কুরআন ও আধুনিক বিজ্ঞান: সামঞ্জস্যপূর্ণ না অসামঞ্জস্যপূর্ণ?
লিখক: ড: জাকির আবদুল করিম নায়েক
বিষয়বস্তুর শিরোনাম
অধ্যায়: ০১: জ্যোতিষ শাস্ত্র
⇛ বিশ্ব সৃষ্টি ও মহা বিস্ফোরণ (বিগ ব্যাংগ)
⇛ ছায়াপথ সৃষ্টির আগে প্রাথমিক গ্যাস পিন্ড
⇛ পৃথিবীর আকার গোল
⇛ চাঁদের আলো হচ্ছে প্রতিফলিত আলো
⇛ সূর্যের আবর্তন
⇛ সূর্য নিষ্প্রভ হয়ে যাবে
⇛ মহাশূন্যে বস্তুর অস্তিত্ব
⇛ সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্ব
অধ্যায়: ০২: পদার্থ বিজ্ঞান
⇛ অণূকে বিভক্ত করা যায়
অধ্যায়: ০৩:পানি বিজ্ঞান
⇛ পানি চক্রঃ
⇛ বাষ্পে পরিণত হওয়া
⇛ বৃষ্টিগর্ভ বাতাস
অধ্যায়: ০৪: ভূতত্ব বিজ্ঞান
⇛ পাহাড় - পর্বতসমূহ তাঁবুর পেরেকের মত
⇛ পাহাড় দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত
অধ্যায়: ০৫: মহাসাগর
⇛ মিষ্টি ও লবণাক্ত পানির মধ্যে অন্তরায়
⇛ মহাসাগরের গভীরের অন্ধকার
অধ্যায়: ০৬: উদ্ভিদ বিজ্ঞান
⇛ পুরুষ ও স্ত্রী লিঙ্গ বিশিষ্ট গাছ
⇛ ফলের মধ্যেও পুরুষ ও স্ত্রী লিঙ্গ আছে।
⇛ প্রত্যেক সৃষ্টিকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করা হয়েছে
অধ্যায়: ০৭: প্রাণী বিজ্ঞান
⇛ পাখী ও প্রাণী দল বা সম্প্রদায় হিসেবে বাস করে
⇛ পাখীর উড্ডয়ন
⇛ মৌমাছি ও এর দক্ষতা
⇛ মাকড়সার জাল ও দুর্বল ঘর
⇛ পিঁপড়ার জীবনধারা ও যোগাযোগ
অধ্যায়: ০৮: ওষুধ
⇛ মধু মানুষের চিকিৎসা
অধ্যায়: ০৯:শারীরতত্ব
⇛ রক্তচলাচল এবং দুধ
অধ্যায়: ১০: ভ্রুণতত্ব
⇛ মুসলমানরা উত্তর চায়
⇛ মেরুদন্ড ও পাঁজরের মাঝ থেকে নিক্ষিপ্ত ফোঁটা
⇛ শুক্র সামান্য পরিমাণ তরল পদার্থ
⇛ সুলালাহ - তরল পদার্থের নির্যাস
⇛ নোতফাতুন আমসাজ- মিশ্রিত তরল পদার্থ
⇛ লিঙ্গ নির্ধারণ
⇛ ভ্রূণ অন্ধকারের তিন পর্দার আড়ালে সুসংরক্ষিত
⇛ ভ্রূণের পর্যায়সমূহ
⇛ ভ্রূণ আংশিক গঠিত ও আংশিক গঠিত নয়
⇛ শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তির অনুভূতি
অধ্যায়: ১১: সাধারন বিজ্ঞান
⇛ আঙ্গুলের ছাপ
⇛ চামড়ার ব্যথা অনুভবকারী উপাদান
অধ্যায়: ১২
উপসংহার
১. জ্যোতিষ শাস্ত্র
❑ বিশ্বজগৎ সৃষ্টি: মহাবিস্ফোরণ
জ্যোতিপদার্থবিদগণ (Astrophysicists) বিশ্ব জগতের সৃষ্টির ব্যাখ্যা করেছেন ব্যাপকভাবে গ্রহণীয় বিস্ময়কর ঘটনায় যা ‘মহাবিস্ফোরণ' (Big Bang) নামে জনপ্রিয়ভাবে পরিচিত। বহুদশকব্যাপী জ্যোতির্বিদ ও জ্যোতি- পদার্থবিদগণ কর্তৃক সংগৃহীত পর্যবেক্ষণমূলক ও গবেষণামূলক তথ্য-উপাত্ত দ্বারা এটা সমর্থিত। ‘মহাবিস্ফোরণ' তত্ত্বানুযায়ী সমগ্র বিশ্বজগত প্রাথমিক বা আদি অবস্থায় একটি বিশাল পিও (প্রাথমিক নীহারিকা - Primary Nebula) আকারে বিদ্যমান ছিল। এরপর সেখানে ঘটে এক মহাবিস্ফোরণ (মাধ্যমিক পৃথককরণ)। এরই ফলে গঠিত হয় অসংখ্য ছায়াপথ (Galaxies)। অতঃপর এগুলো বহু খণ্ডে বিভক্ত হয়ে সৃষ্টি হয় নক্ষত্রপুঞ্জ, গ্রহপুঞ্জ, সূর্য, চন্দ্ৰ ইত্যাদি। বিশ্বজগতের উৎপত্তিটি ছিলো অনন্য। দৈবক্রমে' এটা ঘটার সম্ভাবনা শূন্য পর্যায়ে ৷
বিশ্বজগতের সূচনা, উৎপত্তি সম্পর্কে আল-কুরআনের নিম্নে বর্ণিত আয়াতে উল্লেখ রয়েছে।
أوَلَمْ يَرَ الَّذِينَ كَفَرُوا أَنَّ السَّمَوتِ وَالْأَرْضِ كَانَتَا رَتْقًا
“যারা সত্য প্রত্যাখ্যান করে তারা কি ভেবে দেখে না যে, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী (একক সৃষ্টি হিসেবে) ওতপ্রোতভাবে মিশে ছিল, এরপর আমি তাদেরকে পৃথক করে দিলাম? (আল-কুরআন-২১: ৩০)
কুরআনের আয়াত ও মহাবিস্ফোরণ বা 'বিগ-ব্যাংগ' এর মধ্যে এই যে বিস্ময়কর সাদৃশ্যতা তা কোনভাবে এড়ানো যাবে না। ১৪০০ বছর পূর্বে মরুময় আরবে প্রথম আবির্ভূত একটি কিতাব কিভাবে এরূপ একটি জ্ঞানগর্ভ বৈজ্ঞানিক সত্যকে ধারণ করতে পারল?
❑ ছায়াপথ সৃষ্টির পূর্বে ছিল আদি গ্যাসীয় পিণ্ড
বিজ্ঞানীগণ বলেন যে, মহাবিশ্বে ছায়াপথ গঠনের পূর্বে মহাকাশীয় বস্তু ছিল আদিতে গ্যাসীয় পদার্থের আকারে । সংক্ষেপে বললে বলা যায় যে, ছায়াপথ সৃষ্টির পূর্বে বিপুল গ্যাসীয় পদার্থ বা মেঘমালা বিদ্যমান ছিলো । আদি মহাকাশীয় বস্তুকে ‘গ্যাসের' চেয়ে ‘ধূম' শব্দের দ্বারা বর্ণনা করা অধিকতর সঠিক। আল-কুরআন নিম্নবর্ণিত আয়াতে বিশ্বজগতের অবস্থা বর্ণনা প্রসঙ্গে সে 'দুখান' শব্দের উল্লেখ করেছে। ‘দুখান' শব্দের অর্থ হলো ধূম্র -
ثُمَّ اسْتَوَى إِلَى السَّمَاءِ وَهيَ دُخَانُ فَقَالَ لَهَا وَلِلْأَرْضِ انْتِيَا طَوْعًا أَوْ كَرْهًا قَالَتَا أَتَيْنَا طَائِعِينَ.
“অতঃপর তিনি আকাশের দিকে মনোনিবেশ করলেন যা ছিলো ধূম্রকুঞ্জ বিশেষ । তিনি একে এবং পৃথিবীকে বললেন: এস তোমরা একসঙ্গে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়, তারা বলল:আমরা এলাম স্বেচ্ছায় অনুগত হয়ে।” (আল-কুরআন-৪১:১১)
এই ঘটনাটি হলো মহাবিস্ফোরণের (Big Bang) এর স্বাভাবিক পরিণতি যা হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর সময় আরবদের নিকট ছিলো অজানা। তাহলে সে সময়ে এ জ্ঞানের উৎস কি হতে পারে?
❑ পৃথিবীর আকার গোল
আদিমকালে মানুষ বিশ্বাস করত যে, পৃথিবীটি চেপ্টা। বহু শতাব্দীব্যাপী মানুষ বহুদূর গমনে ভয় পেত এজন্য যে, পাছে সে পৃথিবীর কিনার হতে পড়ে যায় । স্যার ফ্রানসিস ড্রেক (Sir Francis Drake) হলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি ১৫৯৭ খৃষ্টাব্দে পৃথিবীর চারিদিকে জলপথে ভ্রমণ করে প্রমাণ করেছিলেন যে পৃথিবী গোলাকার । দিন ও রাতের পরিবর্তন সম্পর্কে কুরআনের নিম্নলিখিত আয়াতটি বিবেচনা করুন।
ألَمْ تَرَ أَنَّ اللهَ يُولِجُ الَّيْلَ فِى النَّهَارِ وَيُولِجُ النَّهَارَ في اليل. الَّيْلِ.
“তোমরা কি দেখনি আল্লাহ রাতকে দিনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেন এবং তিনি দিনকে অন্তর্ভুক্ত করেন রাতের মধ্যে?” (আল-কুরআন-৩১:২৯)
এখানে ‘অন্তর্ভুক্ত করা' এর অর্থ হলো রাতের ধীরে ধীরে এবং ক্রমান্বয়ে দিনে রূপান্তরিত হওয়া অনুরূপভাবে দিনের ধীরে ধীরে এবং ক্রমান্বয়ে রাতে পরিবর্তিত হওয়া। এই প্রাকৃতিক ঘটনাটি তখনই সংঘটিত হতে পারে যদি পৃথিবীটি হয় গোলাকার। যদি পৃথিবীটি চেপ্টা হতো তাহলে হঠাৎ করে রাত দিনে এবং দিনও হঠাৎ করে রাতে রূপান্তরিত হতো। আল-কুরআনের নিম্নলিখিত আয়াতেও পৃথিবীর গোলাকার আকৃতির কথা পরোক্ষভাবে উল্লেখ রয়েছে।
خَلَقَ السَّمَوتِ وَالْأَرْضِ بِالْحَقِّ يُكَوِّرُ الَّيْلَ عَلَى النَّهَارِ وَيُكَوِّرُ النَّهَارَ عَلَى الَّيْل.
“তিনি যথাযথভাবে সৃষ্টি করেছেন আকাশমণ্ডল ও পৃথিবী, তিনি রাত দ্বারা দিনকে আচ্ছাদিত করেন এবং দিন দ্বারা রাতকে আচ্ছাদিত করেন।” (আল-কুরআন-৩৯: ৫)
এখানে আরবী শব্দ 'কাওবেরু' ব্যবহার করা হয়েছে। এ শব্দটির অর্থ হল ‘আচ্ছাদিত করা’, ‘জড়ানো' বা কুণ্ডলী করা', যেভাবে মাথার চারিদিকে পাক দিয়ে পাগড়ি বাঁধা হয় । দিন ও রাতের এই আচ্ছাদন বা জড়ানো তখনই সংঘটিত হতে পারে যদি পৃথিবীটি হয় গোলাকার ।
আবার পৃথিবী বলের মত পুরোপুরি গোলাকার নয়। তবে এটা ভূগোলকের মত অর্থাৎ এটার মেরুদ্বয় চেপ্টা। কুরআনের নিম্নে বর্ণিত আয়াতে পৃথিবীর আকৃতির বর্ণনা রয়েছে।
وَ الۡاَرۡضَ بَعۡدَ ذٰلِکَ دَحٰىهَا ﴿ؕ۳۰﴾
“আর এরপর তিনি পৃথিবীকে করেছেন ডিম্বাকৃতি।”১ (আল-কুরআন-৭৯:৩০)
এখানে আরবী শব্দ 'দাহাহা' এর অর্থ হলো উট পাখির আন্ডা । উট পাখির আন্ডা পৃথিবীর ভূগোলকের আকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এভাবেই কুরআন সঠিকভাবে পৃথিবীর আকৃতির বর্ণনা দিয়েছে যদিও কুরআন যখন পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয় তখন অতি প্রচিলত ধারণা ও বিশ্বাস ছিলো পৃথিবী চেপ্টা ৷
___________
১. আরবী শব্দ 'দাহাহা'কে A. Yusuf Ali অনুবাদ করেছেন 'সুবিশাল বিস্তার' যা সঠিক অনুবাদ। 'দাহাহা' এর অন্য একটি অর্থ হলো উট পাখির আন্ডা।'
❑ চাঁদের আলো হলো প্রতিফলিত আলো
প্রাচীন সভ্যতাগুলো বিশ্বাস করতো যে চাঁদ নিজেই নিজের আলো ছড়ায় কিন্তু বিজ্ঞান আজ আমাদের বলে, চাঁদের আলো আসলে প্রতিফলিত আলো । কুরআন ১৪০০ বছর পূর্বেই এ সত্যটি উল্লেখ করেছে নিম্নলিখিত আয়াতে-
تَبْرَكَ الَّذِي جَعَلَ فِي السَّمَاءِ بُرُوجًا وَجَعَلَ فِيهَا سرجًا وقَمَراً منيراً.
“কত মহান তিনি যিনি নভোমণ্ডলে সৃষ্টি করেছেন রাশিচক্র আর তাতে স্থাপন করেছেন প্রদীপ (অর্থাৎ সূর্য) ও জ্যোতির্ময় চন্দ্র।” (আল-কুরআন-২৫: ৬১)
কুরআনে সূর্যের জন্য আরবী প্রতিশব্দ হলো, 'শামস' আবার সূর্যকে উল্লেখ করা হয়েছে 'সিরাজ' বলে যার অর্থ হলো 'মশাল' অথবা 'ওয়াহাজা' বলে যার অর্থ 'প্রজ্জ্বলিত প্রদীপ' বা ‘দিয়া' হিসেবে যার অর্থ ‘তেজস্কর' ।
এই তিনটি বর্ণনাই সূর্যের ক্ষেত্রে যথোচিত ও মানানসই, যেহেতু এটা অন্তর্দহনে তীব্র তাপ ও আলো উৎপাদন করে। চাঁদের জন্য আরবী প্রতিশব্দ হলো 'কামার' যা কুরআনে ‘মুনীর' শব্দ দ্বারা প্রকাশ করেছে। মুনীর’ হলো সেই বস্তু যা ‘নূর' বা আলো দেয়। আবার কুরআনীয় বর্ণনা চাঁদের বৈশিষ্ট্যের সাথে নিখুঁতভাবে মিলে যায়। চাঁদের বৈশিষ্ট্য হলো চাঁদ নিজে কোন আলো দেয় না বরং এটা একটি নিষ্ক্রিয় বস্তু যা প্রতিফলিত করে সূর্যের আলোকে ।
সমগ্র কুরআনে একবারের জন্যেও চাঁদকে 'সিরাজ', 'ওয়াহাজা' বা 'দিয়া' হিসেবে অথবা সূর্যকে 'নূর' বা মুনীর' হিসেবে উল্লেখ করা হয় নাই। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আল-কুরআন চাঁদ ও সূর্যের আলোর প্রকৃতির মধ্যে পার্থক্য স্বীকার করে । সূর্য ও চন্দ্রের আলোর প্রকৃতি সম্পর্কে আল-কুরআনের নিম্নে বর্ণিত আয়াতগুলো বিবেচনা করুন-
هُوَ الَّذِي جَعَلَ الشَّمْس ضياء وَالْقَمَرَ نُوراً.
“তিনিই সেই সত্তা যিনি সূর্যকে তেজস্কর ও চন্দ্রকে স্নিগ্ধ জ্যোতির্ময় করেছেন।” (আল-কুরআন-১০: ৫)
أَلَمْ تَرَوْا كَيْفَ خَلَقَ اللَّهُ سَبْعَ سَمَوتِ طَبَاقًا وَجَعَلَ الْقَمَرَ فيهنَّ نُورًا وَجَعَلَ الشَّمْس سرَاجًا.
