বিষয় : রাসুল (সা) কি দেনমোহরের অভাবের কারণে আয়েশাহ (রা) কে ঘরে তুলতে বিলম্ব করেছিলেন?
নাস্তিকদের একটি ব্লগ সাইটে দাবি করা হয়েছে:
"অনেক ইসলামিস্টই আজকাল দাবী করেন, নবী মুহাম্মদ ছয় বছর বয়সে আয়িশাকে বিয়ে করে তারপরে তিন বছর অপেক্ষা করেছিলেন, আয়িশার প্রাপ্তবয়ষ্ক হওয়ার জন্য। কিন্তু কথাটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। যার প্রমাণ আমরা পাই ইবনে সা’দের তাবাকাত গ্রন্থ থেকে । সত্য হচ্ছে, সেই সময়ে নবীর কাছে দেনমোহর দেয়ার মত অর্থ ছিল না, তাই আবু বকরের কাছ থেকেই ঋণ নিয়ে তিনি আয়িশাকে তুলে এনেছিলেন।"
(তাবাকাত ইবন সা'দ এর এই বর্ণনাটি) আবু বকর(রাঃ), রাসূল এর নিকট আরজ করলেন, “হে আল্লাহর রাসূল! আপনার স্ত্রীকে ঘরে আনছেন না কেন? প্রিয়নবী বললেন, “এই মুহূর্তে মোহর পরিশোধ করার মতো অর্থ আমার কাছে নেই। আবু বকর(রাঃ) অনুরোধ করলেন- যদি আমার অর্থ কবুল করতেন। তখন রাসূল, আবু বকর(রা:) এর কাছ থেকে অর্থ ঋণ নিয়ে আয়িশা(রাঃ) এর নিকট পাঠিয়ে দিলেন।
বর্ণনাটি তাবারীর ইতিহাস গ্রন্থেও পাওয়া যায়
(তারিখ আত-তাবারী এর এই বর্ণনাটি) : We stayed in Abu Bakr’s house for a few days; then Abu Bakr asked (the Prophet) “O Messenger of God, what prevents you from consummating the marriage with your wife?” The Prophet said “The bridal gift (sadaq).” Abu Bakr gave him the bridal gift, twelve and a half ounces (of gold), and the Prophet sent for us. He consummated our marriage in my house, the one where I live now and where he passed away.
এই বিষয়গুলো উল্লেখ করে ইসলামবিরোধী নাস্তিকরা প্রমাণ করতে চায় যে বিবাহের পরে নবী ﷺ কর্তৃক আয়েশা(রা.)কে ঘরে তুলতে বিলম্বের কারণ তাঁর বালেগা হবার জন্য অপেক্ষা করা নয় বরং দেনমোহরের টাকার অভাব। তারা এই যুক্তি দেখিয়ে নবী ﷺ কে শিশুকামী বলার অপচেষ্টা করে (নাউযুবিল্লাহ)।
তাদের এহেন দাবির জবাব :
আমি বলব যে,"নবী ﷺ কর্তৃক আয়েশা(রা.)কে ঘরে তুলতে বিলম্ব করার কারণ তাঁর বালেগা হবার জন্য অপেক্ষা করা নয় বরং দেনমোহরের টাকার অভাব", এই দাবিটি সম্পুর্ণ মিথ্যা, ভিত্তিহীন, প্রমাণহীন, বাস্তবতাবিরোধী।
"সেই সময়ে নবীর কাছে দেনমোহর দেয়ার মত অর্থ ছিল না, তাই আবু বকরের কাছ থেকেই ঋণ নিয়ে তিনি আয়িশাকে তুলে এনেছিলেন", এইটা মোটেও "সত্য" নয়! বরং এটাই হচ্ছে মিথ্যা!
