Are you sure?

বিজ্ঞান »  ইসলাম ও বিজ্ঞান

"এবং তা (বীর্য) নির্গত হয় সুলব ও তারাইবের মাঝখান হতে"

 

সুরা আত-ত্বারিক্বে (আয়াত 5-7) আল্লাহ বলেছেন : 

"فلينظر مما خلق . خلق من ماء دافق .يخرج من بين الصلب و الترائب "

অর্থ: "মানুষ যেন দেখে তাকে কোথা থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে, তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে সজোরে নির্গত বীর্য হতে, যা বাহিরে আসে সুলব ও তারাইব এর মাঝখান থেকে।"

 

আয়াতটিতে 'তারাইব' দ্বারা পুরুষের তারাইব উদ্দেশ্য নাকি নারীদের তারাইব উদ্দেশ্য, সেব্যাপারে মতভেদ আছে। একদল মুফাসসির বলেছেন 'নারীদের তারাইব', এবং আরেকদল মুফাসসির বলেছেন 'পুরুষদের তারাইব'। 

 

এই মতভেদটি উল্লেখ্য করতে গিয়ে মুফাসসির 'আবুল-হাসান আল-মাওরিদী' (রহ) তাঁর 'আন-নুকতু ওয়াল উয়ুন' গ্রন্থে লিখেছেন : 

 

فيه قولان: أحدهما: من بين صلب الرجل وترائبه، قاله الحسن وقتادة الثاني: بمعنى أصلاب الرجال وترائب النساء _[1]

 

অর্থ : "এবিষয়ে দুইটি মত রয়েছে, উক্ত দুটির মধ্যে একটি হলো : পুরুষের সুলব ও পুরুষেরই তারাইবের মধ্য হতে, এটি আল-হাসান ও কাতাদাহর মত, আরেকটি হলো যে তা পুরুষদের সুলব ও নারীদের তারাইব অর্থে এসেছে। " 

 

অর্থাৎ এখানে দুটি মতই সঠিক হতে পারে, দুটি মতই সঠিক হয়ার সম্ভাবনা আছে। মুফাসসির 'ইযযুদ্দিন ইবনু আব্দিস-সালাম '(রহ) তারাইবের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লিখেছেন : 

صلب الرجل و ترائبه أو صلبه و ترائب النساء_[2]

অর্থ : "পুরুষের সুলব ও পুরুষেরই তারাইব আর নাহয় পুরুষের সুলব ও নারীদের তারাইব।" 

 

আমি বলব : এক্ষেত্রে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত অধিক সঠিক মতটি হলো প্রথমটি, অর্থাৎ এখানে পুরুষের তারাইবই উদ্দেশ্য। নিম্নে উসুলভিত্তিক আলোচনার দ্বারা আমার উক্ত দাবিটির বিশুদ্ধতা প্রমাণ করা হলো।

 

উসুল অনুযায়ী,

 

"যে তাফসিরটি আয়াতের ব্যাহ্যিক রুপ ও অর্থের সাথে অধিক সামঞ্জস্যপুর্ণ হবে সেটি অন্যান্য তাফসিরের তুলনায় অগ্রাধিকার পাবে ও অধিক সঠিক হিসেবে গণ্য হবে, শুধুমাত্র তখনিই আয়াতের ব্যাহ্যিক দিক পরিত্যাগ করা বৈধ হবে যখন উক্ত ব্যাহ্যিক দিক পরিত্যাগ  করার মতো এমন সুস্পষ্ট দলিল পাওয়া যাবে যেটা অনুসরণ করা জরুরি।" [3] 

 

এক্ষেত্রে ২য় মতটি অর্থাৎ নারীদের তারাইব উদ্দেশ্য হয়ার মতটি আয়াতের ব্যাহ্যিক দিক ও রুপের বিরোধী এবং প্রথম মতটি অর্থাৎ পুরুষের তারাইব উদ্দেশ্য হয়ার মতটি হলো আয়াতটির অধিকতর ব্যাহ্যিক অর্থ।

 

ইবনুল-কাইইম (রহ) লিখেছেন : 

 

وَاخْتُلِفَ فِي التَّرَائِبِ فَقِيلَ: الْمُرَادُ بِهَا تَرَائِبُهُ أَيْضًا، وَقِيلَ: الْمُرَادُ تَرَائِبُ الْمَرْأَةِ، وَالْأَوَّلُ أَظْهَرُ [4] 

 

অর্থ : "এবং তারাইব এর ব্যাপারে মতভেদ ঘটেছে, ফলে বলা হয়েছে যে এরদ্বারা পুরুষেরই  তারাইব উদ্দেশ্য, এবং আরো বলা হয়েছে যে এরদ্বারা নারীদের তারাইব উদ্দেশ্য। তবে অধিকতর ব্যাহ্যিক ও স্পষ্ট হলো প্রথম মতটি।" 

 

মুহাম্মদ বিন সালিহ আল-উসাইমিন (রহ) বলেছেন : 

 

وقال بعض العلماء: (يخرج من بين الصلب) : أي صلب الرجل، (والترائب) أي: ترائب المرأة؛ ولكن هذا خلاف ظاهر اللفظ[5]

অর্থ : "কিছু উলামারা বলেছেন : (তা নির্গত হয় সুলব ও তারাইব এর মাঝখান হতে) অর্থাৎ পুরুষের সুলব ও নারীদের তারাইব হতে। কিন্ত এটা (আয়াতের) ব্যাহ্যিক সুস্পষ্ট লফযের বিরোধী।" 

 

এক্ষেত্রে দ্বিতীয় মতের পক্ষের মুফাসসিররা অর্থাৎ নারীদের তারাইব উদ্দেশ্য হয়ার পক্ষের মুফাসসিররা এমন কোনো সুস্পষ্ট দলিল আনেন নি যা এক্ষেত্রে আয়াতটির ব্যাহ্যিক রুপ ও অর্থ কে পরিত্যাগ করার প্রয়োজনীয়তার দিকে ইঙ্গিত দেয়। অর্থাৎ এক্ষেত্রে দ্বিতীয় মতের পক্ষের মুফাসসিরদের কর্তৃক আয়াতের ব্যাহ্যিকতা ত্যাগের যথার্থতা সাব্যস্তকারী কোনো উপযুক্ত যথেষ্ট যথার্থ দলিল নেই। সুতরাং উক্ত ব্যাহ্যিকতাত্যাগকরণ গ্রহণযোগ্য নয়।

 

কাজেই উক্ত উসুল অনুযায়ী সাব্যস্ত হলো যে  নারীদের তারাইব উদ্দেশ্য হয়ার মতটির তুলনায় পুরুষদের তারাইব উদ্দেশ্য হয়ার মতটি অধিক গ্রহণযোগ্য অধিক সঠিক ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত।

 