“তোমরা কি লক্ষ্য করনি আল্লাহ কিভাবে সৃষ্টি করেছেন সপ্তস্তরে সুবিন্যস্ত আকাশমণ্ডলী? আর সেখানে চন্দ্রকে স্থাপন করেছেন স্নিগ্ধ আলোরূপে এবং সূর্যকে স্থাপন করেছেন প্রদীপরূপে।” (আল-কুরআন-৭১ : ১৫-১৬)
তাই দেখা যায় মহিমান্বিত কুরআন ও আধুনিক বিজ্ঞান সূর্য ও চন্দ্রের আলোর প্রকৃতির মধ্যে বিরাজমান পার্থক্যের ব্যাপারে পুরাপুরি একই দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে ৷
❑ সূর্য ঘুরে
সুদীর্ঘকাল ব্যাপী ইউরোপীয় দার্শনিক ও বিজ্ঞানীগণ বিশ্বাস করতেন মহাবিশ্বের কেন্দ্রে পৃথিবী স্থির-নিশ্চল অবস্থায় বিদ্যমান রয়েছে এবং সূর্যসহ অন্যান্য সকল বস্তু এর চারিদিকে ঘুরছে। পাশ্চাত্য জগতে মহাবিশ্বের এই ভূকেন্দ্রিক মতবাদ খৃষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে ঠিক টলেমীর (Ptolemy) সময় হতে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিলো। ১৫১২ খৃষ্টাব্দে নিকোলাস কোপারনিকাস ( Nicholas Copernicus) গ্রহের গতি সম্পর্কীয় সূর্য কেন্দ্রিক তত্ত্ব প্রদান করেন। এ তত্ত্ব দাবী করে যে, সৌর জগতের কেন্দ্রে সূর্য গতিহীন অবস্থায় আছে আর একে কেন্দ্র করে গ্রহগুলো এর চারিদিকে ঘূর্ণায়মান অবস্থায় রয়েছে।
১৬০৯ খৃস্টাব্দে জার্মান বিজ্ঞানী ইউহান্নাস কেপলার (Yohannus Keppler) ‘এসট্রোনোমিয়া নোভা' (Astronomia Nova) নামে একটি লেখা প্রকাশ করেন। তিনি এই লেখার উপসংহারে একথা বলেন যে, সূর্যের চারিদিকে গ্রহগুলো উপবৃত্তাকার কক্ষ পথে শুধু ঘুরছে না বরং অনিয়মিত বেগে তারা তাদের নিজেদের অক্ষের চারিদিকেও ঘুরছে। এ জ্ঞানের আলোকে ইউরোপীয় বিজ্ঞানীদের পক্ষে পর্যায়ক্রমে রাত দিনের আগমনসহ সৌরজগতের বহু কিছুরই কার্য সাধন পদ্ধতির সঠিক ব্যাখ্যা প্রদান সম্ভব হয় ।
এসব আবিষ্কারের পর, মনে করা হতো যে, সূর্য স্থির রয়েছে। পৃথিবীর ন্যায় সে তার অক্ষের চারিদিকে ঘুরে না। আজ আমার মনে পড়ে এ সকল ভ্রান্ত ধারণা স্কুল জীবনে ভূগোল পুস্তকে পাঠ করেছিলাম। আল-কুরআনের নিম্নের আয়াতটি বিবেচনা করুন-
وَهُوَ الَّذِي خَلَقَ اليْل وَالنَّهَارَ وَالشَّمْسَ وَالْقَمَرَ كُلٌّ في فَلَك يَسْبَحُونَ
“আর তিনিই সৃষ্টি করেছেন রাত ও দিন এবং সূর্য ও চন্দ্র; সকল (মহাকাশীয় বস্তুই) নিজ নিজ কক্ষপথে সাঁতার কাটছে।” (আল-কুরআন-২১: ৩৩)
উপরোক্ত আয়াতে যে আরবী শব্দ ইয়াসবাহুন' ব্যবহৃত হয়েছে তা ‘সাবাহা' শব্দ হতে উদ্ভূত। এটা গতিশীল বস্তুর গতির ধরন বুঝায়। যদি আপনি এ শব্দটি ভূপৃষ্ঠে মানুষের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেন তখন এটা বুঝাবে না যে, তিনি গড়াচ্ছেন বরং বুঝাবে যে, তিনি হাঁটছেন বা দৌড়াচ্ছেন। যদি আপনি পানিতে কোন ব্যক্তির ক্ষেত্রে এ শব্দ ব্যবহার করেন তখন এটা বুঝাবে না যে, তিনি ভাসছেন বরং এটাই বুঝাবে যে, তিনি সাঁতার কাটছেন ।
একইভাবে বলা যায়, 'ইয়াসবাহ' শব্দটি যদি আপনি মহাকাশীয় বস্তু যেমন সূর্যের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেন- তখন এটা বুঝাবে না যে সে কেবলমাত্র মহাকাশে উড়ছে বরং এটাও বুঝাবে যে, এটা চক্রাকারে আবর্তন করছে, যেমনভাবে এটা মহাকাশে ভ্রমণ করে থাকে। স্কুলের অধিকাংশ পাঠ্য পুস্তকে এ সত্য সন্নিবেশিত করা হয়েছে যে, সূর্য তার নিজ অক্ষের চারিদিকে ঘুরে। নিজ অক্ষের চারিদিকে সূর্যের এই যে আবর্তন এটা প্রমাণ করা যায় এমন এক যন্ত্রের সাহায্যে যা প্রক্ষিপ্ত করে টেবিলের উপর সূর্যের প্রতিকৃতি, অন্ধ না হলে যে কোন ব্যক্তি সূর্যের এই প্রতিকৃতি পরীক্ষা করতে পারেন। এটা দেখা গেছে যে, সূর্যের বিভিন্ন অবস্থান স্থান আছে যা প্রতি ২৫ দিনে একটি পূর্ণ বৃত্তাকার ঘূর্ণন সম্পন্ন করে, অর্থাৎ নিজ অক্ষের চারিদিকে প্রদক্ষিণ করতে সূর্যের লাগে প্রায় ২৫ দিন ।
প্রকৃতপক্ষে মহাকাশে সূর্য মোটামুটি প্রতি সেকেণ্ডে ১৫০ মাইল বেগে ভ্রমণ করে এবং আমাদের ছায়াপথ (Milky Way Galaxy) এর কেন্দ্রের চারিদিকে একবার সম্পূর্ণ প্রদক্ষিণ করতে সূর্যের সময় লাগে ২০ কোটি বছর।
আল-কুরআন ঘোষণা করে-
لا الشَّمْسُ يَنْبَغِي لَهَا أَنْ تُدْرِكَ الْقَمَرَ وَلَا الَّيْلُ سَابِقُ النَّهَارِ وَكُلٌّ فِي فَلَكٍ يَسْبَحُونَ
“সূর্যের ক্ষমতা নেই চাঁদকে ধরে ফেলা এবং রজনীর পক্ষে সম্ভব নয় দিনকে অতিক্রম করা, সকলেই মহাশূন্যে নিজ নিজ কক্ষে থেকে সন্তরণ করে (সুনির্দিষ্ট নিয়মে)। (আল-কুরআন-৩৬ : ৪০)
এই আয়াত এমন প্রয়োজনীয় সঠিক তথ্য উল্লেখ করেছে যা মাত্র সম্প্রতি আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছে। সেগুলো হলো সূর্য ও চন্দ্রের পৃথক কক্ষপথের অস্তিত্ব, মহাকাশে নিজস্ব গতিতে তাদের ভ্রমণ ।
সূর্য, সৌর জগতকে নিয়ে যে 'নির্দিষ্ট স্থান' অভিমুখে গমন করছে সে স্থানটি আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করেছে। এ স্থানের নাম দেয়া হয়েছে সৌর চূড়া (Solar Apex)। বস্তুত: সৌরজগত মহাকাশে যে বিন্দুর দিকে ধাবিত হচ্ছে তা হারকিউলসের তারামণ্ডলে (Alpha lyrae) অবস্থিত যার সঠিক অবস্থান দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ।
পৃথিবীর চারিদিকে প্রদক্ষিণ করতে চন্দ্র যে সময় নেয় সেই একই সময়ে চন্দ্র তার নিজ অক্ষের চারিদিকে ঘুরে থাকে। একবার সম্পূর্ণ ঘুরে আসতে চন্দ্রের সময় লাগে প্রায় সাড়ে ঊনত্রিশ (২৯.৫) দিন। আল-কুরআনের এই আয়াতগুলোর বৈজ্ঞানিক নির্ভুলতা দেখে যে কেউ অবাক না হয়ে পারেন না। তাহলে আমাদের কি ভেবে দেখা উচিত নয় এই প্রশ্নটি: কুরআনে ধারণকৃত জ্ঞানের উৎস কি?
❑ নির্দিষ্ট মেয়াদকাল পর সূর্য নির্বাপিত হবে
সূর্যের এই আলো তার পৃষ্ঠদেশে রাসায়নিক প্রক্রিয়ারই ফসল। বিগত ৫ শত কোটি বছর ধরে এই রাসায়নিক প্রক্রিয়া ধারাবাহিকভাবে সংঘটিত হয়ে চলেছে। ভবিষ্যতে একটি নির্দিষ্ট ক্ষণেই এর পরিসমাপ্তি ঘটবে। তখন সূর্য সম্পূর্ণরূপে নির্বাপিত হয়ে যাবে। এরই ফলশ্রুতিতে ধরনী হতে বিলুপ্ত হয়ে যাবে জীবনের অস্তিত্ব। সূর্যের অস্থায়িত্ব সম্পর্কে আল-কুরআনের ঘোষণা—
وَالشَّمْسُ تَجْرِي لِمُسْتَقَرٌّ لَهَا - ذلِكَ تَقْدِيرُ الْعَزِيزِ الْعَلِيمِ.
'আর সূর্য তার গতিপথে ছুটে যাচ্ছে নির্দিষ্ট মেয়াদকালের জন্য। এটা তিনিই নির্ধারিত করে দিয়েছেন যিনি মহাশক্তিমান ও মহাজ্ঞানী ।”
[আল-কুরআন ৩৬:৩৮- অনুরূপ বর্ণনা কুরআনের নিম্নলিখিত স্থানে উল্লেখ আছে- ১৩ : ২, ৩৫ : ১৩, ৩৯ : ৫ এবং ৩৯ : ২১]
এখানে আরবী শব্দ 'মুস্তাকার' ব্যবহার করা হয়েছে। এর অর্থ হলো 'সময়' বা ‘স্থান’ যা নির্দিষ্ট করা আছে। সুতরাং কুরআন বলে যে, সূর্য ধাবিত হচ্ছে একটি নির্ধারিত স্থানের দিকে এবং এটা এভাবেই ধাবিত হতে থাকবে একটি নির্ধারিত সময়কাল পর্যন্ত যার অর্থ হলো সূর্যের এক সময়ে পরিসমাপ্তি বা বিলোপ ঘটবে বা নির্বাপিত ও নিষ্প্রভ হয়ে যাবে ।
❑ আন্ত:নাক্ষত্রিক পদার্থের১ অস্তিত্ব
সুসংগঠিত সৌর জগতের বাহিরের স্থানটিকে শূন্য মনে করা হতো। পরবর্তীতে জ্যোতিপদার্থবিদগণ আন্ত:নাক্ষত্রিক স্থানে পদার্থের সেতুসমূহের উপস্থিতি আবিষ্কার করেন। পদার্থের এই সেতুসমূহকে প্লাজমা (Plasma)২ বলে। এই সেতুসমূহ আয়নিত গ্যাস দ্বারা গঠিত। এই গ্যাসে আছে সমান সংখ্যক মুক্ত ইলেকট্রন ও ধনাত্মক আয়ন । প্লাজমাকে কখনো কখনো পদার্থের ৪র্থ অবস্থা বা দশা বলা হয় । (পদার্থের কঠিন, তরল ও বায়ুবীয় এই পরিচিত এই তিন অবস্থা ছাড়া)। আল-কুরআনের নিম্নলিখিত আয়াতে আন্তঃনাক্ষত্রিক বস্তুর অস্তিত্বের বিষয় উল্লেখ রয়েছে।
الَّذِي خَلَقَ السَّمَوتِ وَالْأَرْضَ وَمَا بَيْنَهُمَا.
“তিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী এবং উহাদের মধ্যস্থিত সকল কিছুকে সৃষ্টি করেছেন।” (আল-কুরআন-২৫ : ৫৯)
আন্তর্নক্ষত্রিক ছায়াপথবর্তী বস্তুর অস্তিত্বের সন্ধান ১৪০০ বছর পূর্বেই জানা- এটা কেউ প্রস্তাবনা হিসেবে পেশ করলেও সে হাস্যকর রূপে গণ্য হতো ।
______________________
১. মহাবিশ্বে নগণ্য ব্যতিক্রম ছাড়া নক্ষত্রদের মাঝে দূরত্ব সুবিপুল। এই সুবিপুল অঞ্চল পরম শূন্য নয় । এখানে থাকে হাইড্রোজেন (H2), হিলিয়াম (He) ধূলিকণাসহ নানা প্রকার পদার্থ। এরাই আস্ত" নাক্ষত্রিক পদার্থ। ছায়াপথের মোট ভরের ৭ থেকে ১০% থাকে আন্ত:নাক্ষত্রিক স্থানে । [অনুবাদক]
২. পদার্থের সাধারণত তিন অবস্থা বা দশা আছে। যথা (১) কঠিন, যেমন- ইট, পাথর, চেয়ার, টেবিল ইত্যাদি, (২) তরল, যেমন- পানি, তেল, দুধ, মধু ইত্যাদি (৩) গ্যাস, যেমন- হাইডোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন ইত্যাদি। এগুলো ছাড়া পদার্থের আরো একটি অবস্থা বা দশা আছে। পদার্থের এই চতুর্থ অবস্থা বা দশাকে প্লাজমা (Plasma) বলে। প্লাজমা হচ্ছে আয়নিত গ্যাস যেখানে সমান সংখ্যক মুক্ত ইলেকট্রন এবং ধনাত্মক আয়ন আছে। গ্যাস ক্ষরণ টিউব ও নক্ষত্রের বাতাবরণে প্লাজমা থাকে। বৈদ্যুতিকভাবে প্রশম থাকা সত্ত্বেও প্লাজমা বিদ্যুতের সুপরিবাহি । এদের থাকে খুবই উচ্চ তাপমাত্রা । [অনুবাদক]
❑ সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্ব
১৯২৫ সনে এডউইন হাবল (Edwin Hubble) নামে এক আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী পর্যবেক্ষণমূলক সাক্ষ্য প্রমাণের আলোকে ঘোষণা করেন যে, ছায়াপথগুলো পরস্পর পরস্পর হতে দূরে সরে যাচ্ছে, যার অর্থ হলো মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হচ্ছে। মহাবিশ্বের এই প্রসারণ আজ বৈজ্ঞানিক সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত । মহাবিশ্বের প্রকৃতি সম্পর্কে কুরআন বলেন-
والسَّمَاء بَنَيْنَهَا بِأَيْد وَإِنَّا لَمُوسِعُونَ.
“আমি ক্ষমতা ও দক্ষতা বলে নির্মাণ করেছি নভোমণ্ডল এবং আমি মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ ঘটাই।” (আল-কুরআন-৫১:৪৭)
আরবী শব্দ ‘মুসিউন’ সঠিকভাবে অনূদিত হয়েছে ইহাকে সম্প্রসারিতকরণ'/ ‘সম্প্রসারণকারী' হিসেবে এবং এটা 'মহাবিশ্বের বিশালতার সম্প্রসারণ সৃষ্টিকে বুঝায় ।
সর্বশ্রেষ্ঠ জ্যোতিপদার্থবিদদের মধ্যে অন্যতম বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং (Stephen Hawking) তাঁর 'সময়ের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস' (A Brief History of Time) নামক পুস্তকে উল্লেখ করেছেন: “মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হচ্ছে” -এ আবিষ্কারটি বিংশ শতাব্দী মহান বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লবগুলোর অন্যতম । আল-কুরআনে মহাবিশ্বের এই সম্প্রসারণশীলতার উল্লেখ রয়েছে বহুপূর্বেই, এমনকি মানুষের টেলিস্কোপ তৈরীর জ্ঞান আহরণের অনেক পূর্বে!
কেউ কেউ হয়ত বলতে পারেন কুরআনে জ্যোতির্বিজ্ঞানের সঠিক তথ্য ও ঘটনার উল্লেখ বিস্ময়কর কিছু নয়। কারণ- তৎকালীন আরবগণ জ্যোতির্বিদ্যায় যথেষ্ট অগ্রগামী ছিলেন। তখন তারা জ্যোতির্বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আরবদের এই অগ্রসরতার স্বীকৃতি দিয়ে সঠিক কাজই করেছেন। তবে আরবদের জ্যোতির্বিদ্যায় পারদর্শিতা অর্জনের বহু শতাব্দী পূর্বে যে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছিল তারা সে সত্য উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছেন। অধিকন্তু জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কিত সঠিক বৈজ্ঞানিক তথ্য ও ঘটনা যেমন মহাবিস্ফোরণ (Big Bang) সহ মহাবিশ্বের সূচনা উৎপত্তি যা উপরে উল্লেখ করা হয়েছে, বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আরবগণ অগ্রসরতার উচ্চশিখরে অবস্থান করা সত্ত্বেও এগুলো তারা মোটেও জানতেন না । সুতরাং কুরআনে বর্ণিত বৈজ্ঞানিক তথ্য ও ঘটনা জ্যোতির্বিদ্যায় আরবদের পারদর্শিতা ও অগ্রগামিতার ফসল নয়। আসলে এর উল্টোটাই বরং সঠিক ও যথার্থ। জ্যোতির্বিজ্ঞান কুরআনে একটি স্থান দখল করার কারণেই আরবগণ জ্যোতির্বিদ্যায় অগ্রগতি লাভ করেছিলেন।
২. পদার্থ বিদ্যা (Physics)
❑ পরমাণুর কণিকাসমূহের অস্তিত্ব
প্রাচীনকালে ‘পরমাণুবাদ তত্ত্ব' নামে একটি সুপরিচিত তত্ত্ব ব্যাপকভাবে স্বীকৃত ছিলো। সর্বপ্রথম এ তত্ত্ব উত্থাপন করেন গ্রীক বিজ্ঞানীগণ, বিশেষ করে ডেমোক্রিটাস (Democritus) নামে এক পণ্ডিত যিনি ২৩ শতবর্ষ (২৩০০ বছর) পূর্বে বাস করতেন। ডেমোক্রিটাস ও তাঁর পরবর্তী লোকেরা ধারণা করতেন পদার্থের ক্ষুদ্রতম অংশই পরমাণু । প্রাচীন আরবগণও এই ধারণা পোষণ করতেন । আরবী শব্দ ‘জাররাহ' সাধারণত পরমাণুকেই বুঝায়। সাম্প্রতিক সময়ে আধুনিক বিজ্ঞান আবিষ্কার করেছে যে, পরমাণুকে বিভক্ত করা সম্ভব। ‘পরমাণুকে যে আরো ভাঙ্গা যায়' এ তত্ত্বটি বিংশ শতাব্দীর আবিষ্কার। ১৪০০ বছর পূর্বে এ ধারণাটি অস্বাভাবিক বলে মনে হতো এমনকি একজন আরবের নিকটও। তার নিকট ‘জাররাহ' এর অর্থ ছিলো ‘ঐ সীমা যার বাইরে কেউ যেতে পারে না।' নিম্নে কুরআনের আয়াতটি এই সীমা স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে ।
وَقَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا لَا تَأْتِينَا السَّاعَةُ. قُلْ بَلَى وَرَبِّي لَتَأْتِيَنَّكُمْ. علِم الْغَيْبِ لَا يَعْزُبُ عَنْهُ مِثْقَالُ ذَرَّةٍ فِي السَّمَوتِ وَلَا فِي الْأَرْضِ وَ لَا أَصْغَرُ مِنْ ذَلِكَ وَلَا أَكْبَرُ الا في كتب مُّبِين.
