Are you sure?

হাদিস »  বিবিধ

নবীযুগ ও সাহাবীযুগে সুন্নাহ/হাদিস লিখে রাখার প্রমাণাদী- ১

নবী ও সাহাবীদের যুগ থেকেই হাদিস তথা সুন্নাহ লেখা হত,হঠাৎ করে হাদিস অস্বীকারকারী একটি বাতিল ফেরকা আবির্ভাব হয়েছে আমাদের দেশে। যারা দাবী করছে হাদিস ২০০-২৫০ বছর পর লেখা হয়েছে এবং হাদিস যদি গুরুত্বপূর্ণ হত কুরআনের মত সাহাবীরা লেখত,সুতরাং হাদিস গুরুত্বপূর্ণ নয় হাদিস মানা যাবে না।

তাদের এসব বিভ্রান্তির জবাব আমরা পূর্বেও দিয়েছি আলহামদুলিল্লাহ এখন আমরা আজকের পোস্টে তুলে ধরব নবী ও ছাহাবীযুগেই হাদিস/সুন্নাহ লেখা হত এমন কিছু দৃষ্টান্ত ও গ্রন্থ সমূহ তুলে ধরা হবে।

নবীযুগ এবং ছাহাবাযুগে [১১০ হিজরী] হাদীস সংকলনঃ
১- ‘কিতাবুচ্ছাকাহ

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু উমর (রাঃ) বলেনঃরাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জীবনের শেষ দিন গুলোতে সরকারী কর্মকর্তাদের কাছে পাঠানোর জন্য ‘কিতাবুচ্ছাদকাহ' রচনা করান। যাতে রয়েছে চতুস্পদ জন্তুর যাকাতের কিছু বিধান। (তিরমিযী)

২- ছহীফায়ে আমর ইবনু হাযম

রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইয়েমেনের গভর্ণর হযরত আ’মর ইবনু হাযম (রাঃ) এর কাছে একটি পুস্তিকা লিখে পাঠিয়েছিলেন। যাতে ছিল - তিলাওয়াতে কুরআন, যাকাত, তালাক, ইতাক (কৃতদাস মুক্তি করণ), কেছাছ ( হত্যার বদলা), দিয়ত, (নিহত ব্যক্তির রক্তপণ), ফরয এবং নফল বিধানাবলী এবং কবীরা গুণাহ সমূহের বিস্তারিত বর্ণনা। (আহমদ, আবুদাউদ, নাসায়ী, দারাকুতনী, দারিমী, হাকেম।)

৩- ছহীফায়ে আ’লী
রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আলী (রাঃ)কে একটি সহীফা লিপিবদ্ধ করিয়ে দিলেন যার সম্পর্কে হযরত আলী (রাঃ) বলতেনঃ “আল্লাহর শপথ ! আমাদের কাছে আল্লাহর কিতাব এবং এই
ছহীফা ব্যতীত লেখা পড়ার অন্য কোন গ্রন্থ নেই, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই ছহীফাটি আমাকে প্রদান করেছেন। এতে রয়েছে যাকাতের বিধানাবলী। [আহমদ |

৪- ছহীফায়ে ওয়ায়েল ইবনু হুজর lessorjaiga] হযরত ওয়ায়েল ইবনু হুজর (রাঃ) যখন তাঁর দেশ ‘হাদ্বরামুতে’ যেতে লাগলেন, তখন নবী করীম রাসূলুল্লাহ
ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জন্য, যাকাত, ছাওম, বিবাহ, সুদ ইত্যাদি বিষয় সমৃদ্ধ একটি ছহীফা লিপিবদ্ধ করে তাঁকে দিলেন [তাবরানী]।

৫- ছহীফায়ে সাআ’দ ইবনু উবাদাহ

হযরত সাআ'দ ইবনু উবাদা (রাঃ) নিজে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে হাদীস শুনে এই ছহীফা লিপিবদ্ধ করেছেন। (তিরমিযী)।

