Are you sure?

হাদিস »  বিবিধ

কুরআন বোঝা সহজ হলে হাদিস ও তাফসীর পড়ার প্রয়োজন হয় কেন?

কুরআন কী সহজ?

মহান আল্লাহ কুরআন সহজ করে দেয়ার মানে এই না যে কোনো মানুষ কুরআন পড়লেই সবকিছু সহজে বুঝে যাবে।

মহান আল্লাহ বলেন ,

اَفَلَا یَتَدَبَّرُوۡنَ الۡقُرۡاٰنَ  اَمۡ عَلٰی قُلُوۡبٍ اَقۡفَالُہَا

তা কি কুরআন সম্বন্ধে গভীরভাবে চিন্তা করে না, না তাদের অন্তরে তালা দেয়া আছে? (সূরা মুহাম্মদ ৪৭:২৪)

কুরআনের সবকিছু যদি সহজেই বোঝা যেত তাহলে মহান আল্লাহ কুরআন নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করার কথা বলতেন না। কুরআনকে দুইটি ক্ষেত্রে সহজ করে দেয়া হয়েছে। যথা:

  • ১) আরবী ভাষায়।
  • ২) উপদেশ গ্রহন। 

প্রথমত আরবী ভাষায় কুরআন সহজ করে দেয়া হয়েছে।

মহান আল্লাহ বলেন, فَاِنَّمَا یَسَّرۡنٰہُ  بِلِسَانِکَ لَعَلَّہُمۡ یَتَذَکَّرُوۡنَ–

আমি তোমার (রাসূলুল্লাহ ﷺ)ভাষায় কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে। (সূরা আদ-দুখান ৪৪:৫৮)

যেকোনো বইয়ের ক্ষেত্রেই অনুবাদ থেকে ততটা মর্মার্থ বোঝা যায় না যতটা মূল ভাষা থেকে বোঝা যায়।এছাড়াও অনুবাদের ক্ষেত্রে কিছু না কিছু ত্রুটি থাকে।যেহেতু আল-কুরআন আরবী ভাষায় নাযিল হয়েছে,তাই স্বাভাবিকভাবেই আরবীতে সহজ।কুরআন যদি আরবীতে সহজবোধ্য না হতো তাহলে আরবরাই এর মর্মার্থ বুঝত না,ফলে উপদেশ গ্রহণ করা কঠিন হয়ে যেত।কিন্তু আল্লাহ তার অশেষ রহমতে কুরআনকে আরবী ভাষায় সহজ করে দিয়েছেন। সুতরাং অনুবাদ পড়ে কুরআনকে সহজ বলে দাবী করা নিতান্তই বোকামি। দ্বিতীয়ত, উপদেশ গ্রহণের জন্য কুরআনকে সহজ করে দেয়া হয়েছে।

মহান আল্লাহ বলেছেন, وَ لَقَدۡ یَسَّرۡنَا الۡقُرۡاٰنَ  لِلذِّکۡرِ  فَہَلۡ مِنۡ مُّدَّکِرٍ– আমি কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি উপদেশ গ্রহণের জন্য, উপদেশ গ্রহণ করার কেউ আছে কি? (সূরা ক্বামার  ৫৪:১৭, ২২, ৩২, ৪০)

উল্লেখ্য যে,আরবী ذِكْر শব্দের অর্থ দুইটা হতে পারে।যথা: ১) মুখস্ত করা ২) উপদেশ ও শিক্ষা গ্রহণ করা।

