Are you sure?

বিবিধ »  ইসলাম বিদ্বেষীদের অপনোদন

মারিয়া রাঃ প্রসঙ্গে কোরআনের কিছু আয়াতের পটভূমিকা

প্রচলিত সুবিধাভোগী ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী-ভিত্তিক সম্প্রদায়ের কায়েমি স্বার্থে আঘাত করে ইসলাম মানবতাকে অন্যায়-অবিচার থেকে মুক্তির পথ দেখিয়েছিল। স্বার্থহানীর কারণে কায়েমি স্বার্থবাদীরা ইসলামের এই অগ্রযাত্রাকে ইসলামের সূচনা কাল থেকেই থামিয়ে ফেলতে বা পৃথিবী থেকে এই দর্শনকে বিলীন করে দেবার জন্য সর্বশক্তি দিয়ে প্রচেষ্টা চালিয়েছিল এবং এখনও চালিয়ে যাচ্ছে। 

৬১০ খৃঃ থেকেই প্রতিবিপ্লবী ইসলাম-বৈরী শক্তি, যখন যেভাবে পারে সেভাবেই ইসলামের মহান মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করার প্রচেষ্টায় নিয়োজিত আছে; কখনও পুরো মিথ্যা ঘটনার আমদানি করে, কখনও বা সত্য ঘটনার সাথে কৌশলে মিথ্যার প্রলেপ দিয়ে মিথ্যাচার করে। 

শত শত মিথ্যাচারের মধ্যে এমনি একটি রটনা-

" মুহাম্মদ ﷺ-এর এক স্ত্রী হাফসা রাঃ-এর মারিয়া নামের এক অতীব সুন্দরী দাসী ছিল। যাকে দেখে মুহাম্মদ ﷺ অনুরক্ত হয়ে পড়েন। তাই মারিয়াকে ভোগের জন্য একদিন হাফসা রাঃ-কে মিথ্যা কথা বলেন যে, হাফসা রাঃ-এর বাবা উমর রাঃ নাকি হাফসা রাঃ-এর সাথে কথা বলতে চান। তাই হাফসা রাঃ-কে মদিনা থেকে ১.৫/২ মাইল দূরে আপার মদিনার আল আলিয়া/ওয়ালিয়ার উনার বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু হাফসা রাঃ সেখানে গিয়ে জানতে পারেন যে তাঁর বাবা তাকে খবর দেননি। বাড়িতে ফিরে এসে মুহাম্মদ ﷺ-কে মারিয়া সহ উনার বিছানায় দেখতে পান। আর তা দেখে হাফসা রাঃ মেনে নিতে পারেন নাই। এই নিয়ে হাফসা রাঃ উচ্চ কণ্ঠে শোরগোল শুরু করলে তিনি হাফসা রাঃ-এর কাছে শপথ করে মারিয়া রাঃ-কে উনার জন্য হারাম করেন। এবং এই ঘটনাটি যেন আর কাউকে না বলে গোপন রাখেন এই অনুরোধ করেন। কিন্তু এই অনুরোধ হাফসা রাঃ রক্ষা করতে পারেননি, তিনি তা আয়েশা রাঃ-এর কাছে বলে দেন। এবং আয়েশা রাঃ মুহাম্মদ ﷺ-এর অন্যান্য স্ত্রীদের নিয়ে কষ্ট দেওয়া শুরু করেন। যার কারণে মুহাম্মদ ﷺ রাগান্বিত হয়ে তাদেরকে শাস্তি দেবার জন্য একমাস স্ত্রীদেরকে যৌন সম্পৃক্ততা থেকে দূরে রাখেন। এবং সুরা আত তাহরিমের প্রথম ৫ আয়াত নাজিল করে পরিস্থিতি নিজের অনুকূলে নিয়ে আসেন। "

এই অপপ্রচারের জবাব দেবার আগে সূরা আত-তাহরীমের প্রথম পাঁচ আয়াত নাজিলের কারণ নিয়ে কিছু আলোচনার প্রয়োজন।

সুরা তাহরিমের আয়াতে আছে,

১) “হে নবী, আল্লাহ আপনার জন্যে যা হালাল করছেন, আপনি আপনার স্ত্রীদেরকে খুশী করার জন্যে তা নিজের জন্যে হারাম করেছেন কেন? আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়াময়। 
২) আল্লাহ তোমাদের জন্যে কসম থেকে অব্যহতি লাভের উপায় নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আল্লাহ তোমাদের মালিক। তিনি সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। 
৩) যখন নবী তাঁর একজন স্ত্রীর কাছে একটি কথা গোপনে বললেন, অতঃপর স্ত্রী যখন তা বলে দিল এবং আল্লাহ নবীকে তা জানিয়ে দিলেন, তখন নবী সে বিষয়ে স্ত্রীকে কিছু বললেন এবং কিছু বললেন না। নবী যখন তা স্ত্রীকে বললেন, তখন স্ত্রী বললেনঃ কে আপনাকে এ সম্পর্কে অবহিত করল? নবী বললেন, যিনি সর্বজ্ঞ, সম্যক অবহিত, তিনি আমাকে অবহিত করেছেন। 
৪) তোমাদের অন্তর অন্যায়ের দিকে ঝুঁকে পড়েছে বলে যদি তোমরা উভয়ে তওবা কর, তবে ভাল কথা। আর যদি নবীর বিরুদ্ধে একে অপরকে সাহায্য কর, তবে জেনে রেখো আল্লাহ জিবরাঈল এবং সৎকর্মপরায়ণ মুমিনগণ তাঁর সহায়। উপরন্তু ফেরেশতাগণও তাঁর সাহায্যকারী।”

সহিহ মুসলিমের রিওয়াতে এসেছে , 

 আবূ কুরায়ব মুহাম্মাদ ইবনুল ’আলা ও হারূন ইবনু আবদুল্লাহ (রহিমাহুমাল্লাহ) (আবূ উসামাহ সূত্রে) ..... হিশামের পিতা (উরওয়াহ্) সূত্রে আয়িশাহ্ (রাযিঃ) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিষ্ট দ্রব্য (হালুয়া) ও মধু পছন্দ করতেন। তার নিয়ম ছিল- আসরের সালাত (সালাত/নামাজ/নামায) আদায়ের পরে স্ত্রীদের ঘরে ঘরে এক চক্কর গিয়ে আসতেন এবং তাদের সান্নিধ্যে-সন্নিকটে গমন করতেন। এভাবে তিনি হাফসাহ (রাযিঃ) এর কাছে গেলেন এবং তার কাছে স্বাভাবিকভাবে আবদ্ধ থাকার সময়ের চেয়ে অধিক সময় আবদ্ধ রইলেন। আমি (আয়িশাহ্) এ বিষয় জিজ্ঞেস করলে আমাকে বলা হল- তাকে (হাফসাকে) তার গোত্রের কোন মহিলা এক পাত্র মধু হাদিয়া দিয়েছিল। তাই সে তা থেকে কিছু রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে পান করিয়েছিল।

(আয়িশাহ বলেন) আমি বললাম, ওহে আল্লাহর কসম! আমি অবশ্যই তার জন্য কৌশলের ফাঁদ পাতব। আমি বিষয়টি সাওদাহ্ এর সঙ্গে আলোচনা করলাম এবং তাকে বললাম, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমার কাছে আগমন করলে তিনি তো তোমার সন্নিকটে আসবেন, তখন তুমি তাকে বলবে, হে আল্লাহর রসূল! আপনি মাগাফীর খেয়েছেন। তখন তিনি তো তোমাকে বলবেন- ’না’। তখন তুমি তাকে বলবে, (তবে) এ দুর্গন্ধ কিসের?- আর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট হতে দুৰ্গন্ধ পাওয়া যাবে- এটা ছিল তার কাছে অতি অসহনীয় বিষয়। তখন তিনি তোমাকে বলবেন- হাফসাহ আমাকে মধুর শরবত পান করিয়েছে। তুমি তখন তাকে বলবে, ঐ মধুর মৌমাছি- উরফুত (গাছের কষ) চুষেছে।" আর আমিও তাকে এভাবেই বলব। আর তুমিও হে সফিয়াহ! তাই বলবে।

পরে যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাওদাহ (রাযিঃ)-এর কাছে গেলেন- ’আয়িশাহ্ (রাযিঃ) বলেন, সাওদাহ্ (রাযিঃ) এর বর্ণনা- “কসম সে সত্তার যিনি ব্যতীত আর কোন ইলাহ নেই! তুমি আমাকে যা কিছু বলেছিলে তা তার কাছে প্রকাশ করেই দিচ্ছিলাম প্রায় তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তখন দরজায়- তোমার ভয়ে (তা আর করা হল না)। পরে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার নিকটবর্তী হলে সে বলল, “হে আল্লাহর রসূল! আপনি মাগাফীর খেয়েছেন? তিনি বললেন, ’না’। সে (সাওদাহ্) বলল, তবে এ ঘ্রাণ কিসের? রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হাফসাহ আমাকে মধুর শরবত পান করিয়েছে। সাওদাহ্ বলল, (তবে তাই) তার মৌমাছি উরফুত বা মাগাফিরের ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করেছে।”

পরে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার নিকট আগমন করলে আমিও তাকে অনুরূপ বললাম। অতঃপর সফিয়্যাহ্ (রাযিঃ) এর কাছে গেলে সেও অনুরূপ বলল। পরে (আবার) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাফসাহ এর নিকট গেলে সে বলল, হে আল্লাহর রসূল! আমি কি আপনাকে তা পান করতে দিব না? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তার প্রতি আমার কোন চাহিদা নেই।” আয়িশাহ (রাযিঃ) বলেন, সাওদাহ (রাযিঃ) বলতে লাগল, আল্লাহর কসম আমরা তো তাকে (একটি প্রিয় পানীয় হতে) বঞ্চিত করে দিয়েছি। আয়িশাহ্ (রাযিঃ) বলেন, চুপ থাক।1

তাফসিরে ইবনে কাসির সহ প্রায় সকল তাফসিরে এসেছে , এবং উপরে উল্লেখিত  মুসলিমের হাদিসটির মত  সহীহ বুখারী, তিরমিজি , নাসই , মাজাহ সহ বিভিন্ন গ্রন্থের বিভিন্ন  রিওয়াতে এ আয়াতসমূহের প্রেক্ষাপট নিয়ে একটি ঘটনা বর্ণিত রয়েছে। রাসূল (ﷺ) মিষ্টি ও মধু ভালোবাসতেন। তিনি যয়নাব বিনতে জাহশ ( রাঃ ) এর ঘরে মধু পান করতেন। এ কারণে তিনি তার ঘরে কিছুটা বিলম্ব করতেন। এই জন্যেই আয়েশা ( রাঃ ) ও হাফসা ( রাঃ ) পরামর্শ করেন যে, তাদের মধ্যে যার কাছেই রাসূল (ﷺ) প্রথমে আসবেন, তিনি যেন রাসূল (ﷺ) কে বলেন যে, “আপনার মুখ থেকে মাগাফীরের2 গন্ধ আসছে। সম্ভবত আপনি মাগাফীর খেয়েছেন।” তাই রাসূল(ﷺ) তাদের নিকটে আসলে তারা এ কথাই বললেন। রাসূল (ﷺ) মুখে দূর্গন্ধ থাকাটাকে খুবই অপছন্দ করতেন। তাই তিনি বললেন, “আমি যয়নাবের ঘরে মধু খেয়েছি। আমি শপথ করছি যে, আর কখনো মধু খাবো না।” তিনি তাঁর এই শপথের কথা অন্য কারো নিকট প্রকাশ করতে নিষেধ করলেন। কারণ সবাই যদি জানতে পারে রাসূল (ﷺ) নিজের জন্য মধু হারাম করেছেন, তাহলে প্রত্যেকেই নিজের জন্য মধু হারাম করে নিবে। 
৩য় আয়াতে “নবী তাঁর একজন স্ত্রীর কাছে একটি কথা গোপনে বললেন” বলতে রাসূল (ﷺ) এর এই মধু পান না করার শপথের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। আর দু’জন স্ত্রী বলতে বোঝানো হয়েছে আয়েশা ( রাঃ ) এবং হাফসা ( রাঃ ) কে।3

