Are you sure?

কুরআন »  বিবিধ

কুরআনের একটি উপমার বিশ্লেষণ- রঙিন জীবনে ধুসরতা

আমাদের জীবনের কয়েকটি পর্যায়ক্রমিক ধাপ রয়েছে। এভাবে জীবন তার শেষ সময়ের দিকে গড়ায়। চিরন্তন এক বাস্তবতা তুলে ধরা হয়েছে একটি উপমার সৌন্দর্যের মাধ্যমে। এই আয়াতটা সূরা হাদিদের অন্তর্ভুক্ত। এই সূরার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় মুসলিম সমাজকে কেন্দ্র করে। এমন অনেক মাদানি সূরা রয়েছে যার মূল আলোচ্য বিষয়টিতে সমগ্র মানবজাতিকে সম্বোধন করা হয়েছে। কারণ এই ধর্ম তথা ইসলামের আহ্বান সমগ্র মানবজাতির জন্য বিশেষ বার্তা।

কিন্তু কুরআনে আবার এমন জায়গা রয়েছে, বিশেষ করে মদিনায় অবতীর্ণ কোন কোন সূরা, যেখানে আলোচ্য বিষয়ের মূল উদ্দেশ্য মুসলিম সমাজ। তারাই এই সূরাগুলো শুনছে। জীবনে আমরা যে সমস্ত বিষয়ের পেছনে ছুটি তাঁর একটি মৌলিক সারাংশ- আল্লাহ্ এই মাদানি সূরায় আমাদের বর্ণনা করেছেন। মহান আল্লাহ্ তা'আলা বলেন:

Al-Hadid 57:20
ٱعْلَمُوٓا۟ أَنَّمَا ٱلْحَيَوٰةُ ٱلدُّنْيَا لَعِبٌ وَلَهْوٌ وَزِينَةٌ وَتَفَاخُرٌۢ بَيْنَكُمْ وَتَكَاثُرٌ فِى ٱلْأَمْوَٰلِ وَٱلْأَوْلَٰدِۖ كَمَثَلِ غَيْثٍ أَعْجَبَ ٱلْكُفَّارَ نَبَاتُهُۥ ثُمَّ يَهِيجُ فَتَرَىٰهُ مُصْفَرًّا ثُمَّ يَكُونُ حُطَٰمًاۖ وَفِى ٱلْءَاخِرَةِ عَذَابٌ شَدِيدٌ وَمَغْفِرَةٌ مِّنَ ٱللَّهِ وَرِضْوَٰنٌۚ وَمَا ٱلْحَيَوٰةُ ٱلدُّنْيَآ إِلَّا مَتَٰعُ ٱلْغُرُورِ

(তোমরা ভালভাবে) জেনে রাখো যে, এই পার্থিব জীবন তো খেলাধুলা, জাঁকজমক প্রদর্শন, পারস্পরিক অহঙ্কার প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা, ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি বৃদ্ধির প্রতিযোগিতা ছাড়া আর কিছুই নয়। (আর এসব কিছুর) উপমা যেন আকাশ থেকে পড়া এক পশলা বৃষ্টি, যার দ্বারা উৎপন্ন ফসলের সমাহার কৃষকের মনকে (আনন্দে) পূর্ণ করে দেয়। অতঃপর (একদিন) সেই ফসল শুকিয়ে যায় এবং তুমি তাকে হলুদ বর্ণরুপে দেখতে পাও। এরপর সেগুলি (ফসলহীন মৃত) খড়কুটোয় পরিণত হয়ে যায়। (কাফিরদের এই দুনিয়ার চেষ্টাও এইরূপ অর্থহীনতায় পরিণত হয়ে যায়) আর (ফলে) পরকালের জীবনে (তাদের জন্য থাকবে) কঠিন শাস্তি। আর (মুমিনদের জন্য থাকবে) আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমা ও সন্তুষ্টি। আর এই পার্থিব জীবন তো ছলনাময় প্রতারণার উপকরণ ছাড়া আর কিছুই নয়।

▪︎ মহান আল্লাহ্ শুরু করেছেন এভাবে ٱعْلَمُوٓا۟- "তোমরা ভালভাবে জেনে রাখো", এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের জন্য একটা আদেশ, যেন আমরা ভাল করে বিষয়টি উপলব্ধি করি। কিন্তু যে বিষয়গুলো তিনি আমাদের কাছে উল্লেখ করেছেন সেগুলো আমাদের নিকট সুস্পষ্ট। আসলে আমরা আমাদের জীবন পরিচালনা করার সময় এই বিষয়গুলোর প্রতি খুব ভালো করে লক্ষ্য করি না বলেই তিনি ভালভাবে জেনে আমলে নিতে বলেছেন।

আল্লাহ্ বলেছেন, "ٱعْلَمُوٓا۟ أَنَّمَا ٱلْحَيَوٰةُ ٱلدُّنْيَا لَعِبٌ অর্থাৎ খুব ভালভাবে জেনে রাখো যে, পার্থিব জীবন খেলাধুলা ছাড়া আর কিছুই নয়।" যারা পিতা-মাতা হয়েছেন তারাই এই আয়াতটি গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারবেন অন্যথায় নয়। বাচ্চারা বড় হওয়ার সাথে সাথে তাদের কিছু প্রয়োজন এবং চাহিদা দেখা দেয়- আর আমরা সবাই এটা জানি। বাচ্চারা যখন জন্মগ্রহণ করে তখন তাদের কোন চাহিদা থাকে না, যেটা থাকে সেটা হলো প্রয়োজন। তাদের দুধ পান করতে হয়, পেশাব পায়খানা করতে হয়, ঘুমাতে হয়...এভাবেই এই জীবনচক্র চলতে থাকে বাচ্চাদের ক্ষেত্রে।

কিন্তু যখন তারা আরেকটু বড় হতে শুরু করে, তখন বিভিন্ন জিনিস চাওয়া শুরু করে। আমাদের বাচ্চারা যাদের বয়স ছয়, নয় মাস বা এক বছর তারা খেলা করতে চায়। তারা চায় কেউ তাদের কোলে নিক, খেলাচ্ছলে উপর- নিচ করুক- যেটায় তারা খুশি হয়ে অনেক হাসে, কাতুকুতু দিক...। তারা শুধুই খেয়ে ঘুমিয়ে পড়তে চায় না; তারা খেলতে চায়। এই চাহিদাটা প্রকৃতিগতভাবেই বাচ্চার মধ্যে চলে আসে।

