বিষয় : জাবির বিন হাইয়ান এর ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কিত আপত্তিসমুহের খন্ডন।
লেখক : সামিউল হাসান তবিব আল-ইনফিরাদী
0. সুচিপত্র :-
1. ভূমিকা।
2. প্রকৃতপক্ষে জাবির একজন সুন্নি সুফি মুসলিম ছিলেন।
3. জাবির বিন হাইয়ান কি যাদুকর ছিলেন?
4. প্রাচীন কিমিয়াশাস্ত্রের সমস্যাসমুহ এবং জাবির।
5. জাবির প্রসঙ্গে ইবনু তাইমিয়াহর সমালোচনা।
6. জাবির কি একজন শিয়া ছিলেন?
7. জাবির একজন ইমানদার মুসলিম হিসেবে মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
8. পরিশিষ্ট।
9. টিকাসমুহ।
1.ভূমিকা :-
প্রসিদ্ধ মুসলিম রসায়নবিদ 'জাবির বিন হাইয়ান'এর ধর্মবিশ্বাসের ব্যাপারে বিভিন্ন রকমের আপত্তি ও অভিযোগ আনা হয়ে থাকে, যেমন ; তিনি নাকি যাদুবিদ্যাচর্চাকারী ছিলেন, শিয়া ছিলেন! এই লেখাটিতে, জাবির বিন হাইয়ান এর প্রকৃত ধর্মীয় আকিদাহ-বিশ্বাস কি ছিলো তা নির্ণয় ও বর্ণনা করাপুর্বক তাঁর ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে আনীত অভিযোগসমুহের জবাব প্রদান করা হবে, ইনশাল্লাহ।
2. প্রকৃতপক্ষে জাবির একজন সুন্নি সুফি মুসলিম ছিলেন :-
প্রথমত, 'জাবির বিন হাইয়ান ' এর ব্যাপারে প্রসিদ্ধ হলো এই, যে তিনি একজন 'সুফী' মুসলিম ছিলেন।
ইতিহাসবিদ "আবুল-ফারাজ ইবনুন-নাদিম আল-ওয়াররাক্ব" জাবির প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছেন যে,
هو أبو عبد الله جابر بن حيان بن عبد الله الكوفي المعروف بالصوفي_[1]
অর্থ : এবং তিনি আবু-আব্দুল্লাহ জাবির বিন হাইয়ান বিন আব্দুল্লাহ আল-কুফী, যিনি কিনা 'সুফী' বলে প্রসিদ্ধ।
ইতিহাসবিদ "খাইরুদ্দিন বিন মাহমুদ আয-যিরকিলী" জাবির সম্পর্কে লিখেছেন যে,
جابر بن حيان بن عبد الله الكوفي، أبو موسى: فيلسوف كيميائي، كان يعرف بالصوفي_[2]
অর্থ : জাবির বিন হাইয়ান বিন আব্দুল্লাহ আল-কুফী, আবু-মুসা: দার্শনিক কিমিয়াবিদ, সুফী বলে প্রসিদ্ধ ছিলেন।
দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন সুন্নী মুসলিম ইতিহাসবিদরা 'জাবির বিন হাইয়ান' সম্পর্কে বলেছেন যে তিনি (জাবির) একজন "সুফী মুসলিম" ছিলেন। উদাহরণস্বরুপ,
"আবুল-কাসিম সঈদ আল-আন্দালুসী" জাবির সম্পর্কে লিখেছেন যে,
جابر بن حيان الصوفي ....وكان متقلدا للعلم معروف بعلم الباطن وهو مذهب المتصوفين من أهل الإسلام كالحرث بن أسد المحاسبي وسهل بن عبد اللّٰه التستري ونظائرهم [3]
