বিষয় : আলাক্বাহ সংক্রান্ত কিছু কথা।
লেখক : সামিউল হাসান তবিব আল-ইনফিরাদী
0. সূচীপত্র :-
1. ভূমিকা।
2. রক্ত (دم) ও আলাক্বাহ (علقة) এর মাঝে বিদ্যমান সম্পর্ক।
3. আলাক্বাহ (علقة) সংক্রান্ত ব্যাখ্যাগুলো সম্পর্কে আলোচনা।
4. বিজ্ঞান ও আলাক্বাহ (علقة)।
5. উল্লেখযোগ্য কিছু বিষয়।
6. পরিশিষ্ট।
7. টীকাসমূহ।
1. ভূমিকা :-
কোরআন এর বহু আয়াত এবং মুহাম্মাদ ﷺ এর বহু হাদিস অনুযায়ী, মানুষ علقة হতে সৃষ্ট, অর্থাৎ বিকশিত হওয়ার একটি ধাপে বা পর্যায়ে মানবভ্রূণ علقة হয়।
উক্ত আয়াতগুলোতে এবং উক্ত হাদিসগুলোতে علقة বলতে কী বুঝানো হয়েছে? তা সম্পর্কে এই লেখাটিতে আলোচনা করা হবে।
2. রক্ত (دم) ও আলাক্বাহ (علقة) এর মাঝে বিদ্যমান সম্পর্ক :-
ধ্রুপদী আরবী ভাষায়, علقة (আলাক্বাহ) শব্দটির একটি প্রয়োগ হচ্ছে এই যে, তা "রক্ত" (دم) শব্দটির সমার্থক (Synonym) হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যেকোনো ধরনের এবং যেকোনো অবস্থার "রক্ত" বুঝানোর জন্য علقة শব্দটি ব্যবহৃত হতে পারে। অতরল জমাটবদ্ধ শক্ত রক্তকে علقة বলা হয় এবং অজমাটবদ্ধ অশক্ত তরল রক্তকেও علقة বলা হয়। তাছাড়া রক্তের ধরন-প্রকৃতি এবং অবস্থাকে অনির্দিষ্ট রেখে নিছক "রক্ত" বুঝানোর জন্যও علقة শব্দটি ব্যবহৃত হয়। _[1]
3. আলাক্বাহ (علقة) সংক্রান্ত ব্যাখ্যাগুলো সম্পর্কে আলোচনা :-
উক্ত আয়াতগুলোতে এবং উক্ত হাদিসগুলোতে, علقة বলতে কী বুঝানো হয়েছে? তা নিয়ে উলামাদের মাঝে দুইটি মত প্রচলিত আছে, যথা :
এক : এর দ্বারা অতরল জমাটবদ্ধ শক্ত রক্ত সুনির্দিষ্টভাবে উদ্দেশ্য।
দুই : এর দ্বারা "রক্ত" উদ্দেশ্য এবং এক্ষেত্রে উক্ত রক্তের ধরন-প্রকৃতি এবং অবস্থা অনির্দিষ্ট।
উপর্যুক্ত এক নং মতটি হচ্ছে জুমহুর (অধিকাংশ) উলামাদের মত।
উপর্যুক্ত দুই নং মতটি হচ্ছে কিছু উলামাদের মত, যাদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত আছেন মুক্বাতিল, ইবনু ক্বুতাইবাহ, আত-ত্ববারী, ইবনু খালওয়াইহ, আবুল-লাইস এবং ইবনু আত্বিয়াহ। _[2]
উপর্যুক্ত এক নং মতটি অনুযায়ী, এক্ষেত্রে রক্তটির ধরন-প্রকৃতি এবং অবস্থা সুনির্দিষ্ট। অর্থাৎ, উপর্যুক্ত এক নং মতটি অনুযায়ী, এক্ষেত্রে علقة দ্বারা অতরল জমাটবদ্ধ শক্ত রক্ত ব্যতীত অন্য কোনো ধরনের এবং অন্য কোনো অবস্থার রক্ত উদ্দেশ্য হতে পারেনা। এর বিপরীতে, উপর্যুক্ত দুই নং মতটি অনুযায়ী, এক্ষেত্রে রক্তটির ধরন-প্রকৃতি এবং অবস্থা অনির্দিষ্ট। অর্থাৎ, উপর্যুক্ত দুই নং মতটি অনুযায়ী, এক্ষেত্রে علقة দ্বারা যেকোনো ধরনের এবং যেকোনো অবস্থার রক্ত উদ্দেশ্য হতে পারে।