অত:পর, যেই ভিত্তিসমুহের উপর নির্ভর করে এক্ষেত্রে পুরুষদের তারাইব উদ্দেশ্য হয়ার মতটির বিপরীতে নারীদের তারাইব উদ্দেশ্য হয়ার মতটির যৌক্তিকতা মুফাসসিরদের নিকট প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে, নিম্নে সেই ভিত্তিগুলোর উসুলভিত্তিক খন্ডন করা হলো।

 

নারীদের তারাইব উদ্দেশ্য হয়ার মতটির পক্ষে অবস্থানকারী মুফাসসিরদের কর্তৃক উক্ত মতটির পক্ষে বর্ণিত ভিত্তিসমুহের মধ্যে মূল প্রধান ও বিবেচনাযোগ্য ভিত্তি হলো চারটি, উক্ত চারটি ভিত্তি নিম্নরুপ : …[6]

 

প্রথম ভিত্তি - আরবি ভাষা সাহিত্যে তারাইব শব্দটি নারীসম্পর্কিত হিসেবে প্রসিদ্ধ, তাছারা বিভিন্ন প্রাচীন আরবি কবিতার চরণে দেখা যায় যে তারাইব শব্দটি মহিলাদের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। 

 

দ্বিতীয় ভিত্তি - 'خُلِقَ مِنْ مَاءٍ دَافِقٍ' (তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে সজোরে নির্গত বীর্য হতে) আয়াতটিতে 'সজোরে নির্গত বীর্য' বলতে নারী পুরুষ উভয়ের বীর্য উদ্দেশ্য।

 

তৃতীয় ভিত্তি - এখানে 'مِنْ بَيْنِ الصُّلْبِ ' (মিন বাইনাস সুলবি) ব্যবহৃত হয়েছে مِنَ الصُّلْبِ (মিনাস সুলবি) অর্থে, আরবি ভাষাতে  بَيْنِ (বাইনা) শব্দটির এই ধরনের ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে। 

 

চতুর্থ ভিত্তি - এখানে يَخْرُجُ এর সর্বনামটি 'মানুষ' এর দিকে ফিরেছে। (পক্ষান্তরে পুরুষের তারাইব উদ্দেশ্য হয়ার মতের পক্ষের আলেমদের মতের ভিত্তি হচ্ছে যে এক্ষেত্রে يَخْرُجُ এর সর্বনামটি 'বীর্য' এর দিকে ফিরেছে)  

 

উক্ত চারটি ভিত্তির খন্ডন ও ক্রুটি নির্ণয়  : 

 

প্রথম ভিত্তিটি হচ্ছে সব ভিত্তির প্রধান। এটাই হচ্ছে নারীদের তারাইব উদ্দেশ্য হয়ার মতটির পক্ষে অবস্থানকারী আলেমদের উক্ত মতটির পক্ষে অবস্থান করার মূল কারণ [4]।

 

এই ভিত্তিটি ভুল, ইবনুল-কাইইম (রহ) এর খন্ডন করে বলেছেন যে তারাইব শব্দটি নারীদের জন্য প্রসিদ্ধ হয়ার মানে মোটেও এইনা যে ইহা নারীদের জন্য নির্দিষ্ট বা খাস কোনোকিছু, বরং প্রকৃতপক্ষে তা নারী পুরুষ উভয়ের জন্যই সার্বিকভাবে সাধারণভাবে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয় [4]। এবং আব্দুর-রহমান আস-সা'দী (রহ) এক্ষেত্রে ইবনুল-কাইইমের সম-অর্থের মন্তব্য করেছেন [7]। 

 

দ্বিতীয় ভিত্তিটি ভুল, কেননা সজোরে নির্গত হয় শুধুমাত্র পুরুষদের বীর্য, নারীদের কোনো বীর্য সজোরে নির্গত হয়না, নারীদের বীর্য সজোরে নির্গত হয়া অসম্ভব বাস্তবতাবিরোধী। যেহেতু সজোরে নির্গত বীর্যের গুণটি শুধুমাত্র পুরুষদের জন্য প্রযোজ্য, সুতরাং এখানে শুধুমাত্র পুরুষদেরই বীর্য উদ্দেশ্য, নারীদের বীর্য উদ্দেশ্য নয়।

 

এই ভিত্তিটির বিরোধিতা করে, 

 

 ইবনুল-কাইইম (রহ) বলেছেন : 

 

فَإِنَّ الَّذِي يُوصَفُ بِالدَّفْقِ وَالنَّضْحِ إنَّمَا هُوَ مَاءُ الرَّجُلِ، وَلَا يُقَالُ نَضَحَتْ الْمَرْأَةُ الْمَاءَ وَلَا دَفَقَتْهُ [4]

 

অর্থ : "অবশ্যই যেটাকে সজোরে নির্গত হয়া ও নিক্ষেপ করা দ্বারা গুণান্বিত করা হয় তা হলো পুরুষের বীর্য, এমনটা বলা হয়না যে একজন নারী বীর্য নিক্ষেপ বা সজোরে নির্গত করেছে। " 

 

মুহাম্মদ বিন সালিহ আল-উসাইমিন (রহ) বলেছেন : 

 

المرأة لا يمكن أن يكون ماؤها دافقاً أبداً، بل الدافق هو ماء الرجل [5]

 

অর্থ : "একজন মহিলার ক্ষেত্রে এটা কখনো সম্ভবই না যে তার বীর্য সজোরে নির্গত হবে, বরং যা সজোরে নির্গত হয় তা হলো পুরুষের বীর্য। " 

 

যদি প্রসঙ্গ আসে তৃতীয় ভিত্তিটির, সেক্ষেত্রে বলব যে যদিও এটা ভাষাগতভাবে বিশুদ্ধ, কিন্ত বাইনা এর এরুপ ব্যবহারের প্রচলন ও ব্যবহার কম, এটি এর পরিচিত প্রসিদ্ধ অর্থ না। পক্ষান্তরে পুরুষদের তারাইব উদ্দেশ্য হয়ার মতটি মেনে নিলে এর অধিক প্রসিদ্ধ অধিক প্রচলিত অধিক ব্যাবহৃত ও অধিক পরিচিত মূল অর্থটি বহাল থাকে। এই ধরনের পরিস্থিতিতে মুলনিতী হলো যেই মতটি অধিক পরিচিত অধিক প্রসিদ্ধ ও অধিক প্রচলিত অর্থের ভিত্তিতে দেয়া হয়েছে সেটিই অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত [8]।

 

যদি প্রসঙ্গ আসে চতুর্থ ভিত্তিটির, সেক্ষেত্রে বলব - এখানে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত অধিক সঠিক মতটি হচ্ছে যে يَخْرُجُ এর সর্বনামটি 'সজোরে নির্গত বীর্য' বা 'বীর্য' এর দিকে ফিরেছে, 'মানুষ' এর দিকে নয়। কেননা 'সজোরে নির্গত বীর্য'  উক্ত সর্বনামের সবচেয়ে নিকটবর্তি সাম্ভাব্য সর্বনামের প্রত্যাবর্তন গ্রহনকারী [9]।