ছহীফায়ে সামুরা ইবনু জুনদাব 

হযরত সামুরা ইবনু জুনদাব (রাঃ) এই ছহীফাটি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জীবদ্দশায় তৈরী করেছিলেন। পরে তা তাঁর ছেলে হযরত সালমান (রাহঃ) এর আয়ত্বে আসে৷ (হিফাযতে হাদীস]।

৭- ছহীফায়ে জাবির ইবনু আব্দিল্লাহ, হযরত জাবির ইবনু আব্দিল্লাহ (রাঃ) এর তৈরীকৃত ছহীফা। এতে হজ্জের বিধানাবলী সম্পর্কে হাদীস আছে। [মুসলিম]।

৮- ছহীফায়ে আনাস ইবনু মালেক রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বিশিষ্ট খাদেম হাযরত আনাস ইবনু মালেক (রাঃ) রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে হাদীস শুনে তা লিখেছিলেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে তা সত্যায়িত করে নিয়েছিলেন। [হাকেম।]

৯- ছহীফায়ে আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর কাছে হাদীস সম্পর্কীয় কয়েকটি পুস্তিকা ছিল,[তিরমিযী।] হযরত আব্দুল্লাহ (রাঃ) এর ইন্তেকালের সময় তাঁর কাছে এক উটের বোঝাই সমান কিতাব ছিল। ইবনু সাআ’দ ।।

১০- ছহীফায়ে ছাদেকাহ,

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল আ’ছ (রাঃ) এর কাছে হাদীসসমূহের অনেক বড় ভান্ডার ছিল। যার সম্পর্কে তিনি নিজেই বলতেনঃ ‘ছাদেকাহ’ এমন একটি গ্রন্থ যা আমি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে সরাসরি শুনে লিপিবদ্ধ করেছি। [দারিমী। ||. সায়্যিদ আবুবকর গজনবী (রাহ:) এর তাহকীক মতে ‘ছহীফায়ে ছাদেকাতে’ পাঁচ হাজার তিনশত চুয়াত্তর (৫৩৭৪) এর কিছু বেশী হাদীস স্থান পেয়েছে। জেনে রাখা উচিত যে, বুখারী ও মুসলিমে পুনরাবৃত্তি ব্যতীত হাদীসের সংখ্যা চার হাজারের বেশী নয়। [কিতাবতে হাদীস
আ’হদে নববী মে।]

১১- ছহীফায়ে উমর ইবনুল খাত্তাব

এই ছহীফায় ছদকা এবং যাকাতের বিধানাবলী লিপিবদ্ধ ছিল। ইমাম মালেক (রাহঃ) বলেনঃ ‘আমি হযরত উমর (রাঃ) এর এ কিতাবটি পড়েছি। [মুয়াত্তা ইমাম মালেক৷৷

১২- ছহীফায়ে উসমান

এই ছহীফায় যাকাতের সকল বিধান লিপিবদ্ধ
ছিল। [বুখারী]।

১৩- ছহীফা আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ 

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদের ছেলে হযরত আব্দুররহমান বলতেনঃ এ ছহীফা তাঁর পিতা নিজ হাতে লিখেছেন। [আয়িনায়ে পরবেষিয়াত]।

১৪- মুসনাদু আবুহুরায়রা

এ হাদীস গ্রন্থের কপিটি ছাহাবা যুগেই লিপিবদ্ধ হয়েছে। এর একটি কপি উমর ইবনু আব্দিল আযীযের (রাহঃ) এর পিতা, সমকালীন মিসরের আব্দুল আযীয ইবনু মারওয়ান (ইন্তেকালঃ ৮৬
হিজরী) এর কাছে ছিল। [বুখারী]।

১৫- মক্কা বিজয়ের ভাষণ ।। ইয়েমেন নিবাসী আবুশাহ নামক এক ছাহাবীর অনুরোধে রাসূলুল্লাহ্ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের বিস্তারিত ভাষণ লিখে দেয়ার আদেশ দিলেন [বুখারী]।

