Are you sure?

বিজ্ঞান »  ইসলাম ও বিজ্ঞান

পৃথিবীর গোলাকার আকৃতি এবং এর ঘূর্ণায়মান সম্পর্কে পবিত্র আল কোরআন!

 ১] পৃথিবীর আকৃতি সম্পর্কে...!

অনেকেই জিজ্ঞেস করে পবিত্র কোরআন মাজীদে পৃথিবীর আকৃতি সম্পর্কে কী বলা হয়েছে? এটা সমতল নাকি গোলাকারের ন্যায় বস্তু?

তো তাদের উদ্দেশ্যে বলি, সর্বোত্তম রব মহামহিমান্বিত আল্লাহ্ সুবাহানাহু ওয়াতা’আলা সরাসরি পবিত্র কোরআন মাজীদে পৃথিবীকে গোলাকার বলেননি। হতে পারে আমাদের পিতৃপুরুষদের বিশ্বাস তারা পৃথিবীকে সমতল ভাবত সেহেতু হঠাৎ করেই পৃথিবীকে গোলক বলে দিলে তারা শয়তানের ধোঁকায় পড়ে ইসলাম ত্যাগ করত। ফলে আমরাও এই সত্য ও শাশ্বত শান্তির ধর্মে জন্ম নেওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করতে পারতাম না। তাই মহাজ্ঞানী আল্লাহ্ তা'আলা এ বিষয়ে ইঙ্গিত দেওয়ার জন্য কৌশল অবলম্বন করেছেন। কেননা মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআন কে এমনভাবে নাযিল করেছেন যা সর্ব যুগের জন্য সঠিক ভাবে প্রযোজ্য এবং ব্যাখ্যাপূর্ণ। বর্তমান আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগ। আর আমরা এমন যুগে এসে নিশ্চিত হয়েছি যে, পৃথিবীর আকৃতি সমতল নয় বরং গোলকের ন্যায়। আর পবিত্র কোরআন মাজীদেও পৃথিবী গোলাকার হওয়ার ইঙ্গিতপূর্ণ কথা নানাভাবে এসেছে। আসলে মহান রব পবিত্র কোরআনে অনেক বিষয়ে অসংখ্যবার ইঙ্গিতপূর্ণ এবং সুস্পষ্ট বর্ণনা দিয়েছেন, যা (ইঙ্গিতপূর্ণ কথাগুলো) আমরা উপযুক্ত সময়ের আগে অনুধাবন করতে পারব না; যাকে হয়তো তিনি "ءَايَٰتِ(Signs)/আয়াতী তথা নিদর্শন" হিসেবে উল্লেখ করেছেন। বিশেষ করে কিয়ামত সংশ্লিষ্ট আয়াতগুলো সঠিক সময়ের আগে সঠিকভাবে অনুধাবন করা প্রায় অসম্ভব। ঠিক একই ভাবে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগ আসার আগেই পৃথিবীর আকার নিয়ে পবিত্র কোরআনের ইঙ্গিতপূর্ণ কথাগুলো অনুধাবন করা সম্ভব হয় নাই। তাহলে আসুন দেখি কোরআনে এ সম্পর্কে কোন ইঙ্গিতপূর্ণ কথা আছে কিনা? তার আগে নিদর্শন সম্পর্কে কিছু আয়াত দেখা যাক। নিদর্শন হলো এমন কিছু যা মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে অনেক বিষয়ে সুস্পষ্ট বর্ণনা করার পরে বিভিন্ন বিষয়ের দিকে ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলে জানিয়ে দিয়েছেন যে, তোমরা এসব নিয়ে চিন্তা ভাবনা, ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ, যথার্থ গবেষণা করো এবং দেখ কোরআন আসলেই তাঁর পক্ষ থেকে আগত সত্য বাণী কিনা? কোরআন মাজীদে যা বলা হয়েছে এর সত্যতা তোমরা নিজেরাই জানতে পারবে গবেষণা করার মাধ্যমে। তো মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআন মাজীদের ৪১ নং সূরা হা-মীম আস সাজদা (ফুসসিলাত) এর ৫৩ নং আয়াতে এরশাদ করেছেন:

سَنُرِیۡهِمۡ اٰیٰتِنَا فِی الۡاٰفَاقِ وَ فِیۡۤ اَنۡفُسِهِمۡ حَتّٰی یَتَبَیَّنَ لَهُمۡ اَنَّهُ الۡحَقُّ ؕ اَوَ لَمۡ یَکۡفِ بِرَبِّکَ اَنَّهٗ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ شَهِیۡدٌ

বিশ্বজগতে ও তাদের নিজদের মধ্যে আমি তাদেরকে আমার নিদর্শনাবলী দেখাব যাতে তাদের কাছে সুস্পষ্ট হয় যে, এটি (কুরআন) সত্য; তোমার রবের জন্য এটাই যথেষ্ট নয় কি যে, তিনি সকল বিষয়ে সাক্ষী?" [অনুবাদক: আল-বায়ান]

অর্থাৎ যেসব নিদর্শন পবিত্র কোরআন মাজীদে সুস্পষ্ট বর্ণনা করা হয়েছে এবং যেসব বিষয়ে নানাভাবে ইঙ্গিতপূর্ণ কথা রয়েছে তার সত্যতা প্রকাশ পেয়ে যাবে এবং এই কোরআন যে মহান আল্লাহর পক্ষ হতে আগত, তা স্পষ্ট হয়ে যাবে। আর এমন অসংখ্য নিদর্শনের কথা মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে সুস্পষ্ট এবং ইঙ্গিতপূর্ণ বর্ণনা দিয়েছেন।

