Are you sure?

বিজ্ঞান »  ইসলাম ও বিজ্ঞান

আলাকাহ শব্দের অর্থ কী?


আলাকাহর অন্য যেকোনো অর্থ বর্ণনা করার পুর্বে মুফাসসিরদের কর্তৃক বর্ণিত শব্দটির 'রক্তপিন্ড' অর্থটি প্রসঙ্গে সুস্পষ্ট খোলাসাহ দেয়াটা জরুরি, অন্যথায় ব্যাপারটাতে এই একটা সংশয় থেকেই যায় যে সব মুফাসসিররাইত এর অর্থ রক্তপিন্ড বলেছেন, এত বিপুল সংখ্যাক মুফাসসিররা কিভাবে একই সাথে একই ভুল করলেন! কোনো মুফাসসিরইত এর অর্থ রক্তপিন্ড ছাড়া অন্যকিছু বলেন নি!  তাহলে কিভাবে কি? কিভাবে আলাকাহর রক্তপিন্ড অর্থ নেয়াটা ভুল? কাজেই এই লেখাটিতে সর্বপ্রথম এর রক্তপিন্ড অর্থটির ব্যাপারে বিস্তারিত পরিপুর্ণ আলোচনা করার চেষ্টা করা হবে।

বিপুল সংখ্যাক উলামারা বলেছেন যে আলাকাহ দ্বারা কোর'আনে রক্তপিন্ড উদ্দেশ্য। সাধারণভাবে অগভিরভাবে খোজলে এমন কোনো আলেমের বক্তব্য খোজে পাওয়া যায়না যে তিনি আলাকাহর অর্থ রক্তপিন্ড হয়ার বিরোধিতা করেছেন। ফলে মনে হতে পারে যেন আলাকাহর অর্থ রক্তপিন্ড হয়ার ব্যাপারে ইজমা সংঘটিত হয়েছে অর্থাৎ সকল আলেমরা এর রক্তপিন্ড অর্থটির উপর একমত হয়েছেন।

কিন্ত বাস্তবতা আসলে কি? আসলেই কি আলাকাহর অর্থ রক্তপিন্ড হয়ার ব্যাপারে ইজমা হয়ে গেছে? এটা একটা গুরুত্বপুর্ণ প্রশ্ন ও এর বিস্তারিত উত্তর সামনে আসছে।

কোনো বিষয়ের উপর ইজমা হয়ার জন্য শর্ত হলো প্রত্যেক মুজতাহিদের সেই ব্যাপারে একমত হতে হবে, যদি শুধুমাত্র একজন বা দুজন মুজতাহিদও মতভেদ করে বসেন, তাহলেই বাকিদের ঐক্যমত হয়াটা আর ইজমা হিসেবে গণ্য হবেনা [1]।এখন,ইমাম মালিক, আশহাব, আল-বাসিলী, আল-মাতিতী, ইবনু আরফাহ, ইবনু মারযুক, ফকিহদের একটি দল ও মুসলিম মায়েরা এক্ষেত্রে আলাকাহর রক্তপিন্ড হয়ার বিরোধিতা করেছেন ও বলেছেন যে না, আলাকাহ মোটেও রক্তপিন্ড নয় বরং রক্তপিন্ড ও আলাকাহ হচ্ছে দুটা আলাদা ভিন্ন পৃথক জিনিস। _[2][3]

সুতরাং দেখা যাচ্ছে একজন বা দুজন নয় বরং এরচেয়ে বেশি সংখ্যাক আলেমদের একটি দল আলাকাহর রক্তপিন্ড হয়ার বিরোধিতা করেছেন ও রক্তপিন্ড ও আলাকাহকে দুটি ভিন্ন ও পৃথক জিনিস হিসেবে গণ্য করেছেন।কাজেই প্রমাণিত হলো যে আলাকাহর অর্থ রক্তপিন্ড হয়ার উপর ইজমা নেই। এখন পরিস্থিতিটা হচ্ছে এরকম যে বেশিরভাগ উলামাদের নিকট আলাকাহ মানে রক্তপিন্ড এবং এর বিপরীতে সামান্য কিছুসংখ্যাক উলামাদের নিকট আলাকাহ মানে রক্তপিন্ড না।অর্থাৎ আলাকাহর রক্তপিন্ড হয়ার মতটি জুমহুর উলামাদের মত।