এক্ষেত্রে উভয় অর্থই সঠিক। কারণ কুরআনই একমাত্র গ্রন্থ যা লক্ষ লক্ষ মানুষের এমনকি অনেক ৬/৭ বছরের বাচ্চারও মুখস্ত। আরবী ভাষা জানেনা এমন অহরহ মানুষেরও কুরআন মুখস্ত।মহান আল্লাহ যদি সহজ করে না দিতেন তাহলে এরকমটা কখনোই সম্ভব হতো না। আর কুরআন উপদেশ গ্রহণ করার জন্য সহজ,ফলে আলেম,বিশেষজ্ঞ,মূর্খ যারা উপদেশ গ্রহণ করতে চায় তারা উপদেশ গ্রহণ করতে পারে।হালাল-হারাম,ইবাদত সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত থাকায় সহজেই আলেম,কিংবা সাধারণ মানুষ(যারা উপদেশ গ্রহণ করতে চায়) সহজেই কুরআন থেকে শিক্ষা নিতে পারে। তবে কুরআন থেকে উপদেশ গ্রহণ করা সহজ হওয়ার মানে এই না একজন সাধারণ মানুষ সহজে সব বিধিবিধান বের করতে পারবে না।যেমনঃ কুরআনে সালাত আদায় করতে বলা হয়েছে।কিন্তু কিভাবে সালাত আদায় করতে হবে,কতটুকু সমসয়ের মধ্যে করতে হবে ইত্যাদি বিষয় জানার ক্ষেত্রে রাসূল ﷺ এর অনুসরণ করতে হবে।আর রাসূল ﷺ  এর অনুসরণ করা কুরআনবিরোধী না, অথবা এর দ্বারা কুরআন অপূর্ণ বলে প্রমাণিত হয় না। কারণ কুরআনেই রাসূল ﷺ  কে  অনুসরণ করতে বলা হয়েছে। অতএব এ থেকে জানা গেল যে মুখস্ত করা উপদেশ গ্রহণ করার ক্ষেত্রেও কুরআনকে সহজ করে দেয়া হয়েছে।অন্য কোনো ক্ষেত্রে মহান আল্লাহ কুরআনকে সহজ বলেননি। উপরোক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয় যে মহান আল্লাহ কুরআনকে মুখস্ত করা, উপদেশ গ্রহণের জন্য সহজ করে দিয়েছে। কিন্তু ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগকারী নাস্তিকরা কি মুখস্ত করা কিংবা উপদেশ গ্রহণ করার জন্য কুরআন পড়ে?নিশ্চয় না।তাদের উদ্দেশ্যই হলো কুরআনের ভুল ব্যাখ্যা করা,ইসলাম অবমাননা করা। তাহলে কিভাবে কুরআন তাদের জন্য সহজ হতে পারে? কুরআন উপদেশ গ্রহণ করার জন্য সহজ করে দেয়া হয়েছে। সুতরাং যারা উপদেশ গ্রহণ করতে চায় তাদের জন্য কুরআন সহজ।এখন প্রশ্ন আসে যে,কারা উপদেশ গ্রহণ করে।একথাও কুরআনে বলে দেয়া হয়েছে।

মহান আল্লাহ তা'য়ালা বলেছেন, یُّؤۡتِی الۡحِکۡمَۃَ مَنۡ یَّشَآءُ ۚ وَ مَنۡ یُّؤۡتَ الۡحِکۡمَۃَ فَقَدۡ اُوۡتِیَ خَیۡرًا کَثِیۡرًا ؕ وَ مَا یَذَّکَّرُ  اِلَّاۤ  اُولُوا الۡاَلۡبَابِ– যাকে ইচ্ছে তিনি হিকমাত দান করেন এবং যে ব্যক্তি এ জ্ঞানপ্রাপ্ত হয়, নিঃসন্দেহে সে মহাসম্পদ প্রাপ্ত হয় এবং উপদেশ তারাই গ্রহণ করে, যারা জ্ঞানী। (সূরা বাকারা ২:২২৯)

اَفَمَنۡ یَّعۡلَمُ اَنَّمَاۤ  اُنۡزِلَ  اِلَیۡکَ مِنۡ رَّبِّکَ الۡحَقُّ کَمَنۡ ہُوَ اَعۡمٰی ؕ اِنَّمَا یَتَذَکَّرُ اُولُوا الۡاَلۡبَابِ– যে ব্যক্তি জানে যে, তোমার(রাসূল ﷺ) প্রতিপালকের নিকট থেকে তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তা সত্য, সে কি ঐ ব্যক্তির সমান যে অন্ধ? বুদ্ধিমান লোকেরাই উপদেশ গ্রহণ করে থাকে।(সূরা আর-রাদ ১৩:১৯)