অর্থ : সুফি জাবির বিন হাইয়ান …এবং তিনি (জাবির) একটি ইলমের অনুসারী ছিলেন যেটাকে ইলমে বাতেন বলা হয়, এবং তা হচ্ছে ইসলামের অনুসারিদের অন্তর্ভুক্ত সুফিদের মাযহাব, যেমন : আল-হারছ বিন আসাদ আল-মুহাসিবী ও সাহল বিন আব্দুল্লাহ আত-তুসতারী ও তাদের অনুরুপ ব্যাক্তিরা।
"জামালুদ্দিন আবুল-হাসান আলি আল-কিফতী" জাবির সম্পর্কে লিখেছেন যে,
جابر بن حيان الصوفي الكوفي كَانَ ...،متقلداً للعلم المعروف بعلم الباطن وهو مذهب المتصوفين من أهل الإسلام كالحارث بن أسد المجاشي وسهل بن عبد الله التستري ونظرائهم ..[4]
অর্থ : সুফি জাবির বিন হাইয়ান …এবং তিনি (জাবির) একটি ইলমের অনুসারী ছিলেন যেটাকে ইলমে বাতেন বলা হয়, এবং তা হচ্ছে ইসলামের অনুসারিদের অন্তর্ভুক্ত সুফিদের মাযহাব, যেমন : আল-হারছ বিন আসাদ আল-মাজাশী ও সাহল বিন আব্দুল্লাহ আত-তুসতারী ও তাদের অনুরুপ ব্যাক্তিরা।
কাতেবে হালবী "হাজি খালিফাহ মুস্তফা আল-উসমানী" জাবির সম্পর্কে লিখেছেন যে,
شيخ الصِّناعة وأُستاذ الجماعة أبو موسى جابر بن حَيَّان بن عبد الله الأَزْدي الكوفي مولداً الطُّوسي منشأً الصُّوفي...... كان متقلداً لعلم الباطن أي مذهب المتصوفين_[5]
অর্থ : শায়খুস সানায়াহ উসতাযুজ জামায়াহ আবু-মুসা জাবির বিন হাইয়ান বিন আব্দুল্লাহ আল-আযদী, জন্মগতভাবে আল-কুফী, বেড়ে উঠেছেন আত-তুসী হিসেবে, আস-সুফী … তিনি ইলমুল-বাতেন তথা সুফি ধারার অনুসারী ছিলেন।
তৃতীয়ত, বিভিন্ন সুন্নি মুসলিম ইতিহাসবিদরা জাবিরের নামটি উল্লেখ্য করার ক্ষেত্রে, তাঁর নামের সহিত 'সুফী' উপাধীটি ব্যবহার করার দ্বারা তাঁকে একজন 'সুফী' সাব্যস্ত করেছেন। উদাহরণস্বরুপ ; _[6]
"ইবনু খাল্লিকান" জাবিরকে 'সুফী' বলেছেন। [6]
"ইবনু আবি-উসাইবায়াহ" জাবিরকে 'সুফী' বলেছেন। [7]
"আফিফুদ্দিন আল-ইয়াফিয়িঈ " জাবিরকে 'সুফী' বলেছেন।[8]
"সালাহুদ্দিন আস-সিফদী" জাবিরকে 'সুফী' বলেছেন।[9]
"ইবনুল-আমাদ আল-হাম্বলী" জাবিরকে 'সুফী' বলেছেন।[10]
"ইবনু ফাদ্বলিল্লাহ আল-আমরী" জাবিরকে 'সুফী' বলেছেন।[11]
"আব্দুল-লতিফ আল-বাগদাদী" জাবিরকে 'সুফী' বলেছেন।[12]
"আল-খাতিবুত তিব্রিযী" জাবিরকে 'সুফী' বলেছেন।[13]
"আত-তাইব আল-হিজরানী" জাবিরকে 'সুফী' বলেছেন।[14]
"সিদ্দিক হাসান খান" জাবিরকে 'সুফী' বলেছেন। [15]
উল্লেখ্য যে, জাবির বিন হাইয়ান, যেমন তেমন সুফি ছিলেন না, তিনি আত-তুসতারী ও আল-হারছ বিন সাদ এর মতো সুফিদের অনুরূপ একজন সুফি ছিলেন,যা সঈদ ও আল-কিফতীর বক্তব্য দ্বারা প্রমাণিত হয়। সুফিদের কিছু উপদল আছে প্রচন্ড ভ্রষ্টতাপুর্ণ, তবে আত-তুসতারী ও আল-হারছ বিন সাদ যেই ধারার সুফিবাদের অনুসারী ছিলেন সেই ধারার সুফিবাদ তেমন সমস্যাযুক্ত নয়।
