কিছু নাস্তিক এবং মাজহাব বিদ্বেষী ব্যক্তি, বিশেষ করে তথাকথিত আহলে হাদীস মতবাদের কিছু অনুসারী, হানাফি মাযহাবের বিরুদ্ধে চরম অপপ্রচারে লিপ্ত হয়েছে। এরা হানাফি ফিকহের ফতোয়ার কিতাবসমূহ থেকে খন্ডিত বক্তব্য তুলে নিয়ে ভুল অনুবাদ ও মনগড়া ব্যাখ্যার মাধ্যমে সাধারণ মুসলিমদের বিভ্রান্ত করছে। তাদের এ অপপ্রচারের একটি ভয়াবহ উদাহরণ হলো – হানাফি মাযহাবে নাকি স্ত্রী অনুপস্থিত থাকলে নিজের মেয়েকে ধর্ষণ করা জায়েজ! আল-ইয়াযু বিল্লাহ।
তারা তাদের দাবির পক্ষে 'ফতোয়ায়ে আলমগীরী' নামক প্রসিদ্ধ হানাফি ফতোয়ার কিতাব থেকে একটি মাসয়ালার খণ্ডিত বক্তব্য উদ্ধৃত করেছে।
মূল বক্তব্যটি হচ্ছে:
وَحَدُّ الشَّهْوَةِ فِي الرَّجُلِ أَنْ تَنْتَشِرَ آلَتُهُ أَوْ تَزْدَادَ انْتِشَارًا إنْ كَانَتْ مُنْتَشِرَةً، كَذَا فِي التَّبْيِينِ. وَهُوَ الصَّحِيحُ، كَذَا فِي جَوَاهِرِ الْأَخْلَاطِيِّ. وَبِهِ يُفْتَى، كَذَا فِي الْخُلَاصَةِ. فَمَنْ انْتَشَرَتْ آلَتُهُ فَطَلَبَ امْرَأَتَهُ وَأَوْلَجَهَا بَيْنَ فَخِذَيْ ابْنَتِهَا لَا تَحْرُمُ عَلَيْهِ أُمُّهَا مَا لَمْ تَزْدَدْ انْتِشَارًا، كَذَا فِي التَّبْيِينِ
অর্থাৎ "পুরুষের জন্য কামনার সীমা (চিহ্ন) হলো তার যৌনাঙ্গ উত্তেজিত হওয়া, অথবা (আগে থেকে উত্তেজিত থাকলে) উত্তেজনা বৃদ্ধি পাওয়া। এ কথাটি 'আত-তাবইইন' গ্রন্থে আছে। এটাই হলো সঠিক মত। এ কথাটি ‘জাওয়াহিরুল আখলাতি’ গ্রন্থেও আছে। এ মত অনুযায়ীই ফতোয়া দেওয়া হয়। এ কথাটি ‘আল-খুলাসা’ গ্রন্থেও আছে। অতএব, যার যৌনাঙ্গ উত্তেজিত হয়েছে, তারপর সে তার স্ত্রীকে কামনা করেছে, এবং তার যৌনাঙ্গকে তার স্ত্রীর কন্যার উরুর মাঝে প্রবেশ করিয়েছে, তাহলে ঐ মেয়ের মা (অর্থাৎ স্ত্রী) তার জন্য হারাম হবে না, যতক্ষণ না (তার যৌনাঙ্গের) উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি পায়। এ কথাটি 'আত-তাবইইন' গ্রন্থে আছে।"
কিন্তু সমস্যা
হলো , ইসলাম বিদ্বেষী ও মাজহাব বিদ্বেষী কতিপয় আহলে হাদীস ভাইয়েরা শুধু একজন অনুবাদকের অনুবাদ দেখিয়ে অর্থাৎ,
" [ যদি কোনো ব্যক্তির জননেন্দ্রিয় উত্থিত হয়, অত:পর সে তার স্ত্রীকে সহবাসের উদ্দেশ্যে তলব (তালাশ) করে, কিন্তু তাকে না পেয়ে যদি সে তার স্ত্রীর মেয়ের দুই রানের মাঝে তার জননেন্দ্রিয় প্রবেশ করায়, তাহলে ওই মেয়ের মা (অর্থাৎ ঐ স্ত্রী) তার স্বামীর জন্য হারাম হবেনা ] "
এতটুকু উল্লেখ করে বলে থাকেন যে,
এই অনুবাদ দ্বারাই তারা দাবি করছে যে, হানাফি মাযহাবে নিজের মেয়ের সাথে সঙ্গম করা জায়েজ!
আসলে এখানে কী আলোচনা হয়েছে?