অবিশ্বাসীরা বলে: আমাদের নিকট কিয়ামত আসবে না। (হে নবী) তুমি বল: কেন আসবে না? আমার প্রতিপালকের শপথ অবশ্যই তা তোমাদের উপর আসবেই। শপথ তাঁর যিনি অদৃশ্য সম্বন্ধে সম্যক পরিজ্ঞাত, আকাশমণ্ডলে ও পৃথিবীতে পরমাণু পরিমাণ কিছু কিংবা তদপেক্ষা ক্ষুদ্র অথবা বৃহৎ কিছু তাঁর নিকট থেকে লুকিয়ে নেই তবে সকল কিছুই এক সুস্পষ্ট কিতাবে (লিপিবদ্ধ) আছে। (আল-কুরআন-৩৪:৩)
অনুরূপ পয়গাম কুরআনে ১০:৬১ স্থানে আছে।
এই আয়াতটি আল্লাহর সর্বজ্ঞতা, প্রকাশ্য বা গোপন সকল বস্তু সম্পর্কে তাঁর জ্ঞানের কথা উল্লেখ করেছে। এ আয়াতটি আরো অগ্রসর হয়ে প্রকাশ করেছে যে, পরমাণু অপেক্ষা বৃহত্তর বা ক্ষুদ্রতর সকল কিছু সম্পর্কে আল্লাহ সম্পূর্ণরূপে পরিজ্ঞাত । সুতরাং এ আয়াত হতে সুস্পষ্টরূপে প্রতিভাত হয় যে, পরমাণু হতে ক্ষুদ্রতর কোন কিছু বিদ্যমান থাকা সম্ভব অথচ এ সত্য অতি সম্প্রতি উদ্ঘাটন করেছে আধুনিক বিজ্ঞান ।
৩. ভূগোল (Geography)
❑ পানি চক্র:
বার্নাড পালিসি (Bernard Palissy) হলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি ১৫৮০ খৃষ্টাব্দে পানি চক্রের বর্তমান কালের ধারণা বর্ণনা করেছিলেন। তিনি বর্ণনা করেছিলেন সমুদ্র হতে পানি কিভাবে বাষ্পীভূত হয় এবং পরে শীতল হয়ে মেঘে পরিণত হয়। এই মেঘমালা দূরবর্তী স্থানে গমন করে উপরে উঠে পরে ঘনীভূত হয়ে বৃষ্টির আকারে পতিত হয়। এই পানি নদী নালা, খাল বিল, হ্রদ রূপে জমা হয় এবং প্রবাহিত হয়ে একটি নিরবচ্ছিন্ন চক্রে পুনরায় মহাসাগরের ফিরে আসে।
খৃস্টপূর্ব ৭ম শতাব্দীতে মিলিটাসের থ্যালেস (Thales of Miletus) বিশ্বাস করতেন যে, সাগরের উপরিভাগে ছিটানো পানির সূক্ষ্ম পানি কণাগুলোকে বাতাস সংগ্রহ করে বয়ে নিয়ে যায় দূরবর্তী স্থানে বৃষ্টিরূপে ফেলার জন্য। আদিকালে মানুষ ভূগর্ভস্থ পানির উৎস সম্পর্কে জানত না। তারা মনে করত মহাসাগরের পানিকে বাতাস বিভিন্ন মহাদেশের অভ্যন্তরে প্রবলভাবে ঠেলে দেয়। তারা আরো বিশ্বাস করত যে, এ পানি ফিরে আসে কোন গোপন পথে দিয়ে, অথবা অতল গহ্বর দিয়ে। এই পথটি মহাসাগরের সাথে সংযুক্ত এবং প্লেটোর সময় হতে এটাকে টার্টারাস (Tartarus) বলা হত। এমনকি ১৮ শতাব্দীর বিখ্যাত চিন্তাবিদ ডেসকার্টেস (Descartes) এ অভিমতই পোষণ করতেন। ১৯ শতাব্দী পর্যন্ত এ্যারিস্টোটল এর (Aristotle's) তত্ত্ব বহুল প্রচলিত ছিলো। এই তত্ত্বানুযায়ী পাহাড়ের বিশাল বিশাল ঠাণ্ডা গুহায় পানি ঘনীভূত এবং ভূগর্ভে অনেক হ্রদ সৃষ্টি হয়। এই হ্রদগুলো ঝর্ণাগুলোকে পানি সরবরাহ করে। আজ আমরা জানতে পেরেছি যে, মাটির ফাটল দিয়ে বৃষ্টির পানি চুয়ে অভ্যন্তরে প্রবেশ করার কারণে এরূপ অবস্থার সৃষ্টি হয়ে থাকে । আল-কুরআনে পানি চক্রের বর্ণনা নিম্নের আয়াতগুলোতে পাওয়া যায় ।
أَلَمْ تَرَ أَنَّ اللَّهَ أَنْزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَسَلَكَهُ يَنَابِيْعَ فِي الْأَرْضِ ثُمَّ يُخْرِجُ بِهِ زَرْعًا مُّخْتَلِفًا أَلْوَانُهُ.
“তুমি কি লক্ষ্য করনি যে, আল্লাহ আকাশ হতে পানি বর্ষণ করেন, তারপর তিনি তা প্রবেশ করান ধরনির প্রসবণসমূহের মধ্যে এবং তদ্বারা নানা বর্ণের ফসল উৎপন্ন করেন।” (আল-কুরআন-৩৯:২১)
بِهِ الْأَرْضَ بَعْدَ مَوْتِهَا إِنَّ فِي ويُنَزِّلُ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَيُحى به ذلك لايت لِّقَوْمٍ يَعْقِلُونَ.
“আর তিনি আকাশ হতে পানি বর্ষণ করেন এবং তদ্বারা ভূমিকে তার মৃত্যুর পর পুনর্জীবিত করেন। অবশ্যই এতে রয়েছে নিদর্শন ঐসব লোকদের জন্য যারা বোধশক্তিসম্পন্ন।” (আল-কুরআন-৩০:২৪)
وَأَنْزَلْنَا مِنَ السَّمَاءِ مَاءً بِقَدَرٍ فَأَسْكَتْهُ فِي الْأَرْضِ وَإِنَّا عَلَى ذَهَابِ بِهِ لَقَدِرُونَ.
“আর আমি আকাশ হতে পানি বর্ষণ করি পরিমাণ মতো অতঃপর আমি তা জমিনে মাটিতে সংরক্ষণ করি। আমি উহাকে অপসারিত করতেও সক্ষম (অতি সহজেই)।” (আল-কুরআন-২৩ : ১৮)
আজ থেকে ১৪০০ বছর পূর্বে বিশ্বে কোন পুস্তকে পানি চক্রের এমন নির্ভুল বর্ণনা দেয়নি।
❑ বাষ্পীয়ভবন১
কুরআনের নিম্নলিখিত আয়াতে বাষ্পীয়ভবনের ইঙ্গিত ।
وَالسَّمَاء ذَاتِ الرَّجْع.
“আর শপথ আকাশমণ্ডলীর যা বার বার বৃষ্টি বর্ষণ করে।” (আল-কুরআন-৮৬:১১)
[“রাজঈ' শব্দের আভিধানিক অর্থ 'ফিরে আসা' বা 'প্রত্যাবর্তন করা', ব্যবহারিক অর্থ 'বৃষ্টিপাত'। সূর্যের তাপে সমুদ্রের পানি বাষ্পে রূপান্তরিত হয়, এরপরে ঘনীভূত হয়ে মেঘ হয়। তারপর বৃষ্টিরূপে ধরনীতে ফিরে আসে। বর্ষা ছাড়া প্রায় সকল ঋতুতে একাধিকবার বৃষ্টি হয় এবং বর্ষাকালে বৃষ্টিপাত হয় বার বার। তাই আকাশের বার বার বৃষ্টি বর্ষণের পশ্চাতে বাষ্পীয় ভবনের ঘটনা বিদ্যমান রয়েছে ।] (অনুবাদক)
______________
১. বায়ু সহযোগে সাধারণ উষ্ণতায়, তাপ সহযোগে উচ্চতর উষ্ণতায় কোন তরলকে তার বাষ্পে পরিণত করার প্রক্রিয়াকে বাষ্পীয় ভবন বলে। [অনুবাদক]
❑ বায়ু মেঘমালাকে নিষিক্ত করে:
আল-কুরআনে আল্লাহ বলেন-
وَاَرْسَلْنَا الرِّيحَ لَوَاقِحَ فَأَنْزَلْنَا مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَاسْقَيْنكُمُوْهُ.
“আর আমি বৃষ্টি-গর্ভ বায়ু প্রেরণকারি, তারপর আমি আকাশ হতে বৃষ্টি বর্ষণ করি এবং তা তোমাদেরকে পান করতে দেই (প্রচুর পরিমাণে) । (আর কুরআন-১৫:২২)
এখানে যে আরবী শব্দ 'লাওয়াকিহ্' ব্যবহার করা হয়েছে এটা হল 'লাকাহা’ হতে ‘লাকিহ' এর বহুবচন যার অর্থ হলো- 'ফলবতীকরণ' বা গর্ভবতীকরণ । কিন্তু এই পটভূমিকায় গর্ভবতী বা ফলবতী করার অর্থ হল যে, বায়ু মেঘগুলোকে ধাক্কা দিয়ে একত্র করে ঘনীভবন বাড়িয়ে তোলে যার ফলে সৃষ্টি হয় বিদ্যুৎ চমক এবং বৃষ্টি । অনুরূপ একটি বর্ণনা কুরআনের নিম্নে আয়াতগুলোতে রয়েছে:
أَلَمْ تَرَ أَنَّ اللَّهَ يُزْجِي سَحَابًا ثُمَّ يُؤَلِّفُ بَيْنَهُ ثُمَّ يَجْعَلُهُ رُكَامًا فَتَرَى الْوَدْقَ يَخْرُجُ مِنْ خِلْلِهِ. وَيُنَزِّلُ مِنَ السَّمَاءِ مِنْ جِبَال فيهَا مِنْ بَرَد فَيُصِيبُ بِهِ مَنْ يُشَاءُ وَيَصْرِفُهُ عَنْ مَنْ يَشَاءُ يَكَادُ سَنَا بَرْقِهِ يَذْهَبُ بِالْأَبْصَارِ .
“তুমি কি লক্ষ্য করনি, আল্লাহ মেঘমালাকে ধীরে ধীরে সঞ্চালিত করেন এরপর তাদেরকে একত্র করেন এবং পরে তা পুঞ্জীভূত করেন একটি স্তূপে। অতঃপর তুমি দেখতে পাও এর মধ্য হতে নির্গত হয় বৃষ্টি ধারা। আর তিনি আকাশস্থিত পাহাড়সদৃশ মেঘমালা থেকে বর্ষণ করেন শিলা এবং তা দিয়ে তিনি যাকে ইচ্ছা আঘাত করেন ও যাকে ইচ্ছা তার উপর হতে দূরে ফিরিয়ে দেন। মেঘের বিদ্যুৎ ঝলক এমন যেন চোখের দৃষ্টিশক্তিকে প্রায় কেড়ে নেয়।” (আল-কুরআন-২৪: ৪৩)
الله الَّذِي يُرْسِلُ الرِّيحَ فَتُثيرُ سَحَابًا فَيَبْسُهُ في السَّمَاءِ كَيْفَ يَشَاءُ وَيَجْعَلُه كِسَفًا فَتَرَى الْوَدْقَ يَخْرُجُ مِنْ خِلْلِهِ فَإِذَا أصَابَ بِهِ مَنْ يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ إِذَا هُمْ يَسْتَبْشِرُونَ.
“আল্লাহ, যিনি বায়ু প্রেরণ করেন, ফলে বায়ু মেঘরাশিকে সঞ্চালিত করে, এরপর তিনি মেঘমালাকে যেমন ইচ্ছা আকাশে ছড়িয়ে দেন, তা খণ্ড বিখণ্ড করেন, অতঃপর তুমি দেখতে পাও তার মধ্য হতে নির্গত হয় বৃষ্টি ধারা পরে যখন তিনি তার বান্দাদের মধ্যে যাদেরকে ইচ্ছা তা পৌঁছিয়ে দেন, তখন তারা হয় আনন্দিত।” (আল-কুরআন-৩০: ৪৮)
কুরআনের বর্ণনাগুলো সম্পূর্ণরূপে সঠিক এবং পানি বিজ্ঞানের আধুনিক উপাত্তের সাথে নিখুঁতভাবে মিলে যায়। মহিমান্বিত কুরআনের বহু স্থানে পানি চক্রের বর্ণনা রয়েছে- ৩: ৯, ৭:৫৭, ১৩:১৭, ২৫:৪৮-৪৯, ৩৬:৩৪, ৫০:৯-১১, ৫৬:৮৬-৭০, ৬৭:৩০ এবং ৮৬:১১।
৪. ভূতত্ত্ববিদ্যা (Geology)
❑ পর্বতগুলো তাঁবুর কীলক বা পেরেকের মত
ভূতত্ত্ব বিজ্ঞানে ভাঁজকরণ প্রতিভাসটি অধূনা আবিষ্কৃত সত্য। ভাঁজকরণ' প্ৰক্ৰিয়া পবর্তমালা বা শ্রেণী গঠনের জন্য দায়ী। ভূপৃষ্ঠের কঠিন আবরণটি (Lithosphere) যার উপরে আমরা বাস করি, সেটা একটি কঠিন খোসার মত, পক্ষান্তরে এর গভীর স্তরগুলো গরম এবং গ্যাসীয় ও তরল (fluid) এবং তাই এগুলো যে কোন রকম জীবের জীবন ধারণের জন্য অনোপযোগী । এটাও আমরা জানি যে, পর্বতের দৃঢ় ও সুস্থিত অবস্থা ভাঁজকরণ ঘটনার সাথে গভীরভাবে জড়িত । কারণ ভূপৃষ্ঠে যে ভাঁজগুলো ছিল, সেই ভাঁজগুলোই স্তরসমূহকে যোগান দিয়েছিল মজবুত ভিত্তি। আর এই স্তরসমূহ পবর্ত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।
ভূতত্ত্ববিদগণ আমাদেরকে বলেন যে, পৃথিবীর ব্যাসার্ধও প্রায় ৩৭৫০ মাইল বা ৬,০৩৫ কিলোমিটার এবং পৃথিবীর উপরিভাগের কঠিন আবরণ যার উপর আমরা বাস করি এটা খুবই পাতলা এর পুরুত্ব ১ থেকে ৩০ মাইল এর মধ্যে। যেহেতু কঠিন আবরণটি পাতলা, তাই এর কম্পনের সম্ভাবনাটা বেশি। পবর্তগুলো পেরেক বা তাঁবুর কীলকের মত কাজ করে ও ভূপৃষ্ঠের এই কঠিন আবরণটিকে ধরে রাখে এবং তাকে দেয় সুস্থিতি । কুরআনে হুবহু এরূপ বর্ণনাই রয়েছে ।
“আমি কি পৃথিবীকে বিস্তীর্ণ বিছানাস্বরূপ এবং পবর্তসমূহকে কীলকস্বরূপ সৃষ্টি করিনি?” (আল কুরআন ৭৮:৬-৭)
‘আওতাদ' শব্দটির অর্থ খুঁটি বা কীলক (ঐগুলোর মত যা ব্যবহার করা হয় তাঁবু খাটাতে) এগুলো হল ভূতাত্ত্বিক ভাঁজসমূহের (Geologecal folds) এর গভীর ভিত্তি।
'পৃথিবী' (Earth) নামক একটি বই বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের বুনিয়াদি reference পাঠ্য পুস্তক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পুস্তিকাটির অন্যতম লেখক ছিলেন ড. ফ্রাঙ্কপ্রেস (Dr. Frank Press), যিনি ছিলেন ১২ বছর ধরে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞান একাডেমীর প্রেসিডেন্ট এবং ছিলেন আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার (Jimmy Carter) এর বিজ্ঞান উপদেষ্টা। এই পুস্তকে তিনি চিত্র ও উপমাসহকারে বর্ণনা করেছেন যে, পর্বত কীলকাকৃতির; পর্বত নিজেই পুরোটার একটি ক্ষুদ্র অংশ যার মূল মাটির গভীরে সুদৃঢ়ভাবে প্রোথিত।২ ড. প্রেসের মতে পর্বতসমূহ ভূপৃষ্ঠের কঠিন আবরণটিকে স্থিতিশীল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পৃথিবীর কম্পন রোধে পর্বতসমূহের কার্যক্রম সম্পর্কে আল-কুরআন সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে।
وَجَعَلْنَا فِي الْأَرْضِ رَوَاسِى أَنْ تَمِيدَبِهِمْ من وَجَعَلْنَا فِيهَا فجاجًا سُبُلًا لَّعَلَّهُمْ يَهْتَدُونَ.
আমি পৃথিবীতে সৃষ্টি করেছি সুদৃঢ় পর্বতমালা যাতে পৃথিবী তাদেরকে নিয়ে এদিক ওদিক ঢলে না যায় । (আল-কুরআন-২১ : ৩১)
অনুরূপ বর্ণনা কুরআনের ১৬ : ১৫ ও ৩১ : ১০ স্থানে আছে। তাই দেখা যায় পর্বতসমূহের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে মহামান্বিত কুরআনে যেসব বর্ণনা রয়েছে ভূতত্ত্ব বিজ্ঞানের সাম্প্রতিক আবিষ্কারের সাথে পুরাপুরিই সামঞ্জস্যপূর্ণ।
___________
১. স্তরীভূত শিলার ঊর্ধ্বমুখী বা নিম্নমুখী গমনের ফলে সৃষ্ট অবস্থাকে ভাঁজ বলে। এই ভাঁজ পাললিক শিলায় অধিক হলেও আগ্নেয় শিলা বা রূপান্তরিত শিলার অনেক ভাঁজ পৃথিবীতে দেখা যায়। আকৃতিতে ভাঁজ কয়েক মিলিমিটার থেকে কয়েক শত কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। [অনুবাদক]
২. 'Earth', Press and Stever, P. 435. Also see Earth Science, Trsbuck and luthens; P. 157.
❑ পর্বতসমূহ সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত
ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগ বহু শক্ত স্তর মজবুত প্লেট২ বা পাতে (Plates) বিভক্ত যেগুলোর পুরুত্ব হল প্রায় ১০০ কিলোমিটার। এই পাত বা প্লেটগুলো আংশিক গলিত অঞ্চলে ভাসমান অবস্থায় থাকে। এই আংশিক গলিত অঞ্চলকে এসথেনোস্ফিয়ার (Aesthenosphere) বলে ।১
পর্বত গড়া শুরু হয় পাত বা প্লেটগুলোর প্রান্তসীমায়। পৃথিবীর কঠিন আবরণ (ভূত্বক) ৫ কিলোমিটার মোটা বা পুরু মহাসাগরের নিচে, প্রায় ৩৫ কিলোমিটার মোটা সমতল মহাদেশীয় পৃষ্ঠাদেশগুলোর নিচে এবং প্রায় ৮০ কিলোমিটার মোটা বিশাল পর্বতমালার নিচে। এগুলো হল মজবুত ভিত্তি যার উপর পর্বতগুলো দাঁড়িয়ে আছে । কুরআনও পর্বতসমূহের শক্ত ভিত্তি সম্পর্কে বলে ।
وَالْجِبَالَ أرسها.