3. জাবির বিন হাইয়ান কি যাদুবিদ্যাচর্চাকারী ছিলেন? :-
"জাবির বিন হাইয়ান"এর ব্যাপারে কিছু ইতিহাসবিদরা এইমর্মে অভিযোগ এনেছেন, যে তিনি নাকি যাদুবিদ্যাচর্চা করতেন, তিনি নাকি একজন বড় যাদুকর ছিলেন। এবং অনেকে আবার এটাও বলেছেন যে, কিমিয়াশাস্ত্রে এক জিনিস কে আরেক জিনিসে পরিণত করতে নাকি যাদুবিদ্যা ব্যবহার করা হয়, কাজেই জাবিরের কিমিয়াচর্চা করাটাও যাদুবিদ্যাচর্চারই অন্তর্ভুক্ত।
এই জাতীয় অভিযোগ যাঁরা এনেছেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলেন 'ইবনু খালদুন'। 'ইবনু খালদু' তাঁর "আল-মুকাদ্দিমাহ" গ্রন্থে, এবং "দিওয়ানুল মুবতাদা" গ্রন্থে জাবিরের ব্যাপারে উপরে উল্লেখিত এসব অভিযোগ ব্যাক্ত করেছেন। [16]
শেষের দিকের অভিযোগটি ভিত্তিহীন ও ভুল। কেননা কিমিয়াশাস্ত্রে এক জিনিসকে আরেক জিনিসে পরিণত করতে মোটেও কোনো যাদুবিদ্যার আশ্রয় নেয়া হতোনা, বরং নিছকই কিছু রাসায়নিক কৌশল ও বিক্রিয়া ব্যবহার করা হতো। তৎকালীন মানুষরা এই আশ্চর্যজনক রসায়নের খেলাকে বোঝতে না পেরে যাদু বলে ধরে নিয়েছিলো, তবে বর্তমানে আমরা জানি যে, এসব মোটেও কোনো যাদু ছিলোনা। তাছারা, কিমিয়াবিদরা অন্যান্য জিনিস হতে যেসব মুল্যবান ধাতু তৈরি করতেন, সেগুলো আসল ছিলোনা, বরং নকল ছিলো, সেগুলো মুল্যবান ধাতুসমুহের বিভিন্ন নকল সংস্করণ ছিলো।
এবং জাবিরের যাদুবিদ্যাচর্চাকারী হয়া প্রসঙ্গে আমি বলব যে,
"জাবির বিন হাইয়ান যাদুবিদ্যা চর্চা করেছিলেন, কিন্ত পরবর্তিতে তিনি যাদুবিদ্যাচর্চা ত্যাগ করে ধার্মিকতার দিকে ফিরে এসেছিলেন।"
আমার উক্ত দাবিটির পক্ষে নিম্নে যুক্তি-প্রমাণ উপস্থাপন করা হলো।
"জাবির বিন হাইয়ান যাদুবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা ও ঘাটাঘাটি করে যাদুবিদ্যা সম্পর্কিত একাধিক বই লিখেছিলেন। তারপর তিনি অন্যান্য বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন বই লিখেন। এবং তারপর তিনি যুহদ ও ওয়ায বিষয়ক একাধিক বই লিখেন এবং শরিয়তের বিধিবিধান বিষয়ক প্রচুর সংখ্যাক বই লিখেন। তারপর তিনি যাদুবিদ্যার সহিত অসম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিভিন্ন বই লিখেন। এবং তারপর উনার বই লেখার ধারাবাহিকতা শেষ হয়ে যায় ও উনি আর কোনো বই লিখেন না " _[17]