তারপর আমাদের জীবন পরিক্রমায় অন্য একটি পর্যায় এসে যুক্ত হয়।আল্লাহ্ বলেছেন: ٱعْلَمُوٓا۟ أَنَّمَا ٱلْحَيَوٰةُ ٱلدُّنْيَا لَعِبٌ وَلَهْوٌ--- তোমরা জেনে রাখো যে, দুনিয়ার জীবন হলো খেলাধুলা, কৌতুক...। এখানে "لَهْوٌ- লাহয়ু" বলতে এমন জিনিস বোঝায় যা নিয়ে অবসর সময় কাটানো হয়; যা উপকারী নয়, কিন্তু বিনোদন পাওয়া যায়- যা আপনাকে কাজের কথা ভুলিয়ে দিবে, এটাকে "লাহয়ু" বলা হয়।

আমাদের বাচ্চারা যখন আরেকটু বড় হতে শুরু করে তখন তারা শুধু বেড়ানো বা লুকোচুরি খেলার মাঝে সন্তুষ্ট থাকে না। আপনাকে আরো কিছু যুক্ত করতে হয়, যেগুলোকে আমরা বিনোদন বলি।

"আব্বা আমাকে একটি গল্প বলো, আমি কী এই কার্টুন দেখতে পারি? এই অনুষ্ঠানটি দেখতে পারি? আমি কী এটা দেখতে পারি? আমি কী ঐটা দেখতে পারি? তুমি কী আমাকে একটি গল্প শোনাতে পারবা অথবা কোন কবিতা বা ছন্দ?" এর নাম তো খেলাধুলা নয়, এর নাম কী? বিনোদন। সুতরাং জীবনের পরবর্তী পর্যায়টি হলো বিনোদন। বর্তমানে খেলাধূলা এবং বিনোদনের সমন্বয়ে তৈরী করা হয়েছে ভিডিও গেমস ইন্ডাস্ট্রি। বর্তমানে গল্প এবং খেলাধুলা- দুটাকেই এক করে দেওয়া হয়েছে আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে। এই ভিডিও গেমসগুলোর সবচেয়ে বড় ভোক্তা হলো শিশুরা।

আমাদের মুসলিম শিশুদের একটা বড় অংশও এগুলোর ব্যবহারকারী। আর এই গেমসগুলো তাদের বয়স সীমার অনেক বাইরে। যেমন: আপনার আট বছরের একটা বাচ্চা এসে আপনাকে বলে-- "আম্মু, আমাকে এই ঈদে গ্রান্ড থেফট অটো গেমস কিনে দিতে হবে। যদি আমাকে এই গেমসটা কিনে দাও, তবে আমি অনেক ভালো হয়ে যাব, তোমার কথামতো চলব, ভাল করে পড়াশোনা করব ইত্যাদি কথা তাই না?

তাহলে প্রথম ছিল খেলাধুলা, দ্বিতীয়ত বিনোদন। তারপর আল্লাহ্ তৃতীয় পর্যায়ের কথা উল্লেখ করেন। وَزِينَةٌ-- শোভা- সৌন্দর্য (জাঁকজমক প্রদর্শন) সৌন্দর্য নিজেই চরম আকাঙ্ক্ষার বস্তু হয়ে দাঁড়ায়। এর মানে কী জানেন? এর মানে হলো আপনি সাবালক হয়েছেন। এর মানে আপনি তরুণ হয়ে গেছেন। আপনি এখন সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছেন নিজের সৌন্দর্য নিয়ে।

আপনার বয়স যখন ৯ বা ১০ বছর ছিল, আপনার জুতা ম্যাচিং করছে কিনা- এটা নিয়ে মাথা ব্যথা ছিল না। আপনার পোশাক কেমন- সেটা নিয়েও কোন মাথা ব্যথা ছিল না, বা অন্য কারো পোশাকের দিকেও আপনি ভ্রুক্ষেপই করতেন না।

এখন আপনি যদি ১৩ বছর বয়সের কোন বোন হয়ে থাকেন, আপনি ৩০ মিনিট ধরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের হিযাব ঠিক করেন। যদি একপাশ অন্য পাশ অপেক্ষা কিছুটা উঁচু হয়, জোরে জোরে মাথায় থাপ্পড় দিতে থাকেন এটাকে একটু নিচে নামানোর জন্য। কিন্তু এটা নিচে নামছে না, এমন সময় আপনার আম্মু দরজায় নক করে জিজ্ঞেস করেন, ঠিক কিছু ঠিক আছে তো?---হ্যাঁ, সব ঠিক আছে।

অন্যদিকে ছেলেদের ক্ষেত্রে, এখনো তাদের কোন দাঁড়ি গজায়নি, কিন্তু তারা মনে করে যে- একটা দুইটা গজিয়েছে। আয়নার সামনে বারবার দাড়িয়ে দেখতে থাকে, হ্যাঁ, আমার দাঁড়ি গজাচ্ছে; ওহ! আমি একটা দেখতে পেয়েছি। আবার যাদের মুখ ভর্তি দাঁড়ি উঠেছে, তারা অনেকেই পেন্সিলের মত এটাকে সাজিয়ে রাখে। মনে হয় যেন একটা শৈল্পিক রুপ দিয়ে এটাকে ছাটানো হয়েছে; যেন কোন এক ইঞ্জিনিয়ারের মহৎ কর্ম।

এমনকি টাক মাথার ছেলেটাকেও দেখা যায় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ওমন করছে। আমি দেখেছি, তরুণ ছেলেরা যখন জুম্মার নামাজ পড়তে মসজিদে আসে, তারা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা প্রত্যেকটি গাড়ির গ্লাসে নিজের চেহারা দেখে, চুল ঠিক করে; এমনটা আমি নিজেও অনেকবার করেছি- যা সত্য কথা। এটা খুব মজার। দৃশ্যটা বেশ মজার হয় আরো- যখন বিশেষ করে আপনি গাড়ির ভেতরে থাকেন, কিন্তু তারা তা জানে না। আর তারাও আপনার গাড়ির গ্লাসে নিজের চেহারা দেখে চুল ঠিকঠাক করছে নিজেকে সুন্দর দেখানোর জন্য আর আপনিও ভেতর থেকে তা দেখছেন, তখন একটু মজা করলেন আর হঠাৎ করে গাড়ির গ্লাস খুলে দেন, দেখেন ছেলেটি কেমন লজ্জা পায়? ব্যপারটা অনেক সময় মজার লাগে তাই না? হাহাহা 