ہٰذَا بَلٰغٌ  لِّلنَّاسِ وَ لِیُنۡذَرُوۡا بِہٖ وَ لِیَعۡلَمُوۡۤا اَنَّمَا ہُوَ  اِلٰہٌ  وَّاحِدٌ  وَّ لِیَذَّکَّرَ اُولُوا  الۡاَلۡبَابِ– এটা মানুষদের জন্য একটা বার্তা যার দ্বারা তাদেরকে সতর্ক করা হচ্ছে আর যাতে তারা জানতে পারে যে, তিনি এক ইলাহ আর যাতে বুদ্ধিমান মানুষেরা উপদেশ লাভ করে। (সূরা ইব্রাহিম ১৪:৫২)

کِتٰبٌ  اَنۡزَلۡنٰہُ  اِلَیۡکَ مُبٰرَکٌ  لِّیَدَّبَّرُوۡۤا اٰیٰتِہٖ وَ  لِیَتَذَکَّرَ  اُولُوا الۡاَلۡبَابِ– এটি একটি কল্যাণময় কিতাব তোমার কাছে অবতীর্ণ করেছি যাতে তারা এর আয়াতগুলোর প্রতি চিন্তা-ভাবনা করে, আর জ্ঞান-বুদ্ধিসম্পন্ন লোকেরা উপদেশ গ্রহণ করে থাকে। (সূরা  সোয়াদ  ৩৮:২৯)

 قُلۡ ہَلۡ  یَسۡتَوِی الَّذِیۡنَ یَعۡلَمُوۡنَ وَ الَّذِیۡنَ لَا یَعۡلَمُوۡنَ ؕ اِنَّمَا یَتَذَکَّرُ  اُولُوا الۡاَلۡبَابِ– বল যারা জানে আর যারা জানে না, তারা কি সমান? বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন লোকেরাই কেবল উপদেশ গ্রহণ করে থাকে। (সূরা যুমার ৩৯:৯)

ہُوَ الَّذِیۡ یُرِیۡکُمۡ  اٰیٰتِہٖ وَ  یُنَزِّلُ  لَکُمۡ مِّنَ السَّمَآءِ رِزۡقًا ؕ وَ مَا یَتَذَکَّرُ اِلَّا مَنۡ یُّنِیۡبُ– তিনি তাঁর নিদর্শনাবলী তোমাদেরকে দেখান আর আকাশ থেকে তোমাদের জন্য রিযক অবতীর্ণ করেন. আল্লাহ-অভিমুখীরা ছাড়া কেউ উপদেশ গ্রহণ করে না। (সূরা মুমিন ৪০:১৩)

اِنَّ  فِیۡ  ذٰلِکَ لَذِکۡرٰی لِمَنۡ کَانَ لَہٗ  قَلۡبٌ اَوۡ  اَلۡقَی  السَّمۡعَ وَ  ہُوَ  شَہِیۡدٌ– এতে অবশ্যই উপদেশ রয়েছে তার জন্য যার আছে (বোধশক্তিসম্পন্ন) অন্তর কিংবা যে খুব মন দিয়ে কথা শুনে। (সূরা ক্বাফ ৫০:৩৭)

সুতরাং বোধশক্তিসম্পন্ন, বুদ্ধিমান,আল্লাহ অভিমুখী ও মনোযোগ দিয়ে কুরআন শ্রবণকারী লোকেরাই উপদেশ গ্রহণ করে। ফলে তাদের জন্য কুরআন সহজ। কিন্তু নাস্তিক এবং অপবাদদাতা অমুসলিমদের কী উপরোক্ত গুণ আছে?তারা কি আল্লাহ অভিমুখী? তারা কী মনোযোগ দিয়ে কুরআন শ্রবণ করে? নিশ্চয় না। আর একজন সুস্থ বিবেক-বোধশক্তিসম্পন্ন মানুষ নিশ্চয় বলবে না যে কোনো কিছু আপনা আপনিই অস্তিত্বে চলে এসেছে যেমনটা নাস্তিকরা বলে। যারা শুধু নিজেদের অসৎ কামনা পূরণ করতে কুরআন নিয়ে মিথ্যাচার করে তারা আর যাই হোক না কেন,বুদ্ধিমান নয়। সুতরাং উপদেশ গ্রহণকারীদের যেসকল বৈশিষ্ট্য আছে তার কোনোটাই নাস্তিক বা অমুসলিমদের মধ্যে দেখা যায় না।তাই তাদের কাছে কুরআন সহজ হওয়া অসম্ভব।