লক্ষ্য করুন, তিনি যাদুবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা ও চর্চা করার পরবর্তীকালে যুহদ,ওয়ায ও শরিয়তের বিধিবিধান নিয়ে পড়াশোনা ও চর্চা করেছেন। যুহদ মানে হলো চরম পর্যায়ের ধার্মিকতা, ওয়ায মানে হলো ভালো ভালো ইসলামি উপদেশ প্রদান , আর শরিয়তের বিধিবিধান মানে কি তা তো স্পষ্টই।
জাবির বিন হাইয়ান একজন সুফী ছিলেন, এবং যথেষ্ট ভালো ধারার সুফি ছিলেন, সুফীরা নিজেদের মধ্যে যুহদ কে ধারন করে, সুতরাং একজন সুফী হিসেবে জাবিরও নিজের মধ্যে যুহদ কে ধারনকারী ছিলেন, সুতরাং জাবির শুধুমাত্র যুহদ নিয়ে পড়াশোনা ও চর্চাই করেন নি, বরং যুহদ কে নিজের মধ্যে ধারনও করেছেন। আর যে নিজের মধ্যে যুহদ কে ধারন করে, অর্থাৎ চরম মাত্রার ধার্মিকতাকে ধারন করে, সে শরিয়তের বিধানসমুহ মানতে অবশ্যই বাধ্য। সুতরাং, জাবির যে শুধুমাত্র শরিয়তের বিধিবিধানসমুহ নিয়ে পড়াশোনা ও চর্চাই করেছেন ব্যাপারটা এমন নয়, বরং এরপাশাপাশি তিনি শরিয়তের বিধানগুলোকে মান্যকারীও ছিলেন। আর ইসলামে যাদুবিদ্যাচর্চা কোনোভাবেই বৈধ নয়।
সুতরাং বলা যায় যে, যাদুবিদ্যাচর্চার পরবর্তী সময়ে জাবির যখন যুহদচর্চা করছিলেন, শরিয়তের বিধিবিধান সম্পর্কিত জ্ঞানচর্চা করছিলেন, ওয়াযচর্চা করছিলেন ; তখন তিনি যাদুবিদ্যাচর্চাকে ত্যাগ করেছিলেন। যাদুবিদ্যাচর্চা হতে তওবাহ করে ফিরে এসেছিলেন। কেননা যুহদ-ওয়ায ও শরিয়তের বিধিবিধান এসব বিষয় যাদুবিদ্যার সহিত সাংঘর্ষিক, যাদুবিদ্যার বিরোধী, যুহদ ধারন করতে হলে যাদুবিদ্যাকে পরিত্যাগ করা একটা পুর্বশর্ত, শরিয়তের বিধিবিধান মানতে হলে যাদুবিদ্যাকে ত্যাগ করা আবশ্যক।
মোদ্দাকথা : জাবির যাদুবিদ্যাচর্চা করেছিলেন, কিন্ত পরবর্তীতে তিনি যাদুবিদ্যা বাদ দিয়ে যুহদ, ওয়ায ও শরিয়তের বিধিবিধানের প্রতি মনোনিবেশ করেছিলেন।
4. প্রাচীন কিমিয়াশাস্ত্রের সমস্যাসমুহ ও জাবির :-
বিভিন্ন উলামারা প্রাচীন কিমিয়াশাস্ত্র ও কিমিয়াবিদদের ব্যাপারে কঠোর সমালোচনা করেছেন। এরই প্রেক্ষিতে অনেকে, জাবিরকে সমালোচনা করেছেন, জাবিরের ব্যাপারে বিভিন্ন নেতিবাচক কথা বলেছেন, যেমন ; সালাহুদ্দিন আস-সিফদী, জাবিরের কিমিয়া চর্চা করার কারণে তিনি কড়া ভাষায় জাবিরের সমালোচনা করেছেন (অবশ্য তিনি জাবিরকে তাকফির করেন নি)।_[18]
কিমিয়াশাস্ত্র ও কিমিয়াবিদদের সমালোচনা করার পিছনে কারণসমুহ হলো,
১. কিমিয়াশাস্ত্রকে যাদু মনে করা হতো। ও কিমিয়াবিদদের যাদুবিদ্যাচর্চাকারী ভাবা হত।