সৌন্দর্য একটি চরম আকাঙ্ক্ষার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় এই সময়ে। আপনি চান আপনাকে যেন সুন্দর দেখায়। আপনি সুন্দর কারো প্রতিও আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। আপনি সুন্দর গাড়িতে চড়তে ভালবাসেন। যদি আপনার বাসা সুন্দর না হয়, আপনি মানুষকে দাওয়াত করতে চান না। আপনার বাবা যদি বেশ পুরাতন মডেলের গাড়ি চালান আপনি তাকে স্কুল থেকে বেশ দূরে নামিয়ে দিতে বলেন। আপনার বন্ধুদের এমন গাড়ি দেখানোর চেয়ে আপনি হেঁটে স্কুলে যাওয়াকে বেশি পছন্দ করেন। কারণ এ বয়সে সৌন্দর্য আপনার মনকে সম্পূর্ণরূপে আচ্ছন্ন করে রাখে। ফ্যাশন, সুন্দর পোশাক, বাসার ভেতরের ভেতরের ডিজাইন ইত্যাদি।

এ বয়সে আপনি আপনার রুম সাজিয়ে রাখতে পছন্দ করেন। আপনি গাড়ি চান। দেখতে সুন্দর এমন একটি ফোন চান, ভালভাবে কাজ করুক অথবা না করুক- ওটা কোন ব্যপার না। আবার এটার জন্য সুন্দর একটা কাভারও কিনে আনেন। এটাকেই বলা হয় زِينَةٌ (জিনাতাহ)। এমন সময় আপনি অতিক্রম করেছেন। সৌন্দর্যের প্রতি এই চরম আকাঙ্ক্ষাও এক সময় হ্রাস পেতে শুরু করে।

হাইস্কুল জীবন শেষ, এখন আপনি কলেজ বা ভার্সিটিতে। কলেজ ভার্সিটির ছাত্রদের দিকে তাকালে অনেক সময় "বাস্তুহারা" মানুষদের মত মনে হয়। চুলগুলো এলো, ভালো করে ফ্রেশ হয় না, বিছানা থেকে উঠেই ক্লাসের জন্য ভোঁ দৌড়। কোন রকম একটা গেঞ্জি ও প্যান্ট পরে ক্লাসে হাজির হয়। এসব নিয়ে তাদের কোন মাথাব্যথা নেই। তাদের মাথায় সবসময়ই একটা চিন্তা কাজ করে কখন পাশ করব। খুব সিরিয়াস ছাত্ররা এভাবেই চিন্তা করে। তাদের এখন সবচেয়ে বড় মাথাব্যাথার বিষয় হলো-- সিজিপিএ, ইন্টার্নশীপ ইত্যাদি। কেন তারা এভাবে চিন্তা করে? কারণ নতুন একটি আকাঙ্ক্ষার আবির্ভাব ঘটেছে।

আমি বলছি না যে পূর্বের আকাঙ্ক্ষাগুলো হারিয়ে গেছে। পূর্বের আকাঙ্ক্ষাগুলো কী ছিল?

1. খেলা করা
2. বিনোদন
3. সৌন্দর্য।

আর চার নাম্বারটা হলো "ভাব দেখানো- (وَتَفَاخُرٌۢ بَيْنَكُمْ) পারস্পরিক অহমিকা। আপনি আপনার মূল্য অন্যের কাছে উপস্থাপন করতে চান। আপনি হয়তো ওয়ালমার্ট বা কোন নামকরা প্রতিষ্ঠানে চাকরি পেয়েছেন। তারা আপনাকে একটি ব্যাজ দিয়েছে। আর আপনিও এটা জামার উপর সবসময়ই ঝুলিয়ে রাখেন। আপনি এমনভাবে রাখেন যেন মানুষ সেটা দেখতে পায়।

"ও তুমি ওখানে চাকরি পেয়েছো?" আবার গাড়িও কিনেছ।
---হ্যাঁ, তারা আমাকে পার্কিং লটেও জায়গা দিয়েছে। এই যে আমি তার ছবি তুলে রেখেছি, দেখুন।"

এভাবে আপনার ভেতরে একধরনের গর্ববোধ কাজ করে। আপনি মানুষকে দেখাতে চান আপনি কি অর্জন করেছেন। যখন লোকজন ভার্সিটি থেকে পাশ করে বের হয়, তখন তারা কী পায়? সার্টিফিকেট। এই সার্টিফিকেট কী তারা ড্রয়ারে রেখে দেয় নাকি দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখে? একটি ফ্রেমে বাঁধাই করে ওয়ালে ঝুলিয়ে রাখে।

এটা আপনার গর্ব। আপনি মানুষকে দেখাতে চান জীবনে কী অর্জন করেছেন। মানুষ বিখ্যাত কারো সাথে ছবি তুললে অন্যদের সেটা দেখাতে চায়। দেখো দেখো আমি কার সাথে !"

সত্যি বলছি এইসব অনুষ্ঠানে মাঝে মাঝে আপনার নিজেকে এক প্রাণহীন এক মূর্তির মত মনে হবে। মানুষ এসে এভাবে বলে-- "ভাই, এদিকে আসেন, আপনার সাথে আমার একটা ছবি তুলতে হবে।" লোকটা এমনকি সালামও দেয় না, (রাগতস্বরে বলে) আমার একটি ছবি তুলতে হবে। আর আপনিও হয়তো ভয় পেয়ে যান, আর বলেন ঠিক আছে, ঠিক আছে, ছবি তুলুন! সেলিব্রিটি হলে কিন্তু মানুষের সাথে এমনটাই ঘটে- তাই না? হ্যাঁ, ঠিক তাই।

যাইহোক জীবনের এই পর্যায়ে এসে আপনি মানুষকে দেখাতে চান যে- আপনি কোন নামকরা ভার্সিটিতে পড়েন, কোন জায়গা থেকে গ্রাজুয়েট হয়েছেন, কী চাকরি করছেন, আপনার প্রথম অ্যাপার্টমেন্ট, প্রথম গাড়ি ইত্যাদি।

অনেকে গাড়ি কিনে মানুষকে দেখানোর জন্য। আপনার ভেতরে একটা অদম্য ইচ্ছা কাজ করে। বিশেষ করে তরুণরা, তারা যখন পরিবারের ক্ষুদ্র পরিসর থেকে বের হয়ে বৃহৎ পৃথিবীতে বিচরণ শুরু করে, তারা সবাইকে দেখাতে চায় তারা এখন বড় হয়ে গেছে এবং নিজের মত করে জীবনযাপন করছে।