মহান আল্লাহ তাদের ব্যাপারে যথার্থই বলেছেন ,وَ لَقَدۡ صَرَّفۡنَا فِیۡ ہٰذَا  الۡقُرۡاٰنِ  لِیَذَّکَّرُوۡا ؕ وَ  مَا  یَزِیۡدُہُمۡ   اِلَّا  نُفُوۡرًا– আমি এ কুরআনে নানাভাবে (বিষয়াবলী) ব্যাখ্যা করেছি যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে, কিন্তু তা তাদের (সত্য হতে) পলায়নের মনোবৃত্তিই বৃদ্ধি করেছে।(সূরা বানী ইসরাঈল ১৭:৪১)

وَ اِذَا قَرَاۡتَ الۡقُرۡاٰنَ جَعَلۡنَا بَیۡنَکَ وَ بَیۡنَ  الَّذِیۡنَ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ بِالۡاٰخِرَۃِ حِجَابًا مَّسۡتُوۡرًا  ﴿ۙ۴۵﴾وَّ جَعَلۡنَا عَلٰی قُلُوۡبِہِمۡ  اَکِنَّۃً  اَنۡ یَّفۡقَہُوۡہُ  وَ فِیۡۤ  اٰذَانِہِمۡ وَقۡرًا ؕ وَ اِذَا ذَکَرۡتَ رَبَّکَ فِی الۡقُرۡاٰنِ وَحۡدَہٗ  وَلَّوۡا عَلٰۤی  اَدۡبَارِہِمۡ  نُفُوۡرًا– তুমি যখন কুরআন পাঠ কর তখন আমি তোমার আর যারা আখেরাতে বিশ্বাস করে না তাদের মাঝে একটা অদৃশ্য পর্দা স্থাপন ক’রে দিয়েছি। আর আমি তাদের অন্তরের উপর এক আবরণ দিয়ে দিয়েছি যাতে তারা কুরআন বুঝতে না পারে, আর তাদের কানে সৃষ্টি করেছি বধিরতা। আর যখন তুমি কুরআনে তোমার প্রতিপালকের একত্বের উল্লেখ কর, তখন তারা (সত্য থেকে) পালিয়ে পিছনে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। (সূরা বানী ইসরাঈল ১৭:৪৫-৪৬)

وَ اِذَا  ذُکِّرُوۡا لَا یَذۡکُرُوۡنَ– তাদেরকে উপদেশ দেয়া হলে তারা উপদেশ নেয় না। (সূরা আস-সাফফাত ৩৭:১৩)

অতএব নাস্তিকরা তাদের নিজের দোষের কারণেই কুরআন বুঝতে পারে না ও তারা উপদেশ গ্রহণ করে না।কুরআন সহজ হওয়ার কোনো শর্তই তাদের মধ্যে পাওয়া যায় না।সুতরাং এটা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো যে,নাস্তিক ও অমুসলিমদের জন্য কুরআন সহজ না।

 

কুরআন বুঝতে হাদিস প্রয়োজন কেন?

সাধারণত রাসূল ﷺ এর কথা,কাজ ও মৌনসম্মতিকে হাদিস বলা হয়। মহনবী হজরত মুহাম্মদ ﷺ এর প্রতি কুরআন অবতীর্ণ হয়েছিল।

মহান আল্লাহ তার ব্যাপারে বলেছেন, لَقَدۡ کَانَ لَکُمۡ  فِیۡ رَسُوۡلِ اللّٰہِ  اُسۡوَۃٌ حَسَنَۃٌ  لِّمَنۡ کَانَ یَرۡجُوا اللّٰہَ وَ الۡیَوۡمَ  الۡاٰخِرَ  وَ ذَکَرَ  اللّٰہَ  کَثِیۡرًا–তোমাদের জন্য আল্লাহর রসূলের মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে যারা আল্লাহ ও শেষ দিনের আশা রাখে আর আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে। (সূরা আল-আহযাব ৩৩:২১)