২. কিমিয়াশাস্ত্র কে এক ধরনের প্রতারণা ভাবা হতো। কিমিয়াবিদদের প্রতারক ভাবা হতো। কেননা কিমিয়াবিদরা বিভিন্ন মুল্যবান ধাতুর নকল জাল রুপ তৈরি করতেন।
প্রথম কারণটা ভুল, কিমিয়াশাস্ত্রে কোনো যাদুবিদ্যা প্রয়োগ করা হতোনা, কাজেই শুধুমাত্র কিমিয়া চর্চা করলেই কেও যাদুবিদ্যাচর্চাকারী হয়ে যায়না, অবশ্য অনেক কিমিয়াবিদরা কিমিয়া ছাড়াও অন্যান্য বিভিন্ন যাদুবিদ্যাচর্চা করতেন, তবে তা ভিন্ন বিষয়, জাবিরের অন্যান্য ধারার যাদুবিদ্যাচর্চা করা নিয়ে ইতিমধ্যে আলোচনা গত হয়েছে।
দ্বিতীয় কারণ টা ঠিকাছে, কেননা অনেক কিমিয়াবিদরা বিভিন্ন নকল জাল মুল্যবান ধাতুকে খাঁটি বলে মিথ্যাচার করে মানুষদের সহিত প্রতারণা করতেন। কিন্ত কিমিয়ার ক্ষেত্রে মুল্যবান ধাতুর নকল বা জাল রূপ তৈরি করার মানেই এই না যে এটা প্রতারণা। বরং এটা তখন প্রতারণা হবে যখন উক্ত জাল জিনিসগুলোকে খাঁটি বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হবে। অনেক কিমিয়াবিদরা এইভাবে প্রতারণা করতেন, কিন্ত জাবির ও যে এইজাতীয় প্রতারণা করতেন, তা প্রমাণিত নয়। জাবির ছিলেন একদম প্রথম দিকের একজন কিমিয়াবিদ, কাজেই পরবর্তীতে আসা মুল-ধারার কিমিয়াবিদ সমাজে যেই প্রতারণার প্রবণতা প্রচলিত ছিলো, তা যে জাবিরের মাঝেও থাকতে হবে, এমন কোনো নিশ্চয়তা নাই। আর যদি ধরেও নেই যে জাবির প্রতারক ছিলেন, তাহলে এরদ্বারা নিছক এতটুকু প্রমাণিত হয় ও সাব্যস্ত হয় যে জাবির একজন পাপিষ্ট ছিলেন, এরদ্বারা জাবির কাফের বা অমুসলিম সাব্যস্ত হন না। প্রতারণা করা একটা বড় ধরনের কবিরাহ গুনাহ ও হারাম কাজ ; কিন্ত এটা কুফুরি না, এটা করলে অনেক গুনাহ হবে, তবে এতে কেও কাফের হয়ে যাবেনা।
5. জাবির প্রসঙ্গে ইবনু তাইমিয়াহর সমালোচনা :-
কিমিয়াশাস্ত্রের সমালোচনা করতে করতে কথাপ্রসঙ্গে শায়খুল ইসলাম 'তাকিউদ্দিন আবুল-আব্বাস ইবনু তাইমিয়াহ ' জাবির সম্পর্কে একস্থানে বলেছেন যে,
وَأَمَّا جَابِرُ بْنُ حَيَّانَ صَاحِبُ الْمُصَنَّفَاتِ الْمَشْهُورَةِ عِنْدَ الْكِيمَاوِيَّةِ فَمَجْهُولٌ لَا يُعْرَفُ وَلَيْسَ لَهُ ذِكْرٌ بَيْنَ أَهْلِ الْعِلْمِ وَلَا بَيْنَ أَهْلِ الدِّينِ_[19]
অর্থ : যদি কথা আসে জাবির বিন হাইয়ান প্রসঙ্গে, সে কিমিয়াবিদদের নিকট বহু প্রসিদ্ধ গ্রন্থের লেখক, এবং সে একজন অপরিচিত অজ্ঞাত ব্যাক্তি, তাকে চেনা যায়না, এবং আহলুল-ইলম ও আহলুদ-দীন এর মাঝে তার উল্লেখ্য পাওয়া যায়না।