 

উল্লেখ্য, নারীদের তারাইব উদ্দেশ্য হয়ার মতটির দ্বিতীয় ও চতুর্থ ভিত্তিদ্বয়ের উপর ভিত্তি করে নতুন আরেকটি অদ্ভুত ধরনের তৃতীয় মত দেয়া হয়েছে, তা হচ্ছে এই যে এখানে পুরুষ ও মহিলা উভয়েরই সুলব কিংবা তারাইব একইসাথে উদ্দেশ্য। যেহেতু নারীদের তারাইব উদ্দেশ্য হয়ার মতটির দ্বিতীয় ও চতুর্থ ভিত্তিদুটি দুর্বল (যেমনটা উপরে দেখানো হয়েছে), সেহেতু উক্ত তৃতীয় মতটির ভিত্তিও দুর্বল। 

 

মোদ্দাকথা,উসুল অনুযায়ী এক্ষেত্রে সঠিক ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত রাজিহ মত হলো এই যে এখানে তারাইব বলতে পুরুষদের তারাইব উদ্দেশ্য নারীদের তারাইব নয়।

 

ইবনু-কাইইমিল যাওযিয়াহ (রহ), মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমিন (রহ), আব্দুর-রহমান আস-সা'দী (রহ) ও মুহাম্মদ আত-তাহির বিন আশুর (রহ) এক্ষেত্রে নারীদের তারাইব উদ্দেশ্য হয়ার মত ও পুরুষদের তারাইব উদ্দেশ্য হয়ার মতটির মাঝে তুলনা করে পুরুষদের তারাইব উদ্দেশ্য হয়ার মতটিকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন।

 

ইবনুল-কাইইম (রহ) বলেছেন : _[4]

 

فَالدَّافِقُ عَلَى بَابِهِ، لَيْسَ فَاعِلًا بِمَعْنَى مَفْعُولٍ كَمَا يَظُنُّهُ بَعْضُهُمْ، بَلْ هُوَ بِمَنْزِلَةِ مَاءٍ جَارٍ وَوَاقِفٍ وَسَاكِنٍ. وَلَا خِلَافَ أَنَّ الْمُرَادَ بِالصُّلْبِ صُلْبُ الرَّجُلِ، وَاخْتُلِفَ فِي التَّرَائِبِ فَقِيلَ: الْمُرَادُ بِهَا تَرَائِبُهُ أَيْضًا، وَهِيَ عِظَامُ الصَّدْرِ مَا بَيْنَ التَّرْقُوَةِ إلَى الثَّنْدُوَةِ، وَقِيلَ: الْمُرَادُ تَرَائِبُ الْمَرْأَةِ، وَالْأَوَّلُ أَظْهَرُ؛ لِأَنَّهُ سُبْحَانَهُ قَالَ: {يَخْرُجُ مِنْ بَيْنِ الصُّلْبِ وَالتَّرَائِبِ} [الطارق: ٧] وَلَمْ يَقُلْ يَخْرُجُ مِنْ الصُّلْبِ وَالتَّرَائِبِ فَلَا بُدَّ أَنْ يَكُونَ مَاءُ الرَّجُلِ خَارِجًا مِنْ بَيْنَ هَذَيْنِ الْمُخْتَلِفَيْنِ كَمَا قَالَ فِي اللَّبَنِ: {مِنْ بَيْنِ فَرْثٍ وَدَمٍ} [النحل: ٦٦] وَأَيْضًا فَإِنَّهُ سُبْحَانَهُ أَخْبَرَ أَنَّهُ خَلَقَهُ مِنْ نُطْفَةٍ فِي غَيْرِ مَوْضِعٍ، وَالنُّطْفَةُ هِيَ مَاءُ الرَّجُلِ، كَذَلِكَ قَالَ أَهْلُ اللُّغَةِ، قَالَ الْجَوْهَرِيُّ: وَالنُّطْفَةُ الْمَاءُ الصَّافِي قَلَّ أَوْ كَثُرَ، وَالنُّطْفَةُ مَاءُ الرَّجُلِ، وَالْجَمْعُ نُطَفٌ؛ وَأَيْضًا فَإِنَّ الَّذِي يُوصَفُ بِالدَّفْقِ وَالنَّضْحِ إنَّمَا هُوَ مَاءُ الرَّجُلِ، وَلَا يُقَالُ نَضَحَتْ الْمَرْأَةُ الْمَاءَ وَلَا دَفَقَتْهُ، وَاَلَّذِي أَوْجَبَ لِأَصْحَابِ الْقَوْلِ الْآخَرِ ذَلِكَ أَنَّهُمْ رَأَوْا أَهْلَ اللُّغَةِ قَالُوا: التَّرَائِبُ مَوْضِعُ الْقِلَادَةِ مِنْ الصَّدْرِ، قَالَ الزَّجَّاجُ: أَهْلُ اللُّغَةِ مُجْمِعُونَ عَلَى ذَلِكَ وَأَنْشَدُوا لِامْرِئِ الْقَيْسِ:مُهَفْهَفَةٌ بَيْضَاءُ غَيْرُ مُفَاضَةٍ ... تَرَائِبُهَا مَصْقُولَةٌ كَالسَّجَنْجَلِ.وَهَذَا لَا يَدُلُّ عَلَى اخْتِصَاصِ التَّرَائِبِ بِالْمَرْأَةِ، بَلْ يُطْلَقُ عَلَى الرَّجُلِ وَالْمَرْأَةِ

 

