চলুন আমরা পবিত্র আল কুরআনের সাহিত্য শৈলীর দিকে নজর দেই।মহান আল্লাহ্ চেয়েছেন আল কুরআন একটি মুযিজা ও জীবন্ত সাক্ষ্য প্রমাণ এই দুনিয়ার শেষ অবধি জারি থাকবে। এটা অবিশ্বাসীদের জন্যে একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে পাঠানো হয়েছিল। কোন কিছু দিয়ে চ্যালেঞ্জ করতে হলে, নিজেকে অন্যের তুলনায় শ্রেষ্ঠ দাবি করলে, এটা অবশ্যই ঐসব বিষয় দিয়েই করতে হবে যে ক্ষেত্রে তারা দক্ষতার শীর্ষে থাকে। আপনি দুর্বল বা অক্ষম কোন ব্যক্তিকে ভারী জিনিস উত্তোলনের জন্য চ্যালেঞ্জ ছুঁড়তে পারেন না; কেননা এটাতে কিছুই প্রমাণিত হয় না। একজন ভারোত্তোলনকারীকেই আপনার চ্যালেঞ্জ করতে হবে।
কুরআন যখন অবতীর্ণ হলো, এটা তখনকার আরবদের নিজেদের ভাষার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েই জয়লাভ করল; এটা এজন্য না যে আরবরা ঐ সময় নিজেদের ভাষাশিল্পে দুর্বল ছিল। আমরা বরং এর উল্টো চিত্রই দেখি। আরব ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, আরবরা তাদের ভাষাজ্ঞানের উৎকর্ষে শেক্সপিয়ারিন লেভেলের মত সর্বোচ্চ দক্ষশিল্পী ছিল। সুতরাং কুরআন অবতীর্ণ হয়ে যায় ভাষাতাত্ত্বিকভাবে এ সংগ্রামে জয়ী হল, তখন কুরআনের সত্যতারই বিজয় হলো।
নবী ﷺ এর সময়ে আরবরা বিশেষত মক্কার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের লোকেরা ভাষাশিল্পীর উৎকর্ষে চরম শিখরে পৌঁছে গিয়েছিল। কাব্য থেকে শুরু করে গল্পকথা এবং সাহিত্য সকল ক্ষেত্রেই তারা সেরাদের ক্ষেত্রে অবস্থান করতো। সাহিত্যের ক্ষেত্রে যারা শীর্ষে অবস্থান করতো সৌভাগ্য ও সুখ্যাতি এসে তাদের মুকুটে পরিণত হতো।
এদিক থেকে মক্কার আবাসিক অধিবাসী হিসেবে এসব কবি ও সাহিত্য সম্রাটদের মাঝে কী কখনো মুহাম্মদ ﷺ প্রতিযোগী হিসেবে দাঁড়িয়েছিলেন? আল্লাহর ওহী এবং ইসলামের বাণী আগমনের পূর্বে মুহাম্মদ সাঃ তো দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে মক্কায় বাস করেছিলেন। ঐ পুরো সময় জুড়ে কার্যত প্রকাশ্যভাবে তিনি কাব্য ও ভাষাশিল্পের ত্রিসীমানায় অপরিচিত ছিলেন। আল কুরআন অবতীর্ণ হতে শুরু করল।
মহান আল্লাহ্ চেয়েছিলেন, এটি সাহিত্যকর্ম এবং ভাষাতাত্ত্বিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে এমন এক ব্যক্তির মাধ্যমে আসুক, যিনি ইতিপূর্বে এসব ভাষা-সাহিত্যে, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম শিল্প-দক্ষতায় অপরিচিত তথা এ সম্পর্কে পুরাই অজ্ঞ, যে জানে না এমন ব্যক্তি। মুহাম্মদ ﷺ এর ভাষা দক্ষতার ব্যপারে তাদের অবলোকনের মাধ্যমেই মক্কাবাসীরা জানতে বাধ্য হলো এই বাণী মুহাম্মদ থেকে আসা অসম্ভব। তার উপর একজন ব্যক্তির প্রতিভা সৃষ্টিশীল দক্ষতা সাধারণত তার ২৫/৩০ এর কোঠার প্রথমাংশেই প্রকাশিত হয়ে থাকে; চল্লিশ বা পঞ্চাশের দশকে গিয়ে প্রকাশ পায় না। আবার তিনি কখনোই পূর্বেও এসব ভাষা সাহিত্যের সাথে পরিচিত ছিলেন না, কারো থেকেও শিখেননি, কোন কাব্য বা কবিতাও রচনা করেননি, পাঠও করেননি। আবার এমন ভাষার মুগ্ধময় দক্ষতার ব্যবহারও ইতিপূর্বে তাঁর থেকে কেউই কখনো শোনেননি- দীর্ঘ ৪০ টা বছর পর্যন্ত।