১৬- রেওয়ায়েতে হযরত আয়েশা সিদ্দীকা । হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীসসমূহ তাঁর শাগরিদ হযরত উরওয়া ইবনু যুবাইর (রাহঃ) লিপিবদ্ধ করেছেন৷ [ইন্তেখাবে হাদীসের ভূমিকা ৷৷

১৭- ছহীফায়ে সহীহা

এ ছহীফা হযরত আবুহুরায়রা (রাঃ) এর তৈরীকৃত একটি পুস্তিকা। তিনি তাঁর শাগরিদ হাম্মাম ইবনু মুনাব্বিহ (রাহঃ) এর দ্বারা লিখালেন। এতে ১৩৮ টি হাদীস রয়েছে, যে গুলোর বেশীর ভাগের সম্পর্ক হল চরিত্রের সাথে। এ হাদীসগ্রন্থটি পাক-ভারতে প্রকাশিত হয়েছে। স্মরণ রাখবেন, হযরত আবুহুরায়রা (রাঃ) ৫৯ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন। যার অর্থ হল, এই মূল্যবান রচনাটি ছাহাবাযুগে রচিত হয়েছে। এ ছহীফার একটি কপি ষষ্ট হিজরী সনে কপি করা হয়েছিল। যা সুপ্রসিদ্ধ ডক্টর জনাব হুমায়দুল্লাহ [প্যারিসে অবস্থানকারী] দামেশকের যাহেরিয়া লাইব্রেরী থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। একই ছহীফার দ্বাদশ শতাব্দীতে লিখিত একটি কপি ডক্টর সাহেব বার্লিন লাইব্রেরী থেকে উদ্ধার করেছিলেন, উভয় হস্তলিখা কপিকে মিলানোর পর জানা গেল যে, উভয় কপির হাদীসসমূহে কোন পার্থক্য নেই। ছহীফা সহীহা যাকে ‘ছহীফা হাম্মাম ইবনে মুনাব্বিহ'ও বলা হয়, তার সমূহ হাদীস শুধু যে মুসনাদে আহমদে হুবহু বিদ্যমান আছে তা নয় বরং সব হাদীস হযরত আবুহুরায়রা (রাঃ) এর বর্ণনায় প্রসিদ্ধ ছয় কিতাবেও পাওয়া যায়। কাজেই ছহীফায়ে সহীহা যেন একথার জ্বলন্ত প্রমান বহন করে যে, নবীযুগ এবং ছাহাবাযুগেও হাদীসসমূহ লিপিবদ্ধ করা হত। তদুপরি ছহীফাটির সব হাদীস মুসনাদু আহমদ এবং প্রসিদ্ধ ছয় কিতাবে হুবহু পাওয়া যাওয়া, হাদীস সমূহ শুদ্ধ ও অকাট্য হওয়ার বড় প্রমাণ।

১৮- ছহীফায়ে বশীর ইবনু নাহীক

এ ছহীফাটি হযরত আবুহুরায়রা (রাঃ) এর আর একজন শাগরিদ বশীর ইবনু নাহীক (রাহঃ) তৈরী করেছেন। [জামিউ বয়ানিল ইল্মা৷

১৯-মাকতুবাতে হযরত নাফে'। ভয় ও ভয় । কপিটি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু উমর (রাঃ) হযরত নাফে' (রাঃ) এর মাধ্যমে লিপিবদ্ধ করিয়েছেন।
[দারিমী]।

২০- পত্রাদি ও সনদসমূহ হাদীসের নিয়মিত কিতাবসমূহ ব্যতীত তাঁর পক্ষ থেকে লিপিবদ্ধকৃত চিঠিপত্র ও সনদ ইত্যাদির সংখ্যাও সহস্র। এ গুলোর
মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি হল, যথাক্রমে ঃ