 আল্লাহ তা'য়ালা তাকে কুরআন স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেয়ার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। মহান আল্লাহ বলেন, بِالۡبَیِّنٰتِ وَ الزُّبُرِ ؕ وَ اَنۡزَلۡنَاۤ  اِلَیۡکَ الذِّکۡرَ  لِتُبَیِّنَ  لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ  اِلَیۡہِمۡ وَ لَعَلَّہُمۡ  یَتَفَکَّرُوۡنَ– (অতীতের রসূলদেরকে পাঠিয়েছিলাম) স্পষ্ট প্রমাণাদি আর কিতাব দিয়ে; আর এখন তোমার(রাসূল ﷺ) প্রতি কুরআন অবতীর্ণ করছি মানুষকে স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য যা তাদের প্রতি অবতীর্ণ করা হয়েছে আর যাতে তারা চিন্তা-ভাবনা করে। (সূরা আন-নাহল ১৬:৪৪)

کَمَاۤ  اَرۡسَلۡنَا فِیۡکُمۡ رَسُوۡلًا مِّنۡکُمۡ یَتۡلُوۡا عَلَیۡکُمۡ  اٰیٰتِنَا وَ یُزَکِّیۡکُمۡ وَ یُعَلِّمُکُمُ الۡکِتٰبَ وَ الۡحِکۡمَۃَ وَ یُعَلِّمُکُمۡ مَّا لَمۡ تَکُوۡنُوۡا تَعۡلَمُوۡنَ– যেমন (তোমরা আমার একটি অনুগ্রহ লাভ করেছ যে) আমি তোমাদেরই মধ্য হতে তোমাদের কাছে একজন রসূল পাঠিয়েছি, যে আমার আয়াতগুলো তোমাদেরকে পড়ে শুনায়, তোমাদেরকে শুদ্ধ করে, তোমাদেরকে কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দেয় এবং তোমাদেরকে এমন সব বিষয় শিক্ষা দেয় যা তোমরা জানতে না। (সূরা বাকারা ২:১৫১)

لَقَدۡ مَنَّ اللّٰہُ عَلَی الۡمُؤۡمِنِیۡنَ اِذۡ بَعَثَ فِیۡہِمۡ رَسُوۡلًا مِّنۡ اَنۡفُسِہِمۡ یَتۡلُوۡا عَلَیۡہِمۡ اٰیٰتِہٖ وَ یُزَکِّیۡہِمۡ وَ یُعَلِّمُہُمُ الۡکِتٰبَ وَ الۡحِکۡمَۃَ ۚ وَ  اِنۡ کَانُوۡا مِنۡ قَبۡلُ لَفِیۡ ضَلٰلٍ مُّبِیۡنٍ– নিশ্চয় আল্লাহ মু’মিনদের প্রতি অত্যন্ত অনুকম্পা প্রদর্শন করেছেন, যখন তাদের নিকট তাদের নিজস্ব একজনকে রসূল করে পাঠিয়েছেন, সে তাদেরকে আল্লাহর আয়াত পড়ে শুনাচ্ছে, তাদেরকে পরিশোধন করছে, তাদেরকে কিতাব ও হিকমাত (সুন্নাহ) শিক্ষা দিচ্ছে, যদিও তারা পূর্বে সুস্পষ্ট গোমরাহীতে ছিল। (সূরা ইমরান ৩:১৬৪)

রাসূল ﷺ-কে নিজের মনগড়া কিছু শিক্ষা দিতেন না, তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা ওহী থেকে অন্যদের শিক্ষা দিতেন।আর মহান আল্লাহ তাকে জিব্রাইল علیہ السلام এর মাধ্যমে শিক্ষা দিয়েছেন। যেমনটা কুরআনে বলা হয়েছে,وَ مَا یَنۡطِقُ عَنِ  الۡہَوٰی  ؕ﴿۳﴾اِنۡ  ہُوَ   اِلَّا  وَحۡیٌ  یُّوۡحٰی  ۙ﴿۴﴾عَلَّمَہٗ  شَدِیۡدُ الۡقُوٰی– আর সে মনগড়া কথাও বলে না।তাতো ওয়াহী যা তার প্রতি প্রত্যাদেশ করা হয়।তাকে শিক্ষা দেয় এক শক্তিশালী সত্ত্বা (জিবরাঈল علیہ السلام) (সূরা নাজম ৫৩:৩-৫)

সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে কুরআন বোঝানোর জন্য সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য শিক্ষক হচ্ছেন আমাদের প্রিয় রাসূলুল্লাহ ﷺ। আর কুরআন যদি সবাই সহজেই বুঝতে পারত তাহলে মহান আল্লাহ তা বুঝিয়ে দেয়ার জন্য রাসূল পাঠাতেন না। তাই কুরআনের সঠিক মর্মার্থ বুঝতে অবশ্যই রাসূল ﷺ এর অনুসরণ করতে হবে। এছাড়াও মহান আল্লাহ তাকে অনুসরণের ও আনুগত্যের আদেশ দিয়েছেন। মহান আল্লাহ বলেন,قُلۡ  اِنۡ کُنۡتُمۡ تُحِبُّوۡنَ اللّٰہَ فَاتَّبِعُوۡنِیۡ یُحۡبِبۡکُمُ اللّٰہُ وَ یَغۡفِرۡ لَکُمۡ ذُنُوۡبَکُمۡ ؕ وَ اللّٰہُ غَفُوۡرٌ  رَّحِیۡمٌ– বলে দাও, ‘যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তবে আমার অনুসরণ কর, আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের গুনাহসকল ক্ষমা করবেন, বস্তুতঃ আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’। (সূরা আল-ইমরান ৩:৩১)

وَ اَطِیۡعُوا اللّٰہَ وَ الرَّسُوۡلَ لَعَلَّکُمۡ تُرۡحَمُوۡنَ– আল্লাহর ও রসূলের আনুগত্য কর, যাতে তোমরা কৃপাপ্রাপ্ত হতে পার। (সূরা আল-ইমরান ৩:১৩২)

تِلۡکَ حُدُوۡدُ اللّٰہِ ؕ وَ مَنۡ یُّطِعِ اللّٰہَ وَ رَسُوۡلَہٗ یُدۡخِلۡہُ جَنّٰتٍ تَجۡرِیۡ مِنۡ تَحۡتِہَا الۡاَنۡہٰرُ خٰلِدِیۡنَ فِیۡہَا ؕ وَ ذٰلِکَ الۡفَوۡزُ  الۡعَظِیۡمُ– এসব আল্লাহর নির্ধারিত সীমা এবং যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং তাঁর রসূলের অনুসরণ করবে, আল্লাহ তাকে জান্নাতে দাখিল করবেন, যার পাদদেশে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত, তারা তাতে চিরবাসী হবে এবং এটা বিরাট সাফল্য। (সূরা নিসা ৪:১৩)

وَ مَاۤ اَرۡسَلۡنَا مِنۡ رَّسُوۡلٍ اِلَّا لِیُطَاعَ بِاِذۡنِ اللّٰہِ ؕ وَ لَوۡ اَنَّہُمۡ اِذۡ ظَّلَمُوۡۤا اَنۡفُسَہُمۡ جَآءُوۡکَ فَاسۡتَغۡفَرُوا اللّٰہَ وَ اسۡتَغۡفَرَ لَہُمُ الرَّسُوۡلُ لَوَجَدُوا اللّٰہَ تَوَّابًا  رَّحِیۡمًا– আমি রসূল এ উদ্দেশেই প্রেরণ করেছি, যেন আল্লাহর নির্দেশে তাঁর আনুগত্য করা হয়। যখন তারা নিজেদের উপর যুলম করেছিল, তখন যদি তোমার নিকট চলে আসত আর আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থী হত এবং রসূলও তাদের পক্ষে ক্ষমা চাইত, তাহলে তারা আল্লাহকে নিরতিশয় তাওবাহ কবূলকারী ও পরম দয়ালুরূপে পেত। (সূরা নিসা ৪:৬৪)

مَنۡ یُّطِعِ الرَّسُوۡلَ فَقَدۡ اَطَاعَ اللّٰہَ ۚ– যে রসূলের আনুগত্য করল, সে তো আল্লাহরই আনুগত্য করল।(সূরা নিসা ৪:৮০)