রাসূল (ﷺ) নিষেধ করলেও একজন স্ত্রী তা অপরজনের নিকট প্রকাশ করে দেয়। আল্লাহ্‌ তায়ালা আয়াত নাযিল করে রাসূল (ﷺ) কে এ কথা অবহিত করেন। রাসূল (ﷺ) এ ব্যাপারে উক্ত স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলে যে স্ত্রী কথাটি প্রকাশ করেছেন তিনি খুবই অবাক হন এবং জানতে চান যে, কে রাসূল (ﷺ) কে এ ব্যাপারে জানিয়েছেন? তখন রাসূল (ﷺ) জবাব দেন, “যিনি সর্বজ্ঞ, সম্যক অবহিত, তিনি আমাকে অবহিত করেছেন।”
যেহেতু নবীদের স্ত্রীদের নিকট এমন আচরণ প্রত্যাশিত নয়, তাই আল্লাহ্‌ তায়ালা আয়াত নাযিল করে তাদেরকে তিরস্কার করেন এবং সংশোধনের নির্দেশ দেন। 

এই চারটি আয়াতের প্রেক্ষাপট নিয়ে আরেকটি ঘটনা সীরাত ও তাফসির গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে। ঘটনাটি মারিয়া ( রাঃ ) কে কেন্দ্র করে। তাফসীরে ইবনে জারিরে রয়েছে, হাফসা ( রাঃ ) এর ঘরে তার পালার দিনে রাসূল (ﷺ), মারিয়া ( রাঃ ) এর সাথে মিলিত হন। এতে হাফসা ( রাঃ ) দুঃখিতা হন যে, তার ঘরে তার পালার দিনে তারই বিছানায় রাসূল (ﷺ) কিনা মারিয়া ( রাঃ ) এর সাথে মিলিত হলেন! রাসূল (ﷺ) তখন হাফসা ( রাঃ ) কে সন্তুষ্ট করার জন্য বললেন, “আমি তাকে আমার উপর হারাম করে দিলাম। তুমি এ কথা কাউকে জানিয়ো না।” কিন্তু হাফসা ( রাঃ ) এ ঘটনাটি আয়েশা ( রাঃ ) কে জানিয়ে দিলে আল্লাহ্‌ তায়ালা এ আয়াতসমূহ নাযিল করেন।
ঘটনা সম্পর্কে বিখ্যাত ইতিহাসবিদ ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, “এটি একটি গারীব উক্তি। সম্পূর্ণ সঠিক কথা হলো যে, এই আয়াতগুলো অবতীর্ণ হবার কারণ ছিল রাসূল (ﷺ) এর নিজের উপর মধুকে হারাম করা।4

রাসূল (ﷺ) এক স্ত্রীর পালা অন্যকে দিবেন এটা তাঁর নীতির বিরুদ্ধে ছিল। আয়েশা ( রাঃ ) কে তিনি সবচেয়ে ভালোবাসলেও অন্য কোন স্ত্রীর পালা আয়েশা ( রাঃ ) কে দিতেন না। একবার অন্য এক স্ত্রীর পালার দিনে আয়েশা ( রাঃ ) তাঁর নিকটে আসলে তিনি বলেন, “ আয়েশা! আমার কাছ থেকে দূরে থাকো! আজকে তোমার দিন না।”5

এটা খুব আশ্চর্যের যে, ইসলাম বিদ্বেষীরা সহীহ বুখারীর একটি সহীহ বর্ণনাকে উপেক্ষা করে গারীব উক্তিকে আঁকড়ে ধরছে কুৎসা রটানোর জন্য। এমনকি তারা গারীব ঘটনাটিতেও নিজেদের কথা যুক্ত করে। তাদের ভার্সন অনুযায়ী- রাসূল (ﷺ) মিথ্যা বলে হাফসা ( রাঃ ) কে বাবার বাড়ী পাঠিয়ে দেন। তারপর হাফসা ( রাঃ ) এর ঘরে প্রবেশ করে হাফসা ( রাঃ ) এর দাসী মারিয়া ( রাঃ ) এর সাথে মিলিত হন। এদিকে হাফসা ( রাঃ ) বাবার বাড়ী থেকে যখন নিজ গৃহে প্রবেশ করে রাসূল (ﷺ) কে নিজ দাসীর সাথে দেখতে পান তখন প্রচণ্ড রেগে যান। রাসূল (ﷺ) তাকে শান্ত করেন এবং এ ঘটনাটি কাউকে বলতে নিষেধ করেন। কিন্তু হাফসা ( রাঃ ) এ ঘটনাটি প্রকাশ করে দিলে সব স্ত্রীকে উচিত শিক্ষা দেবার জন্য রাসূল (ﷺ) সকল স্ত্রীর সাথে এক মাস দেখা করবেন না বলে শপথ করেন। 
এ গল্পটি চূড়ান্ত পর্যায়ের মিথ্যাচার। এ গল্পের সমর্থনে সহীহ হাদীস দূরে থাকুক কোন জাল হাদীসও নেই। এখানে বলা হয়েছে, হাফসা( রাঃ ) এর দাসী ছিলেন মারিয়া ( রাঃ )। অথচ মারিয়া ( রাঃ ) ছিলেন রাসূল (ﷺ) এর দাসী যাকে কিনা মিশরের মুকাওকিস উপহার হিসেবে পাঠিয়েছিলেন। 
এক মাস দেখা না করার যে শপথের কথা বলা হয়েছে সেটি এক মাস দেখা না করার যে শপথের কথা বলা হয়েছে সেটি সম্পূর্ণ আলাদা ঘটনা। ইতিহাসে এটি “ঈলার ঘটনা” নামে পরিচিত। আমরা জানি, রাসূল (ﷺ) অত্যন্ত সাদা-সিধে জীবনযাপন করতেন। আয়েশা ( রাঃ ) এর ভাষায়- টানা তিনদিন নবী পরিবারে খাবার জুটেছে কখনো এমনটা হয়নি। তিনি আরো বলেছেন- মাসের পর মাস চুলোয় আগুন জ্বলতো না। শুকনোখেজুর আর পানিতেই দিন কাটতো। উম্মুল মুমিনীনরা সবসময় দুনিয়ার চেয়ে আখিরাতকেই বেশী প্রাধান্য দিতেন। কিন্তু তারাও মানুষ ছিলেন। তাই সংসারের খরচ বাড়াতে তারা বারবার রাসূল (ﷺ) কে বারবার পীড়াপীড়ি করতেন। এ নিয়ে কিছুটা মনমালিন্যের প্রেক্ষিতে তিনি এক মাস স্ত্রীদের সাথে দেখা করবেন না বলে শপথ করেন। এ ঘটনার সাথে মধু নিয়ে শপথ করার ঘটনার কোন সম্পর্ক নেই।6

 তাফসির থেকে আমরা  উল্লেখিত আয়াত সমূহের নাজিলের কারণ হিসাবে দুটি ঘটনার উল্লেখ পাচ্ছি-  এক- মধু খাওয়া সংক্রান্ত এবং দুই- মারিয়া রাঃ সংক্রান্ত ঘটনা।  হাদিস বিশারদগণ জানাচ্ছেন যে মারিয়া রাঃ সংক্রান্ত সব হাদিস বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে তাবীঈদের থেকে 'মুরসাল' হাদিস7  হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে ৷ কিন্তু কিছু সংখ্যক হাদিস হযরত উমর রাঃ, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাঃ এবং হযরত আবু হুরাইরা রাঃ থেকেও আমরা দেখতে পাই যে হাদিস গুলোতে এ বিষয়ে সরাসরি কিছু না থাকলেও কেউ চাইলে কিছু যোগসূত্র দাবি করতে  পারে বলে প্রাচীন কিছু আলেেম ধারণা করে গেছেন ৷ তবে আশ্চর্যজনক ভাবে সিহাহ সিত্তার কোন গ্রন্থেই এ তথ্য উল্লেখ করা হয়নি। 

আন্যদিকে মধু সংক্রান্ত হাদিসটির মতন এবং সনদকে ইসলামের সকল জামানার হাদিস বিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ সহি বলেই সাক্ষ্য দিচ্ছেন। উভয় ঘটনার নেতৃত্বে যে আয়েশা রাঃ ছিলেন সে তথ্য আমরা বিভিন্ন খণ্ড খণ্ড চিত্রে পাচ্ছি। মধু সম্পর্কিত হাদিস আয়েশা রাঃ থেকে বর্ণনা এসেছে, তাও সে মধু বিষয়ে কোথাও যায়নাব রাঃ কোথাও হাফসা রাঃ কোথাও উম্ম সালমা রাঃ-এর ঘরের কথা উল্লেখ আছে। আর সেই কথা আমাদেরকে আয়েশা রাঃ-এর বর্ণনা মারফত জানতে পারছি। এই নিয়ে আমাদের দ্বিমত করার অবকাশ নেই। হতে পারে প্রথম দুই আয়াতের সাথে বাকি তিন আয়াতের প্রেক্ষাপট ভিন্ন ছিল। অথবা সব গুলো ঘটনা একে অপরের সাথে সম্পৃক্ত । 

যখন কেউ প্রশ্ন করে বসেন যে, সামান্য মধু খাওয়ার বিবাদকে কেন্দ্র করে স্বয়ং মুহাম্মদ ﷺ সকল স্ত্রীর কাছ থেকে দূরে সরে গেলেন! এবং আল্লাহ স্বয়ং নেতৃত্বদানকারী দুই স্ত্রীকে সতর্ক করে দেয়া এবং এই বিষয়ে সকল স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দেবার হুমকি প্রদান কি কঠিন হয়ে গেল না? এইটি তো ইসলামের মূল স্প্রীট সামাজিক ন্যায় বিচারের পরিপন্থী হয়ে গেল না? 

এই ভাবে যখন চিন্তা করি তখন আমরা ভিন্ন তিন তিনটি আয়াতকে একত্র করেই এই অভিযোগ তৈরি করছি, অথচ কোন প্রমাণ নেই যে ঐ আয়াত তিনটির ঐতিহাসিক সময় এবং প্রেক্ষাপট এক ছিল বলে। প্রমাণ না পেয়ে এই ধরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা কি ইতিহাসের প্রতি অবিচার করা নয়? 

উক্ত আয়াতগুলো যদি মারিয়া রা সংক্রান্ত হতো তাহলে আয়েশা রাঃ কি তা জানতেন না? ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি তিনিই ছিলেন মারিয়া রাঃ-এর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। যদি এই আয়াত মারিয়া যদি রাঃ সংক্রান্ত হতো তাহলে কি তিনি তার ছাত্রদেরকে সে কথা বর্ণনা করে যেতেন না? পাঠকদের মনে করিয়ে দিচ্ছি যে, আয়েশা রাঃ কোরআনের আয়াতেরও ভাষ্যকার ছিলেন। তিনি তাঁর ছাত্রদের কাছে কোরআনের আয়াতের অর্থ শিক্ষা দান করতেন। তাই আমি যেটি মনে করি যে, যেহেতু সূরা আত তাহরীমের ১ম এবং ২য় আয়াতটি মারিয়া রাঃ সংক্রান্ত ছিলোনা সেহেতু আল্লাহ পাক তা উল্লেখ করেনি। ইতিহাস পাঠকরা জানেন যে এর চেয়েও মারাত্মক মারাত্মক সত্য কথা তিনি অবলীলায় বর্ণনা করে গিয়েছেন।  আথচ এই আয়াত নাজিল হবার কারন স্বয়ং আয়েশা রা নিজে মধু খাওয়ার ঘটনার কথা বলেছেন ,  যেমন  

হাসান ইবন মুহাম্মদ যা’ফরানী (রহঃ) ... আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যয়নব বিনত জাহশের নিকট কিছুক্ষণ থাকতেন এবং সেখানে তিনি মধু পান করতেন। আমি এবং হাফসা পরামর্শ করলাম যে, আমাদের মধ্যে যার নিকটই রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাশরীফ আনেন, সে যেন বলে, আপনার মুখ হতে মাগাফিরের গন্ধ আসছে। আপনি কি মাগাফির খেয়েছেন? এরপর তিনি আমাদের একজনের গৃহে আসলে তিনি তাকে তা বললেন। তখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ না, বরং আমি যয়নব বিনতে জাহশের নিকট মধু পান করেছি। আমি আর কখনো তা পান করবো না; তখন অবতীর্ণ হয়ঃ (يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ لِمَ تُحَرِّمُ مَا أَحَلَّ اللَّهُ لَكَ) অর্থঃ হে নবী! আল্লাহ্ আপনার জন্য যা হালাল করেছেন, আপনি তা হারাম করছেন কেন? (৬৬ : ১)। (إِنْ تَتُوبَا إِلَى اللَّهِ) অর্থঃ যদি তোমরা উভয়ে (আয়েশা ও হাফসা) অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর দিকে ফিরে এসো। (৬৬ : ২) (وَإِذْ أَسَرَّ النَّبِيُّ) অর্থঃ স্মরণ কর, নবী তাঁর স্ত্রীদের একজনকে গোপনে কিছু বলেছিলেন। ...... (৬৬ : ৩), এটা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উক্তিঃ “বরং আমি মধু পান করেছি”— সে সম্পর্কিত।

তাহক্বীকঃ সহীহ।8

কে এই মারিয়া কিবতিয়া  রাঃ ? 

