কুরআনের কিছু আয়াত দেখিয়ে নাস্তিকরা দাবী করে যে আল্লাহর ইচ্ছায় তারা পথভ্রষ্ট নাস্তিক হয়ে গেছে।যদিও তারা সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করে না,তবুও নিজেদের কুকর্মের জন্য সৃষ্টিকর্তাকেই দায়ী করে।অনেক মুসলিমের মনেও এ নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরী হয়।তারা মনে করে যে মানুষের স্বাধীন কোনো ইচ্ছা নেই।এই লেখায় তাদের ভ্রান্ত ধারণা খন্ডন করে সত্য উন্মোচন করা হবে ইনশাআল্লাহ। অভিযোগকৃত আয়াতগুলো নিম্নরূপ:
مَنۡ یَّشَاِ اللّٰہُ یُضۡلِلۡہُ ؕ وَ مَنۡ یَّشَاۡ یَجۡعَلۡہُ عَلٰی صِرَاطٍ مُّسۡتَقِیۡمٍ–আল্লাহ যাকে চান, তাকে পথভ্রষ্ট করেন এবং যাকে চান তাকে সরল পথে অটল রাখেন। [সূরা আনআম ৬:৩৯]
ؕ ذٰلِکَ ہُدَی اللّٰہِ یَہۡدِیۡ بِہٖ مَنۡ یَّشَآءُ ؕ وَ مَنۡ یُّضۡلِلِ اللّٰہُ فَمَا لَہٗ مِنۡ ہَادٍ– তিনি যাকে চান তাকে এর দ্বারা হিদায়াত করেন। আর আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন, তার জন্য কোন হিদায়াতকারী নেই। [সূরা যুমার ৩৯:২৩]
وَ لَا یَنۡفَعُکُمۡ نُصۡحِیۡۤ اِنۡ اَرَدۡتُّ اَنۡ اَنۡصَحَ لَکُمۡ اِنۡ کَانَ اللّٰہُ یُرِیۡدُ اَنۡ یُّغۡوِیَکُمۡ ؕ ہُوَ رَبُّکُمۡ ۟ وَ اِلَیۡہِ تُرۡجَعُوۡنَ– ‘আর আমি তোমাদেরকে উপদেশ দিতে চাইলেও আমার উপদেশ তোমাদের কোন উপকারে আসবে না, যদি আল্লাহ তোমাদের বিভ্রান্ত করতে চান।’ [সূরা হূদ ১১:৩৪]
এ আয়াতগুলো দ্বারা কী উদ্দেশ্য?
এ বিষয় সম্পর্কিত আয়াতগুলো থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে,বান্দার হেদায়েত ও পথভ্রষ্ট হওয়া সম্পূর্ণ আল্লাহর হাতে। অন্য কোনো মানুষ চাইলেই কাউকে হেদায়েত দিতে পারবে না অথবা পথভ্রষ্ট করতে পারবে না। যেমন: মহান আল্লাহ বলেছেন,
لَیۡسَ عَلَیۡکَ ہُدٰىہُمۡ وَ لٰکِنَّ اللّٰہَ یَہۡدِیۡ مَنۡ یَّشَآءُ– তাদেরকে হিদায়াত করার দায়িত্ব তোমার নয়, কিন্তু আল্লাহ যাকে চান হিদায়াত করেন। [সূরা বাকারা ২:২৭২]