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ ﷺ ৪০ বছর বয়সেও নিরক্ষর ছিলেন, তিনি জানতেন না কিভাবে পড়তে হয় বা লিখতে হয় অথবা কাব্য রচনা করতে হয়। যখন হঠাৎ করেই মুহাম্মদ ﷺ, তাঁর উপর নাযিলকৃত কুরআনের আয়াত তিলাওয়াত করতে শুরু করলেন, তখন ঐসব কবি সম্রাট, ভাষা-সাহিত্যিকরা এটাকে সম্মান করতে লাগলেন এবং আশ্চর্য হলেন যে- এমন একজন অক্ষর জ্ঞানহীন লোকের থেকে এ আসা সম্ভব কিভাবে- যাঁর থেকে কখনোই এসব আশা করা যেত না?
প্রশ্ন হলোঃ এগুলো কোথায় থেকে আসল? এসব ভাষাতাত্ত্বিক শিল্প নৈপুণ্যের বিস্ময়কর ব্যবহার ও ভাষা দক্ষতা ৪০ বছর ধরে সবটাই নিজের কাছে রেখে দিবেন আর হঠাৎ করেই এগুলো ব্যবহার করতে শুরু করবেন, এরকম হওয়ার তো কোন মানেই হয় না। এসব বিস্ময়কর প্রতিভা যদি তাঁর আগে থেকেই থাকত, তবে তিনি সমাজে সর্বোচ্চ পদমর্যাদা, সম্মান ও খ্যাতির জন্য খুব সহজেই এগুলো ব্যবহার করতে পারতেন। আরো গুরত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তিনি তো জানতেন না যে- ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত জীবিত থাকবেন, যেখানে চল্লিশের পূর্বেই কত যুবকেরা মৃত্যুবরণ করেছে, তার উপর তৎকালীন সময়টাই ছিল জাহিলিয়াত তথা রক্তারক্তি, গৃহযুদ্ধে নিহত হওয়ার যুগ। অর্থাৎ এ বিষয়টাই স্পষ্ট করে দেয়- তিনি ওসব দক্ষতার অধিকারী ছিলেন না। তারপরও এটা ছিল সমগ্র বিশ্বের রবের পক্ষ থেকে সমগ্র বিশ্ববাসীর মাঝে গর্বিত সাহিত্যিকদের সম্মুখে তাঁর রাসূলের মুখে বলা বাণীর চ্যালেঞ্জ। এটি ছিল একাধারে বক্তব্য আকারে নাযিলকৃত, যা একবার বললে দ্বিতীয়বার আর ফেরত নেওয়া সম্ভব ছিল না; আর এমন মুখে উচ্চারিত বাণীই ছিল মহান আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ কালাম, পবিত্র কুরআনের সৌন্দর্য, পবিত্র ও জীবন বিধান।
অবিশ্বাসীদের সাথে এসব বিষয়ে রাসূল ﷺ কিভাবে নিজেকে তুলে ধরবেন সে বিষয়েও মহান আল্লাহ্ শিখিয়ে দিয়েছেন নীচের আয়াতের মধ্যে।
Yunus 10:16
قُل لَّوْ شَآءَ ٱللَّهُ مَا تَلَوْتُهُۥ عَلَيْكُمْ وَلَآ أَدْرَىٰكُم بِهِۦۖ فَقَدْ لَبِثْتُ فِيكُمْ عُمُرًا مِّن قَبْلِهِۦٓۚ أَفَلَا تَعْقِلُونَ
Bengali - Mujibur Rahman
তুমি বলে দাওঃ যদি আল্লাহর ইচ্ছা হত তাহলে, না আমি তোমাদেরকে এটা পাঠ করে শোনাতাম আর না আল্লাহ তোমাদেরকে ওটা জানাতেন। কেননা আমি এর পূর্বেও তো জীবনের এক দীর্ঘ সময় (অর্থাৎ ৪০ বছর) তোমাদের মধ্যে অতিবাহিত করেছি; তাহলে কি তোমরা এতটুকু জ্ঞান রাখনা?