আবার ৪২ নং সূরা আশ-শুরার ২৯ নং আয়াতে এরশাদ করেছেন:

وَ مِنۡ اٰیٰتِهٖ خَلۡقُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ وَ مَا بَثَّ فِیۡهِمَا مِنۡ دَآبَّۃٍ ؕ وَ هُوَ عَلٰی جَمۡعِهِمۡ اِذَا یَشَآءُ قَدِیۡرٌ 

তাঁর অন্যতম নিদর্শন আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং এতদুভয়ের মধ্যে তিনি যে সব জীবজন্তু ছড়িয়ে দিয়েছেন সেগুলি। তিনি যখন ইচ্ছা তখনই ওদেরকে সমবেত করতে সক্ষম।" [অনুবাদক: মুজিবুর রহমান]

এইখানে মহান আল্লাহ বলেই দিয়েছেন তাঁর অন্যতম নিদর্শন রয়েছে "আকাশ মন্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি" তে। এখন এই পৃথিবীতে কী কী নিদর্শন রয়েছে তা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করতে হবে; এসব নিদর্শন গুলোর মধ্যে রয়েছে কিভাবে দিন-রাত্রি সংঘটিত হয়, কেন সংঘটিত হয়, পৃথিবীর আকার- আকৃতি কেমন ইত্যাদি ইত্যাদি; কেননা এসব বহু বিষয়ে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে কোরআনে। এখন আমাদের উচিত তা গবেষণা করে বের করা। তাহলে অনেক কিছুই হয়তো জানতে পারব তবে সেটা উপযুক্ত সময়ের আগে নয়। পবিত্র কোরআনেও এ সম্পর্কে বলা হয়েছে ৪১ নং সূরা হা-মীম আস সাজদা (ফুসসিলাত) এর ৩৭ নং আয়াতে এরশাদ করেছেন:

وَ مِنۡ اٰیٰتِهِ الَّیۡلُ وَ النَّهَارُ وَ الشَّمۡسُ وَ الۡقَمَرُ ؕ لَا تَسۡجُدُوۡا لِلشَّمۡسِ وَ لَا لِلۡقَمَرِ وَ اسۡجُدُوۡا لِلّٰهِ الَّذِیۡ خَلَقَهُنَّ اِنۡ کُنۡتُمۡ اِیَّاهُ تَعۡبُدُوۡنَ

তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে রাত ও দিন, সূর্য ও চাঁদ। তোমরা সূর্যকে সাজদাহ করনা, চাঁদকেও নয়; সাজদাহ কর আল্লাহকে, যিনি এগুলি সৃষ্টি করেছেন, যদি তোমরা প্রকৃতই তাঁর ইবাদাত কর।[অনুবাদক: মুজিবুর রহমান]

মহান আল্লাহ এইখানে সুস্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছেন যে "দিন-রাত্রি ও চাঁদ-সূর্যের মধ্যে নিদর্শন রয়েছে"। এখন কী এমন নিদর্শনের কথা বলতে চাইল মহান রব? হতেও তো পারে এই দিন- রাত্রি কিভাবে সংঘটিত হচ্ছে, কেন হচ্ছে এসব নিয়ে চিন্তা-ভাবনা, ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ, গবেষণা করলে পৃথিবীর আকার-আকৃতি, এটা স্থির নাকি ঘূর্ণায়মান বস্তু তা জানা যাবে। প্রতিষ্ঠিত আধুনিক বিজ্ঞান বলে, পৃথিবীর গোলাকার আকৃতির ফলে পর্যায়ক্রমে দিন-রাত্রি সংঘটিত হয়। পর্যায়ক্রমে দিন রাত্রি সংঘটন হওয়া বলতে প্রথমে উত্তাপবিহীন মৃদু আলো অর্থাৎ সকাল, এরপর আস্তে আস্তে আলোর তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়ে উত্তাপ বেড়ে যায় যখন সূর্য মাথার উপরে থাকে অর্থাৎ তখন দুপুর, এরপর সূর্য পশ্চিমাকাশের দিকে ঢোলে পড়ে আস্তে আস্তে আলোর তীব্রতা কমতে থাকে অর্থাৎ বিকাল, এরপর সূর্য পশ্চিমাশে ডুবে যেতে থাকে যখন থাকে আলো-আধারের খেলা অর্থাৎ এটাকে আমরা বলি সন্ধ্যা আর এমন সময় কোন কিছুই স্পষ্ট দেখা যায় না ভালো করে, এরপর আলো নিঃশেষ হয়ে নেমে আসে ঘন অন্ধকার অর্থাৎ রাত। এইভাবে পর্যায়ক্রমে দিনের আলো কমতে কমতে রাত চলে আসে, আবার রাত শেষে দিন চলে আসে; যদি পৃথিবীর আকৃতি গোলাকার না হয়ে সমতল হতো তাহলে এভাবে ধীরে ধীরে দিন থেকে রাত নেমে আসত না। ঠিক এইভাবে প্রাকৃতিক নিয়ম মেনে দিনের পর রাত, রাতের পর দিন ক্রমে চলে আসছে। আর এই নিয়ম মহান আল্লাহ-ই প্রকৃতির মাঝে সৃষ্টি করে রেখেছেন যা কখনোই পরিবর্তনযোগ্য নয়। এ সম্পর্কে তিনি পবিত্র কোরআন মাজীদের ৩৫ নং সূরা আল ফাতিরের ৪৩ নং আয়াতে এরশাদ করেছেন:

فَلَنۡ تَجِدَ لِسُنَّتِ اللّٰهِ تَبۡدِیۡلًا ۬ۚ وَ لَنۡ تَجِدَ لِسُنَّتِ اللّٰهِ تَحۡوِیۡلًا.