অতএব রাসূল ﷺ  এর কথা,আদেশ-নিষেধ মেনে চলার মাধ্যমে সে প্রকৃতপক্ষে আল্লাহরই আনুগত্য করবে।কারণ এই আদেশ-নিষেধগুলো প্রকৃতপক্ষে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে,তার নিজের মনগড়া কোনো কথা নয়।তাই কুরআন বুঝতে হলে অবশ্যই রাসূলুল্লাহ ﷺ কে এর অনুসরণ করতে হবে। কিন্তু আমরা রাসূলুল্লাহ ﷺ  এর অনুসরণ কিভাবে করব?তার আদেশ-নিষেধ কোথা থেকে পাবো?আমরা তো তার সাক্ষাৎ পাইনি।ইতিহাস ও রাসূল ﷺ  এর জীবনী সংক্রান্ত গ্রন্থ থেকে তো তার ব্যাপারে সবকিছু জানা যায় না। সুতরাং রাসূল ﷺ-কে পরিপূর্ণভাবে অনুসরণ করতে হলে,তার কথা, কাজ-কর্ম,আদেশ-নিষেধ ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে হলে আমাদেরকে হাদিসশাস্ত্র চর্চা করতে হবে।কারণ হাদিস থেকেই মহানবী ﷺ এর কথা,কাজ-কর্ম,আদেশ-নিষেধ ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত ভাবে জানা যায়।

একজন মানুষ কখন ঐতিহাসিক বা সমসাময়িক কোনো ঘটনাকে সত্য বলে মেনে নেয়? যখন সে নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে খবরটা পায়। রাসূল ﷺ  কি কথা বলেছেন, কখন এবং কীভাবে কোনো কাজ করেছেন, তিনি কি আদেশ-নিষেধ করেছেন তা সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছে সাহাবীরা, তারা রাসূল ﷺ এর বর্ণিত কথা অর্থাৎ হাদিস মুখস্ত করে রাখত,তার কাছ থেকেই দ্বীনের যাবতীয় বিষয় সম্পর্কে শিক্ষা গ্রহণ করত।সাহাবীদের থেকে যারা শিক্ষা গ্রহণ করেছেন তাদেরকে বলে তাবেয়ী,তাবেয়ীদের থেকে যারা শিক্ষাগ্রহণ করেছে তাদেরকে বলে তাবে-তাবেয়ীন।এভাবে রাসূলুল্লাহ ﷺ  এর শিক্ষা প্রত্যেক যুগের মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে। আর হাদিসশাস্ত্রে এই তথ্য বর্ণনাকারী এবং তথ্যের উৎসের ব্যাপারেও বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এজন্য হাদিসের মাধ্যমে আমরা রাসূল ﷺ  এর কথা,কাজ,সম্মতি,আদেশ-নিষেধ ইত্যাদি জানার ক্ষেত্রে একটা নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্র পেয়ে যাচ্ছি। ফলে হাদিসের মাধ্যমে পরিপূর্ণ ও নির্ভুলভাবে রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে অনুসরণ করা সম্ভব হচ্ছে। মহান আল্লাহ উপদেশ গ্রহণের জন্য কুরআনকে সহজ করে দিয়েছেন।কুরআনে রাসূল ﷺ কে অনুসরণের উপদেশ দেয়া হয়েছে এবং হাদিসের মাধ্যমে রাসূল ﷺ  কে সঠিকভাবে অনুসরণ করা যায়।সুতরাং হাদিস পড়ার মাধ্যমে কুরআন সহজ হয়ে যায়।

 

কুরআন বুঝতে তাফসীর কেন প্রয়োজন?

তাফসীর (تفسير) শব্দটি আরবী শব্দমূল ফা-সিন-রা(فسر)  থেকে উৎপত্তি হয়ছে যার অর্থঃ ব্যাখ্যা করা, বিস্তৃত করা, খোলাসা করা ।কুরআনের ব্যাখ্যা করাকে তাফসীর বলে। মহান আল্লাহ অল্প শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমেই কুরআনে বিভিন্ন বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

