Are you sure?

বিজ্ঞান »  ইসলাম ও বিজ্ঞান

আসমানের ব্যবধান কী ৫০০ বছরের পথ?

 

শিরোনাম : "প্রত্যেক আসমানের মধ্যবর্তি দুরুত্ব কিংবা আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যবর্তি দুরুত্ব নির্দিষ্টকরন সক্রান্ত কোনো সহিহ হাদিস নেই "

লেখক : শায়খ মুহাম্মাদ সালিহ আল-মুনাজ্জিদ
অনুবাদক : সামিঈ আল-হাসান তবিব আল-ইনফিরাদী

প্রশ্ন  - আপনাদের একটি উত্তরে আপনারা ইবন খুযাইমার কিতাব "আত-তাওহিদ" এ বর্নিত একটি বর্ননা উল্লেখ্য করেছেন, যে ইবন আব্বাস (রা) হতে বর্নিত যে নবি (ﷺ) বলেছেন : (নিকটবর্তি আসমান ও এর পরবর্তি আসমানের মধ্যকার দুরুত্ব ৫০০ বছরের পথ)। তাহলে এটাকে আধুনিক বিজ্ঞানের প্রমানিত তথ্যসমুহের আলোকে কিভাবে বুঝা হবে?  নাকি ৫০০ বছরের পথ কথাটার অর্থ এর শাব্দিক রুপ অনুযায়ি নেয়া হবেনা? 

উত্তর -

নবি (ﷺ) হতে বর্নিত যেসব মারফু হাদিসগুলোতে বলা হয়েছে যে প্রত্যেক আসমানের মধ্যকার দুরুত্ব পাচশত বছরের পথ,এর সবগুলৌই এমন হাদিস যা প্রমানিত নয় ও সহিহ নয়। আমাদের নিকট সেগুলো (হাদিসগুলো) চারজন সম্মানিত সাহাবি (রা) হতে পৌছেছে।

এই হলো এর বিস্তারিত,

প্রথম হাদিস : আব্বাস ইবন আবদুল মুত্তালিব (রা) থেকে বর্ণিত যে, একদিন তিনি একদল লোকের সাথে বাহতা নামক স্থানে বসা ছিলেন। রাসুলুল্লাহ ﷺ -ও  তাদের মাঝে উপকিষ্ট ছিলেন এমন সময় তাদের উপর দিয়ে একটা মেঘ উড়ে গেল। তাঁরা সে দিকে তাকান। তখন রাসুলুল্লাহ ﷺ বললেনঃ তোমরা কি জান এর নাম কি? তারা বলল হ্যাঁ এটি হল সাহাব (মেঘ)।তখন রাসুলুল্লাহ ﷺ বললেনঃ মুযন (জালদ)-ও। তারা বললঃ মুযনও। রাসুলুল্লাহ ﷺ বললেনঃ আনান (নীরদ)-ও। তরা বললঃ আনানও। এর পর রাসুলুল্লাহ ﷺ তাদের বললেনঃ আকাশ ও পৃথিবীর মাঝে কতটুক দুরত্ব কি তা কি তোমরা জান? তারা বললেনঃ আল্লাহর কসম, আমরা তা জানি না।তিনি বললেনঃ এতদুভয়ের মাঝে দুরত্ব হল একাত্তর বা বাহাত্তর বা তিহাত্তর বছরের পথ। এর উপর আসমানের দুরত্বও অনুরূপ। এভাবে তিনি সাত আসমানের উল্লেখ করেন। পরে বললেনঃ সপ্তম আকাশের উপর আছে সাগর। এর উপর ও নিচের দুরত্ব হল আসমান ও যমীনের দুরুত্বের অনুরূপ। এর উপর হল আটটি মেষ (আকৃতির ফিরিশতা) এগুলোর খুর থেকে নিয়ে হাটু পর্যন্ত হল এক আকাশ থেকে আরেক আকাশের দুরত্বের সমান। এগুলোর পিঠের উপর হল আরশ। এর নিচ থেকে উপরের ব্যবধান হল দুই আকাশের মাঝের ব্যাবধানের অনুরূপ। এরও উর্ধ্বে হলেন আল্লাহর রাব্বুল ইযযত।