 ইসলামের প্রধান প্রতিপক্ষ মক্কার কুরাইশদের সাথে ৬২৮ খৃঃ এর মার্চ মাসে যুদ্ধ বিরতি সন্ধি হওয়ার পর মক্কা মদিনার সীমান্তে সাময়িক সময়ের জন্য শান্তি ফিরে আসে। মুহাম্মদ ﷺ স্বীকৃত রাষ্ট্র নায়কে পরিণত হন। তখন বৃহত্তর পরিসরে ইসলাম প্রচারের নিমিত্তে মুহাম্মদ ﷺ আরব উপদ্বীপের আশ পাশের শাসকদের কাছে ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত দিতে দূত প্রেরণ করেন। তেমন একজন দূত আলোকজন্দ্রিয়ার রোমান খৃস্টান বিশপ (Patriarch) কাছেও পাঠিয়েছিলেন ৷ আরবরা তাকে মুকাওকিস বলে অভিহিত করত ৷9

image
চিত্রঃ মুকাওকিস কে লেখা রাসুল্লাহ  ﷺ এর চিঠি । 

 

হাতেব ইবনে আবী বালতা রাঃ দাওয়াত পৌঁছে দেবার পর যদিও তিনি ইসলাম কবুল করেননি কিন্তু বালতার সাথে ভাল ব্যবহার করেছিলেন। দাওয়াতের উত্তর দিয়ে ছিলেন। কূটনৈতিক সম্পর্ক সৃষ্টির লক্ষ্যে কিছু সোনা দানা এবং ঘোড়া দুলদুল, গাধা ইয়াফুর সহ মিশরের কিবতী খৃষ্টানদের মধ্যে থেকে সম্ভ্রান্ত বংশের দুটি মেয়েকে মুহাম্মদ ﷺ এর সম্মানে পাঠিয়েছিলেন ।10 ইবনে সা'দ মেয়ে দুটির মধ্যে একজনের নাম শিরীন এবং অপর জনের নাম মারিয়া বলে উল্লেখ করেছেন ৷ 

মিসর থেকে ফেরার পথে হাতিব রাঃ তাদের উভয়কে ইসলাম গ্রহণের আহবান জানালে তারা ইসলাম গ্রহণ করেন৷ অতঃপর রসুল ﷺ এর কাছে হাজির হলে তিনি শিরীন রাঃকে হাসান ইবনে সাবিত রাঃ-এর কাছে দিয়ে দেন এবং মারিয়া রাঃ-এর সাথে আলোচনা করে সুরাইয়া11 হিসাবে গ্রহণ করেন৷ ইসলামী আইনে আপন দুই বোনকে এক ব্যক্তির সাথে বিয়ে অনুমতি দেয় না। তখনকার সময়ে সুরাইয়া বেমানান অবৈধ বা বে-আইনি কিছু ছিলনা। ইব্রাহীম আঃ-এর শরীয়তে সুরাইয়া গ্রহণের অনুমতি ছিল। ইব্রাহিম আঃ স্বয়ং হাজিরাকে সুরাইয়া হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। যার সন্তান ইসমাইল আঃ থেকে বর্তমান আরব জাতীর সৃষ্টি হয়েছিল।

মারিয়া রাঃ অন্য এক ভৌগলিক অঞ্চল থেকে এসে ছিলেন, তিনি হুজরা জীবনের অভ্যস্ত ছিলেন না। রাসুল ﷺ মারিয়া রাঃ-কে হুজরায় না রেখে কিছু দিনের জন্য হুজরার নিকটে হারিছা বিন নুমান রাঃ-এর বাড়িতে রাখার ব্যবস্থা করেন। পরবর্তীতে মদিনার আবহাওয়ায় মারিয়া রাঃ-এর স্বাস্থ্যগত অসুবিধার কারণে তাকে মদিনা থেকে আড়াই মাইল দূরে মসজিদে কুবার নিকট উম সুলাইম বিনত মিলহানের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে ছিলেন। খায়বরের যুদ্ধের পরে মদিনা মসজিদ সংলগ্ন হুজরা তৈরি না হওয়া পর্যন্ত আল আলিয়ার বানি আনাফিরের যে বাড়িতে সাফিয়া রাঃ-কে রাখা হয়েছিল, সাফিয়া রাঃ হুজরায় চলে যাওয়ার পর মারিয়া রাঃ সে বাড়িতে এসে উঠেন। সন্তান সম্ভাব্য হবার পর তাকে আবার মদিনার হুজরা সংলগ্ন হারিছা বিন নোমান রাঃ-এর বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে আসলেও এখানে মারিয়া রাঃ স্বচ্ছন্দতা না পাওয়ায় তিনি আবার আল আলিয়ার বাড়িতেই চলে আসেন। সেখানে তিনি মৃত্যু পর্যন্ত ছিলেন। এখনও সেই স্থানকে মাশরাবাত উম ইব্রাহিম নামে ডাকা হয়।

এখনও সেই স্থানকে মাশরাবাত উম ইব্রাহিম নামে ডাকা হয়।
চিত্রঃ  মাশরাবাত উম ইব্রাহিম রাঃ।

 

৬৩০ খৃঃ এর মার্চ মাসে তাঁর গর্ভে মুহাম্মদ ﷺ এর কনিষ্ঠ পুত্র ইবরাহীম রাঃ জন্মলাভ করেন। ৬৩২ খৃঃ ইব্রাহিম রাঃ অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিছু কাল রোগ ভোগের পর ২৭শে ফেব্রুয়ারি মারা যান। মারিয়া রাঃ মুহাম্মদ ﷺ-কে মাত্র তিন বছর পেয়েছিলেন। মুহাম্মদ ﷺ-এর ইন্তেকালের পাঁচ বছর পরে তিনিও ইন্তেকাল করেন (১৬ হিঃ)। উমর রাঃ তাঁর নামাজে জানাজা পড়িয়ে ছিলেন। তাকে জান্নাতুল বাকীতে দাফন করা হয়। যে পাঁচ বছর তিনি বেঁচে ছিলেন সে পাঁচ বছর তিনি নিভৃতচারিণী ছিলেন। মাঝে মধ্যে তিনি সন্তান ইব্রাহীম রাঃ ও স্বামী মুহাম্মদ ﷺ-এর কবর জিয়ারত করতে যেতেন।12 এবার মূল আলোচনাতে ফিরে আসছি। 

এখন আমরা উপরের যদি উল্লেখিত অপপ্রচারটি লক্ষ্য করি তাহলে আমরা দেখতে পাব যে তারা তাদের অপপ্রচারে যা বলার চেষ্টা করছে তা হচ্ছে, "আত-তাহরীমের উক্ত পাঁচ আয়াত মুহাম্মদ ﷺ এবং মারিয়া রাঃ-এর মধ্যকার যৌনসংক্রান্ত বিষয় এবং যৌন ঈর্ষাকাতর অন্যান্য বিবিদের বিবাদ।" কোন একক হাদিসে প্রাপ্ত ঘটনা পড়ে তাৎক্ষণিক ভাবে হয়তো কারো কারো ভাবনায় নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। কিন্তু বাস্তব সত্য হচ্ছে সুরা আত তাহরীমের এই পাঁচ আয়াত শুধু হাফসা রাঃ-এর ঘরে হাফসা রাঃ-এর অবর্তমানে কিছু সময়ের মারিয়া রাঃ-এর উপস্থিতির জন্য নাজিল হয়নি। মুনাফিকরা হয়তো ইসলামের প্রতি নেতিবাচক মানসিকতা লালন করা জন্য সত্য উপলব্ধি করতে অক্ষম। না হয় সত্য জেনেও শুধু বিদ্বেষের কারণে ৬২৭ খৃঃ ফেব্রুয়ারি/মার্চ থেকে খন্দকের যুদ্ধের পর থেকে ৬৩১ খৃঃ – ৪ বছরে মুহাম্মদ ﷺ এর ঘরে ঘটে যাওয়া আসল নানা ঘটনাকে কৌশলে শুধু মাত্র একটি ঐতিহাসিক ভাবে  দুর্বল  ঘটনা দিয়ে চাপা দিয়ে চায়। 

আত তাহরীমের পাঁচ আয়াত নাজিলের প্রেক্ষাপট ছিল মুহাম্মদ ﷺ এর সাথে সদ্য নারী স্বাধীনতা প্রাপ্ত স্ত্রীদের মধ্যে ঘটে যাওয়া অনেকগুলো ঘটনার সমাপ্তি টানার প্রেক্ষাপট। অপপ্রচারকারীরা সব সময় ইসলাম, মুসলিম, মুহাম্মদ ﷺ-কে হেয় করতে যে পন্থা অবলম্বন করে থাকে, ঠিক সেই একই ভাবে ঘটে যাওয়া কিছু সত্যের সাথে কৌশলে মিথ্যার ভেজাল দিয়ে এই ঘটনাকে সমানে প্রচার করে যাচ্ছে। তাদেরকে এই কাজের উপাদান যোগান দিচ্ছে আমাদের অতীত ইতিহাসবিদদের যাচাই বাচাই না করে রাখা বিভিন্ন সংগৃহীত সংকলিত লেখাগুলো। 

১মতঃ আমি চ্যালেঞ্জ করছি সেই অপ প্রচারকারীদেরকে তারা প্রমাণ করুক যে, মারিয়া রাঃ হাফসা রাঃ-এর দাসী ছিলেন।  ২য়তঃ প্রমাণ করুক যে মুহাম্মদ ﷺ মিথ্যা কথা বলে হাফসা রাঃ-কে উনার বাবার বাড়িতে পাঠিয়েছিলেন। 

এরা আগেও কখনও পারেনি এখনও তা পারবেনা, কারণ এই অপপ্রচারটি যিনি সর্ব প্রথম নেটে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সেই ফেইথফ্রিডমের কর্ণধার আলি সিনাও তা প্রমাণ করতে পারেনি। 

আসুন তো আবার  দেখি এই আলোচিত পাঁচ আয়াতে কী আছে? 