“আর তিনি পর্বতগুলোকে সুদৃঢ়ভাবে স্থাপন করেছেন।” (আল-কুরআন-৭৯ : ৩২)
অনুরূপ বক্তব্য কুরআনের ১৬ : ১৫, ৩১ : ১০ ও ৮৮ : ১৯ স্থানে উল্লেখ আছে।
--------------
১-২. পৃথিবীর শক্ত বহিরাবরণকে অশ্বমণ্ডল (Lithosphere) বলে। এর অংশ হচ্ছে প্লেট। অশ্বমণ্ডলের গভীরতা ১০০ কিলোমিটার। এই কঠিন অশ্বমণ্ডলের নিচের স্তরকে অ্যাসথেনোস্ফিয়ার (Aesthenosphere) বলে। এই স্তরের গভীরতা ১৫০ কিলোমিটার I অতিরিক্ত তাপ ও চাপে এই স্তর কঠিন নয় বরং নমনীয়রূপে বিরাজমান । [অনুবাদক]
৫. সমুদ্র বিদ্যা (Oceanology)
❑ সুপেয়, মিষ্টি পানি এবং লবনাক্ত, খর পানির মধ্যে পর্দা বা অন্তরাল
কুরআনের নিম্নলিখিত আয়াতটি বিবেচনা করুন ।
مَرَجَ الْبَحْرَينِ يَلْتَقِينِ. بَيْنَهُمَا بَرْزَخٌ لا يَبْغِينِ
“তিনি দুটি সমুদ্রকে বহমান করেছেন, যারা একে অপরের সাথে মিলিত হয়। কিন্তু উহাদের মধ্যে রয়েছে এক পর্দা বা অন্তরাল যা তারা অতিক্রম করতে পারে না।” (আল-কুরআন-৫৫:১৯-২০)
আরবী শব্দ 'বারজাখ' এর অর্থ হল অন্তরাল, পর্দা, আড়াল বা প্রাচীর । কিন্তু অন্তরাল, পর্দা বা প্রাচীর বলতে আমরা সাধারণত: যা বুঝে থাকি সেরূপ এটা কোন স্বাভাবিক বাহ্য পর্দা বা প্রাচীর বা অন্তরাল নয় ।
আরবী শব্দ ‘মারাজা’-এর আক্ষরিক অর্থ হল তারা উভয়ে মিলিত হয় এবং একে অপরের সাথে মিশে যায় ।
কুরআনের প্রাচীন ভাষ্যকারগণ দু'টি সমুদ্রের পানির জন্য দু'টি বিপরীতমুখী অর্থ অর্থাৎ দু'টির পানির ধারা পরস্পর মিলিত হয় এবং মিশে যায় অথচ একই সময়ে তাদের উভয়ের মাঝে রয়েছে অন্তরাল বা পর্দা-এর ব্যাখ্যা প্রদানে সক্ষম হন না। আধুনিক বিজ্ঞান আবিষ্কার করেছে, যেসব স্থানে দু'টি ভিন্ন সাগর এসে মিলিত হয় তথায় উভয়ের মধ্যে থাকে পর্দা বা অন্তরাল। এই পর্দাটি দু'টি সাগরকে এমনভাবে পৃথক করে দেয় যে, যাতে করে প্রতিটি সাগর তার নিজস্ব তাপমাত্রা, লবনাক্ততা এবং ঘনত্ব অক্ষুণ্ণ রাখে। ১ সাগর বিদ্যার বিশারদগণ বর্তমানে এ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রদানের ক্ষেত্রে উত্তম অবস্থানে রয়েছেন। দু'টি সাগরের মধ্যে রয়েছে ঢালু অদৃশ্য পানির পর্দা যার মধ্যদিয়ে পানি এক সাগর হতে অন্য সাগরে যায়।
কিন্তু যখন এক সাগরে পানি অন্য সাগরে প্রবেশ করে তখন তার নিজস্ব পার্থক্যসূচক বৈশিষ্ট্য হারায় এবং অন্য পানির সাথে মিশে সমসত্ত্ব দ্রবণে পরিণত হয় ।
এভাবে এই পর্দা বা অন্তরালটি দু'টি পানির জন্য একটি ‘পরিবর্তনমূলক সমপ্রকৃতিকরণ’ অঞ্চল হিসেবে কাজ করে।
এই বৈজ্ঞানিক ঘটনা বা প্রতিভাস যা কুরআনে উল্লেখিত হয়েছে ড. উইলিয়াম হে (Dr. Willium Hay) যিনি একজন বহুল পরিচিত সমুদ্র বিজ্ঞানী এবং আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ববিষয়ক বিজ্ঞানের অধ্যাপক, তিনি কুরআনে উল্লেখিত এই বৈজ্ঞানিক ঘটনাগুলোকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন । এরূপ ঘটনা উল্লেখ রয়েছে কুরআনের নিম্নবর্ণিত আয়াতে-
وَجَعَلَ بَيْنَ الْبَحْرَيْنِ حَاجِرًا.
“এবং তিনি সৃষ্টি করেছেন বহমান দু'টি সাগরের মধ্যে অন্তরায় বা পর্দা।” (আল-কুরআন-২৭:৬১)
এই প্রতিভাস বা ঘটনা (অন্তরাল বা পর্দা সৃষ্টির ঘটনা) বহু স্থানেই ঘটে । ভূমধ্যসাগর ও আটলান্টিক মহাসাগরের মিলন স্থলে জিব্রাল্টার প্রণালীতে বিরাজমান বিভাজকসহ অনেক পর্দা বা অন্তরায় বহু স্থানেই দেয়া যায়। একটি সাদা অন্তরাল বা পর্দা পরিষ্কারভাবে দেখা যায় Cape Point এ, Cape Peninsula এ এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় যেখানে আটলান্টিক মহাসাগর ভারত মহাসাগরের সাথে মিলিত হয়েছে।
কিন্তু যখন কুরআন সুপেয় পানি ও লবণাক্ত পানির মধ্যে অন্তরাল/বিভাজক সম্পর্কে বলে তখন এই অন্তরালসহ ‘একটি নিবৃত্তিকরণ পর্দা বা দুর্ভেদ্য অন্তরালের' উপস্থিতির কথা উল্লেখ করে ।
আল্লাহ বলেন:
وَهُوَ الَّذِي مَرَجَ الْبَحْرَيْنِ هَذَا عَذْبٌ فُرَاتٌ وَهُذَا مِلْحٌ أُجَاج وَجَعَلَ بَيْنَهُمَا بَرْزَخًا وَحَجْرًا مَّحْجُورًا.
“তিনিই দুই সাগরকে সমান্তরালে প্রবাহিত করেন। এর একটি সুপেয়, মিষ্টি অপরটি লবনাক্ত, খর এবং উভয়ের মধ্যে তিনি রেখেছেন একটি পর্দা, দুর্ভেদ্য অন্তরাল যা এ দুটোকে মিশে যেতে দেয় না।” (আল-কুরআন- ২৫:৫৩)
আধুনিক বিজ্ঞান আবিষ্কার করেছে যে, মোহনাসমূহে যেখানে সুপেয়, (মিষ্টি) পানি এবং লবনাক্ত (খর) পানি মিলিত হয়, এখানকার অবস্থাটা, দু'টি লবনাক্ত পানির সাগর যেখানে মিলিত হয়, সেখানকার অবস্থা হতে কিছুটা ভিন্ন প্রকৃতির হয়ে থাকে । মোহনাসমূহে যা মিঠা বা সুপেয় পানিকে লবনাক্ত পানি হতে পৃথক করে সেটা আবিষ্কৃত হয়েছে। সেটা হল Pycnocline zone বা অঞ্চল যার চিহ্নিত ঘনত্ব ধারাবাহিকতাহীনভাবে দু'টি স্তরকে২ পৃথক করে থাকে। এই পর্দা বা অন্তরালটির (বিভাজন অঞ্চলের) রয়েছে এমন লবনাক্ততা যা সুপেয় পানি ও লবনাক্ত পানি৩ এই উভয় প্রকার পানির লবনাক্ততা হতে আলাদা ।
নীল-নদ প্রবাহিত হয়ে ভূমধ্যসাগরের যেখানে পড়েছে মিশরের সেই স্থানসহ অন্যান্য অনেক স্থানে এই বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে থাকে ।
____________
১. Principles of Occanography, Davis, pp. 92-93
২. Oceanography, Gross, P. 242. Also see Introductory Oceanography, Thurman, PP. 300-301
৩. Oceanography, Gross, P. 244 and Introductory Oceanography, Thurman, PP. 300-301.
❑ মহাসাগরের গভীরে অন্ধকার
সামুদ্রিক ভূতত্ত্ববিদ্যায় বিশ্ব বিখ্যাত বিশেষজ্ঞ ও জেদ্দার বাদশাহ আবদুল আজীজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক দুর্গারাওকে কুরআনের নিম্নলিখিত আয়াতের উপর তাঁর মতামত জানতে চাওয়া হয়-
أوْ كَظلمت فِى بَحْرٍ لُجِّى يُغْشَهُ مَوْجٌ مِنْ فَوْقِهِ مَوْجٌ مِنْ فَوْقِهِ سَحَابٌ، ظلمت بَعْضُهَا فَوْقَ بَعْضٍ إِذا أَخْرَجَ يَدَهُ لَمْ يَكُدْ
يَرهَا . وَمَنْ لَّمْ يَجْعَلِ اللَّهُ لَهُ نُورًا فَمَالَهُ مِنْ نُّور
“অথবা (অবিশ্বাসীদের অবস্থা) এর উপমা এমন, যেমন এক বিশাল গভীর সমুদ্রের তলের অন্ধকার, উপরে একটি তরঙ্গ ছেয়ে আছে তার উপর আরও একটি তরঙ্গ এবং এর উপরে ঘনকালো মেঘমালা। অন্ধকারের উপর অন্ধকার ছেয়ে আছে। এমনকি কেউ যদি তার হাত বের করে তবে সে তা আদৌ দেখতে পাবে না। আল্লাহ যাকে আলো দেন না তার জন্য আর কোন আলো নেই।” (আল-কুরআন-২৪:৪০)
অধ্যাপক রাও বলেন যে, বিজ্ঞানীগণ কেবলমাত্র বর্তমানে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে মহাসাগরের গভীরে যে অন্ধকার বিরাজ করছে এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন । কোনরূপ সাহায্য ছাড়া মানুষ পানির নিচে ২০ হতে ৩০ মিটার অধিক গভীরে ডুব দিতে সক্ষম নয় এবং মহাসাগরীয় অঞ্চলের ২০০ মিটার অধিক গভীরে মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না। কুরআনের এই আয়াত সকল সাগরের কথা উল্লেখ করে না। কারণ প্রতিটি সাগর অন্ধকার স্তরে স্তরে পুঞ্জিভূত করে রাখে না। এ আয়াত বিশেষভাবে গভীর সাগর বা গভীর মহাসাগরের কথাই উল্লেখ করেছে। যেহেতু কুরআন বলে বিশাল গভীর মহাসাগরের মধ্যে অন্ধকার ।' গভীর মহাসাগরে এই স্তরে স্তরে অন্ধকার সৃষ্টি ২টি কারণে হয়ে থাকে :
(১) আলোক রশ্মি ৭টি রং এর সমন্বয়ে গঠিত। এ সাতটি রং হল বেগুনী, নীল, আসমানী, সবুজ, হলুদ, কমলা ও লাল (বেনীআসহকলা)। আলোক রশ্মি যখন পানিতে আপতিত হয় তখন প্রতিসরণ সংঘটিত হয়ে থাকে। পানির উপরিভাগের ১০ হতে ১৫ মিটার গভীরে পানি লাল রংকে শোষণ করে। তাই একজন ডুবরী ২৫ মিটার গভীরে যদি যান এবং আঘাতপ্রাপ্ত হন তাহলে তিনি তার রক্তের লাল রং দেখতে সক্ষম হবেন না। কারণ লাল রংটি এই গভীরতায় পৌছতে পারে না । অনুরূপভাবে কমলা রং ৩০ হতে ৫০ মিটার, হলুদ ৫০ হতে ১০০ মিটার, সবুজ ১০০ হতে ২০০ মিটার, নীল ২০০ মিটার ছাড়িয়ে এবং সর্বশেষ আসমানী ও বেগুনী ২০০ মিটারের অধিক গভীর পানিতে শোষিত হয়। এক স্তরের পর অন্য স্তরে ক্রমাগতভাবে রংসমূহের অন্তর্ধান মহাসাগর ক্রমবর্ধমান হারে অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে থাকে- অর্থাৎ আলোর স্তরে স্তরে অন্ধকার সৃষ্টি হতে থাকে । ১০০০ মিটার গভীর নীচে পরিপূর্ণ অন্ধকার বিরাজ করে।১
(২) সূর্যের রশ্মি মেঘমালার দ্বারা শোষিত হয় যাতে আলোক রশ্মিগুলো বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। ফলে মেঘমালার নীচে সৃষ্টি হয় এক অন্ধকার স্তর। এটাই হল অন্ধকারের প্রথম স্তর । আবার যখন আলোক রশ্মিসমূহ মহাসাগরের পৃষ্ঠদেশে পৌঁছায় তখন এগুলো ঢেউ এর উপরিতল কর্তৃক প্রতিফলিত হয়, ফলে ঢেউ এর উপরিতল দীপ্তিময় চক চকে হয়ে উঠে। সুতরাং তরঙ্গগুলোই আলোককে প্রতিফলিত করে এবং অন্ধকার সৃষ্টি করে। অপ্রতিফলিত রশ্মিগুলো পানি ভেদ করে সমুদ্রের গভীরে পৌছায়। সুতরাং মহাসাগর দু'টি অংশে বিভক্ত হয়ে যায় । একটি তার পৃষ্ঠদেশ বা উপরিভাগ যা আলো ও তাপ দ্বারা চিহ্নিত করা যায় । অন্যটি গভীর অঞ্চল যা চিহ্নিত করা যায় অন্ধকার দ্বারা। পৃষ্ঠদেশ বা উপরিভাগ আবার মহাসাগরের গভীর অঞ্চল হতে পৃথক হয়েছে তরঙ্গমালার দ্বারা ।
সাগর ও মহাসাগরের গভীর অঞ্চলের পানিকে ঢেকে রেখেছে আভ্যন্তরীণ তরঙ্গমালা। কারণ গভীর অংশের পানির ঘনত্ব তার উপরিভাগের পানির ঘনত্ব হতে অধিক ।
আভ্যন্তরীণ তরঙ্গমালার নিম্ন হতেই অন্ধকার শুরু হয়। এমনকি মাছেরাও সাগর মহাসাগরের গভীর অঞ্চলে দেখতে পায় না। তাদের একমাত্র আলোর উৎস হল তাদের নিজেদের দেহের আলো।
আল-কুরআন এটা যথার্থভাবেই বর্ণনা করেছে-
“এক বিশাল গভীর সমুদ্রের মধ্যে অন্ধকার, উপরে একটি তরঙ্গ ছেয়ে আছে তার উপর আরও একটি তরঙ্গ।”
অন্যকথায়, এই তরঙ্গমালার উপরে রয়েছে বিভিন্ন প্রকার তরঙ্গ অর্থাৎ ঐ তরঙ্গগুলো যা দেখা যায় মহাসাগরের পৃষ্ঠদেশে বা উপরিভাগে। কুরআনের আয়াতটি আরও বলে: শীর্ষদেশে রয়েছে ঘন কালো মেঘমালা, একের উপর এক গভীর অন্ধকার ।
যেমন বর্ণনা করা হয়েছে— এই মেঘমালা একটার উপর আর একটা আড়াল বা পর্দা হিসেবে রয়েছে এবং বিভিন্ন স্তরে আলোর রং শোষণ করে অতিরিক্ত অন্ধকার সৃষ্টি করে ।
অধ্যাপক দুর্গারাও তার বক্তব্যের পরিসমাপ্তি টানেন এ কথা বলে: ১৪০০ বছর পূর্বে একজন স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে এসব বিস্ময়কর ঘটনাসমূহের এরূপ সুবিস্তারিত বর্ণনা দেয়া কোনভাবেই সম্ভব নয়। সুতরাং এ সকল তথ্য অবশ্যই কোন অতিপ্রাকৃতিক উৎস হতেই এসেছে।২ '
____________
১. Oceans, Elder and Pernetta, p.27
২. এ বক্তব্যের সূত্র: এটাই সত্য (This is The Truth) এ শিরোনামের Video tape এ Tape এর জন্য Islamic Research Foundation এর সাথে প্রয়োজনে যোগাযোগ করতে পারেন ।
৬. জীব বিজ্ঞান (Biology)
❑ প্রতিটি জীব পানি হতে সৃষ্টি হয়
কুরআনের নিম্নবর্ণিত আয়াতটি বিবেচনা করুন-
أوَلَمْ يَرَ الَّذِينَ كَفَرُوا أَنَّ السَّمَوتِ وَالْأَرْضِ كَانَتَا رَتْقًا فَفَقَتْنُهُمَا وَجَعَلْنَا مِنَ الْمَاءِ كُلَّ شَيْءٍ حَيٍّ أَفَلَا يُؤْمِنُونَ.
“অবিশ্বাসীরা কি ভেবে দেখে না যে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী (একক সৃষ্টি হিসেবে ওতপ্রোতভাবে মিশে ছিল এরপর আমি তাকে পৃথক করে দিয়েছি এবং প্রতিটি জীবিত জিনিসকে পানি হতে সৃষ্টি করেছি তবুও কি তারা ঈমান আনবে না? (আল-কুরআন-২১:৩০)
কেবলমাত্র বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার পরেই আমরা জানতে পেরেছি যে, জীব কোষের যে মৌলিক উপাদান, সাইটোপ্লাজম (Cytoplasm) তা ৮০% পানি দিয়ে তৈরী । আধুনিক গবেষণা আরও প্রকাশ করেছে যে, অধিকাংশ জীবেই ৫০% হতে ৯০% পানি আছে এবং প্রতিটি জীবন্ত সত্তারই বেঁচে থাকার জন্য পানির প্রয়োজন। সমস্ত জীবিত জিনিসই পানির দ্বারা গঠিত এ সত্যটি ১৪০০ বছর পূর্বে অনুমান করা কি কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব? অধিকন্তু মরুভূমিতে যেখানে সর্বদাই রয়েছে পানির অভাব, সেখানে এরূপ একটি অনুমানও কি কোন মানুষের পক্ষে কল্পনাসাধ্য হতে পারে?
কুরআনের নিম্নের আয়াতে পানি হতে প্রাণী সৃষ্টির উল্লেখ রয়েছে:
وَاللهُ خَلَقَ كُلَّ دَابَّةٍ مِّنْ مَّاء:
“আর আল্লাহ সমস্ত জীব সৃষ্টি করেছেন পানি হতে।” (আল-কুরআন- ২৪:৪৫)
কুরআনের নিম্নের আয়াতে পানি হতে মানুষ সৃষ্টির উল্লেখ রয়েছে:
وَهُوَ الَّذِي خَلَقَ مِنَ الْمَاءِ بَشَرًا فَجَعَلَهُ نَسَبًا وَصِهْرًا وَكَانَ رَبُّكَ قَدِيرًا.
“আর তিনিই পানি হতে মানুষ সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর এ থেকে তার বংশগত ও অপরটি বৈবাহিক সম্পর্ক- এ দুটি আত্মীয়তার ধারা সৃষ্টি করেছেন। তোমার প্রতিপালক সকল কিছুর উপর সর্বশক্তিমান।” (আল-কুরআন-২৫:৫৪)
৭. উদ্ভিদ বিজ্ঞান (Botany)
❑ উদ্ভিদ সৃষ্টি হয় জোড়ায় জোড়ায়, পুরুষ ও স্ত্রীরূপে
পূর্বেকার লোকদের এ ধারণাই ছিল না যে, উদ্ভিদেরও চিহ্নিত করণযোগ্য স্বতন্ত্র কোন পুরুষ ও স্ত্রী লিঙ্গ আছে। কিন্তু এখন উদ্ভিদ বিজ্ঞান প্রকাশ করেছে যে, প্রত্যেক উদ্ভিদের পুরুষ ও স্ত্রী লিঙ্গ আছে। এমনকি একলিঙ্গ (Unisexual) বিশিষ্ট উদ্ভিদেরও পুরুষ ও স্ত্রী- এই উভয়েরই চিহ্নিতকরণযোগ্য উপাদান রয়েছে। আল-কুরআন ঘোষণা করে:
وَاَنْزَلَ مِنَ السَّمَاء فَأَخْرَجْنَا بِهِ أَزْوَاجًا مِّنْ نَّبَات شَتَّى.
