Are you sure?

ইতিহাস »  বিবিধ ইতিহাস

ফরাসি বিপ্লবঃ নাস্তিক্যবাদী হত্যাযজ্ঞ

কিছু দিন আগে একটা উক্তি ফেসবুকে বেশ চোখে পড়ছিল, "বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মৌলবাদ দূর করতে আমরা এসেছি"- টাইপের। অনেকে হয়তো এটাকে নেহায়েত রাজনৈতিক বক্তব্য মনে করেছেন, কিন্তু ইতিহাস তেমন বলে না। আপনি ইতিহাস না জানলেও সমস্যা নেই । আবরার ফাহাদ হত্যার কথা তো বেশি পুরাতন না। আবরার প্রমাণ করে গিয়েছে যে, ধর্মনিরপেক্ষতা কতটা ধর্মান্ধ। এসব উদাহরণ আমরা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ভেবে পত্রিকার পাতা উল্টে গেলেও সচেতন ব্যক্তির পক্ষে কখনো নিশ্চিন্ত থাকা সম্ভব না। আবরার হত্যার গল্প আপনাকে যতটুকু শিউরে তুলেছে, ধর্মনিরপেক্ষতার ইতিহাস তার চেয়ে হাজার গুণ রোমহর্ষক । যার সামান্য ধারণা দেয়ার জন্য আমি ফরাসি বিপ্লবের উপর কিছু তথ্য পরিবেশনের চেষ্টা করেছি।
সত্যি বলতে, ফরাসি বিপ্লবের উদ্দেশ্য ছিল যুক্তির ধর্ম প্রতিষ্ঠা। এই ধর্ম হল, সর্বোচ্চ সত্ত্বা 'প্রকৃৃতি'র ধর্ম, যা প্রচলিত ধর্ম উৎখাতের উদ্দেশ্যে রুশোর প্রস্তাবিত গণধর্মের উপর ভিত্তি করে সৃৃষ্টি করা হয়েছে। তাই প্রথাগত ধর্মগুলোর বিলুপ্তি ও নব্য গণধর্মের প্রচলনকে ঐতিহাসিক অগ্রগতি বলে উপস্থাপিত করা হয়েছিল।
যেহেতু দাবি করা হয়েছিল যে, প্রচলিত ধর্ম বিলুপ্তির ফলাফল হল- একটি কল্পিত উন্নত রাষ্ট্র বা utopia এবং 'মানুষের ভবিষ্যত' ধর্মের বিলুপ্তির সাথেই সামঞ্জস্যপূর্ণ; সেহেতু বিপ্লবীরা স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃৃত্বের নামে ধর্ম উৎখাতের পুণ্যময় আবেগে প্রজ্বলিত হয়ে ওঠে। নব্য গণধর্ম, তার সংজ্ঞানুসারে ধর্মবিরোধী হবার কারণে বিপ্লবী ফ্রান্সে তখন রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে যাজক, সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীদের এবং 'উদারনীতির শত্রু' অন্যান্য ধর্মভীরুদের হত্যা করা হয়। এমনই বিভীষিকাময় ছিল ত্রাসের রাজত্ব(reign of terror 1793-1794) এবং বিশেষ করে ভডের (vendèe) আতঙ্ক (1793), ত্রাসের মুকুটজয়ী অর্জন।
স্বাধীনতা ও সাম্যের প্রতি অগাধ প্রেম যখন সবচেয়ে বেশি ছিল, তখন ফ্রান্সে ত্রাসের রাজত্ব মোটেও গৃৃহযুদ্ধ বা শ্রেণি সংগ্রাম ছিল না। এটা ছিল অতীতের সাথে সমস্ত সম্পর্কের ছেদের দ্বারা ইতিহাসের নবযুগ সূচনার উদ্দেশ্যে চাপিয়ে দেয়া ধর্মযুদ্ধ। ভলতেয়ারের মত ফরাসি বিপ্লবীদের যাজকবিদ্বেষ শুধু যে চরিত্রহীন পাদ্রীদের বিরুদ্ধে ছিল তা নয়, বরং গোটা ধর্মভীরু গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ছিল। তাই যাজকদের পাশাপাশি সাধারণ ধার্মিকরাও ত্রাসের রাজত্বকালে নৃৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বলপূর্বক প্রথাগত ধর্ম উৎখাত করে গণধর্ম প্রতিষ্ঠা করা হয়। সন্ত্রাসের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল যাজক ও সন্ন্যাসীদের হত্যা, জনসম্মুখে নারীদের প্রহার, উপাসনালয়ের সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ, প্রতিমা বিবস্ত্রকরণ, উপাসনালয় ও প্রার্থনাসভা অপবিত্রকরণ এবং নতুন সর্বেশ্বরবাদী ধর্মের ঘোষণা, নতুন ধর্মনিরপেক্ষ দিনপঞ্জিকা প্রবর্তন, রাজপথের নাম সাধকদের থেকে পাল্টে বিপ্লবীদের নামে রাখা হয়, এবং মহান ও ধ্বংসাত্নক ভাববাচক উপাস্যের (স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃৃত্ব) প্রকৃৃত উপাসনা শুরু হয়। কথিত "দেশপ্রেমিক" ও "নাগরিকদের" নিকট ধ্বংসযজ্ঞ ও পুনর্গঠন উভয়ই মানবজাতির অগ্রগতির জন্য অপরিহার্য বলে বিবেচিত হত। [i]
এই অগ্রগতি , বর্বরতার এত বড় স্মারক ছিল যে, পরবর্তীকালের উদারবাদীরা লজ্জাবোধ করেন। ফরাসি বিপ্লবের বাস্তবতা উদারনীতির ধর্মীয় বিশ্বাস, মানে-প্রচলিত ধর্মই ইতিহাস জুড়ে সকল রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের একমাত্র কারণ, এমন অন্ধ বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক। একজন উদারনৈতিক ইতিহাসবেত্তা হয়তো বনু কুরাইযার মৃৃত্যুদণ্ডকে ফুলিয়ে ফাপিয়ে আবেগঘন রঙ মিশিয়ে ধর্মভীরুদের কেন্দ্রীয় বিশ্বাসের ভিত্তিগত পচনের নিদর্শন হিসাবে বর্ণনা করবে; যদিও মাত্র কয়েক শ' লোক সেদিন মারা গিয়েছিল। কিন্তু তারা ত্রাসের রাজত্বকালে ভডের হত্যাযজ্ঞকে এড়িয়ে যায়, হালকাভাবে উপস্থাপন করে বা অপব্যাখ্যা করে। অথচ প্রায় আড়াই লক্ষ ধর্মভীরু মানুষকে সেদিন ফরাসি বিপ্লবের সন্ন্যাসীদের হাতে 'রাষ্ট্রের শত্রু' হিসাবে জবাই হতে হয়েছিল।
উদারপন্থীরা এই মহা অপরাধের ব্যাপারে সর্বদাই সন্দেহ পোষণ করে; নিহতের সংখ্যা কমিয়ে [ii] এবং ধর্মদ্রোহী এই যুদ্ধকে শ্রেণী সংঘাত, বলে প্রচার করেছে। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের ঐতিহাসিক অপরাধের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করা, উদারপন্থীদের এই বিশ্বাস অটুট রাখার জন্য জরুরি যে- ঐতিহাসিক অগ্রগতি মানেই ধর্মনিরপেক্ষ ।
Michael Burleigh লিখেছেন,

