Are you sure?

বিবিধ »  রম্য গল্প

উন্মুক্ত চেতনা

আলেফ মিয়া অজপাড়া গায়ের মানুষ হইলেও স্বভাবে বড়ই সৌখিন। পেশায় কৃষক। সাধারণত কৃষকদের কর্ম হইতেছে মাঠে ফসল ফলানো। আলেফ মিয়াও তাহাই করেন। ইহার পাশাপাশি শখের তাড়নায় তিনি বাড়ির আঙিনায় নানান জাতের ফুলের বাগান করেন। সাম্প্রতিক তাহার উঠানের উত্তর পাশে তিনটি গোলাপ গাছে লাল, সাদা এবং হলুদ এই তিন রঙের গোলাপ ফুটিয়াছে। পাশাপাশি তিনটি পৃথক বর্ণের গোলাপ দেখিতে বড়ই চমৎকার লাগিতেছে। যেই দেখিয়াছে সেই মুগ্ধ হইয়াছে।

একদিন সকালবেলা আলেফ মিয়া তাহার ফুল বাগান পরিচর্চা করিতেছিলেন তখন সেইখানে  আরজ আলী আসিয়া উপস্থিত হইলেন। লাল, সাদা আর হলুদ গোলাপের সৌন্দর্য দেখিয়া তিনিও মুগ্ধ হইলেন। বলিলেন "আপনার গোলাপ গুলো তো খুবি সুন্দর হইয়াছে!"

আলেফ মিয়া বলিলেন "সুবহানাল্লাহ, আল্লাহর সৃষ্টি সত্যিই অনেক সুন্দর।"

আরজ আলী হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিলেন, তারপর বলিলেন "আল্লাহর সৃষ্টি! যাহার নিজেরই কোনো অস্তিত্ব নাই তাহার আবার সৃষ্টি! বড় আশ্চর্যজনক কথা।"

এই কথা শুনিয়া আলেফ মিয়ার রাগ উঠিয়া গেলো। রাগন্বিত হইয়া বলিলেন "তাহা হইলে এইসব কে সৃষ্টি করিয়াছে।"

আরজ আলী কপালে ভাজ ফালাইয়া বলিলেন "কেনো প্রকৃতি, প্রকৃতিই তো সবকিছু সৃষ্টি করিয়াছে।"

আলেফ মিয়া বলিলেন "ইহা তো আরো বড় আশ্চর্যজনক কথা।"

আরজ আলী অবাক হইয়া জিজ্ঞেস করিলেন "কেনো? ইহা আশ্চর্যজনক কথা হইবে কেনো?"

আলেফ মিয়া বলিলেন "আমাদের চারিপাশ যা কিছু রহিয়াছে সবকিছু মিলিয়াই হইতেছে প্রকৃতি। মিয়াভাই, এইসব কিছুই যখন ছিলোনা তখন তো প্রকৃতিও ছিলো না। যখন প্রকৃতি বলিতে কিছু ছিলোনা তখন প্রকৃতি কি-করিয়া এই সবকিছু সৃষ্টি করিলো? ব্যাপারটা এইরকম হইয়া গেলো না যে একটা কাগজে একটা পাখির ছবি আঁকা ছিলো, আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করিলেন ছবি কে আঁকিয়াছে, আমি বলিলাম ছবি নিজেই নিজেকে আঁকিয়াছে!"

আরজ আলীর হাসি মুখ মলিন হইয়া গেলো। কিছু সময়ের জন্য চুপ করিয়া রইলেন। সেই ফাকে আলেফ মিয়া তাহার বাগান সম্পর্ক নানান কথা বলিতে লাগিলেন। কোন গাছে প্রতিদিন পানি দিতে হয় কোন গাছে দিতে হয় না, কোন গাছে কি সার দিতে হয়, কোন কোন ফুলের ঘ্রাণ হয় কোন কোন ফুলের হয় না ইত্যাদি ইত্যাদি। 

আরজ আলীকে দেখিয়া মনে হইতেছে কোনো কথাই তিনি শুনিতেছেন না। অন্যমনস্ক হইয়া ফুলে ফুলে ভ্রমরার মুধু আহরণ দেখিতেছেন আর কি যেনো ভাবিতেছেন। হঠাৎ তাহার ঠোটের কোণে হাসি ফুটিয়া উঠিলো। ভাবনার জগৎ হইতে বাস্তবে ফিরিয়া আসিয়া বলিলেন "আচ্ছা, ধরিয়া লইলাম আপনার আল্লাহই সকল কিছু সৃষ্টি করিয়াছে কিন্তু আপনার আল্লাহ মানুষের জন্য এমন কিছু অযৌক্তিক বিধান তৈরি করিয়াছে যেগুলো একেবারে অযৌক্তিক।"

আরজ আলীর জবান হইতে এরূপ কথা শুনিতে শুনিতে অভ্যস্ত হইয়া গেছে আলেফ মিয়া, তাই আর উত্তেজিত হইলেন না। স্বাভাবিক ভাবেই বলিলেন "একটু খুলিয়া বলিবেন মিয়াভাই?"

আরজ আলী বলিলেন "এইযে পর্দার বিধান, ইহাকে আমার একেবারেই অযৌক্তিক বলিয়া মনে হয়। বলাহয় নারীদের নিরাপত্তার স্বার্থেই নাকি পর্দার বিধান দেয়া হইয়াছে, ইহা কি কোনো যুক্তির কথা হইলো? আপনার ফুল গাছ দেখেন, এতো সুন্দর ফুল ফুটিয়াছে, মিস্টি সুবাস ছড়াইতেছে। অনেকেই তো চাইবে আপনার গাছের এতো সন্দর ফুল ছিড়িয়া লইয়া যাইতে, তাই বলিয়া কি আপনি ফুলের নিরাপত্তার জন্য ফুল গুলোকে কাপড় দিয়া ঢাকিয়া রাখিবেন?"