“তিনিই আকাশ হতে পানি বর্ষণ করেন এবং তা দিয়ে আমি নানা প্রকার উদ্ভিদ জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করি যা একটি অন্যটি হতে আলাদা ।” (আল-কুরআন- ২০:৫৩)
____________
১. যে ফুলে কেবলমাত্র পুং কেশর বা কেবলমাত্র গর্ভ কেশর থাকে তাকে এক লিঙ্গ ফুল (Unisexual flower) বলে। যে ফুলে শুধু পুং কেশর আছে তাকে বলা হয় পুরুষ ফুল আর যে ফুলে কেবল স্ত্রী কেশর আছে তাকে স্ত্রী ফুল বলে। লাউ, কুমড়া, ঝিঙা ইত্যাদি উদ্ভিদে একই গাছে স্ত্রী ফুল ও পুরুষ ফুল জন্মে থাকে। [অনুবাদক]
❑ ফল সৃষ্টি হয় জোড়ায় জোড়ায়, পুরুষ ও স্ত্রীরূপে
আল-কুরআনে উল্লেখ আছে-
وَمِنْ كُلِّ الثَّمَرْتِ جَعَلَ فِيهَا زَوْجَيْنِ اثْنَيْنِ
“আর তিনি প্রত্যেক প্রকারের ফল সৃষ্টি করেছেন জোড়ায় জোড়ায়, দু' দু'প্রকার।” (আল-কুরআন-১৩:৩)
উন্নত শ্রেণীর উদ্ভিদের প্রজননের সর্বশেষ সৃষ্টি হল ফল। ফলের পূর্ববর্তী অবস্থা হল ফুল যার আছে পুরুষ অঙ্গ (পুং কেশর) এবং স্ত্রী অঙ্গ (গর্ভ কেশর)। পরাগ রেণু বাহিত হয়ে ফুলে এসে পড়লে তাতে ফল ধরে। পালাক্রমে পরিপক্ক হয় এবং তার বীজ মুক্ত করে। সুতরাং সকল ফলই পুরুষ ও স্ত্রী অঙ্গের অস্তিত্ব সূচিত করে । এ সত্যই প্রকাশ করেছে আল-কুরআন ।
কিছু প্রজাতির উদ্ভিদে অনিষিক্ত ফুলেও (Parthenocarpic) ফল আসে। যেমন- কলা, কিছু নির্দিষ্ট জাতের আনারস, ডুমুর, কমলা লেবু, আঙ্গুর ইত্যাদি। তাদেরও অবশ্যই নির্দিষ্ট পরিচয়বাহী লিঙ্গ আছে।
❑ সব কিছুই সৃষ্টি হয় জোড়ায় জোড়ায়
আল-কুরআন ঘোষণা করে :
وَمِنْ كُلِّ شَيْءٍ خَلَقْنَا زَوْجَيْنِ.
“আর আমি প্রত্যেক বস্তু সৃষ্টি করেছি জোড়ায় জোড়ায়।” (আল-কুরআন-৫১:৪৯)
এই আয়াতটি সকল জিনিসেরই উপর গুরুত্ব প্রদান করেছে, এটা মানুষ, প্রাণী, উদ্ভিদ ও ফল ছাড়াও বিদ্যুতের ন্যায় অন্য কিছুকেও বুঝায়। বিদ্যুতে যেমন আছে ধনাত্মক ও ঋণাত্মক চার্জ, সেরকম প্রত্যেক বস্তুর পরমাণুতে ঋণাত্মক (negative) চার্জবাহী ইলেকট্রন ও ধনাত্মক (Positive) চার্জবাহী প্রোটন আছে।
কুরআন ঘোষণা করে:
سُبْحانَ الَّذِي خَلَقَ الْأَزْوَاجَ كُلَّهَا مِمَّا تُنْبِتُ الْأَرْضُ وَمِنْ أَنْفُسِهِمْ ومما لا يَعْلَمُونَ.
“পবিত্র ও মহান তিনি, যিনি উদ্ভিদ, মানুষ এবং ওরা যাদেরকে জানে না তাদের প্রত্যেককে সৃষ্টি করেছেন জোড়া জোড়া করে।” (আল-কুরআন-৩৬:৩৬)
এখানে কুরআন বলছে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করা হয়েছে সকল বস্তুকে ঐ সকল বস্তুসহ যেগুলোকে আজও মানুষ জানতে পারেনি, ভবিষ্যতে হয়ত সেগুলো আবিষ্কৃত হবে ।
৮. প্রাণি বিজ্ঞান (Zoology)
❑ পশু পাখি দলবদ্ধ হয়ে বাস করে
আল্লাহ বলেন :
وَمَا مَنْ دَابَّةٍ فِي الْأَرْضِ وَلَا طير يُطِيرُ بِجَنَاحَيْهِ إِلا أُمَمٌ أَمْثَالُكُمْ.
“ভূপৃষ্ঠে বিচরণশীল সকল প্রাণী এবং ডানায় ভর করে উড়ন্ত সকল পাখি ওরা সকলে তোমাদের মত এক একটি সম্প্রদায় (হিসেবে জীবন ধারণ করে)।” (আল-কুরআন-৬ : ৩৮)
গবেষণায় দেখা গেছে যে, প্রাণী ও পাখি এরা সকলেই দলবদ্ধ হয়ে বাস করে অর্থাৎ তারা সংগঠিত করে, একসঙ্গে বাস করে ও কাজ করে।
❑ পাখির উড্ডয়ন
পাখির উড্ডয়ন সম্পর্কে কুরআন বলে :
أَلَمْ يَرَوْا إِلَى الطَّيْرِ مُسَخَّرَت فِى جَوِّ السَّمَاءِ مَا
يُمْسِكُهُنَّ الدَّ اللهُ إِنَّ فِي ذَلِكَ لايت لِّقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ.
“তারা কি লক্ষ্য করেনি আকাশের শূন্য গর্ভে নিয়ন্ত্রণাধীন পক্ষীকুলের প্রতি? আল্লাহ ব্যতীত কেউ তাদেরকে ঊর্ধ্বে ধরে রাখে না। অবশ্য এতে রয়েছে নিদর্শন তাদের জন্য যারা ঈমান এনেছে। (আল-কুরআন- ১৬:৭৯)
একই ধরনের বক্তব্য নিম্নের আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে:
أَوَ لَمْ يَرَوْا إِلَى الطَّيْرِ فَوْقَهُمْ طَفْت ويَقْبِضْنَ مَا يُمْسِكُهُنَّ الا الرَّحْمَنُ إِنَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ بَصِير.
“তারা কি লক্ষ্য করে না তাদের ওপর উড়ন্ত পক্ষীকুলকে ডানা বিস্তার করতে এবং গুটিয়ে নিতে? দয়াময় ব্যতীত আর কেউই তাদেরকে ধরে রাখে না । নিশ্চয়ই তিনি সকল কিছুর প্রতি লক্ষ্য রাখেন । (আল-কুরআন-৬৭:১৯)
আরবী 'আমসাকা' শব্দটির অর্থ- 'কারো হাতের উপর রাখা', পাকড়াও করা, 'ধরে রাখা', কারো পিষ্টদেশ ধরা। এগুলো এ ধারণা প্রকাশ করে যে, আল্লাহ তার নিজস্ব ক্ষমতাবলে পাখিদেরকে ঊর্ধ্বে ধরে রাখেন। এই আয়াতগুলো ঐশী নির্দেশের উপর পাখিদের আচরণগত পরম ঘনিষ্ঠ নির্ভরতার প্রতি গুরুত্ব প্রদান করেছে। আধুনিক বৈজ্ঞানিক তথ্য উপাত্ত কিছু প্রজাতির পাখির গমনাগমনের পূর্বলেখন (programming) বিষয়ে তাদের অর্জিত উৎকর্ষতার মাত্ৰা প্ৰদৰ্শন করেছে। পাখিদের বংশীয় সংকেতে তাদের যাযাবরী বা ভ্রমণশীল আচরণের অনুক্রম প্রকাশের ক্ষমতা নিয়ে বিদ্যমান আছে; আর কেবলমাত্র এটাই পথপ্রদর্শক ও পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই একটি শিশু পাখির দীর্ঘ ও জটিল ভ্রমণ এবং নির্দিষ্ট তারিখে প্রস্থান স্থানে ফিরে আসার সক্ষমতার ব্যাখ্যা প্রদান করতে পারে ।
অধ্যাপক হাম বার্গার (Prof. Hamburger) তাঁর 'ক্ষমতা ও নশ্বরতা' (Power and Fragility) নামক পুস্তকে মাটন বার্ড (mutton bird ) এর উপমা দিয়েছেন। এ পাখির বাস হল প্রশান্ত সাগরীয় এলাকায়। ইংরেজী সংখ্যা ‘৪' এর আকারে ১৫০০০ মাইল পথ ভ্রমণ করে। এ ভ্রমণ সম্পন্ন করতে তার সময় লাগে ৬ মাস এবং প্রস্থান স্থানে ফিরে আসে (নির্দিষ্ট তারিখের সর্বাধিক এক সপ্তাহ বিলম্বে। এরূপ একটি ভ্রমণের জন্য পাখিদের স্নায়ু কোষে খুবই জটিল নির্দেশিকা অবশ্য বিদ্যমান আছে। তারা অবশ্যই অনুক্রমিত (programmed )। আমাদের কি উচিত নয় সেই পূর্ব লেখনিক (programmer) এর পরিচয় জানা?
❑ মৌমাছি ও তার নৈপুণ্য
আল্লাহ বলেন:
وَأَوْحَى رَبُّكَ إِلَى النَّحْلِ أَنِ اتَّخِذِي مِنَ الْجِبَالِ بُيُوتًا وَمِنَ الشَّجَرِ وَمِمَّا يَعْرِشُونَ. ثُمَّ كُلى منْ كُلِّ الثَّمَرَاتِ فَاسْلُكِي سُبُل ربك ذللاً.
“তোমার প্রতিপালক মৌমাছিকে মৌচাক বানানোর কৌশল শিখিয়ে মৌমাছিকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, মৌচাক বানাও পাহাড়ে, গাছে ও মানুষ যে গৃহ নির্মাণ করে তাতে। তারপর আহরণ কর সব রকম ফুলের রস এবং তোমার প্রতিপালকের প্রশস্ত সহজ পথ দক্ষতার সাথে বের করে ফেল । (আল-কুরআন-১৬:৬৮-৬৯)
ভন ফ্রিসচ (Von-Frisch) ১৯৭৩ সনে মৌমাছিদের আচরণ ও বার্তা বিনিময় ও যোগাযোগ বিষয়ে গবেষণা কর্মের জন্য নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। একটি মৌমাছি নূতন কোন বাগান বা ফুলের সন্ধান পেলে চাকে ফিরে এসে সে তার সঙ্গীদের তথায় পৌছানোর সঠিক দিক ও মানচিত্র মৌমাছি নৃত্য (Bee dance) নামে পরিচিত পদ্ধতির মাধ্যমে বলে দেয়। মৌমাছিদের এই গতিবিধির উদ্দেশ্য হল শ্রমিক মৌমাছিদের মধ্যে বার্তা প্রেরণ। মৌমাছিদের এই গতিবিধির অর্থ ও উদ্দেশ্য আলোকচিত্র ও অন্যান্য পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিকভাবে আবিষ্কৃত হয়েছে । আল-কুরআন উপরোক্ত আয়াতে উল্লেখ করেছে কিভাবে একটি মৌমাছি দক্ষতার সাথে তার প্রভুর প্রশস্ত পথ বের করে ফেলে।
শ্রমিক মৌমাছি বা সৈনিক মৌমাছি হল স্ত্রী মৌমাছি। সূরা আন নহল সূরা নং ১৬ আয়াত নং ৬৮-৬৯ তে মৌমাছির জন্য স্ত্রীলিঙ্গ ব্যবহার করা হয়েছে ('ফাসলুকি' এবং 'কুলি')। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যেসব মৌমাছি মৌচাক ছেড়ে খাদ্য সংগ্রহে বের হয় তারা স্ত্রী মৌমাছি। অন্য কথায় বলা যায় শ্রমিক মৌমাছি বা সৈনিক মৌমাছি হল স্ত্রী মৌমাছি।
বস্তুত: শেক্সপিয়ারের হেনরী দা ফোর্থ (Henry the Furth) নাটকের কিছু সংলাপে মৌমাছি সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মৌমাছিরা সৈনিক, তাদের আছে একজন রাজা। শেক্সপিয়ারের (Shakespeare) এর সময়কালে লোকেরা মনে করত শ্রমিক মৌমাছিরা হল পুরুষ জাতীয় মৌমাছি। তারা গৃহে ফিরে রাজা মৌমাছির নিকট জবাবদিহিতার সম্মুখীন হয়। আসলে এটা মোটেই সত্য নয় । বরং শ্রমিক মৌমাছিরা হল স্ত্রী মৌমাছি। তারা কাজের প্রতিবেদন পেশ করে রাজার নিকট নয় বরং তাদের রাণীর নিকট। এ সত্যটি আবিষ্কার করতে আধুনিক গবেষণা বিগত ৩০০ বছর পর্যন্ত সময় নিয়েছে।
❑ মাকড়সার জাল ক্ষণভঙ্গুর দুর্বল
মহান আল্লাহ বলেন:
مَثَلُ الَّذِينَ اتَّخَذُوا مِن دُونِ اللّهِ أَوْلِيَاء كَمَثَلِ الْعَنْكَبوتِ اتَّخَذَتْ
بَيْتًا وَإِنَّ أَوْهَنَ الْبُيُوتِ لَبَيْتُ الْعَنْكَبوتِ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ.
“যারা আল্লাহকে ছেড়ে অপর কাউকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করে তাদের উপমা মাকড়সার মত, যে নিজের জন্য একটি ঘর বানায়। নিশ্চয়ই সব ঘরের চেয়ে মাকড়সার ঘরই অধিক দুর্বল যদি তারা জানতো।” (আল-কুরঅন-২৯:৪১)
কুরআন হালকা-পাতলা, সূক্ষ্ম, দুর্বল-ক্ষণভঙ্গুর হিসেবে মাকড়সার জালের বাহ্যিক বর্ণনা দেয়া ছাড়াও কুরআন মাকড়সার ঘরে আত্মীয়তার অসারতার উপরেও জোর দিয়েছে। মাকড়সার ঘরেই স্ত্রী মাকড়সা অধিকাংশ সময়েই তার সঙ্গী পুরুষ মাকড়সাকে মেরে ফেলে।
এই নীতিগর্ভ রূপক দৃষ্টান্তটি ঐসব লোকেদের এরূপ সম্পর্কের দুর্বলতার দিকটি উল্লেখ করে, যারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে এ জগতে ও পরজগতে নিজেদের জন্য অন্যদের নিকট নিরাপত্তা অনুসন্ধান করে থাকে ।
❑ পিপীলিকার জীবনধারা ও যোগাযোগ
কুরআনের নিম্নের আয়াতটি বিবেচনা করুন:
وَحُشِرَ لِسُلَيْمَنُ جُنُودُهُ مِنَ الْجِنِّ وَالْإِنْسِ وَالطَّيْرِ فَهُمْ يُوْزَعُوْنَ. حَتَّى إِذَا أَتَوْا عَلَى وَادِ
النَّمْلِ قَالَتْ نَمْلَةٌ يَأَيُّهَا النَّمْلُ ادْخُلُوا مَسْكِنَكُمْ لاَيَحْطِمَنَّكُمْ سُلَيْمَنُ وَجُنُودُهُ وَهُمْ لايَشْعُرُونَ.
সুলায়মানের সামনে জিন, মানুষ ও পাখিদের বাহিনীকে সমবেত করা হল, উহাদেরকে বিন্যস্ত করা হল বিভিন্ন ব্যুহে । যখন তারা পিপীলিকা অধ্যুষিত এলাকায় পৌছাল, তখন একটি পিপীলিকা বলল: হে পিপীলিকারা! তোমরা তোমাদের গর্তে/ঘরে প্রবেশ কর যেন সুলায়মান এবং তার বাহিনী অজ্ঞাতসারে তোমাদেরকে পদতেল পিষ্ট করে না ফেলে।” (আল-কুরআন-২৭ : ১৭-১৮)
অতীতে সম্ভবত: কিছু ব্যক্তি রূপকথার ও গল্পের বই মনে করে উপহাস করে থাকতে পারে কুরআনকে যাতে উল্লেখ আছে পিপীলিকাদের পারস্পরিক কথাবার্তা বলার এবং উন্নত সূক্ষ্ম পন্থায় বার্তা বিনিময়ের বিষয়। সাম্প্রতিক সময়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা পিপীলিকাদের জীবন ধারার এমন সব সঠিক তথ্য প্রদর্শন করেছে যা পূর্ববর্তীরা মোটেই জানতো না। গবেষণায় দেখা গেছে মানুষের জীবন ধারার সাথে যে সকল প্রাণী বা কীট পতঙ্গের জীবন ধারার ঘনিষ্ঠতম সাদৃশ্য রয়েছে সেটা হল পিপীলিকার জীবন ধারা।
পিপীলিকা সম্পর্কে নিম্নে বর্ণিত গবেষণালব্ধ ফলাফল হতে এটা সহজেই প্রতীয়মান হয় -
১. মানুষের ন্যায় পিপীলিকা একইভাবে মরদেহ কবরস্থ করে ।
২. পিপীলিকাদের রয়েছে শ্রম বিভাজনের পরিশীলিত উন্নত পদ্ধতি, তাই তাদের পরিচালক, তত্ত্বাবধায়ক, শ্রমিক প্রধান, শ্রমিক ইত্যাদি আছে ।
৩. মাঝে মধ্যে খোশ গল্প করার জন্য তারা নিজেরা এক সঙ্গে মিলিত হয় ।
৪. নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করার জন্য তাদের রয়েছে উন্নত যোগাযোগ পদ্ধতি ।
৫. তারা নিয়মিত বাজার বসায় দ্রব্যাদি বিনিময়ের জন্য ।
৬. শীতকালে দীর্ঘসময়ের জন্য তারা খাদ্যশস্য জমা করে রাখে এবং যদি শস্য কণার অঙ্কুরিত হওয়া শুরু হয় তারা তখন শেকড়গুলো কেটে দেয় মনে হয় তারা যেন এটা বুঝে যে, অঙ্কুর বৃদ্ধির জন্য রেখে দিলে এটা পচে নষ্ট হয়ে যাবে ।
জমাকৃত খাদ্যশস্য বৃষ্টির পানিতে ভিজে গেলে তারা সেগুলো রোদে শুকানোর জন্য বের করে আনে, শুকিয়ে গেলে আবার তারা সেগুলো ভিতরে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যেন তারা এটা জানে যে, আর্দ্রতা অঙ্কুর গজানোর কারণ এবং এর ফলে শস্যের পচন হতে পারে।
৯. চিকিৎসাবিদ্যা (Medicine)
❑ মধু: মানুষের জন্য আরোগ্যকারী
মৌমাছি নানা প্রকার ফুল ও ফল হতে রস আহরণ করে এবং এগুলো দিয়ে দেহের অভ্যন্তরে আত্তিকরণে মধু তৈরী করে। এরপর এই মধু চাকের মোম কোষে জমা করে রাখে। মাত্র দুই শতাব্দী পূর্বে মানুষ এ তথ্য জানতে পেরেছে যে, মৌমাছির পেট হতেই মধু পাওয়া যায়। অথচ ১৪০০ বছর পূর্বে কুরআনের নিম্নলিখিত আয়াতে এ প্রকৃত ঘটনাটি উল্লেখ করেছে।
يَخْرُجُ مِنْ بُطُونِهَا شَرَابٌ مُّخْتَلِفٌ الْوَانُهُ فيه شفاء للناس.
