয় তাহলে সে নিজে যেন তার সাহায্যের জন্যে এগিয়ে আসে।” [আল বুখারী]
এখানেই শেষ নয়। ইসলাম দাসদের আশা-আকাংখা ও অনুভূতি উপলব্ধির প্রতিও যথেষ্ট সম্মান প্রদর্শন করেছে।
হযরত বিশ্বনবী (স) বলেন: তোমাদের কেউ যেন (দাসদের সম্বন্ধে) এরূপ না বলে যে, আমার দাস এবং আমার দাসী; উহার পরিবর্তে বলতে হবে, ঐ আমার সেবক এ আমার সেবিকা।” [এ হাদীসের বর্ণনাকারী ছিলেন হযরত আবু হুরাইরা (রা)।]
হাদীসের এই শিক্ষা অনুযায়ীই হযরত আবু হুরাইরা (রা) যখন দেখতে পান যে, এক ব্যক্তি ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছে এবং তার গেরলাম তার পেছনে পায়ে হেটে যাচ্ছে, তখন তিনি ঐ ব্যক্তিকে বললেন,
তাকেও ঘোড়ার পিঠে তোমার পেছনে বসিয়ে দাও; কেননা সে তোমার ভাই; তোমার ন্যায় তারও প্রাণ আছে।”
দাসদের সার্বিক কল্যাণ ও সমান অধিকার প্রদানের ক্ষেত্রে ইসলামের কীর্তি যেমন অমর। তেমনি সুদীর্ঘ। আরো সম্মুখে অগ্রসর হওয়ার পূর্বে ইসলামের যে বৈপ্লবিক পদক্ষেপের ফলে দাসরা অভূতপূর্ব সামাজিক মর্যাদা ও সম্মানলাভ করেছে সে সম্পর্কে কিঞ্চিত আলোচনা করা গেল। ইসলামী বিপ্লবের পর ইসলাম আসার পর দাসদের জীবনে যে আমূল পরিবর্তন সাধিত হয় তার ফল হলো এই যে, তারা আর বাজারে পণ্য সামগ্রী হয়ে রইল না। যথেচ্ছ বেচা-কেনার হাত থেকে তারা চিরতরে মুক্তি পেল এবং মানবেতিহাসের এই প্রথম বারই তারা স্বাধীন মানুষের মর্যাদা ও অধিকার লাভের সৌভাগ্য অর্জন করল। ইসলাম আসার পূর্বে তাদেরকে মানুষ বলেই গণ্য করা হতো না, বরং মানুষ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর এবং অত্যন্ত নিকৃষ্ট শ্রেণীর এক প্রকার জীব বলে মনে করা হতো।
ওদরে সৃষ্টির উদ্দেশ্য হলো: ওরা অন্যদের সেবা করবে এবং তাদের অত্যাচার-উৎপীড়ন ও লাঞ্ছনা-গঞ্ছনা নীরবে সহ্য কবে। দাসদের সম্পর্কে এরূপ ন্যাক্কারজনক দৃষ্টিভংগীর অনিবার্য ফল ছিল এই যে, দাসদেরকে বেধড়ক মেরে ফেলা হতো। বর্বরোচিত ও পাশবিক শাস্তির চর্চাস্থল বলে গণ্য করা হতো, চরম ঘৃনার্হ ও কঠিন কাজ করতে বাধ্য করা হতো। অথচ কারো অন্তরে তাদের জন্যে সামান্যতম দয়া বা সহানুভূতির উদ্রেক হতো না। ইসলাম দাসদের এই করুণ অবস্থা থেকে উদ্ধার করে স্বাধীন মানুষদের সাথে একই ভ্রতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে দেয়। ইসলামের এই কীর্তি কোন মুখরোচক ঘোষণামাত্র নয় বরং মানবেতিহাসের এক অমোঘ সত্য; উহার পাতায় পাতায় ইহার সাক্ষ্য বর্তমান। ইউরোপের সাক্ষ্য ইউরোপের পক্ষপাত তথা ইসলাম বিদ্বেষী লেখকগণষও এ সত্যকে অস্বীকার করতে পারেনি যে, ইসলামের প্রথম যুগে দাসরা এমন এক সমুন্নত সামাজিক মর্যাদা লাভ করেছিল যার নযীর বিশ্বের কোন দেশ বা জাতির মধ্যে খাঁজে পাওয়া যায় না।
মুসলিম সমাজব্যবস্থায় তাদেরকে এরূপ সম্মানজনক আসন দান করা হয়েছিল যে, দাসত্বের বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার পরেও কোন দাস তার পূর্ববর্তী প্রভুদের বিরুদ্ধে সামান্যতম গাদ্দারীর কথাও কল্পনা করতে পারেনি। বরং এরূপ করাকে তারা চরম ঘৃণার্হ ও জঘন্য কাজ বলে বিবেচনা করত। মুক্তিলাভের পর একদিকে যেমন পূর্ববর্তী প্রভুর পক্ষ থেকে কোন আশংকার কারণ থাকত না। অন্যদিকি তেমনি পূর্বের মত তার প্রতি মুখাপেক্ষী হওয়ারও কোন হেতু অবশিষ্ট থাকত না। বরং সে তার পুরাতন প্রভুর মতই একজন স্বাধীন মানুষ বলে বিবেচিত হতো। -এরূপে স্বাধীন হওয়ার পরে সে তার প্রভু গোত্রের একজন স্বাধীন সদস্য হিসেবেই গণ্য হতো। ইসলাম প্রভু ও দাসদের মধ্যে অভিভাকত্বের এমন এক বন্ধন প্রতিষ্ঠিত করে দিত যে মুক্তির পরবর্তী পর্যায়ে উহাকে রক্তের সম্বন্ধের চেয়ে কোন অংশেই কমশক্তিশালী বলে বিবেচনা করা যেত না। দাসদের জান ও মানবতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন অধিকন্তু দাসদের জানের প্রতিও এতদূর সম্মান প্রদর্শন করা হলো যে, একজন স্বাধীন মানুষের মতই তার জানকেও পরিপূর্ণ নিরাপত্তা দেয়া হলো একং নিরাপত্তার জন্যে যাবতীয় আইন-কানুনও রচনা করা হলো। এমনকি এর বিপক্ষে যে কোন ধরনের কথা ও কাজকে নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করা হলো। হযরত বিশ্বনবী (স) মুসলমানদেরকে তাদের দাস-দাসীকে দাস বা দাসী –গোলাম ও বাঁদী বলে সম্বোধন করতে নিষেধ করে দিলেন এবং তাদেরকে এই মর্মে শিক্ষা দিলেন যে, তাদেরকে এমনভাবে ডাকতে হবে যাতে করে তাদের মানসিক দূরত্ববোধ বিলুপ্ত হয়ে যায় মএবং তারা নিজেদেরকে তাদের প্রভুদের পরিবারভুক্ত সদস্য মনে করতে শুরু করে। হযরত বিশ্বনবী (স) বলেন: ইহা নিশ্চিত যে, আল্লাহই তোমাদেরকে তাদের প্রবু হওয়ার সুযোগ দিয়েছেন। তিনি ইচ্ছা করলে তোমাদেরকে দাস বানিয়ে তাদের অধীনস্থ করে দিতে পারতেন।” [এহ্ইয়াউ উলুমিদ্দীন- ইমাম গাজ্জালী (র)] এর মর্মার্থ হলো: তারা এক বিশেষ অবস্থায় ও ঘটনাচক্রে দাস হতে বাধ্য হয়েছে। কেননা মানুষ হিসেবে তাদের এবং তাদের প্রবুদের মধ্যে তো বিন্দুমাত্রও পার্থক্য নেই। ইসলাম একদিকে প্রভুদের অহেতুক অহংকারকে কমিয়ে দিয়েছে এবং অন্যদিকে দাসদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করে এক অনাবিল মানবীয় সম্পর্কের বন্ধরে তাদেরকে প্রভুদের সাথে আবদ্ধ করে দিয়েছে। ফলে প্রভু ও দাস পরস্পর ঘনিষ্ঠত হয়ে উঠেছে। পারস্পরিক মৈত্রী ও ভালোবাসা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং পরবর্তী পর্যায়ে এই ভালোবাসাই সমস্ত মানবীয় সম্পর্কের ভিত্তি রচনা করেছে। দৈহিক নিপীড়ন বা ক্ষতি সাধনের জন্যে প্রভু ও দাস উভয়ের জন্যে একই প্রকার দণ্ডের ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং এ ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে আদৌ কোন পার্থক্য কিংবা বৈশিষ্ট্যের প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয়নি। “যে আমাদের কোন দাসকে হত্যা করবে তাকেও হত্যা করা হবে।” –ইসলামের এই সুদুরপ্রসারী বিধান অত্যন্ত সুস্পষ্ট। ইহা নিষ্কলুষ মানবীয স্তরে প্রভু ও দাসদের মধ্যে পূর্ণাংগ সাম্য স্থাপন করতে চায়; -উভয়ই জীবনের সকল দিক ও বিভাগে সমান অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা লাভ করুক –ইহাই একমাত্র কাম্য। দাসদের মানবীয় অধিকার ইসলামী শিক্ষার ফলে এই সত্যটিও স্পষ্ট হয়ে গেল যে, দাস থাকা অবস্থায়ও কোন দাসকে তার মানবীয় অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে হয় না। ইসলামী শরীয়াতের এই সংস্করণ ব্যবস্থা শুধু দাসদের জান ও ইজ্জতের নিরাপত্তার জন্যেই যথেষ্ট ছিল না, বরং ইহা এতদূর উদার ও ভদ্রতাপূর্ণ ছিল যে, ইসলামের পূর্বাপর কোন ইতিহাসের এর নযীর খুঁজে পাওয়া যায় না। এই পর্যায়ে ইসলাম এতদূর পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছে যে, কোন দাসের চেহারার উপর চড় মারাও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। শুধু আদব শিক্ষা দেয়ার জন্যে যে চড় মারার অনুমতি দেয়া হয়েছে তার জন্যেও সুনির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন বিধিবদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। যাতে করে কোন প্রভু শাস্তি দেয়ার ক্ষেত্রেও বেধ সীমালংঘন করতে না পারে। প্রকৃতপক্ষে শিশুদের দুষ্টামি বন্ধ করার জন্যে বড়রা যে ধরনের শাস্তি দিয়ে থাকে তার চেয়ে কঠিন শাস্তি দাসদের জন্যে কখনো বৈধ করা হয়নি। আর এই ধরনের শাস্তিও ইসলামের বিপ্লবোত্তর যুগে দাদের মুক্তির জন্য আইনগত ভিত্তি বলে বিবেচিত হয়এবং তারা মুক্তিলাভের ন্যায্য অধিকার লাভে সমর্থ হয়। বস্তুত এ-ই ছিল দাস মুক্তির সর্বপ্রথম পর্যায়। এখন আসুন, তাদের মুক্তিলাভের পরবর্তী বিভিন্ন পর্যায় তথা পূর্ণাংগ স্বাধীনতার প্রতি একবার দৃকপাত করি। স্বাধীনতার প্রথম পর্যায় প্রথম পর্যায়ে ইসলাম দাসদেরকে মানসিক ও আধ্যাত্মিক স্বাধীনতা দান করেছে। তাদের অতীতের মানবীয় মর্যাদা পুনরুদ্ধার করে দিয়েছে এবং স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে, একই যৌথ মানবতার সূত্রে গ্রথিত বলে সকল দাসই তাদের প্রভুদের ন্যায় একই মর্যাদা ও সম্মানের অধিকারী : স্বাধীনতার গৌরব থেকে বঞ্চিত হয়ে তারা মানবতাকে কোন দিন হারায়নি এবং প্রাকৃতিক বা জন্মগত কোন দুর্বলতারও শিকার হয়নি। বরং কিছু বাহ্যিক অবস্থা ও পরিবেশের কারণেই তাদের স্বাধীনতাকে হরণ করা হয়েছিল এবং যাবতীয় সামাজিক কর্মকাণ্ডের পথ তাদের জন্যে রুদ্ধ করে দেয়া হয়েছিল। তাই বাহ্যিক অবস্থা- তথা দাসত্বকে বাদ দিলে তারা অন্যান্য লোকদের মতই মানুষ; এবং মানুষ হিসেবে তাদের প্রভুদের ন্যায় তারা, যাবতীয় মানবীয় অধিকার লাভের উপযুক্ত। পূর্ণাংগ স্বাধীনতার পথ কিন্তু ইসলাম এতটুকু করেই ক্ষান্ত হয়নি। কেননা অন্যতম মূলনীতি হচ্ছে মানুষের পূর্ণাংগ সমতা বিধান। এ নীতির দাবীই হলো: বিশ্বের সমস্ত মানুষ সমান এবং স্বাধীন মানুষ হিসেবে মানবীয় অধিকার লাভের ক্ষেত্রেও সবাই সমান। এ জন্যেই ইসলাম দাসদেরকে পুরোপুরি স্বাধীন করে দেয়ার উদ্দেশ্যে দু’টি কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। প্রথমটি হলো সরাসরি মুক্তিদান (বা ‘ইতক্) অর্থা প্রভুদের পক্ষ থেকে দাসদেকে স্বেচ্ছায় মুক্তি প্রদান করা। এবং দ্বিতীয়টি হলো মুক্তির লিখিত চুক্তি (বা মুকাতাবাত) অর্থাৎ প্রভু ও দাসের মধ্যে মুক্তিদানের লিখিত চুক্তি সম্পাদন। সরাসরি মুক্তিদান সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে কোন মুনিব কর্তৃক তার কোন দাসকে দাসত্বের যাবতীয় বন্ধন থেকে মুক্ত করে দেয়াকে ইসলামের পরিভাষায় ইত্ক (বা মুক্তিদান) বলা হয়। ইসলাম এই পদ্ধতিটিকে অত্যন্ত ব্যাপকভাবে কার্যকরী করে তোলে। হযরত বিশ্বনবী (স)-ও এই ক্ষেত্র তাঁর অনুসারীদের সামনে সর্বোত্তম নমুনা উপস্থাপিত করেন। তিনি নিজেই তার সমস্ত দাস চিরতরে মুক্ত করে দেন। তাঁর সাহাবীবৃন্দও তার অনুসরণ করে নিজ নিজ দাসদেরকে আযাদ করে দেন। হযরত আবু বকর (রা) তো তার ধন-সম্পত্তির এক বিরাট অংশ ব্যয় করে কাফের প্রভুদের নিকট থেকে তাদের দাসদেরকে ক্রয় করে মুক্ত করে দেন। এমনকি দাস ক্রয় করে মুক্ত করে দেয়ার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রের বায়তুলমালে একটি নির্দিষ্ট অংশ বরাদ্ধ করে রাখা হতো। হযরত ইয়াহয়া (রা) বলেন: খলিফা উমর ইবনে আবদুল আজীজ (রা) একবার আমাকে যাকাত ইত্যাদি আদায় করার জন্যে আফ্রিকা প্রেরণ করেন। আমি যাকাত ও সাদকা সংগ্রাহ করে উহা বিতরণ করার জন্যে উহার হকদার তালাশ করতে শুরু করলাম। কিন্তু যাকাত-সাদকার অর্থ গ্রহণ করার কোন ব্যক্তিকেই খুঁজে পেলাম না। কেননা হযরত উমর ইবনে আবদুল আজীজ (রা) সমস্ত মানুষকেই সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। অতপর আমি উক্ত অর্থ দ্বারা একজন দাস খরিদ করলাম এবং তাকে আযাদ করে দিলাম।” গোনাহর কাফ্ফারা হযরত বিশ্বনী (স) একটি নিয়ম করে দিয়েছিলেন যে, যদি কোন দাস দশজন মুসলমানকে লেখাপড়া শেখাত কিংবা মুসলিম সমাজের এই ধরনের কোন সেবায় শরীক হতো তাহলে তিনি তাকে আযাদ করে দিতেন। অনুরূপবাবে পবিত্র কুরআনে কিছু কিছু গোনাহর কাফ্ফারা স্বরূপ দাস মুক্তির নির্দেশ দেয়া হয়েছে। স্বয়ং হযরত বিশ্বনবী (স)-ও তাঁর উম্মতদেরকে বলেছেন যে, কতক গোনাহর কাফ্ফারা হচ্ছে গোলাম আযাদ করে দেয়া। ফলে অসংখ্য গোলাম আযাদী লাভ করে ধন্য হয়। কেননা গোনাহ ছাড়া কোন মানুষ নেই; কাজেই বহু মানুষই স্ব স্ব গোনাহর কাফ্ফারার জন্যে গোলামদেরকে আযাদ করে দেয়। স্বয়ং হযরত বিশ্বনবী (স) এরশাদ করেন: “বনী আদমের মধ্যে কোন ব্যক্তিই গোনাহ থেকে মুক্ত নয়।” এই পর্যায়ে কোন মু’মিন কর্তৃক কাউকে ভুল করে মেনে ফেলার দৃষ্টান্তই দাস মুক্তি সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভংগি সম্পূর্ণরূপে স্পষ্ট হয়ে উঠে। ইসলামে কোন মু’মিন গোলামকে আযাদ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং নিহত ব্যক্তির ওয়ারিসদের জন্যে রক্তপণ নির্ধারণ করা হয়েছে। এই প্রসংগে আল্লাহ পাক এরশাদ করেন: (আরবী************) “এবং যে ব্যক্তি কোন মু’মিনকে ভুলবশত হত্যা করে তার কাফফারা হলো এই যে, একজন মু’মিন দাসকে মুক্ত করে দেবে এবং নিহত ব্যক্তির ওয়ারিসদেরকে রক্তপণ প্রদান করবে।” –(সূরা আন নিসা: ৯২) মু’মিনের হত্যা সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভংগি একজন মু’মিনকে কেউ ভুলক্রমে হত্যা করলেও হত্যাকারীকে আইনগত দণ্ড না দেয়া পর্যন্ত তাকে সামাজিক কর্মকাণ্ড থেকে বঞ্চিত করাই হলো ইসলামের স্পষ্ট বিধান। এ কারণেই হত্যাকারীর জন্যে হুকুমহলো: নিহত ব্যক্তির ওয়ারিস ও সমাজের অধিকারকে যে ক্ষুণ্ণ করার হয়েছে তার ক্ষতিপূরণ তাকে দিতে হবে; -ওয়ারিসদের দিতে হবে রক্তপণ হিসেবে যুক্তিসংগত পরিমাণ অর্থ এবং সমাজকে দিতে হবে একজন ব্যক্তি –সদ্য মুক্ত একজন গোলাম, যাতে করে সে নিহত ব্যক্তির শূন্যতা পূরণ করতে সক্ষম হয়। অন্য কথায় ইসলামের দৃষ্টিতে নিহত ব্যক্তির হত্যার পর একজন দাসকে মুক্তি দেয়ার অর্থই হলো সে স্থলে আর একজন ব্যক্তিকে জীবিত ক রা। হত্যাকারী তো একজন মানুষকে ধ্বংস করে তার খেদমত থেকে গোটা সমাজকে বঞ্চিত করেছিল। কিন্তু উহার কাফ্ফারা বা ক্ষতিপূরণ স্বরূপ সে যখন একজন গোলামকে আযাদ করে দিল তখন সমাজ আর একজন সেবক লাভ করল। বস্তুত দাসদের কল্যাণের জন্যে এতদূর ব্যাপক ভূমিকা নেয়ার পরেও ইসলামের দৃষ্টিতে দাসত্ব যেন মৃত্যুরই নামান্তর। আর এ কারণেই ইসলাম বাস্তব জীবনের সম্ভাব্য সকল ক্ষেত্রে এই পতিত দাসদেরকে পুনরুত্থা ও চিরমুক্তির জন্য মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার কাজ অব্যাহত রেখেছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়: ‘সরাসরি মুক্তিদান’ (বা ‘ইতক) পদ্ধতির মাধ্যমে এত বিরাট সংখ্যক দাস স্বাধীনতা লাভ করে যে, উহার নযীর কোন প্রাচীন বা আধুনিক জাতির ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যায় না। এখানে ইহাও লক্ষণীয় যে, মুসলমানগণ এত বিরাট সংখ্যক দাসকে কোন পার্থিব স্বার্থে মুক্ত করে দেয়নি, বরং একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যেই তারা এই কাজ সম্পন্ন করেছে। মুক্তির লিখিত চুক্তি ইসলামী বিধানে দাস স্বাধীন করে দেয়ার দ্বিতীয় পদ্ধতি ছিল ‘মুকাতাবাত’ অর্থাৎ লেখাপড়ার পদ্ধতি। যদি কোন দাস তার প্রভুর নিকট মুক্তিলাভের দাবী করত তাহলে মুকাতাবাতের এই পদ্ধতি অনুযায়ী নির্ধারিত অর্থলাভের পরিবর্তে সেই দাসকে মুক্তি দেয়া প্রবুর জন্য অপরিহার্য কর্তব্য হয়ে পড়ত। প্রভু ও দাস উভয়ে এই অর্থের পরিমাণ নির্ধারণ করে নিত। এ বিষয়ের লিখিত চুক্তিকেই বলা হতো ‘মুকাতাবাত’। এই চুক্তি অনুসারে দাস যখন উপরোক্ত অর্থ পরিশোধ করে দিত তখন তাকে আযাদ করা ছাড়া প্রভুর কোন উপায় থাকত না। কোন প্রবু মুক্তি দিতে না চাইলে দাস আদালতে বিচারের প্রার্থনা করত। আদালত উক্ত অর্থ আদায় করে দাসের নিকট মুক্তিপত্র প্রদান করত। যে সকল দাস নিজ নিজ প্রবুর সুমতি, বদান্যতা ও তাকওয়ার উপর ভরসা করে কবে কখন ভাগ্যক্রমে তার দাসত্বের বন্ধন খুলে যাবে –এই অপেক্ষায় না থেকে কিছু অর্থের বিনিময়ে স্বাধীনতা লাভ করতে পারত তাদের সকলের জন্যেই ইসলাম এই পদ্থরি মাধ্যমে স্বাধীনতার দ্বার উন্মুক্ত করে দিল। ইসলামী সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা কোন দাস যখন চুক্তির মাধ্যমে আযাদ হওয়ার আবেদন করত তখন তার প্রভু যে শুধু উক্ত আবেদন প্রত্যাখ্যান করতে অসমর্থ ছিল তাই নয়। বরং সে দাসকে এতটুকু দুশ্চিান্তাও করতে হতো না যে, তার প্রভু কোন প্রতিশোধমূলক বা অমানবিক ব্যবহার শুরু করতে পারে। কেননা স্বয়ং ইসলামী সরকারই হতো তার প্রধান পৃষ্ঠপোষক। এ কারণে মুকাতাবাতের চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর মুনিবকেই তার দাসকে তার খেদমতের বিনিময়ে বাধ্যতামূলকভাবে কিছু পারিশ্রমিকের ব্যবস্থা করে দিতে হতো যাতে করে সে চুক্তির অর্থ সংগ্রহ করতে পারে। মুনিব এতে সম্মত না হলে দাসকে এতটুকু সময় ও সুযোগ অবশ্যই দিতে হতো যাতে করে সে অন্য কারুর কাজ করে উক্ত অর্থ উপার্জনের সুযোগ পেতে পারে এবং ঐ অর্থ দিয়ে মুক্তিলাভ করতে পারে। ঠিক এই অবস্থাই চতুর্দশ শতাব্দীতে –অর্থাৎ বহু শতাব্দী পর ইউরোপে সৃষ্টি হয়েছিল। অথচ উহার বহু পূর্বেই ইসলাম এই দাস প্রথা নির্মূলের কাজ পুরোপুরি সমাধা করে দিয়েছিলো। সরকারী কোষাগার থেকে সাহায্য প্রদান এই পর্যায়ে ইসলামী রাষ্ট্র আরো একটি এমন বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জল যার কোন তুলনা মানবেতিহাসে নেই। সেটি হলো রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে মুক্তিপ্রার্থী দাসের জন্যে আর্থিক সাহায্য প্রদান। দাস প্রথা বিলুপ্ত করার জন্যে ইসলাম যে কতদূর দৃঢ়সংকল্প ও তৎপর তার বাস্তব প্রমাণ এখানেও বিদ্যমান। আর এই সাহায্য প্রদানের মূলে কোন পার্থিব স্বার্থও নিহিতি নেই; বরং এর একমাত্র উদ্দেশ্য হলো প্রবু পরোয়ারদেগার ও মহান মালিকের সন্তুষ্টি অর্জন। মানুষ যাতে করে পুরোপুরিভাবেই একমাত্র আল্লাহর দাসত্ব করার সুযোগ লাভ করতে পারে ইসলাম সে জন্যেই এই উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। যাকাতের হকদার প্রসংগে আলআহ তা’আলা এরশাদ করেন: (আরবী*************) “যাবতীয় সাদকা কেবল দরিদ্র, অভাবী এবং উহার আদায়কারী কর্মীদের জন্যে—— এবং দাসদের মুক্ত করার জন্যে।” -(সূরা আত তাওবা: ৬০) এই আয়াতে আল্লাহ তা’আলা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন যে, যে সকল দাস নিজেদের অর্জিত অর্থ দ্বারা মুক্তি লাভ করতে অক্ষম তাদেরকে যাকাতের তহবিল থেকে সাহায্য করতে হবে। দু’টি বৈপ্লবিক নীতি ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় ‘ইতক’ ও ‘মুকাতাবাত’ –নিঃশর্ত মুক্তি ও অর্থের বিনিময়ে মুক্তি দাস প্রথার ভয়াল ইতিহাসের যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দিয়েছে অবশিষ্ট দুনিয়ার সে পর্যন্ত পৌছাতে অন্ততঃপক্ষে সাত শ’ বছর অতিবাহিত হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, ইসলাম দাসদের অনুকূলে সর্বাত্মক হেফাযত ও পৃষ্ঠপোষকতার ব্যবস্থা করে সমগ্র দুনিয়াকে সমুন্নত করার যে পরিকল্পনা দিয়েছে তার ধারণা প্রাচীনকাল তো দূরের কথা আধুনিক যুগের কোন ইতিহাসেও বর্তমান নেই। ইসলাম মানুষকে দাসদের সাথে যে মহত্ব উদারহা ও মহানুভবতা প্রদর্শনের শিক্ষা দিয়েছে এবং কোন রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক চাপ কিংবা কোনরূপ লোভ-লালসা ছাড়াই দাসদেরকে স্বেচ্ছায় মুক্তি প্রদানের অদম্য প্রেরণার সৃষ্টি করেছে তার কোন নযীর মানবেতিহাসে নেই। পরবর্তীকালে ইউরোপে দাসরা যে স্বাধীনতা লাভ করেছে তাতে তারা ততটুকু সামাজিক মর্যাদাও লাভ করতে পারেনি যতটুকু ইসলামী সমাজে দেয়া হয়েছিল বহু শতাব্দী পূর্বে। সমাজতান্ত্রিক বিভ্রান্তির স্বরূপ উপরোক্ত ঐতিহাসিক সত্য কমিউনিষ্টদের ভ্রান্ত মতাদর্শ ‘দ্বান্দ্বিক জড়বাদ’ (Dialectcal Materalism)-কে খণ্ডন করার জন্যে যথেষ্ট। এ জড়বাদের মূল কথা ছিল : ইসলাম মানবেতিহাসের একটি বিশেষ যুগের অর্থনৈতিক অবস্থা ও পরিবেশের ফসল। দ্বান্দ্বিক জড়বাদের অনুসরণে উহাই ছিল তৎকালীন অর্থণৈতিক ও বস্তুগত ঘটনাবলীর নিখুঁত দর্পণ। কিন্তু পরবর্তীকালের অধিকতর উন্নত অর্থনৈতিক পরেবেশে উহা অচল হয়ে যায়। ইসলাম সমাজতন্ত্রীদের এই মিথ্যা ধূম্রজালকে একেবারেই ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে; বরং একথাও বলা যেতে পারে যে, স্বয়ং ইসলামই তাদের মিথ্যা প্রতারণার অকাট্য প্রতিবাদ। ইসলাম আরব উপদ্বীপের ভেতরে ও বাইরে পে অপ্রতিরোধ্য শক্তি ও প্রভাব বিস্তার করেছে তাতে ইহা নিসন্দেহে প্রমাণিত হয়েছে যে, কালমার্করে মতাদর্শ সম্পূর্ণরূপেই ভুল। দাসদের সাথে ব্যবহার কিংবা জীবনের অন্যান্য সমস্যার সমাধানের কথা হোক, সম্পদের বন্টন কিংবা নেতা ও অধীনস্ত তথা মুনিব ও কর্মচারীর পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়ই হোক –প্রতি ক্ষেত্রেই ইসলামের বৈশিষ্ট্য সমুজ্জল। ইসলাম উহার সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমগ্র কাঠামোকে এমন এক স্বেচ্ছাপ্রণোদিত আনুগত্যের ভিত্তিতে নির্মাণ করেছে যে, বিশ্বের সমাজব্যবস্থার ইতিহাসে আজও উহা একক এবং সর্বোচ্চ আসনের অধিকারী। একটি প্রশ্ন ও উত্তর প্রশ্ন: এই প্রসংগে অনেকিই প্রশ্ন করতে পারে যে, যে ইসলাম দাসদের মুক্তির জন্যে এতদূর অগ্রসর, যা-তাদের মক্তির জন্যে কোন রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি না করেই শুধু আভ্যন্তরীণ প্রচেষ্টার মাধ্যমে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সৃষ্টি করতে সক্ষম তা উহার চূড়ান্ত পদক্ষেপ হিসেবে কেন এই প্রথাকে চিরতরে নিষিদ্ধ করে দেয়নি? এরূপ করা হলে সমগ্র মানবজাতিই ইহার অপরিসীম কল্যাণ ও বরকত থেকে উপকৃত হতে পারত এবং একথাও চিরকালের জন্যে প্রমাণিত হতো যে, ইসলাম সত্যিই একটি পূর্ণাংগ জীবনবিধান। যে আল্লাহ বনী আদমকে আশরাফুল মাখলূকাত করে সৃষ্টি করেছেন তিনিই তাদের পথপ্রদর্শনের জন্যে প্রমাণিত হতো যে, ইসলাম সত্যিই একটি পূর্ণাংগ জীবনবিধান। যে আল্লাহ বনী আদমকে আশরাফূল মাখলুকাত করে সৃষ্টি করেছেন তিনিই তাদের পথপ্রদর্শনের জন্যে এই জীবনবিধান অবতীর্ণ করেছেন। উত্তর: এর উত্তর জানার পূর্বে দাস প্রথাতর কারণে যে নানা প্রকার সামাজিক, মনস্তাত্বিক, রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল তার প্রতি দৃকপাত করা প্রয়োজন। কেননা উক্ত পরিবেশ ও সমস্যার কারণেই ইসলাম দাস প্রথার উপর সর্বশেষ আঘাত দিতে অগ্রসর হয়নি। বরং পরবর্তী কিছুকালের জন্যে হিাকে বিলম্বিত করে দিয়েছে। বিষয়টির এই দিকের সমীক্ষণের জন্যে আমাদের একথাও মনে রাখতে হবে যে, দাস প্রথার পরিপূর্ণ বিলম্বিত ক্ষেত্রে যতটুকু বিলম্ব ঘটেছে উহা ইসলামের কাম্য ছিল না এবং ইসলামের অনাবিল প্রকৃতির পক্ষে উহা সম্ভবপরও ছিল না। এই বিলম্বের কারণ ছিল ভিন্নতর। পরবর্তী সময়ে বিভ্রান্তি ও বিমুখতার যে ঝোঁপ্রবণতা ইসলামের অনাবিল উৎসকে ম্লান করে দিয়েছে তা-ই ছিল বিলম্বের একমাত্র কারণ। দাসপ্রথার প্রকৃত ঐতিহাসিক পটভূমি ইসলামের যখন আগমন ঘটে তখন এই দাসপ্রথার প্রচল ছিল সমস্ত দুনিয়ায়। এবং এটা ছিল তৎকালীন সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার এক অবিচ্ছেদ্য অংগ। মানবীয় জীবনের জন্যে এটা ছিল অপরিহার্য। সুতরাং এই অবস্থার আমূল পরিবর্তন তথা দাসপ্রথাকে চিরতরে বন্ধ করার জন্যে এক দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে পর্যায়ক্রমে অগ্রসর হওয়াই ছিল এক বিজ্ঞজনোচিত কাজ। দীর্ঘমেয়াদ ও পর্যাক্রমের এই নীতি ইসলামের অন্যান্য বিধান কার্যকরী করার ক্ষেত্রেও অবলম্বন করা হয়েছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, মদ্যপানকে হঠাৎ করে একেবারেই পুরোপুরিভাবে নিষিদ্ধ করা হয়নি। বরং সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করার পূর্বে বহু বছর ধরে উহার বিপক্ষে মানুষের মন-মানসিকতা তৈরী করা হয়েছে। -যদিও এটা ছিল একটি ব্যক্তিগত অপরাধ এবং সেই জাহেলিয়াতের যুগে আরবে এমন লোকও বর্তমান ছিল যারা মদ্যপানকে অভদ্রোচিত কাজ মনে করে উহা কখনো স্পর্শ করত না। কিন্তু দাসপ্রথা সম্পর্কে আরবদের দৃষ্টিভংগি ছিল সম্পূর্ণ অন্যরূপ। তৎকালীন সমাজ কাঠামো এবং প্রচলিত মন-মানসিকতায় এর শিকড় ছিল অত্যন্ত গভীরে প্রোথিত। কেননা ব্যক্তিগত, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের অসংখ্য কর্মকাণ্ডই এর সাথে সম্পর্কিত ছিল। বস্তুত দাসপ্রথার ভালো-মন্দ সম্পর্কে কারুর কোন লক্ষ্যই ছিল না। একমাত্র এ কারণেই এই প্রথার পুরোপুরি বিলুপ্তির জন্যে হযরত বিশ্বনবী (স)-এর পবিত্র জীবন তথা পবিত্র কুরআনের অবতরণ শেষ হওয়ার পর থেকে আরো দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন ছিল। অতপর যথাসময়েই এই প্রথা বিলুপ্ত হয়ে যায়। আল্লাহ –যিনি সমগ্র সৃষ্টির একমাত্র স্রষ্টা এবং যিনি উহার স্বভাব প্রকৃতি সম্পর্কে পুরোপুরি ওয়াকিফহাল তিনি-খুব ভালোরূপেই জ্ঞাত আছেন যে, মদ্যপান নিষিদ্ধ করার লক্ষ্য কয়েক বছরের মধ্যেই কেবল মৌখিক নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমেই অর্জিত হতে পরে। তাই তিনি যথাসময়েই উহাকে হারাম (বা নিষিদ্ধ) বলে ঘোষণা করেন। অনুরূপভাবে অচিরেই যদি দাসপ্রথাকে নিষিদ্ধ করা সময়োপযোগী হত তাহলে তিনি সাধারণভাবে কিছু উপদেশ দান করেই উহার অপকারিতা সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক করে দিতেন এবং স্বীয় নীতি অনুযায়ী কোনরূপ বিলম্ব না করেই সুস্পষ্ট বিধান দিয়ে উহাকে চিরদিনের জন্যে নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করতেন। কিন্তু অবস্থা অনুকূলে ছিল না বলেই তিনি তা করেননি। [মদ্যপান ও দাসপ্রথার মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। মদ্যপান কোন যুগেই মানুষের জন্যে অপরিহার্য প্রয়োজন বলে পরিগণিত হয়নি। উহা একটি অন্যায় কাজ। কিন্তু উহাকে বর্জন করলে ব্যক্তি বা সমাজ বীজনে কোন শূন্যতার সৃষ্টি হয় না। অথচ ইসলামের আবির্ভাবের যুগে দাসপ্রথা ছিল একটি অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রয়োজন। উহাকে হঠাৎ করে নিষিদ্ধ করে দিলে এমন এক শূন্যতার সৃষ্টি হতো যার ফলে অসংখ্য সংকট ও বিপর্যয়ের সৃষ্টি হতো। ইসলাম তাই উহার বিলুপ্তির জন্যে এমন উপায় অবলম্বন করেছে যার ফলে উহার ধ্বংসাত্মক প্রভাব থেকেও মানুষ মুক্তি লাভ করেছে এবং সমাজেও কোন শূন্যতার সৃষ্টি হয়নি। (অনুবাদক)] ইসলামের কর্মপদ্ধতি আমরা যখন বলি যে, ইসলাম সমগ্র মানবজাতির জীবনপদ্ধতি এবং সকল যুগের সকল মানুষই উহার বিধান অনুসরণ করে এক পূতপবিত্র জীবনের সমস্ত নিখুঁত ও সর্বাধিক কার্যকর নিয়ম-নীতির সাথে পরিচিত হতে পারে, তখন আমরা এই অর্থে বলি না যে, ইসলাম এমন একটি নিরেট জীবনব্যবস্থা যে চিরকালের জন্যে উহার শাখা-প্রশাখা বা খুঁটিনাটি বিষয়গুলো কী হবে তাও পূর্ব থেকেই নির্ধারিত করে দেয়া হয়েছে। কেননা এই ধরনের বিস্তৃত দিকনির্দেশনা উহা শুধু মানুষের মৌলিক সমস্যাগুলোর ক্ষেত্রেই দান করেছ; ইতিহাসের উত্থান পতনের সাথে উহার কোন সম্পর্ক নেই। স্থান-কাল নির্বিশেষে উহা একই রূপ বর্তমা। উহার বাইরের সমস্যাগুলো পরিবর্তনশীল। সে ক্ষেত্রে ইসলাম এমন কিছু মূলনীতি পেশ করেই ক্ষ্যান্ত হয়েছে যাতে করে উহার আলোকে জীবনের উৎকর্ষ ও ক্রমবিকাশ বিন্দুমাত্রও বাধাগ্রস্ত না হয়। ইসলাম দাসপ্রথা বিলোপের ক্ষেত্রে এই মূলনীতিই অবলম্বন করেছে। উহা দাসদের মুক্তির জন্যে শুধু যে ‘ইতক’ ও ‘মুকাতাবাত’ পদ্ধতি গ্রহণ করেছে তাই নয় বরং অতি প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা এই অবহেলিত মানবীয় সমস্যাটির একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্থায়ী সমাধানের পথও উন্মুক্ত করে দিয়েছে। মানবীয প্রকৃতি ও ইসলাম ইসলাম মানবীয প্রকৃতিকে পরিবর্তন করার জন্যে আসেনি, এসেছে উহাকে পরিমার্জিত ও সন্দুর করে তোলার জন্যে। ইসলাম চায়, স্বীয় সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এবং বাইরের কোন চাপ ছাড়াই উহা যেন মানবতার শীর্ষ শিখরে উপনীত হতে পারে। বস্তুত ব্যক্তি জীবনে ইসলাম যে বিপ্লব সৃষ্টি করেছে –যে উৎকর্ষ ও সমৃদ্ধি এনেছে তার কোন তুলনা নেই; অনুরূপভাবে মানুষের সমষ্টিগত জীবনে-তথা তাদের তাহজীব ও তামাদ্দুনের ক্ষেত্রে যে গৌরবময় অধ্যায় রচনা করেছে তারও কোন নযীর বিশ্ব ইতিহাসে নেই। কিন্তু এই সুমহান ও সর্বাত্মক সাফল্য লাভ সত্ত্বেও ইসলাম কখনো ইহা চায়নি যে, মানুষের মূল স্বভাব ও প্রকৃতিতে পরিবর্তন করে দিয়ে এমন এক দৃষ্টান্তমূলক শীর্ষে পৌঁছিয়ে দিবে যেখানে পরবর্তী ও বর্তমান মানবগোষ্ঠী বাস্তব ক্ষেত্রে কস্মিনকালেও পৌঁছতে সক্ষম হবে না। কেননা এমনটি হলে আল্লাহ তা’আলা এই জগতে মানুষকে নয়, বরং ফেরেশতারাই মেনে চলতে সক্ষম হত। ফেরেশাতদের প্রকৃতি সম্পর্কে আল্লাহ বলেন: (আরবী***********) “তাদেরকে যে আদেশ দেয়া হয় তাতে তারা আল্লাহর (সামান্য মাত্রও) নাফরমানি করে না; তাদেরকে যা আদেশ করা হয় তা তারা সাথে সাথেই পালন করে।: -(সূরা আত তাহরীম: ৬) কিন্তু আল্লাহ তা’আলা মানুষকে ফেরেশতা বানাতে চাননি; চেয়ছেন ভালো মানুষ বানাতে। কেননা দুনিয়ার জন্যে তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন। তিনি মানুষের যোগ্যতা ও গুণাবলী সম্পর্কে পুরোপুরিই অবগত ছিলেন এবং ইহাও তিনি অবগত ছিলেন যে, তাদের প্রকৃতিগত যোগ্যতা ও বৃত্তিসমূহের সর্বাত্মক উৎকর্ষের জন্যে কতখানি সময়ের প্রয়োজন- যাতে করে তার দেয়া আইন-কানুনসমূহ হৃদয়ঙ্গম করতঃ যথাযথরূপে মেনে চলতে পারে। সে যাইহোক, ইসলামের একচ্ছত্র গৌরব এবং একক শ্রেষ্ঠত্বকে প্রমাণ করার জন্যে এই একটি বিষয়ই যথেষ্ট যে, মানবেতিহাসে উহাই সর্বপ্রথম দাসপ্রথার বিরুদ্ধে বলিষ্ঠতম কণ্ঠে আওয়াজ তুলেছে এবং তাদের স্বাধীনতার এমন এক সর্বাত্মক আন্দোলন সৃষ্টি করেছে যার তুলনা দুনিয়ার অন্য কোন দেশে দীর্ঘ সাত শ’ বছরেও খুঁজে পাওয়া যায় না। সাত শ’ বছরে ঐ সকল দেশ এই আন্দোলনকে স্বাগত জানিয়ে স্ব স্ব এলাকার দাসমুক্তির জন্যে এগিয়ে এসেছে। বস্তুত আরব উপদ্বীপ থেকে যখন সাত শ’ বছর পূর্বেই এই প্রথাকে সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করে দেয়া হয়েছিল তখন একথা সহজেই অনুমান করা যায় যে, অন্য যে কারণে এই প্রথাটি শতাব্দীর পর শতাব্দীকাল ধরে মূর্তিমান অভিশাপ হয়ে সমগ্র দুনিয়াকে গ্রাস করে রেখেছিল তা অবশিষ্ট না থাকলে ইসলাম আরব উপদ্বীপের ন্যায় উহার প্রভাবিত সমস্ত ভূখন্ড থেকেই উহাকে নির্মূল করতে সক্ষম হতো। কিন্তু উক্ত কারণটি বিরাজমান থাকার ফলেই ইসলামের পক্ষে ইহা সম্ভবপর হয়নি। কেননা উহার সাথে মুসলমানগণ যেমন সম্পর্কিত ছিল তেমনি সম্পর্কিত ছিল অমুসলমানরাও। অথচ অমুসলমানদের উপর ইসলামের কোন আধিপত্য ছিল না। এ কারণেই তখন দাস প্রথার পরিপূর্ণ বিলুপ্তি সম্ভবপর হয়নি। উক্ত কারণটি ছিল যুদ্ধ ও উহার অনিবার্য ফলশ্রুতি। এই যুদ্ধদই ছিল সে যুগের দাসপ্রথার সবচেয়ে বড় উৎস। আরো কিছুদূর অগ্রসর হয়ে এ সম্পর্কে আমরা আলোচনা করব। স্বাধীনতার অপরিহার্য শর্ত দাসপ্রথা সম্পর্কে আলোচনা করার সময়ে একথা অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে যে, স্বাধীনতা কোন স্থান থেকে দান হিসেবে পাওয়া যায় না। বরং বহুবল বা শক্তির জোরেই উহাকে অর্জন করতে হয়। কোন আইন রচনা করলে কিংবা কোন ফরমান জারি করলেই শত শত বছরের পুরানো দাসরা আপনা আপনিই স্বাধীন হয়ে যেতে পারে না। আমেরিকাবাসীদের এই পর্যায়ের অভিজ্ঞতা এই সত্যটি এক স্পষ্ট দর্পণ। আমেরিকার প্রেসিডণ্ট আব্রাহাম লিংকন কলমের এক খোঁচায় সে দেশের দাসদের স্বাধীনতার ফরমান জারি করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে কি শত শত বছরের দাস সত্যিই কি স্বাধীন হয়ে গিয়েছিল? –না, হয়নি। কেনা মানসিক ও আত্মিক দিক থেকে তারা এই স্বাধীনতার জন্যে প্রস্তুত হতে পারেনি। এবং পারেনি বলেই তখনও এরূপ দৃশ্য দেখা গেছে যে, আইনগতভাবেই স্বাধীন হওয়ার পরেও তারা পূর্ববর্তী প্রভুদের নিকট যাচ্ছে এবং তাদের অনুরোধ করছে যে, তারা যেন তাদেরকে ঘর থেকে বের করে না দেন বরং আগের মতই দাস বানিয়ে রেখে দেন। দাসদের মনস্তাত্বিক অবস্থা মানবীয় মনস্তত্বের আলোকে এই বিষয়টির বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে: বাহ্যদৃষ্টিতে অস্বাভাবিক ও বিস্ময়করমনে হলেও প্রকৃতপক্ষে বিষয়টি ততদূর বিস্ময়কর নয়। প্রত্যেক মানুষের জীবনই কিছুসংখ্যক নির্ধারিত অভ্যাস ও কর্মতৎপরতার সমষ্টি মাত্র। যে পরিবেশ ও অবস্থাসমূহের মধ্যে তার জীবন অতিবাহিত হয় উহা তার যাবতীয় ধ্যান-ধারণা ও চিন্তাধারা-বরং তার গোটা মনস্তাত্বিক ভাবধারাকেই প্রভাবিত করে। [জড়বাদীদের মতে মানুষের চিন্তাধারা বস্তুগত অবস্থঞার ফসলমাত্র। কিন্তু তাদের এ দাবী একটি ভ্রান্ত গোলক ধাঁধা বই অন্য কিছুই নয়। প্রকৃত ঘটনা এই যে, বস্তুগত ঘটনাবলী কেবল তখনই সম্পন্ন হয় যখন জীবনে পূর্ব থেকেই উহার জন্য এক মনস্তাত্বিক ভিত্তি রচিত হয়। বাস্তব ঘটনাবলীর প্রবাব মানুষের চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করে-একথা টিক; কিন্তু ইহা কখনো ঠিক নয় যে, চিন্তাধারা ও মতাদর্শ বাস্তব ঘটনারই অনিবার্য ফল।] এ কারণেই একজন দাসের মনস্তাত্বিক গঠনপ্রক্রিয়া ও প্রকৃতি একজন স্বাধীন মানুষের মানসিক ও বাস্তব দৃষ্টিভংগি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর। কিন্তু প্রাচীন যুগের লোকদের এই ধারণা কখনো সঠিক নয় যে, স্বাধীন ব্যক্তি ও দাসের মন-মানসিকতা ও চিন্তাধারার এই পার্থক্য মানুষের মৌলিক পার্থক্য ও মতভেদের ফসল মাত্র। বরং এই পার্থক্যের মূল কারণ হচ্ছে, স্থায়ী দাসত্বের বন্ধরে আবদ্ধ থেকে থেকে দাসের মনস্তাত্বিক জীবনে একটি বিশেষ মেজাজের সৃষ্টি হয়। এতে করে সদাসর্বদাই আনুগত্য ও ফরমাবরদারির এক নিষ্প্রশ্ন স্বভাব তাকে প্রতিনিয়তই আচ্ছন্ন করে বসে; উহার বাইরে কিছু কল্পনা করার ইচ্ছা বা শক্তিও সে হারিয়ে ফেলে। স্বাধীনতা বা স্বেচ্ছা প্রণোদিতভাবে কোন দায়িত্ব পালনের অনুভূতি বলতে তার কিছুই থাকে না। সমাজ ও রাষ্ট্রের কোন স্বাধীন ও দায়িত্বশীর ব্যক্তি হিসেবে যথাযথভাবে নিজ দায়িত্ব পালনের কোন স্বাধীনতা ও দায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসেবে তার যথাযথভাবে নিজ দায়িত্ব পালনের কোন ক্ষমতা তার থাকে না। সে যেমন নিজ থেকে স্বাধীনভাবে কোন কিচু চিন্তা করতে পারে না। তেমনি সাহসী হয়ে কোন কাজের বাস্তব পদক্ষেপও গ্রহণ করতে পারে না। বরং স্বাধীনতালাভের পর একজন স্বাধীন মানুষ যে সকল দায়িত্বপালনে সক্ষম হয় তা পালন করার যাবতীয দায়িত্বই সে হারিয়ে বসে। দাসদের জীবন একজন দাস কেবল তখনই তার কাজ সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে পারে যখন তাকে কিভু ভাবতে না হয়। বরং তার কাজ মুনিবের হুকুম তামিল করা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকে। এ কারণে যদি কখনো তাকে নিজের ফায়সালা অনুসারে কাজ করার দাযিত্ব অর্পণ করা হয় তাহলে সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে; সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা তার বিলুপ্ত হয়ে যায়। সে জীবনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ব্যাপারেও স্বীয় কর্তব্য নির্ধারণ কিংবা উহার ফলাফলের সম্মুখীন হওয়ার সাহস সঞ্চয় করতে পারে না। এই হীনমন্যতার কারণ তার মানসিক বা দৈহিক দুর্বলতা নয়; বরং মনস্তত্বের ভাষায় এর ভাষায় কারণ হলো এই যে, তার কার্য-কলাপের সুফল-কুফলের মোকাবিলা করার নৈতিক সাহস থেকে সে বঞ্চিত হয়ে পড়ে; সম্ভাব্য সংকট বা কুফলের মোকাবিলা করার নৈতিক সাহস থেকে সে বঞ্চিত হয়ে পড়ে; সম্ভাব্য সংকট বা কুফলের ভয়ে সে ভীত হয়ে যায় এবং খামাখাই সে বুঝতে শুরু করে যে, উহা নিয়ন্ত্রণ করার শক্তি তার নেই। অবশেষে হাত-পা গুটিয়ে বসে পড়ে এবং নিজের জান বাঁচাবার জন্যে এই কর্মচঞ্চল জীবন থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। প্রাচ্য জগতে দাসত্বের প্রভাব নিকটবর্তী অতীতের মিসর ও পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে অনুমান করা যায় যে, পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদের আমদানীতে মানসিক ও দৈহিক দাসত্ব প্রাচ্যের অধিবাসীদের জীবনকে কতদূর মূল্যহীন ও অথর্ব করে তুলেছে। পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদী শক্তি নিজেদের ঘৃণ্য উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্যে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবেই এদের উপর মানসিক ও দৈহিক দাসত্বের জাল বিস্তার করেছে এবং ছেড়ে যাওয়ার সময়ে গোটা প্রাচ্য জগতকেই তাদের কঠিন বন্ধরে আবদ্ধ করে রেখে গেছে। বস্তুত এই হচ্ছে তাদের মানসিক দাসত্ব। এরই সুস্পষ্ট প্রকাশ আমরা দেখতে পাই পাশ্চাত্যের পদলেহনকারী লোকদের কথাবার্তা ও বক্তৃতার মাধ্যমে। তারা যখন ইসলামের কতক আইন-কানুনকে বস্তাপচা ও বেকার সাব্যস্ত করে এরূপ ধারণা পোষণ করে যে, বর্তমান যুগে উহা সম্পূর্ণরূপেই অচল তখন এর অন্তরালে তাদের সেই দাস্য মনোবৃত্তিই সক্রিয় হয়ে উঠে যার ফলে একজন দাস স্বেচ্ছায় ও স্বাধীনভাবে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের এবং উহার সুফল-কুফলকে পৌরুষের সাথে মোকাবেলা করার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলে। এ কারণেই যদি কোন ইংরেজ বা আমেরিকান আইনবিদ অধিক থেকে অধিকতর জঘন্য কোন আইনকে সমর্থন করে তাহলে এই লোকেরা কুব আনন্দের সাথে উহাকে জারি করার জন্যে প্রস্তুত হয়ে যায়। কেননা এমনি করে তারা নিজেদের ইচ্ছার স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের এবং নিজেদের ক্ষমতার বলে উহাকে জারি করার ঝুঁকি থেকে বেঁচে যায়। পাশ্চাত্যের দেশসমূহে এখন যে কার্যালয় ব্যবস্থাপনা (Official Management) দেখা