পক্ষান্তরে মুলনিতী হলো "জুমহুর উলামাদের মত এমন কোনো জিনিস নয় যা কখনৌই ভুল হতে পারেনা। বরং জুমহুরদের মতও ভুল হতে পারে, শুধুমাত্র সংখ্যায় বেশি হয়ার মানেই এইনা যে সর্বদাই তাঁদের মতটি সঠিক হয়ে যাবে"[4] আর স্বয়ং এই  মুলনিতীটাও জুমহুর উলামাদের পক্ষ হতে প্রদানকৃত![4]। সুতরাং মুলনিতী অনুযায়ী আলাকাহর অর্থ রক্তপিন্ড হয়ার মতটি এমন কিছু না যা ভুল হতে পারেনা। বরং এটাও ভুল হয়া সম্ভব, এক্ষেত্রে উক্ত মতের পক্ষের উলামাদের সংখ্যার ব্যাপকতা উক্ত মতটির বিশুদ্ধতার নিশ্চয়তাদাতা নয় (যেহেতু : উক্ত মতের একাধিক বিরোধীতাকারীও আছেন)।

আলাকাহর বাস্তবতা আসলে কি? তা কি আসলেই রক্তপিন্ড নাকি না? উত্তর হলো আলাকাহ মোটেও রক্তপিন্ড নয় (বাইরে থেকে দেখতে অবশ্য হুবুহু রক্তপিন্ডই মনে হয়)। এখন কেও আপত্তি করে বলতে পারে যে আপনে কিভাবে কিসের ভিত্তিতে বলে দিলেন যে বাস্তবে আলাকাহ রক্তপিন্ড না? এই আপত্তির ব্যাপারে বলব যে  আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান অনুযায়ী ভ্রুণ কখনৌই রক্তের পিন্ড হয়ে যায়না, আর এরই ভিত্তিতে আমি বলেছি যে আলাকাহ রক্তপিন্ড নয়।

এবার অনেকে আবার আপত্তি করে বলতে পারে যে "আমরা এসব চিকিৎসাবিজ্ঞানে বিশ্বাসী না, এসব ইহুদি খ্রিষ্টানদের জিনিসে আমাদের ভরসা নাই।"এইধরনের আপত্তি যারা করতে পারে তাদের উদ্দেশ্য বলব যে : প্রথমত, আজ থেকে আপনারা বা আপনাদের কাছের কেও অসুস্থ হলে ডাক্তারের কাছে যাওয়া ও আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের সাহায্যে উৎপন্ন হয়া যেকোনো ধরনের ঔষধ গ্রহণ করা সম্পুর্ণরুপে ত্যাগ করে দিন ; দ্বিতীয়ত, আলাকাহ যে আসলে রক্তপিন্ড না সেটা বোঝার জন্য বা জানার জন্য অউদো আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের সাহায্যেরও কোনো প্রয়োজন নেই, মানবভ্রুণ আলাকাহ পর্যায়ে থাকাকালীন সময়ে অনেক মহিলার গর্ভপাত হয়, এরকম কোনো একজন মহিলার পেট হতে গর্ভপাতের দরুন নির্গত হয়া আলাকাহ পর্যায়ে থাকাকালীন ভ্রুণটিকে যদি কেও ভালোভাবে পরিক্ষা নিরীক্ষা ও যাচাই করে দেখে, তাহলে সে দেখতে পাবে যে আলাকাহ অউদো কোনো রক্তপিন্ড নয়।

এবার আরো আপত্তি করে এক-শ্রেণীর লোক বলে উঠতে পারে যে "আপনেকি আলাকাহ পর্যায়ে থাকাকালীন সময়ে গর্ভপাতের দরুন নির্গত হয়া কোনো ভ্রুণকে নিজে যাচাই করে দেখেছেন কখনো? নিজে যাচাই না করে দেখে কিভাবে এমনটা বললেন?" এই আপত্তির জবাবে বলব : আমি যাচাই করে দেখিনাই, কিন্ত বিভিন্ন ফিকহের গ্রন্থে উল্লেখিত হয়েছে যে মুসলিম মায়েদের বক্তব্য অনুযায়ী গর্ভপাতের দরুন নির্গত হয়া আলাকাহ আসলে রক্তপিন্ড নয় এবং একদল আলেম এব্যাপারে মুসলিম মায়েদের বক্তব্যের সাথে একমতও হয়েছেন।অর্থাৎ বিভিন্ন ফিকহের গ্রন্থে যেই মুসলিম মায়েদের কথা বলা হয়েছে তাঁরা গর্ভপাতের দরুন নির্গত আলাকাহকে যাচাই করে দেখেছেন ও পেয়েছেন যে আলাকাহ আসলে রক্তপিন্ড নয় এবং একদল আলেম এক্ষেত্রে মুসলিম মায়েদের এই বক্তব্যকে মেনে নিয়েছেন [3]।