...তুমি আল্লাহর পদ্ধতিতে (سننت/সুন্নাত) কখনও কোন পরিবর্তন পাবেনা এবং আল্লাহর পদ্ধতির কোন ব্যতিক্রমও দেখবেনা।
"...But you will never find in the way (established method) of Allah any change, and you will never find in the way of Allah any alteration." [Translator: Sahih International]

প্রথম ধাপ:

এখন আসা যাক পবিত্র কোরআন মাজীদে পৃথিবীর গোলাকার আকৃতির পক্ষে ইঙ্গিতপূর্ণ কোনো কথা পাওয়া যায় কিনা? তবে কিছু কথা বলে রাখি। আদিম কালে মানুষ বিশ্বাস করতো যে, পৃথিবী চ্যাপ্টা। বহু শতাব্দীব্যাপী মানুষ পরিভ্রমণে বহুদূর পর্যন্ত গমনে ভয় পেত এই কারণে যে, পাছে সে পৃথিবীর কিনারা হতে পড়ে যায়! স্যার ফ্রান্সিস ড্রেক (Sir Francis Drake) হলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি ১৫৭৭ খ্রিস্টাব্দে পৃথিবীর চারিদিকে জলপথে ভ্রমণ করে প্রমাণ করেছিলেন যে পৃথিবী গোলাকারের ন্যায়।

 

দূর সমুদ্র হতে কোনো জাহাজ তীরের দিকে আসার সময় প্রথমে তার ধোঁয়া, মাস্তুল ইত্যাদি এবং ক্রমান্বয়ে চোঙ্গা, ছাদ প্রভৃতি দেখা যায়। আবার তীর হতে সমুদ্রে যাওয়ার সময়ে প্রথমে জাহাজের নিচের অংশগুলো এবং ক্রমে ক্রমে মাস্তুল অদৃশ্য হয়। পৃথিবী গোলাকার বলে এর বক্র অংশ আমাদের দৃষ্টিকে আড়াল করে রাখে। সেজন্য আমরা বহু দূর থেকে জাহাজের সকল অংশ এক সময় দেখতে পাইনা। পৃথিবী সমতল হলে দূর হতে জাহাজের সকল অংশ একই সঙ্গে দেখা যেত। আর দিন ও রাতের এ পরিবর্তন সম্পর্কে মহামহিমান্বিত আল্লাহ্ সুবাহানাহু ওয়াতা'আলা পবিত্র কোরআন মাজীদের ৩১ নং সূরা লোক্‌মান (لقمان), আয়াত: ২৯ এ এরশাদ করেছেন 

أَلَمْ تَرَ أَنَّ ٱللَّهَ يُولِجُ ٱلَّيْلَ فِى ٱلنَّهَارِ وَيُولِجُ ٱلنَّهَارَ فِى ٱلَّيْلِ وَسَخَّرَ ٱلشَّمْسَ وَٱلْقَمَرَ كُلٌّ يَجْرِىٓ إِلَىٰٓ أَجَلٍ مُّسَمًّى وَأَنَّ ٱللَّهَ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ

তুমি কি দেখনা যে, আল্লাহ রাতকে দিনে এবং দিনকে রাতে প্রবেশ করান? তিনি চাঁদ-সূর্যকে করেছেন নিয়মাধীন, প্রত্যেকটি বিচরণ করে নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত; তোমরা যা কর আল্লাহ সে সম্পর্কে অবহিত।" [অনুবাদক: মুজিবুর রহমান] (প্রায় এই একই কথা অনেক আয়াতের মধ্যে বলা হয়েছে, পবিত্র কোরআন ১৩:২; ১৪:৩৩; ১৬:১২; ২১:৩৩; ৩১:২৯; ৩৫:১৩; ৩৬:৩৮; ৩৮:৩২; ৪১:৩৭; ৫৫:৫ সহ ইত্যাদি আয়াত দ্রষ্টব্য)

এখানে "يُولِجُ বা প্রবেশ/প্রবিষ্ট করান"-এর অর্থ হলো রাতের ধীরে ধীরে এবং ক্রমান্বয়ে দিনে রূপান্তরিত হওয়া। অনুরুপভাবে দিনের ধীরে ধীরে এবং ক্রমান্বয়ে রাতে পরিবর্তিত হওয়া অর্থাৎ দিন এবং রাত্রির সংঘটন হওয়া। আর এই প্রাকৃতিক ঘটনা তখনই সংঘটিত হতে পারে যদি পৃথিবীর আকৃতি গোলাকারের ন্যায় হয় অর্থাৎ পৃথিবী গোলক হওয়ায় তার নিজস্ব অক্ষের উপর ঘূর্ণায়মানের ফলে দিবা-রাত্রি সংঘটিত হয়। যদি পৃথিবী চ্যাপ্টা হতো তাহলে হঠাৎ করে রাত দিনে এবং দিনও হঠাৎ করে রাতে রূপান্তরিত হতো অথবা যদি সমতল হতো তাহলে দিন বা রাত বলে পৃথক কিছু থাকতো না একই সঙ্গে। সবসময় সমগ্র পৃথিবী একই রকমের আলো পেত। অবশ্য আমরা যদি কল্পনা করে নেই যে, পৃথিবী না, বরং সূর্যই পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে, সেক্ষেত্রে অবশ্য ভিন্ন কথা। সেক্ষেত্রে দিন এবং রাত সংঘটিত হবে ঠিকই, কিন্তু সমগ্র পৃথিবীতে একই সাথে দিন হবে, আবার একই সাথে রাত হবে। মহিমান্বিত ঐশীগ্রন্থ পবিত্র আল কোরআন মাজীদের আয়াতেও পৃথিবীর গোলাকার আকৃতির কথা পরোক্ষভাবে বলা হয়েছে সুকৌশলে। 

