বাইবেল সংকলন কোন বই কে লিখেছে? (পর্ব ২) নতুন নিয়ম

বাইবেলের নতুন নিয়ম বা New Testament-এর বই গুলো কে লিখেছে? 

New Testament - নতুন নিয়ম 

নতুন নিয়মে ২৭ টি বই আছে। বলে রাখা ভালো যে, নতুন নিয়মের কোন বইই ঈশ্বর প্রদত্ত না। সব গুলো বইই মানুষ লিখেছে কোনটায় ঈশ্বরের বাণী না । তবে এর মধ্যে ৪ টা বই গুরুত্বপূর্ণ যেগুলোতে খ্রিস্টানরা মনে করে, সেগুলোতে যিশুর বাণী রয়েছে। আর এই বাণী যিশু ঈশ্বর থেকে এনেছে এমন ধারণা খ্রিস্টানদের। এই চারটি বই যিশুর ৪জন শিষ্য লিখেছে বলে একমত সব খ্রিস্টান। 

গুরুত্বপূর্ণ ৪ টি বই হলো :-

1. Matthew বাংলাতে (মথি) 

2. Mark বাংলাতে (মার্ক)

3. Luke বাংলাতে (লূক)

4. John. বাংলাতে (যোহন)

(Gospel According To Matthew = মথির মতানুসারে গসপেল বা যিশুর বাণী)

কল খ্রিস্টান ধর্মবেত্তা পণ্ডিত ও অগণিত আধুনিক খ্রিস্টান পণ্ডিতগণ একমত যে, মথির লেখা সুসমাচারটি মূলত হিব্রু ভাষায় লিখা ছিল। কিন্তু খ্রিস্টান সম্প্রাদায়ের বিকৃতির কারণে সেই মূল হিব্রু বইটি হারিয়ে গিয়েছে। বর্তমানে শুধুমাত্র সেই মূল বইয়ের গ্রিক অনুবাদ বইটির প্রাচীনতম সূত্র হিসেবে বিদ্যমান। এই গ্রিক অনুবাদটিরও কোন সুত্র পরস্পরা তাদের নিকট নেই। এমনকি, এখন পর্যন্ত জানা যায়নি যে, এই গ্রিক অনুবাদটির অনুবাদক কে? প্রাচীন খ্রিস্টান ধর্মবেত্তা পণ্ডিত জিরোম তা স্বীকার করেছেন। অনুবাদকের নামই যখন জানা যায়নি, তখন অনুবাদকের সত্যতা, বিশ্বস্ততা ইত্যাদি অবস্থা জানার আর সুযোগ কোথায়? 

হ্যাঁ, খ্রিস্টান ধর্মগুরু পণ্ডিতগণ সম্পূর্ণ আন্দাজে ঢিল ছুড়ে বলেন যে, সম্ভবত অমুক বা তমুক হয়তো অনুবাদ করেছিলেন। এই আন্দাজের কথা বিপক্ষের নিকট গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। অনুরুপভাবে এইসব প্রমাণহীন আন্দাজ ও অনুমানের উপর নির্ভর করে কোন কোন বইয়ের নাম লেখকের নামও নির্ধারণ করা যায় না৷ বোয়ি ইনসাইক্লোপিডিয়ায় মথিলিখিত সুসমাচারের বিষয়ে লেখা হয়েছে,  "৪১ খ্রিস্টাব্দে এই বই হিব্রু ভাষার অথবা সে সময়ের ফিলিস্তিনের প্রচলিত কিলদানীয় ও সিরিয় ভাষার মিশ্র ভাষারুপে লিখিত হয়। কিন্তু বর্তমানে বিদ্যমান রয়েছে শুধু এর গ্রিক অনুবাদ। বর্তমানে হিব্রু ভাষার যে মথিলিখিত সুসমাচারটি প্রচলিত, তা উক্ত গ্রিক ভাষার অনুবাদ৷"

(Gospel According To Mark and Luke = মার্ক ও লুকের মতানুসারে গসপেল বা যিশুর বাণী)