এরপরও যদি বাস্তবে আলাকাহর রক্তপিন্ড না হয়ার ব্যাপারে কারো কোনো আপত্তি থেকে থাকে, তাহলে আর কিছু বলার নেই ; বরং সেক্ষেত্রে শুধু এতটুকু সুস্পষ্ট করে দিচ্ছি যে এই লেখাটির একদম শুরুতেই উহ্যভাবে ধরে নেয়া হয়েছে যে আলাকাহ প্রকৃতপক্ষে রক্তপিন্ড না। আলাকাহ অবস্থায় থাকাকালীন সময়ে ভ্রুণ রক্তপিন্ড হয়না, এই বিষয়টি যারা মেনে নিয়েছেন উক্ত লেখাটি তাদেরই জন্য, যারা এবিষয়টি মেনে নিতে পারছেনা তাদের জন্য এই লেখাটি নয়।

এতক্ষণের আলোচনা হতে স্পষ্ট হয়েছে যে আলাকাহর অর্থ রক্তপিন্ড হয়ার বিষয়টি বিপুল সংখ্যাক আলেমদের মত, কিন্ত যেহেতু একদল আলেম ও বাস্তব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মুসলিম মায়েরা এই মতটির বিরোধিতা করে বলেছেন যে আলাকাহ রক্তপিন্ড নয়, সেহেতু মুলনিতী অনুযায়ী আলাকাহর রক্তপিন্ড হয়ার মতটি ভুল হয়া ও রক্তপিন্ড না হয়ার মতটি সঠিক হয়া সম্ভব। আমরা জানি, বাস্তবে মানবভ্রুণ কখনো রক্তপিন্ড হয়ে যায়না, সুতরাং আলাকাহর রক্তপিন্ড হয়ার মতটি সঠিক হয়া অসম্ভব, অপরদিকে আলাকাহর রক্তপিন্ড হয়ার মতটি ভুল হয়া ও রক্তপিন্ড না হয়ার মতটি সঠিক হয়া সম্ভব, সুতরাং আলাকাহর রক্তপিন্ড হয়ার মতটি ভুল ও রক্তপিন্ড না হয়ার মতটি সঠিক।

এখন প্রশ্ন হলো যদি আলাকাহ রক্তপিন্ড নাই হয়ে থাকে, তাহলে এত বিপুল সংখ্যাক আলেমরা কিসের ভিত্তিতে কেন বললেন যে আলাকাহ রক্তপিন্ড? এবার এই গুরুত্বপুর্ন প্রশ্নটির দিকে আসা যাক।

বিপুল সংখ্যাক উলামা কর্তৃক আলাকাহকে রক্তপিন্ড বলার কারণ হলো দুইটি।

এক.আলাকাহর বহুল প্রচলিত একটা অর্থ হলো 'রক্তপিন্ড'।

দুই.আলাকাহ পর্যায়ে থাকাকালীন সময়ে গর্ভপাতের দরুন নির্গত ভ্রুনকে ব্যাহ্যিকভাবে দেখতে হুবুহু একটি রক্তপিন্ডের মতো মনে হয়।

এককভাবে প্রথম কারণটি আলাকাহর ব্যাখ্যা হিসেবে রক্তপিন্ডকে সাব্যস্ত করার জন্য যথেষ্ট নয়। কেননা রক্তপিন্ড বাদেও আলাকাহ শব্দটির অন্য আরো বহুল প্রচলিত শাব্দিক অর্থ আছে। অর্থাৎ প্রথম কারণটি মুখ্য বা প্রধান কোনো কারণ নয়, বরং দ্বিতীয় কারণটির জন্য এক ধরনের সমর্থনকারীকারণস্বরুপ প্রথম কারণটি কাজ করছে। সুতরাং এক্ষেত্রে দ্বিতীয় কারণটিই হলো প্রধান ও মুখ্য, এই দ্বিতীয় কারণটিই প্রথম কারণটির জন্য যৌক্তিকতার ভিত্তি স্থাপন করেছে। অর্থাৎ দ্বিতীয় কারণটিই হলো আলেমদের কর্তৃক আলাকাহকে রক্তপিন্ড বলার মুল প্রধান মুখ্য কারণ। কাজেই দ্বিতীয় কারণটির আরো গভিরে যাওয়া যাক।