▪︎ তার উপর এরকম বিশাল কাজের কৃতিত্ব ও স্বীকৃতি কে নিতে অস্বীকার করবে? বর্তমান আধুনিক যুগের অনেক বিখ্যাত লেখক ও কবিরাও পর্যন্ত অন্যের লেখা বা কাব্যকে নিজের কৃতিত্ব বলে চালিয়ে দিতেও দ্বিধাবোধ করে না, সেখানে নবীজি ﷺ আপনার আমার মতো মাটির মানুষ হওয়া সত্বেও এসব লোভনীয় বিষয় বা প্রবৃত্তি থেকে পরিপূর্ণ মুক্ত ছিলেন না বিধায় এত বিশাল কৃতিত্বকেও নিজের বলে জাহির করে নেওয়া উচিত ছিল। কারণ মানুষের প্রকৃতিগত স্বভাব হচ্ছে- যে কোন বিশাল কাজের কৃতিত্ব ও সম্মান নেওয়ার জন্য সবসময়ই ওৎ পেতে বসে থাকা। অথচ নবীজি ﷺ এর ক্ষেত্রে ভিন্ন চিত্র দেখা যায়। কুরআনের সাথে নবীজি ﷺ এর যেই মর্যাদা ও গৌরব আসত, সেই সাথে এই কর্মের সমস্ত স্বীকৃতি ও কৃতিত্ব এবং অবদানও তাঁর প্রতি জুড়ে দেওয়া হতো, কিন্তু তিনি এর সবই প্রত্যাখ্যান করতেন। এ বিষয়টি পবিত্র কুরআনে মহিমান্বিত আল্লাহ্ এইভাবে উল্লেখ করেছেন যে,
Yunus 10:15
وَإِذَا تُتْلَىٰ عَلَيْهِمْ ءَايَاتُنَا بَيِّنَٰتٍۙ قَالَ ٱلَّذِينَ لَا يَرْجُونَ لِقَآءَنَا ٱئْتِ بِقُرْءَانٍ غَيْرِ هَٰذَآ أَوْ بَدِّلْهُۚ قُلْ مَا يَكُونُ لِىٓ أَنْ أُبَدِّلَهُۥ مِن تِلْقَآئِ نَفْسِىٓۖ إِنْ أَتَّبِعُ إِلَّا مَا يُوحَىٰٓ إِلَىَّۖ إِنِّىٓ أَخَافُ إِنْ عَصَيْتُ رَبِّى عَذَابَ يَوْمٍ عَظِيمٍ
Bengali - Mujibur Rahman
আর যখন তাদের সামনে আমার আয়াতসমূহ পাঠ করা হয় - যা অতি স্পষ্ট, তখন ঐ সব লোক, যাদের আমার নিকট উপস্থিত হওয়ার চিন্তা নেই -তারা এইরূপ বলেঃ এটা ছাড়া অন্য কোন কুরআন আনয়ন করুন অথবা এতেই কিছু পরিবর্তন করে দিন। বলঃ আমার দ্বারা ইহা পরিবর্তন করা সম্ভব নয়, আমিতো শুধুমাত্র উহারই অনুসরণ করব যা অহীযোগে আমার কাছে পৌঁছেছে। আমি যদি আমার রবের নাফরমানী করি তাহলে আমি এক অতি ভীষণ দিনের শাস্তির আশংকা রাখি।
▪︎ মানুষ সাধারণত তাদের কৃতকর্মের কৃতিত্ব ও গৌরব নিতে ভালবাসে। কারণ এটা সৃষ্টিলগ্ন থেকেই মানুষের প্রকৃতির মধ্যে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমনকি অনেক এমনও লোক আছে যারা সেসব কাজ করেনি কিন্তু সেগুলোর কৃতিত্ব ও গৌরব দাবি করে থাকে। আর এখানে দেখি নবীজি ﷺ কে কৃতিত্ব দেওয়া হলেও তিনি উল্টো অস্বীকার করে বলেন, "না, এ কৃতিত্বপূর্ণ বাণীগুলো আমার পক্ষ থেকে আসেনি।" কেউ বিশেষ কিছু অর্জন করলে সেটার মর্যাদা ও কৃতিত্ব নিতে ভালবাসে। আর এখানে তাঁকে মর্যাদা ও সম্মান দিতে চাইলে তা নিতে অস্বীকার করেন। এটা তো এই দুনিয়ার নিয়মের বিপরীত হয়ে গেল। অথচ এই লোকটি ইচ্ছে করলেই এই সমস্ত কৃতিত্ব ও