গোলাকার পৃথিবীতে দিন-রাত্রি সংঘটিত হবার চিত্র 

আবার অন্যত্রে পবিত্র কোরআনে এরশাদ করা হয়েছে ৩৯ নং সূরা আয্‌-যুমার (الزّمر), আয়াত: ৫

خَلَقَ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلْأَرْضَ بِٱلْحَقِّ يُكَوِّرُ ٱلَّيْلَ عَلَى ٱلنَّهَارِ وَيُكَوِّرُ ٱلنَّهَارَ عَلَى ٱلَّيْلِ وَسَخَّرَ ٱلشَّمْسَ وَٱلْقَمَرَ كُلٌّ يَجْرِى لِأَجَلٍ مُّسَمًّى أَلَا هُوَ ٱلْعَزِيزُ ٱلْغَفَّٰرُ

তিনি যথাযথভাবে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। তিনি রাত দ্বারা দিনকে আচ্ছাদিত করেন এবং রাতকে আচ্ছাদিত করেন দিন দ্বারা। সূর্য ও চন্দ্রকে তিনি করেছেন নিয়মাধীন। প্রত্যেকেই পরিক্রমন করে এক নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত। জেনে রেখ, তিনি পরাক্রমশালী, ক্ষমাশীল।" [অনুবাদক: মুজিবুর রহমান]

এই আয়াত প্রসঙ্গে ইবনে হাযম বলেছেন, এটা রাত-দিনের পারস্পরিক আবর্তনের সুস্পষ্ট বর্ণনা। কারণ كور শব্দটি كوالعمامة/like a turban থেকে সংগৃহীত, এর অর্থ হচ্ছে পাগড়ির মত (যা গোলাকার) প্যাঁচ। এ আয়াতটি স্থলভাগের তথা পৃথিবীর গোলাকার হওয়ার সুস্পষ্ট প্রমাণ।" [ইবনে হাযম, আল ফাসলু ফিল মিলাল ; ২/৭৮]।

আল্লাহ তা‘আলা আরো এরশাদ করেছেন يُغْشِي اللَّيْلَ النَّهَارَ يَطْلُبُه۫ حَثِيْثًا/He covers the night with the day chasing it rapidly অর্থাৎ তিনি দিনকে রাত দ্বারা আচ্ছাদিত করেন যাতে ওরা একে অন্যকে অনুসরণ করে চলে ত্বরিত গতিতে...।" [সূরা আল আ‘রাফ ৭ : ৫৪] 

এখানে يُكَوِّرُ এর অর্থ হলো এক বস্তুকে অপর বস্তুর ওপর পেঁচিয়ে বা জড়িয়ে দেয়া। এরপর বলা হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলাই চন্দ্র ও সূর্যকে নিয়মাধীন করে দিয়েছেন যারা তাদের নির্দিষ্ট কক্ষপথ ছাড়া কখনো অন্যত্র চলাচল করে না। প্রত্যেকেই তার নিজ নিজ গতিসীমা বজায় রেখে চলাচল করে। এইটা একটা বৈজ্ঞানিক কথা।

আরেকটু ভাল করে বলি: এখানে يُكَوِّرُ -এর অর্থ এক বস্তুকে অপর বস্তুর উপর পেঁচিয়ে বা জড়িয়ে দেওয়া, রাত্রিকে দিনের উপর পেঁচিয়ে বা জড়িয়ে দেওয়ার অর্থ হল, রাত্রি আনয়ন করে দিনকে ঢেকে দিয়ে তার আলো শেষ করে দেওয়া এবং দিনকে রাত্রি দ্বারা পেঁচিয়ে বা জড়িয়ে দেওয়ার অর্থ হল, দিন আনয়ন করে রাত্রিকে ঢেকে দিয়ে তার অন্ধকার শেষ করে দেওয়া। এর অর্থ এবং (يُغْشِيْ الَّيْلَ النَّهَارَ) (الأعراف-৫৪) এর অর্থ একই। [উক্ত আয়াতের তাফসীরে আহসানুল বয়ান এবং ফাতহুল মাজীদ দ্রষ্টব্য]