اِنَّکَ لَا تَہۡدِیۡ مَنۡ اَحۡبَبۡتَ وَ لٰکِنَّ اللّٰہَ یَہۡدِیۡ مَنۡ یَّشَآءُ– নিশ্চয় তুমি যাকে ভালবাস তাকে তুমি হিদায়াত দিতে পারবে না; বরং আল্লাহই যাকে ইচ্ছা হিদায়াত দেন। [সূরা কাসাস ২৮:৫৬]
مَنۡ یَّہۡدِ اللّٰہُ فَہُوَ الۡمُہۡتَدِ ۚ وَ مَنۡ یُّضۡلِلۡ فَلَنۡ تَجِدَ لَہٗ وَلِیًّا مُّرۡشِدًا– আল্লাহ যাকে হিদায়াত দেন, সে হেদায়াতপ্রাপ্ত। আর যাকে ভ্রষ্ট করেন, তুমি তার জন্য পথনির্দেশকারী কোন অভিভাবক পাবে না। [সূরা কাহফ ১৮:১৭]
সুতরাং আল্লাহর ইচ্ছায় মানুষ হেদায়েতপ্রাপ্ত অথবা পথভ্রষ্ট হয়।কিন্তু তাই বলে কি আল্লাহ এমনি এমনিই মানুষকে হেদায়েত দেন অথবা পথভ্রষ্ট করেন?নিশ্চয় না।যদি আল্লাহ বিনা কারণেই এক বান্দাকে হেদায়েত দিত ও অপর বান্দাকে পথভ্রষ্ট করত তাহলে এটা হতো অত্যাচার বা জুলুম।কিন্তু আল্লাহ জুলুমকারী নন।তাই আল্লাহর ইচ্ছায় হেদায়েত বা পথভ্রষ্ট হওয়া নিয়ে মুমিন ও মুসলিমদের চিন্তার কোনো কারণ নেই।মহান আল্লাহ বলেছেন,
اِنَّ اللّٰہَ لَا یَظۡلِمُ النَّاسَ شَیۡئًا وَّ لٰکِنَّ النَّاسَ اَنۡفُسَہُمۡ یَظۡلِمُوۡنَ– নিশ্চয় আল্লাহ মানুষের প্রতি কিছুমাত্র যুলম করেন না; বরং মানুষই নিজদের উপর যুলম করে। [সূরা ইউনুস ১০:৪৪]
ۚ وَ مَا کَانَ اللّٰہُ لِیَظۡلِمَہُمۡ وَ لٰکِنۡ کَانُوۡۤا اَنۡفُسَہُمۡ یَظۡلِمُوۡن–আল্লাহ এমন নন যে, তাদের উপর যুলম করবেন বরং তারা নিজেরা নিজদের ওপর যুল্ম করত। [সূরা আনকাবূত ২৯:৪০]
وَ مَا کَانَ اللّٰہُ لِیُضِیۡعَ اِیۡمَانَکُمۡ ؕ اِنَّ اللّٰہَ بِالنَّاسِ لَرَءُوۡفٌ رَّحِیۡمٌ– আল্লাহ এমন নন যে, তিনি তোমাদের ঈমানকে বিনষ্ট করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ মানুষের প্রতি অত্যন্ত স্নেহশীল, পরম দয়ালু। [সূরা বাকারা ২:১৪৩]
অর্থাৎ আল্লাহর যাকে ইচ্ছা হেদায়েত অথবা পথভ্রষ্ট করার মানে এই না যে তিনি বান্দাদের প্রতি অবিচার করেন।আল্লাহ স্বীয় ইনসাফে বান্দাকে ভালো অথবা মন্দ পথে পরিচালিত করেন ও তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ ন্যায়বিচারক।
কর্মের ক্ষেত্রে কি মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা আছে?