পূর্বেকার সময়ের আলেমরা গর্ভপাতের দরুন নির্গত হয়া আলাকাহ পর্যায়ে থাকাকালীন ভ্রুণের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন মাসলা-মাসায়েল হুকুম-আহকাম নিয়ে বিভিন্ন গ্রন্থে বহু আলোচনা করেছেন। সেসব আলোচনাতে তাঁরা 'আলাকাহ' পর্যায়ের ভ্রুনকে 'রক্তপিন্ড' বলেই সংজ্ঞায়িত করেছেন।

গর্ভপাতের দরুন নির্গত হয়া আলাকাহ পর্যায়ে থাকাকালীন ভ্রুণকে ব্যাহ্যিকভাবে দেখতে হুবুহু রক্তপিন্ডের মতো মনে হয় কেননা তা রক্তের প্রলেপ দ্বারা আবৃত ও রঞ্জিত থাকে, কিন্ত প্রকৃতপক্ষে তা আসলে কোনো রক্তপিন্ড হয়না,উক্ত নির্গত ভ্রুণটিকে ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখলে এবিষয়টা স্পষ্ট হয়ে যায় যে ভ্রুনটি আসলে কোনো রক্তপিন্ড না বরং রক্তের প্রলেপের নিচে সম্পুর্ণ ভিন্নকিছু আছে।

গর্ভপাতের দরুন নির্গত আলাকাহ পর্যায়ের ভ্রুণ দেখতে হুবুহু রক্তপিন্ডের মতো হয় কিন্ত বাস্তবে তা রক্তপিন্ড নয়, আলেমরা বলেছেন তা রক্তপিন্ড। সুতরাং গর্ভপাতের দরুন নির্গত আলাকাহকে আলেমদের কর্তৃক রক্তপিন্ড বলার কারণ হলো তা দেখতে হুবুহু রক্তপিন্ডের মতো।

কাজেই এটা বলা সঠিক হবে যে আলেমরা আলাকাহকে রক্তপিন্ড বলেছেন কেননা গর্ভপাতের দরুন নির্গত আলাকাহ দেখতে হুবুহু রক্তপিন্ডের মতো। আর ঠিক এই জায়গাতেই আলাকাহর রক্তপিন্ড হয়ার মতটির ভুল ধরা পরে। যারা বলেছেন যে আলাকাহ রক্তপিন্ড, তাঁরা ব্যাহ্যিক দৃষ্টির উপর ভরসা করে প্রাপ্ত তথ্যের উপর ভিত্তি করে আলাকাহর একাধিক প্রচলিত অর্থের মধ্য থেকে রক্তপিন্ড অর্থটিকে বাছাই করেছেন ও আলাকাহকে রক্তপিন্ড বলেছেন।পক্ষান্তরে, মুসলিম মায়েদের ও আলেমদের একটি ক্ষুদ্র দলের মধ্য থেকে যারা এই জায়গাটাতে গর্ভপাতের দরুন নির্গত আলাকাহর উপর ভালোভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রাপ্ত তথ্যের উপর নির্ভর করেছেন, তাঁরা কিন্ত ঠিকিই এব্যাপারটা ধরতে পেরেছেন যে আলাকাহ প্রকৃতপক্ষে কোনো রক্তপিন্ড নয়, আলাকাহ ও রক্তপিন্ড সম্পুর্ণ ভিন্ন ধরনের দুটি ভিন্ন জিনিস, যার ফল-স্বরুপ তাঁরা মত দিয়েছেন যে আলাকাহ রক্তপিন্ড নয়।

আলেমদের কর্তৃক আলাকাহকে রক্তপিন্ড বলার পিছনের কারণ ও উক্ত কারণের ভুল বর্ণনা করে এখানে আমি যা বলেছি, তা সম্পুর্ণরুপে আমার পক্ষ হতে আনা বিচ্ছিন্ন কোনো তত্ত্ব নয়, বরং এমনটা বহু আলেমরাও বলেছেন। উদাহরণস্বরুপ,

আল-আযহারের একজন বড় আলেম 'মাহমুদ মুহাম্মদ গারিব' বলেছেন :

أن العلقة في الأيام الأولى لا يمكن رؤيتها بالعين المجردة ولكن يمكن رؤية الدم المحيط بها مما جعل القدامى يقولون إنَّ العلقة هى قطعة الدم الجامدة المتعلقة بجدار الرحم. [5]