ক্যাথলিক ওয়ার্ড তার গ্রন্থে লিখেছে, জিরোম তার চিঠিতে লিখেছে যে, কোন-কোন প্রাচীন ধর্মগুরু পণ্ডিতরা (Mark) মার্ক লিখিত সুসমাচারের শেষ অধ্যায়ের (১৬ অধ্যায়ের) বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করতেন। কোন-কোন প্রাচীন ধর্মগুরু (Luke) লুক লিখিত সুসমাচারের ২২ অধ্যায়ের কিছু পদের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করতেন৷ করিপয় প্রাচীন ধর্ম গুরু পণ্ডিত এই সুসমাচারের প্রথম দুইটি অধ্যায়ের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করতেন৷ মারসিওনীয় সসম্প্রদায়ের খ্রিস্টানগণের নিকট সংরক্ষিত বাইবেলের (Luke) লুক লিখিত সুসমাচারের এই অধ্যায় দুইটি নেই৷ 

গবেষক পণ্ডিত নর্টন ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে বোস্টন শহরে মুদ্রিত তার বইয়ের ৭০ পৃষ্ঠায় (Mark) মার্ক লিখিত সুসমাচারের বিষয়ে লিখেছেন, এই সুসমাচারের একটি পরিচ্ছেদ সম্পর্কে যাচাই-বাছাই করা প্রয়োজন। পরিচ্ছেদটি হলো শেষ (১৬ অধ্যায়ের ৯ পদ) থেকে শেষ পর্যন্ত। আশ্চর্য হতে হয় যে, ক্রিসবাখ বাইবেলের মূলপাঠের মধ্যে এই পদ গুলোকে সন্দেহভাজন বলে চিহ্নিত করেনি, অতচ তিনি তার ব্যাখার মধ্যে অনেক প্রমাণ পেশ করেছেন যে, এগুলো পরবর্তী যুগে সংযোজিত। এরপর নর্টন ক্রিসবাখের প্রমাণ গুলো আলোচনা করেন এবং এরপর লেখেন,  এ সকল প্রমাণের মাধ্যমে প্রমাণিত হল যে, (Mark) মার্ক লিখিত সুসমাচারের এই অংশটি সন্দেহজনক। বিশেষ করে যদি আমরা লিপিকারদের অভ্যাসটির দিকে লক্ষ করি যে, তারা কোন কথাকে বই থেকে বের করার চেয়ে ভেতরে ঢুকিয়ে দিতেই বেশী পারঙ্গম। 

ক্রিসবাখ প্রটেস্ট্যান্ট সম্প্রাদায়ের নিকট খুবই নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি। নর্টন অতদূর গ্রহণযোগ্য না হলেও ক্রিসবাখের মতামত এখানে তাদের বিরুদ্ধে প্রমান।

(Gospel According To John = যোহনের মতানুসারে গসপেল বা যিশুর বাণী)

(John)যোহন লিখিত সুসমাচারের শেষে, ২১ অধ্যায়ের ২৪ পদে বলা আছে নিম্নরুপ :-

24. ইনিই সেই শিষ্য যিনি এইসব বিষয়ে সাক্ষ্য দিয়েছেন, আর তিনিই এইসব লিপিবদ্ধ করেছেন৷ আমরা জানি তাঁর সাক্ষ্য সত্য৷(যোহন 21:24)

এখানে আমরা দেখছি যে, সুসমাচারের লেখক শিষ্য (John) যোহনের বিষয়ে সাক্ষ্য দিয়েছেন। তিনি যোহনের জন্য নাম পুরুষের সর্বনাম ব্যবহার করেছেন। পক্ষান্তরে লেখক তার নিজের জন্য উত্তম পুরুষের সর্বনাম ব্যবহার করে বলেছেন, "আমরা জানি '। এ থেকেই সুস্পষ্টভাবে জানা যায় যে, এই সুসমাচারের লেখক (John) যোহন ছাড়া অন্য কেউ। সম্ভত এই অন্য ব্যক্তিটি যোহনের লিখিত কিছু পেয়েছিলেন, অতপর তিনি তা নিজের পছন্দমতো কম-বেশী করে নিজের ভাষায় লিখেছেন।  আল্লাহই ভালো জানেন। 