আল্লাহ যাকে ইচ্ছা হেদায়েত দেন অথবা পথভ্রষ্ট করেন একথা সত্য।তাই আল্লাহর ইচ্ছার দোহাই দিয়ে অনেকেই নিজের দোষ অস্বীকার করতে চায়।তাদের এই অপযুক্তি আল্লাহ খন্ডন করে বলেছেন,
وَ قَالُوۡا لَوۡ شَآءَ الرَّحۡمٰنُ مَا عَبَدۡنٰہُمۡ ؕ مَا لَہُمۡ بِذٰلِکَ مِنۡ عِلۡمٍ ٭ اِنۡ ہُمۡ اِلَّا یَخۡرُصُوۡنَ– আর তারা বলে, ‘পরম করুণাময় আল্লাহ ইচ্ছা করলে আমরা এদের ইবাদাত করতাম না’, এ বিষয়ে তাদের কোন জ্ঞান নেই। তারা শুধু মনগড়া কথা বলছে। [সূরা যুখরূফ ৪৩:২০]
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীরে জালালাইনে বলা হয়েছে:
"যারা মূর্খ, নির্বোধ তারাই এমন ভিত্তিহীন অযৌক্তিক,অসুন্দর উক্তি করতে পারে।কেননা মানুষকে যে দুনিয়াতে ভালোমন্দ কাজ করার স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে তার কারণ হলো এই যে, আখিরাতে তাদেরকে ভালো কাজের পুরস্কার দেয়া হবে এবং মন্দ কাজের শাস্তি দেয়া হবে। যদি তাদের কর্মের স্বাধীনতা না থাকত তাহলে তারা।যন্ত্রের ন্যায় কাজ করত। ফলে ছওয়াব বা আজাবের প্রশ্নই উঠত না।"[তাফসীরে জালালাইন ৫/৮২৭]
মানুষকে ভালো ও মন্দ কর্ম করার স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে মহান আল্লাহ বলেন,
اِنَّ ہٰذِہٖ تَذۡکِرَۃٌ ۚ فَمَنۡ شَآءَ اتَّخَذَ اِلٰی رَبِّہٖ سَبِیۡلًا– নিশ্চয় এ(কুরআন) এক উপদেশ। অতএব যে চায় সে তার রবের দিকে পথ অবলম্বন করুক। [সূরা মুযযাম্মিল ৭৩:১৯]
اِنَّا ہَدَیۡنٰہُ السَّبِیۡلَ اِمَّا شَاکِرًا وَّ اِمَّا کَفُوۡرًا– অবশ্যই আমি তা���ে পথ প্রদর্শন করেছি, হয় সে শোকরকারী অথবা অকৃতজ্ঞ। [সূরা ইনসান ৭৬:৩]
ذٰلِکَ الۡیَوۡمُ الۡحَقُّ ۚ فَمَنۡ شَآءَ اتَّخَذَ اِلٰی رَبِّہٖ مَاٰبًا– ঐ দিনটি সত্য। অতএব যে চায়, সে তার রবের নিকট আশ্রয় গ্রহণ করুক। [সূরা নাবা ৭৮:৩৯]
وَ ہَدَیۡنٰہُ النَّجۡدَیۡنِ– আর আমি তাকে দু’টি পথ প্রদর্শন করেছি। [সূরা বালাদ ৯০:১০]
فَمَنۡ شَآءَ ذَکَرَہٗ ﴿ؕ۵۵﴾ وَ مَا یَذۡکُرُوۡنَ اِلَّاۤ اَنۡ یَّشَآءَ اللّٰہُ ؕ ہُوَ اَہۡلُ التَّقۡوٰی وَ اَہۡلُ الۡمَغۡفِرَ– অতএব যার ইচ্ছা সে তা থেকে উপদেশ গ্রহণ করুক।আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কেউ উপদেশ গ্রহণ করতে পারে না। তিনিই ভয়ের যোগ্য এবং ক্ষমার অধিকারী। [সূরা মুদ্দাসসির ৭৪:৫৫-৫৬]
اِنَّ ہٰذِہٖ تَذۡکِرَۃٌ ۚ فَمَنۡ شَآءَ اتَّخَذَ اِلٰی رَبِّہٖ سَبِیۡلًا ﴿۲۹﴾ وَ مَا تَشَآءُوۡنَ اِلَّاۤ اَنۡ یَّشَآءَ اللّٰہُ ؕ اِنَّ اللّٰہَ کَانَ عَلِیۡمًا حَکِیۡمًا– নিশ্চয় এটি উপদেশ; অতএব যে চায় সে যেন তার রবের দিকে একটি পথ গ্রহণ করে।আর আল্লাহ ইচ্ছা না করলে তোমরা ইচ্ছা করবে না; নিশ্চয় আল্লাহ মহাজ্ঞানী, প্রাজ্ঞ। [সূরা ইনসান ৭৬:২৯-৩০]