"পুর্বেকার যুগে খালি চোখে আলাকাহ কে দেখা যেতনা, কিন্ত আলাকাহর বাহিরের রক্তের আবরণটি দেখা যেতো, এবং এব্যাপারটি থেকেই পুর্ববর্তী আলেমরা ধরে নিয়েছিলেন যে অবশ্যই আলাকাহ হলো একটি রক্তের পিন্ড যা গর্ভের দেয়ালে লেগে থাকে "

ডক্টর মুহাম্মাদ আলি আল-বার বলেছেন :

لماذا أصر المفسرون القدامى على أن العلقة هي الدم الغليظ ... فالعلقة لا تكاد ترى بالعين المجردة، وهي مع ذلك محاطة بالدم من كل جهاتها، فتفسير العلقة بالدم الغليظ ناتج عن الملاحظة بالعين المجردة .[6]
"কেন পুর্ববর্তী মুফাসসিররা আলাকাহর মানে রক্তপিন্ড হওয়ার ব্যাপারে অনড় ছিলেন?…মূলত আলাকাহকে খালিচোখে দেখার উপায় ছিলনা, এবং এর পাশাপাশি আলাকাহর প্রতিটা দিকই রক্ত দ্বারা বেষ্টিত ছিল, এবং আলাকাহকে রক্তপিন্ড বলে ব্যাখ্যা করার ব্যাপারটি হলো খালি চোখে আলাকাহকে পর্যবেক্ষণ করার ফলাফল। "

শায়খ মুহাম্মাদ সালিহ আল-মুনাজ্জিদ বলেছেন :

ومن ذكر من أهل التفسير الدم الجامد، فلمشابهته له في الشكل، فلم يكن في عصرهم من الأجهزة ما يمكنهم من سبر أغوارها. [7]

"মুফাসসিরদের মধ্যে যারা (আলাকাহর অর্থ) রক্তপিন্ড উল্লেখ্য করেছেন, এর কারণ হলো তার (আলাকাহর) সাথে তার (রক্তপিন্ডের) দৈহ্যিক সাদৃশ্যতা, উনাদের (পুর্ববর্তী মুফাসসিরদের) যুগে এমন সরঞ্জাম ছিলনা যাদ্বারা উনাদের পক্ষে তার (আলাকাহর) প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে জানা সম্ভব হতো।"

এইপর্যন্ত হয়া আলোচনাটির ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্তে উপনিত হয়া যায় যে আলাকাহর রক্তপিন্ড হয়ার মতটি ভুল ও রক্তপিন্ড না হয়ার মতটি সঠিক। যদি আলাকাহ রক্তপিন্ড না হয় তাহলে অবশ্যই এর বিকল্প কোনো অর্থ প্রযোজ্য হবে।

আলাকাহর একাধিক প্রযোজ্য হয়ার যোগ্য অর্থ রয়েছে। নিম্নে সেগুলো বর্ণনা করা হলো।

প্রথম অর্থ - "এমন কিছু যা যুক্ত থাকে "

আলাকাহর একটি বহুল প্রচলিত অর্থ হলো "এমন কিছু যা যুক্ত থাকে " [8]। আলাকাহর এই অর্থটি এর প্রচলিত অন্যান্য সাধারণ অর্থগুলোর মতো একটি নয়, বরং এটা আলাকাহর একদম মূল প্রকৃত ধাতুগত অর্থ, আলাকাহর মূল অর্থ 'এমন কিছু যা যুক্ত থাকে ' এর উপর ভিত্তি করেই আলাকাহর অন্যান্য অর্থগুলো অস্তিত্বে এসেছে ও দাঁড়িয়ে আছে [9]।

উল্লেখ্য যে, আলাকাহর মূল অর্থে 'এমন কিছু যা যুক্ত থাকে ' এর উপর ভিত্তি করেই আলাকাহর 'রক্তপিন্ড' অর্থটি এসেছে, বিশুদ্ধতা লাভ করেছে ও প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে। অর্থাৎ আলাকাহর 'এমন কিছু যা যুক্ত থাকে ' অর্থটি হচ্ছে আলাকাহর 'রক্তপিন্ড' অর্থটির জনক বা স্রষ্টা। আরবরা রক্তপিন্ডকে 'আলাকাহ' বলে সম্বোধন করা আরম্ভ করেছিলো কেননা রক্তপিন্ড হলো এমন কিছু যা নিজের আঠালো ভাবের কারণে অন্যান্য জিনিসের সাথে যুক্ত থাকে। যেহেতু রক্তপিন্ড এমন কিছু যা যুক্ত থাকে ও আলাকাহর সংজ্ঞা হলো এমন কিছু যা যুক্ত থাকে, সেহেতু (আলাকাহর সংজ্ঞানুযায়ী) রক্তপিন্ডও আলাকাহ, এ থেকেই রক্তপিন্ডকে আলাকাহ বলা আরম্ভ হয়। আলাকাহর রক্তপিন্ড অর্থটি হলো আলাকাহর প্রকৃত সংজ্ঞা 'এমন কিছু যা যুক্ত থাকে' এর প্রত্যক্ষ অনুসরণে সৃষ্ট হয়া একটি অর্থ, এটি আলাকাহর কোনো সতন্ত্র অর্থ নয়[10]। অর্থ হিসেবে এটি আলাকাহর কোনো প্রধান বা মূল অর্থও না, তবে এটি আলাকাহর বহুল ব্যবহৃত একাধিক অর্থগুলোর অন্তর্ভুক্ত একটি অর্থ।

