Are you sure?

ইতিহাস »  সিরাত

হাসান রা. ৯০টি বিবাহ করেছিলেন?

প্রশ্ন: হাসান রা. কি বিয়ের পরই তালাক দিতেন? এই ঐতিহাসিক বর্ণনা কি সঠিক, হাসান রা. বিয়ের পর বিয়ে করতেন এবং অধিক পরিমাণে তালাক দিতেন? এমনকি তার উপাধি ‘মিতলাক' অর্থাৎ অধিক পরিমাণে তালাকদাতা পড়ে গিয়েছিল।[1]

 

উত্তর: এই বর্ণনাটি সন্দেহযুক্ত। কারণ মুআবিয়া রা.- এর সঙ্গে হাসান রা. সন্ধি করায় ষড়যন্ত্রকারীরা প্রচণ্ডভাবে হতাশ হয়েছিল। এজন্য তারা একদিকে তাকে (হাসান রা.) ‘মুজিল্লিল আরব' (আরবিদের অপদস্থকারী) এর মতো গালি দিত।[2] ”অন্যদিকে তার সম্পর্কে এমন কিছু বর্ণনা ছড়িয়ে দেয় যে, তিনি জীবনভর বিয়ে পর বিয়ে আর তালাকের পর তালাকে কাটিয়েছেন। তার এই সন্ধিও ছিল আরাম-আয়েশের জন্য। এসব বর্ণনার বেশির ভাগ অত্যন্ত দুর্বল; বরং অধিকাংশ বর্ণনা পরম্পরা বিচ্ছিন্ন এবং সনদহীন। মুত্তাসিল বা পরম্পরা সম্বলিত বর্ণনা মাত্র দুটি। একটি বালাজুরির, আরেকটি আসাকিরের। আর বাকিগুলো মুনকাতি বা পরম্পরা বিচ্ছিন্ন। মাঝের সূত্র সম্পর্কে কিছু জানা সম্ভব হয় নি।

বালুজুরির বর্ণনা অনুযায়ী আব্বাস ইবনু হিশাম কালবি থেকে, তিনি তার বাবা মুহাম্মাদ ইবনু সায়িব কালবি থেকে বর্ণনা করেছেন যে, হাসান রা. ৯০ টি বিয়ে করেছিলেন। তিনি বিয়ে করতেন আর তালাক দিতেন। এমনকি আলি রা. বলেছেন, আমার আশঙ্কা হচ্ছে অনেক গোত্রের সঙ্গে আমাদের শত্রুতার সৃষ্টি হয়ে যায় কি না![3] এই বর্ণনার পুরো ধারাবাহিকতা শিয়া ঐতিহাসিকদের; এটি দুর্বল বরং মনগড়া হওয়ার বিষয়টি পরিষ্কার। বালাজুরির পর কোনো ঐতিহাসিক পাঁচ শতাব্দী পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোনো বর্ণনা পেশ করেন নি। পাঁচ শতাব্দী পর ইবনু আসাকির তারিখে দিমাশকে হাসান রা.-এর অধিক পরিমাণে বিয়ে করা এবং তালাক দেওয়ার ব্যাপারে বেশ কিছু বর্ণনা একত্র করেন।[4] কিন্তু সবগুলো মুহাম্মাদ ইবনু উমার ওয়াকিদি থেকে বর্ণিত এবং সবগুলোর সনদ পরম্পরা বিচ্ছিন্ন।

ষষ্ঠ ও সপ্তম হিজরি শতকের কোনো-কোনো ঐতিহাসিক সনদ বাদ দিয়ে এসব বর্ণনাকে যথারীতি ওয়াকিদির ছাত্র মুহাম্মাদ ইবনু সাদের সূত্রে বর্ণনা করেন; কিন্তু বিস্ময়ের বিষয় হলো, মুহাম্মাদ ইবনু সাদের ‘আত-তাবকাতুল কুবরা'য় এসব বর্ণনা নেই। এর পরিবর্তে এসব বর্ণনা কয়েক শতাব্দী পরে তাহজিবুল কামাল, সিয়ারু আলামিন নুবালা ও আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়াতে পাওয়া যায় এবং এসবও পরম্পরা বিচ্ছিন্নতার সঙ্গে। এসব বর্ণনার ওপর একটি দৃষ্টি দেওয়া যাক। তারিখে দিমাশকে আছে—