পর্যালোচনা : শায়খুল ইসলাম এক্ষেত্রে একদম স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে উনার দৃষ্টিতে জাবির একজন অজ্ঞাত ব্যাক্তি, উনি জাবির সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য খুজে পান নাই। অর্থাৎ উনার নিকট জাবির সম্পর্কিত যথেষ্ট পরিমাণ তথ্য পৌছেনি। কাজেই উনার এই বক্তব্যটিকে জাবিরের বিরুদ্ধে উল্লেখ্য করার যৌক্তিকতা নেই।
6. জাবির কি একজন শিয়া ছিলেন? :-
জাবিরের ব্যাপারে বলা হয়ে থাকে যে, তিনি নাকি একজন শিয়া ছিলেন। তো প্রশ্ন হলো, এই দাবিটির উৎস কী? এই দাবির উৎস হচ্ছে স্বয়ং শিয়ারাই। অর্থাৎ, শিয়ারা দাবি করে থাকে যে জাবির একজন শিয়া। আর শিয়াদের উক্ত দাবিকে প্রমাণ ও উৎস ধরেই বলা হয়ে থাকে যে, জাবির একজন শিয়া ছিলেন।
জাবিরের শিয়া হয়া প্রসঙ্গে "ইবনুন-নাদিম" বলেছেন যে :
"واختلف الناس في أمره فقالت الشيعة إنه من كبارهم وأحد الأبواب وزعموا أنه كان صاحب جعفر الصادق رضي الله عنه"[20]
"এবং মানুষজন তার (জাবিরের) ব্যাপারে মতভেদ করেছে। শিয়ারা বলেছে যে তিনি তাদের অন্তর্ভুক্ত বড়পর্যায়ের ব্যাক্তিদের অন্তর্ভুক্ত ও বাবদের একজন। এবং তারা দাবি করেছে যে তিনি জাফর আস-সাদিক রাদিয়াল্লাহু আনহু এর ঘনিষ্ঠ ছাত্র ছিলেন"
বিভিন্ন সুন্নি ইতিহাসবিদরা বলেছেন যে জাবির একজন সুন্নি সুফি মুসলিম ছিলেন। সেসব ইতিহাসবিদদের মধ্যে আছেন : সঈদ, আল-কিফতী, হাজি খালিফাহ, ইবনু খাল্লিকান, ইবনু আবি-উসাইবায়াহ, আল-ইয়াফিয়িঈ, আস-সিফদী, ইবনুল-আমাদ, ইবনু ফাদ্বলিল্লাহ, আব্দুল-লতিফ, আত-তিবরিযী, আল-হিজরানী এবং সিদ্দিক হাসান। পক্ষান্তরে শিয়াদের দাবি, জাবির একজন সুফি নন বরং শিয়া ছিলেন। আমাদের (সুন্নি মুসলিমদের) নিকট সুন্নি ইতিহাসবিদদের বক্তব্যই অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত। অর্থাৎ যেসব সুন্নি ইতিহাসবিদরা জাবিরকে সুফি বলেছেন, তাদের কর্তৃক জাবিরকে সুফি বলা, শিয়াদের কর্তৃক জাবিরকে শিয়া বলার উপর অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত। সুতরাং, সুন্নি ইতিহাসবিদদের বক্তব্যের সহিত সাংঘর্ষিক হয়ার কারণে, শিয়াদের উক্ত দাবিটি অগ্রহণযোগ্য, অনির্ভরযোগ্য, ভুল ও বাতিল।
7. জাবির একজন ইমানদার মুসলিম হিসেবে মৃত্যুবরণ করেছিলেন :-
জাবির বিন হাইয়ান যে একজন ইমানদার মুসলিম হিসেবে মৃত্যুবরণ করেছেন, এইমর্মে কোনো মুসলিম ইতিহাসবিদের সরাসরি মন্তব্য নেই। তবে ইতিহাসবিদ "ইবনু শাকির আল-কাতবী" জাবিরের মৃত্যু সম্পর্কে এমন একটি মন্তব্য করেছেন যাদ্বারা পরোক্ষভাবে এটা প্রমাণিত হয় যে জাবির ইমানদার মুসলিম হিসেবেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