কোরআনের কোনো একটা শব্দের ক্ষেত্রে উক্ত শব্দের যেকোনো একটা অর্থ বাছাই করে নিয়ে এমনেতেই বসিয়ে দেয়ার সুযোগ নেই। কোরআনের আয়াতের কোনো একটি শব্দের একটি নির্দিষ্ট অর্থ তখনিই উক্ত আয়াতের উক্ত শব্দের জন্য গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবে যখন সেই অর্থটি নিম্নে উল্লেখিত ৫ টি শর্ত মান্য করবে : _[11]

এক. সেই অর্থটিকে ভাষাগতভাবে সঠিক হতে হবে,অর্থাৎ আরবি ভাষায় অর্থটির অস্তিত্ব থাকতে হবে।

দুই.আরবি ভাষায় অর্থটিকে অধিক পরিচিত ও প্রচলিত হতে হবে। কম ব্যবহৃত কিংবা আরবদের নিকট অপরিচিত হলে হবেনা।

তিন.অর্থটিকে প্রাসঙ্গিক হতে হবে, অর্থাৎ প্রসঙ্গের সাথে সামঞ্জস্যপুর্ন হতে হবে, প্রসঙ্গের অনুকূলে হতে হবে।

চার.মাঝে মাঝে কোনো একটি শব্দের অর্থের সাথে আয়াতের শানে নুযুল এর সম্পর্ক থাকে ও অর্থটি অনুধাবনের জন্য শানে নুযুল জানার প্রয়োজন হয়। সেসব ক্ষেত্রে শানে নুযুল এর সাথে অর্থের যে সম্পর্ক বিদ্যমান, সেই সম্পর্ক অনুযায়ি অর্থ নিতে হবে।

পাচ. যদি শরঈ অর্থ ও ভাষাগত অর্থের মাঝে যদি ভিন্নতা দেখা দেয়, তাহলে শরঈ অর্থ অগ্রাধিকার পাবে।

আলাকাহর 'এমন কিছু যা যুক্ত থাকে ' অর্থটি ভাষাগতভাবে সম্পুর্ণ সঠিক, এটি যথেষ্ট পরিচিত ও প্রচলিত, আলাকাহর কথা উল্লেখিত হয়েছে এমন আয়াতগুলোর মধ্যে প্রাসঙ্গিক এবং এক্ষেত্রে শানে নুযুলের সাথে আলাকাহর অর্থসক্রান্ত সম্পর্ক নেই। এর পাশাপাশি এখানে শরঈ ও ভাষাগত অর্ধের মাঝে ভিন্নতার কোনো প্রসঙ্গ নেই। সুতরাং আলাকাহর এই অর্থটি রক্তপিন্ড অর্থটির বিকল্প হিসেবে কোরআনে বর্ণিত আলাকাহর অর্থ হিসেবে প্রযোজ্য হয়ার জন্য গ্রহণযোগ্য।

উল্লেখ্য যে বিংশ শতাব্দীর একজন বড় ও প্রসিদ্ধ মুফাসসির 'মুহাম্মদ মুতাওয়াল্লা আশ-শারাওই' আলাকাহর অর্থ হিসেবে 'এমন কিছু যা যুক্ত থাকে' ধরেছেন [12]।

দ্বিতীয় অর্থ - "জোঁকের মত কোনোকিছু "

আলাকাহর আরেকটি প্রসিদ্ধ অর্থ হলো 'জোঁক' [13]। আলাকাহ দ্বারা সরাসরি জোঁকও বোঝানো হয়, আবার 'জোঁকের মত কোনোকিছু ' ও বোঝানো হয় [14]।