“This was the first occasion in history when an ‘anticlerical’ and self-styled ‘non-religious’ state embarked on a programme of mass murder that anticipated many twentieth-century horrors... The secular state was just as capable of unimaginable barbarity as any inspired by religion"

"ইতিহাসের এটাই প্রথম ঘটনা ছিল যখন একটি 'যাজকবিরোধী' এবং স্ব-শৈলীযুক্ত 'অ-ধর্মীয়' রাষ্ট্র,  একটি গণহত্যার কর্মসূচী শুরু করেছিল, যা বিংশ শতাব্দীর অনেক ভয়াবহতার আগেই সংগঠিত হয়েছে...ধর্ম দ্বারা অনুপ্রাণিত যে কোনও রাষ্ট্রের মতই ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র অকল্পনীয় বর্বরতা ঘটাতে সক্ষম ছিল" । [iii]

অত:পর, বার্লি আলোচনা করেন যে, ফরাসি বিপ্লব ছিল একটি রাজনৈতিক ধর্মবিশ্বাস যা পরবর্তী দু'শ বছরের ইতিহাসকে মলিন করে দিয়েছে।
একটি মহান ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে নতুন উদার রাজনৈতিক ব্যবস্থার অবতারণা করার প্রথম প্রচেষ্টা হিসাবে, ফরাসি বিপ্লব উদারনীতির জন্য অনুকরণীয়। স্বাধীনতা, সমতা এবং ভ্রাতৃত্ব সম্পর্কে তার সমস্ত আবেগপূর্ণ বক্তৃতা সহ; লক্ষ্য অর্জনে এর নির্মমতা; এবং আদর্শ হিসাবে কঠোর পৌত্তলিক রোমান প্রজাতন্ত্রকে আলিঙ্গন; এবং এমনকি তার নিজস্ব একটি সংশোধিত পৌত্তলিক ধর্ম সৃষ্টি, সবকিছু মিলিয়ে ফরাসি বিপ্লব হল একটি স্পষ্ট উদাহরণ যাকে আমরা কঠোর উদারনীতি বলতে পারি। পরবর্তীতে ইতিহাস থেকে ধর্মকে মুছে ফেলার জন্য ধর্মনিরপেক্ষতার কোন প্রচেষ্টা এরকম রক্তাক্ত হতে পারে নি।
(কোনটি আরও বেশি হয়েছে, যেমন সোভিয়েত ইউনিয়নে; কিছু ক্ষেত্রে কম, যেমন একবিংশ শতাব্দীর ইংল্যান্ড এবং আমেরিকায় জনজীবন ধর্মনিরপেক্ষ করার জন্য নরম উদারনীতির ক্রমাগত চাপ।) কিন্তু সবারই একই আবেগ এবং একই লক্ষ্য। তারা সকলেই ধর্মনিরপেক্ষতা, ধর্মের নির্মূল এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক ধর্মের কিছু সংস্করণের প্রতিস্থাপনকে ইতিহাসের অগ্রগতি হিসাবে সংজ্ঞায়িত করে।

 

i. Simon Schama’s Citizens: A Chronicle of the French Revolution (New York: Alfred A. Knopf, 1989), ch. 17–19, and Michael Burleigh, Earthly Powers: The Clash of Religion and Politics in Europe from the French Revolution to the Great War (HarperCollins, 2005), ch. 3.

ii. Schama, Citizens , pp. 791–92.

iii. Burleigh, Earthly Powers , p. 97.