১। হে নবী, আল্লাহ যে জিনিষ হালাল করেছেন তা তুমি হারাম করছো কেন? (তা কি এর জন্য যে) তুমি তোমার স্ত্রীদের সন্তুষ্টি চাও? আল্লাহ ক্ষমাশীল এবং দয়ালু। প্রথমতঃ এই আয়াতে কোন একটি হালাল জিনিসকে রাসুল ﷺ উনার জন্য হারাম করে নিয়ে ছিলেন সেইটি উল্লেখ করলেও রাসুল ﷺ এর হারাম করা সে জিনিসটি কী ছিল সে কথার কোন উল্লেখ নাই। 

২। আল্লাহ তোমাদের জন্য কসমের বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত হওয়ার পন্থা নির্ধারণ করে দিয়েছেন৷ আল্লাহ তোমাদের অভিভাবক এবং তিনি মহাজ্ঞানী ও মহা কৌশলী৷ এই আয়াতে মুহাম্মদ ﷺ-এর করা কসম থেকে কীভাবে পরিত্রাণ পাওয়া যায় সেই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। 

৩। (এখানে এই ব্যাপারটিও লক্ষণীয় যে) নবী তাঁর এক স্ত্রীকে (কোন স্ত্রী?) একটি গোপন কথা (কি ছিল সেই গোপন কথা?) বলেছিলেন। পরে সে স্ত্রী যখন অন্য আরেক স্ত্রীর কাছে (কে সেই অন্য স্ত্রী?) সেই গোপন কথা প্রকাশ করে দিয়েছিলেন। তখন নবী কিছুটা সাবধান করলেন এবং কিছুটা মাফ করে দিলেন। (ঐ স্ত্রীকে) নবী যখন তাকে এই কথা জানালেন তখন সে জিজ্ঞেস করল: কে আপনাকে এ বিষয়ে অবহিত করেছে? নবী বললেন আমাকে তিনি অবহিত করেছেন যিনি সব কিছু জানেন এবং সর্বাধিক অবহিত। 

[ ৩নং আয়াতে জানতে পারছি যে, মুহাম্মদ ﷺ তাঁর এক স্ত্রীকে একটি কথা গোপনে বলেছিলেন কিন্তু কী কথা বলেছিলেন তা আমরা জানতে পারিনা। যে স্ত্রীকে বলেছেন উনার কোন নাম জানা যায়না এবং অন্য যে স্ত্রীকে বলেছিলেন তাঁর কোন নাম জানা যায়না। ]

৪। তোমরা দুই জন যদি আল্লাহর কাছে তাওবা করো (তবে তা তোমাদের জন্য উত্তম), কেননা, তোমাদের মন সরল সোজা পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে গিয়েছে আর যদি তোমরা নবীর বিরুদ্ধে পরস্পর সংঘবদ্ধ হও তা হলে জেনে রাখো, আল্লাহ তার অভিভাবক, তাছাড়া জিবরাঈল, ঈমানদারগণ এবং সব ফেরেশতা তার সাথী ও সাহায্যকারী৷  এই আয়াতেও যে দু’জন স্ত্রীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে তাদেরও কোন নাম পাওয়া যাচ্ছেনা। এবং অভিযোগ করা হচ্ছে যে ঐ দুইজন স্ত্রী সোজাপথ থেকে সরে গেছেন এবং আরো জানতে পারছি যে তারা একত্র হয়ে মুহাম্মদ ﷺ-এর বিরুদ্ধে বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু কিসের বিরোধিতা করেছিলেন আমরা তা জানতে পারিনা। 

৫। যদি নবী তোমাদের [সকলকে] পরিত্যাগ করে, তবে আল্লাহ্‌ তাঁকে তোমাদের পরিবর্তে উৎকৃষ্টতর স্ত্রী দেবেন ; যারা হবে আত্মসমর্পণকারী, বিশ্বাসী,অনুগত, তাওবাকারী, [বিনয়ী] এবাদতকারী, যে [ঈমানের জন্য] হিজরত করে, এবং সীয়াম পালন করে, – যারা পূর্বে বিবাহিতা এবং অবিবাহিতা কুমারী হবে। 

৫নং আয়াত থেকে যা বুঝা যায় তা হচ্ছে যে, মুহাম্মদ ﷺ-এর দুই স্ত্রীর নেতৃত্বে অন্যান্য স্ত্রীদের নিয়ে কোন এক বিষয়ে তারা মুহাম্মদ ﷺ-এর সাথে চরম বাদ প্রতিবাদে চলে গিয়েছিলেন। আর ঘটনা আরও চরমে চলে যাবার আশংকায় ঘটনাকে শান্ত করতে আল্লাহ তাদের চরম ভাবে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। পাঠক লক্ষ্য করেন যে- প্রথম আয়াতে বলা হয়েছে- তুমি তোমার স্ত্রীদের সন্তুষ্টি চাও? (দেখুন: কারেন আর্মস্টং, মুহাম্মদ-মহানবীর জীবনী পৃঃ ২৭৪)।

স্ত্রীদের কথা উল্লেখ করায় বুঝা যাচ্ছে সব স্ত্রীদের কথা বলা হচ্ছে এবং তাদের অন্যায্য দাবী মেনে নেবার জন্য মুহাম্মদ ﷺ-কে আল্লাহ তম্বি করলেন।  আবার তিন/চার নং আয়াতে দুই স্ত্রীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। মধু না খাবার বিষয়ে কসম করা মানে মধু খাওয়াকে রাসুল ﷺ এর নিজের জন্য হারাম করাকে কেউ কেউ সামান্য ভাবলেও একজন মুসলিম তা সামান্য ভাবতে পারেনা। কোন কিছু হারাম হালাল করার ক্ষমতা কোন মানুষের নেই। এমনকি মুহাম্মদ ﷺ-এরও ছিলনা। আল্লাহ যা হারাম করেছেন তাকে হালাল জ্ঞানে ব্যবহার করা এবং আল্লাহ যা হালাল করেছেন তা নিজের জন্য হারাম করা মানে হচ্ছে আল্লাহর হুকুম অমান্য করা। কাজেই কোন মুসলিমের কোন অধিকার নেই আল্লাহর হুকুম অমান্য করে।

তাফসির অনুসারে  এখানে যে মধুকে আল্লাহ হালাল করেছেন ,  মুহাম্মদ ﷺএর স্ত্রীদের কষ্ট লাঘব করতে সে মধু না খাওয়ার কসম করা আল্লাহর মনপুতঃ হয়নি, যদিও মুহাম্মদ ﷺ মধু খাওয়া তার উম্মতের জন্য হারাম করেননি শুধু নিজের জন্য করেছিলেন। তাই আল্লাহ মুহাম্মদ ﷺ-এর ক্ষণিক দুর্বলতায় কসম থেকে সংশোধন করে মৃদু তম্বী করেছেন মাত্র। 

দ্বিতীয় আয়াত দ্বারা কেমন করে নবীর করা ভুলকে সংশোধন করা যাবে তা বলে দেন। 

তৃতীয় আয়াতে কোন এক স্ত্রী মুহাম্মদ ﷺ-এর সাথে কৃত ওয়াদার বরখেলাপ করেছেন তা উল্লেখ করেছেন এবং বলে দিয়েছেন যে, তোমরা যা-ই গোপন কর না কেন আল্লাহ তা মুহাম্মদ ﷺ-কে জানিয়ে দেন। কাজেই গোপনে কিছু করেও পার পাওয়া যাবেনা। 

চতুর্থ আয়াতে যে কারণে যে সব স্ত্রীদের চাপের জন্য মুহাম্মদ ﷺ বশ্যতা স্বীকার করার পরও তারা তাতে সন্তুষ্ট না হয়ে আরও চাপ অব্যাহত রেখে যাচ্ছিলেন সেই নেতৃত্বদানকারী দুই স্ত্রীকে প্রথম সতর্কবাণী দিয়ে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। 

পঞ্চম আয়াতে বুঝা যাচ্ছে যখন সকল স্ত্রী এই ঘটনায় জড়িত হয়ে পড়েছিলেন তখন তাদেরকে সংযত করতে কড়া ভাষায় সরাসরি আল্টিমেটাম দেওয়া হয় যে তারা যদি এই কাজ থেকে বিরত না হয় তাহলে তাদের বদলে মুহাম্মদ ﷺ-এর জন্য অন্য স্ত্রীর ব্যবস্থা করা হবে। 

আমরা উপরের আয়াত থেকে নবীর স্ত্রীদের দ্বারা কোন পারিবারিক বিদ্রোহ বিশৃঙ্খলার কথা অনুমান করতে পারলেও তারা কারা এবং কেন কিসের জন্য এই পারিবারিক বিদ্রোহ বিশৃঙ্খলা ঘটিয়েছিলেন তা এই সব আয়াত থেকে জানতে পারিনা। হাদিসেও স্পষ্ট করে কিছু উল্লেখ নেই তাহলে এখানে ইসলামী-বিরোধী শক্তি মারিয়া রাঃ-এর সাথে মুহাম্মদ ﷺ-এর যৌনতার প্রেক্ষিতে হাফসা রাঃ ও আয়েশা রাঃ-এর প্রতিক্রিয়া কেমন করে আবিষ্কার করল? 

তারা আব্বাস রাঃ কর্তৃক বর্ণিত একটি হাদিস দিয়ে উল্লেখিত দুইজন স্ত্রী যে আয়েশা রাঃ আর হাফসা রাঃ ছিলেন তা প্রমাণ করতে পারলেও সে হাদিস দিয়ে কিন্তু তাদের উল্লেখিত ঘটনা প্রমাণ করতে পারেনি।  আমরা এখন দেখব বোখারি শরীফে  হাদিসে কী উল্লেখ আছে?

 আবদুল্লাহ ইবনু ’আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি বহুদিন ধরে উৎসুক ছিলাম যে, আমি উমার ইবনু খাত্তাব (রাঃ)-এর নিকট জিজ্ঞেস করব, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিবিগণের মধ্যে কোন্ দু’জন সম্পর্কে আল্লাহ্ তা’আলা এ আয়াত নাযিল করেছেনঃ "তোমরা দু’জন যদি আল্লাহর নিকট তওবা কর (তবে এটা উত্তম)। কেননা, তোমাদের মন সঠিক পথ থেকে সরে গেছে।" এরপর একবার তিনি [উমার (রাঃ)] হাজ্জের জন্য রওয়ানা হলেন এবং আমিও তাঁর সঙ্গে হজ্জে গেলাম। (ফিরে আসার পথে) তিনি ইতিনজার জন্য রাস্তা থেকে সরে গেলেন। আমি পানি পূর্ণ পাত্র হাতে তাঁর সাথে গেলাম। তিনি ইতিনজা করে ফিরে এলে আমি ওযূর পানি তাঁর হাতে ঢেলে দিতে লাগলাম।

তিনি যখন ওযূ করছিলেন, তখন আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, হে আমীরুল মু’মিনী! নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সহধর্মিণীগণের মধ্যে কোন্ দু’জন, যাদের সম্পর্কে আল্লাহ্ তাআলা বলেছেনঃ "তোমরা দু’জন যদি আল্লাহর কাছে তওবা কর (তবে আমাদের জন্য উত্তম), কেননা, তোমাদের মন সঠিক পথ থেকে সরে গেছে।" জবাবে তিনি বললেন, হে ইবনু ’আব্বাস! আমি তোমার প্রশ্ন শুনে অবাক হচ্ছি। তারা দুজন তো আয়িশাহ (রাঃ) ও হাফসাহ (রাঃ)।

এরপর ’উমার (রাঃ) ঘটনাটি বর্ণনা করলেন, “আমি এবং আমার একজন আনসারী প্রতিবেশী যিনি উমাইয়াহ ইবনু যায়দ গোত্রের লোক এবং তারা মদীনাহর উপকণ্ঠে বসবাস করত। আমরা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে পালাক্রমে সাক্ষাত করতাম। সে একদিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে যেত, আমি আর একদিন যেতাম। যখন আমি দরবারে যেতাম, ঐ দিন দরবারে ওয়াহী অবতীর্ণসহ যা ঘটত সবকিছুর খবর আমি তাকে দিতাম এবং সেও অনুরূপ খবর আমাকে দিত। আমরা কুরাইশরা নিজেদের স্ত্রীগণের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে রেখেছিলাম।

কিন্তু আমরা যখন আনসারদের মধ্যে এলাম, তখন দেখতে পেলাম, তাদের স্ত্রীগণ তাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে আছে এবং তাদের ওপর কর্তৃত্ব করে চলেছে। সুতরাং আমাদের স্ত্রীরাও তাদের দেখাদেখি সেরূপ ব্যবহার করতে লাগল। একদিন আমি আমার স্ত্রীর প্রতি নারাজ হলাম এবং তাকে উচ্চস্বরে কিছু বললাম, সেও প্রতি-উত্তর দিল। আমার কাছে এ রকম প্ৰতি-উত্তর দেয়াটা অপছন্দ হল। সে বলল, আমি আপনার কথার পাল্টা উত্তর দিচ্ছি এতে অবাক হচ্ছেন কেন? আল্লাহর কসম, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিবিগণ তাঁর কথার মুখে মুখে পাল্টা উত্তর দিয়ে থাকেন এবং তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ আবার একদিন এক রাত পর্যন্ত কথা না বলে কাটান।

(উমার (রাঃ) বলেন), এ কথা শুনে আমি ঘাবড়ে গেলাম এবং আমি বললাম, তাদের মধ্যে যারা এরূপ করেছে, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এরপর আমি আমার কাপড় পরিধান করলাম এবং আমার কন্যা হাফসার ঘরে প্রবেশ করলাম এবং বললামঃ হাফসা! তোমাদের মধ্য থেকে কারো প্রতি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি সারা দিন রাত পর্যন্ত অসন্তুষ্ট থাকেননি? সে উত্তর করল, হ্যাঁ। আমি বললাম, তুমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছ। তোমরা কি এ ব্যাপারে ভীত হচ্ছাে না যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অসন্তুষ্টির কারণে আল্লাহ্ অসন্তুষ্ট হয়ে যাবেন? পরিণামে তোমরা ধ্বংসের মধ্যে পড়ে যাবে। সুতরাং তুমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে অতিরিক্ত কোন জিনিস দাবি করবে না এবং তাঁর কথার প্রতি-উত্তর করবে না এবং তার সাথে কথা বলা বন্ধ করবে না। তোমার যদি কোন কিছুর প্রয়োজন হয়, তবে আমার কাছে চেয়ে নেবে। আর তোমার সতীন তোমার চেয়ে অধিক রূপবতী এবং রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অধিক প্রিয় তা যেন তোমাকে বিভ্রান্ত না করে। এখানে সতীন বলতে আয়িশাহ (রাঃ)-কে বোঝানো হয়েছে।