এই হাদিসটি বর্নিত হয়েছে "সিমাক বিন হারব" এর সুত্রে "আব্দুল্লাহ বিন উমাইরাহ" হতে, তিনি "আব্বাস বিন আব্দিল-মুত্তালিব" হতে। এবং মুহাদ্দিসদের কেও কেও ইবন উমাইরার পরে "আল-আহনাফ বিন কায়স " এর নাম বৃদ্ধি করেছেন।

হাদিসটি ইমাম আহমাদ "আল-মুসনাদ"(3/292) এ বর্ননা করেছেন। এবং আবু-দাউদ (4723), এবং আত-তিরমিযি (3320) এবং এনারা ছাড়াও আরো অনেক মুহাদ্দিস হাদিসটি বর্ননা করেছেন।।

এই এই সনদটি "আব্দুল্লাহ বিন উমাইরাহ" এর কারনে যইফ। তাকে ইবন আবি-হাতেম "আল-জারহু ওয়াত তা'দিল" (5/124) ও আল-বুখারি "আত-তারিখুল কাবির"(5/159) এ উল্লেখ্য করেছেন। এবং তারা দুজন তার ব্যাপারে কোনো জারাহ ও তা'দিল উল্লেখ্য করেন নি। বরং আল-বুখারি বলেছেন : আল-আহনাফ হতে তার শ্রবন আমরা জানিনা। এবং ইব্রাহিম আল-হারবী বলেছেন : আমি আব্দুল্লাহ বিন উমাইরাহ কে চিনিনা, যেমনটা "ইকমালু তাহযিবিল কামাল"(8/102) এ আছে। এবং সেকারনে আয-যাহাবী "আল-মুগনী"(1/350) তে বলেছেন : "সে অপরিচিত "। এবং ইবন হাজার বলেছেন "সে মাজহুল" ; "তা'জিলুল মুনফা'আহ"(2/274)।

ফলে এই হাদিসটি সম্পর্কে ইবনুল জাওযি বলেছেন "সহিহ নয়" ; "আল-ইলালুল মুতানাহিয়াহ"(1/9)। এবং আল-বাওসুরী বলেছেন "যইফ মুনকাতিঈ", যেমনটা "ইত্তিহাফুল খাইরাতিল মাহরাহ"(6/165) এ আছে। শায়খ আহমাদ শাকের "তাহকিকুল মুসনাদ" এ বলেছেন "খুবই যইফ "। অনুরুপ  বলেছেন আর-রিসালাহ প্রকাশনির মুদ্রনের মুহাক্কিকরা। এবং হাদিসটিকে আল-আলবানী "যইফুত তিরমিযী" তে "যইফ" বলেছেন।