তাদের আলোচনায় অ্যাপার্টমেন্টের (বাড়ি) আলোচনা চলে আসে। কেউ যদি জিজ্ঞেস না করে, তবুও তারা বলে। কারণ তারা আসলেই গর্বিত যে, এখন তারা নিজেদের মত করে বসবাস করছে। অথবা তারা খুবই গর্বিত যে, তারা জীবনের প্রথম গাড়িটি কিনেছে। তাদের কথাবার্তায় বার বার এই গাড়িটির ব্যপার চলে আসে, যদিও এ বিষয়ে কেউই আগ্রহী নয়। সুতরাং এই (تَفَاخُرٌۢ بَيْنَكُمْ) পারস্পরিক অহমিকা প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা এখন জীবনের পর্যায়গুলোর মাঝে এসে যুক্ত হয়েছে।

আপনি এখনো গেমস পছন্দ করেন, বিনোদন পছন্দ করেন। নিজের সৌন্দর্য নিয়ে আপনি এখনো খুব সচেতন থাকেন এবং অন্যদের কাছে এখনো নিজেকে আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করতে চান। তার উপর এখন আবার নিজের কৃতিত্বও অন্যের কাছে জাহির করতে চান। এই পর্যায়টিও একসময় নিঃশেষ হয়ে যায়।

আপনি বিয়ে করেন, সন্তান-সন্ততি জন্ম লাভ করে। এখন আপনার সার্বক্ষণিক চিন্তাভাবনা আপনার ছেলেমেয়েদের নিয়ে। সারাক্ষণ এটা নিয়েই চিন্তিত থাকেন। তাদের কী প্রয়োজন, আমাদের আগামীকালের জন্য সদাই কিনেছি কী? স্কুলের ইউনিফর্ম রেডি আছে কী? গ্রীষ্মকালীন ছুটি কখন শুরু হবে? এই ছোট অ্যাপার্টমেন্টে আমরা আর থাকতে পারছি না, আমাদের বড় কোন বাসায় উঠতে হবে। কারণ এতজন ছেলেমেয়ের জন্য এখানে আর জায়গা হচ্ছে না। জামাকাপড়, প্রতিনিয়ত জুতার সাইজ বড় হয়ে যাওয়া, বড় বোনের ব্যবহৃত পিঙ্ক কালারের জুতা ছোট বোনের ব্যবহার করতে না চাওয়া...। তাই আপনাকে এখন ওসব নতুন করে ওসব কিনতে হবে।

ফলে, এখন আপনি টাকা উপার্জন নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন থাকেন। আপনার নিজের জন্য এবং ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতের জন্য টাকা জমানোর চিন্তায় মগ্ন থাকেন সর্বদা। আপনার মোবাইলের অ্যাপস থেকে প্রতি কয়েক ঘন্টা পরপর অ্যাকাউন্ট চেক করছেন। টাকাগুলো কী এখনো আছে? আবার চেক করে দেখি- আচ্ছা, এখনো আছে। হায় হায়, গ্যাস কোম্পানি অটোমেটিক্যালি বিল কেটে নিয়ে গেছে। আর এভাবে যতবার অ্যাকাউন্টে মাইনাস দেখেন- তখন আপনার অন্তর পুড়ে যায়।

আল্লাহ্ বলেন--وَتَكَاثُرٌ فِى ٱلْأَمْوَٰلِ وَٱلْأَوْلَٰدِۖ- ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি বৃদ্ধির প্রতিযোগিত"। প্রসঙ্গত আপনি যখন জীবনের এই পর্যায়ে আসবেন, যে সময় আপনি টাকা পয়সা উপার্জন, সেভিংস (টাকা জমানো), অবসর পরিকল্পনা ইত্যাদি নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকেন অথবা আপনার ছেলেমেয়েদের স্কুল কলেজের খরচ নিয়ে চিন্তিত থাকেন।

তরুণরা যারা এখনো জীবনের প্রাথমিক পর্যায়গুলোতে আছে, তাদেরকে যদি আপনি টাকা জমানো নিয়ে প্রশ্ন করেন, তারা বলে--"আমি সেভিংস নিয়ে কোন পরোয়া করি না। আপনি কিসব নিয়ে কথা বলছেন? আমি কখনোই আমার বাবা-মায়ের মত হবো না। আমি বাসা-বাড়ি নিয়ে কোন কেয়ার করি না ইত্যাদি। আপনিও সেই একই পথের মধ্যে দিয়ে যাবেন। আপনার পূর্বে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মানুষ একই কালচক্রের মধ্যে দিয়ে গত হয়েছে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম। আমরা মনে করি, যেসব জিনিস আমাদের সুখী করবে তার একটি সারাংশ আল্লাহ্ তা'আলা এই আয়াতে তুলে ধরেছেন; এই যে এসবের পেছনে তোমরা ছুটে চলো।

একজন শিশু মনে করে সে সুখী হবে যখন সে খেলাধুলা করে। আরেকটু বড় হলে সে মনে করে বিনোদন পেলে সুখী হবে। আরেকটু বড় হলে মনে করে- নিজেকে সুন্দর দেখালে, সুন্দর কিছু পেলে অথবা সুন্দর কিছুর পাশে থাকলে সে সুখী হবে। আরেকটু বড় হলে মনে করে- কিছু একটা করে দেখাতে পারলে নিজেকে সুখী মনে হবে। তারপর আরো বড় হলে মনে করে অনেক টাকা পয়সা উপার্জন করতে পারলে সে অনেক সুখী হবে। এইভাবে আপনার সুখী হবার বস্তু উপাদান চেঞ্জ হতেই থাকবে একেরপর এক। অবশেষে আপনার নিজের কাছেই কোন এক সময় এসব বস্তু উপাদান- যা আপনাকে সুখ দিত তা আর ভাল লাগে না। আর এভাবে সুখ একটি আপেক্ষিক বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। অর্থাৎ আপনাকে আগে যা সুখ দিত সেই একই উপাদান আর সুখ দিতে পারে না। আর এভাবে কোন কিছুই প্রকৃতপক্ষে চিরকালীন সুখ দিতে পারে না।