উমার (রাঃ) আরো বলেন, এ সময় আমাদের মধ্যে এ কথা ছড়িয়ে পড়েছিল যে, গাস্‌সানের শাসনকর্তা আমাদের ওপর আক্রমণ চালাবার উদ্দেশে তাদের ঘােড়াগুলোক প্রস্তুত করছে। আমার প্রতিবেশী আনসার তার পালার দিন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর খেদমত থেকে রাতে ফিরে এসে আমার দরজায় খুব জোরে করাঘাত করল এবং জিজ্ঞেস করল, আমি ঘরে আছি কিনা? আমি শংকিত অবস্থায় বেরিয়ে এলাম। সে বলল, আজ এক বিরাট ঘটনা ঘটে গেছে। আমি বললাম, সেটা কী? গাস্‌সানিরা কি এসে গেছে? সে বলল, না তার চেয়েও বড় ঘটনা এবং তা ভয়ংকর। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সহধর্মিণীগণকে ত্বলাক (তালাক) দিয়েছেন। আমি বললাম, হাফসা তো ধ্বংস হয়ে গেল, ব্যর্থ হলো। আমি আগেই ধারণা করেছিলাম, খুব শীগগীরই এরকম একটা কিছু ঘটবে।

এরপর আমি পোশাক পরিধান করলাম এবং ফজরের সালাত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে আদায় করলাম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওপরের কামরায় (মাশরুবা) একাকী আরোহণ করলেন, আমি তখন হাফসার কাছে গেলাম এবং তাকে কাঁদতে দেখলাম। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কাঁদছ কেন? আমি কি তোমাকে এ ব্যাপারে পূর্বেই সতর্ক করে দেইনি? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি তোমাদের সকলকে ত্বলাক (তালাক) দিয়েছেন? সে বলল, আমি জানি না। তিনি ওখানে ওপরের কামরায় একাকী রয়েছেন।

আমি সেখান থেকে বেরিয়ে এসে মিম্বরের কাছে বসলাম। সেখানে কিছু সংখ্যক লোক বসা ছিল এবং তাদের মধ্যে অনেকেই কাঁদছিল। আমি তাদের কাছে কিছুক্ষণ বসলাম, কিন্তু আমি এ অবস্থা সহ্য করতে পারছিলাম না। সুতরাং যে ওপরের কামরায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অবস্থান করছিলেন আমি সেই ওপরের কামরায় গেলাম এবং তাঁর হাবশী কালো খাদিমকে বললাম, তুমি কি উমারের জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে যাবার অনুমতি এনে দেবে? খাদিমটি গেল এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে কথা বলল। ফিরে এসে উত্তর করল, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে আপনার কথা বলেছি; কিন্তু তিনি নিরুত্তর আছেন। তখন আমি ফিরে এলাম এবং যেখানে লোকজন বসা ছিল সেখানে বসলাম। কিন্তু এ অবস্থা আমার কাছে অসহ্য লাগছিল। তাই আবার এসে খাদেমকে বললাম! তুমি কি উমরের জন্য অনুমতি এনে দিবে? সে প্রবেশ করল এবং ফিরে এসে বলল, আপনার কথা বলেছি কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চুপ থেকেছেন। তাই আমি আবার ফিরে এসে মিম্বরের কাছে ঐ লোকজনের সাথে বসলাম।

কিন্তু এ অবস্থা আমার কাছে অসহ্য লাগছিল। পুনরায় আমি খাদেমের কাছে গেলাম এবং বললাম, তুমি কি উমারের জন্য অনুমতি এনে দেবে? সে গেল এবং আমাকে উদ্দেশ্য করে বলতে বলতে লাগল, আমি আপনার কথা উল্লেখ করলাম; কিন্তু তিনি নিরুত্তর আছেন। যখন আমি ফিরে যাবার উদ্যোগ নিয়েছি, এমন সময় খাদিমটি আমাকে ডেকে বলল, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপনাকে অনুমতি দিয়েছেন। এরপর আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট প্রবেশ করে দেখলাম, তিনি খেজুরের চাটাইর ওপর চাদরবিহীন অবস্থায় খেজুরের পাতা ভর্তি একটি বালিশে ভর দিয়ে শুয়ে আছেন। তাঁর শরীরে পরিষ্কার চাটাইয়ের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। আমি তাঁকে সালাম করলাম এবং দাঁড়ানো অবস্থাতেই জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি আপনার বিবিগণকে ত্বলাক (তালাক) দিয়েছেন? তিনি আমার দিকে চোখ ফিরিয়ে বললেন, না (অর্থাৎ ত্বলাক (তালাক) দেইনি)। আমি বললাম, আল্লাহু আকবার।

এরপর আলাপটা নমনীয় করার উদ্দেশে দাঁড়িয়ে থেকেই বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি যদি শোনেন তাহলে বলিঃ আমরা কুরাইশগণ, মহিলাদের ওপর আমাদের প্রতিপত্তি খাটাম; কিন্তু আমরা মদীনায় এসে দেখলাম, এখানকার পুরুষদের ওপর নারীদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বিদ্যমান। এ কথা শুনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুচকি হাসলেন। তখন আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! যদি আপনি আমার কথার দিকে একটু নজর দেন। আমি হাফসার কাছে গেলাম এবং আমি তাকে বললাম, তোমার সতীনের রূপবতী হওয়া ও রাসসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রিয় পাত্রী হওয়া তোমাকে যেন ধোকায় না ফেলে। এর দ্বারা ’আয়িশাহ (রাঃ)-এর প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুনরায় মুচকি হাসলেন।

আমি তাঁকে হাসতে দেখে বসে পড়লাম। এরপর আমি তার ঘরের চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম, আল্লাহর কসম, শুধুমাত্র তিনটি চামড়া ব্যতীত আর আমি তাঁর ঘরে উল্লেখযোগ্য কিছুই দেখতে পেলাম না। অতঃপর আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! দোয়া করুন, আল্লাহ্ তা’আলা যাতে আপনার উম্মতদের সচ্ছলতা দান করেন। কেননা, পারস্য ও রোমানদের প্রাচুর্য দান করা হয়েছে এবং তাদের দুনিয়ার আরাম প্রচুর পরিমাণে দান করা হয়েছে; অথচ তারা আল্লাহর ইবাদাত করে না। এ কথা শুনে হেলান দেয়া অবস্থা থেকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সোজা হয়ে বসে বললেন, হে খাত্তাবের পুত্র! তুমি কি এখনো এ ধারণা পোষণ করছ? ওরা ঐ লোক, যারা উত্তম কাজের প্রতিদান এ দুনিয়ায় পাচ্ছে। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, আমার ক্ষমার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করুন। হাফসাহ (রাঃ) কর্তৃক ’আয়িশাহ (রাঃ)-কে কথা ফাঁস করে দেয়ার কারণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঊনত্রিশ দিন তার বিবিগণ থেকে আলাদা থাকেন।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন, আমি এক মাসের মধ্যে তাদের কাছে যাব না তাদের প্রতি গোস্বার কারণে। তখন আল্লাহ্ তা’আলা তাঁকে মৃদু ভর্ৎসনা করেন। সুতরাং যখন ঊনত্রিশ দিন হয়ে গেল, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বপ্রথম ’আয়িশাহ (রাঃ)-এর কাছে গেলেন এবং তাকে দিয়েই শুরু করলেন। ’আয়িশাহ (রাঃ) তাঁকে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কমস করেছেন যে, একমাসের মধ্যে আমাদের কাছে আসবেন না; কিন্তু এখন তো উনত্রিশ দিনেই এসে গেলেন। আমি প্রতিটি দিন এক এক করে হিসাব করে রেখেছি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ঊনত্রিশ দিনেও একমাস হয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, এ মাস ২৯ দিনের ’আয়িশাহ (রাঃ) আরও বলেন, ঐ সময় আল্লাহ্ তাআলা ইখতিয়ারের (সূরাহ আহবের ২৮নং) আয়াত নাযিল করেন এবং তিনি তাঁর বিবিগণের মধ্যে আমাকে দিয়েই শুরু করেন এবং আমি তাঁকেই গ্রহণ করি।এরপর তিনি অন্য বিবিগণের অভিমত চাইলেন। সকলেই তাই বলল, যা আয়িশাহ (রাঃ) বলেছিলেন।13

এই হাদিস থেকে তাহরীমের চার নং আয়াতের উল্লেখিত স্ত্রী দুইজন আয়েশা রাঃ ও হাফসা রাঃ ছিলেন এবং হাফসা রাঃ আয়েশা রাঃকে রাসুল ﷺ এর প্রতিপক্ষ বানানোর কথা জানতে পারলেও এই পুরা হাদিস থেকে এখানে মারিয়া রাঃ-এর কোন কথার উল্লেখ পাচ্ছিনা! এইটি কি অবাক করা বিষয় নয়, যে বা যার কারণে পাঁচ পাঁচটি আয়াত নাজিল হয়েছিল বা মুহাম্মদ ﷺ এই আয়াত নাজিল করে মারিয়া রাঃ এর ঘটনাকে চাপা দিয়েছিলেন সে ঘটনার মূল পাত্রী মারিয়া রাঃ এর কোন উপস্থিতি নেই! এই হাদিস থেকে এই সব আয়াত নাজিলের যে কারণ পাচ্ছি তা হচ্ছে- 

১। তোমার যা খুশী দরকার আমার কাছে চাও। 

২। এবং কখনোই তোমার প্রতিবেশীকে (আয়েশা রাঃকে) নবীজীর প্রতিপক্ষ বানিয়ো না, যদিও সে তোমার চেয়ে অধিক সুন্দরী ও মুহম্মদ ﷺ এর বেশী প্রিয়। 