গৌরব নিজের বলে জাহির করে রাজা বাদশাহীদের মত জীবন যাপন করতে পারতেন, কোনরুপ কষ্টের পাহাড় বইতে হতো না; আর কেই বা আছে যে কিনা নিজের কৃতিত্ব অস্বীকার করে বছরের পর পর অসীম কষ্টের বোঝা বহন করবে? অথচ তাঁর ঘরে মাসের পর মাস দুবেলা খাবার পর্যন্ত ভালমতো জুটত না, চুলায় ঠিকঠাক মতো আগুন জ্বলত না, হাঁড়ি পাতিলগুলো যেন শুকনো থেকে যেত। এ থেকেই প্রমাণিত হয় যে, এই মহান বাণীগুলো সুমহান কারো থেকে নাযিল হয় এক মহান ব্যক্তির উপর।
নবীজি ﷺ বিশ্বাসী- অবিশ্বাসী নির্বিশেষে একইভাবে প্রশ্ন করতে স্বাগত জানাতেন। তবে আপনি যদি বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ ﷺ এর সাহাবীদের নিয়ে গবেষণা চালান তবে আপনি কাউকেই এমন পাবেন না যিনি এমন আয়াত সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করেছেন যা স্পষ্টত কোন অর্থ বহন করছে না যেমন: আলিফ- লাম- মীম (ألف- لام- ميم) বা হা- মীম (حا- ميم)। আরো আকর্ষণীয় বিষয় হলো, যেসকল অবিশ্বাসীরা নবীজি ﷺ এর কাছে তর্ক করার জন্য আসতো, প্রমাণ করতে চাইতো যে- এই কুরআন প্রাচীন রূপকথা, অর্থহীন কথাবার্তা, সেই তারাও কিন্তু এসব আয়াত নিয়ে প্রশ্ন তুলতো না! অবিশ্বাসীদের আরবি ভাষার গভীরতর শিল্পদক্ষতা থাকা সত্বেও কিভাবে নবী ﷺ কে আক্রমণ করার এমন একটি মোক্ষম সুযোগ নিতে পারল না? এটা কখনোই সম্ভবপর হতে পারে না যদি না তারা এই বাণীর সুগভীর মূল্য বুঝতে না পারে।
যদিও তারা আল কুরআনে বিশ্বাস রাখতো না তবুও তারা এই কুরআনে এমন কিছু ভুলত্রুটি খুঁজে পায়নি যা কিনা নবী ﷺ এর বিরুদ্ধে প্রচার কার্যে ব্যবহার করবে।
এমনকি ঐসব অবিশ্বাসীরা যখন তাদের নিজেদের গোত্রে ফিরে গেল, তারা তাদের অনুসারীদের নির্দেশ দিল যেন এই কুরআন না শোনে। তারা জানতো- যে কেউই এই কুরআন শুনবে সে কুরআনের শব্দে শব্দে পাবে মাধুর্য এবং তাদের হৃদয় ও মনে এর প্রভাব অনুভব করবে। যদি তারা বিশ্বাস করত এই কুরআন অর্থহীন তবে তারা এসব শোনার ক্ষেত্রে তো বাঁধা দিত না নিশ্চয়ই। মানুষজন নিজ থেকেই এই কুরআন থেকে দূরে সরে যেত।
অবিশ্বাসীদের নেতৃবৃন্দ তো আরো এক ধাপ এগিয়ে গেল। তারা তাদের ভক্তকুলদের নির্দেশ দিল, যেন কুরআন পাঠের সময় তারা গোলমাল সৃষ্টি করে, মানুষজনের মনকে যেন এই কুরআন তেলাওয়াত শোনা থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে! তারা জানতো এই কুরআনের গভীর অর্থ, সুগভীর সারকথা, এবং বিস্তৃত প্রভাব ক্ষমতা রয়েছে। মহিমান্বিত আল্লাহ্ বলেন,
Fussilat 41:26