[সহজার্থে :এখানে আরবি শব্দ "কাওবেরু"-শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এ শব্দের অর্থ আচ্ছাদিত করা, জড়ানো বা কুন্ডলী করা বা গোল করে প্যাচানো অর্থাৎ যেভাবে মাথার চারিদিকে পাক দিয়ে পাগড়ি বাঁধা হয়। দিন ও রাতের এই আচ্ছাদন/জড়ানো বা প্রবিষ্ট করানো তখনই সম্ভব হতে পারে যদি পৃথিবী গোলাকারের মতো বস্তু হয়। আবার তাই বলে পৃথিবী বলের মত পুরোপুরি গোলাকার নয়। তবে এটা ভূগোলকের মতো অর্থাৎ এটার মেরুদ্বয় চ্যাপ্টা। 

দ্বিতীয় ধাপ
পবিত্র কোরআন মাজীদে বর্ণিত আরেক আয়াতেও পৃথিবীর আকৃতি সম্পর্কে জানা যায় যেখানে বলা হয়েছে ৭৯ নং সূরা আন নাযিয়াত (النّزعت), আয়াত: ৩০ -

وَٱلْأَرْضَ بَعْدَ ذَٰلِكَ دَحَىٰهَآ

এবং পৃথিবীকে এরপর দা-হাহা-(دَحَىٰهَآ) করেছেন।

উল্লেখ্য যে এই "دحا" শব্দটি পবিত্র কোরআনে মাত্র একবার এসেছে। আবার এই আয়াতে যে শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে তা হলো "دَحَاهَا/দা-হাহা"। অধিকাংশ তাফসীরকারকগণের পুরনো অনুবাদগুলোতে এর অর্থ হিসেবে অনুবাদ করা হয়েছে " পৃথিবীকে এরপর বিস্তৃত করেছেন/বিছিয়ে দিয়েছেন/বিছানার ন্যায় ছড়িয়ে দিয়েছেন" বলে। আর ইংরেজিতে এর অনুবাদ করা হয়েছে "Spread out" বলে। আবার এটাই সত্য যে, পুরনো তাফসীরবিদগণ যার যার যুগ অনুযায়ী সমৃদ্ধি জ্ঞানের আলোকে অনুবাদ করেছেন, তাফসীর করেছেন এবং তাঁরা আধুনিক বিজ্ঞান সম্পর্কে জানতেন না বিধায় তাঁরা দাহবুন এর সঙ্গে মিল রেখে অনুবাদ করেছেন যার অর্থ দাঁড়ায় প্রসারিত করা বা বিছিয়ে দেওয়া; যেটাও একটা সঠিক অনুবাদ। আর হ্যাঁ প্রত্যেক ভাষার ন্যায় আরবিতেও একটা শব্দের অনেক রকম অর্থ থাকে। এই যেমন ইংরেজিতে "Live" অর্থ বাস করা, আবার এর অন্য আরেকটা অর্থ "সরাসরি" সম্প্রচার করা বোঝায়। একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝাই:
১] I live in Bangladesh. এখানে live এর অর্থ হবে বাস করা অর্থাৎ আমি বাংলাদেশে বাস করি।
২] Broadcast live on TV. এখানে live এর অর্থ "বাস করা" না হয়ে বরং "সরাসরি" হবে অর্থাৎ টিভিতে সরাসরি সম্প্রচার চলছে। এর মানে বাক্যে অবস্থান অনুযায়ী শব্দের অর্থের পরিবর্তন হয়। ঠিক তেমনি আরবি ভাষাতেও এমনটা রয়েছে। তো আরবি তে দা-হাহা শব্দের অনেক রকম অর্থ রয়েছে যা ডিকশনারি তে পাওয়া যায়। এই যেমন: বিস্তৃতি, প্রসারিত, সম্প্রসারিত, প্রসারণ, ডিম্বাকৃতির, ছড়িয়ে পড়া, বৃত্তাকার তৈরি, সুষম। তাহলে বাক্যে একটা শব্দের অবস্থান অনুযায়ী এর সঠিক অর্থ নিতে হবে আমাদের কে। প্রমাণের জন্য এখানে ক্লিক করুন

আর হ্যাঁ আরবি "ٱلْأَرْضَ (আরদ্)" শব্দের অর্থ দুটো হয়: পৃথিবী, জমিন। তাহলে এইখানে আমরা দা-হাহা( دَحٰٮهَا ) শব্দের প্রত্যেকটি অর্থ নিয়ে একটা বাক্য তৈরি করি। দেখা যাক কী হয়:
i] জমিনকে এরপর করেন বিস্তৃত;
And after that He expanse the earth.
ii] জমিনকে এরপর প্রসারিত করেছেন;
And after that He expanded the earth.
iii] জমিনকে এরপর করেছেন সম্প্রসারিত;
And after that He extended the earth.
iv] জমিনকে এরপর করেছেন প্রসারিত অর্থাৎ ছড়িয়ে দিয়েছেন;
And after that He stretched the earth.
v] পৃথিবীকে এরপর করেছেন ডিম্বাকৃতির;
And after that He egg-shaped the earth.
vi] জমিনকে এরপর ছড়িয়ে দিয়েছেন;
And after that He spread out the earth.
vii] পৃথিবীকে এরপর বৃত্তাকার তৈরি করেছেন;
And after that He made round the earth.
viii] জমিনকে এরপর করেছেন সুষম; (অর্থাৎ বসবাসের উপযোগী করে সমতল বিছিয়েছেন)
And after that He balanced the earth.