এখান থেকে যা জানা যায় তা হচ্ছে-

১। পার্থিব সুযোগ সুবিধা দাবি করা।

২। আয়েশা রাঃকে রাসুল ﷺ এর প্রতিপক্ষ বানানো।

আবার দেখি- "আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করুন যেন আপনার অনুসারীরা অনেক উন্নতি করতে পারে, যেহেতু পারস্য বাসরীয়রা ও বাইজেন্টাইনরা আল্লাহকে না মেনেও কতই না উন্নতি করেছে, তাদের কতই না সম্পদ।" রাসুলুল্লাহ ﷺ উঠে বসলেন এবং বললেন, "ওহ ইবনে আল খাত্তাব! তোমার কি কোন সন্দেহ আছে (যে এস্থান দুনিয়ার মধ্যে সেরা)? মানুষ তার ভালো কাজেরই কেবল প্রতিফল পায়।" আমি তাঁকে আল্লাহর কাছে আমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করার কথা বললাম। এখানেও স্পষ্টত মারিয়া রাঃ এর কোন কথা উল্লেখ করা হয় নাই শুধু আছে সহায় সম্পদ, পার্থিব উন্নতির কথা। এই হাদিসের আড়ালে চাপা পড়ে আছে নবী পত্নীদের চির অভাব অনটন আর কষ্টের কথা। যদিও মর্যাদা, সুবিধা প্রাপ্তি ইত্যাদি নিয়ে স্ত্রীরা প্রবল চাপ সৃষ্টি করেছিলেন তথাপি তারা রাসুল ﷺকে কত গভীর ভালবাসতেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় নিম্নের ঘটনায়-  ২৯ দিন বাদে যখন মুহাম্মদ ﷺ স্ত্রীদের কাছে গেলেন, তখন প্রথমে গেলেন- আয়েশা রাঃ এর কাছে। এখানের ঘটনাটি গভীর ভাবে অনুধাবন করুন- যখন ২৯ দিন অতিবাহিত হলো, তখন তিনি সর্বপ্রথম আয়েশা রাঃ এর নিকট গিয়েছিলেন। আয়েশা বললেন, "আপনি শপথ করেছিলেন যে, একমাস আমাদের কাছে আসবেন না, আজ কেবল মাত্র ২৯ দিন অতিবাহিত হয়েছে। আমি এক এক করে দিন গুনে রেখেছি।" দেখুন কেমন ভালবাসা ছিল মুহাম্মদ ﷺ এর প্রতি আয়েশা রাঃ এর যিনি প্রতিদিন এক এক করে স্বামীর ফিরে আসার দিনের প্রতীক্ষা করে যাচ্ছিলেন! মুহাম্মদ ﷺ জবাবে বললেন, "২৯ দিনেও মাস হয়।" সে মাস ২৯ দিনে ছিল। যদি মারিয়া রাঃ এই সব ঘটনার মূল হতেন আর আয়েশা রাঃ যদি শুধু মারিয়া রাঃ এর বিরোধীতা করতেন তাহলে মুহাম্মদ ﷺ কি প্রথম আয়েশা রাঃ এর সাথে কথা বলতে যেতেন? কিংবা আয়েশা রাঃ এত ব্যকুল হয়ে এই ভাবে উনার স্বামীর জন্য অপেক্ষা করতে পারতেন? আবার লক্ষ্য করুন- ২৯দিন পর স্ত্রীদের কাছে এসে প্রথমে রাসুলুল্লাহ ﷺ আয়েশা রাঃ  কে বললেন, "আমি তোমাকে কিছু বলতে যাচ্ছি, – হে নবী! তোমার স্ত্রীগণকে বলো,- "তোমরা যদি দুনিয়ার জীবনটা ও তার শোভা-সৌন্দর্য কামনা করো, তবে এসো আমি তোমাদের ভোগ্যবস্তুর ব্যবস্থা করে দিব এবং তোমাদের বিদায় করে দিব সৌজন্যময় বিদায়দানে।" (সুরা আহযাব, আয়াত ২৮) কিন্তু জবাব দেয়ার জন্য তোমার পিতামাতার সাথে পরামর্শ করার আগ পর্যন্ত তাড়ার কিছু নেই।  এখানে লক্ষ্য করুন ২৯ দিন বিচ্ছিন্ন থেকে স্ত্রীদের কাছে এসে যা বলছেন তা মারিয়া রাঃ এর প্রতি বৈরিতার কথা এই সব কিছু যা বলেছেন তা হচ্ছে পার্থিব সম্পদের কথা, এখানে বলেননি মারিয়া রাঃ এর কথা! বলেননি তোমরা মারিয়ার প্রতি যা করছ তা ন্যায় করনি। তবে পাঠক ভেবে নিবেন না আগের দিনের রাজা বাদশাহের হেরেমে যে ভাবে ভোগ বিলাসে তাদের নারী মত্ত হয়ে থাকতো সে ভাবে নবী পত্নীরা মত্ত ছিলেন! মুহাম্মদ ﷺ যখন গনিমতের মাল লাভ করতে থাকেন তখন তা সাধারণ গরীব জনসাধারণের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন, নিজের পরিবারের সদস্যদেরকে কৃচ্ছতায় রাখতেন। আর নবী পত্নীরা সাধারণ জনসাধারণ যে সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে সেই অধিকার পাবার জন্য নবী ﷺ এর উপর চাপ প্রয়োগ করেছেন। যা মূলতঃ অন্যায় ছিলোনা। সোজা কথায় এই আয়াতগুলো এবং সুরা আযহাবের আয়াতগুলোতেও মারিয়া রাঃ বা নারী ঈর্ষার কোন কথা উল্লেখ করা হয়নি।

আবার আমরা ফিরে যাচ্ছি মারিয়া রাঃ এর সাথে  কথিত ঐদিনের ঘটনায়। যদি ঘটনাটি সত্যিই  হয়ে থাকে! আলোচনাতে যাবার আগে পাঠকদের একটি ছবি দেখাচ্ছি- 

মাসজিদে নববী, A. মুহাম্মদ সাঃ এর মিরহাব  B. আয়েশা রাঃ এর হুজরা  C. হাফসা রাঃ এর হুজরা  D. যায়��াব বিনত জাহাশ রাঃ এর হুজরা  E. যায়নাব বিনত খুযাইমাহ রাঃ হুজরা  F. ফাতিমা রাঃ এর হুজরা ছবিতে নেই  G. বাব উসমান রাঃ  H. আহলুল সুফফাদের হুজরা। জুয়াইরা রাঃ এর হুজরা ছবিতে নেই  J. উম্ম হাবিবা বিনত আবু সুফিয়ান রাঃ এর হুজরা  K. সাফিয়্যা রাঃ এর হুজরা  L. বাব আল রাহমা  M. আবু বকর রাঃ এর হুজরা  N. সাদ আবী আক্কাশ রাঃ এর হুজরা  O. আ আব্বাস রাঃ এর হুজরা  P. জাফর বিন আবি সাদিক রাঃ এর হুজরা।
মাসজিদে নববী, A. মুহাম্মদ ﷺ এর মিরহাব  B. আয়েশা রাঃ এর হুজরা  C. হাফসা রাঃ এর হুজরা  D. যায়নাব বিনত জাহাশ রাঃ এর হুজরা  E. যায়নাব বিনত খুযাইমাহ রাঃ হুজরা  F. ফাতিমা রাঃ এর হুজরা ছবিতে নেই  G. বাব উসমান রাঃ  H. আহলুল সুফফাদের হুজরা। জুয়াইরা রাঃ এর হুজরা ছবিতে নেই  J. উম্ম হাবিবা বিনত আবু সুফিয়ান রাঃ এর হুজরা  K. সাফিয়্যা রাঃ এর হুজরা  L. বাব আল রাহমা  M. আবু বকর রাঃ এর হুজরা  N. সাদ আবী আক্কাশ রাঃ এর হুজরা  O. আ আব্বাস রাঃ এর হুজরা  P. জাফর বিন আবি সাদিক রাঃ এর হুজরা।

আমরা যদি উপরের ছবিটি দেখি তাহলে দেখতে পাব তখন মদিনার মসজিদ সংলগ্ন হুজরায় কীভাবে মুহাম্মদ ﷺ এর স্ত্রীগণ বাস করতেন। এখন আলোচ্য হুজরা C ছিল হাফসা রাঃ এর, এবং হাফসা রাঃ এর ঠিক সামনের হুজরা ছিল যায়নাব রাঃ এবং ফাতিমা রাঃ এর। এখন যদি আমরা চিন্তা করি যে সেদিন হাফসা রাঃ উনার হুজরায় ছিলেন না, মুহাম্মদ ﷺ সেই হুজরায় অবস্থান নিতেন যেদিন যে স্ত্রীর সাথে তার পালা থাকত। ঐদিন হাফসা রাঃ এর পালা ছিল। তাই মুহাম্মদ ﷺ হাফসা রাঃ এর হুজরায় ছিলেন। আমরা নিশ্চয় অনুমান করতে পারি যে হাফসা রাঃ মুহাম্মদ ﷺ এর অনুমতি নিয়েই বাবার বাড়িতে গিয়েছিলেন। যেহেতু পূর্ব নির্ধারিত পালা থাকা সত্ত্বে তিনি বাবার বাড়ি চলে যাবার কারণে মুহাম্মদ ﷺ মারিয়া রাঃকে খবর দিয়ে নিয়ে আসেন বা হাফসা রাঃ ঘরে নাই জেনেই এমন সময় মারিয়া রাঃ সেখানে আসেন।  এক স্ত্রীর অনুপস্থিতিতে তার জন্য নির্ধারিত ঘরে অন্য স্ত্রীকে ডেকে এনে সময় কাটানো মুহাম্মদ ﷺ কর্তৃক নিয়মের ব্যতিক্রম ছিল। তখনকার প্রচলিত সামাজিক আইনে তা বে-আইনী বা নীতি বিরুদ্ধ ছিলোনা। আমরা হাদিসে জানতে পারি যে মুহাম্মস ﷺ যে কোন আইন নিজে আমল করে তখন অন্যকে তা আমল করতে নির্দেশ দিতেন।  যখন মারিয়া রাঃ হাফসা রাঃ এর অনুপস্থিতে তার ঘরে ডেকে এনে যে ব্যতিক্রমী ঘটনার সৃষ্টি করেছেন তার পিছনে ছিলো অন্য কোন উদ্দেশ্য। কারণ ইসলাম-পূর্ব যুগে সুরাইয়া স্ত্রীর কোন অধিকার ছিলোনা আযাদ স্ত্রীর মত মর্যাদা। তখন রাসুল ﷺ প্রাক ইসলামী যুগের বৈষম্যময় এই প্রথাকে নির্মূল করার জন্য অথবা সন্তান হবার সাথে সাথে সুরাইয়া স্ত্রী আযাদ স্ত্রীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করার জন্য মারিয়া রাঃকে হাফসা রাঃ এর ঘরে এনে বাস্তবে সমমর্যাদা করেন। মারিয়া রাঃ রাতের গভীরে গোপনীয় ভাবে আসেননি। তিনি যখন হাফসার ঘরে এসেছেন তখন অন্যরা দেখেছেন এবং একজন সুরাইয়ার আজাদ স্ত্রীর ঘরে অবস্থানের জন্য বর্ণবাদী চিন্তা ভাবনার কারো ইগোতে আঘাত লেগেছিল বলেই কেউনা কেউ হাফসা রাঃ এর কাছেই খবর পাঠিয়েছিলেন।  যে কারণে তিনি অসময়ে ফিরে আসেন। মুহাম্মদ ﷺ নিশ্চয় এই নিয়ে আযাদ স্ত্রীদের প্রতিক্রিয়া হবে জানতেন কিন্তু ঘটনা এত তীব্র আকার ধারণ করবে বুঝতে পারেনি। এক স্ত্রীর অবর্তমানে সুরাইয়ার সাথে মিলিত হওয়া কোন বে-আইনী বা ইসলাম বিরোধী কিছু ছিলনা। মুহাম্মদ ﷺ সকল স্ত্রীরা ছিলেন তখনকার আরব সমাজের উচ্চ এবং সম্ভ্রান্ত বংশীয় আযাদ মহিলা। আর মারিয়া রাঃ এর সে মর্যাদা ছিলনা, তিনি ছিলেন উপঢৌকন প্রাপ্ত নারী। তাই একজন উপঢৌকন প্রাপ্ত নারী মর্যাদার মহিলার পক্ষে আযাদ এবং সম্ভ্রান্ত বংশের স্ত্রীর ঘরে এসে স্বামীর সাথে দেখা করাকে সে সময়ের সমাজ ব্যবস্থার মূল্যবোধে আশরাফ স্ত্রীদের কাছে চরম অপমানজনক মনে হওয়া স্বাভাবিক। তাই তো মারিয়া রাঃ যখন বের হয়ে গিয়েছিলেন তখন হাফসা রাঃ এসে সেই অভিযোগ উপস্থাপন করেছিলেন- আপনি কেন আমার ঘরে তাকে নিয়ে এসেছেন? এর জন্য তিনি নিজকে অপমানিত বোধ করতে থাকেন। আর এই ভাবে তাঁর ঘরে মারিয়া রাঃকে নিয়ে এসে অপমান করা ঠিক হয় নাই বলে তার প্রতিবাদ করতে ছিলেন।  মুহাম্মদ ﷺ যে ভাবেই হোক হাফসা রাঃকে সহজ করে আনতে পেরেছিলেন। তিনি বুঝতে পারেন যে মারিয়া রাঃ এর সন্তান লাভ হওয়ার কারণে অন্যান্য স্ত্রীরাও তাদের সামাজিক পদ মর্যাদা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। তারা ভাবতে থাকেন কোথাকার কোন্‌ বিদেশী মহিলা এখন মুহাম্মদ ﷺ এর প্রধান স্ত্রীর মর্যাদা পেয়ে যাচ্ছে, তাই তারা সকলে মারিয়া রাঃকে আর সহজ ভাবে মেনে নিতে পারবেনা না। তাই এই বিষয়টি নিয়ে হাফসা রাঃএর অন্যান্য স্ত্রীরা মধুর ঘটনার মত এক হয়ে গিয়ে কোন অঘটন ঘটিয়ে ফেললে তা মারিয়া রাঃ এবং তার অপ্রত্যাশিত ভাবে লাভকৃত সন্তান শিশু ইব্রাহিমের রাঃ এর জন্য কোন আনাকাংখিত ঘটনার জন্ম হতে পারে।  মুহাম্মদ ﷺ নবী এবং রাসুল হলেও তিনি মানুষ ছিলেন, তাই তার ঘরে যখন একাধিক গর্ভ ধারণ করার যোগ্য স্ত্রী থাকতে কারো গর্ভে সন্তান না আসায় ধরে নিয়েছিলেন যে তার আর কোন সন্তান জন্ম নিবেনা, জীবনের শেষ সময় ৬০ বছর বয়সের একজন মানুষের ঘরে যদি সন্তান আসে তাহলে যজ্ঞের ধনের মত মনে হবে সে সন্তানকে, স্বাভাবিক ভাবে সন্তানের বাবা এই সন্তানটির নিরাপত্তার ব্যাপারে উদগ্রীব থাকবেন। তাই সন্তান এবং সন্তানের মায়ের জন্য যাতে কোন বিড়ম্বনা সৃষ্টি না হয় এর জন্য যাতে বিষয়টি এখানে শেষ হয়ে যায় এবং হাফসা রাঃকে এই ঘটনা যাতে অন্য কাউকে না বলেন তার জন্য অনুরোধ করেন।  সেই সময়ে পৃথিবীতে প্রথম বারের মত মুহাম্মদ ﷺ কর্তৃক নারীদেরকে স্বাধীনতা এবং সামাজিক মর্যাদা দান করার কারণে সদ্য প্রাপ্ত নারী স্বাধীনতা এবং সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির প্রতিদ্বন্দ্বীতা স্ত্রীদের মধ্যে চলছিল, তদুপরি মুহাম্মদ ﷺ এর স্ত্রী হবার কারণে তাদের জীবন যাপিত করতে হচ্ছিল খুব কৃচ্ছতার মধ্য দিয়ে। তখন নবীর স্ত্রীর মর্যাদার ভিত্তিতে নয় নিজদের জীবন যাত্রা সাধারণ মদিনাবাসীদের প্রাপ্ত সুযোগ সুবিধার মত করার জন্য মুহাম্মদ ﷺ এর প্রতি প্রবল চাপ দিয়ে যাচ্ছিলেন।  অন্যদিকে তখন মুহাম্মদ ﷺ এক ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করছিলেন, নতুন উম্মাহের ভবিষ্যৎ গঠনের জন্য হুজরার চেয়ে বাইরের জীবনে সময় ব্যয় অনেক দরকারি হয়ে উঠেছিল। কাজেই এই সময়ে হাফসা রাঃ এর ঘরে মারিয়া রাঃ এর উপস্থিতির কারণে অন্যান্য স্ত্রীরা এসে এই আশরাফ আতরাফ সমস্যাকে আরো বাড়িয়ে দিলে তখন তাকে বাইরের গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা রেখে ঘরের সমস্যার সমাধানের জন্য অধিক সময় ব্যয় করতে বাধ্য হয়ে পড়বেন বুঝতে পেরে তিনি হাফসা রাঃকে এই ঘটনা নিয়ে অন্যান্য স্ত্রীদের সাথে আলাপ আলোচনা না করার নির্দেশ দেন এবং হাফসা রাঃ কারো কাছে প্রকাশ করবেন না বলে কথা দেন। কিন্তু এই কথা হাফসা রাঃ রক্ষা করতে পারেননি, তিনি তা আয়েশা রাঃ এর কাছে জানিয়ে দেন। আর সকল ঘটনার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আয়েশা রাঃ এবং হাফসা রাঃ। 