সারা দুনিয়ার মানুষ তারা যে ধর্মেরই অনুসারী হোক না কেন, যখন কেউ কোন বাড়ি কিনতে পারে তখন সে মনে করে যে--আমি জীবনে কিছু একটা অর্জন করতে পেরেছি। যদি না পারে, তখন আপনি যদি জিজ্ঞেস করেন, তুমি কী চাও? তখন হয়তো বলবে, ইশ! আমি যদি কোন সম্পদ অর্জন করতে পারতাম! তারা ভাড়া বাসায় বাস করে। তারপর সুন্দর কোন বাড়ির সামনে দিয়ে ড্রাইভিং করে যাওয়ার সময়, এমনকি এটা যদি ছোট বাড়িও হয়- তখন তাদের চোখের পলক পড়ে না। মনে মনে ভাবে- ইশ! যদি এরকম একটি বাড়ির মালিক হতে পারতাম! ব্যপারটা খুব সুন্দর হতো।

আপনি নিজেকে থামিয়ে রাখতে পারেন না। ফ্ল্যাট বিক্রয় রিয়েল এস্টেট ওয়েবসাইটে গিয়ে বিভিন্ন বাড়ির সুন্দর সুন্দর ফটোগুলো দেখতে থাকেন। আপনি হয়তো ভাবছেন তিন চার বছর পরে অন্য শহরে চলে যাবেন। কিন্তু আপনি এখন থেকেই ঐ শহরের বিভিন্ন বাড়ির ছবি দেখতে শুরু করেন। নিজের বউকে ডেকে বলেন-- "এই দেখ দেখ, এই বাড়ির বেড রুমটা দেখ, বাড়ির বাইরের অংশটা দেখ, কত সুন্দর তাই না? আপনার বউও বলে- হ্যাঁ, অনেক সুন্দর। আর আপনিও তখন ভাবতে শুরু করেন বাড়িটা নিয়ে। আপনি আর নিজেকে থামিয়ে রাখতে পারেন না। আল্লাহ্ আমাদের ভেতরে এটা দিয়েছেন। আর এটাই হলো আয়াতের অর্ধেক। এই দুনিয়ায় আমি আপনি যে সবকিছুর পেছনে ছুটে চলি এই অর্ধাংশে মহান আল্লাহ্ তার একটি সারাংশ তুলে ধরেছেন।

এরপর আল্লাহ্ বলেন: كَمَثَلِ غَيْثٍ أَعْجَبَ ٱلْكُفَّارَ نَبَاتُهُۥ -দুনিয়ার উপমা হলো বৃষ্টির মতো...। আরবিতে বৃষ্টির জন্য যে শব্দটি ব্যবহৃত হয় তা হল "মাতার"- ماتار । কিন্তু غيث (গাইস) শব্দের অর্থ পরিমান মত বৃষ্টি, এত বেশি নয় যার ফলে জমিনে বন্যা তৈরি হয়, আবার এত কমও নয় যার ফলে জমিনে গাছপালাও জন্মাবে না। একেবারে পরিমাণমত বৃষ্টি। আর এই ধরনের বৃষ্টিকে বলা হয় "গাইস"। এইজন্য যখন আমরা আল্লাহর কাছে বৃষ্টির জন্য দোআ করি আমরা "সালাতুল ইস্তিগাসা" আদায় করি। কারণ আমরা যেমন তেমন বৃষ্টির জন্য দোআ করছি না, আমরা দোআ করছি "গাইস" এর জন্য। পরিমাণ মতো বৃষ্টির জন্য। কারণ খারাপ বৃষ্টির জন্য মানুষ মারাও যেতে পারে। বন্যা হয়ে যেতে পারে। এই বন্যা আপনাকে মেরে ফেলতে পারে। আল্লাহ্ আকাশ থেকে পাথরের বৃষ্টিও বর্ষন করতে পারেন। তাই আপনি "গাইস" চাইবেন, যে বৃষ্টি প্রাণের সঞ্চার করে।

তো, আল্লাহ্ বলছেন, দুনিয়ায় যেসব কিছুর পেছনে তোমরা ছুটে চলো, তার উপমা হলো পরিমাণ মতো বৃষ্টির মতো أَعْجَبَ ٱلْكُفَّارَ نَبَاتُهُۥ - যে কৃষক জমিনে বীজ বপন করেছে, সে এই বৃষ্টি দেখে দারুণ খুশি হয়। কারণ এই বৃষ্টির ফলে তার জমিতে ফসল ফলবে। এই উপমায় একটি সুন্দর চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। কৃষকের জন্য আরবিতে যে শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে সেটা হলো "কুফ্ফার" كفار.

এখন আমরা সাধারণভাবে "কাফের" শব্দের একটা অর্থ জানি। "কাফের" শব্দের অর্থ কী? অবিশ্বাসী। কিন্তু এই আয়াতে কাফের শব্দের অর্থ এটা নয়। এই আয়াতে "কুফ্ফার" শব্দের অর্থ হলো: যে ব্যক্তি জমিনে বীজ লুকিয়ে রাখে। এটাই কুফ্ফার শব্দের শাব্দিক অর্থ। একজন অবিশ্বাসীকে এই জন্য কাফের বলা হয়- কারণ সে সত্য লুকিয়ে রাখে।

ফসল ফলানোর জন্য একজন কৃষককে সারা বছর ধরে অনেক পরিশ্রম করতে হয়। সর্বপ্রথম কোন কাজটা তাদের করতে হয়? বীজ বপন করার কাজ। তারপর তাদেরকে জমিনের মাটি ঠিক করতে হয়, পানি দিতে হয়। উর্বরতা বৃদ্ধিকারক কিছু ব্যবহার করতে হয় এবং নিশ্চিত করতে হয় যেন জমিনে পর্যাপ্ত পরিমাণে সূর্যের আলো পড়ে। এসব কিছু কৃষকদের করতে হয়। কিন্তু সর্বপ্রথম তাদের যা করতে হয়...এবং যে কাজটি সবচেয়ে পরিশ্রমের আর সেটা হলো বীজ বপন করা।

আর আল্লাহ্ এই পর্যায়টাকেই উল্লেখ করেছেন, কারণ এটাই সবচেয়ে পরিশ্রমের কাজ, আর এ সময় কৃষক তার পরিশ্রমের কোন ফলাফল দেখতে পায় না। তিনি জানেন না- আসলে তার এই বীজ থেকে চারা গজাবে কিনা। অথবা পোকামাকড় এই বীজটাকে খেয়ে ফেলবে কিনা। তিনি জানেন না- বৃষ্টি হবে কিনা। তিনি আগাম কিছুই জানেন না। কৃষকের বিষয়টা আমাদের মত নয়। আমি প্রায় এই উদাহরণটা দিয়ে থাকি। আপনি যদি কোন চাকরি করে থাকেন, তাহলে আপনি মাসে একবার বেতন পেয়ে থাকেন। অথবা কেউ কেউ প্রতি সপ্তাহে বেতন পেয়ে থাকেন।