  • ১. 'হাসান রা. ৯০ জন নারীকে বিয়ে করেছিলেন।[5]  এর বর্ণনাকারী ইবনু জাদাবাহ অর্থাৎ ইয়াজিদ ইবনু আয়াজকে মিথ্যুক ও পরিত্যাজ্য বলে সাব্যস্ত করা হয়েছে।[6] বর্ণনায় বিয়ের স্থলে ‘আহসান' শব্দটিও ভাবনার বিষয়। একই বর্ণনা সিয়ারু আলামিন নুবালায় মাদায়িনি থেকে পরম্পরা বিচ্ছিন্ন সনদে বর্ণিত হয়েছে।[7] মূল বর্ণনা ইবনু জাদাবাহরই।

  • ২. ‘আলি রা বলেন, হে কুফাবাসী, হাসানের সঙ্গে (নিজেদের মেয়েদের) বিয়ে দিয়ো না। কেননা, সে বেশি বেশি তালাক প্রদানকারী।[8] হাফিজ যাহাবি রহ. এটাকে দুই জায়গায় উল্লেখ করেছেন। একটি স্থানে এটাকে জাফর ইবনু মুহাম্মদের সনদের উল্লেখ করেছেন; কিন্তু এই সনদটি পরম্পরা বিচ্ছিন্ন।[9] অন্যত্র এটাকে ওয়াকিদি থেকে বর্ণনা করেছেন।[10] আর ওয়াকিদির দুর্বল হওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট।

  • ৩. ‘হাসান ইবনু আলি অধিক পরিমাণে নারীদের তালাক প্রদানকারী ছিলেন।[11] উল্লিখিত বর্ণনাটি হুবহু শব্দে ‘তাহজিবুল কামাল' কিতাবে উল্লেখ আছে।[12] হাফিজ ইবনু কাসির রহ.ও এই বর্ণনাটি ওয়াকিদি সূত্রে উল্লেখ করেছেন।[13] মোটকথা, কালবি বংশের মতো কট্টর রাফিজি, ইবনু জাদাবাহর মতো মিথ্যুক এবং ওয়াকিদির মতো দুর্বল বর্ণনাকারীদের দেখার পর এ ধরনের বর্ণনাকে কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি দেওয়ার কোনো কারণ থাকতে পারে না। দুর্বল ও মনগড়া বর্ণনায় হাসান রা.- এর বিয়ের ব্যাপারে একটি উক্তি ৭০, আরেকটি ৫০ এবং তৃতীয়টি ৩০০ এর। প্রথম উক্তিটি নাহজুল বালাগাহর ব্যাখ্যাকারক ইবনু আবিল হাদিদ (মৃত্যু ৬৫৫ হিজরি) থেকে বর্ণিত। কট্টর শিয়া ও মুতাজিলা হওয়ার কারণে তার বর্ণনার ওপর কোনো ভরসা করা যায় না।[14] দ্বিতীয় ও তৃতীয় মতটি আবু তালিব মক্কি 'কুওয়াতে কুলুব’ নামক তাসাউফের কিতাবে উল্লেখ করেছেন, যেখানে মুতাজিলাদের কোনো সূত্রে উল্লেখ করেন নি। সেখানে এটাও লেখা হয়েছে, তিনি একসঙ্গে কখনো কখনো চারটি করে বিয়ে করতেন এবং চারটিকে তালাক দিয়ে দিতেন। এমনকি আলি রা.- কে বলতে হয়েছে, হাসানের সঙ্গে বিয়ের সম্বন্ধ করো না। সে অধিক পরিমাণে তালাক দিয়ে থাকে।[15]

 