যায় উহাও সেই গোলামী যুগের স্মৃতি বহন করে চলেছে। এই সকল কার্যালয়ের নিষ্প্রাণ কর্মপদ্ধতি এবং উহার ভীতসন্ত্রস্ত কর্মচারীদের প্রতি তাকালে একথা সহজেই অনুমান করায ায় যে, দাসত্বের অভিশপ্ত ছায়া এখও পাশ্চাত্যের অধিবাসীদেরকে কী রূপে গ্রাস করে রেখেছে। রাষ্ট্রীয় কর্মচারীদের মধ্যে এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না যে, স্বেচ্ছায় সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কোন মতামত দিতে সক্ষম। উপরস্থ কর্মচারীদের দ্ব্যার্থহীন নির্দেশ ও পরামর্শ ব্যতিরেকে নিম্নস্থ কোন কর্মচারীই নিজ দায়িত্বে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে না। একই রূপে উপরন্তু কর্মচারীরাও তাদের নিম্নস্থ কর্মচারীদের ন্যায় কোন বিষয়ে স্বাধীনভাবে মতামত দেয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারে না। তাদের যাবতীয় কর্তব্য-অকর্তব্য তাদের মর্জির উপরই নির্ভরশীল। তাদের মন-মানসিকতা যদি দাসদের মত না হতো তাহলে কিছুতেই তারা নিষ্প্রাণ মেশিনের মত হতে পারত না এবং এরূপ অসহায় জীবের মত অন্যের মুখাপেক্ষী হতে পারত না। তাদের এই সুনির্দিষ্ট দাস্য মনোবৃত্তি অন্যের ফরমাবরদারির জন্যে তো খুবই প্রশংসনীয়। কিন্তু স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের যোগ্যতার বিচারে একেবারেই অর্থহীন। এই মনোবৃত্তির উপস্থিতিতে স্বাধীনতার দাবী কখনো পূর্ণ হতে পারে না এবং স্বাধীন জীবনযাপন করাও সম্ভবপর হতে পারে না। বলা বাহুল্য এ কারণেই তাদেরকে বাহ্যদৃষ্টিতে স্বাধীন বলে গণ্য করা হয়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাদের অবস্থা দাসদের চেয়ে কোন অংশেই উৎকৃষ্ট নয়। দাসত্বের মূল কারণ প্রকৃত ঘটনা হলো এই যে, এই দাস্য মনোবৃত্তিই একজন দাসকে দাস বানিয়ে দেয়। প্রথম দিকে তো বাইরের কোন অবস্থার ফলে ইহার সৃষ্টি হয়; কিন্তু যতই দিন যেতে থাকে ততই উহার বন্ধন দৃঢ় হতে দৃঢ়তর হতে থাকে এবং পরিশেষে ইহা এক পৃথক ও স্বতন্ত্র স্বভাবে পরিণত হয়। একটি বৃক্ষের শাখা যেমন কিছুকাল জমিনের উপর পড়ে থাকলে ধীরে ধীরে উহার শিকড় জমিনের নিচে বিস্তালাভ করে এবং একদিন উহা একটি পৃথক বৃক্ষে পরিণত হয়। ঠিক তেমনি অবস্থাই একজন মানুষের মানসিকতার ক্ষেত্রেও সংঘটিত হয়। সংশোধনের নির্ভুল পন্থা এই প্রকার দাস্য মনোবৃত্তিকে কেবল দাসত্ব বিরোধী আইন প্রবর্তন করেই নির্মূল করা যায় না। উহাকে নির্মূল করার জন্যে প্রয়োজন নতুন পরিবেশ সৃষ্টি আভ্যন্তরীণ বিপ্লব। এতে করে দাসদের মনস্তাত্বিক ও প্রকৃতিগত ধারাকে সম্পূর্ণ নতুন খাতে প্রবাহিত করা যেতে পারে এবং ব্যক্তি চরিত্রের সেই সকল দিককে অনুপ্রাণিত করা যেতে পারে যার ফলে একজন মানুষ স্বাধীন মানুষ হিসেবে জীবনযাপনের সকল ক্ষেত্রে যাবতীয় দায়িত্ব পালনের জন্যে নির্দ্বিধায় অগ্রসর হতে পারে। ইসলামের ধারাবাহিক কর্মপদ্ধতি বস্তুত ইসলাম ঠিক এই পরিকল্পনা অনুযায়ী কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। প্রাথমিক পর্যায়ে উহা দাসদের প্রতি উহার ভদ্রজনোচিত ও সুবিচারভিত্তিক ব্যবহারের শিক্ষা দিয়েছে। দাসদের মনস্তাত্বিক ভারসাম্যতার পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং তাদের মধ্যে মানবীয় মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের অনুভূতি সৃষ্টির জন্যে এই শিক্ষাই ছিল সর্বোৎকৃষ্ট বিধান (Prescription)। কেননা মানুষ একবার যখন মানবীয় মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ কর তখন তারা উহার দাবী ও দায়দায়িত্ব সম্বন্ধে আর ভীত হয় না। -এবং আমেরিকার নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দাসদের ন্যায় পুনরায় দাসত্বের আশ্রয় গ্রহণ করে নির্ঝঞ্ঝাট জীবনযাপনের জন্যেও লালয়িত হয় না। দাসদের সাথে সদ্ব্যবহার এবং তাদের মানবীয় মর্যাদা ও সম্মান পুনরুদ্ধার পর্যায়ে মুসলিম জাতির ইতিহাস চরম বিস্ময়কর ও প্রশংসনীয় দৃষ্টান্তে ভরপুর। এ পর্যায়ে আমরা পবিত্র কুরআন ও হাদীস থেকে কিছু উদ্ধৃতি ইতিপূর্বে পেশ করেছি। এখানে অত্যন্ত সংক্ষেপে হযরত নবী (স)-এর বাস্তব জীবন থেকে কিছু ঘটনা উল্লেখ করছি। দাস হলো প্রভুর ভাই মদনিায় আগমনের পর হযরত বিশ্বনবী (স) মুসলমানদের মধ্যে যে ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করেন তাতে করে তিনি আরব প্রভুদেকে আযাদকৃত দাসদের ভাই বানিয়ে দেন। হযরত বেলল ইবনে রিবাহকে হযরত খালিদ ইবনে রুয়াইহার, হযরত জায়েদকে [যিনি স্বয়ং বিশ্বনী (স)-এর আযাদকৃত দাস ছিলেন] হযরত হামজার এবং হযরত খারিজাকে হযরত আবু বকরের ভাই বানিয়ে দেন। ভ্রাতৃত্বের এই সম্পর্ক রক্ত সম্পর্কের চেয়ে কোন অংশেই কম ছিল না। কেননা যাদেরকে একে অন্যের ভাই বানিয়ে দেয়া হলো তাদেরকে একে অন্যের উত্তরাধিকার বলেও গণ্য করা হলো। দাসদের সাথে বিবাহ ইসলাম এখানেই ক্ষান্ত হয়নি, বরং আরো এক ধাপ অগ্রসর হয়েছে। হযরত বিশ্বনবী (স) তাঁর ফুফাতো বোন হযরত জয়নাবকে নিজের দাস হযরত জায়েদের নিকট বিবাহ দেন। কিন্তু হযরত বিশ্বনবী (স)-এর কথায় হযরত জয়নাব সম্মত হলেও মানসিকভাবে তাদের দাম্পত্য জীবন সুখময় হয়নি। কেননা বিবাহের গভীরতম সম্পর্ক নির্ভর করে মানুষের –বিশেষ করে নারীর সূক্ষ্ম অনুভূতি ও চিন্তাধারার উপর। হযরত জয়নাবের বংশ ছিল ধনবান ও সম্মানীয়। অথচ হযরত জায়েদ ছিলেন দরিদ্র। বংশীয় মর্যাদা থেকে তিনি ছিলেন বঞ্চিত। এই বিবাহে হযরত বিশ্বনবী (স)-এর যে লক্ষ্য ছিল তা অর্জিত হয়েছিল নিসন্দেহে। নিজ বংশের একজন মেয়েকে একজন দাসের সাথে বিবাহ দিয়ে তিনি বিশ্ববাসীর নিকট এই সত্যই তুলে ধরেছেন যে, অত্যাচারী মানবগোষ্ঠী তাদেরই একটি শ্রেণীকে লাঞ্ছনা ও অবমাননার যে গভীর পঙ্কে নিমজ্জিত করে রেখেছে সেখান থেকে বের হয়ে একজন দাসও কুরাইশ দলপতিদের ন্যায় ইজ্জত ও সম্ভ্রমের শীর্ষ শিখরে আরোহণ করতে পারে। কিন্তু ইসলামের যে মহান লক্ষ্য ছিল তা এতটুকু করেই অর্জিত হয়নি। ইসলামী সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে ইসলাম দাসদেরকে সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব এবং জাতীয অধিনায়কত্বের পদও প্রদান করেছে। হযরত বিশ্বনী (স) যখন আনসার ও মুহাজিরদের নিয়ে একটি সেনাবাহিনী গঠন করে তখন তার সিপাহসালার (Commander in Chif) নিয়োগ করেন তাঁরই দাস হযরত জায়েদ (রা)-কে। হযরত জায়েদের ইন্তেকালের পর তিনি এই দায়িত্বভার তারই পুত্র হযরত উসাম (রা)-এর হস্তে অর্পণ করেন। -অথচ এই সেনাবাহিনীতে হযরত আবু বকর (র) এবং হযরত উমর (রা)-এর ন্যায় মহা সম্মানীয় ও সর্বজনমান্য আরব নেতৃবৃন্দও বর্তমান ছিলেন- যারা তাঁর জীবদ্দশায় সুবিশ্বস্ত পরামর্শদাতা ছিলেন এবং তাঁর ওফাতের পর তাঁরই স্থলাভিষিক্ত হন। এরূপে হযরত বিশ্বনবী (স) দাসদেরকে শুধু স্বাধীন মানুষের মর্যাদাই প্রদান করেননি, বরং স্বাধীন সৈন্যদের সুউচ্চ নেতৃত্বের পদও অলংকৃত করার সুযোগ দিয়েছেন। এই পর্যায়ে হযরত বিশ্বনবী (স) এতদূর গুরুত্ব আরোপ করেছেন যে, তিনি স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছেন: “শোন এবং নেতৃবৃন্দের আনুগত্য কর, একজন মস্তক মুণ্ডানো হাবশী দাসকেও যদি তোমাদের নেতা বানানো হয় তবুও তার আনুগত্য কর –যতক্ষণ সে তোমাদের মধ্যে আল্লাহর আইন জারি করবে।” –(আল বুখারী) অন্য কথায় বলা যায়, ইসলাম একজন দাসের এ অধিকারকেও স্বীকৃতি দিয়েছে যে, ইসলামী রাষ্ট্রে সে সর্বোচ্চ পদও অলংকৃত করতে পারে। হযরত উমর (রা) যখন তার স্থলাভিষিক্ত খলীফা পদে লোক নির্বাচিত করার প্রয়োজন অনুভব করেন তখন তিনি বললেন: “আবু হুযাইফার দাস সালেম যদি জীবিত থাকতেন তাহলে আমি তাকে খলীফা পদে নিয়োগ করতাম।” এই উক্তি মূলতঃ হযরত বিশ্বনবী (স)-এর বক্তব্যের ব্যাখ্যা মাত্র। হযরত সাহাবায়ে কেরাম (রা) তাঁদের জীবনে একে বাস্তবায়িত করে দেছিয়েছেন। হযরত উমর ও হযরত বেলাল (রা) হযরত উমর (রা)-এর জীবন চরিত অধ্যয়ন করলে ইসলামী সমাজে আরো একটি দিক থেকে দাসদের মর্যাদা স্পষ্ট হয়ে উঠে। মদ সম্পর্কে হযরত বেলাল ইবনে রিবাহ (একজন আযাদকৃত দাস) যখন হযরত উমরের মতকে দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেন তখন হযরত উমর (রা) যিনি ছিলেন তৎকালীন খলীফাতুল মুসলেমীন –কোনোক্রমেই বেলাল (রা)-কে সম্মত করাতে না পেরে শুধু আল্লাহর দরবারেই দোয়া করলেন: (আরবী*********) “হে আল্লাহ! বেলাল এবং তাঁর সাথীদের জন্যে আমাকে যথেষ্ট বানিয়ে দাও।” প্রজাদের মধ্যে একটি মাত্র ব্যক্তির –একজন ভূতপূর্ব দাসের –বিরোধিতার জবাবে একজন খলীফাতুল মুসলেমীনের মানসিক প্রতিক্রিয়া যে কতদূর অর্থবহ ও মর্মস্পর্শী তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় কি? দাসদের সাথে সদ্ব্যবহারের মূল কারণ অসংখ্য দৃষ্টান্তের মধ্যে মাত্র কয়েকটি দৃষ্টান্তের কথা এখানে আলোচনা করা হলো। এতে করে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, ইসলাম প্রথম পর্যায়ে দাসদেরকে কেবল মনস্তাত্বিক ও মানসিক দিক থেকে স্বাধীনতালাভের জন্যে তাদের সাথে উদার ও সহানুভীতমূলক ব্যবহারের শিক্ষা প্রদান করেছে। এবং এরই অনিবার্য ফল স্বরূপ তাদের মধ্যে মানবীয় মর্যাদার সঠিক চেতনা সৃষ্টি হয়েছে এবং তাদের অন্তরে হারানো স্বাধীনতা ফিরে পাওয়ার ইচ্ছা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। ইসলাম একদিকে মুসলমানদেরকে এই শিক্ষা দিয়েছে যে, তারা স্বেচ্ছায় তাদের দাসদের আযাদ করে দিক এবং অন্যদিকে দাসদের মন-মানসিকতার স্তরকে উন্নত করার জন্যে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে এবং তাদেরকে এই নিশ্চয়তা দিয়েছে যে, তারা ইচ্ছা করলে তাদের হারানো স্বাধীনতা এবং তাদের প্রবুরা যে সকল অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে তা অবশ্যেই লাভ করত পারে। দাসদের এই মানসিক প্রশিক্ষণের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল তাদের মধ্যে স্বাধীনতার স্পৃহা জাগ্রত করা এবং স্বাধীনতালাভের পরবর্তী সময়ের সর্বাত্মক দায়িত্ব পালনের উপযুক্ত করে গড়ে তোলা। এরূপে তারা যখন স্বাধীনতার জন্যে উপযুক্ততা অর্জন করে ঠিক তখনই ইসলাম বাস্তব ক্ষেত্রেও তাদেরকে আযাদ করে দেয়ার নির্দেশ প্রদান করে। কেননা ঐ সময়েই তারা স্বাধীনতার জন্যে উপযুক্ত হয়ে উঠে এবং উহা রক্ষা করার যোগ্যতাও তাদের মধ্যে সৃষ্টি হয়ে যায়। পাশ্চাত্য জগতের উপর ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব একটি জীবনব্যবস্থায় মানুষের স্বাধীনতার স্পৃহাকে জাগ্রত করে দেয়া হয়-উহাকে ভাষা দেয়া হয়। উহার বাস্তব অভিব্যক্তির জন্যে প্রয়োজনীয় সকল মাধ্যম ও পন্থা অবলম্বন করা হয় এবং এরপরই যখনই সে স্বাধীনতার জন্যে আবেদন করে তখনই তাকে স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেয়া হয়। এবং আরেকটি জীবনব্যবস্থায় দাসদেরকে চিরকালের জন্যেই দাসত্বের বন্ধরে আবদ্ধ দেখতে চায়, তাদেরকে এতদূর দুর্বল ও অসহায় করে রাখা হয় যে, বাইরের জগতে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ইনকিলাবের ফলে লাখ লাখ মানুষের হত্যা ও লুণ্ঠনের শিকার না হওয়া পর্যন্ত তারা স্বাধীনতার কোন আশা করতে পার না। এই দু’টি ব্যবস্থায় আসমান-জমিন পার্থক্য বর্তমান। দাস প্রথার বিলুপ্তির ক্ষেত্রে ইসলাম যে অন্যান্য জীবনপদ্ধতির তুলনায় বহুগুণে শ্রেষ্ঠ তার বিভিন্ন দিক বর্তমান। ইসলামের উদ্দেশ্য ছিল বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ উভয় দিক থেকেই দাসদের মুক্ত করা। আব্রাহম লিঙ্কনের ন্যায় উহা দাসদেরকে মানসিকভাবে আযাদীর জন্যে উপযুক্ত করে তোলার পূর্বেই শুধু মহৎ উদ্দেশ্যের উপর ভরসা করে তাদের মুক্তির জন্যে একটি ফরমান জারী করাকেই যথেষ্ট বলে মনে করেনি। ইসলামের এই কর্মপদ্ধতি পর্যালোচনা করলে সহজেই উপলব্ধি করা যায় যে, মানুষের মনোবৃত্তি ও মনস্বত্ব সম্পর্কে ইসলামের প্রজ্ঞা কত গভীর এবং স্বীয় লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে সম্ভাব্য পন্থা ও মাধ্যমকে ব্যবহার করার প্রশ্নে উহা কতদূর সক্রিয়। ইসলাম দাসদেরকে কেবল মুক্তই করেনি, বরং শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদেরকে এতদূর উপযুক্ত করে তুলেছে যে, তারা স্বাধীনতার যাবতীয় দায়িত্বভারও সহজে বহন করতে পারে এবং স্বাধীনতার হেফাযত