وَقَالَ ٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ لَا تَسْمَعُوا۟ لِهَٰذَا ٱلْقُرْءَانِ وَٱلْغَوْا۟ فِيهِ لَعَلَّكُمْ تَغْلِبُونَ
Bengali - Mujibur Rahman
কাফিরেরা বলেঃ তোমরা এই কুরআন শ্রবণ কর না এবং তা আবৃত্তি কালে শোরগোল সৃষ্টি কর যাতে তোমরা জয়ী হতে পার।
অভিযোগের বাতুলতা:
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ ﷺ আমাদের কাছে যেসব বাণীর প্রচার চালাতেন চলুন সেগুলো দেখি একটু।
- প্রথমত আল কুরআন;
- দ্বিতীয়ত রাসূল ﷺ এর বর্ণিত হাদিস;
- এবং শেষত হাদিসে কুদসী (হাদিসে বর্ণিত আল্লাহর কথা)।
এখন এসব কথাই আমাদের কাছে এসেছে রাসূল ﷺ এর কাছ থেকেই, কিন্তু প্রতিটি কথাতেই রয়েছে স্বতন্ত্র সাহিত্যভঙ্গি, ভিন্ন ধরনের সাহিত্যশৈলী। নবীজি ﷺ একই দিনে কিছু বর্ণনা করতেন যা কুরআনের অংশে পড়তো, আবার অন্য এক অংশ হাদিসে লিপিবদ্ধ হতো। এভাবে দীর্ঘ ২৩ বছর একাধারে চলেছে। এমনকি কবি ও লেখকদের সবচেয়ে প্রতিভাধর ব্যক্তিরও জীবনের বিভিন্ন সময়ে তাদের কাজের স্বতন্ত্র স্টাইল (রীতি-ধারা) ও বৈশিষ্ট্য থাকে।এখন নবীজি ﷺ যদি নিজ থেকেই এসব বর্ণনা লিখে থাকতেন, তাহলে লুকোচুরির শত চেষ্টা করা সত্বেও অবশ্যই তাঁর স্টাইল ও কথাবার্তার ধরণ অন্যসব লেখার ভেতরে চলে যেত। অথচ আমরা কুরআনের বর্ণনা, নবী ﷺ এর হাদিসের বর্ণনা এবং হাদিসে কুদসীর মাঝে স্পষ্টত আলাদা আলাদা স্টাইল, শিল্পস্বাতন্ত্র্য দেখতে পাই। আর এটা তাঁর নবুয়্যতী জীবনের ২৩ বছর জুড়েই ঘটেছে। এটা যে মহিমান্বিত আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ, নবীজি ﷺ থেকে নয়। আর এটা কোন আশ্চর্যের বিষয় নয় যখন মহান আল্লাহ্ নবী ﷺ এর নিকটে কোন ওহী প্রেরণ করেন, তখন সেটা অবিশ্বাসীদের মাঝে বিস্ময় ঘটাতো ও গোলযোগ সৃষ্টি করত। তারা কুরআন এবং এর নবতর বাণীকে অস্বীকার করতে চাইত কিন্তু সেটা কিভাবে করবে তা বুঝে উঠতে পারছিল না। কোন কোন বিষয়ে তারা নবীজি ﷺ কে জাদুকারী প্রভাবের অভিযোগ দিয়ে বলত- সে একজন জাদুকর।
তো এ ব্যপারে বলা যায়, তিনি যদি এরকমই সুদক্ষ জাদুকরই হতেন তবে কিভাবে তিনি তোমাদের সবাইকে জাদুর প্রভাবে প্রভাবিত না করে থাকতে পারে? তিনি নিশ্চয়ই তাঁর জাদুর মাধ্যমে তোমাদেরকেও প্রভাবিত করতে পারতেন যেরুপ তাঁর প্রতি বিশ্বাসী লোকেরা প্রভাবিত হয়েছে। তোমরা যে তাঁকে অবিশ্বাস করতেছ সেটাই বরং বড় একটি প্রমাণ যে তিনি আসলে জাদুকর নন! তিনি জাদুকর হলে তোমরা কেউই প্রভাবিত না হয়ে থাকতে পারতে না, তখন তো সেই জাদুর প্রভাবের কারণে তাঁর আনীত বাণীর প্রতি বিশ্বাস না করে তোমাদের কোন উপায় থাকত না।