اِنۡ ہُوَ اِلَّا ذِکۡرٌ لِّلۡعٰلَمِیۡنَ ﴿ۙ۲۷﴾ لِمَنۡ شَآءَ مِنۡکُمۡ اَنۡ یَّسۡتَقِیۡمَ﴿ؕ۲۸﴾ وَ مَا تَشَآءُوۡنَ اِلَّاۤ اَنۡ یَّشَآءَ اللّٰہُ رَبُّ الۡعٰلَمِیۡنَ– এটাতো সৃষ্টিকুলের জন্য উপদেশমাত্র।যে তোমাদের মধ্যে সরল পথে চলতে চায়, তার জন্য।আর তোমরা ইচ্ছা করতে পার না, যদি না সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহ ইচ্ছা করেন। [সূরা তাকভীর ৮১:২৭-২৯]
এখন প্রশ্ন আসতে পারে যে,মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কেউ উপদেশ গ্রহণ করতে পারে না অথবা সৎপথে চলতে পারে না।তাহলে বান্দার ইচ্ছার গুরুত্ব কোথায়? এ প্রশ্নের যথার্থ উত্তর তাফসীরে জালালাইনে দেয়া হয়েছে:
মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি আছে। সেই স্বাধীন ইচ্ছার প্রয়োগের মাধ্যমে সে আল্লাহর নৈকট্য লাভের পন্থা অবলম্বন করতে পারে।তবে একথা মনে রাখতে হবে যে তার এ ইচ্ছা আল্লাহর মাশিয়াতে কাউনিয়া বা ইচ্ছার অধীন।আল্লাহর মাশিয়াতে কাউনিয়া না থাকলে বান্দার ইচ্ছায় কিছুই হতে পারে না।একথাটিই বলা হয়েছে।আল্লাহ ইচ্ছা না করলে তোমরা ইচ্ছা করবে না---এর অর্থ এই নয় যে বান্দা আল্লাহর ইচ্ছার সামনে বাধ্য।বরং এর অর্থ এই যে সবকিছুই আল্লাহ তা'লার আযলী ইচ্ছার আওতাধীন।সেক্ষেত্রে শরয়ী ইচ্ছা থাক বা না থাক।বান্দার সৎকর্মে আল্লাহর কাউনী ও শরয়ী ইচ্ছা থাকে;কিন্তু অপকর্মে কাউনী ইচ্ছা থাকলেও শরয়ী ইচ্ছা অবশ্যই থাকে না।একারণেই শান্তি এবং পুরুস্কারের ব্যবস্থা রয়েছে। [তাফসীরে জালালাইন ৭/২৩৪,সূরা ইনসানের ৩০ আয়াতের তাফসীর]
মানুষ সরল পথে চলতে চাইলে অথবা দ্বীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে চাইলেই থাকতে পারবে না যতক্ষণ না আল্লাহ ইচ্ছা করবেন। তবে একথাও সত্য যে, কেউ যদি আল্লাহর পথে চলতে ইচ্ছা করে তাহলে আল্লাহ তাকে সেদিকে চলতে সাহায্য করে। মূলত আল্লাহর ইচ্ছা হওয়ার পরই বান্দার সেই পথে চলার তাওফীক হয়।[তাফসীরে জাকারিয়া পৃঃ ২৭৮১]
এছাড়াও বান্দার ইচ্ছার ও কর্মপ্রচেষ্টার কারণে আল্লাহ তার জন্য সঠিক পথে চলা সহজ করে দেন।যেমন কুরআন মাজীদে বলা হয়েছে,
وَ الَّذِیۡنَ جَاہَدُوۡا فِیۡنَا لَنَہۡدِیَنَّہُمۡ سُبُلَنَا ؕ وَ اِنَّ اللّٰہَ لَمَعَ الۡمُحۡسِنِیۡنَ– আর যারা আমার পথে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়, তাদেরকে আমি অবশ্যই আমার পথে পরিচালিত করব। আর নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মশীলদের সাথেই আছেন। [সূরা আনকাবূত ২৯:৬৯]