করতেও সক্ষম হয়। ইসলামের এই শিক্ষা গোটা সমাজব্যবস্থায় পারস্পরিক সহযোগিতা, ভালোবাসা এবং কল্যাণকামিতার প্লাবন সৃষ্টি করে দিয়েছে। অথচ ইউরোপের দাসরা মানবীয় অধিকার আদায়ের জন্যে প্রাণপণ লড়াই ব্যতিরেকে স্বাধীনতা অর্জন করতে পারেনি। ইসলাম কোন বাধ্যবাধকতার কারণে কিংবা কোন চাপের মুখে দাসপ্রথাকে বিলোপ করেনি। ইউরোপে ন্যক্কারজনক শ্রেণী সংগ্রামের ফলে সেখানকার দাসরা আযাদীর সাথে পরিচিত হয়ে উঠেছে। অথচ ইসলাম নিজ থেকেই দাস প্রথা বন্ধ করার জন্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে এবং কখনো উহা শ্রেণী সংগ্রাম শুরু হওয়ার অপেক্ষা করেনি। বিভিন্ন দল ও শ্রেণীর মধ্যে পারস্পরিক সংঘর্ষ চরমে উঠুক, তিক্ততার পর তিক্ততা সৃষ্টি হোক এবং পরিশেষে এক সময়ে দাসরা কোন প্রকারে স্বাধীনতা লাভ করুক –ইহা ইসলামের কাম্য নয়। ইউরোপে শ্রেণী সংগ্রামের ফলে উদ্ভূত ঘৃণা ও তিক্ততা মানুষের সুকুমার বৃত্তিগুলোকে বিনষ্ট করে দিয়েছে। ফলে তাদের মানসিক উৎকর্ষকে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। দাসদের মানসিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের পর তাদের আযাদীর পূর্ণতার উদ্দেশ্যে ইসলাম যে সামাজিক ভিত্তি রচনা করেছে তার পর্যালোচনা আমরা এই অধ্যায়ের শেষ ভাগে করতে চাই। যুদ্ধ ও দাসত্ব ইতোপূর্বেই আমরা আলোচনা করেছি যে, ইসলাম দাস হওয়ার একটিমাত্র কারণ ছাড়া সকল কারণকেই অত্যন্ত সাফল্যের সাথে দূর করতে সক্ষম হয়েছে। সে কারণটি হলো ‘যুদ্ধ’। এটা দূর করা বাস্তবেই ইসলামের পক্ষে সম্ভবপর ছিল না। বস্তুত দাসদের স্বাধীনতা আন্দোলনের পর দাস হওয়ার এই একটি বড় কারণই অবশিষ্ট ছিল। এর বিস্তৃত বিবরণ নিম্নে দেয়া হলো। একটি প্রাচীন প্রথা প্রাচীনকাল থেকেই দুনিয়ার সকল জাতির মধ্যেই এই প্রথা প্রচলিত ছিল যে, যুদ্ধের ময়দানে যে সেনাবাহিনী পরাজিত হতো তাদের সবাইকেই (একজনকেও বাদ না দিয়ে) হয় নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হতো কিংবা তাদেরকে দাস বানিয়ে [ Universal History of the World নামক ঐতিহাসিব বিশ্বকোষের ২২৭৩ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে: “৫৯৯ খৃস্টাব্দে রোম সম্রাট Marius বিভিন্ন যুদ্ধে কয়েক লক্ষ্য কয়েদীকে বন্দী করেন। তিন তাদেরকে মুক্তি দিতে কিংবা মুক্তিপণ গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন এবং তাদের সবাইকে মেরে ফেলেন।] রাখা হতো। অতপর দীর্ঘকাল অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে যুদ্ধের এই ঐতিহ্য অতীব মানব গোষ্ঠীর জীবনের জন্যে এক অপরিহার্য প্রয়োজন ও সত্য বলে পরিগণিত হয়। মুসলমান যুদ্ধবন্দী দুনিয়ার এই সামাজিক পটভূমিতে ইসলামে আবির্ভাব ঘটে এবং ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে মুসলমানদেরকে কিছু সংখ্যক যুদ্ধও পরিচালিত করতে হয়। এই সকল যুদ্ধে যে সমস্ত মুসলমানকে বন্দী করা হতো কাফেররা তাদেরকে দাস বানিয়ে ফেলত; তাদের যাবতীয় অধিকার ছিনিয়ে নেয়া হতো এবং সে যুগের দাসদের জন্যে নির্ধারিত উৎপীড়ন ও নির্যাতন তাদের উপরও চালানো হতো। নারীদের সতীত্ব ও ইজ্জতের প্রতি কোন সম্মান প্রদর্শন করা হতো না। বস্তুত নারীদের সতীত্ব বিনষ্ট করার ক্ষেত্রে বিজয়ীদের দ্বিধা বা সংকোচ বলতে কিছুই ছিল না। কোন কোন সময়ে পিতা-পুত্র ও বন্ধু-বান্ধবরা মিলিত হয়ে একই নারীর উপর ধর্ষণ চালাতো এবং এরূপে সে তাদের সাধারণ (Common) রক্ষিতা বলে গণ্য হতো। এই পর্যায়ে নারীত্বের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ যেমন কোন বাধার সৃষ্টি করত না। তেমনি কুমারী বা বিবাহিতা হওয়ার প্রশ্নও তাদের মনে কোন দয়ার উদ্রেক করত না। সে সকল শিশুকে বন্দী করা হতো তাদেরকেও একই রূপ ভাগ্য বরণ করতে হতো। একটি বাস্তব বাধা এই পরিস্থিতিতে শত্রু পক্ষের যুদ্ধ বন্দীদেরকে হঠাৎ করে মুক্তি দেয়া ইসলামের পক্ষে বাস্তবেই সম্ভবপর ছিল না। কেননা এরূপ করলে তা কিছুতেই কল্যাণকর হতো না। শত্রুরা এরূপ সুযোগ পেলে পাল্টা পদক্ষেপের আশংকা থেকে মুক্ত হয়ে যেত এবং সম্মানিত মুসলমানদেরকে দাস বানিয়ে ইচ্ছামতো নির্যাতন চালাতে থাকত। এই পরিস্থিতিতে ইসলামের জন্যে এই একটি পথই উন্মুক্ত ছিল যে, শত্রুরা মুসলমান কয়েদীদের সাথে যেমন ব্যবহার করবে শত্রু পক্ষের কয়েদীদের সাথেও তেমনি ব্যবহার করা হবে। মোটকথা ইসলামের সাথে শত্রু পক্ষের সহযোগিতা না করা পর্যন্ত যুদ্ধবন্দীদেরকে দাস রূপে গণ্য করার এই ঐতিহ্যকে খতম করা কিছুতেই সম্ভবপর ছিল না। এ কারণেই দাস প্রথাকে চিরতরে বিলুপ্ত করার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত –অন্য কথায় যুদ্ধবন্দী সম্পর্কে বিশ্বের সমস্ত জাতির একটি সাধারণ কর্মনীতি গ্রহণ না করা পর্যন্ত ইসলাম এর অস্তিত্বকে অনিচ্ছা সত্বেও বরদাশত করেছে। যুদ্ধের প্রাচীন ইতিহাস প্রাচীণকাল থেকে আজ পর্যন্ত যুদ্ধের মানেই হচ্ছে বিশ্বাসঘাতকতা, ধোঁকাবাজি, উৎপীড়ন ও নির্যাতন। অন্য লোকদেরকে দাস বানিয়ে নিজেদের ঘৃণ্য উদ্দেশ্যকে পূর্ণ করার মাধ্যম হচ্ছে এই যুদ্ধ। এক একটি যুদ্ধের পেছনে সক্রিয় হয়ে উঠে বিভিন্ন জাতির ঘৃণ্য লোভ, দেশ জয়ের লালসা এবং স্বার্থ উদ্ধোরের জঘন্য অভিলাষ। এ সমস্ত যুদ্ধ ছিল রাজা-বাদশা সেনানায়কদের ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারের জঘন্য অভিলাষ। এ সমস্ত যুদ্ধ ছিল রাজা-বাদশা সেনানায়কদের ব্যক্তিগত স্বার্থ অহংকার ও প্রতিশোধ স্পৃহার অনিবার্য ফসল। ন্যাক্কারজনক ও স্বার্থ প্রণোদিত এই সকল যুদ্ধে যে সমস্ত কয়েদীকে বন্দী করা হতো তাদেরকে দাস বানাবার কারণ এই ছিল না যে, প্রত্যয় ও লক্ষ্যের দিক থেকে তারা ছিল বিজয়ীদের চেয়ে নিকৃষ্ট কিংবা দৈহিক, মনস্তাত্বিক ও মানসিক যোগ্যতার দিক থেকে তারা ছিল তাদের চেয়ে পশ্চাদপদ বরং তাদের একমাত্র অপরাধ ছিল; তারা পরাজিত, যুদ্ধ ক্ষেত্রে তারা পরাস্ত হয়েছে বিজয়ীদের হাতে। কাজেই বিজয়ীরা অধিকার হাসিল করতঃ তারা ইচ্ছামত তাদের উপর অত্যাচার চালাবে, তাদের ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলবে, তাদের শান্তিপূর্ণ শহর ও বস্তিগুলোকে ধ্বংস করে দিবে এবং তাদের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সবাকেই তরবারি দ্বারা দ্বিখণ্ডিত করে ফেলবে। তাদের এ কাজে বাধা দেয়ার কেউই ছিল না। কেননা তাদের সম্মুখে না ছিল কোন মহৎ উদ্দেশ্য, না ছিল কোন সমুন্নত জীবন বিধান। যুদ্ধের পরিবর্তে জিহাদ যুদ্ধের এই ঘৃণ্য দিকগুলোকে ইসলাম নির্মূল করে দিয়েছে। উহা আল্লাহর পথে জিহাদ ছাড়া অন্যান্য সকল প্রকার যুদ্ধকে নিন্দনীয় সাব্যস্ত করে উহাকে নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করেছে। উহা কেবল জিহাদকেই অবশিষ্ট রেখেছে। কেননা উহার উদ্দেশ্য হলো মানুষকে মানুষের জুলুম ও অত্যাচার-উৎপীড়ন থেকে রক্ষা করা, সাম্রাজবাদী ও নিষ্ঠুর শাসকদের কবল থেকে মানুষকে মুক্ত করা। সত্যকে গ্রহণ করার পথে তারাই ছিল বড় অন্তরায়। কেননা তারা আল্লাহর সৃষ্ট বান্দাদেরকে তার পথ থেকে বিচ্যুত করে নিজেরাই হয়েছিল তাদের আল্লাহ। সুতরাং তাদের উদ্ধত মস্তককে অবনত করার জন্যে প্রয়োজন ছিল অস্ত্রের দরকার ছিল তরবারির –যাতে করে মানুষ পেতে পারে তাদের সত্যিকার আযাদী। স্বেচ্ছায় বেছে নিতে পারে তাদের মুক্তির পথ। এই প্রসংগে আল্লাহ তা’আলা বলেন: (আরবী**********) “এবং তোমরা আল্লাহর পথে সেই সমস্ত লেকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর যারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে। কিন্তু সীমালংঘন করো না। কেননা আল্লাহ সীমালংঘনকারীদেরকে ভালোবাসেন না। -(সূরা আল বাকারা: ১৯০) তিনি আরো বলেন: (আরবী************) “এবং তোমরা তাদের সাথে ততক্ষণ পর্যন্ত যুদ্ধ কর যতক্ষণ না সমগ্র দ্বীন আল্লহর জন্যে হয়ে যায়।” –(সূরা আল আনফাল: ৩৯) ইসলামের পয়গাম শাস্তি ও নিরাপত্তার পয়গাম। এ থেকে কোন মানুষই বিমুখ হতে পারে না এবং কেউ একে নিষ্প্রয়োজনও মনে করতে পারে না। আজ ইসলামী দুনিয়ার বিরাট সংখ্যক খৃষ্টান ও ইহুদী সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে নিজেদের ধর্ম-কর্ম পালন করছে। এতে করে এই সত্যই দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, ইসলাম স্বকীয় বিশ্বা ও চিন্তাধরাকে কখনো জোর করে কারুর উপর চাপিয়ে দেয় না এবং এই প্রকার জবরদস্তির নীতিও কখনো সমর্থন করে না। [বিখ্যাত ইংরেজ লেখক আরনল্ড The Preaching of Islam নামক গ্রন্থে ইসলামের এই দাবী অকুণ্ঠভাবে সমর্থন করেছেন।] অমুসলমানদের সাথে ইসলামের ব্যবহার যদি কোন ব্যক্তি বা জনগোষ্ঠী ইসলামী পয়গামকে স্বাগত জানায় এবং ইসলামের দেয়া সত্যকে গ্রহণ করে তাহলে মুসলমান এবং তাদের মধ্যে যাবতীয় শত্রুতা শেষ হয়ে যায়; বরং তারাও মুসলিম সমাজের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়; তখন তাদেরকে দাস মনে করা তো দূরের কথা তাদের সামান্যতম তুচ্ছ করারও অধিকার থাকে না। মুসলমানদের ন্যায় তারাও সমান অধিকা ও সুবিধা ভোগ করতে থাকে। কেননা মুসলমানদের মধ্যে বিভিন্ন দলাদলি কিংবা আশরাফ-আতরাফের বৈষম্য সৃষ্টি করা সম্পূর্ণরূপে অবৈধ। অনারব ব্যক্তির চেয়ে কোন আরব শ্রেষ্ঠ নয়। এখানে শ্রেষ্ঠত্বের একমাত্র মাপকাঠি হচ্ছে মানুষের সৎকর্ম ও আল্লাহভীতি। অন্যদিকে যদি কেউ ইসলামকে দ্বীন হিসেবে গ্রহণ না করে, অথচ ইসলামের দয়ায় মুসলমানদের সাথে বসবাস করতে চায় তাহলে ইসলাম তাকে নিজের অনুসারী বানানোর জন্যে বিন্দুমাত্রও চেষ্টা করে না; বরং তার নিকট থেকে এক প্রকার নির্ধারিত কর আদায় করে তার সর্বাত্মক নিরাপত্তা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করে। এই করকে বলা হয় ‘জিজিয়া’। ইহা গ্রহণের সময়ে ইসলাম এরূপ অংগীকারও করে যে, ইসলামী সরকার যদি কোন বাইরের শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হয়ে তাকে রক্ষা করতে না পারে তাহলে এই করের সমুদয় অর্থ তাকে ফেরত দেয়া হবে। [ইসলাম ইতিহাসের অসংখ্য ঘটনা বর্তমান। আমরা এখানে টি. ডাবলিউ আরনল্ড প্রণীত The Preaching of Islam নামক গ্রন্থ থেকে কয়েকটি দৃষ্টান্ত পেশ করছি। উহার ৫৮ পৃষ্ঠায় মিঃ আরনল্ড বলেন: “হীরার উপকণ্ঠে অবস্থিত এলাকাবাসীদের সাথে খালেদ (রা) যে চুক্তি সম্পাদন করেছিলেন তাতে লেখা ছিল: যদি আমরা তোমাদের হেফাযত করতে পারি তাহলে জিজিয়া আমাদের প্রাপ্য, কিন্তু আমরা হেফাযত করতে না পারলে উহা আমাদের প্রাপ্য নয়।” তিনি আরো বলেন: “আরব জেনারেল আবু উবায়দা (রা) সিরিয়ার বিজিত নগরসমূহের পরিচালকদের নিকট এরূপ লিখিত ফরমান প্রেরণ করেন যে, তিনি যেন জিজিয়া বাবদ আদায়কৃত সমুদয় অর্থ ঐ সকল শহরবাসীকে ফেরত দেন। অতপর হযরত আবু উবায়দা (রা) উক্ত শহরবাসীদের নিকট লিখেন: আমরা তোমাদের অর্থ তোমাদের ফেরত দিচ্ছি: কেননা এক বিরাট সেনাবাহিনী আমাদের আক্রমণ করছে। যেহেতু চুক্তি অনুযায়ী আমরা তোমাদের হেফাযত করতে সক্ষম নেই। সেহেতু তোমাদের দেয়া কর আমরা ফেরত দিচ্ছি। আমরা জয়লাভ করলে আমাদের চুক্তি বলবৎ থাকবে এবং আমরা উহার শর্তাবলী মেনে চলব।”] অন্যান্য ধর্ম ও উহার অনুসারীদের নিরাপত্তা বিধানের ক্ষেত্রে একথা অবশ্যই স্মরণীয় যে, নিজ প্রত্যয় ও বিশ্বাস অনুযায়ী ইসলামই একমাত্র সর্বশ্রেষ্ঠ দ্বীন। কিন্তু এতদসত্বেও উহা অন্যান্য ধর্মের পরিপূর্ণ হেফাযতের দায়িত্ব গ্রহণ করে। অবশ্য যদি কোন ব্যক্তি বা জনগোষ্ঠী ইসলাম গ্রহণ না করে এবং ইসলামী রাষ্ট্রকে জিজিয়া দিতেও সম্মত না হয় তাহলে ইসলাম তাদেরকে দুশমন বলে গণ্য করে। বস্তুত তারা হচ্ছে এমন লোক যারা জিদ ও হটধর্মীর কারণেই নিজেদের বিদ্বেষকে জিইয়ে রাখতে চায় এবং কোন শান্তিপূর্ণ সমঝোতা বা সন্ধিকেও এড়িয়ে যেতে থাকে। এরাই যুগে যুগে হক ও সত্যের পথে বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়ায় এবং তাদের যাবতীয় উপায়-উপাদান, ধন-সম্পদ ও প্রভাব-প্রতিপত্তিকে সত্যকে দাবিয়ে রাখার জন্যে কাজে লাগাতে থাকে। এদের সংশোধনের সমস্ত পথই যখন বন্ধ হয়ে যায়, ইসলাম কেবল তখনই এদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করতে বাধ্য হয়। কিন্তু এদের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ ঘোষণার পূর্বে যাতে কর রক্তপাতকে এড়িয়ে যাওয়া যায় সে উদ্দেশ্যে ইসলাম এদেরকে যথারীতি ‘আলটিমেটাম’ দেয়। এই আলটিমেটামই হচ্ছে ইসলামের পক্ষে থেকে সন্ধি স্থাপনের শেষ পদক্ষেপ। কেননা পারত পক্ষে ইসলাম কখনো রক্তপাত কামনা করে না –কামনা করে দুনিয়ার সর্বত্র শান্তি ও নিরাপত্তায় ভরে উঠুক। আল্লাহ তা’আলা বলেন: (আরবী**************) -“আর যদি তারা সন্ধির দিকে অগ্রসর হয় তাহলে তোমরাও সন্ধির দিকে অগ্রসর হও এবং আল্লাহর উপর ভরসা কর।” –(সূরা আল আনফাল: ৬১) জেহাদ ইসলামের মূল প্রাণ সকল মানুষ ‘সিরাতে মুস্তাকিম’ –(তথা আল্লাহর দেয়া সরল পথ অবলম্বন করুক –ইহাই ইসলামের কাম্য। আর এই লক্ষ্য অর্জনের জন্যেই সৃষ্টি হয়েছে ইসলামী যুদ্ধের সুদীর্ঘ ইতিহাস। এই লক্ষ্যে শান্তিপূর্ণ মাধ্যমে অগ্রসর হওয়া যখন অসম্ভব হয়ে পড়ে তখন বাধ্য হয়েই ইসলাম শক্তিপ্রয়োগ করে। ইসলামের এই যুদ্ধ কোন সেনাপতির স্বার্থপরতা কিংবা দিগ্বিজয়ের নেশার ফসল নয়। অন্য মানুষকে দাস বানানোর চিন্তাও এর পশ্চাতে কার্যকর নয়। এই যুদ্ধ কেবল আল্লাহর উদ্দেশ্যেই পরিচালিত হয় এবং তার সন্তুষ্টি লাভই হলো একমাত্র লক্ষ্য। কিন্তু ইসলাম শুধু লক্ষ্যের কথা বলেই ক্ষ্যান্ত হয়নি, বরং এই সকল যুদ্ধের জন্যে যথারীতি নিয়ম-কানুনও নির্ধারিত করে দিয়েছে। হযরত বিশ্বনবী (স) মুসলমানদের লক্ষ্য করে বলেন: “আল্লাহর নাম নিয়ে যাও এবং তার পথে যুদ্ধ কর। যে আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণ করে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর। কিন্তু প্রতিশ্রুতি ভংগ করো না। মৃতদেহ বিকৃত করো না এবং কোন শিশুকে হত্যা করো না।” [মুসলিম, আবু দাউদ ও তিরমিযী।] হযরত বিশ্বনী (স) যারা বাস্তবেই মুসলিম বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে তাদেরকে বাদ দিয়ে অন্যদের উপর হাতিয়ার তুলতে নিষেধ করেছেন। এমনি করে যাবতীয় মালামাল ও ধন-সম্পদ ধ্বংস করতে এবং কারো ইজ্জত ও সম্ভ্রম নষ্ট করতে কঠোরভাবে বারণ করেছেন। আর কোন অন্যায় ও বিপর্যয় সৃষ্টির উৎসাহ যাতে বৃদ্ধি না পায় সে জন্যে তাদেরকে সাবধান করে দিয়েছেন। কেননা আল্লাহ তা’আলা বলেন: (আরবী**********) “এবং আল্লাহ বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদেরকে ভালোবাসেন না।” –(সূরা আল মায়েদা: ৬৪) ইসলামী জিহাদের অতুলনীয় ঐতিহ্য ও ইতিবৃত্ত ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, মুসলমানগণ তাদের সকল যুদ্ধে –এমনকি খৃস্টানদের বিরুদ্ধে পরিচালিত ‘ক্রুসেট’ –এর বিভিন্ন যুদ্ধেও উপরোক্ত ঐতিহ্যসমূহ রক্ষা করে চলেছে। খৃস্টানরা যখন জেরুজালেম অধিকার করে নেয় তখন তারা সেখানকার মুসলিম জনবসতিসমূহকে তাদের নিষ্ঠুরতম অত্যাচারের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে। তাদের ইজ্জত ও সম্ভ্রম লুণ্ঠন করে, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলকেই পশুর মত জবাই করে; এমনকি শহরের মুসলমানদের সর্ববৃহৎ মসজিদটিও তাদের নাপাক হাত থেকে রেহাই পায়নি। কিন্তু মুসলমানরা যখন পুনর্বার ঐ শহরটি দখল করে তখন মুসলমানরা সেই সকল জালেমদের উপর আদৌ কোন হস্তক্ষেপই করেনি –যদিও আল্লাহ তা’আলা মুসলমানদেরকে জুলুম ও সীমালংঘনর প্রতিশোধ গ্রহণের পূর্ণ অধিকার দিয়েছেন: (আরবী*************) “যে তোমাদের বিরুদ্ধে সীমালংঘন করবে তোমরাও তার বিরুদ্ধে অনুরূপ সীমালংঘন কর।” –(সূরা আল বাকারা: ১৯৪) মুসলমানগণ প্রতিশোধ গ্রহণের পরিবর্তে তাদের পূর্ববর্তী শত্রুদের সাথে এমন উদার ও ভদ্রজনোচিত ব্যবহার করেছে যার নযীর কেউ কোনদিন দেখেনি। বস্তুত মুসলমানদের এই সামরিক মহান লক্ষ্য ও অতুলনীয় ঐতিহ্যের কারণেই বিশ্বের সকল অমুসলিম জাতির উপরেই মুসলমানদের আসন। এসলাম অতি সহজেই এরূপ চিন্তাধারা ছড়িয়ে দিতে পারত যে, যারা মূর্তিপূজার অভিশাপে অভিশপ্ত এবং হক ও সত্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার তারা কোন মানুষই নয়। বরং আধা বন মানুষ এবং এ কারণে তারা মানুষের দাস হয়ে থাকারই উপযুক্ত। মানসিক ও মানবীয় গুণাবলীর দিক তেকে তারা যদি নিম্নমানের না হতো তাহলে হক ও সত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে পারে? সুতরাং যেহেতু তাদের এই ভূমিকা মানবতার সম্পূর্ণ বিপরীত তাই এরা কোন ইজ্জত ও সম্মানের পাত্র হতে পারে না এবং দুনিয়ায় স্বাধীন মানুষের যে নির্দিস্ট স্বাধিকার ভোগ করছে তাতেও তাদের কোন অধিকার থাকতে পারে না। ইসলাম অতি সহজেই এই দৃষ্টিভংগী গ্রহণ করতে পারতো। কিন্তু ইসলাম তা করেনি। ইসলাম না এরূপ কথা বলেছে, না মুসলমানদেরকে এই শিক্ষা দিয়েছে যে, যুদ্ধবন্দীরা মানুষ নয় –ওরা আধা বর্বর মানুষ, ওদেরকে দাস বানানোই সংগত। বরং এর বিপরীত, একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও কেবল দায়ে ঠেকে ওদেরকে গোলাম বানিয়ে নিয়েছে; কেননা তাদের শত্রুরা তাদের ভাইদেরকে –যারা বন্দী হয়ে তাদের হস্তগত হয়েছে –দাস বানিয়ে ফেলেছৈ। একমাত্র এই কারণেই ইসলাম দাস প্রথা সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত করার ঘোষণা দিতে পারেনি; বরং একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত উহাকে বিলম্বিত করেছে। সারা দুনিয়ায় আন্তর্জাতিকভাবে যখন এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, পরবর্তী কোন যুদ্ধে যারা বন্দী হবে তাদের ব্যাপারে আর যাই করা হোক না কেন কাউকেই দাস বানানো যাবে না। তখনই ইসলামের ইপ্সিত লক্ষ্য পূর্ণমাত্রায় অর্জিত হয়। এর পূর্বে যদি ইসলাম একতরফাভাবে দাস প্রথা রহিত করে দিত হালে মুসলমানদের শত্রুরা হত বাঘের চাইতেও হিংস্র; মুসলমানরা কাউকে দাস বানাবে না, অথচ অমুসলমানরা মুসলমানদেরকে দাস বানাবার পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করে মুসলমান বন্দীদের উপর চালাতো অমানুষিক অত্যাচার ও পাশবিক উৎপীড়ন। দাসপ্রথা ইসলামী জীবন পদ্ধতির অংগ নয় প্রসংগত বলা প্রয়োজন যে, যুদ্ধবন্দীদের সাথে ব্যবহার সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের মাত্র একটি আয়াত বলা হয়েছে: (আরবী***************) “অতপর হয় অনুগ্রহ করে ছেড়ে দিতে হবে, নতুবা বিনিময় গ্রহণ করে ছেড়ে দিতে হবে –যতক্ষণ না যোদ্ধারা অস্ত্র ত্যাগ করে।: -(সূরা মুহাম্মাদ: ৪) এই আয়াতে যুদ্ধবন্দীদেরকে দাস বানানোর কোন কথা নেই। যদি থাকতো তাহলে এটা চিরকালের জন্যে ইসলামের যুদ্ধ সংক্রান্ত একটি আইনে পরিণত হতো। হয়তো দ্ব্যার্থহীন ভাষায় বলা হয়েছে : হয় পণ গ্রহণ করে, নতুবা পণ না নিয়ে শুধু অনুগ্রহ প্রদর্শন করে যুদ্ধবন্দীদেরকে মুক্ত করে দিতে হবে। বস্তুত এই দু’টি কথাই ইসলামী যুদ্ধবিধির একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। যুদ্ধবন্দী সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের হুকুম অনুযায়ী উক্ত দু’টি পন্থাই কেবল গ্রহণ করা যেতে পারে। অন্য কোন পন্থা গ্রহণের কোন অবকাশ নেই। এতে করে প্রমাণিত হয় যে, প্রাথমিক যুগে মুসলমানরা যে যুদ্ধবন্দীদেরকে দাস বানাতো তার কারণ এটা ছিল না যে, দাস বানানোই ছিল ইসলামের অপরিহার্য আইন। বরং তৎকালীণ বিশ্ব পরিস্থিতির বাস্তব তাগিদেই মুসলমানদেরকেও যুদ্ধ বন্দীদেকেদাস বানানো অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল। মোটকথা উহা ছিল সমকালীন পরিস্থিরি বাস্তব প্রয়োজন। ইসলামের শাশ্বত যুদ্ধনীতির সাথে উহার কোন সম্পর্ক ছিল না। ইসলাম দাসপ্রথা কখনো চালু রাখতে চায়নি দাসপ্রথার পক্ষে যত তাগিদই বর্তমান থাকুক না কেন ইসলাম কখনো চায়নি যে, যুদ্ধবন্দীদেরকে অবশ্যই দাস বানাতে হবে। বরং অবস্থা ছিল এর সম্পূর্ণ বিপরীত। ইসলামের নিয়ম ছিল: যদি শান্তি ও নিরাপত্তার পরিবেশ ফিরে আসত তাহলে কাউকেই দাস বানানো হতো না। হযরত বিশ্বনবী (স) স্বয়ং বদরের যুদ্ধে ধৃত মক্কার নেতাদের কাউকে মুক্তিপণ নিয়ে এবং কেউকে বিনা পণেই মুক্তিদান করেন। অনুরূপভাবে তিনি নাজরানের খৃস্টানদের নিকট থেকে জিজিয়া নিতে সম্মত হন এবং উহার বিনিময়ে তাদের সকল বন্দীকে মুক্ত করে দেন। ইসলামের এই ভাস্বর কার্যকলাপের প্রতি লক্ষ্য করে বিশ্বমানবতা ধীরে ধীরে এতদূর উপযুক্ত হয়ে উঠে যে, অতীতের অন্ধকার থেকে আলোকের পথে বেরিয়ে আসতে উদ্যত হলো –যুদ্ধবন্দীদের সমস্যাটির একটি মানবকি সমাধান খুঁজে বের করার জন্যেও ব্যস্ত হয়ে উঠল। বিভিন্ন যুদ্ধে মুসলমানরা যাদেরকে বন্দী করে তাদের সাথে কোন প্রকার দুর্ব্যবহার করা হয়নি; -না কোন রূপ নির্যাতন করা হয়েছে, না কখনো তুচ্ছ বা হেয় করার চেষ্টা করা হয়েছে বরং তাদের হারানো স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেয়ার জন্যে বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে। এবং তার জন্যে শুধু এতটুকু শর্ত আরোপ করা হয়েছে যে, মুক্তির পর সে যেন স্বাধীন মানুষের মত দায়িত্বশীল জীবনযাপন করতে সক্ষম হয়। এই শর্ত পালিত হলে কোনরূপ ইতস্তত না করেই তাকে আযাদ করে দেয়া হতো। অথচ তাদের মধ্যে এমন লোকও থাকত যে মুসলমানদের হাতে বন্দী হওয়ার পূর্বে কয়েক পুরষ ধরেই দাস হিসেবে জীবনযাপন করে এসেছে। মূলত এদেরকে ইরান ও রোমের বাদশারা অন্যান্য দেশ থেকে ধরে নিয়ে আসত এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সময়ে এদেরকে সৈন্য হিসেবে ব্যবহার করত। শত্রুপক্ষের ধৃতা মহিলা দাসী অথবা বন্দী মহিলার প্রতিও যথোচিত সম্মান প্রদর্শন করতে ইসলাম কখনো ভুল করেনি। অথচ এদের সম্পর্ক ছিল শত্রুপক্ষের সাথে এবং যুদ্ধে পরাজিত হয়েই এরা মুসলমানদের হাতে এসে পৌঁছত। কিন্তু ইসলাম কখনো এদের ইজ্জত ও সম্ভ্রম নষ্ট করার অনুমতি দেয়নি, যুদ্ধলবধ গনীমতের মাও মনে করার সুযোগ দেয়নি। এবং (অন্যান্য দেশের ন্যায়) সকলের সাধারণ সম্পত্তি (Common Property) সাব্যবস্ত করে বল্গাহীন ব্যভিচার ও পাশবিকতারও কোন অবকাশ দেয়নি। বরং (সম্ভ্রম ও সতীত্ব সংরক্ষণের একমাত্র পন্থা হিসেবে) ইসলাম এদেরকে মালিকদের জন্যেই নির্ধারিত করে দিয়েছে এবং তাদেরকে উপকৃত হওয়ার সুযোগ দিয়েছে। অন্য কারুর জন্যে এদের সাথে যৌন সম্পর্কস্থাপন করাকে সম্পূর্ণরূপে অবৈধ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। অধিকন্তু ইসলাম এই মহিলাদের স্বাধীন হওয়ার জন্য ‘মুকাতাবাতের’ পন্থাও উন্মুক্ত করে দিয়েছে। এমনকি এই নিয়মও প্রবর্তন করেছে যে, মালিকের ঔরষে এদের কেউ সন্তানবতী হলে সাথে সাথেই সে নিজে নিজে স্বাধীন বলে গণ্য হবে এবং তার সন্তানও স্বাধীন মানুষ হিসেবে বিবেচিত হবে। এতে করে কয়েদী মহিলাদের প্রতি ইসলাম কতদূর উদার, মহৎ ও অনুগ্রহপরায়ণ তা সহজেই পরিস্ফুট হয়ে উঠে। ইসলামে এই হচ্ছে দাসদের ইতিবৃত্ত। মানবেতিহাসের এ এক ভাস্বর অধ্যায়। নীতির দিক থেকে ইসলাম ইহা পসন্দ করেনি। বরং নিজস্ব সকল উপায়-উপাদানের মাধ্যমে একে নির্মূল করার চেষ্টা করেছে এবং এ পর্যায়ে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে কোন ভুল করেনি। সাময়িকভাবে উহার অস্তিত্বকে যে স্বীকার করে নিয়েছে তার একমাত্র কারণ ছিল এই যে, তখন উহার কোন বিকল্প ছিল না। কেননা উহার পরিপূর্ণ বিলুপ্তির জন্যে শুধু মুসলমানদের সম্মতিই যথেষ্ট ছিল না, বরং অমুসলিম দুনিয়ার সহযোগিতাও ছিল এক অপরিহার্য বিষয়। বাইরের দেশগুলোর যুদ্ধবন্দীদেরকে দাস বানানোর ফায়সালা পরিহার না করা পর্যন্ত ইসলামের একার পক্ষে এই বিলুপ্তি সম্ভবপরই ছিল না। পরবর্তী সময়ে দুনিয়ার সমস্ত জাতি যখন সম্মিলিতভাবে উহা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তখন ইসলাম উহাকে স্বাগত জানায়। কেননা ইসলামী জীবনব্যবস্থার অন্যতম মৌনীতি হচ্ছে সাম্য। ইসলাম বিশ্বাস করে: সাম্য ও স্বাধীনতা বিশ্বমানবতার এক মৌলিক অধিকার। আধুনিক যুগে দাস ব্যবসা পরবর্তী বিভিন্ন যুগে মানুষের ক্রয়-বিক্রয় এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের যে দৃষ্টান্ত মুসলিম দেশগুলোতে পাওয়া যায় তার সাথে ইসলামের বিন্দুমাত্রও সম্পর্ক নেই। এই ব্যবসা ইসলামী জিহাদের কোন ফসল নয়। এ হচ্ছে ইসলামের নামে অপরাধকারী মুসলিম শাসকদের নির্লজ্জ অপরাধের ঘৃণ্য কাহিনী। তাদের অন্যান্য অপরাধগুলোকে ইসলামের সাথে সম্পর্কিত করা যেমন সঠিক নয়, ঠিক তেমনি এই দাস বেচা-কেনার ঘটনাকেও ইসলামী নাম দেয়া সংগত নয়। দাসপ্রথা প্রসঙ্গে আলোচনার সারমর্ম দাসপ্রথার পর্যালোচনার সময়ে নিম্নলিখিত কথাগুলো স্মরণ রাখা একান্ত প্রয়োজন: এক। দাসপ্রথা চালু