আল্লাহ তা'য়ালা বলেছেন, وَ نَزَّلۡنَا عَلَیۡکَ الۡکِتٰبَ تِبۡیَانًا  لِّکُلِّ شَیۡءٍ وَّ ہُدًی وَّ رَحۡمَۃً وَّبُشۡرٰی لِلۡمُسۡلِمِیۡنَ – আমি তোমার প্রতি এ কিতাব নাযিল করেছি যা প্রত্যেকটি বিষয়ের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা, সত্য পথের নির্দেশ, রহমাত আর আত্মসমর্পণকারীদের জন্য সুসংবাদ স্বরূপ। (সূরা নাহল ১৬:৮৯)

وَ لَقَدۡ صَرَّفۡنَا فِیۡ ہٰذَا  الۡقُرۡاٰنِ  لِیَذَّکَّرُوۡا ؕ– আমি এ কুরআনে নানাভাবে (বিষয়াবলী) ব্যাখ্যা করেছি যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে। (সূরা বানী ইসরাঈল ১৭:৪১)

কুরআনে একটা শব্দে অনেক ব্যকরণিক আলোচনা থাকে।একটা শব্দের অনেক অর্থ থাকে যা বিশেষজ্ঞ এবং চিন্তাশীলদের জন্য গবেষণার দরজা খুলে দেয়।এজন্যই হয়ত মহান আল্লাহ বারবার কুরআন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণা করতে নির্দেশ দিয়েছেন।অনুবাদে কোনো শব্দ-বিশ্লেষণ বা বিস্তারিত আলোচনা থাকে না।ফলে শুধু অনুবাদ পড়ে কুরআনের বিভিন্ন বিষয়ের ব্যাখ্যা জানাও সম্ভব হয় না। অথচ মহান আল্লাহ অনেকবার কুরআন নিয়ে চিন্তা করতে বলেছেন। যদি সাধারণভাবে অথবা অনুবাদ পড়েই কুরআনের সবকিছু সহজে বোঝা যেত তাহলে আল্লাহ তা'য়ালা কুরআন নিয়ে চিন্তা করতে বলতেন না। কুরআনের বিষয়সমূহ বিস্তারিতভাবে জানতে ও ব্যাখ্যা করতেই তাফসীরের প্রয়োজন।তাফসীরশাস্ত্রে কুরআনের বিভিন্ন শব্দের অর্থ,ব্যকরণিক বিশ্লেষণ,শব্দনির্গত জ্ঞান ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়।ফলে কুরআন থেকে বিস্তারিত জ্ঞান অর্জন করা ও চিন্তা করা সহজ হয়ে যায়। মহান আল্লাহ কুরআনকে উপদেশ গ্রহণের জন্য সহজ করে দিয়েছেন এবং এটাও বলে দিয়েছেন যে জ্ঞানী,বুদ্ধিমান ও মনোযোগী মানুষেরা  উপদেশ গ্রহণ করে।সুতরাং এরূপ লোকদের জন্য কুরআন সহজ।কুরআনের তাফসীর করতে গেলে আরবী ভাষা,ব্যকরণ,শব্দ, বাক্যালংকার, হাদিস,ফিকহ ইত্যাদি বিষয়ে যথেষ্ঠ জ্ঞানী হওয়া লাগে।জ্ঞান অর্জন এবং কুরআনের আয়াত সমূহ নিয়ে চিন্তা করতেও যথেষ্ঠ মনোযোগী হতে হয়।ফলে তাফসীরের কিতাব পড়ে কুরআন উপলব্ধি করা তুলনামূলকভাবে সহজ হয়ে যায়।যেহেতু তাফসীরের মাধ্যমে কুরআন থেকে উপদেশ গ্রহণ করার শর্তসমূহ পূরণ করে এবং কুরআনকে উপদেশ গ্রহণের জন্য সহজ করে দেয়া হয়েছে;সুতরাং তাফসীরের কারণে কুরআন কঠিন নয়,বরং সহজ বলে প্রতীয়মান হয়।

অতএব কুরআন এতটা সহজ নয় যে, নিজের মনমতো পড়েই সবকিছু বুঝে ফেলা যাবে। হাদিস ও তাফসীর পড়ার কারণেই কুরআন সহজে বোঝা যায় এবং নাস্তিকদের অভিযোগ ভুল প্রমাণিত হয়।

আল্লাহই সর্বজ্ঞ।