অপরদিকে কৃষক কতবার বেতন পায়? সাধারণত বছরে একবার। তাকে সারা বছর পরিশ্রম করতে হয়। তারপর সম্ভবত বছর শেষে সে তার পরিশ্রমের ফল পাবে। তাকে পরিশ্রম ঠিকই করতে হবে, কিন্তু ফসল পেতেও পারে আবার নাও পেতে পারে। এক্ষেত্রে তার কোন নিশ্চয়তা নেই তার পরিশ্রমের পারিশ্রমিক (ফসল/ফলাফল) পেতে। এখন লোকটি সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে পরিশ্রম করে যায়। তারপর একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে ফসলের জন্য পরিমাণমতো বৃষ্টি হয়েছে। সে কী তখন খুশি হবে? হ্যাঁ, অনেক খুশি হবে। একসময় সে দেখতে পায়, বীজ থেকে চারা গজিয়েছে। গাছগুলো এখনো বড় হয়নি, যখন পরিপক্ব হবে তখন হয়তো সেগুলো উচ্চতায় তাকেও ছাড়িয়ে যাবে। কিন্তু এখন সেগুলো সবেমাত্র গজিয়েছে, আর তাতেই সে অত্যন্ত খুশি; অনেক বেশি।

তারপর আল্লাহ্ বলেন: ثُمَّ يَكُونُ حُطَٰمًاۖ- এরপর তা "হুতাম" বা খড়কুটো হয়ে যায়। "হুতাম" হলো যা জমিনে খড়কুটো হয়ে পড়ে থাকে, যার প্রতি আমরা কোন মনোযোগ দেই না। হেঁটে যাওয়ার সময় আপনার পায়ের নিচে পড়তে 'খটাশ' করে শব্দ হয়, কিন্তু আপনি এর প্রতি কোন নজর দেন না। যেমন শুকনো পাতা আপনার পায়ের নিচে পড়লে আপনি এভাবে বলেন না--"ওহ! আমি দুঃখিত, আসলে আমি খেয়াল করিনি।" আপনি এভাবে বলেন না, কারণ এটা শুধুই অর্থহীন আবর্জনা। "হুতাম-حطم" শব্দের শাব্দিক অর্থ হলো -- যা আপনার পায়ের নিচে পড়ে, যার প্রতি আপনি কোনোই গুরত্ব দেন না।"

এই উদাহরণটি দেওয়া হয়েছে যেন আমরা আমাদের জীবনটাকে উপলব্ধি করতে পারি।

প্রথম আকাঙ্ক্ষাটি কী ছিল? খেলা করা। কোন খেলনা নিয়ে খেলা করার পূর্বে আপনি আপনার সন্তানকে খেলনার দোকানে নিয়ে গেলেন। ব্যপারটা খারাপ লাগে, তবুও আপনি নিয়ে গেলেন। সে খেলনার দোকানের সেলফে রাখা খেলনাগুলোর দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে। আপনি যদি তাকে অন্যদিকে নিয়ে যান, তবুও সে তার মাথা ঐ খেলনার দিকে ফিরিয়ে রাখে, আপনার হাত থেকে সে ছুটে যেতে চায়। এমন অভিজ্ঞতা কম বেশি সবার জানা আছে। সে ইতিমধ্যে ভাবতে শুরু করে দিয়েছে---সে কিভাবে ঐ খেলনা ধরে রেখেছে, ঐটা নিয়ে খেলছে, তার মুখে ঘষছে, আরো সব মজার মজার কত্ত সব কি করছে! সে ইতিমধ্যেই এসব কিছুই পরিকল্পনা করে ফেলেছে। তাই সে আপনার কাছে বায়না ধরে--"আম্মু! প্লীজ ঐটা, প্লীজ আম্মু আমাকে ঐটা কিনে দাও।"

তাই আপনি খেলনাটি কিনে ব্যাগে রাখেন, আর তাকে বলেন, "বাসায় যাওয়ার আগে এটা বের করতে পারবে না।" সে গাড়ির পেছনের সিটে বসে খেলনার ব্যাগটি হাতে ধরে রাখে, আর বার বার ব্যাগের মুখটা একটু ফাঁকা করে দেখে- খেলনাটা আছে কিনা। তারপর এক সময় সেটা বের করে আনে, আর আপনাকে জিজ্ঞেস করে:

--"আম্মু! আমি কী এটা নিয়ে একটু খেলতে পারি? প্লীজ না বলো না, শুধু একবার। শুধু একবার খেলি?
--"না, আমি বলেছি এখন না।"

কিন্তু তার প্রত্যাশার কোন কমতি নেই। ভাবতে থাকে, ওহ! এটা দিয়ে খেলতে পারলে অ....নেক মজা পাবো।"

আপনার বাচ্চাকে একটা খেলনা ব্যাগ দিয়ে রাখুন, যেটা এখনো খোলা হয়নি। তারপর ব্যাপারটা ভিডিও করুন। অনেকক্ষণ যাবৎ তাকে এটা খুলতে দিবেন না, কারণ সেই সময়টুকুই ঐ খেলনার সাথে কাটানো তার সবচেয়ে সেরা সময়।

এটা ঠিক ঐ কৃষকের মত যে চরম চিন্তায় মশগুল থাকে--"বৃষ্টি হবে তো? বৃষ্টি হবে তো?" আর যখনই বৃষ্টি আসে সে তখন চরম খুশি হয়ে যায়। যদিও এখনো ফসল বের হয়নি, যদিও এখনো গাছগুলো পরিপক্বতা লাভ করেনি, তারপরও সে দারুণ খুশি। সে ভাবতে শুরু করে দেয়, আমি অনেক ফসল পাবো, বিক্রি করে অনেক টাকা পাব, টাকাগুলো অমুক অমুক ক্ষেত্রে ব্যয় করব ইত্যাদি।

তো বাচ্চাটি চরম উত্তেজিত, অবশেষে সে বাক্সটি খুলে খেলনাটি বের করে আনলো। সে এটা নিয়ে...ধরুন সে তিন ঘন্টা খেলা করলো। এরপর আপনি খেলনাটি কোথায় পাবেন? খাটের নিচে। সাধারণত বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এটাই হয়।

