প্রশ্নঃ
মুসলমানদের জন্য নামাজ,রোজা ফরজ করা হয়েছে (Quran 2:183, 2:184, 2:187, Sahih Bukhari 1:2:7, 6:60:40 Sahih Muslim 1:9) যা সূর্য উদয়-অস্তের সাথে সম্পর্কিত (24 hour cycle)! কিন্তু আল্লাহ্ উত্তর এবং দক্ষিণ মেরুর বাসিন্দাদের ব্যাপারে কিছু ভেবে দেখেন নি!
জবাবঃ
:::::::::::
ইসলামের শরীয়তের মূল ভিত্তি হচ্ছে চারটি-
১) কোরআন ২) হাদিস ৩) ইজমা ৪)কিয়াস।
যখন কোন নির্দেশনা সরাসরি কোরআনে পাওয়া না যাবে তখন দেখতে হবে রাসুল(সাঃ) সেই বিশেষ বিষয়ে কি নির্দেশনা দিয়েছেন।
যদি সেখানেও কিছু না পাওয়া যায় তবে যথাক্রমে ইজমা ও কিয়াসের অনুসরণ করতে হবে। নাস্তিকরা এ নির্দেশনার বিষয়ে অজ্ঞ বিধায় অযথা মিথ্যাচার করে।
গোটা পৃথিবীতে মানুষ আছে প্রায় ৭৫০ কোটি।সেখানে উত্তর আর দক্ষিণ মেরু মিলিয়ে মানুষের সংখ্যা কত? সংখ্যাটা পাঁচ অঙ্ক পার হয় না। উত্তর মেরুতে প্রকৃত পক্ষে কোন মানুষই বাস করে না।Eskimo বা Inuit-রা উত্তর মেরুতে না, উত্তর মেরুর কাছাকাছি বাস করে।আর দক্ষিণ মেরুতেও কোন স্থায়ী বাসিন্দা নেই। এখানে দুই ধরণের মানুষ আসে- বৈজ্ঞানিক গবেষণার কাজে এবং টুরিস্ট। গ্রীষ্মকালে জনসংখ্যা থাকে ৪০০০, শীতকালে যেটা এসে দাঁড়ায় মাত্র ১০০০-এ।এখন আপনার কি মনে হয় এত বিশাল জনসংখ্যার হিসেবে তাদের কথা আলাদাভাবে বলা কি খুব গুরুত্বপূর্ণ?
মেরু অঞ্চলের দেশসমূহ- যাতে বছরের বিভিন্ন সময়ে ২৪ ঘন্টা পর্যন্ত দিন থাকে, সেখানে রাতের নামাজসমূহ ও দিনে রোজা আদায় নিয়ে সমস্যায় পড়তে হয়। ফ্রান্স, নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ডসহ বেশকিছু দেশে বছরের কোনো কোনো সময়ে ইফতারের সময় হওয়ার কিছুক্ষণ পরে এশার সময় আসার পূর্বেই পুনরায় ফজরের সময় হয়ে যায়। এ জন্য ওই সব দেশসমূহের নামাজ রোজার বিধান নিয়ে আলেমরা গবেষণা ও পর্যালোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন-
মাসয়ালা-১:
উলামায়ে কেরামগন মেরু অঞ্চলের দেশ সমূহে নামাজ রোজার বিধান বলবৎ থাকার সিদ্ধান্ত দিয়েছেন এবং তাদের সিদ্ধান্তের স্বপক্ষে একটি হাদিস উল্লেখ করেছেন।
তা হচ্ছে,
হজরত নাউয়াস ইবনে সামআন (রা.)-এর সূত্রে বর্ণিত, একদা হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) দাজ্জালের আবির্ভাব ও সে সময়ের ফেতনাসংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনা করছিলেন।
বর্ণনার একপর্যায়ে সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন,
"হে আল্লাহর রাসূল! দাজ্জাল পৃথিবীতে কতদিন অবস্থান করবে? হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, চল্লিশ দিন অবস্থান করবে, এর প্রথম দিন এক বছর সমপরিমাণ, দ্বিতীয় দিন এক মাস সমপরিমাণ এবং তৃতীয় দিন এক সপ্তাহ সমপরিমাণ, আর বাকী দিনগুলো সাধারণ দিনসমূহের ন্যায়। সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! এক বছর সমপরিমাণ দিনে কি আমাদের এক রাত-দিনের পরিমাণ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়লেই কি যথেষ্ট হবে? হরজত রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, না, বরং তা সময় হিসাব করে পূর্ণ এক বছরের নামাজই আদায় করতে হবে।"
-সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৯৩৭, সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ৪৩২১
অর্থাৎ
এখানে ক্লিয়ার বলে দেয়া হয়েছে যেখানে দিন,রাত্রি স্বাভাবিক নয় সেখানে কিভাবে নামাজ আদায় করতে হবে।রোজার ক্ষেত্রেও একই নির্দেশনা।
মাসয়ালা-২:
যদি এমন হয় যে, দিন বড় হলেও সাহরি ইফতারি ও সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত অল্প সময়ের জন্য হলেও নিয়মমাফিক হয়ে থাকে তাহলে এর বিধান সাধারণ এলাকাসমূহের ন্যায়ই হবে। হ্যাঁ, যদি সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত উক্ত নিয়মমাফিক হয়েও দিন অস্বাভাবিক বড় হয়ে যাওয়ার করণে রোজা রাখতে কঠিন সমস্যা হয় তাহলে শরিয়তে তাদেরকে রোজা ভেঙ্গে পরবর্তি স্বাভাবিক দিনে সেগুলো কাজা করে নেওয়ার সুযাগ দেয়। -রদ্দুল মুহতার: ১/৩৩৯, ফাতাওয়ায়ে হক্কানিয়া: ৪/১৪৫
মাসয়ালা-৩:
যদি লাগাতার কয়েকদিন সূর্য অস্ত না যায় তাহলে ২৪ ঘন্টা করে সময় ভাগ করে প্রথম ১২ ঘন্টাকে রাত ধরে দ্বিতীয় ১২ ঘন্টা শুরু হওয়ার দেড় ঘন্টা পূর্বে সাহরি খেয়ে শেষ করে রোজার নিয়ত করে রোজা আরম্ভ করে দিবে। দ্বিতীয় ১২ ঘন্টা শেষ হলে ইফতার করে মাগরিব এশা তারাবিহ নামাজ সব পড়ে নিবে। -রদ্দুল মুহতার: ১/৩৩৯, ফাতাওয়ায়ে ফরিদিয়া: ৪/৯৮
মাসয়ালা-৪:
আর যদি ২৪ ঘন্টায় সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত হলেও নিয়মমাফিক না হয়, বরং সূর্যাস্তের পর ইফতার ও সাহরির সময় না পেতেই ফজরের সময় ও সূর্যোদয় হয়ে যায় তাহলে উলামায়ে কেরাম তাদের নামাজ-রোজা আদায়ের দু’টি পদ্ধতি বর্ণনা করেছেন-
এক.
সে সব এলাকার লোকেরা প্রতি চব্বিশ ঘন্টা সময় হিসেব করে তা ভাগ করে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করবে, চাই পূর্ণ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সময় পাওয়া যাক বা না যাক। রোজার ক্ষেত্রে তারা সেখানে ২৪ ঘন্টা পূর্ণ হওয়ার এতটুকু সময় পূর্বে ইফতার করে নিবে যেটুকু সময় জরুরত পরিমাণ খানা-পিনা করতে পারবে। এরপর তারা রোজার নিয়ত করে খানা-পিনা বন্ধ করে দিবে। তবে এক্ষেত্রেও এভাবে তাদের রোজা আদায় কঠিন ও কষ্টকর হলে ওই সময় না রেখে পরবর্তিতে কাজা করে নিতে পারবে। এ জন্য রোজা কাজা হলে গুনাহ হবে না। আর মাগরিব এশা ও বিতির নামাজ যথাক্রমে পড়ে নিবে। তারবির সময় না পাওয়া যাওয়ায় তা না পড়লেও চলবে। -ফাতহুল কদির: ১/১৫৬, রদ্দুল মুহতার: ২/৪২০, আহসানুল ফাতাওয়া: ৪/৭১
দুই.