اِنَّ اللّٰہَ یُضِلُّ مَنۡ یَّشَآءُ وَ یَہۡدِیۡۤ اِلَیۡہِ مَنۡ اَنَابَ– নিশ্চয় আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন এবং যে তাঁর অভিমুখী হয়, তাকে তিনি তাঁর দিকে পথ দেখান’।[সূরা রা'দ ১৩:২৭]
اَللّٰہُ یَجۡتَبِیۡۤ اِلَیۡہِ مَنۡ یَّشَآءُ وَ یَہۡدِیۡۤ اِلَیۡہِ مَنۡ یُّنِیۡبُ–আল্লাহ যাকে চান তার দিকে নিয়ে আসেন। আর যে তাঁর অভিমুখী হয় তাকে তিনি হিদায়াত দান করেন।[সূরা আশ-শূরা ৪২:১৩]
اِنَّ سَعۡیَکُمۡ لَشَتّٰی ؕ﴿۴﴾فَاَمَّا مَنۡ اَعۡطٰی وَ اتَّقٰی ۙ﴿۵﴾وَ صَدَّقَ بِالۡحُسۡنٰی ۙ﴿۶﴾فَسَنُیَسِّرُہٗ لِلۡیُسۡرٰی ؕ﴿۷﴾وَ اَمَّا مَنۡۢ بَخِلَ وَ اسۡتَغۡنٰی ۙ﴿۸﴾وَ کَذَّبَ بِالۡحُسۡنٰی ۙ﴿۹﴾فَسَنُیَسِّرُہٗ لِلۡعُسۡرٰی– নিশ্চয় তোমাদের কর্মপ্রচেষ্টা বিভিন্ন প্রকারের।সুতরাং যে দান করেছে এবং তাকওয়া অবলম্বন করেছে,আর উত্তমকে সত্য বলে বিশ্বাস করেছে,আমি তার জন্য সহজ পথে চলা সুগম করে দেব। আর যে কার্পণ্য করেছে এবং নিজকে স্বয়ংসম্পূর্ণ মনে করেছে,আর উত্তমকে মিথ্যা বলে মনে করেছে,আমি তার জন্য কঠিন পথে চলা সুগম করে দেব। [সূরা লাইল ৯২:৪-১০]
অতএব আল্লাহর ইচ্ছার দোহাই দিয়ে নিজের দোষ ঢাকার কোনো সুযোগ থাকছে না। নিচের উদাহরণে এ বিষয়টা বোঝা আরও সহজ হবে আশা করি:
মনে করুন, আপনি কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে ইচ্ছুক। কিন্তু আপনি চাইলেই কি সে প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে পারবেন? নিশ্চয় কর্তৃপক্ষের ইচ্ছা ছাড়া সেখানে চাকরি করতে পারবেন না। তাই বলে কি আপনি কর্তৃপক্ষের দোহাই দিয়ে বলবেন যে তারা চায়নি বলে আপনি সেখানে চাকরি করতে পারেন নি? নিশ্চয় এটা হাস্যকর যুক্তি। কর্তৃপক্ষ আপনার আগ্রহ, চেষ্টা,যোগ্যতা ইত্যাদি বিচার করে চাকরি দিবে। আপনার আগ্রহ, চেষ্টা, যোগ্যতা ইত্যাদি যদি কর্তৃপক্ষের চাওয়ার অনুরূপ হয় তাহলে চাকরি হবে। আপনি চাকরি না পেলে সেটা আপনার প্রচেষ্টার অভাব, কর্তৃপক্ষের দোষ নয়। সুতরাং বান্দার ইচ্ছা বা কর্মপ্রচেষ্টা অনুসারে মহান আল্লাহ তার স্বীয় ইনসাফ অনুযায়ী সৎপথে চলা সহজ করে দেন।মানুষ আল্লাহর অভিমুখী হতে চাইলে আল্লাহ তাকে তার দিকে পথ দেখান।আল্লাহর ইচ্ছায় যেমন সে সৎপথে চলার তাওফীক পেয়েছে,তেমনি বান্দার চেষ্টার কারণেও মহান আল্লাহ তাকে সৎ পথে পরিচালিত করেছেন।তাই নিজের দোষের কারণে যেমন আল্লাহকে দায়ী করা যাবে না,তেমনি নিজেকেই স্বয়ংসম্পূর্ণ মনে করে মহান আল্লাহর অনুগ্রহকে অস্বীকার করা যাবে না।
আল্লাহ মানুষকে কেন পথভ্রষ্ট করেন?
আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন,তার মানে এই না যে তিনি কাউকে এমনি এমনিই পথভ্রষ্ট করে দেন।তিনি কাউকে জোর করেও পথভ্রষ্ট করেন না।মহান আল্লাহ বান্দাদের ওপর জুলুম করেন নন।তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ ন্যায়বিচারক। আল্লাহ মানুষকে তার কর্মের জন্য স্বীয় ইলম ও ইচ্ছায় পথভ্রষ্ট করেন। মহান আল্লাহ বলেন,
وَ مَنۡ یُّشَاقِقِ الرَّسُوۡلَ مِنۡۢ بَعۡدِ مَا تَبَیَّنَ لَہُ الۡہُدٰی وَ یَتَّبِعۡ غَیۡرَ سَبِیۡلِ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ نُوَلِّہٖ مَا تَوَلّٰی وَ نُصۡلِہٖ جَہَنَّم– আর যে রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে তার জন্য হিদায়াত প্রকাশ পাওয়ার পর এবং মুমিনদের পথের বিপরীত পথ অনুসরণ করে, আমি তাকে ফেরাব যেদিকে সে ফিরে এবং তাকে প্রবেশ করাব জাহান্নামে। [সূরা নিসা ৪:১১৫]
فَبِمَا نَقۡضِہِمۡ مِّیۡثَاقَہُمۡ وَ کُفۡرِہِمۡ بِاٰیٰتِ اللّٰہِ وَ قَتۡلِہِمُ الۡاَنۡۢبِیَآءَ بِغَیۡرِ حَقٍّ وَّ قَوۡلِہِمۡ قُلُوۡبُنَا غُلۡفٌ ؕ بَلۡ طَبَعَ اللّٰہُ عَلَیۡہَا بِکُفۡرِہِمۡ فَلَا یُؤۡمِنُوۡنَ اِلَّا قَلِیۡلًا –অতঃপর (তাদের শাস্তি দেয়া হয়েছিল) তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গ, আল্লাহর আয়াতসমূহের সাথে কুফরী করা, অন্যায়ভাবে নবীগণকে হত্যা করা এবং এ কথা বলার কারণে যে, ��আমাদের অন্তরসমূহ আচ্ছাদিত’। বরং আল্লাহ তাদের কুফরীর কারণে অন্তরের উপর মোহর এঁটে দিয়েছিলেন। সুতরাং স্বল্পসংখ্যক ছাড়া তারা ঈমান আনবে না। [সূরা নিসা ৪:১৫৫]
فَمَنۡ یُّرِدِ اللّٰہُ اَنۡ یَّہۡدِیَہٗ یَشۡرَحۡ صَدۡرَہٗ لِلۡاِسۡلَامِ ۚ وَ مَنۡ یُّرِدۡ اَنۡ یُّضِلَّہٗ یَجۡعَلۡ صَدۡرَہٗ ضَیِّقًا حَرَجًا کَاَنَّمَا یَصَّعَّدُ فِی السَّمَآءِ ؕ کَذٰلِکَ یَجۡعَلُ اللّٰہُ الرِّجۡسَ عَلَی الَّذِیۡنَ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ – সুতরাং যাকে আল্লাহ হিদায়াত করতে চান, ইসলামের জন্য তার বুক উন্মুক্ত করে দেন। আর যাকে ভ্রষ্ট করতে চান, তার বুক সঙ্কীর্ণ-সঙ্কুচিত করে দেন, যেন সে আসমানে আরোহণ করছে। এমনিভাবে আল্লাহ অকল্যাণ দেন তাদের উপর, যারা ঈমান আনে না। [সূরা আনআম ৬:১২৫]
ذٰلِکَ بِمَا قَدَّمَتۡ اَیۡدِیۡکُمۡ وَ اَنَّ اللّٰہَ لَیۡسَ بِظَلَّامٍ لِّلۡعَبِیۡدِ– তোমাদের হাত আগে যা প্রেরণ করেছে সে কারণে এ পরিণাম। আর নিশ্চয় আল্লাহ বান্দাদের প্রতি যুলমকারী নন। [সূরা আনফাল ৮:৫১]