“উহার (মৌমাছির) উদর হতে বের হয় নানা বর্ণের পানীয় যার মধ্যে রয়েছে মানুষের জন্য আরোগ্য।” (আল-কুরআন- ১৬:৬৯)
এখন আমরা জানতে পেরেছি যে, মধুর রোগ নিরাময়ের ও লঘু জীবাণু নাশক গুণাবলী রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে রাশিয়ানরা ক্ষত ঢাকার জন্য মধু ব্যবহার করত। মধু ক্ষতটিতে আর্দ্রতা ধরে রাখে এবং খুবই কম ক্ষতচিহ্নযুক্ত চামড়া থেকে যায়। কারণ মধুর ঘনত্বের কারণে ক্ষত স্থানে কোন ছত্রাক বা জীবাণু জন্মাতে পারে না ।
ইংল্যান্ডের নার্সিং হোমের অনারোগ্য বক্ষব্যাধি ও আলঝাইমারস (Alzheimer's) রোগে আক্রান্ত ২২ জন রোগীরও নাটকীয় উন্নতি দেখা যায়। জীবাণু প্রতিরোধকল্পে মৌচাক বন্ধ করার জন্য মৌমাছিরা যে প্রপলিস (propolis) নামক এক প্রকার বস্তু উৎপন্ন করে। সন্যাসিনী সিস্টার ক্যারোল (Sister Carole) এই প্রপলিস (Propolis) দ্রব্যটির সাহায্যেই এই সকল রোগীদের চিকিৎসা করেছিলেন ।১
যদি কোন ব্যক্তি বিশেষ কোন উদ্ভিদের কারণে এলার্জিতে ভোগেন তবে তাকে ঐ উদ্ভিদের মধু পান করালে তার দেহে ঐ এলার্জির প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টি হবে । মধুতে আরও রয়েছে ফ্রুকটোজ (Fructose) এবং ভিটামিন 'কে'
মধু, তার উৎস ও গুণাগুণ সম্পর্কে কুরআনে ধারণকৃত এই জ্ঞান, কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার বহু শতাব্দী পরে আবিষ্কৃত হয়েছে।
____________
১. এ বক্তব্যের সূত্র: ‘এটাই সত্য' (This is the truth) এ শিরোনামের Video tape এ Tape এর জন্য Islamic Research Foundation এর সাথে প্রয়োজনে যোগাযোগ করতে পারেন ।
১০. শরীর তত্ত্ববিদ্যা (Physiology)
❑ রক্ত সঞ্চালন এবং দুগ্ধ উৎপাদন
মুসলিম বিজ্ঞানী ইবনে নাফিস (Ibn Nafees) রক্ত সঞ্চালন সম্পৰ্কীয় তথ্য বর্ণনা দেয়ার ৬০০ বৎসর পূর্বে এবং উইলিয়াম হার্ভে (Willium Herwey) এই রক্ত সঞ্চালনের জ্ঞান পশ্চিমা জগতে ছড়িয়ে দেয়ার ১০০০ বছর পূর্বে কুরআন অবতীর্ণ হয়। প্রায় ১৩০০ বছর পূর্বে এটা জানা ছিল যে, অন্ত্রে কি ঘটে এবং বিপাকীয় প্রক্রিয়ায় খাদ্যের বিভিন্ন উপাদান শোষিত হয়ে দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গের পুষ্টি সাধন করে। কুরআনের একটি আয়াত দুধের উপাদানগুলোর উৎসের বর্ণনা দিয়েছে যা উল্লেখিত অভিমতের সাথে সংগতিপূর্ণ ।
উপরোক্ত ধারণা সম্পর্কে আল-কুরআনের আয়াত বুঝতে হলে এটা জানা প্রয়োজন যে, অস্ত্রে রাসায়নিক বিক্রিয়া সংঘটিত হয়, ফলে খাদ্যদ্রব্য বিশ্লেষিত হয়ে বিভিন্ন উপাদানে বিভক্ত হয় । এই উপাদানগুলো একটি জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তাদের প্রকৃতি অনুযায়ী সরাসরি কখনও কখনও লিভারের পথ পরিক্রমায় রক্ত প্রবাহে মিশে। রক্ত ঐগুলো বহন করে নিয়ে যায় দেহের সকল অঙ্গপ্রতঙ্গে যাদের মধ্যে আছে দুগ্ধ উৎপাদনকারী গ্রন্থি ।
সহজ কথায়, অস্ত্রে বিদ্যমান বস্তুসামগ্রীর মধ্যে বিশেষ বিশেষ উপাদান অন্ত্রপ্রাচীরের নালীতে প্রবেশ করে এবং এইসব উপাদানগুলো রক্তের দ্বারা বাহিত হয়ে বিভিন্ন অঙ্গপ্রতঙ্গে পৌঁছায় ।
যদি আমরা কুরআনের নিম্নলিখিত আয়াতটির মর্মার্থ বুঝতে চাই তাহলে, উল্লেখিত ধারণাটির যথার্থ মূল্যায়ন করা যায় ।
وَإِنَّ لَكُمْ فِي الْأَنْعَامِ لَعِبْرَةً نُسْقِيكُمْ مِّمَّا فِي بُطُونِهِ مِنْ بَيْنِ
فَرْثٍ وَدَمٍ لَّبَنًا خَالِصًا سَائِفًا لِّلشَّرِبِينَ.
“নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য গবাদি পশুর মধ্যে শিক্ষা রয়েছে। আমি তাদের পেটের গোবর ও রক্তের মধ্য হতে তোমাদেরকে পান করাই বিশুদ্ধ দুগ্ধ যা তাদের জন্য তৃপ্তিদায়ক, যারা পান করে।” (আল-কুরআন-১৬:৬৬)
وَإِنَّ لَكُمْ فِي الْأَنْعَامِ لَعِبْرَةً نُسْقِيكُمْ مِّمَّا فِي بُطُونِهَا وَلَكُمْ فِيهَا منافع كَثيرَةٌ وَمِنْهَا تَأْكُلُونَ.
“আর অবশ্যই তোমাদের জন্য গৃহপালিত চতুষ্পদ জন্তুর মধ্যে শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে, তোমাদেরকে পান করাই এদের উদরস্থিত বস্তু হতে একটি জিনিস (দুধ) এবং তাদের মধ্যে তোমাদের জন্য রয়েছে প্রচুর উপকারিতা আর তোমরা তাদের কতককে খাও।” (আল-কুরআন-২৩:২১)
১৪০০ বছর পূর্বে কুরআনে দুগ্ধ উৎপাদনের বর্ণনাটি বিস্ময়করভাবে হুবহু একই যা আধুনিক শরীর তত্ত্ববিদ্যা সম্প্রতি আবিষ্কার করেছে ।
১১. ভ্রূণতত্ত্ব বিদ্যা (Embryology)
❑ মানুষ 'আলাক' জোঁকের মত বস্তু হতে সৃষ্ট
ইয়েমানের প্রখ্যাত পণ্ডিত শায়েখ আবদুল মাজিদ আজিনদানির (Sheikh Abdul Majid Azzindani) নির্দেশনায় একদল মুসলিম পণ্ডিত ভ্রূণতত্ত্ব ও বিজ্ঞানের অন্যান্য বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত কুরআন ও বিশুদ্ধ হাদিস (হযরত মুহাম্মদ সা.-এর কথা, কাজ ও অনুমোদন) হতে তথ্যগুলো চয়ন করে ইংরাজীতে অনুবাদ করেন। এরপর তারা কুরআনের নিচে বর্ণিত আয়াতটির নির্দেশ অনুসরণ করেন।
فَسْتَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ.
“তোমরা যদি না জান তবে জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞাসা কর।” (আল-কুরআন-১৬:৪৩ এবং ২১:৭)
তাই এভাবে কুরআন ও বিশুদ্ধ হাদিস হতে ভ্রূণতত্ত্ব সংক্রান্ত সকল তথ্য আহরণ ও ইংরাজীতে অনুবাদ করার পর কানাডার টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের শব-ব্যবচ্ছেদ বিভাগের (Department of Anatomy) চেয়ারম্যান ও ভ্রূণতত্ত্ব বিদ্যার অধ্যাপক ডা. কেইথ মূর (Dr. Keith Moore) এর নিকট উপস্থাপন করেন । বর্তমানে তিনি ভ্রূণ তত্ত্ববিদ্যার সর্বশ্রেষ্ঠ বিশেষজ্ঞদের অন্যতম ।
উপস্থাপিত ভ্রূণতত্ত্ব বিষয় সম্পর্কিত কুরআন ও হাদিসের বর্ণনাগুলোর উপর তাঁর মতামত জানতে চাওয়া হলে তিনি এগুলোকে খুবই যত্ন ও সতর্কতার সাথে পরীক্ষা করে বলেন : ভ্রূণতত্ত্ব সংক্রান্ত কুরআন ও হাদিসে উল্লেখিত অধিকাংশ তথ্যই ভ্রূণতত্ত্ব ক্ষেত্রে আধুনিক আবিষ্কারের সাথে পুরোপুরি সংগতিপূর্ণ এবং কোন দিক দিয়ে তাদের মধ্যে কোন বিরোধ নেই। তবে কিছু সংখ্যক আয়াতের বৈজ্ঞানিক নির্ভুলতার ব্যাপারে তিনি কোন মন্তব্য করেননি। এসব আয়াতের পরিবেশিত তথ্যগুলো সম্পর্কে তার কোন জ্ঞান না থাকায় এসব তথ্যগুলো সঠিক না বেঠিক তা বলতে তিনি নিজের অপারগতা প্রকাশ করেন। ভ্রূণতত্ত্ব বিজ্ঞানে, আধুনিক গবেষণা কমকাণ্ডে ও লেখালেখিতেও এসবের কোন উল্লেখ নেই ।
কুরআনের এরূপ একটি আয়াত হলো-
اِقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ خَلَقَ الْإِنْسَانَ مِنْ عَلَقٍ
“পাঠ কর তোমার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন । তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন জমাট রক্তের পিণ্ড থেকে।” (আল-কুরআন-৯৬:১-২)
আরবী শব্দ 'আলাক' এর 'জমাট বাঁধা রক্তপিণ্ড' ছাড়া আরও অনেক অর্থ আছে। ‘আলাক' বলতে ‘কোন কিছু যা লেগে থাকে', 'জোঁকের মত বস্তু'- এসব অর্থও বুঝিয়ে থাকে ।
প্রাথমিক অবস্থায় ভ্রূন জোঁকের মত দেখায় কিনা এ বিষয়ে ডা. কেইথ মূর এর কোন জ্ঞান ছিল না। এটা যাচাই করার উদ্দেশ্যে ভ্রূণের প্রাথমিক অবস্থার উপর গবেষণা শুরু করেন। একটি শক্তিশালী অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে তিনি ভ্রূণের প্রাথমিক অবস্থার সাথে একটি জোঁকের চিত্রের তুলনা করে দেখেন। তিনি অভিভূত হয়ে পড়েন উভযের মধ্যে বিস্ময়কর সাদৃশ্য দেখে। একইভাবে ভ্রূণ তত্ত্ব সম্পর্কিত অনেক তথ্যই যা ইতিপূর্বে তাঁর জানা ছিল না- তা কুরআন হতে আহরণ করতে তিনি সক্ষম হন ।
ডা. কেইথ মূর কুরআন ও হাদিসে উল্লেখিত ভ্রূণ তত্ত্ব সম্পর্কিত তথ্য উপাত্তের উপর ৮০টি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। লক্ষণীয় যে, কুরআন ও হাদিসের বর্ণিত তথ্যাবলী ভ্রূণ তত্ত্ব সংক্রান্ত বিজ্ঞানের সর্বশেষ আবিষ্কারের সাথে পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণ । অধ্যাপক মূর বলেন: যদি আমাকে ৩০ বছর পূর্বে এই প্রশ্নগুলো করা হত তাহলে বৈজ্ঞানিক তথ্যের অভাবে আমি এর অর্ধেক প্রশ্নেরও উত্তর প্রদানে সক্ষম হতাম না ।
ডা. কেইথ মূর 'The Developing Human' নামে পূর্বে একটি পুস্তক রচনা করেছিলেন। কুরআন হতে নূতন জ্ঞান আহরণের পর তিনি পুনরায় পুস্তকটিকে নূতন আঙ্গিকে লিখে ১৯৮২ সনে 'The Developing Human' পুস্তকটির ৩য় সংস্করণ বের করেন। মাত্র একজন লেখক কর্তৃক লিখিত এই পুস্তকটি সর্বশ্রেষ্ঠ মেডিকেল পুস্তক হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় পুরস্কার লাভ করে। পুস্তকটি বিশ্বের প্রধান প্রধান ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং প্রথম বর্ষের মেডিকেল ছাত্রদের জন্য ভ্রূণ তত্ত্ব বিদার পাঠ্যপুস্তক হিসেবে চালু আছে।
১৯৮১ সনে সৌদী আরবের দাম্মামে সপ্তম মেডিকেল কনফারেন্সে ডা. মূর বলেন: কুরআনে বর্ণিত মানুষের ক্রমবিকাশ সম্পর্কে তথ্যাবলীর ব্যাখ্যা প্রদানের সুযোগ পেয়ে আমি গভীরভাবে আনন্দিত । এটা আমার নিকট অত্যন্ত সুস্পষ্ট যে, মুহাম্মদ (সা) এর নিকট এসকল বর্ণনা অবশ্যই আল্লাহর নিকট হতেই এসেছিল । কারণ এগুলোর প্রায় সকল জ্ঞানই পরবর্তী বহু শতাব্দী পরেও আবিষ্কৃত হয়নি। এটা আমার কাছে প্রমাণ করে যে মুহাম্মদ (সা) অবশ্যই আল্লাহর রাসূল।১
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের হাউসটনে (Houston) 'বেলার কলেজ অব মেডিসিনের' ধাত্রীবিদ্যা ও স্ত্রীরোগ বিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান ডা. জয়ে লেঈগ সিম্পসন (Dr. Joe Leigh Simpson) ঘোষণা করেন : লেখকের সময়কালে (৭ম শতাব্দীতে) যে সকল বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ভাণ্ডার বিদ্যমান ছিল তার উপর ভিত্তি করে এই হাদিসগুলো, বা হযরত মুহাম্মদ (সা) এর বাণী সংগ্রহ করা যেত না। পরবর্তীতে দেখা গেছে বংশগতি বিষয়ক বিজ্ঞান (Genetics) ও ধর্ম (ইসলাম) এর মধ্যে কোন বিরোধ তো নেই, অধিকন্তু এ ধর্মই (ইসলামই প্রকৃতপক্ষে প্রথাগত বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে ঐশী প্রত্যাদেশের সংযোগ ঘটিয়ে বিজ্ঞানকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারে। কুরআনের বর্ণনাসমূহ পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে সঠিক, যথার্থ প্রমাণিত হতে দেখা গেছে— এটাই সমর্থন করে যে কুরআনের জ্ঞান আল্লাহ প্রদত্ত ।
____________
১. এ বক্তব্যের সূত্র : এটাই সত্য (This the truth) শিরোনামের Video tape.
❑ মানুষ সৃষ্টি হয় মেরুদণ্ড ও পাঁজরের মধ্য হতে নিক্ষিপ্ত ফোটা থেকে
মহান আল্লাহ বলেন:
فَلْيَنْظُرِ الْإِنْسَانُ مِمَّا خَلِقَ خُلِقَ مِنْ مَاءٍ دَافِقٍ يَخْرُجُ مِنْ بَيْنِ الصلب والتَّرَائب.
সুতরাং মানুষের ভেবে দেখা উচিত কী বস্তু হতে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে । তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে সবেগে স্খলিত পানি হতে, যা নির্গত হয় মেরুদণ্ড ও পাঁজরাস্থির মধ্য হতে। (আল-কুরআন-৮৬:৫-৭)
জন্মের পূর্বে প্রাথমিক অবস্থায় মেরুদণ্ড এবং পাঁজরের ১১তম ও ১২তম অস্থিদ্বয়ের মধ্যস্থিত বৃক্কের (Kidney)-এর নিকটে পুরুষ ও স্ত্রীর প্রজনন অঙ্গগুলো অর্থাৎ অণ্ডকোষদ্বয় ও ডিম্বাশয় বিকাশ লাভ করতে শুরু করে। পরবর্তীতে এগুলো নিচে নেমে আসতে থাকে। স্ত্রীর প্রজনন গ্রন্থি (ডিম্বাশয়) বস্তিতে (Pelvis) এসে থেমে যায় এবং পুরুষ জনন গ্রন্থি (অণ্ডকোষ) নামার ধারা অব্যাহত রাখে এবং ইনগুইনাল নালিপথ (Inguinal Canal)১ এর মধ্য দিয়ে শুক্রাশয় বা অণ্ডকোষের থলিতে এসে পৌছায়। প্রজনন অঙ্গের অবতরণের পর এমনকি সাবালকত্ব অবস্থায় এই অঙ্গগুলো মেরুদণ্ড ও পাঁজরাস্থির মধ্যস্থিত অঞ্চলে উদরের মহাধমনী হতে স্নায়ু ও রক্ত সরবরাহ গ্রহণ করে। লসিকার নিষ্কাশিত পদার্থ এবং শিরা বাহিত প্রত্যাবর্তন একই স্থানে গমন করে ৷
____________
১. ইনগুইনাল নালিপথ বা Inguinal canal হলো কুঁচকির নিকটস্থ একাধিক মাংসপেশির মধ্যে তীর্যক একটি নালিপথ। মায়ের উদরে থাকা অবস্থায় অণ্ডকোষ সুড়ঙ্গের মত এই নালিপথ বেয়ে অণ্ডকোষের থলিতে উপনীত হয়। জন্মের পরপরই শুক্রবাহী নালির জন্য কিছুটা ফাঁকা ছাড়া ইনগুইনাল ক্যানেলটি সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায় যাতে করে অণ্ডকোষ পেটে আবার ফিরে যেতে না পারে। [অনুবাদক]
❑ মানুষ সৃষ্টি হয় নুৎফা (সামান্য পরিমাণ তরল) থেকে
মহিমান্বিত কুরআন কমপক্ষে ১১ বার উল্লেখ করেছে যে মানুষ নুৎফা হতে সৃষ্ট । নুৎফার' অর্থ হল ‘নগণ্য পরিমাণ তরল' বা 'এক ফোঁটা তরল' যা পেয়ালা শূন্য করার পর পড়ে থাকে।' কুরআনের নিম্নলিখিত স্থানে এর উল্লেখ রয়েছে- ১৬: ৪, ১৮:৩৭, ২২:৫, ২৩:১৩, ৩৫:১১, ৩৬:৭৭, ৪০:৬৭, ৫৩:৪৬, ৭৫:৩৭, ৭৬:২ এবং ৮০:১৯
সাম্প্রতিক সময়ে বিজ্ঞান দৃঢ়ভাবে প্রতিপন্ন করেছে যে, একটি ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করার জন্য গড়ে ৩০ লক্ষ শুক্রাণু হতে একটি মাত্র শুক্রাণুর প্রয়োজন অর্থাৎ নিষিক্ত করার জন্য স্খলিত শুক্রাণুর ৩০ লক্ষ ভাগের একভাগ বা ০.০০০০৩% শুক্রাণুর প্রয়োজন ।
❑ মানুষ সৃষ্টি হয় সুলালাহ (তরল পদার্থের সারাংশ) হতে
মহান আল্লাহ বলেন:
ثُمَّ جَعَلَ نَسْلَهُ مِنْ سُلْلَةٍ مِّنْ مَّاءٍ مَهِين.