এবং আদ-দাফিক তার বাব অনুযায়ী, এটা মাফউলের অর্থে ফাইল না যেমনটা তাঁদের অনেকে দাবি করে থাকেন, বরং ইহা চলমান ও স্থীর বা শান্ত পানির অর্থে প্রযোজ্য হয়। এবং এতে কোনো মতভেদ নেই যে সুলব দ্বারা পুরুষদের সুলব উদ্দেশ্য। এবং তারাইবের বেলায় মতভেদ ঘটেছে, কাজেই বলা হয়েছে যে এরদ্বারা পুরষেরই তারাইব উদ্দেশ্য, এবং ইহা হচ্ছে ছুনদুওয়াহ ও তারক্বুওয়াহ এর মধ্যকার বুকের হাড়, এবং আরো বলা হয়েছে যে এরদ্বারা নারীদের তারাইব উদ্দেশ্য, তবে প্রথমটিই অধিক সুস্পষ্ট, কেননা তিনি সুবহানাহু তা'আলা বলেছেন 'তা নির্গত হয় সুলব ও তারাইবের মাঝখান থেকে', তিনি এটা বলেন নি যে 'তা নির্গত হয় সুলব ও তারাইব হতে, কাজেই অবশ্যই পুরুষের বীর্যের এই দুটি ভিন্ন ভিন্ন স্থানের মাঝখান হতে নির্গত হয়া ব্যাতিত আর কোনো অবকাশ নেই, যেমনটা তিনি দুধের বেলায় বলেছেন 'মিন বাইনি ফারছিন ওয়াদামিন '।…… এছাড়াও যেটাকে নিক্ষিপ্ত হয়া ও সজোরে নির্গত হয়া দ্বারা গুণান্বিত করা হয় তা হচ্ছে পুরুষের বীর্য, এমনটা বলা হয়না যে একজন মহিলা বির্য নিক্ষেপ বা সজোরে নির্গত করেছে,  যেই ব্যাপারটা অপর মতের ব্যাক্তিদের জন্য সেই মতকে অপরিহার্য সাব্যস্ত করে তা হলো এই যে, উনারা ভাষাবিদদের দেখেছেন যে তাঁরা বলেছেন : তারাইব হলো বুকের মালা পড়ার স্থান, আয-যাজ্জায বলেছেন : ভাষাবিদরা এতে একমত হয়েছেন এবং তারা ইবমরুল কায়েসের চরণ নিয়ে এসেছেন :( মুহাফহাফাহ বাইদ্বায়ু গাইরু মুফাযাতিন… তারাইবুহা মাছকুলাতুন কাস-সাজানজালি), কিন্ত এটা তারাইবের নারিদের জন্য নির্দিষ্ট বা খাস হয়ার দিকে ইংগিত দিচ্ছেনা। বরং তা সার্বিকভাবে নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য প্রযোজ্য হয়। " 

 

মুহাম্মদ বিন সালিহ আল-উসাইমিন (রহ) বলেছেন : _[5]

 

من بين صلب الرجل، وترائبه أعلى صدره، وهذا يدل على عمق مخرج هذا الماء، وأنه يخرج من مكان مكين في الجسد، والصواب أن هذا الوصف لماء الرجل.وقال بعض العلماء: (يخرج من بين الصلب) : أي صلب الرجل، (والترائب) أي: ترائب المرأة؛ ولكن هذا خلاف ظاهر اللفظ.والصواب أن الذي يخرج من بين الصلب والترائب هو ماء الرجل؛ لأن الله تعالى وصفه بذلك....المرأة لا يمكن أن يكون ماؤها دافقاً أبداً، بل الدافق هو ماء الرجل

 

পুরুষের সুলব ও তারাইবের তথা বুকের উপরিভাগের মাঝখান থেকে, এবং ইহা উক্ত বীর্যের নির্গত হয়ার পথের গভীরতার দিকে ইংগিত দেয়। এবং ইঙ্গিত দেয় যে তা এমন একটি স্থান হতে নির্গত হয় যা দেহের মধ্যে সুপ্রতিষ্ঠিত আছে, এবং সঠিক কথা হলো এই যে উক্ত গুণটি পুরুষের বীর্যের জন্য প্রযোজ্য। পক্ষান্তরে উলামাদের কেও কেও বলেছেন (তা নির্গত হয় সুলব ও তারাইবের মাঝখান থেকে) অর্থাৎ পুরুষের সুলব ও নারীদের তারাইব, কিন্ত এটা ব্যাহ্যিক সুস্পষ্ট লফযের বিরোধী। বরং সঠিক হচ্ছে এই যে যা সুলব ও তারাইবের মাঝখান হতে নির্গত হয় তা হলো পুরুষের বীর্য। কেননা আল্লাহ তা'য়ালা তাকেই সেটার দ্বারা গুণান্বিত করেছেন। … একজন মহিলার ক্ষেত্রে এটা কখনো সম্ভবই না যে তার বীর্য সজোরে নির্গত হবে, বরং যা সজোরে নির্গত হয় তা হলো পুরুষের বীর্য।

 

 

আব্দুর-রহমান বিন নাসির আস-সা'দী (রহ) বলেছেন : _[6]

 

{فَلْيَنْظُرِ الإنْسَانُ مِمَّ خُلِقَ} أي: فليتدبر خلقته ومبدأه، فإنه مخلوق {مِنْ مَاءٍ دَافِقٍ} وهو: المني الذي {يَخْرُجُ مِنْ بَيْنِ الصُّلْبِ وَالتَّرَائِبِ} يحتمل أنه من بين صلب الرجل وترائب المرأة، وهي ثدياها.

ويحتمل أن المراد المني الدافق، وهو مني الرجل، وأن محله الذي يخرج منه ما بين صلبه وترائبه، ولعل هذا أولى، فإنه إنما وصف الله به الماء الدافق، والذي يحس [به] ويشاهد دفقه، هو مني الرجل، وكذلك لفظ الترائب فإنها تستعمل في الرجل، فإن الترائب للرجل، بمنزلة الثديين للأنثى، فلو أريدت الأنثى لقال: " من بين الصلب والثديين " ونحو ذلك، والله أعلم

 

{মানুষ যেন দেখে তাকে কি হতে সৃষ্টি করা হয়েছে} অর্থাৎ : সে যেন চিন্তা করে তার সৃষ্টি উপাদান ও তার উৎপত্তি সম্পর্কে, নিশ্চই সে সৃষ্ট {সজোড়ে নির্গত তরল হতে} এবং এই তরল হচ্ছে বীর্য  যা {নির্গত হয় সুলব ও তারাইব এর মাঝখান থেকে} এটা সম্ভব যে তা পুরুষের সুলব ও নারীদের তারাইবের তথা বুকের মাঝখান হতে নির্গত হয়, এবং এটাও সম্ভব যে সজোরে নির্গত বীর্য দ্বারা পুরুষের বীর্য উদ্দেশ্য, এবং তা (পুরুষের বির্য) যেই স্থানটি হতে নির্গত হয় তার সেই স্থানটি সুলব ও তার তারাইবের মাঝে আছে, এবং সম্ভবত এটাই অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত, কেননা আল্লাহ তায়ালা পুরুষকে সজোরে নির্গত বীর্যের গুণটি দিয়েছেন। যার সজোরে নির্গত হয়া পর্যবেক্ষণ ও অনুভব করা যায় তা হলো পুরুষের বীর্য, একইভাবে তারাইব শব্দটি অবশ্যই পুরুষদের বেলায় ব্যবহৃত হয়। সুতরাং এক্ষেত্রে অবশ্যই তারাইব পুরুষেরই। যদি এখানে (তারাইব দ্বারা) আসলেই মহিলাদের বুক উদ্দেশ্য হতো তাহলে অবশ্যই বলা হতো 'মিন বাইনিস সুলবি ওয়াছ ছাদিইয়াইনি' বা এইধরনের কোনোকিছু, আল্লাহু আ'লাম। 

 

এখন যদি বলা হয় : "জুমহুর (বেশিরভাগ/অধিকাংশ) আলেমদের মতে তারাইব দ্বারা নারীদের তারাইবই উদ্দেশ্য, এরমানে কি বাকি সবাই ভুল, আর এই সামান্য কিছু আলেমরাই সঠিক?  এক্ষেত্রে অধিকাংশ মুফাসসির যেব্যাপারে একমত হয়েছেন সেটাই কি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বা অধিক সঠিক হয়ার কথা না?" 