মোটকথা, এসব বর্ণনা খুবই দুর্বল; বরং অধিকাংশ পরম্পরা বিচ্ছিন্ন এবং সনদহীন। আর সনদ থাকলেও সেখানে হিশাম কালবি, ইবনু জাদাবাহ এবং ওয়াকিদির মতো বর্ণনাকারী রয়েছেন, যাদেরকে রিজালের কিতাবে যথেষ্ট দুর্বল হিসেবে গণ্য করা হয়। বরং ভাবলে এই বিষয়টি আর গোপন থাকে না যে, এসব বর্ণনায় ‘মুতাকে' ইমামদের সুন্নত সাব্যস্ত করার জন্য প্রসিদ্ধ করা হয়েছে। সবাই এটা জানেন তালাককে নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ‘আল্লাহর কাছে সবচেয়ে নিকৃষ্ট বৈধ কাজ' হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।[16] এ তালাক শুধু একটি প্রয়োজনের খাতিরে হালাল করা হয়েছে; কিন্তু তালাকের শিকার নারীদের জিজ্ঞেস করে দেখেন—এর দ্বারা তাদের ওপর দিয়ে কী অতিবাহিত হয়ে থাকে! অন্তর থেকে কী পরিমাণ বদদুআ বের হয়। এ ধরনের অভদ্র কাজ হাসান রা.-এর মতো একজন ভদ্র মানুষ অব্যাহতভাবে করছিলেন? তার কাছে কি নারীদের অবস্থান খেলনার মতো ছিল-- যা বারবার পাল্টানো হয়! বলা হয়ে থাকে, লোকেরা নিজেরাই হাসান রা.- এর সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপনের জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকত, যাতে সাইয়িদ বংশের সঙ্গে সম্বন্ধ করার গৌরব অর্জিত হয়; কিন্তু এই সমাজে যদি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ এভাবে হতো তাহলে হাসান রা. - এর আগে তার বাবা আলি রা.- এর সঙ্গে এটা আরও বেশি পরিমাণে হতো। লোকেরা সম্পর্ক করার জন্য তার চেয়ে আলি রা.-কে বেশি গুরুত্ব দিতো। ধরে নিলাম, সম্পর্ক ও সম্মানের জন্য হাসান রা.- এর সঙ্গে এত বেশি আত্মীয়তার সম্পর্ক এসেছে তাহলে ওই নারীরা এবং তাদের বংশের পরিচয় কেন ইতিহাসে সংরক্ষিত নেই? এসব নারী উম্মতের অত্যন্ত সম্মানি, নামকরা এবং অন্যন্য হিসেবে পরিগণিত হতেন। এই সম্মানের কারণে তো তাদের চল্লিশ-পঞ্চাশ পুরুষের নাম সংরক্ষিত থাকার কথা; কিন্তু হাদিস, ইতিহাস এবং বংশীয় ধারার যাবতীয় ভান্ডার অনুযায়ী বিভিন্ন সময় মাত্র ছয়জন নারীর সঙ্গে হাসান রা.-এর বিয়ের কথা প্রমাণিত। তারা হলেন—

  • ১. আয়িশা খাসামিয়া.।
  • ২. বিনতুল আশআস।
  • ৩. উম্মু ইসহাক বিনতু তালহা।
  • ৪ . উম্মু কুলসুম বিনতু ফজল ইবনি আব্বাস।
  • ৫. হিন্দ ইবনু সুহাইল।
  • ৬. খাওলা বিনতে মানজুর।

এই ছয়জন ছাড়া হাসান রা.-এর  আর কোনো স্ত্রীর কথা কোথাও পাওয়া যায় না।[17] হাসান রা. যদি এতগুলো বিয়ে করে থাকতেন তাহলে তার বংশধর এত বেশি না হোক অন্তত স্ত্রীদের অর্ধেক তো হতেন! কিন্তু তার মাত্র ১০ সন্তান ছিলেন, যারা উল্লিখিত ছয়জন স্ত্রীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছেন।

 

রেফারেন্স:
[1] আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ১১/১৯৭, ১৯৮।
[2] তারিখুত তাবারি: ৫/১৬৫। 
[3] আনসাবুল আশরাফ: ৩/২৫ , দারুল ফিকর সংস্করণ।
[4] তারিখু দিমাশক: ১৩/২৪৯।
[5]তারিখ দিমাশক: ১৩/২৪৮, ২৪৯, মাদায়িনি থেকে, তিনি জাদাবাহ থেকে।
[6] তাকরিবুত তাহজিব, জীবনী- ৭৭৬১।
[7] সিয়ারু আলামিন নুবালা: ৩/২৬৭, আর-রিসালা সংস্করণ।
[8] তারিখু দিমাশক: ১৩/২৪৯, মুহাম্মাদ ইবনে উমার ওয়াকিদি থেকে।
[9] সিয়ারু আলামিন নুবালা: ৩/২৬২, আর-রিসালা সংস্করণ।
[10] সিয়ারু আলামিন নুবালা: ৩/২৬৭, আর-রিসালা সংস্করণ।
[11] তারিখ দিমাশক: ১৩/২৫১, ওয়াকিদি থেকে।
[12] তাহজিবুল কামাল: ৬/২৩৭, মুহাম্মাদ ইবনি সাদ ওয়াকিদি থেকে, পরম্পরা বিচ্ছিন্ন সনদে।
[13] আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ১১/১৯৭, ১৯৮।
[14] আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ১৭/৩৫৪।
[15] কুওয়াতুল কুলুব: ২/৪০৯, আল-আলামিয়া সংস্করণ।
[16] সুনানু আবি দাউদ, হাদিস নং: ২১৮০, কিতাবুত তালাক, বাবু জিকরি কারাহিয়াতুত তালাক।
[17] তারিখু দিমাশক: ১৩/২৫১; আল - বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ১১/২০৮; আল-মহবার: ১/৪৪২, ৪৩৯, ৪৫০, ৩২৬।

[মূল: মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস খন্ড ৫. পৃষ্ঠা: ১৬৭-১৭১]।