অন্যক্ষেত্রে অবিশ্বাসীরা নবীজি ﷺ কে উন্মাদ, পাগল বলে দাবি করে বলত, সে তো কেবল পাগলামীপূর্ণ কথাবার্তা বলে বেড়ায়। নাউযুবিল্লাহ। এই অভিযোগের প্রেক্ষাপটে চলুন কিছু সময় ব্যয় করে পাগলামীর সংজ্ঞায়নটা আগে দেখি।
পাগলামি বা উন্মাদনা হলো:...ব্যক্তির এমন কর্ম ও ব্যবহার যার কোন অর্থ হয় না।"
একজন উন্মাদ ব্যক্তি সামাজিক পরিবেশে অযৌক্তিক ও অনুপযুক্ত কাজ করে। কিন্তু নবীজি ﷺ মক্কা সমাজের পুরো সময় জুড়েই তাঁর মহান চরিত্র ও নিখুঁত আচার-ব্যবহারের জন্য বিখ্যাত ও বেশ সুপরিচিত ছিলেন। উপযুক্ত আচার ব্যবহারগত দিক থেকে তাঁর সর্বোত্তম চরিত্র এবং নিখাদ ব্যবহার- এসব তো পাগলামি ও উন্মাদনার ঠিক বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে। একজন ব্যক্তির সর্বোত্তম আচার ব্যবহার থাকা মানে সে তো উপযুক্ত কাজই করে এবং সামাজিক বিষয়াবলিতে উত্তমভাবেই ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া দেখায়। এছাড়া তিনি যদি প্রকৃতপক্ষেই পাগল হয়ে থাকতেন, তাহলে তাঁর শত্রুরাও কেন তাঁর কাছে নিজেদের সম্পদ আমানত হিসাবে দিত? এ থেকেই বোঝা যায় তারাও আসলে জানত- তিনি পাগল নন যদিও তাঁকে পাগল হিসেবে অপবাদ আরোপ করে মূলত নিজেদের অহঙ্কারকে বড় হিসেবে দেখতে চাইত এবং তাঁর আনুগত্যকে অস্বীকার করত। তো আল্লাহর রাসূল সাঃ এর উপর এই পাগলামি উন্মাদনার অভিযোগের প্রতিরোত্তরে এইভাবে বলেছেন,
Al-Qalam 68:2
مَآ أَنتَ بِنِعْمَةِ رَبِّكَ بِمَجْنُونٍ
Bengali - Mujibur Rahman
তোমার রবের অনুগ্রহে তুমি উম্মাদ (পাগল) নও।
Al-Qalam 68:3
وَإِنَّ لَكَ لَأَجْرًا غَيْرَ مَمْنُونٍ
Bengali - Bayaan Foundation
আর নিশ্চয় তোমার জন্য রয়েছে অফুরন্ত পুরস্কার।
Al-Qalam 68:4
وَإِنَّكَ لَعَلَىٰ خُلُقٍ عَظِيمٍ
Bengali - Mujibur Rahman
তুমি অবশ্যই মহান চরিত্রের অধিকারী।
▪︎ কিন্তু বিদ্রুপের বিষয় হলো, অবিশ্বাসীরা যদিও নবীজি ﷺ এবং তাঁর আনীত বার্তাকে অস্বীকার করতো, তাঁকে অবিশ্বাসী কাফের মুশরিকরা উন্মাদ/পাগল, কবি/গণক/জাদুকর বলে আখ্যায়িত করত-- পবিত্র কুরআন ২৩:৭০; ৬৮:৫১ (নাঊযুবিল্লাহী মিনযালিক)। কিন্তু তারাও আবার সফরের সময় মূল্যবান সম্পদের ক্ষেত্রে তাঁকে চোখ বুঁজে সর্বোচ্চ আমানতদার হিসেবে বিশ্বাস করতো। মক্কাবাসীরা যখন দূরে কোথাও ভ্রমণের জন্য যেত তখন তাদের মূল্যবান সম্পদগুলোকে আমানত হিসাবে কারো কাছে গচ্ছিত রেখে যেত। নবী মুহাম্মদ ﷺ ছিলেন মক্কার ঐসব অল্প কয়েকজনের অন্তর্ভুক্ত যাঁদের বিশস্ততার ব্যপারে তাদের দৃঢ় প্রত্যয় ছিল। যেকোনো গুরুত্বর বিষয়ে, যেকোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত বিষয়েও তারা এই মহান মানুষটিকেই কোনরুপ সন্দেহ ছাড়াই বিশ্বাস করত।