উল্লেখ্য যে, এইখানে থাকা প্রত্যেকটি অনুবাদ-ই সঠিক এবং যথার্থ ভাবে ব্যাখ্যাপূর্ণ। এরপরেও ব্যাখ্যা করার মাধ্যমে কোন ভাবেই কোরআন কে ভুল প্রমাণ করা যাবে না। কেননা আপনি যেই অর্থ-ই গ্রহণ করেন না কেন, তা সঠিক ভাবে ব্যাখ্যা করার পরেও কোরআন সঠিক অবস্থানে থাকবে। কিন্তু আমাদের কে কোরআনের বর্ণনা-পরম্পরা বজায় রেখে এর ভাষার সঙ্গে সংগতি রেখে সঠিক অর্থ গ্রহণ করতে হবে। উল্লেখ্য যে, আধুনিক তাফসীরকারকগণের অনেকেই এই আয়াতের অনুবাদে "দা-হাহা (دَحٰٮهَا )" শব্দের অর্থ ডিম্বাকৃতি বলে অনুবাদ করেছেন। নিচে তার প্রমাণ দেওয়া হলো:

i] রাশাদ খলিফার অনুবাদ

ii] ড. কামাল ওমরের অনুবাদ

iii] সৈয়দ ভিকার আহমেদের অনুবাদ

যদি দা-হাহা অর্থ প্রসারিত/সম্প্রসারিত অথবা বিস্তৃত বা সমতল বলে ধরা হয়, তাহলে এর আসল অর্থ হবে,"তিনি পৃথিবীকে মানুষের বসবাসের উপযোগী করে এর ভূমিকে প্রসারিত করেছেন বা সমতল ভাবে বিছিয়ে দিয়েছেন, যেন মানুষ সহ সকল জীব-জন্তু অনায়াসে এর উপর চলাচলে কোনরুপ বাঁধার সৃষ্টি না করে। যা কোরআনের ধারাবাহিক বর্ণনাক্রম থেকে এটাই প্রতীয়মান হয়। আর এমন ব্যাখ্যা করা হয়েছে [তাফসীরে আহসানুল বায়ান ৭৯:৩০] এ।

তো এই আয়াত সম্পর্কে মিশরের বিশিষ্ট ইসলাম প্রচারক, ইতিহাসবিদ ও আরব্য লেখক ড.রাগিব সারজানি বলেছেন, এখানে আরবি دحا শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে যা دحية শব্দ থেকে উদগত। আর دحية এর আবিধানিক অর্থ হলো "বল"। এমনি ভাবে কিছু আয়াতে (৩১:২৯; ৩৫:১৩; ৩৯:৫ সহ ইত্যাদি আয়াত) আল্লাহ্ গোলক পৃথিবীর ঘূর্ণায়মানের ফলে যে দিন-রাত্রি সংঘটিত হয় তা সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন।

পৃথিবীখ্যাত বিশিষ্ট দাঈ ড.জাকির নায়েক তাঁর অধিকাংশ বক্তব্যে বলেছেন, এখানে আরবি শব্দ "دَحَىٰهَآ/দা-হাহা" শব্দের মানে হলো উট পাখির ডিম। আর উট পাখির ডিম পৃথিবীর আকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রায়। আর এভাবেই পবিত্র কোরআন পৃথিবীর আকৃতির ব্যপারে সঠিক বৈজ্ঞানিক তথ্য দিয়েছে। যদিও যখন কোরআন পৃথিবীতে নাযিল হয় তখন অতিপ্রচলিত ধারণা ও বিশ্বাস ছিল পৃথিবীর চ্যাপ্টা আকৃতি।

ব্লগ থেকে পড়তে ক্লিক করুন:

আরবি دحا (daha),বা ধাতু دحو(dah-un) শব্দের অর্থ সম্পর্কে পড়ুন

[নোট: আরবি শব্দ "দাহাহা "-কে আব্দুল্লাহ্ ইউসুফ আলী অনুবাদ করেছেন "সুবিশাল বিস্তার" যা সঠিক অনুবাদ। "দাহাহা "-এর অন্য আরেকটি অর্থ হলো "উট পাখির ডিম"।]

তৃতীয় ধাপ 

মহিমান্বিত ঐশীগ্রন্থ পবিত্র কোরআন মাজীদের ৫৫ নং সূরা আর রহমানের ১৭ নং আয়াতে মহান আল্লাহ পাঁক এরশাদ করেছেন:

رَبُّ ٱلۡمَشۡرِقَيۡنِ وَرَبُّ ٱلۡمَغۡرِبَيۡنِ

তিনিই দুই উদয়াচল ও দুই অস্তাচলের নিয়ন্তা।" [অনুবাদক: মুজিবুর রহমান]

এখানে "দুই উদয়াচল ও দুই অস্তাচল" বলতে পৃথিবীতে একদিনে সূর্যের দুই বার পূর্ব দিকে উদিত হওয়া এবং দুই বার পশ্চিম দিকে অস্ত যাওয়াকে বোঝানো হয়েছে। আর আমরা জানি পৃথিবী দুই গোলার্ধে বিভক্ত; একটা উত্তর গোলার্ধ, আরেকটা দক্ষিণ গোলার্ধ। এখন উত্তর গোলার্ধে যখন সূর্য উদয় হয় দক্ষিণ গোলার্ধে তখন সূর্য অস্ত যায়; আবার যখন দক্ষিণ গোলার্ধে সূর্য উদয় হয় উত্তর গোলার্ধে তখন সূর্যাস্ত যায় অর্থাৎ উভয় গোলার্ধে একে-অন্যের বিপরীত অবস্থা প্রকাশ করে।