আলাকাহর এই 'জোকের মত কোনোকিছু' অর্থটি ভাষাগতভাবে সম্পুর্ণ সঠিক, এটি যথেষ্ট পরিচিতও, আলাকাহর কথা উল্লেখিত হয়েছে এমন আয়াতগুলোর মধ্যে এটি প্রাসঙ্গিক (কেননা মানবভ্রুণ আলাকাহ পর্যায়ে থাকাকালীন সময়ে তার আকৃতি অনেকটা জোঁকের মতই হয়) এবং এক্ষেত্রে শানে নুযুলের সাথে আলাকাহর অর্থসক্রান্ত সম্পর্ক নেই। এর পাশাপাশি এখানে শরঈ ও ভাষাগত অর্ধের মাঝে ভিন্নতার কোনো প্রসঙ্গ নেই। স্পষ্টতই আলাকাহর 'জোঁকের মত কোনোকিছু' অর্থটি গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য প্রযোজ্য পুর্বেউল্লেখিত ৫ টি শর্তকে মান্য করছে। সুতরাং আলাকাহর এই 'জোঁকের মত কোনোকিছু' অর্থটি রক্তপিন্ড অর্থটির বিকল্প হিসেবে কোরআনে বর্ণিত আলাকাহর অর্থ হিসেবে প্রযোজ্য হয়ার জন্য গ্রহণযোগ্য।

উল্লেখ্য যে, শায়খ আহমদ হাতিবাহ ও অন্যান্য কিছু আলেমরা আলাকাহর অর্থ হিসেবে 'জোঁকের মতো কোনোকিছু' ধরেছেন। [15]

অতএব আলাকাহর প্রথম অর্থ 'এমন কিছু যা যুক্ত থাকে' কে এককভাবে ধরে বলা যেতে পারে যে কোরানে বর্ণিত আলাকাহ দ্বারা এমন কিছু উদ্দেশ্য যা যুক্ত থাকে, কিংবা আলাকাহর দ্বিতীয় অর্থ 'জোঁকের মত কোনোকিছু' কে এককভাবে ধরে বলা যেতে পারে যে কোরানে বর্ণিত আলাকাহ দ্বারা জোঁকের মত কোনোকিছু উদ্দেশ্য। পক্ষান্তরে, যেহেতু আলাকাহর 'এমন কিছু যা যুক্ত থাকে ' ও 'জোঁকের মত কোনোকিছু' অর্থদুটি পরস্পরবিরোধী না, বরং সামঞ্জস্যসাধনযোগ্য, সেহেতু আলাকাহর এদুটি অর্থকে একত্রে সম্মিলিতভাবে ধরে বলাটাও সঠিক হবে যে আলাকাহ দ্বারা কোরানে জোঁকের সাথে সাদৃশ্যপুর্ন এমন কিছু উদ্দেশ্য যা যুক্ত থাকে।

টিকাসমুহ :

[1]আজ-জাইযানী,মাআলিমু উসুলিল ফিকাহ (পৃ/166);আল-খুযাইরী, আল-ইজমা ফিত তাফসির (পৃ/61);আশ-শাওকানী, ইরশাদুল ফুহুল (1/234)

[2]মালিকি ফিকহের অন্যতম প্রসিদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য হিসেবে বিবেচিত গ্রন্থ 'আল-মুদাওয়য়ানাহ'(4/630) তে বলা হয়েছে যে ইমাম মালিক বিন আনাস (রহ) বলেছেন :
إذَا أَلْقَتْهُ فَعُلِمَ أَنَّهُ حَمْلٌ وَإِنْ كَانَ مُضْغَةً أَوْ عَلَقَةً أَوْ دَمًا فَفِيهِ الْغُرَّةُ
অর্থ : যখন সে সেটাকে গর্ভপাত করে নির্গত করলো তখন জানা গেলো যে সেটা পেটের বাচ্চা, এবং যদি সেটা মুদ্বগাহ হয় অথবা আলাকাহ হয় অথবা রক্ত হয় তাহলে সেটাতে উজ্জ্বল চিহ্ন রয়েছে।

ইমাম মালিকের এই বক্তব্যটি হতে সুস্পষ্ট হয় যে উনার নিকট আলাকাহ ও রক্ত একই জিনিস না। আরবি ভাষাতে সাধারণভাবে সার্বিকভাবে রক্ত বললে এতে রক্তপিন্ডও অন্তর্ভুক্ত হয়, কাজেই বলা যায় যে তাঁর নিকট আলাকাহ ও রক্তপিন্ড একই জিনিস নয় বরং দুটি ভিন্ন ও পৃথক জিনিস।