مَنۡ عَمِلَ صَالِحًا فَلِنَفۡسِہٖ وَ مَنۡ اَسَآءَ فَعَلَیۡہَا ؕ وَ مَا رَبُّکَ بِظَلَّامٍ لِّلۡعَبِیۡدِ– যে সৎকর্ম করে সে তার নিজের জন্যই তা করে। আর যে অসৎকর্ম করে তা তার উপরই বর্তাবে। তোমার রব তাঁর বান্দাদের প্রতি মোটেই যালিম নন। [সূরা ফুসসিলাত ৪১:৪৬]
فَلَمَّا زَاغُوۡۤا اَزَاغَ اللّٰہُ قُلُوۡبَہُمۡ ؕ وَ اللّٰہُ لَا یَہۡدِی الۡقَوۡمَ الۡفٰسِقِیۡنَ– অতঃপর তারা যখন বাঁকাপথ অবলম্বন করল, তখন আল্লাহ তাদের হৃদয়গুলোকে বাঁকা করে দিলেন। আর আল্লাহ পাপাচারী সম্প্রদায়কে হিদায়াত করেন না। [সূরা সফ ৬১:৫]
کَلَّا بَلۡ ٜ رَانَ عَلٰی قُلُوۡبِہِمۡ مَّا کَانُوۡا یَکۡسِبُوۡنَ– কখনো নয়, বরং তারা যা অর্জন করত তা-ই তাদের অন্তরসমূহকে ঢেকে দিয়েছে। [সূরা মুতাফফিফীন ৮৩:১৪]
সুতরাং কোনো মানুষ পথভ্রষ্ট হয় তার নিজের দোষে।কুফুরী করা,মহান আল্লাহর আয়াত ও রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে অস্বীকার করা, বাকা পথে চলতে চাওয়ার কারণে আল্লাহ স্বীয় ইচ্ছায় তাকে পথভ্রষ্ট করেছেন। অনেকে তাকদীরের দোহাই দিয়ে বলতে পারে যে,বান্দার পথভ্রষ্ট হওয়া তো পূর্ব নির্ধারিত ছিল। একথা বলে সে আবার নিজের পথভ্রষ্ট হওয়ার কারণ হিসেবে মহান আল্লাহর লেখা তাকদীরকে দোষারোপ করে। এর জবাবে বলতে হয়, আল্লাহ কী মানুষকে জোর করে পথভ্রষ্ট করেছে?নাকি আল্লাহ তাকে ভালো ও মন্দ পথ দেখাননি?মানুষকে আল্লাহ ভালো-মন্দ পথ গ্রহণের স্বাধীনতা দিয়েছেন। এবং তিনি তাকে দুটি পথ প্রদর্শন করেছেন [সূরা আল-বালাদ ৯০:১০]। সে কৃতজ্ঞ হোক বা অকৃতজ্ঞ হোক,আল্লাহ অবশ্যই তাকে পথ প্রদর্শন করেছেন। [সূরা আল-ইনসান ৭৬:৩]
আল্লাহ্ পরিস্কারভাবে উল্লেখ করেছেন যে, তিনি যে বান্দাকে পথভ্রষ্ট করেছেন তাকে পথভ্রষ্ট করার কারণ সে বান্দার পক্ষ থেকেই। বান্দা তো জানে না আল্লাহ্ তার তাকদীরে কী রেখেছেন। যেহেতু তাকদীরকৃত বিষয়টি সংঘটিত হওয়ার পর সে তাকদীরের কথা জানতে পারে। সে জানে না যে, আল্লাহ্কি তাকে পথভ্রষ্ট হিসেবে তাকদীরে রেখেছেন; নাকি হেদায়েতপ্রাপ্ত হিসেবে? সুতরাং সে নিজে ভ্রষ্টতার পথ অবলম্বন করে কেন আপত্তি আরোপ করবে যে আল্লাহ্ই তার জন্য সেটা চেয়েছেন! অতএব নিজের কর্মের দোষ তাকদীরের ওপর চাপানো নিতান্তই মূর্খতা।
সুতরাং এটা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো যে বান্দার নিজের দোষের কারণেই আল্লাহ তাকে জন্য পথভ্রষ্ট করেছেন। আল্লাহ আমাদের হেদায়েত করুক ও সৎপথে চলার তওফীক দান করুক।