একটা উদাহরণ দিয়ে আরেকটু ক্লিয়ার করি:

বাংলাদেশ উত্তর গোলার্ধে অবস্থিত। অপরদিকে আমেরিকা দক্ষিণ গোলার্ধে অবস্থিত। এখন আমরা বাংলাদেশে যখন সূর্য কে পূর্ব দিকে উদিত হতে দেখি, তখন আমেরিকানরা দেখে যে, সেখানে সূর্যটা পশ্চিমে ডুবে যাচ্ছে। তাহলে আমাদের এখানে যখন সকাল, আমেরিকানদের কাছে তখন সন্ধ্যা। আবার আমরা যখন সূর্য কে পশ্চিমে অস্ত যাওয়া দেখি তখন আমেরিকানরা সূর্য কে পূর্ব দিক থেকে উদিত হতে দেখে। তার মানে পৃথিবীতে মোট দুই বার সকাল, দুই বার সন্ধ্যা হয় একে- অন্যের বিপরীতে। এখন দুই বার সকাল, দুই বার সন্ধ্যা তখন- ই হওয়া সম্ভব যদি পৃথিবীর আকৃতি সমতল না হয়ে গোলাকার হয়। আর এ থেকে বোঝা যায় যে, মহান আল্লাহ ইঙ্গিতে পৃথিবীর গোলাকার আকৃতির কথা জানিয়ে দিয়েছেন বহু আগে থেকেই। এই কারণে তিনি বারংবার বলেছেন:-" তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে রাত ও দিন, সূর্য ও চাঁদ অন্যতম [পবিত্র কোরআন ৪১:৩৭]।

এই জন্য আমরা পৃথিবীতে দুবার সূর্যোদয় এবং দুবার সূর্যাস্ত যাওয়া দেখি। আল্লাহ্ কোরআনে এই একই কথা বলেছেন যে,"তিনিই দুই সূর্যোদয় এবং দুই সূর্যাস্তের অধিপতি" [পবিত্র কোরআন ৭০:৪১]। তাহলে তিনি নিশ্চিত জানেন পৃথিবী গোলক। তাই তিনি দুই সূর্যোদয় এবং দুই সূর্যাস্তের কথা উল্লেখ করেছেন। আর এসব থেকেই আমরা সুস্পষ্ট নিদর্শন পাই আর সেটা হলো পৃথিবীর গোলাকার আকৃতি সম্পর্কে কোরআনের ইঙ্গিতপূর্ণ কথা।

২] পৃথিবীর ঘূর্ণায়মান সম্পর্কে...!

পৃথিবী কোন ঘূর্ণায়মান বস্তু কিনা? এ সম্পর্কে কোরআন কী বলে?

আগেই প্রমাণ দেখিয়েছি মহান আল্লাহ্ পবিত্র কোরআন কারীমে অনেক বিষয়ে সুস্পষ্ট কিছু বর্ণনা করার পর বহু বিষয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলেছেন, যা আমাদের মানবজাতির জন্য তাতে নিদর্শন রয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন [পবিত্র কোরআন ৪১:৩৭,৩৯,৫৩; ৪২:২৯,৩২,৩৩; ৪৫:১৩; ৪৬:২৭; ৫৭:১৭; ১০:৫,৬,২৪ সহ ৭০+ ইত্যাদি আয়াত দ্রষ্টব্য যাতে বিভিন্ন নিদর্শনের কথা বলা হয়েছে মানবজাতির উদ্দেশ্যে]। এখন পৃথিবী ঘূর্ণায়মান বস্তু কিনা এ সম্পর্কেও মহান আল্লাহ ইঙ্গিতের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন বহু আগে থেকেই। এখন আমাদের উচিত প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানের আলোকে তা খুঁজে বের করা। কেননা যে কোন ইঙ্গিতপূর্ণ কথা উপযুক্ত সময়ের আগে বোঝা যায় না, বরং উপযুক্ত সময় আসলেই কোরআনের কথাগুলোর সমর্থনে প্রকাশ্য সত্য বেরিয়ে আসে যে কোন মাধ্যমে। আর এখানে প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞান হচ্ছে অন্যতম একটা মাধ্যম।

আরেকটা কথা বলে রাখি, পবিত্র কোরআন হচ্ছে জ্ঞানগর্ভ কিতাব অর্থাৎ কুরআ-নিল হাকীম। কাজেই এতে বিজ্ঞান সম্মত কথা থাকাটাই স্বাভাবিক যা কিনা প্রকৃতপক্ষেই সত্য। তো এই জ্ঞানগর্ভ কিতাব আমাদের কে ইঙ্গিতপূর্ণ কথার মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছে যে, পৃথিবী তার নিজস্ব কক্ষপথে ঘূর্ণায়মান রয়েছে এবং এটা নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত ঘুরতেই থাকবে। তো আমরা উপরে প্রমাণ দেখিয়েছি যে, দিন-রাত্রি সংঘটিত হওয়ার কারণ কী? পৃথিবী গোলক বলেই দিন-রাত্রি সংঘটিত হয়, এক দিনে দুই বার সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত যায়। এখন প্রমাণ দেখাব যে, কোরআনের ইঙ্গিতপূর্ণ কথা পৃথিবীর ঘূর্ণায়মানের দিকে যায় কিনা?