সত্যিকার কথা হচ্ছে, অবিশ্বাসীরা নবীজি ﷺ কে ব্যক্তি হিসেবে অবিশ্বাস করতো না, আর কুরআনকেও তারা অপছন্দ করতো না। তাদের কাছে ঘৃণিত বিষয় আসলে এই মহাগ্রন্থ পবিত্র আল কুরআন কেন তাদের মত এলিট ক্লাসের ধনী ব্যক্তির উপর নাযিল হলো না! এই মহা সুপ্রজ্ঞা বাণী তাদের মত ধনী কোন ব্যক্তির উপর নাযিল না হয়ে যখন একজন সাধারণ ব্যক্তির উপর নাযিল হলো, এই আবেগীয় আত্ম-অহংকারের বিষয়টিই তারা সহ্য করতে পারছিল না। তাদের এসব ঘৃণার এবং নির্বোধ কথাবার্তার মহান আল্লাহ্ স্পষ্ট দেখিয়েছেন এই আয়াতে:
Al-Anfal 8:32
وَإِذْ قَالُوا۟ ٱللَّهُمَّ إِن كَانَ هَٰذَا هُوَ ٱلْحَقَّ مِنْ عِندِكَ فَأَمْطِرْ عَلَيْنَا حِجَارَةً مِّنَ ٱلسَّمَآءِ أَوِ ٱئْتِنَا بِعَذَابٍ أَلِيمٍ
Bengali - Bayaan Foundation
আর স্মরণ কর, যখন তারা বলেছিল, ‘হে আল্লাহ, যদি এটি সত্য হয় আপনার পক্ষ থেকে তাহলে আমাদের উপর আকাশ থেকে পাথর বর্ষণ করুন অথবা আমাদের উপর অন্য কোন যন্ত্রণাদায়ক আযাব নিয়ে আসুন’।
▪︎ একজন সত্যিকারের বুঝদার মানুষ হলে তো এইভাবে বলতো, "হে আল্লাহ, যদি এটি সত্য হয় তাও আপনার পক্ষ থেকে তাহলে আমাদের কে আপনি সৎ পথে পরিচালিত করুন।" কিন্তু তারা বলল, "এটা যদি সত্য হয়ে থাকে আমরা বরং মরে যাব কিন্তু এই ব্যক্তিকে অনুসরণ করার কোন প্রশ্নই ওঠে না। আবার পবিত্র আল কুরআনের অন্যত্রে এসেছে,
Az-Zukhruf 43:31
وَقَالُوا۟ لَوْلَا نُزِّلَ هَٰذَا ٱلْقُرْءَانُ عَلَىٰ رَجُلٍ مِّنَ ٱلْقَرْيَتَيْنِ عَظِيمٍ
Bengali - Mujibur Rahman
এবং তারা বলেঃ এই কুরআন কেন অবতীর্ণ করা হলনা দুই জনপদের কোন প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তির উপর?
▪︎ তারা আসলে কুরআনের উপর অভিযোগ আরোপ করতো না, কুরআনের আনীত বার্তার উপরেও অভিযোগ করতো না। তারা যে বিষয়ে সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন ছিল সেটা হলো- কার প্রতি কুরআন নাযিল হয়েছিল সেই অপ্রধান ও কৃত্রিম বিষয়-আশয় নিয়ে। তারা এলিটিজমের অহংকার নামক অন্ধকারে পড়ে রইল। তারা মূল জিনিসকেই পেছনে ফেলে রাখল-- আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত সত্যের বার্তা।
অশেষ কৃতজ্ঞতায়:
উস্তাদ নোমান আলী খানের পবিত্র কুরআনের বিস্ময়কর ভাষাতাত্ত্বিক অলঙ্কারের উপর Divine Speech: Exploring Quran As Literature লেকচার থেকে সংকলিত লেখা। সর্বোপরি তিনি এটা নিয়েছেন ইমাম মুতাওয়াল্লী আল শারাওয়ী রাহিমাহুল্লাহ (মিশর) থেকে।