তাদের এই মিথ্যা দাবির পক্ষে তারা ইবনু সাদ ও আত-তাবারি কর্তৃক বর্ণিত এই যেই বর্ণনাটি উল্লেখ্য করে থাকে, এক্ষেত্রে সেই বর্ণনাটিই তাদের একমাত্র "প্রমাণ" বা "ভিত্তি"। এটা ছাড়া এমন আর কোনো বর্ণনা নেই যা তাদের উক্ত দাবির পক্ষে যায়।
যাই হোক, তারা "প্রমাণ" হিসেবে এই যেই বর্ণনাটি ইবনু সাদ ও আত-তাবারি হতে উল্লেখ্য করে থাকে, সেই বর্ণনাটি "জাল, বানোয়াট, বাতিল, মিথ্যা!" অর্থাৎ তাদের দাবিটিও মিথ্যা, আবার দাবিটির পক্ষে থাকা একমাত্র প্রমাণটিও মিথ্যা, এক্ষেত্রে তারা একটা মিথ্যা জাল বর্ণনার উপর ভিত্তি ও নির্ভর করে একটা মিথ্যা দাবি উপস্থাপন করেছে।
তাদের কর্তৃক প্রমাণ হিসেবে উল্লেখিত বর্ণনাটির বিস্তারিত তাহকিক নিম্নে উপস্থাপন করা হলো।
মূল বর্ণনাটি নিম্নরূপ,
"عن عائشة رضي الله عنها .....قال أبو بكر يا رسول الله ما يمنعك من ان تبني بأهلك قال رسول الله ﷺ الصداق فاعطاه أبو بكر الصداق فبعث بها رسول الله ﷺ إلينا و بنی بي رسول الله ﷺ في بيتي هذا الذي أنا فيه وهو الذي توفي فيه ......"[1]
অর্থ : আয়েশাহ (রা) হতে বর্ণিত …… আবু বকর (রা) বলেন "হে আল্লাহর রাসুল, কোন বিষয়টি আপনাকে আপনার স্ত্রীর সহিত সংসার আরম্ভ করা হতে বিরত রাখছে?" আল্লাহর রাসুল ﷺ উত্তরে বললেন "বিয়ের মোহরানা"। একথা শুনে আবু বকর (রা) তাঁকে ﷺ মোহরানা প্রদান করলেন, অতপর আল্লাহর রাসুল ﷺ সেই মোহরানা আমাদের নিকট পাঠিয়ে দিলেন। এবং আল্লাহর রাসুল ﷺ আমার সহিত সংসার আরম্ভ করলেন আমার এই বাসাতে যেখানে আমি এখনো আছি এবং যেখানে তিনি ﷺ মৃত্যুবরণ করেছেন …
উক্ত বর্ণনাটির সবগুলো সনদ দুইটি ভিন্ন ভিন্ন চুড়ান্ত সুত্র পর্যন্ত এসে মিলিত হয়েছে। সেই দুইটি চুড়ান্ত সুত্র নিম্নরূপ,_[1]
১. মুহাম্মদ বিন উমার আল-ওয়াকিদী হতে, তিনি মুসা বিন মুহাম্মদ বিন আব্দুর রহমান হতে, তিনি রাইতাহ হতে, তিনি আমরাহ বিনতু আব্দুর রহমান হতে, তিনি আয়েশাহ (রা) হতে।
২. আয-যুবাইর বিন বাক্কার হতে, তিনি মুহাম্মদ ইবনুল হাসান বিন যুবালাহ আল-মাখযুমী হতে, তিনি আব্দুর রহমান ইবনু আবিয যিনাদ হতে, তিনি হিশাম বিন উরওয়াহ হতে, তিনি উরওয়াহ ইবনুয যুবাইর হতে, তিনি আয়েশাহ (রা) হতে।
প্রথম চুড়ান্ত সুত্রের একজন রাবি হলেন 'রাইতাহ', তিনি মাজহুল [2]। এবং প্রথম চুড়ান্ত সুত্রের আরেকজন রাবি হলেন 'মুহাম্মদ বিন উমার আল-ওয়াকিদী', তিনি মাতরুক এবং হাদিস জালকারী মিথ্যুক [3][4]।
দ্বিতীয় চুড়ান্ত সুত্রের একজন রাবি হলেন 'মুহাম্মদ ইবনুল হাসান বিন যুবালাহ আল-মাখযুমী', তিনি কাজ্জাব তথা মিথ্যাবাদী [5]।