(ক) সাংবিধানিক চুক্তিঃ হিজরতের পর মদীনা শরীফে ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপনের পর রাসুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলিম এবং অমুসলিম সবার অধিকার ও দায়িত্বসমূহ সম্পর্কে ৫৩ দফায় সমৃদ্ধ একটি সাংবিধানিক চুক্তি স্বাক্ষরিত করলেন, যা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। [ইবনু হিশাম]।

(খ) হুদায়বিয়ার সন্ধির পর রাসুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কায়সার, কিসরা, মুকাউকিস এবং নাজ্জাশী ব্যতীত, বাহরাইন, উমান, দামেশক, ইয়ামামা, নাজদ, দুমাতুল জুনদল এবং হিময়ার গোত্রের শাসকবর্গের কাছে দাওয়াতী পত্রাদি প্রেরণ
করেছেন। [রাসুল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি সিয়াসী যিন্দেগী।

(গ) একটি সৈন্যদলকে যুদ্ধের জন্য প্রেরণ করার সময় রাসুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেনাপতিকে একটি পত্র লিখে দিলেন এবং বললেনঃ অমুক স্থানে পৌছার পূর্বে পড়িও না। সে স্থানে পৌছার পর সেনাপতি পত্র খুলে রাসুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নির্দেশ সবাইকে পড়ে শুনালেন। (বুখারী)।

(ঘ) হিজরতের সময় সুরাক্বা ইবনু মালিককে নিরাপত্তা পত্র লিখে দিয়েছিলেন। (ইবনু হিশাম)।

(ঙ) স্বীয় দাস হযরত রাফে' (রাঃ) এবং হযরত আ’লাঈ (রাঃ) কে মুক্ত করার সময় মুক্তি পত্র লিখে দিয়েছিলেন৷ [মুকাদ্দামায়ে ছহীফায়ে ছহীহা, মুসনাদু আহমদ।]

(চ) ৯ হিজরী সনে যামরা গোত্র, ৫ হিজরী সনে ফাযারা এবং গাতফান গোত্র, ৬ষ্ট হিজরী সনে মক্কার কোরাইশ এবং ৯ম হিজরী সনে উকায়দার ইবনু আব্দিল মালিকের সাথে চুক্তি পত্র সম্পাদন করেছেন। [তাবরানী, ইবনু সাআ’দ, ইবনু হিশাম,
আলওয়াছায়েক]।

(ছ) খায়বরে ইয়াহুদিদেরকে এক ছাহাবীকে হত্যা করার কারনে রক্তপণ আদায়ের লিখিত আদেশ দিয়েছেন। [বুখারী ও মুসলিম]।

(জ) ইয়েমেনের গভর্ণর হযরত মাআ'য (রাঃ) এর ছেলের ইন্তেকাল উপলক্ষে লিখিত শোকবার্তা পাঠিয়েছিলেন। [মুস্তাদরাক, হাকেম ৷

(ঝ) হযরত ছুমামা (রাঃ) কে মক্কাবাসীর জন্য রসদ প্রেরণ বন্ধ না করার জন্য লিখিত
ফরমান জারি করেছেন। [ফতহুলবারী]।

(ঞ) হযরত বেলাল ইবনু হারিছ মুযানীকে (রাঃ) আলকুস পাহাড়ের পার্শ্বে স্থান
দেয়ার জন্য লিখিত আদেশ দিয়েছেন। [আবুদাউদ]।

(ট) বিভিন্ন গোত্রের নামে রক্তপণের মাসায়েল লিখে প্রেরণ করেছেন। [মুসলিম]৷

উপরিক্ত আলোচনা থেকে এটা প্রমাণিত যে সুন্নাহ লিখে রাখার প্রবণতা তখনকার থেকেই প্রসিদ্ধ ছিল।এভাবে পর্যায় ক্রমে তাবেই তাবে তাবেই যুগেও লেখার ধারাবাহিকতা ছিল যা আমরা তুলে ধরবো আগামী পর্বে ইন শা আল্লাহ।চলবে....

সূত্রঃ -ইকবাল কিলানীর লিখিত ইত্তেবায়ে সুন্নাহ গ্রন্থ থেকে।