--"তোমার খেলনাটা কোথায়?"
--"জানি না। তুমি আমাকে কখনো আয়রনম্যান খেলনা কিনে দাওনি। দিয়েছ শুধু ক্যাপ্টেন আমেরিকা। আমি আয়রন ম্যান চেয়েছিলাম।

অল্প কিছু সময়ের মধ্যে...যা একটু আগে তার কাছে ছিল দুনিয়ার সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস, তা এখন মূল্যহীন।

আল্লাহ্ কোন বিষয়টিকে মূল্যহীন হিসেবে বর্ণনা করেছেন? কৃষি জমি।

খেলনাটার জন্য সে প্রচন্ড লালায়িত ছিল। যখন সে পেল, ভালভাবে ঠিকমতো খেললও না; কিছু সময়ের মধ্যেই এটা তার কাছে মূল্যহীন।

আপনার বাচ্চা গ্রান্ড থেফট অটো গেমসের জন্য আপনার কাছে কান্নাকাটি করছিলো। সে এটার জন্য তাহাজ্জুত পড়েছিল। রমজানের ২৭ তারিখে মসজিদেও গিয়েছিল আর দোআ করছিলো, "হে আল্লাহ্! আমার এই গেমস দরকার, আমি প্রতিজ্ঞা করছি এক সপ্তাহের মধ্যে শেষ করে ফেলবো। আমি সব লেভেল শেষ করব, আমি ওয়াদা করছি।"

অবশেষে সে গেইমটা পেল, সে পুরোটা খেলে শেষ করল। তারপর একদিন আপনি রান্নাঘরে আপনার পায়ের নিচে সিডি পড়ে থাকতে দেখলেন।

--"এই সিডিটা এখানে কোত্থেকে এলো? আমি না তোমাকে এটা কিনে দিয়েছিলাম?"
--"হ্যাঁ, আমি সব লেভেল শেষ করে ফেলেছি। এমম...এটা তেমন ভালো লাগেনি। আগেরটা এর চেয়েও ভাল ছিল...মনে হয়।

বিনোদনের ক্ষেত্রেও এমনটা দেখা যায়। নতুন মুভি আসলে সিনেমা হলের সামনে বিশাল লাইন দেখা যায়, যেটা হজের ভিসার জন্য দাঁড়ানো লাইনের চেয়েও লম্বা হয়। মুভিটা দেখার জন্য বাইরে মানুষের অপেক্ষা করতে থাকে। আমার মনে আছে, আগের দিনে "স্টার ওয়ার" মুভি মুক্তি পাওয়ার দিনে মানুষকে দেখতাম "জেডাই" ড্রেস পরে মুভি দেখতে আসত। মনে হয় যেন ইহরামের কাপড় পরে অপেক্ষা করছে কখন কখন জান্নাতের গেইট খোলা হবে!

তারপর তারা সিনেমা হলে ঢুকে মুভিটা দেখে, এবং বলে--"আসলে...একে তো নিম্নমানের স্পেশাল ইফেক্ট দেওয়া, তার উপর গল্পটা আমার অত ভাল লাগেনি। ধূর...টাকাটাই জলে গেল।"

আপনি এর জন্য এত লালায়িত ছিলেন আর অল্প সময়ের মধ্যেই এটা আপনার নিকট মূল্যহীন হয়ে গেল। আবার আমাদের মাঝে অনেকেই এমন আছে, যারা গাড়ির জন্য এমন তীব্র আকাঙ্খা পোষণ করেন। হয়তো আপনি Acura NSX গাড়ির মালিক হতে চান অথবা BMW কিনতে চান।

এরপর একসময় আপনি গাড়িটি কিনলেন। আহ, কি মজা ! আপনার ভার্সিটির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় একটু ধীরে চালান, (বন্ধুদের দেখানোর জন্য) 'কার ওয়াশ' এর কাছে একটু বেশিই আসা যাওয়া করেন।

তারপর, পরের বছর গাড়ির একটা নতুন মডেলের কার বাজারে আসল। এখন হঠাৎ করেই আপনি গাড়ির হেড লাইট নিচু করে রাখেন; গাড়িটি এখন খুব কুৎসিৎ মনে হয়। এটি এখন আর রাস্তায় চলার যোগ্য নয়। এই গাড়িটির ভেতরে এখন থাকলে খুব রাগ হয় নিজের উপর। এটি আপনার নিকট এখন বিরক্তিকর, মূল্যহীন বস্তু মনে হয়- ভাল না লাগার দিক থেকে।

বাসায় বড়দের ক্ষেত্রেও এমন হয়। তারা বাড়ি কিনে। বাসায় নতুন কেউ আসলে তাকে পুরো বাড়ি ঘুরে দেখায়, তাকে বিভিন্ন রুম দেখায়, "এই হলো আমাদের বাথরুম, এটা প্রথম বাথরুম, এটা দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, কেউই আপনার বাথরুম দেখতে চায় না...তবুও আপনি তাকে দেখান। আপনি তাকে বাড়ির সব কিছুই ঘুরে ঘুরে দেখান। কারণ এটা নতুন বাড়ি, এটা নিয়ে আপনি খুবই উত্তেজিত।

দুই বছর পর, তিন বছর পর কেউ একজন আপনাকে তাদের নতুন বাড়িতে উৎযাপন করার উৎসবে দাওয়াত দিল। ঐ বাড়ির আশপাশটা খুব সুন্দর। বাড়িটাও বেশ বড়। নতুন বাড়ি। তাদের বাথরুমও আপনার বাথরুমের চেয়েও সুন্দর।

এর ফলে কী হয়? "হায় আল্লাহ্!" আপনার বাড়িটি ঠিক হলুদ বর্ণ ধারণ করেছে। বুঝতে পারছেন আমি কী বলতে চাইছি?