দ্বিতীয় হাদিস : কাতাদাহর সুত্রে আল-হাসান আল-বসরী হতে বর্নিত যে আবু-হুরাইরাহ (রা) হতে বর্নিত তিনি বলেনঃ একদা নবী ﷺ এবং তার সাহাবীরা এক স্থানে বসা ছিলেন। এমন সময় একটি মেঘ উড়ে এল। নবী ﷺ বললেন, তোমরাকি জান এটি কি? তাঁরা বললেন আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই ভাল জানেন। তিনি বললেনঃ এ হল এক খন্ড মেঘ পৃথিবীর জন্য পানিবাহক। আল্লাহ তায়ালা এটি এমন কাওমের দিকেও হাঁকিয়ে নিয়ে যান যারা তার প্রতি কৃতজ্ঞ নয়। যারা তাকে ডাকে না।এরপর বললেনঃ তোমরাকি জান তোমাদের উপর কি আছে? সাহাবীরা বললেনঃ আল্লাহ ও তারা রাসূলই ভাল জানেন। তিনি বললেন এ হল ’রাকী’ পৃথিবীর আকাশ। সুরক্ষিত ছাদ ও রুদ্ধ ঊর্মীমালা। তোমরা কি জানো তোমাদের এবং এর মাঝে দুরত্ব কত?সাহাবীরা বললেন আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই ভাল জানেন। তিনি বললেন এর মাঝে আর তোমাদের মাঝে দুরত্ব হল পাঁচশ বছরের। এর উপর কি আছে তা কি তোমরা জান? সাহাবীরা বললেন আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভাল জানেন।তারপর নবীজী বললেনঃ এর উপর রয়েছে আরো দুই অসমান। এতদুভয়ের মাঝেও রয়েছে পাঁচশ বছর সফরের ব্যবধান। এভাবে সাত আসমানের কথা তিনি উল্লেখ করলেন। প্রতি দুই আসমানের মাঝে রয়েছে আকাশ ও পৃথিবীর মাঝের মত দুরত্ব।তারপর নবীজী বললেনঃ এরও ঊর্ধ্বে কি আছে তা কি তোমরা জান? সাহাবীরা বললেন আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভাল জানেন। তিনি বললেন এর ঊর্ধ্বে হল আরশ। এর এবং আকাশের মাঝে দুরত্ব হল দুই আসমানের দুরত্বের সমান। এরপর তিনি বললেন, তোমাদের নিচে কি আছে তা কি তোমরা জান?সাহাবীরা বললেন আল্লাহ এবং তার রাষূলই ভাল জানেন। তিনি বললেন নিচে হল যমীন। এর পর কি আছে তাকি তোমরা জান। সাহাবীরা বললেন আল্লাহ এবং তার রাসূলই ভাল জানেন। তিনি বললেন এর নিছে আরো এশটি পৃথিবী আছে। এতদুভয়ের মাঝে পাঁচশ বছর সফরের দুরত্ব।তার পর তিনি বললেনঃ সেই সত্তার কসম যার হাতে মুহাম্মদের প্রাণ তোমরা যদি একটি দড়ি সর্বনিম্ন পৃথিবীর দিকে লটকে ধর তবে তা আল্লাহর জ্ঞানানুসারে কোন স্থানে যেয়ে পৌছবে (যা আমাদের জানা নেই)। এর পর তিনি পাঠ করলেনঃ (هو الأَوَّلُ وَالآخِرُ وَالظَّاهِرُ وَالْبَاطِنُ وَهُوَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ) - তিনি আদি, তিনি অন্ত, তিনি ব্যক্তি, তিনি গুপ্ত এবং তিনিই সব বিষয় সম্যক অবহিত। (সূরা হাদীদ ৫৭ঃ ৩)।

হাদিসটি আহমাদ "আল-মুসনাদ"(14/422) এ ও আত-তিরমিযী "আস-সুনান" (3298) এ বর্ননা করেছেন। এই হাদিসটিও প্রচন্ড যইফ। কাতাদাহ মুদাল্লিস, এবং তিনি আল-হাসান আল-বসরী থেকে নিজ শ্রবন স্পষ্ট করেন নি, এবং আল-হাসান আবু-হুরাইরাহ থেকে হাদিস শ্রবন করেন নি, যেমনটা আইয়ুব আস-সাজাস্তানী বলেছেন : "আল-হাসান আল-বসরী আবু-হুরাইরাহ থেকে শ্রবন করেন নি " বক্তব্য সমাপ্ত ইবন আবি-হাতেমের "আল-মারাসিল"(106) থেকে।

এবং সেকারনে আত-তিরমিযী বলেছেন : হাদিসটি এই সুত্রে গরিব। এবং আজ-জাওরাকানী বলেছেন : "বাতিল" উদ্ধৃতি সমাপ্ত "আল-আবাতিল"(1/201) হতে। এবং ইবনুল যাওযি বলেছেন "সহিহ নয়" উদ্ধৃতি সমাপ্ত "আল-ইলালুল মুতানাহিয়াহ"(1/27) হতে। ইবন হাজার বলেছেন : "এর সনদ সহিহ নয়" উদ্ধৃতি সমাপ্ত "তুহফাতুন নুবালা "(63)  হতে। আয-যাহাবী বলেছেন : "মুনকার" উদ্ধৃতি সমাপ্ত "আল-উলুউ"(74) হতে। এবং হাদিসটিকে আল-আলবানী "যইফুত তিরমিযি"তে " যইফ বলেছেন।

তৃতীয় হাদিস : ইবন লাহিয়াহর সুত্রে, তিনি বলেন : আমাদের দারিজ বর্ননা করেছেন আবুল-হাইসাম হতে, তিনি আবু-সাইদ আল-খুদরী হতে বর্নিত যে রাসূলুল্লাহ ﷺ আল্লাহ্ তা’আলার বাণী “সুউচ্চ বিছানা থাকবে” (সূরাঃ ওয়াকিয়া- ৩৪) প্রসঙ্গে বলেন, এর উচ্চতা হবে আসমান-যমিনের উচ্চতার সমান আর তা হবে পাঁচ শত বছরের দূরত্বের সমান।