 

সেক্ষেত্রে জবাবস্বরুপ বলব : 

 

দলিল প্রমাণই হলো মুখ্য বিষয়, সংখ্যাধিক্যতা নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অধিকাংশের মতের পক্ষের দলিলগুলো অধিক শক্তিশালি থাকে বিধায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে অধিকাংশের মতকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। এক্ষেত্রে উসুল-ভিত্তিক আলোচনার দ্বারা আমি প্রমাণ করে দেখিয়েছি যে জুমহুরদের উক্ত মতটি ভুল, অর্থাৎ এক্ষেত্রে জুমহুরদের (অধিকাংশের) মতের পক্ষের দলিলগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রের মতো অধিক শক্তিশালী হিসেবে গণ্য হয়ার অযোগ্য। সুতরাং এখানে তুলনামুলক দুর্বল মতটির পক্ষের উলামাদের সংখ্যাধিক্যতা বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলবেনা।

 

এইধরনের আপত্তির একদম বিস্তারিত সুবিন্যাস্ত দাতভাঙ্গা শক্তিশালী কড়া জবাব ইবনুল-কাইইম (রহ) তাঁর 'আল-ফুরুসিয়াতুল মুহাম্মাদিয়াহ' গ্রন্থে দিয়েছেন [10]। এব্যাপারে আরো বিস্তারিতভাবে জবাব জানতে চাইলে ইবনুল-কাইইমের উক্ত আলোচনাটি দেখে নেয়া যেতে পারে।

 

তাছারা জুমহুর (অধিকাংশ) আলেমরা এব্যাপারে একমত হয়েছেন যে জুমহুর আলেমদের মত এমন কোনো অকাট্য বিষয় নয় যা ভুল হতে পারেনা, বরং সেটা ভুলও হতে পারে [11]। 

 

যদি বলা হয় যে আত-তাবারী তাঁর তাফসিরে আলি বিন আবি-তালহাহর সুত্র ধরে ইবনু আব্বাস (রা) হতে হাসান সনদে একটি আছার বর্ণনা করেছেন যেখানে ইবনু আব্বাস (রা) তারাইব দ্বারা নারীদের তারাইব উদ্দেশ্য বলেছেন। 

 

তাহলে জবাবস্বরুপ বলব : 

 

মুহাম্মদ বিন জারির আত-তাবারী (রহ) 'আলি বিন আবি-তালহাহ' এর সুত্র ধরে ইবনু আব্বাস (রা) হতে যেই বর্ণনাটি বর্ণনা করেছেন, সেখানে যা বলা হয়েছে, তার মর্ম দাঁড়ায় অনেকটা এরকম যে সুলব দ্বারা উদ্দেশ্য নারীদের একটা স্তন, তারাইব দ্বারা উদ্দেশ্য নারীদের আরেকটা স্তন, অর্থাৎ সুলব ও তারাইবের মাঝখান হতে মানে হচ্ছে 'নারীদের দুই স্তনের মাঝখান হতে '[12]।

 

আত-তাবারীর বর্ণিত উক্ত বর্ণনাটির সনদে এমন দুজন রাবি আছেন, যাদের মুনকার হাদিস বর্ণনা করার অভ্যাস ছিলো।

 

প্রথমজন হলেন আলি ইবনু আবি তালহাহ, তাঁর ব্যাপারে ইমাম আহমদ ইবনু হানবল (রহ) বলেছেন : 

علي بن أَبي طلحة، له أَشياء مُنكرات،_[15]

অর্থ : "আলি বিন আবি তালহাহ, তার বহু মুনকার বিষয়বস্তু আছে " 

 

দ্বিতীয়জন হলেন 'আবু সালিহ আব্দুল্লাহ ইবনু সালিহ ', তাঁর ব্যাপারে আবু-হাতিম ইবনু হিব্বান আল-বুস্তী (রহ) বলেছেন: 

 

مُنكر الحَدِيث جدا يروي عَن الْأَثْبَات مَالا يشبه حَدِيث الثِّقَات وَعِنْده الْمَنَاكِير الْكَثِيرَة عَن أَقوام مشاهير أَئِمَّة_[16] 

'প্রচন্ডভাবে মুনকারুল হাদিস, তিনি ছাবাতদের (নির্ভরযোগ্যদের) থেকে এমন হাদিস বর্ণনা করেন যা ছিকাহদের হাদিসের সাথে মিলেনা, এবং বিখ্যাত ইমামদের বহু দল হতে বর্ণিত তার প্রচুর পরিমাণের মুনকার বর্ণনা রয়েছে ' 

 

তাছারা আত-তাবারীর বর্ণনাটিতে এমন একজন রাবি আছেন যিনি কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনির্ভরযোগ্য ইফরাদযুক্ত হাদিস বর্ণনা করতেন। তিনি হলেন 'মুয়াবিয়াহ ইবনু সালিহ', তাঁর ব্যাপারে ইবনু আদী আজ-জুরজানী (রহ) বলেছেন : 

 

ما أرى بحديثه بأسا وهو عندي صدوق الا أنه يقع في أحاديثه إفرادات_[17]

 

'তার বহু হাদিসে বহু ইফরাদ সংঘটিত হয়ার ব্যাপারটি বাদ দিয়ে বিবেচনা করলে সে আমার নিকট সত্যবাদী ও আমি তার হাদিসে কোনো সমস্যা দেখিনা' 

 

সুতরাং - এমন অবস্থায় যদি এই বর্ণনাটির বিরোধী কোনো সহিহ বা হাসান বর্ণনা থাকে, তাহলে এই বর্ণনাটি মুনকার হবে।

 

আবু-আব্দুল্লাহ আল-হাকিম (রহ) সহিহ সনদে 'সাঈদ বিন জুবাইর'(রহ) এর সুত্র ধরে ইবনু আব্বাস (রা) হতে  আলোচ্য আয়াতটির তাফসির বর্ণনা করেছেন [13]।একইভাবে, দ্বিয়াউদ্দিন আল-মাকদিসী (রহ) সহিহ সনদে 'ইকরামাহ'(রহ) এর সুত্র ধরে ইবনু আব্বাস (রা) হতে  আলোচ্য আয়াতটির তাফসির বর্ণনা করেছেন [14]।

 

এবং সাঈদ ও ইকরামাহর বর্ণনাদুটি এক্ষেত্রে আলির বর্ণনাটির বিরোধী।

 

সুতরাং উক্ত বর্ণনাটি মুনকার, আর মুনকার বর্ণনা দলিলযোগ্য নয়। 

 

যদি বলা হয় যে আত-তাবারীর বর্ণিত বর্ণনাটি মুনকার হলে কি হয়েছে? এটা বাদ দিলেও তো নারীদের তারাইব উদ্দেশ্য হয়ার পক্ষে ইবনু আব্বাস (রা) হতে অন্যান্য বর্ণনা আছে! অমুক অমুক মুফাসসিররা তাঁদের তাফসিরে বলেছেন যে ইবনু আব্বাস (রা) এমনটাই বলেছেন!  