তারা ওই দেশের পার্শ্ববর্তী নিকটতম দেশ যেখানে নিয়মিত সূর্য উদয়-অস্ত হয়, সেখানের নামাজ-রোজার সময় অনুযায়ী নিজ দেশে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ এবং প্রতিদিনের রোজা আদায় করবে। -ইমদাদুল ফাতাওয়া: ১/১৭৩, তাকমিলাতু ফাতহিল মুলহিম: ৬/৩৭৬-৩৭৮
প্রশ্ন আসতে পারে--
নরওয়ে, আলাস্কা এবং আইসল্যান্ডের একজন মুসলিমকে প্রায় সারাদিনই রোযা রাখতে হয়!২০১৭ সালে সবচেয়ে দীর্ঘ রোযার সময়কাল হল ২১ ঘণ্টা, গ্রিনল্যান্ড এবং আইসল্যান্ডে।
অস্বীকার করছি না যে, এত লম্বা সময় ধরে রোযা রাখা আসলেই কষ্টসাধ্য ব্যাপার, কিন্তু অসম্ভব না। ফিনল্যান্ডের কোন মুসলিমের সাথে কথা বলে দেখুন, তারা কিন্তু ভালোভাবেই নামাজ,রোজা পালন করে আসছেন।
সাওমের মূল উদ্দেশ্য হলো তাকওয়া অর্জন। আল্লাহর কথা মনে রেখে নিজেকে অন্যায় থেকে দূরে রাখা। আল্লাহ�� বলেছেন-
“হে ঈমানদারগণ! তোমাদের প্রতি রোযা ফরয করা হয়েছে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের প্রতি ফরয করা হয়েছিল, যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পারো।"(২:১৮৩)
তাই কে কত ঘণ্টা রোযা রাখলো, সেটা মুখ্য বিষয় না। যে বেশি সময় ধরে সাওম পালন করছে আল্লাহ্ তার তাকওয়া দেখবেন। এটা তার জন্য একটা পরীক্ষা। আর কারও পক্ষে যদি এত দীর্ঘ সময়ব্যাপী রমযান মাসে সাওম পালন করা কষ্টকর হয়, তাহলে সে অন্য সময় কাযা আদায় করে নিবে। এই ‘অন্য সময়’ হতে পারে বছরের সবথেকে ছোট দিনগুলো- তাতেও কোন সমস্যা নেই।
আল্লাহ্ তো সে ঘোষণাও কুরআনে দিয়ে দিয়েছেন-
“রোজা নির্দিষ্ট কিছু দিন। তাই তোমাদের মধ্যে কেউ যদি অসুস্থ থাকে, বা সফরে থাকে, তাহলে পরে একই সংখ্যক দিন পূরণ করবে। আর যাদের জন্য রোজা রাখা ভীষণ কষ্টের, তাদের জন্য উপায় রয়েছে — তারা একই সংখ্যক দিন একজন গরিব মানুষকে খাওয়াবে। আর যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বাড়তি ভালো কাজ করে, সেটা তার জন্যই কল্যাণ হবে। রোজা রাখাটাই তোমাদের জন্যই ভালো, যদি তোমরা জানতে।”(২:১৮৪)
.
“…আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজটাই চান, তিনি তোমাদের জন্য কঠিনটা চান না।…”
(২:১৮৫)
অতএব, মেরু অঞ্চলে মুসলিমদের সালাত এবং সাওম পালনের সময়সূচী নিয়ে কোন প্রকার বিভ্রান্তির অবকাশ নেই। আল্লাহ্ আমাদের সকলকে সঠিক পথ বুঝার ও মানার তাওফিক দান করুন,আমিন।
লেখক : নয়ন চৌধুরী
সূর্যের উদয়-অস্ত দ্বারা রোজা ও নামাজের সময় নির্ধারণ সংক্রান্ত নাস্তিকদের প্রশ্ন ও জবাব !
তথ্যসূত্র:
বিস্তারিত প্রথম কমেন্টে ।
ইমাম আবু হানিফা (রহ.) বলেছেন, উত্তর মেরু ও দক্ষিণ মেরুর লোকজন মক্কা-মদিনা অথবা পার্শ্ববর্তী দেশ অনুযায়ী নামাজ-রোজা পালন করবে, ঈদের নামাজ পড়বে এবং অন্য ইবাদত করবে। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.)ও এ অভিমত পোষণ করেছেন। ( আল ফিকহুস সুনান )
তথ্যসূত্র:
ইমাম আবু হানিফা (রহ.) বলেছেন, উত্তর মেরু ও দক্ষিণ মেরুর লোকজন মক্কা-মদিনা অথবা পার্শ্ববর্তী দেশ অনুযায়ী নামাজ-রোজা পালন করবে, ঈদের নামাজ পড়বে এবং অন্য ইবাদত করবে। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.)ও এ অভিমত পোষণ করেছেন। ( আল ফিকহুস সুনান )
[১] http://www.worldometers.info/world-population/
[২] https://www.nationalgeographic.org/encyclopedia/north-pole/
[৩] https://www.coolantarctica.com/Antarctica%20fact%20file/science/can_you_live_in_antarctica.php
[৪] জামে’ তিরমিজি ২২৪০, সুনানে ইবেন মাজাহ ৪০৭৫, হাদিসে কুদসি ১৬২
[৫] https://islamqa.info/en/5842
[৬] https://islamqa.info/en/106527
[৭] https://www.thenationalnews.com/uae/ramadan/2024/03/07/ramadan-2024-which-countries-have-the-longest-fasting-hours-in-the-world/
[৮] https://www.express.co.uk/news/world/685123/fasting-ramadan-muslim-sun-set
[৯] https://www.sunrise-and-sunset.com/
[১০] সূরা আল-বাকারাহ ২:১৮৩
[১১] ফাসিঃ মুসনিদ ৮১পৃঃ
https://www.hadithbd.com/books/link/?id=4171
[১২] সূরা আল-বাকারাহ ২:১৮৪
[১৩] সূরা আল-বাকারাহ ২:১৮৫