সুতরাং, আলোচ্য বর্ণনাটি "জাল, বানোয়াট, বাতিল, মিথ্যা।"
এর বিপরীতে আমরা একটি সহীহ বর্ণনা পাই, যা থেকে বোঝা যায় নবী ﷺ এর গৃহে যাবার পূর্বে আয়েশা(রা.) যাতে শারিরীকভাবে উপযুক্ততা অর্জন করেন, সেদিকে লক্ষ রাখা হয়েছিল। এবং এই বর্ণনাটি স্বয়ং আয়েশা(রা.) থেকে এসেছে।
عَنْ عَائِشَةَ، قَالَتْ كَانَتْ أُمِّي تُعَالِجُنِي لِلسُّمْنَةِ تُرِيدُ أَنْ تُدْخِلَنِي عَلَى رَسُولِ اللَّهِ ـ صلى الله عليه وسلم ـ فَمَا اسْتَقَامَ لَهَا ذَلِكَ حَتَّى أَكَلْتُ الْقِثَّاءَ بِالرُّطَبِ فَسَمِنْتُ كَأَحْسَنِ سُمْنَةٍ ._[6][7]
অর্থঃ আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমার মা আমাকে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সংসারে পাঠাতে চাচ্ছিলেন বিধায় আমার দৈহিক পরিপুষ্টির জন্য চিকিৎসা করাতেন। কিন্তু তা কোন উপকারে আসলো না। অবশেষে আমি তাজা খেজুরের সাথে শসা মিশিয়ে খেলাম এবং উত্তমরূপে দৈহিক পরিপুষ্টি লাভ করলাম।
এই সহীহ হাদিস থেকে আমরা স্পষ্ট একটি ধারণা লাভ করি। বিষয়টি মোটেও এমন না যে আয়েশা(রা.) এর শারিরীক উপযুক্ততা বা এমন কিছু বিবেচনা না করেই তাঁকে স্বামীগৃহে পাঠানো হয়েছিল! অথচ নাস্তিক-মুক্তমনাদের প্রচার-প্রচারণায় মানুষ ঠিক এর বিপরীত ধারণাই লাভ করে থাকে। আমরা পাঠকদেরকে অনুরোধ করবো নাস্তিকদের অপপ্রচারে বিভ্রান্ত না হয়ে নিজে উদ্যোগী হয়ে মূল উৎস থেকে বিষয়গুলো অধ্যায়ন করতে।
টিকাসমুহ :
[1]ইবনু সাদ, আত-তবাকাতুল কুবরা (8/62); আল-হাকিম, আল-মুস্তাদরাক (4/5); আত-তাবারী, আত-তারিখ (11/601); আত-তাবারানী, আল-মুজামুল কাবির (23/24); ইবনু আব্দিল বার, আল-ইস্তিয়াব (4/1936); ইবনু হাজার, আল-ইসাবাহ (8/391); ইবনুল আছির, আসাদুল গাবাহ (6/332); …… ইত্যাদি ইত্যাদি।
[2]ইবনু হাজার, তাকরিবুত তাহযিব (রাবি/8592)।
[3]ইবনু হাজার, তাকরিবুত তাহযিব (রাবি/6175)।
[4]আল-হুয়াইনী, নাছলুন নাবাল (4/573)।
[5]ইবনু হাজার, তাকরিবুত তাহযিব (রাবি/5815)।
[6]সুনানু ইবনে মাজাহ (হা/3324),সুনানু আবি দাউদ (হা/3903),সুনানুন নাসাঈ আল-কুবরা (হা/6691),মুসনাদু আবি ইয়ালা (হা/4558) ইত্যাদি ইত্যাদি।
[7]এই হাদিসটি সহিহ অথবা হাসান । শায়খ আল-আলবানী "আস-সহিহাহ"(1/123) তে এবং শায়খ আল-আরনাওওত সুনানু ইবনে মাজাহর টিকাতে (4/436, টিকা নং 1) এই হাদিসটিকে "সহিহ" বলেছেন। শায়খ আল-হারারী "শারহু সুনানে ইবনে মাজাহ"(19/347) তে হাদিসটিকে হাসান বলেছেন।