খেলনা হলুদ বর্ণ ধারণ করে, গাড়ি হলুদ বর্ণ ধারণ করে, বাড়ি হলুদ বর্ণ ধারণ করে। আবার কারো কারো বিয়েও হলুদ বর্ণ ধারণ করে।

বিয়ের প্রথম দিন...। আপনার স্ত্রীকে দেখার জন্য কেমন উদ্দীপ্ত থাকেন? আপনি বাসায় আসলেন। বিয়ের প্রথম দিন যখন আপনার বউকে প্রথম দেখেছিলেন, অফিস থেকে বাসায় আসার পর যখন দেখেছিলেন, সেটা অন্য রকম এক অনুভূতি।

এভাবে দশ বছর পার হয়ে যাওয়ার পর একদিন বাসায় আসলেন। আপনি তার দিকে তাকালেন আর সেও আপনার দিকে তাকালো...আর এটা ঠিক বিয়ের প্রথম দিনের মতোই সুন্দর, তাই না? না, সেরকমটি নয়। এখানেও কিছু একটা হলুদ বর্ণ ধারণ করেছে।

আমি প্রায়ই এই গল্পটা বলি
আপনি নতুন বিয়ে করেছেন। রাস্তা দিয়ে আপনার স্ত্রীকে নিয়ে যাচ্ছেন। হঠাৎ করে তিনি হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলেন। ব্র্যান্ড নিউ ওয়াইফ পড়ে গেলেন। তখন আপনি কী করেন? "ওহ হো! তুমি ঠিক আছো তো? ব্যথা পাওনি তো কোথাও? আমি কখনোই তোমার কিছু হতে দিব না।"

তারপর দশ বছর পার হয়ে যায়। আপনার স্ত্রীকে নিয়ে তারপর আবার সেই একই রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন এবং আপনার স্ত্রী আবার হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলেন। কিন্তু আপনি হাঁটতেই থাকেন। আপনি আপনার হাঁটা অব্যাহত রেখে মুখ ঘুরিয়ে বলেন:

--"নিজে নিজে উঠে পড়। কী সমস্যা তোমার? তোমাকে নিয়ে কী রাস্তায় একটু বেড়ানোও যাবে না?"

আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন বিয়েটাও হলুদ বর্ণ ধারণ করেছে।

আল্লাহ্ আমাদের বলছেন, দুনিয়াতে আমরা যেসব বিষয়ের জন্য এত আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করি, একসময় তার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলব। তারপর এই আয়াতের উপসংহারে তিনি বলেছেন: وَفِى ٱلْءَاخِرَةِ عَذَابٌ شَدِيدٌ وَمَغْفِرَةٌ مِّنَ ٱللَّهِ وَرِضْوَٰنٌۚ - আর পরকালে আছে কঠিন শাস্তি এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমা ও তাঁর সন্তুষ্টি।" পরকালের শাস্তি এমন এক জিনিস যাতে আপনি কখনো অভ্যস্ত হয়ে যাবেন না। জাহান্নামের শাস্তি এমন নয় যে বার বার শাস্তি পাওয়ার দরুন একসময় তাতে অভ্যস্ত হয়ে যাবেন। এই দুনিয়ার আনন্দ এমনকি শাস্তিতেও আপনি অভ্যস্ত হয়ে যেতে পারেন। কিন্তু জাহান্নামের শাস্তিতে কেউ কখনো অভ্যস্ত হয়ে যাবে না। ও শাস্তি কখনো হলুদ বর্ণ হবে না।

এবং তারপর তিনি বলেন: وَمَغْفِرَةٌ مِّنَ ٱللَّهِ - এবং আল্লাহর ক্ষমা।...অর্থাৎ এটা চিরস্থায়ী। এবং সবচেয়ে বলেছেন: وَرِضْوَٰنٌۚ "ও সন্তুষ্টি।" তাঁর অসাধারণ আলঙ্কারিক বর্ণনাভঙ্গির কারনে তিনি বলেননি--"ওয়া রিদওয়ানুম মিনাল্লাহ।" তিনি শুধু বলেছেন--"ওয়া রিদওয়ান।" যার মানে হলো, "অবিশ্বাস্য শান্তি।" অবশেষে আপনি পুরোপুরি সন্তুষ্ট হয়ে যাবেন। আপনি আর পরবর্তী জিনিসের জন্য উৎসুক থাকবেন হয়ে থাকবেন না। এই দুনিয়াতে যদি আপনি আয়রনম্যান, সুপারম্যান বা যে মুভিই দেখেন না কেন, হল থেকে বের হয়ে এসেই পরবর্তীটার জন্য অপেক্ষা করতে থাকবেন। আপনি পরিতৃপ্ত হয়ে হল থেকে বের হয়ে আসবেন না। وانمغفر ة من اللة ورض-- আপনি অবশেষে সন্তুষ্ট হয়ে যাবেন। আমরা শেষ পর্যন্ত জান্নাতে গিয়ে প্রশান্ত হয়ে যাব।

আপনি এই জীবনে কখনো পরিপূর্ণ শান্তি পাবেন না। এখানে আমরা সবসময়ই পরবর্তী সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে থাকব, যতদিন না মাটি দিয়ে আমাদের পাকস্থলী ও চোখ পূর্ণ হয়ে যাবে।

তাই আল্লাহ্ বলেন: وَمَا ٱلْحَيَوٰةُ ٱلدُّنْيَآ إِلَّا مَتَٰعُ ٱلْغُرُورِ - আর পার্থিব জীবন প্রতারণার উপকরণ ছাড়া আর কিছুই নয়। এই একটি আয়াত, সূরা হাদিদের এই আয়াতে পার্থিব জীবনকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। পার্থিব জীবন কেবলমাত্র প্রতারণা ছাড়া এর বেশি কিছু না।

মানুষ মনে করে এই জিনিসটা পেলে সে সুখ খুঁজে পাবে, কিন্তু তারা তা পায় না। মানুষ মনে করে তারা তাদের বিশাল প্রসাদসম বাড়িকে খুব পছন্দ করে, কিন্তু তার ৯০ বছর বয়সের সময় যখন তার সন্তান সেই বাড়ি থেকে চলে যায়, তখন সেই বাড়িই তার জন্য আজাবের ক্ষেত্র হিসেবে পরিণত হয়।

এই বাড়ি তাদেরকে আর আনন্দ দেয় না। কোন যুবক সেই বাড়িতে গেলে ভাবে--"ইশ! আমি যদি এই বাড়িতে থাকতে পারতাম।" আর বুড়োরা মনে করে--"আমি যদি এটা থেকে কোনোভাবে মুক্তি পেতাম! আমি এখানে আর থাকতে চাই না। সুবাহানাল্লাহ্।

আল্লাহ্ আমাদেরকে সত্যিকারের সুখ এবং আনন্দ কী তা উপলব্ধি করার তৌফিক দান করুন। আর তাঁর উপর সত্যিকারের বিশ্বাস এবং প্রত্যাশা নিয়ে সেই উপলব্ধিকে কাজে পরিণত করার তৌফিক দান করুন। আল্লাহুম্মা আমীন। ওয়া আখেরি দাওয়ানা আনিল হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন।

কৃতজ্ঞতা জানাই: উস্তাদ নোমান আলী খানকে।