 

এর জবাবস্বরুপ বলব : আত-তাবারীর বর্ণিত এই বর্ণনাটি বাদে এমর্মে ইবনু আব্বাস (রা) হতে অন্য যা কিছু বর্ণিত হয়েছে, তার সবই যইফ কিংবা সনদবিহীন।বিভিন্ন আলেমরা তাদের বিভিন্ন গ্রন্থে নারীদের তারাইব হয়ার পক্ষে ইবনু আব্বাস (রা) এর বক্তব্য হিসেবে যেসব জিনিস উল্লেখ্য করেছেন সেগুলোর সবই বিভিন্ন যইফ সনদের বর্ণনা হতে নেয়া হয়েছে।

 

এবার, বিভিন্ন যুগ অনুযায়ী নারীদের তারাইব উদ্দেশ্য হয়ার মত বনাম পুরুষদের তারাইব উদ্দেশ্য হয়ার মতের সংক্ষিপ্ত অবস্থা উল্লেখ্য করা হলো।

 

 ১.  সালাফদের যুগ : 

 

সালাফদের যুগকে দুটি উপশ্রেণীতে ভাগ করা যায়।

 

(ক) সাহাবি, তাবেঈ ও বড় বড় তাবে তাবেঈদের যুগ : 

 

এই যুগের প্রচুর পরিমাণের মুফাসসিরদের সহিত নারীদের তারাইব উদ্দেশ্য হয়ার মতটিকে সম্পর্কিত করে বলা হয় যে তাঁরা নাকি নারীদের তারাইব উদ্দেশ্য হয়ার মতটির পক্ষে বলেছেন। এসব সম্পৃক্তকরণের ভুল ভিত্তি হলো বহু যইফ বা সনদবিহীন বর্ণনা।  

 

এই যুগের মধ্যের শুধুমাত্র সুফিয়ান আছ-ছাওরি, আল-আ'মাশ ও ইকরামাহ হতে এমনটা নির্ভরযোগ্য সনদে প্রমাণিত আছে যে তাঁরা তারাইব দ্বারা নারীদের তারাইব উদ্দেশ্য বলেছেন। এছাড়া নারীদের তারাইব উদ্দেশ্য হয়ার মতটির পক্ষে বাকি যেসমস্ত বর্ণনা এযুগের বিভিন্ন আলেমদের দিকে সম্পর্কিত করা হয়, তার সবই যইফ, খুবই যইফ ও সনদবিহীন। 

 

তবে ইকরামাহর বেলায় একটা কথা আছে, ইকরামাহ হতে বিশুদ্ধ নির্ভরযোগ্য সনদে প্রমাণিত আছে যে তিনি তারাইব দ্বারা নারীদের তারাইব উদ্দেশ্য বলেছেন।

 

কিন্ত মুহাম্মদ ইবনু জারির আত-তাবারী (রহ) বর্ণনা করেছেন : 

 

حَدَّثَنِي يَعْقُوبُ، قَالَ: ثنا ابْنُ عُلَيَّةَ، عَنْ أَبِي رَجَاءٍ، قَالَ: سُئِلَ عِكْرِمَةُ عَنِ التَّرَائِبِ، فَقَالَ: «هَذِهِ، وَوَضَعَ يَدَهُ عَلَى صَدْرِهِ بَيْنَ ثَدْيَيْهِ»_[18] 

 

অর্থ : "আমাকে ইয়াকুব বর্ণনা করে বলেছেন যে আমাদের ইবনু উলাইয়াহ বর্ণনা করেছেন আবু-রাজা হতে যে তিনি (আবু-রাজা) বলেছেন : ইকরামাহকে তারাইবের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হয়, উত্তরে তিনি বলেন : এইতো এটা, এবং নিজের হাত নিজের বুকে দুই স্তনের মাঝে রাখলেন। " 

 

এই বর্ণনাটির সনদ প্রসঙ্গে মুহাক্কিক সালাহ বিন সালিম ও মুহাক্কিক আহমদ আল-বারিরী বলেছেন যে সনদটি "সহিহ"[19]। 

 

স্পষ্টতই এই সহিহ সনদের বর্ণনাটি অনুযায়ী ইকরামাহর মতে তারাইব দ্বারা নারীদের তারাইব নয় বরং পুরুষদের তারাইব উদ্দেশ্য, কেননা ইকরামাহ নিজের বুকে হাত দিয়ে ইশারা করে তারাইবের অবস্থান দেখিয়েছেন এবং তিনি নিজে একজন পুরুষ।

 

যেহেতু ইকরামাহ হতে এব্যাপারে স্ববিরোধী দুটি ভিন্ন ধরনের বর্ণনা পাওয়া যায়, সেহেতু এক্ষেত্রে ইকরামাহকে বিবেচনার বাহিরে রাখতে হবে।

 

 "ক" শ্রেণীর যুগের মধ্য হতে সুফিয়ান আছ-ছাওরি (রহ) ও আল-আ'মাশ (রহ) কে নারীদের তারাইব উদ্দেশ্য হয়ার মতটির পক্ষে পাওয়া গেলো।অপরদিকে এই 'ক' যুগের মধ্যের বিখ্যাত তাবেঈ মুফাসসির কাতাদাহ বিন দা'আমাহ (রহ) এমন একজন মুফাসসির, যিনি পুরুষদের তারাইব উদ্দেশ্য হয়ার মতটির পক্ষে বলেছেন।

 

মুহাম্মদ ইবনু জারির আত-তাবারী বর্ণনা করেছেন : 

 

حدثنا بشر قال ثنا يزيد قال ثنا سعيد عن قتادة قوله يخرج من بين الصلب والترائب يقول يخرج من بين صلب الرجل و نحره_[20] 

 

অর্থ : "আমাদের বিশর বর্ণনা করে বলেছেন যে আমাদের ইয়াযিদ বর্ণনা করে বলেছেন যে আমাদের সাঈদ কাতাদাহ হতে বর্ণনা করেছেন আল্লাহর বক্তব্য (তা নির্গত হয় সুলব ও তারাইবের মাঝখান হতে) অর্থাৎ আল্লাহ বলছেন যে তা নির্গত হয় পুরুষে সুলব ও পুরুষের বুকের উপরিভাগ (তারাইব) হতে। " 

 

এই বর্ণনাটির সনদ 'সহিহ' [21]।

 

সুতরাং, ক যুগে তারাইব দ্বারা নারীদের তারাইব উদ্দেশ্য নাকি পুরুষদের তারাইব উদ্দেশ্য সেব্যাপারে সুফিয়ান, আল-আ'মাশ ও কাতাদাহর মাঝে ইখতিলাফ ছিলো।