এইখানে একটু বিরতি দিচ্ছি-

আয়েশা রাঃকে বুঝতে চেষ্টা করবঃ ৬২৭-৬৩১ খৃঃ সময়ে তিনি ছিলেন মাত্র ১৫ বছর বয়স থেকে ১৮ বছর বয়সের এবং তিনি একমাত্র স্ত্রী যিনি কুমারী ছিলেন। অন্যান্য স্ত্রীদের আগে একাধিক বিয়ে হয়েছিল, এবং অন্যদের সন্তানাদিও ছিল। কিন্তু আয়েশা রাঃ এর জ্ঞান আসার পর থেকেই মুহাম্মদ ﷺ কে উনার স্বামী হিসাবেই জ্ঞান করে এসেছেন এবং বয়সে ছোট হবার কারণেই তিনি মুহাম্মদ ﷺ এর অন্য সব স্ত্রীদের চেয়ে মুহাম্মদ ﷺকের বেশি কাছে পেতে কামনা করতেন। মুহাম্মদ ﷺ যখনই অন্যান্য স্ত্রীদের বিয়ে করেছেন তখন তিনি সতিনদের প্রতি জেলাসী অনুভব করতেন। উনার ভালবাসায় অন্য কেউ ভাগ বসাবে সেই আশঙ্কা করতেন। তাছাড়া অন্যান্য স্ত্রীদের সবার পূর্ব স্বামী কর্তৃক সন্তানাদি থাকলেও আয়েশা রাঃ এর কোন সন্তানাদি ছিলনা এবং তিনি সন্তানের মা হবার জন্য ব্যকুল ছিলেন। যখনই মারিয়া রাঃ সন্তানের মা হবার সংবাদ পেলেন স্বাভাবিক ভাবে তা মেনে নিতে পারছিলেন না। কাজেই সম্পূর্ণ মানবিক প্রভাবের কারণেই তিনি মারিয়া রাঃ বিরোধী ভূমিকায় অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। 

 খন্দকের যুদ্ধের সময় থেকে মুহাম্মদ ﷺ এর স্ত্রীরা নিজেদের পার্থিব সুযোগ সুবিধা এবং মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য চাপ দিয়ে আসছিলেন। কারণ মদিনার অন্যান্য সাধারণ মানুষ যেভাবে জীবন যাপন করে থাকে, নবী পত্নীরা সেভাবে জীবন যাপন করতে পারছিলেন না। তাদেরকে কৃচ্ছতার মাধ্যমে চলতে হচ্ছিল। নিত্য দিন উপবাস করে থাকতে হত। যা মদিনার সাধারণ মানুষের চেয়েও হীন ছিল তাদের অবস্থা। তাই তারা দাবি জানাচ্ছিলেন তাদের জীবন যাপনের মান উন্নত করতে। মুহাম্মদ ﷺ এই সুযোগ দিতে পারছিলেন না। নিজের ঘরের চেয়ে পাড়া প্রতিবেশী এবং উম্মাহর মানুষের কল্যাণের পিছনে অধিক ব্যয় করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু মুহাম্মদ ﷺ এই চাপের কাছে নতি স্বীকার না করায় স্ত্রীরা পারিবারিক জীবনের অশান্তির কারণ হয়ে উঠতে ছিলেন। তাই মারিয়া রাঃ এর সন্তান লাভের ঘটনা, আগ থেকে চলে আসা চাপা অসহিষ্ণুতার মধ্যে অগ্নি সঞ্চালন করে। 

সেই সময়ে মারিয়া রাঃ কে হুজরায় নিয়ে আসার চেষ্টা করার কারণে অন্যান্য স্ত্রীদের মনে তাদের আশরাফী সংস্কারে প্রবল ধাক্কা মারে, মুহাম্মদ ﷺ সে সমাজ ব্যবস্থার সুরিয়াদের প্রতিভূ হিসাবে মারিয়া রাঃকে স্বাধীন স্ত্রী হিসেবে ঘরে প্রবেশাধিকার দিয়ে সে সমাজ ব্যবস্থায় হাজার হাজার সুরাইয়াদেরকে স্বাধীন স্ত্রীর সমমর্যাদা দান করেছিলেন। সুরাইয়াদের এই সমান মর্যাদা দানের বিষয়ে নবী পত্নীরা আপত্তি করেছিলেন। তাঁরা ভুল বুঝে উঠেন এই ভেবে যে, এইবার বোধহয় মারিয়া রাঃ এ হেরেমের সর্বেসর্বা হয়ে উঠবেন! বিবিরা যখন মারিয়া রাঃ এর সামাজিক মর্যাদার উত্থান আটকাতে গিয়ে পুত্র ইব্রাহীম রাঃ এর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন তখনই মুহাম্মদ ﷺ আর স্ত্রীদের সাথে আপোষ মূলক মনোভাব পরিত্যাগ করে তাদের ত্যাগ করে হুজরা ছেড়ে চলে আসেন। সব স্ত্রীগণ এক চরম মাত্রায় উপনীত হওয়ায় স্ত্রীদের প্রতি অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হয়ে শপথ করেছিলেন যে, এক মাস কাল তিনি তাদের সাথে মিলিত হবেন না।  এই দ্বন্দ্ব স্বাভাবিক দ্বন্দ্ব ছিলনা। এই দ্বন্দ্ব ছিল একদিকে পুত্র ইব্রাহীমের জন্মের প্রতি মিথ্যা আরোপ যা ইসলামী দর্শনের পরিপন্থী তেমনি পত্নী সুরাইয়া যে ইসলামের দৃষ্টিতে সমান তারও পরিপন্থী। ইসলামে নীতির প্রশ্নে কারো আপোষ করার ক্ষমতা নাই এবং মুহাম্মদ ﷺ এর পারিবারিক জীবনের ঘটনা যাতে নবুয়তী কার্যের বিঘ্ন না ঘটায় এর জন্য আল্লাহতালাকে এই বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল। যার প্রেক্ষিতে আত তাহরীমের তিন থেকে পাঁচ নং আয়াত নাজিল হয়েছিল। আর এই ঘটনার পর থেকে বিবিরা নিজেদেরকে সকল ধরণের বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। 

এগেল কথিত ঘটনা সত্য হলে কি হত তা , 

শেষ করেও শেষ করতে পারছিনা কারণ অনেকে প্রশ্ন করেন যে, মুহাম্মদ ﷺ কেন মারিয়া রাঃ কে বিয়ে করেন নাই। মুসলিমদের কাছে এইটি কোন প্রশ্ন নয়। মানব সমাজে বিয়ে হচ্ছে সমাজ স্বীকৃত একটি সামাজিক রীতি যা দ্বারা একজন নর আর একজন নারী আইন সঙ্গত ভাবে পরস্পর সন্তান উৎপাদন, ঘর সংসার করেন। তবে এই বিষয়ে আলোচনা করার আগে বিয়ে কী তা নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই। 

ইসলামের বিয়ে জগতের প্রচলিত অন্যান্য বিয়ে থেকে তা ভিন্ন মাত্রার, অন্যান্য জাতি ধর্মের বিয়ে মানে অলংঘনীয় অবিচ্ছেদীয় নারী পুরুষের সম্পর্ক। ইসলামের বিয়ে ঠিক সে ভাবে নয়, ইসলাম নর-নারী মেল বন্ধনকে সুখী মেলবন্ধন হিসাবে দেখে চায়, তাই বিবাহিত নর-নারী কারো যদি মনে হয় তাদের এই মেল বন্ধন সুখী মেল বন্ধন নয় তাহলে সে সম্পর্ক ভেঙ্গে দিতে পারে। ইসলামে নারী পুরুষের মেল বন্ধনকে বিয়ে না বলে নিকাহ বলা অধিক যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়। 

ইসলামে নিকাহ দুই ধরণের।

 ১।কোন স্বাধীন, আযাদ নারীকে নিকাহ করতে হলে সেই আযাদ নারীকে সম্মানী হিসাবে মহর দিতে হয়। 

২। কোন ব্যক্তি তার নিজের দাসীদের মধ্য থেকে কাউকে শয্যাসঙ্গিনী করতে চাইলে সে দাসীকে সামাজিক ভাবে স্বীকৃতি দিয়ে শয্যাসঙ্গিনী হিসাবে গ্রহণ করলে সেটিও নিকাহ বলে বিবেচিত হয়ে যায়।

মারিয়া রাঃ ছিলেন স্বীকৃত মুসলিম, তিনি ছিলেন সন্তানের মা, এমনিতে ইসলামে স্বীকৃত যে কোন দাসী যখন সন্তান জন্ম দেন তখন তিনিও আযাদ হয়ে যান। সেই কারণে মুসলিমরা মারিয়া রাঃকে মুহাম্মদ ﷺ এর অন্যান্য বিবিদের মত সমান শ্রদ্ধা এবং সম্মান করে উম্মুল মুমিনিন বলে সম্মান করে থাকে। আমরা যদি ইতিহাস দেখি তাহলে দেখব যে, মারিয়া রাঃ কোন যুদ্ধ বন্দিনী ছিলেন না, তিনি কোন ক্রীতদাসী ছিলেন না। তিনি ছিলেন সম্ভ্রান্ত বংশের মেয়ে এবং রাষ্ট্র কর্তৃক উপহার হিসাবে প্রাপ্ত এবং মুহাম্মদ ﷺ এর সেবা করার জন্যই উপঢৌকন দেওয়া হয়েছিল। 