পবিত্র কোরআন মাজীদের ৩১:২৯; ৩৯:৫ নং আয়াতটা ভাল করে লক্ষ্য করুন? মহান আল্লাহ তা'আলা প্রথমে কিভাবে দিন-রাত্রি সংঘটিত হয় অর্থাৎ কিভাবে পর্যায়ক্রমে রাতের পর দিন এবং দিনের পর রাত হয় সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট বর্ণনা করেছেন সংক্ষেপে। এরপর তিনি বর্ণনা করেছেন চাঁদ (উপগ্রহ) এবং সূর্যের (নক্ষত্র) সম্পর্কে যে, তা কিভাবে রয়েছে তার প্রকৃত অবস্থা বর্ণনা করেছেন। তিনি এইখানে জানিয়ে দিলেন যে, রাতের পর দিন এবং দিনের পর রাত এইভাবে পর্যায়ক্রমে দিন-রাত্রি সংঘটিত হয় কারণ পৃথিবী গোলক বলে যার প্রমাণ উপরেই দিয়েছি। আর এইভাবে পর্যায়ক্রমে দিন-রাত্রি সংঘটিত হওয়া সম্ভব কখন? পৃথিবী নিজ কক্ষপথে আবর্তন করলে নাকি এর নিজস্ব কক্ষপথে স্থির থাকলে? নিশ্চয়ই এটা তার নিজস্ব কক্ষপথে আবর্তনের ফলেই পর্যায়ক্রমে দিন-রাত্রি সংঘটন হওয়া সম্ভব। আর যদি পৃথিবী তার নিজস্ব কক্ষপথে ঘূর্ণায়মান না হয়ে বরং স্থির থাকত তাহলে কী এইভাবে পর্যায়ক্রমে দিন-রাত্রি সংঘটন হওয়া সম্ভব হতো?

কস্মিনকালেও হতো না। বরং পৃথিবী স্থির থাকলে এর একদিকে চিরকাল অন্ধকার এবং বিপরীত পাশে চিরকাল আলো থাকত। কিন্তু নাহ্! আমরা জানি পৃথিবীর উভয় গোলার্ধে পর্যায়ক্রমে দিন-রাত্রি হয়। আর এই দিন রাত্রি কেবলমাত্র পৃথিবীর আহ্নিক গতির ফলেই হয় অর্থাৎ এটাকে অবশ্যই ঘূর্ণায়মান হতে হবে। আসলে এইখানে মহান আল্লাহ ইঙ্গিতে বলে দিলেন যে পৃথিবী ঘূর্ণায়মান বস্তু যেমনটা চাঁদ-সূর্য। ঠিক এরপরেই তিনি উপগ্রহ ও নক্ষত্র হিসেবে চাঁদ এবং সূর্যের বাস্তবিক উদাহরণ দিলেন যে, এসব বস্তু নিজস্ব কক্ষপথে ঘূর্ণায়মান রয়েছে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত। আর এইখানে যে আরবি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে সেটা হলো كُلٌّ يَجۡرِىٓ (each moving) যা কোন চলমান জিনিসের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় হোক সেটা গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্র বা অন্যান্য চলমান কোন কিছু। আর এই শব্দটি উদগত হয়েছে جري থেকে যার অর্থ "সে দৌড়ে গেল।" আর এর মধ্যে পৃথিবীও শামিল। কেননা পৃথিবী হলো একটা গ্রহ। আর কোন ঘূর্ণায়মান গ্রহে পর্যায়ক্রমে দিন রাত্রি সংঘটন হওয়া সম্ভব। আর এই জন্য মহান আল্লাহ প্রথমে পারস্পরিক দিন-রাত্রির আবর্তনের বর্ণনা দেওয়ার পরে চাঁদ এবং সূর্যের সম্পর্কে বর্ণনা দিলেন যে, এসবও তাদের নিজস্ব কক্ষপথে ঘূর্ণায়মান রয়েছে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত।

তার মানে মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলার মাধ্যমে এটাও জানিয়ে দিয়েছেন যে, পৃথিবীটাও তার নিজস্ব কক্ষপথে আবর্তন করছে বলেই তো পর্যায়ক্রমে দিন- রাত্রি সংঘটিত হচ্ছে। আর এটাই হচ্ছে দিন- রাত্রি সংঘটিত হবার নিদর্শন। এই জন্য মহামহিমান্বিত আল্লাহ্ সুবাহানাহু ওয়াতা'আলা ৪০ নং সূরা গাফির (আল মুমিন) এর ৮১ নং আয়াতে এরশাদ করেছেন:

یُرِیۡکُمۡ اٰیٰتِهٖ ٭ۖ فَاَیَّ اٰیٰتِ اللّٰهِ تُنۡکِرُوۡنَ

তিনি তোমাদেরকে তাঁর নিদর্শনাবলী দেখিয়ে থাকেন। সুতরাং তোমরা আল্লাহর কোন্ কোন্ নি‘আমাত অস্বীকার করবে?" [অনুবাদক: মুজিবুর রহমান]

অর্থাৎ পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ অসংখ্য বিষয়বস্তু সম্পর্কে নানা ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলে দিয়েছেন যেটা আমরা বিজ্ঞানের কল্যাণে অনুধাবন করতে পেরেছি যে, কোরআনে যা বলা হয়েছে সেটাই প্রকৃত সত্য। আর এই সত্য প্রকাশিত হয়ে যাওয়ার পরেও মানুষ কিভাবে তাঁর নিয়ামতকে অস্বীকার করতে পারে?