সুতরাং, রক্তটির ধরন-প্রকৃতি ও অবস্থা কী কী হতে পারে এবং কী কী হতে পারেনা? এই দিক দিয়ে উপর্যুক্ত মতদ্বয় একে অপরের সহিত সাংঘর্ষিক। সুতরাং, এক্ষেত্রে উপর্যুক্ত মতদ্বয়ের কোনো একটিকে ত্যাগ করাপূর্বক অপরটিকে গ্রহণ করা বৈধ হবে।
উপর্যুক্ত এক নং মতটি হচ্ছে জুমহুরের মত। এবং জুমহুরের মত হুজ্জত না [3]। সুতরাং উপর্যুক্ত এক নং মতটি হুজ্জত না। সুতরাং, এক্ষেত্রে, উপর্যুক্ত এক নং মতটিকে ত্যাগ করে উপর্যুক্ত দুই নং মতটিকে গ্রহণ করা বৈধ হবে।
ধরে নিচ্ছি যে, উপর্যুক্ত এক নং মতটি ভুল এবং উপর্যুক্ত দুই নং মতটি সঠিক।
4. বিজ্ঞান ও আলাক্বাহ (علقة) :-
কোরআনীয় ধ্রুপদী আরবী ভাষা অনুযায়ী, কোনো একটা জিনিসের একটি সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যকে উল্লেখ করার দ্বারা উক্ত জিনিসটির সমগ্রটাকেই বুঝানো সম্ভব বৈধ এবং গ্রহণযোগ্য।_[4]
40 থেকে 80 দিন বয়সী মানবভ্রূণকে علقة (আলাক্বাহ) বলা হয়। _[5]
আলাক্বাহ এর অর্থ যদি "রক্ত" হয়, এবং 40 থেকে 80 দিন বয়সী মানবভ্রূণটি যদি "রক্ত" না হয়, এবং "রক্ত" যদি 40 থেকে 80 দিন বয়সী মানবভ্রূণটির একটি "বৈশিষ্ট্য" হয়, তাহলেও উক্ত 40 থেকে 80 দিন বয়সী মানবভ্রূণটিকে علقة (আলাক্বাহ) বলা বৈধ এবং গ্রহণযোগ্য হবে।
অর্থাৎ, 40 থেকে 80 দিন বয়সী মানবভ্রূণটি যদি "রক্ত" না হয়, বরং তা যদি নিছক "রক্তবিশিষ্ট" হয়, তাহলেও তাকে علقة (আলাক্বাহ) বলা বৈধ এবং গ্রহণযোগ্য হবে।
আধুনিক বিজ্ঞান অনুযায়ী, 40 থেকে 80 দিন বয়সী মানবভ্রূণের ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত এই দুইটি কথা সত্য।
এক : 40 থেকে 80 দিন বয়সী মানবভ্রূণ "রক্ত" না।
দুই : 40 থেকে 80 দিন বয়সী মানবভ্রূণের ভিতরে "রক্ত" থাকে, অর্থাৎ তা "রক্তবিশিষ্ট"।
যদি আধুনিক বিজ্ঞান নির্ভরযোগ্য হয় এবং উপর্যুক্ত কথাদ্বয়ের উভয়েই সত্য হয়, তাহলেও 40 থেকে 80 দিন বয়সী মানবভ্রূণকে "রক্ত" অর্থে علقة (আলাক্বাহ) বলাটা ভুল বা বাস্তবতাবিরোধী হবেনা, বরং সঠিক ও বাস্তবতার সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে।
5. উল্লেখযোগ্য কিছু বিষয় :-
এক.
আশ-শাইখ মুহাম্মাদ সালিহ আল-মুনাজ্জিদ এর islamqa.org এ বিদ্যমান আলাক্বাহ (علقة) সংক্রান্ত একটি লেখার [6] উপর ভিত্তি করে আলাক্বাহ (علقة) সংক্রান্ত আমার এই লেখাটি লিখিত হয়েছে। আমার এই লেখাটিকে, islamqa.org এর উক্ত লেখাটিরই একটি "রূপ" বা "সংস্করণ" হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
দুই.
গর্ভপাতের দরুণ নির্গত আলাক্বাহ (علقة) রক্ত দ্বারা আবৃত থাকে, ফলে তা দেখতে হুবুহু জমাটবদ্ধ রক্তের খণ্ডের অনুরূপ হয়।
সুতরাং, গর্ভপাতের দরুণ নির্গত আলাক্বাহ (علقة) সংক্রান্ত ফিক্বহী মাসআলাগুলোর ক্ষেত্রে আলাক্বাহকে (علقة) "জমাটবদ্ধ রক্তের খণ্ড" হিসেবে বিবেচনাকরণ অধিক সুবিধাজনক, অধিক গ্রহণযোগ্য, অধিক নির্ভরযোগ্য এবং অধিক বাস্তবসম্মত।
তিন.
পূর্ববর্তী উলামাদের সবাই এব্যাপারে একমত যে, উক্ত আয়াতগুলোতে এবং উক্ত হাদিসগুলোতে علقة বলতে "রক্ত" উদ্দেশ্য। তবে উক্ত রক্তটির ধরন-প্রকৃতি ও অবস্থা কি সুনির্দিষ্ট নাকি অনির্দিষ্ট? তা নিয়ে পূর্ববর্তী উলামাদের মাঝে মতভেদ ঘটেছে। অধিকাংশ উলামাদের মতে, উক্ত রক্তটির ধরন-প্রকৃতি ও অবস্থা সুনির্দিষ্ট, অর্থাৎ এক্ষেত্রে علقة দ্বারা অতরল জমাটবদ্ধ শক্ত রক্ত সুনির্দিষ্টভাবে উদ্দেশ্য। এর বিপরীতে, কিছু উলামাদের মতে, উক্ত রক্তটির ধরন-প্রকৃতি ও অবস্থা অনির্দিষ্ট, অর্থাৎ এক্ষেত্রে علقة দ্বারা যেকোনো ধরনের এবং যেকোনো অবস্থার রক্ত উদ্দেশ্য হয়ে থাকতে পারে। উল্লেখ্য যে, অধিকাংশ উলামাদের মত অহুজ্জত এবং ভুল হওয়া সম্ভব।
এই লেখাটির "বিজ্ঞান ও আলাক্বাহ (علقة)" অংশে উল্লেখকৃত ব্যাখ্যাটি হচ্ছে একটি নতুন ব্যাখ্যা, যা পূর্ববর্তী উলামাদের মধ্য কেওই উল্লেখ করেন নি। কিন্তু, উক্ত ব্যাখ্যাটি এমন কোনোকিছুর সহিত সাংঘর্ষিকও না, যার সঠিক হওয়ার উপর পূর্ববর্তী উলামাদের ঐক্যমত আছে।
চার.
ফক্বীহদের একটি ক্ষুদ্র দল, গর্ভপাতের দরুণ নির্গত علقة (আলাক্বাহ) সম্পর্কে ফিক্বহী আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন যে, علقة (আলাক্বাহ) জমাটবদ্ধ রক্ত না। _[7]
6. পরিশিষ্ট :
কোরআনের কোনো একটা আয়াতের কোনো একটা শব্দ দ্বারা উক্ত শব্দটির একাধিকটা অর্থ একইসাথে উদ্দেশ্য হওয়া সম্ভব। সুতরাং, আলাক্বাহ (علقة) দ্বারা আলাক্বাহ (علقة) শব্দটির একাধিকটা অর্থ একইসাথে উদ্দেশ্য হওয়া সম্ভব।
অতএব, আলাক্বাহ (علقة) এর "রক্ত" অর্থটিকে গ্রহণ করার পর, রক্ত অর্থটির সাথে আলাক্বাহ (علقة) এর অন্যান্য বিভিন্ন অর্থ (যেমন : এমনকিছু যা যুক্ত থাকে, জোঁক) গ্রহণকরণ বৈধ হবে।
পূর্ববর্তী উলামাদের সবাই এ ব্যাপারে একমত যে, উক্ত আয়াতগুলোতে এবং উক্ত হাদিসগুলোতে আলাক্বাহ (علقة) দ্বারা "রক্ত" উদ্দেশ্য। সুতরাং, আলাক্বাহ (علقة) সংক্রান্ত আপত্তিগুলোর জবাব দিতে গিয়ে, আলাক্বাহ (علقة) এর "রক্ত" অর্থটিকে ত্যাগকরণ অবৈধ, অগ্রহণযোগ্য এবং ভুল।
অতএব, আলাক্বাহ (علقة) এর "রক্ত" অর্থটিকে ত্যাগ করে আলাক্বাহ (علقة) এর অন্য কোনো অর্থ গ্রহণকরণ বৈধ হবেনা।
7.টীকাসমূহ :-
[1]
انظر : المحكم و المحيط الأعظم لابن سيده (دار الكتب العلمية ، 1/212) و لسان العرب لابن منظور (دار صادر ، 10/267) و القاموس المحيط لمجد الدين الفيروزآبادي (مؤسسة الرسالة ، صفحة 910) و تاج العروس لمرتضی الزبيدي (وزارة الإرشاد و المجلس الوطني ، 26/181) وغيرهم