হাদিসটি বর্ননা করেছেন ইমাম আহমাদ "আল-মুসনাদ"(18/247) তে, এবং আত-তিরমিযি "আস-সুনান" (2540) এ বর্ননা করে বলেছেন : গারিব হাদিস, যা হাদিসটির যইফ হয়ার প্রতি ইংগিত দেয়। এবং হাদিসটিকে আল-আলবানী যইফুত তিরমিযিতে "যইফ" বলেছেন। ইবন লাহিয়াহ ও দারিজ আবিস-সামাহ (বিশেষ করে আবুল-হাইসাম হতে তার রর্ননা করার কারনে) এর কারনে এই সনদের দুর্বলতা খুবই সুস্পষ্ট। দেখুন : "তাহযিবুত তাহযিব"(3/209)

চতুর্থ হাদিস : আবু-নাসরের হাদিস, আবু-যার (রা) হতে বর্নিত তিনি বলেন : রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন : পৃথিবীর বিস্তৃতি হলো পাচশত বছরের পথ, এবং পৃথিবীর উপরিভাগ ও নিকটবর্তি আসমানের মধ্যকার দুরুত্ব ৫০০ বছরের পথ …… (তারপর পুর্বে উল্লেখিত হাদিসগুলোর মত) 

হাদিসটি আল-বাযযার "আল-বাহরুয যাখার" (9/460) এ বর্ননা করেছেন। এবং বলেছেন ; "এই হাদিসটি আবু-যার হতে এই সনদ ছাড়া অন্য কোনো সনদে বর্নিত হয়েছে বলে আমরা জানিনা, এবং আবু-নাসর, আমি তাকে হুমাইদ বিন হিলাল মনে করি, এবং তিনি (হুমাইদ) আবু-যার হতে হাদিস শ্রবন করেন নি "।

এবং আজ-জাওরাকানী বলেন : "হাদিসটি মুনকার" উদ্বৃতী সমাপ্ত "আল-আবাতিল"
(1/200) হতে, এবং অনুরুপ বলেছেন ইবনুল যাওযি "আল-ইলালুল মুতানাহিয়াহ" (1/12) তে।  এবং ইবন কাসির তার "তাফসির"(4/303) এ বলেন : "এর সনদে সমস্যা আছে ও এর মদনে নাকারাত ও গারাবাত (অসংগতি ও ক্রুটি) আছে। "

এবং একইভাবে আমরা আসমান ও যমিনের মধ্যকার ব্যবধান ৫০০ বছরের পথ হিসেবে নির্দিষ্ট হয়া সম্পর্কে এমন কোনো সনদ পাইনি যা সহিহ।

শায়খ মুহাম্মাদ আল-হাওত রহিমাহুল্লাহ বলেন :

"সে ব্যাপারে কোনোকিছুই সহিহ নয়, প্রত্যেক আসমানের মধ্যবর্তি দুরুত্বের পরিমান সহিহ নয় , আসমান ও যমিনের মধ্যবর্তি দুরুত্বের ক্ষেত্রেও নয়। এবং সেই দুরুত্ব ৫০০ বা ৮০ বছরের পথ হয়ার ব্যাপারটাও সহিহ নয় "  উদ্ধৃতী সমাপ্ত "উসনাল মাতালিব"(পৃ/164)

আমরা পুর্বের ফতোয়া নং (47048),(214126) এ এটা উল্লেখ্য করেছি। এবং এতে উপরে আলোচিত নবি (সা) পর্যন্ত মারফুভাবে বর্নিত হাদিসগুলোকে সহিহ বলা হয়নি। আমরা তো সেখানে আব্দুল্লাহ বিন মাসউদের বক্তব্য উল্লেখ্য করেছি। তালেবে ইলমদের নিকট এটা গোপন নয় যে সাহাবিদের বক্তব্য নবি (সা) এর হাদিসের মত নয়, বরং যখন সাহাবিদের বক্তব্য অদ্ভুত বিষয় ধারন করে কিংবা সেই বক্তব্যটির চেয়ে অধিক শক্তিশালি মতের বিরুদ্ধে যায় তখন সেখানে আলোচনা ও চিন্তাভাবনার বিষয় থাকে।

মুল আর্টিকেলের লিংক : https://islamqa.info/ar/225192