[3]দেখুন : মুহাম্মদ বিন আহমদ উলাইশ কর্তৃক রচিত 'মানহুজ জালিল ফি শারহে মুখতাসারে খালিল'(9/97-98), আবুল-আব্বাস আহমদ আল-বাসিলী কর্তৃক রচিত 'নুকত ওয়া তানবিহাত ফি তাফসিরিল কোরান' (2/321), আল-বুন্নানীর হাশিয়াহবিশিষ্ট আয-যুরকানীর লিখিত মুখতাসারু খালিলের শরাহগ্রন্থ (8/53-54), আবুল-হাসান আলি আল-লাখমী কর্তৃক রচিত 'আত-তাবসারাহ'(13/6431-6432), আবু-মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল-কাইরাওয়ানী কর্তৃক রচিত 'আন-নাওয়াদির ওয়ায যিয়াদাত ' (13/123) & (4/339)

[4]আল-উসাইমিন,শারহুল আকিদাতিস সাফারিনিয়াহ (1/747); আবুল-আশবাল,শারহু উসুলে ই'তিকাদি আহলিস সুন্নাহ (25/11); ইবনুল কাইইম,আল-ফুরুসিয়াতুল মুহাম্মাদিয়াহ (1/237-242); আশ-শাওকানী, ইরশাদুল ফুহুল (1/234)

[5]মাহমুদ গারিব, সুরাতুল ওয়াকিয়াহ ওয়া মানহাজুহা (পৃ/195)

[6]আল-বার,খালকুল ইনসান বাইনাত তিব্বি ওয়াল কোর'আন (পৃ/205-206)

[7]https://islamqa.info/ar/348627

[8]ইবনু ফারিস,মুজমালুল লুগাহ (পৃ/626) ও মাকাইসুল লুগাহ (4/126); ইবনু সিদাহ,আল-মুহকাম (1/210) ও আল-মুখাসসাস (4/37); আয-যুবাইদী,তাজুল উরুস (26/181); ইবনু মানযুর,লিসানুল আরব (10/265); আন-নববী,তাহযিবুল আসমা ওয়াল লুগাত (4/38); আস-সামিন,উমদাতুল হুফফায (3/111); ইবনু আব্বাদ,আল-মুহিত ফিল-লুগাহ (1/20); ইবনু দুরাইদ,জামহারাতুল লুগাহ (2/939);আর-রাগিব,আল-মুফরাদাত (পৃ/579)

[9]আস-সামিন,উমদাতুল হুফফায (3/110) ও ইবনু ফারিস, মাকাইসুল লুগাহ (4/125)

[10]ইবনু ফারিস, মাকাইসুল লুগাহ (4/125);আল-মাওরিদী,আন-নুকত ওয়াল উয়ুন (6/304-305);তাফসিরুল ইযয (3/469);তাফসিরুল কুরতুবী(20/119); আন-নববী,তাহযিবুল আসমা ওয়াল লুগাত (4/36-37);ওহবাহ,আত-তাফসিরুল মুনির (30/315);ইবনু আদিল,আল-লুবাব(20/414);তাফসিরু ইবনে ফাওরাক (3/245);আদ-দামিরী,আন-নাজমুও ওয়াহহাজ (1/416); ইবনুল যাওযি,আত-তাবসারাহ(2/150) ও যাদুল মাসির (3/223) ও কাশফুল মুশকিল (1/291);আস-সাবুনী,সফওয়াতুত তাফাসির (3/554);ইবনুল-মুলাক্কিন,আত-তাওদ্বিহ (2/303);আশ-শিরবিনী,মুগনিউল মুহতাজ (1/235);আর-রমলী,নিহায়াতুল মুহতাজ (1/246)

[11]আত-তাইয়ার, ফুসুল ফি উসুলিত তাফসির (পৃ/42-44)

[12]তাফসিরুশ শা'রাওই (16/9979)

[13]আল-ফারাহিদী, আল-আইন (1/161);আজ-জাওহারী, তাজুল্লুগাহ (4/1529);ইবনু মানযুর, লিসানুল আরব (10/267);ইবনু ফারিস, মাকাইসুল লুগাহ (4/126)

[14]ইবনুস সিক্কিত তাঁর 'ইসলাহুল মানতিক'(পৃ/41) গ্রন্থে বলেছেন :
والعَلَق: شيء شبيه بالدود أسود يكون في الماء
"এবং আলাক : কোনোকিছু যা পানির কালো জোঁকের সাথে সাদৃশ্যপুর্ণ "

[15]https://shamela.ws/book/37037/2812