 

 

(খ) মধ্যম স্তরের তাবে তাবেঈদের যুগ থেকে শুরু করে ৩০০ হিজরি সন পর্যন্ত 

 

এই যুগের একজন বিখ্যাত মুফাসসির মুহাম্মদ ইবনু জারির আত-তাবারী উল্লেখ্য করেছেন যে আলেমদের একাংশের মতে এখানে তারাইব দ্বারা নারীদের তারাইব উদ্দেশ্য এবং আরেক অংশের মতে এরদ্বারা পুরুষদের তারাইব উদ্দেশ্য [22]।

 

অর্থাৎ আত-তাবারির যুগে এই ব্যাপারটা মতভেদপুর্ন ছিলো।

 

আত-তাবারীর নিকট জুমহুরের মতই হচ্ছে ইজমা , যদি আত-তাবারীর সময় অধিকাংশ আলেমই নারীদের তারাইব উদ্দেশ্য হয়ার মতটির পক্ষে থাকতেন ও খুবই সামান্য কিছু আলেম পুরুষদের তারাইব উদ্দেশ্য হয়ার মতটির পক্ষে থাকতেন, তাহলে অবশ্যই আত-তাবারী নারীদের তারাইব উদ্দেশ্য হয়ার মতটির পক্ষে ইজমা ঘোষণা করতেন। কিন্ত এক্ষেত্রে আত-তাবারী এমনটা করেন নি, বরং তিনি ভিন্ন মুলনিতীর দ্বারা নারীদের তারাইব উদ্দেশ্য হয়ার মতটিকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। যার অর্থ আত-তাবারীর যুগে নারীদের তারাইব উদ্দেশ্য হয়ার মতটি অধিকাংশের মত ছিলোনা, এবং এই যুগের যথেষ্ট সংখ্যাক আলেম পুরুষদের তারাইব উদ্দেশ্য হয়ার মতটির পক্ষে ছিলেন।

 

এই যুগের আরেকজন প্রসিদ্ধ মুফাসসির আবু-মানসুর আল-মাতুরিদী (রহ) আত-তাবারীর (রহ) মত করে উল্লেখ্য করেছেন যে একদল আলেমদের মতে তারাইব দ্বারা নারীদের তারাইব উদ্দেশ্য ও আরেকদল আলেমদের মতে তারাইব দ্বারা পুরুষদের তারাইব উদ্দেশ্য।। [23]

 

আর আল-মাতুরিদী কর্তৃক উক্ত মতভেদের বিষয়টি উল্লেখ্য করার ধরন হতে এটা সুস্পষ্ট হয় যে উনার যুগে ব্যাপারটা এমন ছিলোনা যে মাত্র সামান্য কিছু আলেম পুরুষদের তারাইব উদ্দেশ্য হয়ার পক্ষে ছিলেন ও বাকি সবাই নারীদের তারাইব উদ্দেশ্য হয়ার পক্ষে ছিলেন। বরং উনার উল্লেখ্য করার ধরন হতে বোঝা যায় যে পুরুষদের তারাইব উদ্দেশ্য হয়ার মতটির পক্ষেও যথেষ্ট পরিমাণ আলেম ছিলেন।

 

 

 ২. খালাফদের যুগ :

 

খালাফদের যুগের মুফাসসিরদের প্রায় সবাই নারীদের তারাইব উদ্দেশ্য হয়ার মতটির পক্ষে বলেছেন। 

 

কিন্ত এযুগের একজন অন্যতম মুফাসসির ফাখরুদ্দিন আর-রাযী (রহ) একদম সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন যে তারাইব দ্বারা নারীদের তারাইব উদ্দেশ্য নাকি পুরুষদের তারাইব উদ্দেশ্য, এনিয়ে উনার যুগেও তর্ক বিতর্ক চলমান ছিলো [24]।

 

সুতরাং এদুটি বিষয়ের উপর ভিত্তি করে বলা যায় যে খালাফদের যুগের অধিকাংশ মুফাসসিরদের মতে তারাইব দ্বারা নারীদের তারাইব উদ্দেশ্য হলেও একটা অতি-ক্ষুদ্র দল তখনো পুরুষদের তারাইব উদ্দেশ্য হয়ার মতটির উপর অটল ছিলেন। 

 

আর সেই অতি-ক্ষুদ্র দলটির অন্তর্ভুক্ত একজন হলেন ইবনুল-কাইইম (রহ) [4]।

 

 ৩. সাম্প্রতিক যুগ (১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বর্তমান পর্যন্ত) : 

 

এযুগের অধিকাংশ আলেমদের মতে তারাইব দ্বারা নারীদের তারাইব উদ্দেশ্য, তবে এই যুগের কিছু বড় বড় উচুস্তরের প্রসিদ্ধ মুফাসসিররা পুরুষদের তারাইব উদ্দেশ্য হয়ার মতটির পক্ষে ও নারীদের তারাইব উদ্দেশ্য হয়ার মতটির বিপক্ষে বলেছেন, যেমন : মুহাম্মদ বিন সালিহ আল-উসাইমিন (রহ),  আব্দুর-রহমান বিন নাসির আস-সা'দী (রহ), ও মুহাম্মদ আত-তাহির ইবনু আশুর (রহ) [5][7][25] 

 

দেখা যাচ্ছে যে একদম সালাফদের যুগ থেকে শুরু করে বর্তমানকাল পর্যন্ত আলেমদের একটা দল পুরুষদের তারাইব উদ্দেশ্য হয়ার মতটির উপর অটল থেকেছেন ও আছেন। আর পুর্বেই আলোচনা করা হয়েছে যে এক্ষেত্রে এদলটিই সঠিক।

 

এবার আসা যাক তারাইবের অর্থ কি সেব্যাপারে, তারাইবের অর্থ নিয়ে ছয় ধরনের মতামত রয়েছে [1]। তবে এসব মতভেদের প্যাচে আমাদের যাওয়ার দরকার নেই, কেননা তারাইবের অর্থ কি তা ইবনু আব্বাস (রা) সুস্পষ্ট করে দিয়েছেন আর এটাই যথেষ্ট।

 

ইবনু আব্বাস (রা) তারাইবের ব্যাখ্যায় বলেছেন : 

 

"مَوْضِعُ الْقِلَادَةِ ،أَرْبَعَةُ أَضْلَاعٍ مِنْ كُلِّ جَانِبٍ مِنْ أَسْفَلِ الْأَضْلَاعِ" [13][14]

 

অর্থ : "কিলাদাহর (মালার) স্থান, (অর্থাৎ-) পাঁজরের নিচের দিকের প্রত্যেক পাশের চারটি হাড়" 

 

আর 'সুলব' শব্দটির দুইটা প্রচলিত অর্থ আছে, একটা হলো পিঠ, আরেকটা হলো 'মেরুদন্ড' [26]। 

 