অতঃপর তিনি তার (মানুষের) বংশধরদের সৃষ্টি করেন তুচ্ছ নগণ্য তরল পদার্থের নির্যাস হতে।” (আল-কুরআন-৩২:৮)
আরবী শব্দ ‘সুলালাহ' এর অর্থ হল ‘সারাংশ' বা 'সম্পূর্ণটির উৎকৃষ্ট অংশ' । এখন আমরা জানতে পেরেছি যে, কেবল মাত্র পুরুষ কর্তৃক উৎপাদিত বহু লক্ষ শুক্রকীট হতে কেবল মাত্র একটি শুক্রকীট যা ডিম্বাণুতে প্রবেশ করে তা ডিম্বাণু নিষিক্ত করার জন্য প্রয়োজন। বহু লক্ষের মধ্য থেকে এই একটি মাত্র শুক্রকীটকে কুরআন ‘সুলালাহ' বলে উল্লেখ করেছে। আমরা এখন এটাও জেনেছি যে, স্ত্রী কর্তৃক উৎপাদিত হাজার হাজার ডিম্বাণুর মধ্য হতে কেবলমাত্র একটি ডিম্বাণু নিষিক্ত হয়ে থাকে। হাজার হাজার ডিম্বাণু থেকে কেবলমাত্র একটি ডিম্বাণুকেও ‘সুলালাহ' নামে কুরআন উল্লেখ করেছে।
‘সুলালাহ' এর আর একটি অর্থ হল একটি তরল হতে ধীরে ধীরে নিষ্কাশন'। এই তরল হলো ‘জনন কোষ ধারণকারী পুরুষ ও স্ত্রীর জনন তরল।' ডিম্বাণু ও শুক্রাণু উভয়েই নিষিক্তকরণ প্রক্রিয়ায় তাদের বিরাজমান পরিবেশ হতে ধীরে ধীরে নিষ্কাশিত হয় ।
❑ মানুষ সৃষ্টি হয় নুতফাতিন আমসাজ (মিশ্রিত তরল) হতে
মহান আল্লাহ বলেন:
انَّا خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ مِنْ نُّطْفَةٍ أَمْشَاجِ
আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি মিশ্র শুক্র বিন্দু থেকে। (আল-কুরআন-৭৬ : ২)
আরবী শব্দ 'নুতফাতিন আম সাজিন' এর অর্থ হল 'মিশ্রত তরল।' কুরআনের কোন কোন ভাষ্যকারের মতে 'মিশ্রিত তরল' বলতে পুরুষ বা স্ত্রী জাতীয় উপাদান বা তরলকে বুঝায়। পুরুষ ও স্ত্রী জাতীয় জনন কোষ এর মিশ্রণের পর নিষিক্ত ডিম্বাণু (Zygote) তখনও ‘নুৎফা' হিসেবে বিদ্যমান থাকে। ‘মিশ্রিত তরল' বলতে শুক্রাণু জাতীয় তরলকেও বুঝায়। এটা সৃষ্টি হয় বিভিন্ন গ্রন্থি হতে আসা নানা প্রকার নিঃসরণ হতে। সুতরাং 'নুতফাতিন আমসাজ' অর্থাৎ ‘নগণ্য পরিমাণ মিশ্রিত তরল' বলতে পুরুষ ও স্ত্রী জাতীয় জনন কোষ (জনন তরল বা কোষ) এবং চতুপার্শ্বস্থ তরলসমূহের অংশ-বিশেষকে বুঝায়
❑ লিঙ্গ নির্ধারণ
ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ করা হয় শুক্রাণুর প্রকৃতির দ্বারা ডিম্বাণুর প্রকৃতির দ্বারা নয় ৷ একটি শিশু- নারী না নর তা নির্ভর করে ২৩তম ক্রোমোজোম জোড়াটি (Chromosomes) যথাক্রমে XX না XY তার উপর।
প্রধানত লিঙ্গ নির্ধারণ হয়ে থাকে নিষিক্তকরণের সময় এবং এটা নির্ভর করে ডিম্বাণুকে শুক্রাণুর কোন প্রকার লিঙ্গ ক্রোমজোম নিষিক্ত করে তার উপর। যদি এটা X বহনকারী শুক্রাণু হয় যা ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করে তাহলে ভ্রূণ হবে স্ত্রী লিঙ্গ এবং যদি এটা Y বহনকারী শুক্রাণু হয় তাহলে ভ্রূণ হবে পুংলিঙ্গ ।
وَأَنَّهُ خَلَقَ الزَّوْجَيْنِ الذَّكَرَ وَالْأُنْثى. مِنْ نُّطْفَة إِذَا تُمْنى
“এবং তিনিই সৃষ্টি করেছেন যুগল পুরুষ ও নারী এক ফোটা শুক্র বিন্দু (বীর্য) থেকে যখন তা স্খলিত হয়।” (আল-কুরআন-৫৩: ৪৫-৪৬)
আরবী শব্দ নুৎফা এর অর্থ ‘নগণ্য পরিমাণ তরল' এবং 'তুমনা' এর অর্থ হল ‘স্খলিত' বা ‘রোপিত'। অতএব 'নুতফা' নির্দিষ্ট করে শুক্রাণুকে বুঝায় কারণ এটা স্খলিত হয় ।
মহান আল্লাহ বলেন :
منْ أَلَمْ يَكُ نُطْفَةٌ يُمْنَى. ثُمَّ كَانَ عَلَقَةً
فَخَلَقَ فَسَوَّى. فَجَعَلَ مِنْهُ الزَّوْجَيْنِ الذَّكَرَ وَالْأُنْثَى.
“সে কি স্খলিত এক ফোঁটা শুক্র ছিল না? অতঃপর সে পরিণত হয় এমন কিছুতে (আলাকে) যা লেগে থাকে, এরপর আল্লাহ তাকে আকৃতি দান করেন এবং সুবিন্যস্ত করেন সঠিক অনুপাতে। তারপর তিনি তাকে সৃষ্টি করেন যুগল লিঙ্গ- নর ও নারী।” (আল-কুরআন-৭৫:৩৭-৩৯)
পুনরায় এখানে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সামান্য পরিমাণ (এক ফোঁটা) শুক্রাণু (যা ‘নুৎফাতান্ মিন্ মানিঈন' শব্দের দ্বারা বুঝায়) যা পুরুষের নিকট থেকে আসে সেটাই ভ্রূণের লিঙ্গের জন্য দায়ী
ভারতীয় উপমহাদেশের শাশুড়ীগণ পৌত্র সন্তান পছন্দ করে থাকেন এবং যদি কাঙ্ক্ষিত পুত্র সন্তান না হয় তাহলে তারা প্রায়ই পুত্র বধূকে দোষারোপ করেন। স্ত্রী ডিম্বাণু নয়, পুরুষ শুক্রাণুর স্বভাব প্রকৃতিই হল লিঙ্গ স্থিরকরণের নিয়ামক শক্তি- এটা যদি তারা জানতেন কতই না ভাল হত! তারা যদি এ ব্যাপারে কাউকে দোষারোপ করতেই চান তবে পুত্র বধূকে নয় তার সন্তানকেই দোষারোপ করা উচিত। যেহেতু কুরআন ও বিজ্ঞান উভয়েই এই মতই ব্যক্ত করে যে, শিশুর লিঙ্গ স্থিরকরণে পুরুষের জনন তরলই দায়ী।
❑ অন্ধকারের তিনটি পর্দার দ্বারা ভ্রূণ সংরক্ষিত
মহান আল্লাহ বলেন:
يَخْلُقُكُمْ فِي بُطُون أمهتِكُمْ خَلْقًا مِّنْ بَعْدِ خَلق في ظلمت ثلث.
“তিনিই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন তোমাদের মাতৃগর্ভে এক অবস্থার পর অন্য অবস্থায় তিন তিনটি অন্ধকার পর্দার ভিতরে।” (আল-কুরআন-৩৯:৬)
অধ্যাপক কেইথ মূর এর মত অনুযায়ী কুরআন উল্লেখিত অন্ধকারের তিনটি পর্দা হল:
১. মায়ের সম্মুখবর্তী উদর প্রাচীর
২. জরায়ুর দেয়াল
৩. সেই ঝিল্লি যা শিশুকে ঢেকে রাখে (The amnio chorionic membrane)।
❑ ভ্রূণের পর্যায়সমূহ
মহান আল্লাহ বলেন :
وَلَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ مِنْ سُتْلَةٍ مِّنْ طِينٍ ثُمَّ جَعَلْنَهُ نُطْفَةً فِي قَرَارٍ مكين. ثُمَّ خَلَقْنَا النُّطْفَةَ عَلَقَةً فَخَلَقْنَا الْعَلَقَةَ
مُضْغَةً فَخَلَقْنَا الْمُضْغَةَ عِظَمًا فَكَسَوْنَا الْعِظْمَ لَحْمًا - ثُمَّ انْشَانُهُ خَلْقًا أخَرَ فَتَبْرَكَ اللهُ أَحْسَنُ الْخُلقِينَ.
আমি তো মানুষকে সৃষ্টি করেছি মাটির নির্যাস থেকে। তারপর তাকে এক ফোঁটা) শুক্ররূপে স্থাপন করি এক সুরক্ষিত স্থানে যা সুদৃঢ়ভাবে আঁটা। পরে এ শুক্র বিন্দুকে পরিণত করি জমাট বাঁধা রক্তে, তারপর (ভ্রূণ) পিণ্ডে, তারপর এই পিণ্ড হতে সৃষ্টি করি অস্থিপঞ্জর। পরে অস্থি পঞ্জরকে ঢেকে দিই গোস্ত দ্বারা। তারপর তাঁকে গড়ে তুলি ভিন্ন এক সৃষ্টিরূপে। কত মহান কল্যাণময় আল্লাহ যিনি সর্বোত্তম স্রষ্টা। (আল-কুরআন-২৩ : ১২-১৪)
এই আয়াতে আল্লাহ বলেন, তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন সামান্য তরল থেকে যাকে স্থাপন করা হয়েছে দৃঢ়ভাবে আঁটা এক বিশ্রাম স্থানে। যার জন্য আরবী শব্দ ‘কারারিন মার্কীন' ব্যবহৃত হয়েছে। পিঠের মাংস পেশী যে মেরুদণ্ডটিকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করে আছে সেই মেরুদণ্ডের দ্বারা জরায়ু পশ্চাত ভাগ হতে উত্তমরূপে সংরক্ষিত। Amniotic তরল সম্বলিত amniotic থলি দ্বারা ভ্রূণটি আবার সংরক্ষিত রয়েছে। সুতরাং ভ্রূণের রয়েছে একটি সুরক্ষিত নিরাপদ বসবাসের স্থান।
এই অল্প পরিমাণ তরল 'আলাকে' পরিণত হয়। ‘আলাকের' অর্থ হল ‘এমন কিছু যা দৃঢ়ভাবে লেগে থাকে'। এটার আর একটি অর্থ হল ‘জোঁক সদৃশ্য বস্তু'। উভয় বর্ণনাই বৈজ্ঞানিকভাবে গ্রহণীয়। প্রাথমিক অবস্থায় ভ্রূণ দেয়ালের সাথে যেহেতু লেগে থাকে এবং এটাকে আবার জোঁকের আকৃতির মত দেখায়। এটা আচরণও করে জোঁকের (রক্ত চোষকের) মত। এটা মায়ের গর্ভফুলের মাধ্যমে রক্ত সরবরাহ পেতে থাকে ।
‘আলাকাহ’ এর তৃতীয় অর্থ হল 'রক্ত পিণ্ড'। এই আলাকা অবস্থার মেয়াদকাল হল গর্ভসঞ্চারের তৃতীয় এবং চতুর্থ সপ্তাহ। রক্ত তখন জমাট বাঁধে বদ্ধনালীর। এর মধ্যে। তাই ভ্রূণকে জমাট বাঁধা রক্তের মতো দেখায় অধিকন্তু তাকে জোঁকের আকৃতির ন্যায় বলেও মনে হয় ।
আল-কুরআনে প্রস্তুত অবস্থায় সহজলভ্য জ্ঞানের সাথে সংগ্রামসিক্ত মানুষের গবেষণালব্ধ জ্ঞানের তুলনা করুন।
১৬৭৭ সনে হাম এবং লিউ ওয়েন হোয়েক ( Hamm and Leeuwenhoek) এ দু'জন ছিলেন প্রথম বিজ্ঞানী যারা অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে মানুষের শুক্রাণু কোষ পর্যবেক্ষণ করেন। তাঁরা মনে করেছিলেন যে, শুক্রাণু কোষে আছে অতিক্ষুদ্রাকৃতির মানুষ যা জরায়ুতে বিকাশ লাভ করতে থাকে নবজাতকরূপে গড়ে উঠার জন্য । এটাই পারফোরেশন ( 'Perforation) তত্ত্ব' হিসেবে পরিচিত ছিলো । যখন বিজ্ঞানীগণ আবিষ্কার করলেন যে, ডিম্বাণু, শুক্রাণু হতে বড় তখন ডি গ্রাফ (De Graf) এর মত বিজ্ঞানীসহ অন্যান্য বিজ্ঞানীগণ চিন্তা করলেন ভ্রূণ ক্ষুদ্রাকৃতিতে ডিম্বাণুর মধ্যে বিদ্যমান আছে। পরবর্তীতে ১৮তম শতাব্দীতে মাওপার টুইস (Maupertuis) পিতামাতার দ্বৈত উত্তরাধিকার' তত্ত্ব প্রচার করেন।
‘আলাক’ রূপান্তরিত হয় মুদগায়’। ‘মুদগা' বলতে বুঝায় ‘এমন কিছু যা চিবান (যাতে আছে দাঁতের দাগ) এবং এমন কিছু যা আঠালো এবং ছোট এবং যা গামের মত মুখের ভেতরে রাখা যায়। এই উভয় ব্যাখ্যাই বৈজ্ঞানিকভাবে সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। অধ্যাপক কেইথ মূর এক খণ্ড ‘প্লাস্টার সিল' নিলেন এবং ভ্রূণের প্রাথমিক আকার-আকৃতির ন্যায় এটাকে গড়ে তোলেন, পরে এটাকে দাঁতে চিবিয়ে 'মুদগাহ'-এর মত তৈরী করেন। এরপর তিনি এটাকে ভ্রূণের প্রাথমিক অবস্থার আলোক চিত্রের সাথে তুলনা করেন। তিনি দেখেন চিবানো প্লাস্টার সিলে দাঁতের দাগ Somites এর মত সাদৃশ্যপূর্ণ। এই Somites হল মেরুদণ্ডের প্রাথমিক গঠন।
এই 'মুদগাহ' অস্থিতে (ইজামা) রূপান্তরিত হয়। আবার এই অস্থিগুলোকে অখণ্ড গোস্তের পোশাক পরানো হয়। এরপর আল্লাহ একে তৈরী করেন ভিন্ন সৃষ্টিতে । আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে নেতৃত্বস্থানীয় বিজ্ঞানীদের অন্যতম আমেরিকার ফিলাডেলফিয়ায় থমাস জেফারসন ইউনিভার্সিটির ডেনিয়াল ইনস্টিটিউট এর পরিচালক এনাটমি বিভাগের প্রধান, অধ্যাপক মার্শাল জনসনকে (Prof Marshall Johnson) এর নিকট হতে ভ্রূণ সংক্রান্ত কুরআনের আয়াতের উপর তার মতামত জানতে চাওয়া হলে প্রথমে তিনি বলেন : কুরআনে বর্ণিত ভ্রূণের বিভিন্ন পর্যায়সমূহের বর্ণনা আকস্মিক যুগপৎ সংঘটন হতে পারে না । তিনি বলেন সম্ভবত: হযরত মুহাম্মদ (সা) এর নিকট কোন একটি শক্তিশালী অণুবীক্ষণ যন্ত্র ছিল। কুরআন ১৪০০ বছর পূর্বে অবতীর্ণ হয়েছে আর অণুবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কৃত হয়েছে হযরত মুহাম্মদ (সা) সময় কালের বহু শতাব্দী পরে- একথাটি তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হলে অধ্যাপক জনসন হেঁসে উঠেন এবং স্বীকার করেন আবিষ্কৃত প্রথম অণুবীক্ষণ যন্ত্র কোন বস্তুকে ১০ গুণের অধিক বিবর্ধন করতে পারত না এবং বস্তুর সুস্পষ্ট চিত্র প্রদর্শনেও সক্ষম হত না। পরবর্তীতে তিনি বলেন : মুহাম্মদ (সা) যখন কুরআন পাঠ করতেন তখন ঐশী বাণীর অবতীর্ণ হওয়ার সংশ্লিষ্টতার সাথে আমি কোন বিরোধ দেখি না।১
ডা. কেইথ মূরের (Dr. Keeth Moore) এর মতে সমগ্র বিশ্বে গৃহীত ভ্রূণের বিকাশমান স্তরসমূহের এই আধুনিক শ্রেণী বিন্যাস সহজেই বোধগম্য নয় যেহেতু এটা সংখ্যাসূচক ভিত্তিতে স্তরগুলোকে সনাক্ত করে অর্থাৎ পর্যায়-১, পর্যায়-২ ইত্যাদি। অপরদিকে ভ্রূণ যে সকল গড়ন ও আকার আকৃতিতে বিকশিত হতে থাকে কুরআন ভ্রূণের এ সকল সুস্পষ্ট ও সহজে সনাক্তযোগ্য গড়ন ও আকার আকৃতির উপর ভিত্তি করে এই বিভাজন প্রকাশ করেছে। এগুলো জন্মপূর্ব উন্নয়ন ও বিকাশের বিভিন্ন পর্যায়ের উপর ভিত্তিশীল এবং এগুলো যোগায় মার্জিত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা, যা বোধগম্য ও বাস্তব ।
মানুষের এরূপ ভ্রূণ বিকাশের স্তরগুলোর বর্ণনা নিম্নের আয়াতগুলোতে উল্লেখ রয়েছে—
أَلَمْ يَكُ نُطْفَةً مِّنْ مَّنِي يُمْنَى. ثُمَّ كَانَ عَلَقَةً فَخَلَقَ فَسَوَّى. فَجَعَلَ مِنْهُ الزَّوْجَيْنِ الذَّكَرَ وَالْأُنْثَى.