রাখার ঘৃণ্য নেশা: ইসলামের পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন দেশ দাসপ্রথার পৃষ্ঠপোষকতা করতে থাকে এবং বিভিন্ন রূপে ও বিভিন্ন পন্থায় উহাকে চালু রাখে। অথচ ঐ সময়ে উহাকে অব্যাহত রাখার কোন বাধ্যবাধকতা ছিল না। তাদের এ কর্মকাণ্ডের একমাত্র কারণ ছিল রাজ্য বিজয়ের অভিলাষ এবং প্রবল ক্ষমতা লিপ্সা। আর এই উদ্দেশ্যেই প্রত্যেকটি দল ও জাতিই অন্য দল ও জাতিকে দাস বানাবার নেশায় মেতে উঠতো। এ ছাড়া দাস হওয়ার পেছনে আরেকটি বড় কারণ ছিল দরিদ্রতা। যারা দরিদ্র ঘরে জন্মগ্রহণ করত কিংবা ক্ষেতে-খামারে শ্রমিক বা চাষী হিসেবে কাজ করত তাদেরকে অত্যন্ত অধম ও অপাংক্তেয় বলে গণ্য করা হতো এবং দাসের ন্যায় তাদেরকে নানা কাজে ব্যবহার করা হতো। দাসত্বের এই সর্ববিধ রূপকেই ইসলাম বন্ধ করার জন্যে বদ্ধপরিকর ছিল। এ কারণেই যে রূপটি দূরীভূত করার পবেশ তখনও পর্যন্ত সৃষ্টি হয়নি সেটি ছাড়া অন্যান্য সমস্ত রূপকেই ইসলাম বন্ধ করে দেয়। দুই। দাসপ্রথার আনুষ্ঠানিক বিলুপ্তি: ইউরোপে দীর্ঘকাল ধরে বিশেষ কোন প্রয়োজন ছাড়াই এই দাসপ্রথা বর্তমান ছিল। এমনকি এর বিলুপ্তির পরেও পূর্ণ আন্তরিকতার সাথে ইউরোপবাসীরা এর বিলুপ্তির জন্যে সহযোগিতা করেনি। বরং কিছু বাধ্যবাধকতার কারণে একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেই একে রহিত করার জন্যে অগ্রসর হয়েছে। স্বয়ং ইউরোপিয়ান লেখকরাই একথার সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, ইউরোপে দাসপ্রথা বিলুপ্ত হওয়ার মূলে রয়েছে নিছক অর্থনৈতিক কারণ। তাদের দাসরা তাদের প্রভুদের ধন-সম্পদের পরিমাণ বৃদ্ধির স্থলে উল্টো নিজেরাই হলো তাদের অর্থনৈতিক বোঝা। কেননা একদিকে যেমন প্রভুদের স্বার্থে পরিশ্রম করার মানসিকতা দুর্বল হয়ে যায়, তেমনি অন্য দিকে দৈহিক শক্তিও হ্রাস পেতে থাকে। তাদের খোরাকী ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যা ব্যয় হতো তা তাদের মাধ্যমে অর্জিত আয়ের চেয়ে অনেকগুণ বেশী হতে থাকে। ফলে ধীরে ধীরে এই অর্থনৈতিক কারণেই দাস প্রথা একদিন বিলুপ্ত হয়ে যায়। সুদ ও লোকসানের সমস্যা সম্পর্কেও স্মরণ রাখতে হবে যে, ইসলামের মহান ও পবিত্র লক্ষ্যের সাথে এর বিন্দুমাত্রও সম্পর্ক নেই। ইসলাম বিশ্বমানবতাকে এক মহান চিন্তাধারা উপহার দিয়েছে এবং দাসদেরকে মুক্ত করে তাদের জীবনকে ধন্য করেছে। অথচ ইউরোপবাসীরা তাদেরকে আযাদী না দেয়ার জন্যে সর্ববিধ শক্তি নিয়োগ করেছে। কিন্তু যখন অর্থনৈতিক কারণে একেবারেই নিরুপায় হয়ে পড়েছে কেবল তখনই তাদেকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছে। বস্তুত এ কারণেই দেখা যায় যে, ইউরোপের ইতিহাসে যে বহু সংখ্যক রক্তক্ষীয় সমাজ বিপ্লবের আলোচনা বর্তমান। ইসলামের ইতিহাসে তার চিহ্নমাত্র নেই। অনস্বীকার্য যে, এসব বিপ্লবের পরে সেখানকার প্রভুদের পক্ষে সম্ভপরই ছিল না যে, নিজেদের দাসগুলোকে দাস বানিয়ে তাদের অধীনে রাখবে। সুতরাং অনিচ্ছা সত্ত্বেও তারা তাদেরকে মুক্ত করে দিতে বাধ্য হয়। কিন্তু একটি একটি করে বহু সমাজ বিপ্লব সংঘটিত হলেও সেখানকার দাসরা তাদের স্বাধীনতা অক্ষূণ্ণ রাখার কোন গ্যারান্টি পায়নি। বরং তাদের দাসত্ব ও পরনির্ভরতার বন্ধন আগের চেয়েও কঠিন হয়ে পড়ে। তাদের অদৃষ্ট তাদের চাষী জমিনের সাথে বাঁধা পড়ে যায়। ফলে জমিন বেচা-কেনার সাথে তাদের বেচা-কেনাও বাধ্যতামূলকভাবে চলতে থাকে। কেননা কোন চাষীই তার নির্ধারিত জমিন ত্যাগ করে অন্য কোথাও যাওয়ার আইনগত অধিকার পেত না। এরূপ কেউ করলে তাকে পলাতক বলে গণ্য করা হতো এবং গ্রেফতার করতে পারলে তার শরীরে দাগ দেয়া হতো এবং পুনরায় তাকে জমিনের মালিকের নিকট হস্তান্তর করা হতো। দাসপ্রথার এইরূপটি সমগ্র ইউরোপে আঠারো শতকের ফরাসী বিপ্লব (French Revoletion) পর্যন্ত বর্তমান ছিল। তাই বলা চলে যে, ইউরোপে দাসপ্রথার বিলুপ্তি ইসলামের দেয়া নিঃশর্ত আযাদীর এগার শ’ বছর পরেই ঘটেছে। তিন। “দেখিতে মাকাল ফল —” : কিন্তু অপেক্ষা করুন। সুন্দর নাম, চিত্তাকর্ষক শব্দ ও মনোহর বাক্য দ্বারা যেন প্রতারিত না হন। খুব ঘটা করে বলা হয়: ফরাসী বিপ্লবের পরে ইউরোপে এবং আব্রাহাম লিংকনের ফরমান জারির পর আমেরিকায় দাসপ্রথার বিলুপ্তি ঘটেছে এবং দুনিয়াও উহার বিরুদ্ধে ফায়সালা দিয়েছে। কিন্তু ভেতরের অবস্থা ততদূর সুন্দর নয়। বাস্তব ঘটনা এই যে, দাসপ্রথার অস্তিত্ব এখনো দুনিয়ায় বর্তমান। যদি তা না হতো, তাহলে সাম্রাজ্যবাদের দেবতা বহুরূপী সেজে সারা দুনিয়ার বুকে নেচে বেড়াতে পারত না। দাসত্বের অভিশাপ থেকে যদি দুনিয়া মুক্তই হয়ে থাকে তাহলে আলজিরিয়া ফ্রান্সের হিংস্রতা ও বর্বরোচিত তাণ্ডব লীলাকে কি নামে অভিহিত করা যাবে? আমেরিকা উহার স্বদেশী নাগরিক হাবশীদের উপর যে কুৎসিত ও পাশবিক অত্যাচার চালাচ্ছে তাকে কী বলা হবে? ইউরোপবাসীরা দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাংগ লোকদের উপর যে অমানুষিক নির্যাতন চালাচ্ছে তাকেই বা কি নামে আখ্যায়িত করা হবে? দাসত্বের নতন নাম একটি জাতি যে আরেকটি জাতিকে পদানত করে তাদের মানবিক অধিকারসমূহ কেড়ে নেয় তাকে দাস বানানো ছাড়া অন্য কিছু বলা যায় কি? দাসত্বের মর্ম ইহাই। সুতরাং আসুন। আমরা যেন মনমাতানো শ্লেগানে বিভ্রান্ত না হই। বরং উহার স্বরূপ উদঘাটনের চেষ্টা করি এবং দাস বানানোর এই রূপগুলোর উপর আযাদী, মৈত্রী, সাম্য ভ্রাতৃত্বের লেবেল লাগাবার চেষ্ট না করি। কেননা মনোরম লেবেলের দ্বারা কোন নিকৃষ্ট ও খারাপ জিনিসকে উৎকৃষ্ট ও ভালো বলে চালিয়ে দেয়া যাবে না। অনুরূপভাবে কোন জঘন্য অপরাধের উপর পর্দা ঝুলিয়ে দিয়েও উহাকে লুকিয়ে রাখা যায় না। বিশেষ করে গোটা মানবজাতি যার তিক্ত অভিজ্ঞতা একবার-দু’বার নয়, বরং বারবার লাভ করে সে ক্ষেত্রে এর কথা কল্পনাও করা যায় না। ইসলামের সত্যনিষ্ঠা নিজস্ব অবস্থান ও ভূমিকা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে ইসলাম কখনো কারুর তোষামোদ করতে জানে না। প্রতিটি ক্ষেত্রেই উহা নিজস্ব ভূমিকাকে একবারে সুস্পষ্ট করে তোলে- যাতে করে উহার মুল লক্ষ্য ও পরিকল্পনা কারুর নিকট অজ্ঞাত না থাকে। উহা একেবারে পরিষ্কার দ্ব্যর্থহীন ভাষায় দাসত্ব সম্পর্কে উহার নিজস্ব দৃষ্টিভংগী উপস্থাপিত করছে, উহার মুল কারণসমূহ চিহ্নিত করেছে উহাকে বিলুপ্ত করার পন্থা-পদ্ধতি নির্দেশ করেছে এবং চিরতরে নির্মূল করার পথও রচনা করে দিয়েছে। আধুনিক সভ্যতার কপটতা ইসলামের সম্পূর্ণ বিপরীত কৃত্রিমতায় ভরপুর চাকচিক্যময় আধুনিক সভ্যতার প্রকৃত লক্ষ্য ও কর্মসূচী উভয়ই এক অস্পষ্টতা ও কুহেলিকার শিকার। ইহা নিজস্ব লক্ষ্য ও পরিকল্পনা যেমন প্রকাশ করতে পারছে না। ঠিক তেমনি কর্মপদ্ধতিরও ব্যাখ্যা দিতে পারছে না। উহার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে: “চেহারা সুন্দর কিন্তু ভেতরটা চেংগিজের চেয়েও অধিক অন্ধকার।” তিউনিসিয়া, আলজিরিয়া ও মরক্কোতে এই সভ্যতার অনুসারীরা হাজার হাজার মানুষকে শুধু এই অপরাধেই হত্যা করেছে যে, তারা স্বাধীনতার দাবী করেছিল, নিজেদের জন্যে কেবল মানুষ হওয়ার সম্মানটুকু চেয়েছিল। নিজেদের জন্মভূমিতে অন্যদের পরিবর্তে শধু নিজেদের হুকুমাত কায়েম করতে চেয়েছিল। নিজেদের ভাষায় কথাবার্তা বলার সুযোগটুকু পেতে চেয়েছিল। আরো চেয়েছিল দুনিয়ার অন্যান্য স্বাধীন জাতির মত তাদের জন্মভূমিও স্বাধীন হোক এবং সেখানে তারা বাইরের হস্তক্ষেপ ছাড়াই স্বাধীনত থেকে নিজেদের ইচ্ছা ও আকাংখা অনুযায়ী নিজেদের দ্বীন ও আকীদা মোতাবেক জীবনযাপনের সুযোগ লাভণ করুক- নিজেদের আকাংখা অনুসারে নিজেদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক নির্ধারণ করুক। অথচ আধুনিক সভ্যতার ধ্বজাধারীরা এই নিষ্পাপ ও নিরপরাধ লোকদের রক্তে নিজেদের হাত রঞ্চিত করেছে, পচিয়ে-গলিয়ে নিশ্চিহ্ন করার জন্যে শাস্তিগৃহে আবদ্ধ করে রেখেছে, তাদের মান-ইজ্জত লুণ্ঠন করেছে, তাদের মহিলাদের সতীত্ব বিনষ্ট করেছে, নিজেরা বাজি লাগিয়ে বেয়নেট দিয়ে গর্ভবর্তী মহিলাদের পেট চিরে ফেলেছে। বিশ শতকের এই পৈশাচিক সভ্যতার পতাকাবাহীরাই বন্য জানোয়ারের চেয়েও ঘৃণাকর কার্যে লিপ্ত হয়েছে। কিন্তু সর্বত্রই তারা সদম্ভে ঘোষণা করেছে যে, তারা বিশ্ববাসীকে স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের শিক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যেই বহির্গত হয়েছে। এরা এদের জঘন্য ব্যভিচার ও পামবিক কার্যকলাপকে ‘আলো’ ও ‘উন্নতি’ বলে অভিহিত করেছে। অথচ আজ থেকে দীর্ঘ তের শ’ বছর পূর্বে ইসলাম বাইরের কোন চাপ বা বাধ্যবাধকতা ছাড়াই নিছক মানবতার সম্মানের জন্যেই দাসদের সাথে সদ্ব্যবহার করেছে এবং দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছে: দাস হওয়া মানবজীবনের সভ্যতার পূজারীরা একে বর্বরতা, রক্ষণশীলতা বা সেকেলে চিন্তা বলে সমালোচনা করছে। “বুদ্ধির নাম দিন বাতুলতা আর বাতুলতার নাম দিন বুদ্ধি, যা ইচ্ছে তাই ক রুন আপনি চলুক আপনার শুদ্ধি।” অনুরূপভাবে আমেরিকার বড় বড় হোটেল-রেস্তোরাঁ এবং প্রমোদ-উদ্যানে লিখে রাখা হয়: কেবল শ্বেতাংগদের জন্যে”, “কালো লোক ও কুকুরের প্রবেশ নিষিদ্ধ” ইত্যাদি। এছাড়া যষন সুসভ্য (!) আমেরিকানদের কোন দল কোন কৃষ্ণাংগকে নিজেদের বন্য স্বভাব ও বর্বরতার (Lynching) শিকার বানিয়ে প্রকাশ্য রাস্তায় নিজেদের পায়ের জুতার তলায় পিষে পিষে মেরে ফেলে তখন দেখা যায় যে, বর্বরতা ও পাশবিকতার এই তাণ্ডবলীলা পুলিশ নীরবে প্রত্যক্ষ করতে থাকে-কিন্তু মৃত্যু পথযাত্রী এই মজলুম মানুষটিকে রক্ষা করার কোন প্রয়োজনীয়তাই অনুভব করে না। অথচ ভাষা, ধর্ম ও মানুষ হওয়ার দিক থেকে তারা একই শ্রেণী এবং একই দেশের অধিবাসী। আধুনিক সভ্যতার দাবীদারদের এই অপরাধ বন্য জানোয়ারকেও হার মানায়। কিন্তু এতে করেও তাদের সংস্কৃতি, ভদ্রতা ও প্রগতি বিন্দুমাত্রও ক্ষুণ্ণ হয় না; তাদের উন্নত ও সভ্য হওয়ার পথেও কোন অন্তরায় থাকে না। “আমরা যদি ‘আহ! করি হয় অপরাধ, ওরা যদি হত্যা করে, নাহি অপবাদ।” একদিকে রয়েছে তথাকথিত সভ্য মানবগোষ্ঠীর এই ন্যক্কারজনক কার্যকলাপ এবং অন্যদিকে রয়েছে ইসলামী ইতিহাসের জ্বলন্ত উদাহরণ। হযরত উমর ফারূক (রা) যখন মুসলিম জাহানের দ্বিতীয় খলীফা তখন একজন গোলাম তাকে হত্যা করার হুমকি দেয়। কিন্তু খলীফাতুল মুসলেমীন সর্বময় ক্ষমতার মালিক হওয়া সত্ত্বেও উক্ত গোলামকে কিছুই বলেননি। তাকে না গ্রেফতার করলেন, না দেশ থেকে বিতাড়িত করলেন এবং না এই বলে জল্লাদের হাতে অর্পণ করলেন যে, সে একটি বর্বর লোক, হক ও সত্যকে প্রত্যক্ষ করার পরেও শুধু হঠধর্মী করে বাতিল ও মিথ্যার অনুসরণ করে চলেছে। উক্ত হুমকির উত্তরে হযরত উমর (রা) কেবল এতটুকু বললেন: “এই গোলামটি আমাকে হত্যা করার হুমকি দিয়েছে।” এরপর না তিনি এর কৈফিয়ত তলব করেছেন, না তার স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ করেছন। অতপর সে গোলাম কার্যতই যখন উক্ত ঘৃণ্য কাজটি করে ফেলেছে ঠিক তখনিই তার বিরুদ্ধে খলীফা হত্যা করার অভিযোগ আনা হয়েছে। আফ্রিকায় ইংরেজদের জুলুম ইংরেজরা আফ্রিকায় কৃষ্ণাংগ অধিবাসীদের সাথে যে ব্যবহার করেছে, বৃটিশ পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী তারা যে পাশবিক তাণ্ডবলীলা দেখিয়েছে এবং মানবীয মৌলিক অধিকার থেকে তাদেরকে যেভাবে বঞ্চিত করেছে তা ইংরেজদের তথাকথিত ন্যায়পরায়ণতা ও আধুনিকতা তাহজীবের চূড়ান্ত সাক্ষ্য। বৃটিশদের বিচার ও আধুনিক তাহজীবের যথার্থ রূপই এখানে পরিস্ফূট হয়ে উঠেছে। বস্তুত যার উপর ভিত্তি করে পাশ্চাত্যের লোকেরা বিশ্বের সকল জাতির চেয়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠ বলে দাবী করছে সেই “সর্বশ্রেষ্ঠ” ও “গৌরবময়” জীবন ব্যবস্থার ভেতরকার রূপ ইহাই। অথচ যে ইসলাম শত্রু পক্ষের কয়েদীদেরকে একমাত্র সাম্যের ভিত্তিতে চরিকালীন দাসে পরিণত না করে শুধু সাময়িকভাবে দাস বানাবার অনুমতি দিয়েছে সেই ইসলামকে তারা নিকৃষ্ট, বর্বরোচিত ও রক্ষণশীল বলে আখ্যায়িত করছে। তাদের মতে ইসলাম একটি রক্ষণশীল ধর্ম। কেননা উহা পশুর মত মানুষকে শিকার করার অনুমতি দেয়নি। নিছক কালো চামড়া হওয়ার অপরাধে কাউকে জবাই কিংবা তার মালামাল লুণ্ঠন করা অবকাশ দেয়নি। শুধু তাই নয়। উহার রক্ষণশীলতা তো এমন পর্যায়ে যে, উহা পরিষ্কার দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছে: “শোন ও আনুগত্য কর, যদিও তোমার শাসক একজন মাথা মুণ্ডানো হাবশী হয়।” কয়েদী নারীদের সমস্যার সমাধান কয়েদী নারীদের সমস্যাটি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। যুদ্ধে যে সকল অমুসলিম নারী বন্দী হতো তাদের জন্যে ইসলামী সমাধান ছিল: তাদেরকে মুসলমানদের মধ্যে বন্টন করে দেয়া হতো। প্রয়োজন হলে এক একজনকে একাধিক নারীর দায়িত্বও অর্পণ করা হতো। এরা হতো দাসী এবং দায়িত্ব গ্রহণকারী মুসলমানরা হতো তাদের প্রভু। শুধু এই প্রভুদেরই অধিকার থাকত নিজ নিজদাসীর সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করবে। এমনকি ইচ্ছা করলে কেউ নিজ দাসীকে বিবাহও করতে পারত। (আর এ অবস্থায় সে দাসী না থেকে স্বাধীন নারীর মর্যাদা লাভ করতো।) আধুনিক ইউরোপ ইসলামের এই বিধান দেখে ঘৃণায় নাক সিটকাচ্ছে। অথচ যে সকল নারী-পুরুষ পাশসিক উত্তেজনা তথা কামরিপু চরিতার্থ করার জন্যে পরস্পর অবৈধ সম্পর্ক স্থাপন করছে এবং এ পর্যায়ে কোন নির্দিষ্ট আইন বা মানবিক নীতির ধার ধারে না তাদের অবস্থা দেখে ইউরোপের কেউ নাক সিটকায় না। বল্গাহীন যৌন ব্যভিচার তাদের নিকট কোন অপরাধ নয়। মূলত ইসলামের অমার্জনীয় অপরাধ হলো এই যে, উহা ব্যভিচার সমর্থন করে না এবং ইউরোপ যে পশুর মত অবাধ, উচ্ছৃংখল, নির্লজ্জ ও প্রকাশ্য ব্যভিচারে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে; ইসলাম তাকে বিন্দুমাত্রও সহ্য করে না। সম্ভবত এ কারণেই ইউরোপবাসীরা ইসলামের নাম শুনলেই ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। কয়েদী নারীদের করুণ অবস্থা ও ইসলাম অন্যান্য জাতির মধ্যে কয়েদী নারীদের সাথে যে লজ্জাকর ও পাশবিক ব্যবহার করা হতো তার কোন তুলনা নেই। কয়েদী হওয়ার পর বেশ্যাবৃত্তি ও যথেচ্ছ ব্যভিচার ছাড়া তাদের জীবনযাপনের কোন পন্থাই অবশিষ্ট থাকতো না। কেননা সামাজিক মর্যাদা বলতে তারা কিছু পেত না। সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় কোন শক্তিই তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করতো না। তাদের ইজ্জত ও সম্ব্রম রক্ষার জন্যেও কেউ এগিয়ে আসতো না। তাদের মালিকরাই তাদের রক্ষক হতে পারতো। কিন্তু তারা তাদেরকে কেবল অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার হিসেবেই ব্যবহার করতো। বেশীর ভাগ সময়ে মালিকরাই তাদের দিয়ে গণিকাবৃত্তি করাতো। কিন্তু তাদের ভাষায় “রক্ষণশীল ও অনুন্নত” ইসলামের যুগ শুরু হলো তখন তাদের গণিকাবৃত্তি ও অশ্লীল ব্যভিচারের পথ সম্পূর্ণরূপেই বন্ধ হয়ে যায় এবং এরূপ আইন করে দেয়া হলো যে, বৈধ মালিক চাড়া অন্য কেউই দাসীদের দ্বারা উপকৃত হতে পারবে না। এবং অর্থনৈতিক বা যৌন অস্থিরতা বা বাধ্যবাধকতা যাতে করে অন্যায় পথে চালিত না করে এবং মালিকদের রক্ষণাবেক্ষণে থেকে নির্দোষ ও মানবীয় জীবনযাপন করতে পারে সে জন্য দাসীদের অর্থনৈতিক দায়-দায়িত্বও মালিকদের স্কন্ধে ন্যস্ত করা হলো। নারী স্বাধীনতার রহস্য কিন্তু ইউরোপের “অতি সমঝদার” পণ্ডিতরা ইসলামের এই “মূঢ়তা ও বর্বরতার” ঘোর বিরোধী। তাদের মতে ইসলামের এই কার্যপদ্ধতি মূঢ়তা ও কুসংস্কারের শেষ স্মৃতি। সুতরাং তারা এই ব্যভিচার ও দেহ ব্যবসাকে শুধু বৈধ বলেই গণ্য করে না। বরং আইনগতভাবে এর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করছে। উপরন্তু তারা তাদের সাম্রাজ্যবাদী জঘন্য পরিকল্পনাসমূহ বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে সারা দুনিয়ায় এই পূর্তিগন্ধময় ব্যভিচার ছড়িয়ে দেয়ার জন্যে বদ্ধপরিকর। তাই তো এই অভিশপ্ত আজ সারা দুনিয়ায় প্রবলভাবে বিরাজমান। এ জন্যে তারা নতুন নতুন নাম রচনা করছে এবং নানা বর্ণের চিত্তাকর্ষক আবরণ দিয়ে উহাকে আবৃত্ত করার চেষ্টা করছে। নারী স্বাধীনতার যত দাবীই করা হোক না কেন, প্রকৃতপক্ষে এখনও তারা মজলুম; এখনো তারা পুরুষদের মন ভুলাবার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আধুনিক যুগের সুসজ্জিতা বেশ্যা বা নর্তকী এবং ঘৃণ্য পেশার নারীকে কোন দিক থেকেই কি সত্যিকার স্বাধীন নারী হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়? আজকের নারী সমাজ কি প্রকৃত স্বাধীনতা ভোগ করছেন? ইসলাম দাসী এবং মালিকদের মধ্যে যে মানবকি ও আত্মিক সম্পর্কের বিধান দিয়েছে এবং তাদের জন্যে শারাফাত এবং পবিত্রতার যে ব্যবস্থা করেছে তার সাথে আধুনিক সভ্যতার অধীনে নারীদের যৌন ব্যভিচার ও নগ্ন কার্যকলাপের কোন তুলনা হতে পারে কি? বেশ্যাবৃত্তি ও আধুনিক সভ্যতা ইসলামের মতাদর্শ ও চিন্তাধারা একেবারে সুস্পষ্ট। কিন্তু আধুনিক সভ্যতা এই বৈশিষ্ট্য থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত। ইহা অস্থিরতা ও দ্বিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্যতার এক করুন শিকার। এরই একটি চমৎকার দৃষ্টান্ত হচ্ছে বেশ্যাবৃত্তি ও দেহ ব্যবসায়। তথাকথিক আধুনিক সভ্যতা একে দাস যুগের একটি স্মৃতি বলে আখ্যায়িত করে। অথচ একে জিইয়ে রাখাই নয়। বরং এর দ্রুত প্রসারের এদের ক্রমবর্ধমান চেষ্টার কোন ত্রুটি নেই। এ সময়ে তাদের বক্তব্য হলো: এ একটি “অপরিহার্য সামাজিক প্রয়োজন” সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু আলোচনা করা গেল: মারাত্মক আত্মচিন্তা বর্তমান যুগে বেশ্যাবৃত্তির সবচে’ বড় কারণ হলো আধুনিক সভ্যতার মারাত্মক আত্মচিন্তা। এ কারণে আধুনিক ইউরোপে কোন সভ্য (?) ব্যক্তিই একমাত্র নিজের ছাড়া অন্য কারুর অর্থনৈতিক বোঝা বহন করতে আগ্রহী নয়- চাই সে স্ত্রী থেকে কিংবা তার সন্তান-সন্ততি হোক। সে শুধু যৌন পিপাসা চরিতার্থ করার জন্যে পাগল- নিজের আনন্দ-উল্লাসের জন্যে উন্মাদ; কিন্তু কোন দায়-দায়িত্ব গ্রহণ করতে একে বারে নারাজ। বস্তুত সে যৌন পিপাসা মেটাবার জন্যে যে নারীর সন্ধান করে সে ক্ষেত্রে উক্ত নারীর দেহটিই থাকে তার একমাত্র লক্ষ্যবস্তু। বেশ্যাবৃত্তির মূল কারণ বেশ্যাবৃত্তিকে “অপরিহার্য সামাজিক প্রয়োজন” আখ্যা দিয়ে বর্তমান যুগের আলোকপ্রাপ্ত লোকেরা এরই ভিত্তিতে নারীদের এই দাসত্বকে বৈধ করার জন্যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। কিন্তু ইহা নিছক দৃষ্টিবিভ্রম মাত্র। কেননা এই বেশ্যাবৃত্তির মূল কারণ হচ্ছে আধুনিক যুগের লোকগুলোর প্রবৃত্তির দাসত্ব এবং চিন্তার বিভ্রান্তি। এ কারণে যতদিন তাদের মানবতার মান উন্নত না হবে ততদিন পর্যন্ত বেশ্যাবৃত্তির এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার কোন উপায় নেই। এখানে একথাও স্মরণযোগ্য যে, পাশ্চাত্যের যে সকল “সুসভ্য (!) সরকার পরবর্তী যুগে বেশ্যাবৃত্তির উপর বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে তার মূল কারণ নারীদের নারীত্ব বা মানবতার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন নয়। তাদের নৈতিক, মনস্তাত্বিক ও মানসিকতার অভিয়ানেও এমন কিছু নেই যাতে করে তার বেশ্যাবৃত্তিকে ধ্বংসাত্মক বা ঘৃণাকর বলে বর্জন করতে পারে। বরং তার মূল কারণ ছিল (উর্বর্শী তিলোত্তমার) সাজসজ্জা ও রূপের পসা নিয়ে সুন্দরী সোসাইটি গার্লস এর বাজার সরগরম হওয়া। এদের অবাধ বিচরণের মুখে বেশ্যাবৃত্তির সামাজিক অপরিহার্যতার দিন ফুরিয়ে এসেছে এবং ব্যভিচার সম্পর্কে পাপ-পুণ্যের ধারণা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু এতদসত্ত্বেও তাদের নির্লজ্জতার অবস্থা এই যে, তের শ’ বছর আগেকার দাসীদের জীবন সম্পর্কে ইসলামের গৃহীত পদক্ষেপ নিয়ে অসংযত ভাষায় ঠাট্টা-বিদ্রূপ করছে। অথচ ইসলাম দাসীদের সমস্যা সমাধান কল্পে একটি অস্থায়ী নীতি গ্রহণ করেছিল মাত্র। ইসলাম তখনই একথা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছিল যে, ইহা ইসলামের কোন স্থায়ী বা শাশ্বত ব্যবস্থা নয়। কিন্তু আশ্চর্য এই যে, নেহাত নির্লজ্জেরমত তারা ইসলামের সমালোচনা করে আর নিজদের ব্যাপারে একথা ভুলে যায় যে, বিশ শতকের সভ্যতাকে তারা মানবতার সর্বোচ্চ অপরিবর্তনীয় ও শাশ্বত অধ্যায় বলে চিৎকার করছে তার চেয়ে উহা যে কত সহস্র গুণে পবিত্র, প্রাকৃতিক এবং পূর্ণাংগ তা ভাষায় প্রকা করা দুঃসাধ্য। সোসাইটি গার্লস আধুনিক পাশ্চাত্য সমাজে যৌন নেশাগ্রস্ত, বিলাসীনী ও আনন্দ উল্লাসে নিমজ্জিত সোসাইটি গার্লস যে নির্ভীকতা ও অবাধ স্বাধীনতার ভেতর দিয়ে নিজেদের দেহকে অন্যের হাতে তুলে দিচ্ছে তা দেখে আমাদের বিভ্রান্ত হওয়া সমীচীন নয়। এত কোন স্বাধীনতা নয়। এ হচ্ছে দাসত্বের এমন একটি রূপ যেখানে একটি দাস একান্ত স্বেচ্ছায় তার দাসত্বের শৃংখল নিজের গলায় পরিধান করছে। কিন্তু দাস্য মনোবৃত্তি সম্পন্ন এই মহিলাদের অস্তিত্ব এবং স্বাধীন ও মর্যাদাবান মানুষ না হওয়ার এই পৈশাচিক মানসিকতাকে ইসলাম কখনো সমর্থন করে না এবং একে স্থায়ী করার পক্ষেও কোন সনদ দিতে পারে না। এ ছাড়া দুনিয়ার অন্য কোন ধর্ম বা জীবনদর্শন উক্ত ইচ্ছাকৃত মানবতা বিধ্বংসী দাসত্বকে সমর্থন করতে পারে না। ইউরোপীয় সভ্যতার আসল কীর্তি ইউরোপীয় সভ্যতার ধ্বংসলীলা প্রত্যক্ষ করার জন্যে এই হাল-হাকীকতই যথেষ্ট। উহা এমন এক অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও মানসিক ব্যধি সৃষ্টি করে দেয় যাতে করে মানুষ বাধ্য হয়েই মর্যাদপূর্ণ স্বাধীনতার চেয়ে ঘৃণ্য ও কুৎসিত দাসত্বকেই প্রাধান্য দিচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে ইউরোপীয় সভ্যতা আজ পর্যন্ত যে কীর্তি স্থাপন করেছে তার বহর এতটুকুই। এক কথায় বলা যায়: “বেকারত্ব, দারিদ্র আর মদ্যপান, নাচ-গান, নগ্নতার ঘৃণ্য অভিযান।” ইউরোপে দাসত্বের মূল কারণ এই হলো ইউরোপীয় দাসত্বের সংক্ষিপ্ত উপাখ্যান। ইউরোপের ইতিহাসে নর-নারী নির্বিশেষে সকল জাতি ও গোত্রের দাসত্বের ইতিহাস। এ ইতিহাস সৃষ্টির পেছনে রয়েছে বহু কারণ। এবং সৃষ্টির পরে যুগের পর যুগ ধরে কোন সামাজিক প্রয়োজন কিংবা বাধ্যবাধকতা ছাড়াই একে অবশিষ্ট রাখা হয়েছে। ইউরোপে এমন কোন পরিস্থিতিরও সৃষ্টি হয়নি যাতে করে তের শ’ বছর পূর্বে ইসলামের সংস্পর্শে আসতে পারে এবং বাধ্যবাধকতার কারণে দাসত্বের মাত্র একটি রূপকে অব্যাহত রাখতে পারে। বরং অবস্থা ছিল এর সম্পূর্ণ বিপরীত। ইউরোপীয় সভ্যতার ঘৃণ্য ও অমানবিক প্রকৃতির ফলেই গোটা ইউরোপে দাসত্বের এই অবৈধ প্রচলন। এর পশ্চাতে ‘অপরিহার্য প্রয়োজন’ বলে কিছু নেই এবং এর বাধ্যবাধকতারও কোন প্রশ্ন নেই। সমাজতান্ত্রিক দেশে আধুনিক সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর প্রতিও দৃকপাত করা যাক। ঐ সকল দেশের অধিবাসীরও দাসত্বের অভিশাপে জর্জরিত। সমাজতন্ত্রের দেবতা সাম্রাজ্যবাদের পায়ের তলায় নিষ্পেষিত হচ্ছে। তাদের প্রভু মাত্র একজন। আর সে হলো সরকার। অবশিষ্ট সকল লোককেই মুখ বুজে এই সরকারের আনুগত্য করতে হবে। এই দাসত্বের বহর এতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত যে, কোন নাগরিকের নিজ পেশা বা চাকুরী বেছে নেয়ার স্বাধীনতাও তার নেই। কেননা সে একজন আজ্ঞাবহ গোলাম মাত্র। আর গোলমের নিজস্ব মর্জি বলতে কিছুই থাকে না। এই দিক থেকে সমাজতান্ত্রিক দেশ ও পুঁজিবচাদী দেশের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। একটি একমাত্র সরকারই হচ্ছে সর্বময় ক্ষমতার নিরংকুশ অধিকারী এবং আরেকটিতে বড় বড় পুঁজিপতি হচ্ছে যাবতীয় ক্ষমতার একচ্ছত্র মালিক আর অন্যেরা হচ্ছে তাদের অনুগ্রহের ভিখারী। পাঠকদের সমীপে আলোচ্য বিষয়ের উপসংহারে পূর্ব পাঠকদের সমীপে একটি আরজ করতে চাই। পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র উভয়ের সমর্থকদেরকে নিজ নিজ জীবনাদর্শের প্রশংসায় পঞ্চমুখ দেখতে পাবেন। কিন্তু আমরা আশা করি, তারা যদি আমাদের কথাগুলোর প্রতি লক্ষ্য করেন তাহলে তারা প্রতারিত হবেন না। আমাদের পাঠকবৃন্দও আশা করি, একথা অনুধাবন করতে পেরেছেন যে, নামের দিক থেকে পার্থক্য থাকলেও সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদ মূলত প্রাচীনকালের দাসত্বেরই নতুন রূপ মাত্র। -“সভ্যতা” ও “সামাজিক উন্নতি”র ছদ্মবেশে স্থায়ী হয়ে বসেছে। ইসলামের নির্দেশিত “সরল পথ” বর্জন করে মানবতা কি উন্নতি লাভ করেছে, না ক্রমান্বয়ে অবনতি ও নৈতিক অধপতনের শিকার হয়ে চলেছে। পাঠকবৃন্দ তা সহজেই অনুধাবন করতে পারবেন। তারা আরো উপলব্ধি করতে পারবেন যে, দুনিয়া আজ ইসলামের দিকনির্দেশনার উপর কতদূর নির্ভরশীল।
(লেখাটির সংস্কার চলমাণ )