উক্ত মাসয়ালা এসেছে ফিকহে হানাফির এমন একটি অধ্যায়ে, যার আলোচ্য বিষয় হলো "হুরমতে মুসাহারা" — অর্থাৎ, বৈবাহিক সম্পর্কের কারণে কোনো নারীর সাথে চিরতরে বিবাহ হারাম হয়ে যাওয়ার বিধান। এটি সঙ্গম, স্পর্শ, দৃষ্টি বা চুম্বন ইত্যাদির দ্বারা সৃষ্ট সম্পর্কের পরিণতির বিধান বর্ণনায় রচিত হয়েছে, যৌন অপরাধ বা বিচারিক শাস্তির অধ্যায় নয়। অর্থাৎ এখানে ,
১️। উরুর মাঝখানে রাখা মানেই যৌনসঙ্গম নয়। দুই রানের মাঝে উত্তেজিত লিঙ্গ রাখা (মুসাহারা বা ঘর্ষণ) এবং সঙ্গম (ভিতরে প্রবেশ) ফিকহের দৃষ্টিতে ভিন্ন বিষয়।
২️। এই ঘটনাটি নাজায়েজ/হারাম কর্ম হলেও, উদ্দেশ্য হচ্ছে এটা দ্বারা স্ত্রী হারাম হবে কিনা সে বিষয়ে। এটি যৌনতা বা ধর্ষণের বৈধতা প্রদান নয়। বরং এই কর্মটি কামভাবের জন্য না হয়ে যদি কল্পনা কেন্দ্রিক হয় (স্ত্রীকেন্দ্রিক) এবং এতে নতুন উত্তেজনা সৃষ্টি না হয়, তবে স্ত্রী হারাম হবে না—এই হুকুম আলোচনার বিষয়।
৩। কে কার সাথে যৌনসম্পর্ক করতে পারবে, কোনটা বৈধ আর কোনটা অবৈধ, কিংবা আইনি দৃষ্টিকোণ থেকে কোনটি অপরাধ এবং কোনটি নয়, কোন অপরাধের কী শাস্তি — এসব বিষয় এখানে আলোচনার বিষয়বস্তু নয়। যাঁরা ফিকাহ ও ফাতওয়ার বই সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা রাখেন, তাঁরা জানেন যে, এসব বিষয়ে ফিকাহের গ্রন্থগুলোতে পৃথক পৃথক অধ্যায় রয়েছে, যেখানে শরীয়তের আলোকে বিস্তারিত বিধান উল্লেখ করা হয়েছে।
যদি প্রকৃত সঙ্গম হতো, তাহলে কি হুকুম হতো?
হানাফি ফিকহের বহু কিতাবে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে:
"لو وطئ أم امرأته أو بنتها حرمت عليه امرأته"
অর্থাৎ, যদি কোনো ব্যক্তি স্ত্রীর মা বা মেয়ের সাথে সঙ্গম করে, তাহলে তার স্ত্রী চিরতরে তার জন্য হারাম হয়ে যাবে। 1
এমনকি জোরপূর্বক (বাধ্য হয়ে) হলেও এমন সঙ্গমে স্ত্রী হারাম হয়ে যায়:
"لو أكره على وطئ أم زوجته أو بنتها تحرم عليه زوجته"
অর্থাৎ যদি কোনো ব্যক্তিকে তার শ্বাশুড়ি কিংবা মেয়ের সাথে সহবাসে বাধ্য করা হয়, তাহলেও তার জন্য তার স্ত্রী হারাম হয়ে যাবে।2
সুতরাং, দুই রানের মাঝখানে উত্তেজিত লিঙ্গ রাখার দ্বারা যদি স্ত্রী হারাম না হয়, তাহলে এটি যৌনসঙ্গম নয়—এটাই প্রমাণিত হয়।
আর হানাফি মাযহাবে নিজ মেয়েকে তার প্রতি কামভাবের সাথে স্পর্শ করলেও স্ত্রী হারাম হয়ে যায়।
ফতোয়ায়ে আলমগীরীতেই আছে:
"إذا مد يده إلى امرأة بشهوة فوقعت على أنف ابنتها فازدادت شهوته حرمت عليه امرأته"
অর্থাৎ, যদি কেউ স্ত্রীর দিকে কামভাব নিয়ে হাত বাড়ায় কিন্তু সেই হাত মেয়ের নাকে পড়ে এবং এতে কামোদ্দীপনা বেড়ে যায়, তাহলে স্ত্রী হারাম হয়ে যাবে।3
এখানে স্পষ্ট বোঝা যায়, যেখানে কামভাব নিয়ে মেয়েকে স্পর্শ করলেই স্ত্রী হারাম হয়ে যায়, সেখানে মেয়ের সাথে সঙ্গম জায়েজ বলার কোনো সুযোগই নেই। বরং এটি এক ঘৃণ্য মিথ্যাচার।
নিজ কন্যার সাথে সঙ্গম করা ইসলামে চরম হারাম ও জঘন্য গুনাহ। সকল মাযহাব, সকল ইমাম, সকল যুগের ওলামাগণ একবাক্যে এ গর্হিত কাজকে নিষিদ্ধ বলেছেন। মাযহাবী, লা-মাযহাবী, সালাফ, খালাফ- সবার মতেই এটা হারাম। হানাফি, শাফেয়ী, মালেকী, হাম্বলী- সব মাযহাবেই এটা হারাম। হানাফি মাযহাবও এ বিষয়ে কঠিন হুকুম প্রদান করেছে। সুতরাং যারা ফতোয়ায়ে আলমগীরীর একটি মাসয়ালার খণ্ডিত অংশ এবং ত্রুটিপূর্ণ অনুবাদ দেখিয়ে বলছে যে হানাফি মাযহাবে মেয়েকে ধর্ষণ করা জায়েজ, তারা মূলত মাযহাব বিদ্বেষে অন্ধ হয়ে চরম ধোঁকাবাজি ও মিথ্যাচারে লিপ্ত হয়েছে।
আল্লাহ আমাদেরকে সঠিক জ্ঞান ও বুঝদানের মাধ্যমে দীন বুঝার তাওফিক দান করুন এবং বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা করুন। আমীন।