আলেফ মিয়া মুচকি মুচকি হাসিয়া বলিলেন "মিয়াভাই, বাগানের ফুলগুলো দেখন, ফুলগুলো উন্মুক্ত থাকার কারনে একেক সময় একেক ভ্রমরা আসিয়া মধু লইয়া যাইতেছে। নারীদেরও যদি এমন উন্মুক্ত রাখা হয় তাহা হইলে একেক সময় একেক.."

আলেফ মিয়ার কথা থামাইয়া দিয়া আরজ আলি ধমক দিয়া বলিলেন "আসলে আপনাদের দৃষ্টিভঙ্গিই খারাপ হইয়া গিয়াছে।" 

তারপর বিরবির করিয়া কি যেনো বলিতে বলিতে তিনি চলিয়া গেলেন। 

বিকেলেঃ

আলেফ মিয়া আর আরজ আলী গঞ্জে গিয়াছে তাহাদের ধান ক্ষেতের জন্য ইউরিয়া সার কিনিতে। সার কেনা শেষে বাড়ি ফিরিবার পথে একটা মিষ্টির দোকানের সামনে  আসিয়া দাড়াইলেন আরজ আলী। সাথে আলেফ মিয়াও থামিয়া গেলেন। দোকানে সারি সারি, থরে থরে, নানান রকমের মিষ্টি সাজানো ছিলো। আরজ আলী মিষ্টি দেখাইয়া বলিলেন "ওইযে দোকানে দেখিয়াছেন কতো রকমের মিষ্টি সাজাইয়া রাখিয়াছে। ওই মিষ্টিগুলো দেখিয়া কি আপনার মিষ্টি খাওয়ার লোভ হইতেছে না?"

আলেফ মিয়া হাত কচলাইতে কচলাইতে বলিলেন "তা কিঞ্চিৎ হইতেছে।"

আরজ আলী বলিলেন "মিষ্টির প্রতি আপনার লোভ হইতেছে বলিয়া যদি মিষ্টির দোকানদারকে মিষ্টি ঢাকিায় রাখিতে বলেন উহা কি ঠিক হইবে? নাকি আপনার উচিৎ হইবে আপনার লোভকে সংযত করিয়া রাখা?"

আলেফ মিয়া বলিলেন "আমারি উচিৎ হইবে নিজের লোভকে সংযত করিয়া রাখা।"

আরজ আলী বা'হাতের তালুতে ডান হাত দিয়া সজোরে আঘাত করিয়া 'চটাৎ' শব্দ তুলিয়া বলিলেন "তাহা হইলে এইবার বলেন, নারীদের সৌন্দর্য দেখিয়া কাহারো মনে কুচিন্তা উদিত হইতেই পারে, এজন্য নারীদেরকে পর্দার নামে বস্তাবন্ধি না করিয়া  যাহার মনে কুচিন্তা উদিত হইয়াছে তাহাকে সংযত থাকতে বলাটা যৌক্তিক ছিলো না?"

আলেফ মিয়া বড় চিন্তায় পড়িয়া গেলেন। এই মুহুর্তে তিনি কোনো জবাব দিলেন না। তিনি চুপ রইলেন। আরজ আলীর মুখে তখন বিজয়ের হাসি।

পরদিন সকালেঃ

আজ পাঠাগার বই পড়িতে যাইবার দিন। এমনিতে যেইদিন বই পড়িতে যাইবার কথা থাকে সেইদিন আরজ আলী আসিয়া আলেফ মিয়াকে ডাকিয়া লইয়া যান। আজিকে হইয়াছে ইহার বিপরীত, আজিকে আলেফ মিয়া আসিয়াছেন আরজ আলীর বাড়িতে তাহাকে ডাকিয়া লইয়া যাইতে। আরজ আলী চিরে-গুর খাইতেছিলেন। জলদি জলদি আহার শেষে করিয়া পাঞ্জাবি গায়ে জড়াইয়া তৈয়ার হইয়া লইলেন। ঘর হইতে বাহারি হইয়া যখনি তিনি দরজায় তালা দিবেন তখনি আলেফ মিয়া বলিলেন "দরজায় তালা দেয়ার কি দরকার?"

আরজ আলী অবাক হইয়া বলিলেন "তালা দিবোনা মানে? ঘরে তৈজসপত্র,আসবাবপত্র রহিয়াছে, কিছু টাকাপয়সাও রহিয়াছে, তালা না দিলে খালি বাড়ি পাইয়া চোর আসিয়া সবকিছু লইয়া যাইবে তো।"

আলেফ মিয়া বলিলেন "আপনার তৈজসপত্র,আসবাবপত্র আর টাকাপয়সার প্রতি কাহারো লোভ হইতেই পারে, তাই বলিয়া আপনার ঘরে তালা দিয়া রাখা কি যৌক্তিক কাজ হইবে, বরং যাহার অন্তরে আপনার সম্পদের প্রতি লোভ হইবে তাহাকে নিজের লোভ সংযত করিয়া রাখিতে বলাটাই তো বেশি যৌক্তিক, তাইনা মিয়াভাই?"

আলেফ মিয়া যে আরজ আলীকে তাহার নিজের যুক্তির জালেই আটকাইয়া দিয়াছে ইহা বুঝিতে পারিয়া আরজ আলী আর কথা বাড়াইলেন না। ঘরের দুয়ারে তালা দিয়া চুপচাপ হাটা শুরু করিলেন পাঠাগারের পথে। আলেফ মিয়াও পিছু পিছু হাটিতে লাগিলেন।

 

(আরজ আলীর রম্য গ্রন্থ থেকে)