সুতরাং সুলব ও তারাইবের মাঝখানের অর্থ দাড়ালো 'পাঁজরের নিচের দিকের প্রত্যেক পাশের চারটি (পাঁজরের) হাড় ও পিঠের/মেরুদন্ডের মাঝে'।

 

বোঝার ও সংক্ষিপ্ততার সুবিধার্থে ধরে নেই পাঁজরের নিচের দিকের প্রত্যেক পাশের চারটি (পাঁজরের) হাড় ও পিঠের/মেরুদন্ডের মাঝে যেই অঞ্চলটি রয়েছে সেটা হলো অঞ্চল x বা x অঞ্চল।

 

যদি 'সুলব = পিঠ' হয় তাহলে x অঞ্চলটিতে 'মেরুদন্ড' অন্তর্ভুক্ত হবে। আর যদি x অঞ্চলটিতে মেরুদন্ড অন্তর্ভুক্ত হয় তাহলে এটা বলা সঠিক হবে যে পাঁজরের নিচের দিকের প্রত্যেক পাশের চারটি (পাঁজরের) হাড় ও পিঠের মাঝে তথা সুলব ও তারাইবের মাঝে মেরুদন্ড রয়েছে।যেহেতু সুলব ও তারাইবের মাঝখান হতে অর্থাৎ x অঞ্চল হতে বীর্য নির্গত হয় ও x অঞ্চলে শুধুমাত্র মেরুদন্ডই একমাত্র অঙ্গ যা বীর্য নির্গত হয়ার ক্ষেত্রে সরাসরি অবদান রাখে, সেহেতু অবশ্যই আয়াতে সুলব ও তারাইবের মাঝখান থেকে বলতে সুলব ও তারাইবের মাঝে অবস্থিত মেরুদন্ডই উদ্দেশ্য।

 

আরেকটা বিষয়, আয়াত يخرج من بين الصلب و الترائب (তা নির্গত হয় সুলব ও তারাইবের মাঝখান থেকে)। এখানে ব্যবহৃত من (থেকে) শব্দটি প্রায়সময়ই 'কারণে, মাধ্যমে, সাহায্যে' এই ধরনের অর্থে ব্যবহার হয়, কোরানেও বহু স্থানে من শব্দটি 'কারণে, মাধ্যমে, সাহায্যে' অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে [27]। من শব্দটির এরুপ ব্যবহার মোটেও দুর্লভ কোনো বিষয় নয়, বরং আরবিতে من শব্দটির এরুপ ব্যবহার খুবই প্রচলিত ও পরিচিত। সুতরাং আলোচ্য আয়াতের من শব্দটির অর্থ 'থেকে' এর বদলে  'কারণে বা মাধ্যমে বা সাহায্যে' ধরাটা গ্রহণযোগ্য ও সঠিক হবে।এহিসেবে উক্ত আয়াতটির অর্থ "তা নির্গত হয় সুলব ও তারাইবের মাঝখান থেকে" বদলে বলা যায় "তা নির্গত হয় সুলব ও তারাইবের মাঝখানের (কোনোকিছুর) কারণে বা সাহায্যে বা মাধ্যমে "।

 

সবমিলিয়ে আলোচ্য আয়াতটির অর্থ দাঁড়ায় অনেকটা এরকম - 

 

"তা (পুরুষের বীর্য) নির্গত হয় সুলব ও তারাইবের মাঝখানে অবস্থিত মেরুদন্ডের সাহায্যে বা মাধ্যমে বা কারণে " 

 

 

 

[1]আল-মাওরিদী, আন-নুকত ওয়াল উয়ুন (6/246-247) 

 

[2]ইযযুদ্দিন,তাফসিরুল কোর'আন (3/439) 

 

[3]আল-হারবী, কাওয়াইদুত তারজিহ ইনদাল মুফাসসিরিন (পৃ/ 137-171)

 

[4]ইবনুল-কাইইম, ই'লামুল মাওক্বিঈন (1/112-113)

 

[5]লুকাউল বাবিল মাফতুহ -শামেলাহ (45/6) & (179/13)  

 

[6]তাফসিরু ইবনে আদিল (20/265), তাফসিরু মাক্কী (12/8195),তাফসিরুল কুরতুবী (20/7),তাফসিরু ইবনে কাসির (8/375),তাফসিরুল বাকাঈ (21/378), তাফসিরুত তাবারী (24/292, 296) 

 

[7]তাফসিরুস সা'দী (পৃ/919)

 

[8]আল-হারবী, কাওয়াইদুত তারজিহ ইনদাল মুফাসসিরিন (পৃ/369) 

 

[9]আত-তাইয়ার, ফুসুল ফি উসুলিত তাফসির (পৃ/118)

 

[10]ইবনুল কাইইম,আল-ফুরুসিয়াতুল মুহাম্মাদিয়াহ (1/237-242)

 

[11]আশ-শাওকানী, ইরশাদুল ফুহুল (1/234)

 

[12]তাফসিরুত তাবারী (24/293) 

 

[13]মুস্তাদরাকুল হাকিম (2/565) 

 

[14]আল-মাকদিসী, আল-মুখতারাহ (12/110)

 

[15]সাওয়ালাতুল মাইমুনী (374),আদ্ব-দুয়াফাউল কাবির লিলউকাইলী (3/234),

দ্বিওয়ানুয যুয়াফা লিযযাহাবী (রাবি/2938),তাহযিবুল কামাল লিলমিযযী (20/491)

 

[16]ইবনু হিব্বান, কিতাবুল মাজরুহিন (2/40)

 

[17]ইবনু আদী, আল-কামিল (8/146)

 

[18]তাফসিরুত তাবারী (24/293)

 

[19]তাঁদের দুজন কর্তৃক তাহকিককৃত 'আবু-ইসহাক আছ-ছায়ালাবী' এর গ্রন্থ 'আল-কাশফু ওয়াল বায়ান' এর 29তম খন্ডের 213 নং পৃষ্ঠার টিকা নং 4  

 

[20]তাফসিরুত তাবারী (24/295)  

 

[21]দেখুন :'আবুল-হাসান আলি বিন আহমদ আর-রাযিহী' কর্তৃক রচিত "আত-তাইসির লিমারিফাতিল মাশহুর মিন আসানিদি ওয়া কুতুবিত তাফসির" (পৃ/150)

 

[22]তাফসিরুত তাবারী (24/293,295)

 

[23]তাফসিরুল মাতুরিদী (10/494) 

 

[24]আর-রাযী, মাফাতিহুল গাইব (31/120)

 

[25]তাফসিরু ইবনে আশুর (30/263)

 

[26]আল-ফারাহিদী, আল-আইন (7/127)

 

[27]বদরুদ্দিন মুহাম্মদ ইবনু আব্দুল্লাহ আয-যারকাশী (রহ) তাঁর 'আল-বুরহান ফি উলুমিল কোরান' গ্রন্থে (পৃ/1181) এব্যাপারটা উল্লেখ্য করেছেন।