ইসলামের শরীয়ত মত শুধু মাত্র আযাদ নারীরা হিযাব করার যোগ্যতা অর্জন করেন। কোন দাসী হিযাব ধারণ করতে পারেন না। এই হিযাব সাধারণ হিযাব নয়, এই হিযাব হচ্ছে সতর ঢাকার সাথে সাথে মুখের সামনে পর্দা করা। আমরা ইতিহাসে দেখি যে মারিয়া রাঃ তার মুখের উপর পর্দা করতেন যা নবী পত্নীদের জন্য প্রয়োগযোগ্য ছিল। পরবর্তীতে খলিফাদের কন্যা স্ত্রীরা এই রীতি পালন করে গেছেন। পরবর্তীতে এই প্রথা সম্ভ্রান্ত পরিবারের প্রতিভূ হিসাবে সমাজে প্রচলিত হয়ে পড়ে তাই নিজদেরকে সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের মহিলা হিসাবে পরিচিত লাভ করতে মুসলিম সমাজের মধ্যে প্রচলিত হয়ে পড়ে। 

অন্যান্য স্ত্রীদের মত করে মারিয়া রাঃ কেন নিকাহ করেননি- তার যুক্তি হিসাবে আমরা খুঁজে পাচ্ছি  যে, 

১। মারিয়া রাঃ কোন আযাদ নারী ছিলেন না, তিনি উপটৌকন হিসাবেই আইন এবং সামাজিক রীতিনীতি মতে মুহাম্মদ ﷺ এর অধীনস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তাই তাকে নিকাহ করার সময় নতুন করে মহর দান করার প্রয়োজনীয়তা ছিলনা। 

২। আল কোরআনে নির্ধারিত যাদেরকে মুহাম্মদ ﷺ মহর দ্বারা নিকাহ করতে পারবেন সেই নির্ধারিত তালিকার মধ্যে মারিয়ার রাঃ স্থান ছিলনা। 

৩। সে সময় যে কারণে ইসলাম দাস প্রথা বিলুপ্ত করতে নির্দেশ দিতে পারেনি, সেই এক কারণে সুরাইয়া প্রথা বিলুপ্ত করতে পারেনি, কারণ সে সময়ে হাজার হাজার সুরাইয়া ছিল যাদেরকে মুক্ত করে দিলে তারা সামাজিক আর্থিক নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ত, কাজেই দাসদের যে ভাবে মানবিক অধিকার মর্যাদা দিয়ে বাস্তবে বৈধতা সৃষ্টি করেছিল ঠিক সে ভাবে সুরাইয়াদের মানবিক অধিকার এবং মর্যাদা মারিয়া রাঃ এর দ্বারা বাস্তবায়ন করা হয়ছিল। 

৪। মুহাম্মদ ﷺ ইব্রাহিম আঃ এর জীবনী জানতেন, তাই হাজেরা নাম্নীয় মিশরীয় রাজকুমারী যে ইব্রাহিম আঃ এর সুরাইয়া ছিলেন তা জানতেন। মিশর রাজ থেকে নিজের জন্য উপটৌকন হিসাবে মারিয়া রাঃ প্রাপ্তিকে পূর্ব পুরুষ ইব্রাহিম আঃ এর সুন্নত হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। কারণ মারিয়া এবং হাজেরা দুই জনকেই নবীর প্রতি প্রেরণ করা হয়েছিল এবং দুই জনই মিশরীয় কুমারী নারী ছিলেন। 

বিঃ দ্রঃ মারিয়া কিবতিয়াকে নিয়ে আলেমদের দুই ধরনের মত পাওয়া যায়, একটি তাকে বিবাহ করা হয়েছিল, দ্বিতীয় তাকে বিবাহ করা হয়নি। কোন মতই ইসলামী শরীয়াহর সাথে সাংঘর্ষিক নয়। যেমন এই হাদীসে বোঝা যাচ্ছে সন্তান হওয়াতে তিনি দ্বাসত্বমুক্ত হয়েছেন।
উম্মু ওয়ালাদ সম্পর্কে, 
ইবনে আববাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট (তাঁর পুত্র) ইবরাহীমের মা (মারিয়া কিবতিয়া) ‘র কথা উত্থাপিত হলে তিনি বলেনঃ তার সন্তান তাকে দাসত্বমুক্ত করেছে।
হাদিসটি ইমাম ইবনু মাজাহ এককভাবে বর্ণনা করেছেন।
সুনান ইবনে মাজাহঃ ২৫১৬ ,

এই হাদিসে বোঝাযায় তিনি বিবাহিত স্ত্রী ছিলেন , 

আব্দুল্লাহ আল জুহাইরিয়া (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,রাসুলুল্লাহ (ﷺ) শামউন এর কন্যা মারিয়াকে বিয়ে করেন। এই হলো সেই মারিয়া যাকে আলেকজান্দ্রিয়ার রাজা মুকাওকিস রাসুল (ﷺ)-এর নিকট উপহার হিসেবে পাঠিয়েছিলেন। -সহিহ আল মুস্তাদরাকে হাকিম, হায়দারাবাদ প্রকাশনী, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ৩৬। 

======================================================== 


  1. ⇧ সহিহ মুসলিম , ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৩৫৪৩, ইসলামীক সেন্টার ৩৫৪২
  2. ⇧ মাগাফীর হলো গঁদের সাথে সাদৃশ্যযুক্ত একটি জিনিস যা ঘাসে জন্মে থাকে এবং তাতে কিছুটা মিষ্টতা রয়েছে।
  3. ⇧ তাফসীর ইবনে কাসীর, সুরা তাহরিমের তাফসির । 
  4. ⇧ সুরা তাহরিমের তাফসির - তাফসিরে রুহুল মা আনি , তাফসিরে বায়ানুল কুরআন , তাফসিরে ইবনে কাসির ।
  5. ⇧ সীরাতে আয়েশা-সাইয়্যেদ সুলাইমান নদভী(রহঃ), পৃষ্ঠা ১৪৯
  6. ⇧ সুরা তাহরিমের তাফসির- তাফসিরে জালালাইন , তাফসিরে কুরতুবি , তাফসিরে ইবনে কাসির, তাফসিরে মারিফুল কুরআন । 
  7. ⇧ মুরসাল হাদিস: যে হাদিসের সনদে তাবীঈ রঃ এবং রসূল ﷺ-এর মাঝখানে সাহাবি রাঃ-এর বর্ণনাকারীর নাম উহ্য থাকে তাকে মুরসাল হাদিস বলে ।
  8. ⇧ গ্রন্থঃ সুনান আন-নাসায়ী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন) | অধ্যায়ঃ ৩৫/ মানত ও কসম (كتاب الأيمان والنذور), হাদিস নম্বর - ৩৭৯৬ 
  9. ⇧  মুকাওকাসের নাম ছিল- জুরাইদ বিন মাত্বা বা মিনা বা জর্জ সন অব মিনা যিনি বেঞ্জামিন ১ বলে ইতিহাসে পরিচিত। আলেক্সজান্দ্রীয়া থেকে ৬১৬ খৃঃ যখন পারসিয়ানরা বাইজাইন্টানীদের হটিয়ে ক্ষমতা দখল করে সেই সময় আলেক্সজান্দ্রীয়ার প্রধান চার্চের খৃষ্টান বিশপ জন দ্যা অলম্যানর পালিয়ে যান। তাঁর স্থানের ব্যাঞ্জামিন ১ কে স্থলাভিষিক্ত করা হয়। বেঞ্জামিন ১ ৬১৬ খৃঃ থেকে ৬৩০ খৃঃ পর্যন্ত এই পদে ছিলেন। 
  10. ⇧ তাবারী, পৃঃ ১৩১
  11. ⇧  বাংলায় প্রচলিত শব্দ উপপত্নী বলতে বুঝায় অবৈধ প্রণয়িনী বা রক্ষীতা বৈষ্ণব মোহান্ত সন্ন্যাসী প্রভৃতির দাসী বা উপপত্নী তাই ইসলামে প্রচলিত উপপত্নী শব্দটি ব্যবহার করা যায়না, ইসলাম ঐ ধরণের নারীদের যে মর্যাদা দিয়েছে অন্য কোন ধর্ম তা দিতে পারেনি তাই এই ধরণের সম্পর্কিত নারীকে বাংলায় যা বলা যেতে পারে দ্বিতীয় শ্রেণীর স্ত্রী আরবি ভাষায় যাকে সুরাইয়া বলে। যা ইংরেজিতে সেকেন্ডারি বা ইনফেরিওর ওয়াইফ বলা যেতে পারে। ইংরেজিতে কনকুবাইন বা রক্ষিতারা সমাজে গৌণ স্ত্রীর স্বীকৃতি পেলেও তারা স্বামীর সাথে কোন সামাজিক কিংবা রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে স্ত্রী হিসাবে প্রতিনিধি করতে পারতোনা, সে যেমন মৃত স্বামীর সম্পদের উত্তরাধিকার হতে পারতোনা তেমনি তার গর্ভের সন্তানও মৃত স্বামীর সম্পদের অধিকার পেতো না। বরং এই ধরণের স্ত্রী স্বামীর মুখ্য স্ত্রীর গর্ভের সন্তানরা ভাগ বণ্টন করে নিত, এবং পিতার রেখে যাওয়া উপপত্নীর সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতে পারতো, বা মৃত ব্যক্তির সন্তান তাকে স্বামীর বাড়ি থেকে বিতাড়ন কিংবা অন্য কারো কাছে বিক্রি করে দিতে পারত। কিন্তু ইসলাম এই সব যাবতীয় অন্যায় অমানবিক প্রথাকে বাতিল করে দিয়ে এই ধরণের বিবাহিত নারীকে অন্যান্য স্ত্রীদের মত মর্যাদা দিয়েছে, এবং তার গর্ভের সন্তানরা মুখ্য স্ত্রীর সন্তানদের মত অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। পিতার রেখে যাওয়া কথিত উপপত্নীকে মুখ্য স্ত্রীর সন্তান ধারা যৌন সম্ভোগ পুরো নিষিদ্ধ করে দেয় এবং অন্যত্র বিক্রি বা তাকে দিয়ে অন্য লোকের যৌন সম্ভোগে প্রেরণ বন্ধ করে দেয়। ইসলামে বিয়েটি একটি সামাজিক চুক্তি বিশেষ, যেখানে উপযুক্ত একজন পুরুষ আর একজন নারীর মধ্যে তাদের নিজস্ব চাওয়া পাওয়ার ভিত্তিতে একে অন্যকে স্বামী স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করবে তবে শর্ত থাকে যে বিয়েটি সমাজের সবার সামনে প্রকাশ্য ঘোষণার মাধ্যমে হতে হবে, তাই যে কোন এক নারী এক পুরুষকে স্বামী স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করে নিলে তা বৈধ হয়ে যাবে। ইসলামের উপপত্নী বৈধ সমাজ এবং ধর্মে তা নৈতিকতা হীন নয়। সুরাইয়া এবং পত্নীর মধ্যে শুধু ব্যবধান, পত্নী আজাদ মহিলা যাকে মোহর দ্বারা হালাল করা হয়েছে, আর মালিকানাধিন মহিলাকে মোহর ছাড়া হালাল করা হয়। যাকে কোন কারণে মোহর দ্বারা বিয়ে করা সম্ভব হয়না তাকে ইসলামে সুরাইয়া বলে। ইসলামে সুরাইয়া এবং পত্নী সামাজিক, মর্যাদা এবং অধিকার সমান, সুরাইয়ার সন্তান পত্নীর সন্তানদের মত সমান মর্যাদা এবং অধিকার লাভ করে থাকে।
  12. ⇧ সিয়ারু আলামিন নুবালা । 
  13. ⇧ সহীহুল বুখারী, পর্ব ৬৭ : বিবাহ, অধ্যায় ৮৩, হাঃ ৫১৯১; মুসলিম, পর্ব ১৮ : ত্বলাক, অধ্যায় ৫, হাঃ ১৪৭৯