[2]
انظر : تفسير مقاتل بن سليمان (مؤسسة التاريخ العربي ،3/115 و 3/153 و 3/720 و 4/761) و غريب القرآن لابن قتيبة (بتحقيق أحمد صقر ، صفحة 296) و تفسير الطبري (دار التربية و التراث ، 19/16 و 24/83 و 24/519) و إعراب ثلاثين سورة لابن خالويه (دار الكتب المصرية ، صفحة 134) و بحر العلوم لأبي الليث السمرقندي (2/475 و 3/598 ) و المحرر الوجيز لابن عطية (دا الكتب العلمية ، 4/107 و 4/138 و 4/568 و 5/407 و 5/502)
[3]
قال محمد بن علي الشوكاني في "إرشاد الفحول إلي تحقيق الحق من علم الأصول"(دار الكتاب العربي ، 1/234)
"إذا خالف أهل الإجماع واحد من المجتهدين فقط فذهب الجمهور إلى أنه لا يكون إجماعا ولا حجة"
وقال الشوكاني في كتابه السابق (دار الكتاب العربي ،2/272)
"أنه يقدم ما عمل أكثر السلف على ما ليس كذلك؛ لأن الأكثر أولى بإصابة الحق. وفيه نظر؛ لأنه لا حجة في قول الأكثر، ولا في عملهم، فقد يكون الحق في كثير من المسائل مع الأقل، ولهذا مدح الله القلة في غير موضع من كتابه"
وقال الشوكاني في كتابه السابق (دار الكتاب العربي ، 1/153)
"واعلم أنه لا يضر الخبر عمل أكثر الأمة بخلافه لأن قول الأكثر ليس بحجة"
[4]
وقال الطبري في تفسيره (دار هجر ، 18/353) في تفسير قوله تعالی كل شيء هالك إلا وجهه
واختلف في معنى قوله ﴿إلا وجهه﴾ فقال بعضهم معناه كل شيء هالك إلا هو وقال آخرون معنى ذلك إلا ما أريد به وجهه.
[5]
قال محمد بن إسماعيل البخاري في صحيحه (السلطانية ، 4/111)
حدثنا الحسن بن الربيع حدثنا أبو الأحوص عن الأعمش عن زيد بن وهب قال عبد الله حدثنا رسول الله وهو الصادق المصدوق قال إن أحدكم يجمع خلقه في بطن أمه أربعين يوما ثم يكون علقة مثل ذلك ثم يكون مضغة مثل ذلك ثم يبعث الله ملكا فيؤمر بأربع كلمات ويقال له اكتب عمله ورزقه وأجله وشقي أو سعيد ثم ينفخ فيه الروح فإن الرجل منكم ليعمل حتى ما يكون بينه وبين الجنة إلا ذراع فيسبق عليه كتابه فيعمل بعمل أهل النار ويعمل حتى ما يكون بينه وبين النار إلا ذراع فيسبق عليه الكتاب فيعمل بعمل أهل الجنة.
[6]
https://islamqa.info/ar/421393
[7]
انظر : شرح عبد الباقي بن يوسف الزرقاني علی مختصر خليل (دار الكتب العلمية , الجزء الثامن ، صفحة 53 و 54) والنَّوادر والزِّيادات على مَا في المدَوَّنة من غيرها من الأُمهاتِ لابن أبي زيد القيرواني (دار الغرب الإسلامي ، 13/123) ونكت وتنبيهات في تفسير القرآن المجيد لأحمد بن محمد البسيلي (بتحقيق محمد الطبراني ، الجزء الثاني ، صفحة 321-322) ومنح الجليل شرح مختصر خليل لمحمد بن أحمد عليش "(دار الفكر ،الجزء التاسع ، صفحة 97 و 98) وغيرهم.
*****