“সে কি স্খলিত এক ফোঁটা শুক্র ছিল না? অতঃপর সে পরিণত হয় এমন কিছুতে (আলাকে) যা লেগে থাকে, এরপর আল্লাহ তাকে আকৃতি দান করেন এবং সুবিন্যস্ত করেন সঠিক অনুপাতে। তারপর তিনি তাকে সৃষ্টি করেন যুগল লিঙ্গ- নর ও নারী।” (আল-কুরআন-৭৫ : ৩৭-৩৯)
الَّذِي خَلَقَكَ فَسَوكَ فَعَدَ لَكَ فِي أَيِّ صُورَةٍ مَا شَاءَ رَكَّبَكَ.
“যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, সুবিন্যস্ত করেছেন সঠিক অনুপাতে এবং করেছেন ভারসাম্যপূর্ণ এবং নিজ ইচ্ছামত আকৃতিতে তোমাকে করেছেন সুসংযোজিত । (আল-কুরআন-৮২:৭-৮)
____________
১. এ বক্তব্যের সূত্র: এটাই সত্য (This is the truth) এ শিরোনামের Video Tape. ৫৮
❑ ভ্রূণ আংশিক সুগঠিত ও আংশিক গঠন অসম্পূর্ণ
'মুদগা' অবস্থায় যদি ভ্রূণকে ছেদন করা হয় এবং আভ্যন্তরীণ অংশের যদি ব্যবচ্ছেদ করা হয় তাহলে দেখা যাবে এর অধিকাংশই সুগঠিত আর অবশিষ্ট অংশ পুরোপুরি গঠিত নয়।
অধ্যাপক জনসনের (Prof. Johnson) এর মতে যদি আমরা ভ্রূণকে একটি পরিপূর্ণ সৃষ্টি হিসেবে বর্ণনা করি তাহলে আমরা ঐ অংশটিকে বর্ণনা করছি যা ইতিমধ্যেই সৃষ্টি হয়ে গেছে। আর যদি আমরা এটাকে অসম্পূর্ণ সৃষ্টি হিসেবে বর্ণনা করি তাহলে আমরা ঐ অংশের বর্ণনা করছি যা এখনও গড়ে উঠেনি । তাহলে প্রশ্ন উঠে ভ্রূণ কি পরিপূর্ণ সৃষ্টি না অসম্পূর্ণ সৃষ্টি? ভ্রূণের বিকাশকালীন প্রক্রিয়ায় “ভ্রূণ আংশিক সুগঠিত ও আংশিক গঠন অসম্পূর্ণ” বলে কুরআন যে বর্ণনা দিয়েছে এর চেয়ে উত্তম বর্ণনা আর নেই ।
যেমন কুরআনে উল্লেখ রয়েছে-
خَلَقْتُكُمْ مِّنْ تُرَابٍ ثُمَّ مِنْ نُّطْفَةٍ ثُمَّ مِنْ عَلَقَةٍ ثُمَّ مِنْ مُضْغَةٍ مخلَّقَةٍ وَغَيْرِ مُخلَّقَةٍ لنُبَيِّنَ لَكُمْ.
“আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি মৃত্তিকা হতে, তারপর শুক্র হতে, এরপর জোঁকের মত পিণ্ড হতে, অতঃপর আংশিক পূর্ণাকৃতি ও আংশিক অপূর্ণাকৃতির গোস্ত পিণ্ড হতে, তোমাদের নিকট আমার কুদরত প্রকাশ করার জন্য।” (আল-কুরআন-২২:৫)
আমরা বৈজ্ঞানিকভাবে জানি যে, বিকাশ ও বর্ধনের প্রাথমিক অবস্থায় কিছু কোষ থাকে যাদেরকে পার্থক্য করা যায় আর কিছু কোষ আছে যাদেরকে পার্থক্য করা যায় না। কিছু অঙ্গ থাকে সুগঠিত ও কিছু অঙ্গ অপূর্ণাকৃতির ।
❑ শ্রবণ ও দর্শন ইন্দ্ৰিয়
বিকাশমান মানব ভ্রূণে সর্বপ্রথম শ্রবণ ইন্দ্রিয়ের উদ্ভব ঘটে। ভ্রূণ ২৪তম সপ্তাহের পর হতে শব্দ শুনতে পায়। পরবর্তীতে দর্শন ইন্দ্রিয় বিকাশ লাভ করে এবং ২৮তম সপ্তাহে অক্ষিপট আলোর প্রতি সংবেদনশীল হয়ে উঠে ।
ভ্রূণে ইন্দ্রিয়গুলোর বিকাশ সম্পর্কে কুরআনের নিম্নের আয়াতগুলো বিবেচনা করুন ।
وَجَعَلَ لَكُمُ السَّمْعَ وَالْاَبْصَارَ وَالْاَفْئِدَةَ .
“তিনি তোমাদেরকে দিয়েছেন কর্ণ, চক্ষু ও অন্ত:করণ, তোমরা অতি সামান্যই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে থাক।” (আল-কুরআন-৩২ : ৯)
وَهُوَ الَّذِي أَنْشَاَلَكُمُ السَّمْعَ وَالْاَبْصَارَ وَالْأَفْئِدَةَ قَلِيلاً مَّا تَشْكُرُونَ.
“হে মানুষ তিনিই তোমাদের [শোনার জন্য] কান ও [দেখার জন্য] চোখ [অনুভব করার জন্য] অন্ত:করণ সৃষ্টি করেছেন। তোমরা অতি অল্পই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে থাক।” (আল-কুরআন-২৩ : ৭৮)
إِنَّا خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ مِنْ نُّطْفَةٍ أَمْشَاجِ نَّبْتَلِيْهِ فَجَعَلْنَهُ سَمِيعًا بَصِيرًا.
“আমি তো মানুষকে সৃষ্টি করেছি মিশ্রিত শুক্র বিন্দু হতে, তাকে পরীক্ষা করার জন্য। সে কারণে আমি তাকে দিয়েছি শ্রবণ শক্তি ও দৃষ্টি শক্তি।” (আল-কুরআন-৭৬ : ২)
এ সমস্ত আয়াতে দর্শন ইন্দ্রিয়ের পূর্বে শ্রবণ ইন্দ্রিয়ের উল্লেখ রয়েছে। কুরআনের বর্ণনা আধুনিক ভ্রূণ তত্ত্ব বিজ্ঞানের আবিষ্কারের সাথে হুবহু মিলে যায় ৷
১২. সাধারণ বিজ্ঞান (General Science)
❑ আঙ্গুলের ছাপ
মহান আল্লাহ বলেন:
أَيَحْسَبُ الْإِنْسَانُ اَلنْ نَجْمَعَ عِظَامَهُ. بَلَى قَدرِينَ عَلَى أَنْ نُّسَوِّى بَنَابَهُ.
“মানুষ কি মনে করে যে, আমি তার হাড়গুলোকে সংযোজন করতে পারব না? প্রকৃতপক্ষে আমি তার আঙ্গুলের অগ্রভাগ পর্যন্ত যথাযথভাবে সুবিন্যস্ত করতে সক্ষম।” (আল-কুরআন-৭৫:৩-৪)
মৃত ব্যক্তির অস্থি পঞ্জর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত হয়ে মাটির সাথে মিশে যাওয়ার পর পুনরুত্থান ঘটার ও বিচার দিবসে কিভাবে প্রত্যেককে সনাক্ত করা সম্ভব হবে- এ ব্যাপারে অবিশ্বাসীগণ বিতর্ক করে থাকে। এ প্রশ্নের উত্তর সর্বশক্তিমান আল্লাহ আমাদের দিয়েছেন— তিনি কেবলমাত্র অস্থি-পঞ্জরকেই শুধু সংযোজিত করবেন না বরং আমাদের আঙ্গুলের রেখাসমূহকেও (আঙ্গুলের ছাপকে) তিনি নিখুঁতভাবে পুনরায় তৈরী করবেন ।
ব্যক্তি পরিচয় স্থিরকরনের বিষয় বলতে গিয়ে কেন কুরআন সুনির্দিষ্টভাবে আঙ্গুলের অগ্রভাগের কথা বলল? স্যার ফ্রান্সিস গোস্ট (Sir Francis Golt) এর গবেষণালব্ধ ফলাফলের উপর ভিত্তি করে, ১৮৮০ সনে (মানুষ) সনাক্তকরণে আঙ্গুলের ছাপকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি হিসেবে গণ্য করা হয়। সারা বিশ্বে এমন দু'জন ব্যক্তি নেই যাদের আঙ্গুলের ছাপের ধরন হুবহু একই। এমনকি একই রকমের যমজ ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও হয় না। এ কারণে বিশ্বব্যাপী সকল পুলিশ বাহিনী অপরাধী সনাক্তকরণে আঙ্গুলের ছাপ ব্যবহার করে থাকে ।
১৪০০ বছর পূর্বে প্রত্যেক ব্যক্তির আঙ্গুলের ছাপের স্বতন্ত্রতাকে কে জানত? অবশ্যই স্বয়ং স্রষ্টা ব্যতীত আর কেউই জানত না ।
❑ চামড়ায় ব্যথা অনুভবকারী গ্রন্থি আছে
পূর্বে মনে করা হতো যে, অনুভূতি ও বেদনার জ্ঞানোন্দ্রিয় কেবলমাত্র মস্তিষ্কের স্নায়ুকেন্দ্রের উপর নির্ভরশীল। সাম্প্রতিক আবিষ্কার প্রমাণ করে যে, ব্যথা বেদনায় সাড়াদানকারী গ্রন্থি বা কোষসমূহ (Pain receptors) চামড়ার মধ্যে রয়েছে। এগুলো ব্যতীত কোন ব্যক্তি ব্যথা-বেদনা অনুভব করতে পারে না ।
যখন একজন ডাক্তার অগ্নিদগ্ধে আক্রান্ত কোন রোগীকে পরীক্ষা করেন তখন তিনি সরু পিন দ্বারা পোড়ার মাত্রা নিরূপণ করেন। যদি রোগী ব্যথা অনুভব করে তাহলে ডাক্তার খুশী হন। কারণ রোগীর বেদনার অনুভূতি প্রমাণ করে পোড়ার ক্ষতটি অগভীর ও সামান্য এবং ব্যথা বেদনায় সাড়াদানকারী গ্রন্থি বা কোষসমূহ (Pain receptors) অক্ষত আছে। পক্ষান্তরে রোগী যদি কোন ব্যথা বেদনা অনুভব না করেন, তাহলে রোগীর এই অনুভূতিহীনতাই ইঙ্গিত করে যে, পোড়াটা গভীর এবং গ্রন্থি বা কোষসমূহ বিনষ্ট হয়ে গেছে। আল-কুরআনের নিম্নের আয়াতটি ব্যথায় সাড়াদানকারী গ্রন্থি বা কোষের অস্তিত্বের কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে।
إِنَّ الَّذِيْنَ كَفَرُوا بِايْتِنَا سَوْفَ نُصْلِيهِمْ نَارًا. كُلَّمَا نَضِجَتْ جُلُودُهُمْ بَدَلْتُهُمْ جُلُودًا غَيْرَهَا لِيَذُوقُوا الْعَذَابَ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَزِيزًا حَكِيمًا.
“যারা আমার আয়াতকে অস্বীকার করে তাদেরকে আমি অবশ্যই নিক্ষেপ করব আগুনে। আর যখনই তাদের চামড়া জ্বলে পুড়ে যাবে তখন তা আমি পাল্টে দেব নূতন চামড়া দিয়ে, যাতে তারা শাস্তি আস্বাদন করতে পারে পূর্ণমাত্রায় । আল্লাহ পরাক্রশালী ও প্রজ্ঞাময়।” (আল-কুরআন-৪:৫৬)
থাইল্যান্ডের ‘চিয়াং মাই বিশ্ববিদ্যালয়ের' এ্যানাটমি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তাগাতাত তেজাসেন (Prof Tagatat Tejasen) Pain receptors-এর উপর গবেষণায় দীর্ঘকাল অতিবাহিত করেন। প্রথমে তিনি বিশ্বাস করতে চাননি যে কুরআন ১৪০০ বছর পূর্বে এই বৈজ্ঞানিক সত্যটি উল্লেখ করেছে। পরবর্তীতে কুরআনের এই বিশেষ আয়াতটির অনুবাদ পরীক্ষা করেন। অধ্যাপক তেজাসেন কুরআনের এই আয়াতটির বৈজ্ঞানিক নির্ভুলতায় এতটা অভিভূত হয়ে পড়েন যে, রিয়াদে অনুষ্ঠিত “কুরআন ও সুন্নাহর বৈজ্ঞানিক নিদর্শনাবলী” বিষয়ের উপর ৮ম সৌদী মেডিকেল কনফারেন্সে সকলের উপস্থিতিতে ঘোষণা করেন-
'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।'
‘আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই এবং মুহাম্মদ (সা) আল্লাহর রাসূল।'
উপংসহার (Conclusion)
কুরআনে বৈজ্ঞানিক সত্য ঘটনাসমূহের উপস্থিতিকে আকস্মিক যুগপৎ সংঘটন বলে অভিহিত করা সাধারণ জ্ঞানের ও সঠিক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিপন্থী । বস্তুত কুরআনের আয়াতসমূহের বৈজ্ঞানিক নির্ভুলতাই কুরআনের উন্মুক্ত ঘোষণাকে দৃঢ়ভাবে বলবৎ করে । কুরআন সকল মানুষকে বিশ্বজগত সৃষ্টির উপর চিন্তাভাবনা ও গবেষণা করতে আহ্বান জানায় নিম্নের আয়াতে-
إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَوتِ وَالْاَرْضِ وَاخْتِلَافِ الَّيْلِ وَالنَّهَارِ لايت لِأُولِي الْأَلْبَابِ.
“আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীর সৃজনে, দিন ও রাতের আবর্তনে নিদর্শনাবলী রয়েছে জ্ঞানীদের জন্য।” (আল-কুরআন-৩: ১৯০)
কুরআনের বৈজ্ঞানিক সাক্ষ্য প্রমাণই তার ঐশী উৎসকে সুস্পষ্টভাবে প্রতিপন্ন করে । কোন মানুষের পক্ষে এরূপ একটি পুস্তক সৃষ্টি করা কোনমতেই সম্ভব নয় । যাতে থাকবে জ্ঞানগর্ভ বৈজ্ঞানিক সত্য ঘটনা সম্ভার- যা মানুষের দ্বারা আবিষ্কৃত হবে শত শত বছর পর ।
যাহোক কুরআন কিন্তু কোন বিজ্ঞানের বই নয় কিন্তু এটা নিদর্শনাবলীর' পুস্তক। এই নিদর্শনাবলী মানুষকে আহ্বান করে পৃথিবীতে তার অবস্থানের উদ্দেশ্য উপলব্ধি করতে এবং প্রকৃতির সাথে ঐক্যতানে মিলেমিশে বসবাস করতে। কুরআন হল যথার্থই আল্লাহর বাণী যিনি বিশ্বজগতের সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা । এতে রয়েছে আল্লাহর একত্ববাদের বাণী যা প্রচারিত হয়েছিল আদম, মূসা, ঈসা হতে হযরত মুহাম্মদ (সকলের উপর আল্লাহর শান্তি ও অনুগ্রহ বর্ষিত হোক) পর্যন্ত সকল নবী রাসূল কর্তৃক। কুরআন ও আধুনিক বিজ্ঞান' –এ বিষয়ের উপর কিছু কিছু বিস্তারিত বিবরণসহ বৃহৎ বৃহৎ গ্রন্থ লেখা হয়েছে, এ বিষয়ে আরও গবেষণা কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে। ইনশাআল্লাহ, এই গবেষণা মানব জাতিকে সর্বশক্তিমান আল্লাহর পয়গামের অধিক সন্নিকটে আসতে সাহায্য করবে ।
এই পুস্তিকাটিতে আছে কুরআনে উল্লেখিত বৈজ্ঞানিক ঘটনার কেবলমাত্র কয়েকটি ঘটনা । বিষয়টির প্রতি পরিপূর্ণ সুবিচার করতে পেরেছি এ দাবী আমি করছি না । অধ্যাপক তেজাসেন (Prof Tejasen) কুরআনে উল্লেখিত কেবলমাত্র একটি বৈজ্ঞানিক নিদর্শনের শক্তির প্রভাবে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। কুরআনের ঐশী উৎস সম্পর্কে প্রত্যয় সৃষ্টির জন্য কিছু ব্যক্তির হয়তো ১০টি নিদর্শনের, আবার কারোর ১০০টি নিদর্শনের প্রয়োজন হতে পারে। এমনকি হাজার নিদর্শন দেখানো হলেও কিছু ব্যক্তি এ সত্য গ্রহণ করতে রাজি হবেন না- এরূপ বদ্ধ মানসিকতা সম্পন্ন ব্যক্তিদের নিন্দা করেছে আল-কুরআন ।
صُمٌّ بُكْمٌ عُمْيٌّ فَهُمْ لَا يَرْجِعُونَ.
“এরা বধির, মুক ও অন্ধ, কাজেই তারা (সঠিক পথে) প্রত্যাবর্তন করবে না।” (আল-কুরআন-২: ১৮)
কুরআনে রয়েছে ব্যক্তি ও সমাজের জন্য এক পরিপূর্ণ জীবন বিধান। নিছক অজ্ঞতার বশবর্তী হয়ে আধুনিক মানুষ যে সকল মতবাদ (ইজম) আবিষ্কার করেছে, আলহামদুলিল্লাহ (সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্য) কুরআনী জীবন ব্যবস্থা এদের চেয়ে উত্তম। স্বয়ং স্রষ্টার চেয়ে উত্তম পথ নিদের্শনা কে দিতে পারে? আমি প্রার্থনা করি আল্লাহ যেন আমার এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টাকে কবুল করেন, আর কামনা করি তাঁর ক্ষমা ও পথ নির্দেশনা । আমীন ।