দ্বিতীয় খ্রিষ্টীয় শতকে অনেকেই এই সুসমাচারটিকে অস্বীকার করেন এবং বলেন যে, এটি (John) যোহনের লিখিত নয়। এই সময়ে আরিনুস (১৩০-২০০খ্রি) পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। আরিনুস ছিলেন বোলিকার্পের (St. Polycarp, Bishop of Smyra C. 69-155) শিষ্য। আর বোলিকার্প ছিলেন যিশুর শিষ্য (John) যোহনের শিষ্য। যখন মানুষেরা যোহনের নামে প্রচারিত এই সুসমাচারটিকে অস্বীকার করেছিলেন তখন তিনি একটি বারের জন্যও বলেনি যে, আমি আমার গুরু বোলিকার্পকে বলতে শুনেছি যে, এই সুসমাচারটি তার গুরু যোহনের রচিত। একথা নিসন্দেহে বলা যায় যে, যিশু-শিষ্য যোহন যদি কোন বই লিখত তবে অবশ্যই তার শিষ্য বোলিকার্পকে তা জানাতেন এবং আরিনুসকে বলতেন। 

এ কথা কল্পনা করা যায় না যে, আরিনুস তার গুরু বোলিকার্পের থেকে বিভিন্ন অতি সাধারণ বিষয় বারংবার শুনবেন এবং উদ্ধৃত করবেন, অতচ সুসমাচারের মতো এতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় একটি বারও শুনবেন না। New Testament বা নতুন নিয়ম এর এই ৪ টা বই যে বিকৃত তা প্রমাণিত। 

নতুন নিয়মের অন্য বই গুলো নিয়ে আলোচনা না করে কেবল এই ৪ টা বইটা নিয়ে আলোচনা করার কারণ এই যে, খ্রিস্টানরা এই ৪ টা বইকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে জানে। নতুন নিয়মের অন্যান্য বই গুলো তাদের কাছে এতোটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ সব গুলো বইই মানুষ লিখেছে  তাই।

 

Reference :-

  •  Izharul Haque Book Page: 164-180.
  • Ahmed Deedat The Choice, Vol-2(Is the bible God's Word?) Page 80-97.
  • Wikipedia .
  • Oxford University Press, 1990, Page 30-31. 
  • Enusebius Pamphilus, The Ecclesiastic History, Page 203-205. 
Share this:

More articles

নাস্তিকসহ কিছু মডারেট মুসলিমদেরকেও বলতে শুনা যায় যে, ইসলামে গান-বাজনা কেন নিষিদ্ধ! গান-বাজনা শুনতে সমস্যা কোথায়! এই লেখাটিতে গান-বাজনার ক্ষতিকর দিক, ইসলামে গান-বাজনা হারাম হওয়ার রেফারেন্স এবং কেন গান-বাজনা হারাম তা তুলে ধরা হয়েছে।  আল-কোরআনে গান-বাজনা হারাম  ● মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَشْتَرِي لَهْوَ الْحَدِيثِ لِيُضِلَّ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَيَتَّخِذَهَا هُزُوًا ۚ أُولَٰئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ مُهِينٌ একশ্রেণীর লোক আছে যারা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে গোমরাহ কর....
17 Min read
Read more
আমাদের জীবনের কয়েকটি পর্যায়ক্রমিক ধাপ রয়েছে। এভাবে জীবন তার শেষ সময়ের দিকে গড়ায়। চিরন্তন এক বাস্তবতা তুলে ধরা হয়েছে একটি উপমার সৌন্দর্যের মাধ্যমে। এই আয়াতটা সূরা হাদিদের অন্তর্ভুক্ত। এই সূরার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় মুসলিম সমাজকে কেন্দ্র করে। এমন অনেক মাদানি সূরা রয়েছে যার মূল আলোচ্য বিষয়টিতে সমগ্র মানবজাতিকে সম্বোধন করা হয়েছে। কারণ এই ধর্ম তথা ইসলামের আহ্বান সমগ্র মানবজাতির জন্য বিশেষ বার্তা। কিন্তু কুরআনে আবার এমন জায়গা রয়েছে, বিশেষ করে মদিনায় অবতীর্ণ কোন কোন সূরা, যেখানে আলোচ্য বিষয়ের মূল উদ্দেশ....
28 Min read
Read more
মারিয়া কিবতিয়া(রা.) রাসুল (সা.) এর স্বাধীন স্ত্রী নাকি যৌনদাসী? প্রথমেই বলে নিই, নাস্তিক্যধর্মাবলম্বীরা কথায় কথায় "যৌনদাসী" শব্দটা ব্যবহার করে থাকে যা কুরআন হাদিসের কোথাও নেই। কোনোকিছু ইসলামে না থাকলেও তা ইসলামের উপর চাপানো কতটুকু যুক্তিসঙ্গত? আসুন, জেনে নিই কে ছিলেন এই মারিয়া কিবতিয়া (রা.)? মহানবী (সা.)-এর চিঠি  "বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম আল্লাহ্‌র বান্দা এবং রাসূল মুহাম্মদ এর পক্ষ থেকে কিব্‌ত প্রধান মুকাওকিসের প্রতি- সালাম তার উপর যে হিদায়াতের অনুসরণ করবে। অতঃপর আমি আপনাকে ইসলামের দাওয়াত দি....
10 Min read
Read more
ভুমিকা: দাসপ্রথা ইতিহাসের ন্যাক্কারজনক কর্মকাণ্ডের এক জঘন্যতম উদাহরণ। মুসলিম নব্য শিক্ষিতদেরকে ইসলামের প্রতি বিরূপ ও শত্রুতাভাবাপন্ন করে তোলার জন্যে ইসলামবিদ্বেষীরা সাধারণত  এই অস্ত্রটিই বেশী ব্যবহার করে থাকে।   তাদের বক্তব্য হলো,  “ ইসলাম যদি সকল যুগের জন্যেই গ্রহণযোগ্য হতো এবং মানুষের সকল প্রয়োজনই মেটাতে পারত তাহলে কস্মিনকালে মানুষকে দাস বানানোর অনুমতি দিত না। এমনকি দাসপ্রথাকে বরদাশতও করতে পারত না। এই দাস সমস্যাই একথা সুস্পষ্টরূপে প্রমাণ করে যে, এই জীবনব্যবস্থা কেবল একটি বিশেষ যুগের জন্যেই উপ....
96 Min read
Read more
জিহাদ বলতে অমুসলিমরা সাধারণত "যুদ্ধ" বুঝে থাকে। খ্রিস্টান মিশনারীরা যখনই বিতর্কে হেরে যায়, তখনই আলোচনা ঘুরাতে ইসলামের জিহাদ নিয়ে মিথ্যাচার করা শুরু করে। আজ আমরা বাইবেলের আলোকে "যুদ্ধ" সম্পর্কে জানবো। যুদ্ধ নিয়ে বাইবেলে কী কিছু বলা আছে? বাইবেলের কিছু যুদ্ধের চিত্র আপনাদের সামনে তুলে ধরছি। ঈশ্বর নিজেকে, ঈশ্বর প্রমান করতে ১ লক্ষ ২৭ হাজার মানুষকে হত্যা করে: 23. রাজা বিন্হদদের রাজকর্মচারীরা তাঁকে বললেন, “ইস্রায়েলের দেবতারা আসলে পর্বতের দেবতা| আর আমরা পর্বতে গিয়ে যুদ্ধ করেছি তাই ইস্রায়েলের লোকরা জ....
17 Min read
Read more
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম আসসালামু আলাইকুম ওয়ারহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতাহু প্রিয় ভাই ও বোনেরা। আশা করি অবশ্যই সবাই মহান আল্লাহ্ সুবাহানাহু ওয়াতা'আলার অশেষ রহমত ও দয়ায় ভালো এবং সুস্থ্য আছেন। আজকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করব যা তথাকথিত নাস্তিকরা সহ অমুসলিম খ্রিস্টান মিশনারিদের একটা প্রধান অভিযোগ সম্পর্কে, আর সেটা হলো বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ ﷺ পাপী (নাঊযুবিল্লাহ মিনযালিক) হওয়ার বিষয়ে তারা কোরআনের বিশেষ কয়েকটি আয়াত পেশ করে ইসলামকে আক্রমণ করতে চায় বিশেষ করে ত্রিত্ববাদী খ্রিস্টান প....
23 Min read
Read more