ইতিহাসবিদ "ইবনু শাকির আল-কাতবী" জাবির সম্পর্কে লিখেছেন যে,
وكانت وفاته في حدود التسعين والمائة، رحمه الله تعالى وعفا عنه._[21]
অর্থ : এবং তাঁর (জাবিরের) মৃত্যু একশত নব্বই (হিজরি) এর মাঝেই হয়ে গিয়েছিলো। রহিমাহুল্লাহু তায়ালা ওয়া আফা আনহু (আল্লাহ তার প্রতি রহম করুক ও তাকে ক্ষমা করুক)।
স্পষ্টতই, এক্ষেত্রে ইবনু শাকির মৃত জাবির এর জন্য রহমতের দোয়া করেছেন। আর এটা জানা কথা যে রহমতের দোয়া শুধুমাত্র তাদের জন্যই করা যায় যারা কিনা অন্ততপক্ষে ইমান নিয়ে মুসলিম অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে। যারা ইমানহীনভাবে মারা গিয়েছে তাদের জন্য রহমতের দোয়া করা যায়েয নয়। সুতরাং বলা যায় যে, ইবনু শাকিরের দৃষ্টিতে, জাবির এমন একজন ব্যাক্তি ছিলেন, যিনি কিনা ইমানদার মুসলিম হিসেবে মৃত্যুবরণ করেছেন। আর এক্ষেত্রে অন্য কোনো মুসলিম ইতিহাসবিদকে ইবনু শাকিরের উক্ত দৃষ্টিভংগির বিরোধী কিছু বলতে দেখা যায়না।
8. পরিশিষ্ট :-
মোদ্দাকথা, জাবির বিন হাইয়ানের ব্যাপারে বলা হয়ে থাকে যে তিনি নাকি যাদুবিদ্যাচর্চাকারী ছিলেন, এই দাবিটি সঠিক, তবে এরসাথে এটাও সঠিক যে তিনি যাদুবিদ্যাচর্চাকে পরবর্তীতে ত্যাগ করেছিলেন। কিমিয়াশাস্ত্র যাদুবিদ্যাচর্চার অন্তর্ভুক্ত নয়।জাবিরের ব্যাপারে শিয়ারা দাবি করে যে তিনি শিয়া ছিলেন, শিয়াদের এই দাবি অগ্রহণযোগ্য ভিত্তিহীন কেননা দাবিটী সুন্নি ইতিহাসবিদদের দৃষ্টিভংগির সহিত সাংঘর্ষিক।
9.টিকাসমুহ :-
[1]ইবনুন-নাদিম, আল-ফিহরিসিত (পৃ/435)
[2]আয-যিরকিলী,আল-আ'লাম (2/103)
[3]আবুল-কাসিম সঈদ, তবাকাতুল উমাম (পৃ/61)
[4]আল-কিফতী,ইখবারুল উলামা (পৃ/124)
[5]হাজি খালিফাহ,সিলমুও উসুল (1/405)
[6]ইবনু খাল্লিকান,ওফইয়াতুল আ'ইয়ান (1/327)
[7]ইবনু আবি উসাইবায়াহ ,উয়ুনুল আনবা (পৃ/685)
[8]আল-ইয়াফিয়িঈ,মারাতুল জুনান (1/138)
[9]আস-সিফদী, আল-ওয়াফী বিল-ওয়াফইয়াত (19/76)
[10]ইবনুল আমাদ, শাযারাতুয যাহাব (2/216)
[11]ইবনু ফাদ্বলিল্লাহ, মাসালিকুল আবসার (9/137)
[12]উয়ুনুল আনবা (পৃ/685),আল-ওয়াফী বিল-ওয়াফইয়াত (19/76),মাসালিকুল আবসার (9/137)
[13]আত-তিবরিযী,আল-ইকমাল (পৃ/173)
[14]আত-তাইব,কালাদাতুন নাহার (2/165)
[15]সিদ্দিক হাসান, আবজাদুল উলুম (পৃ/492)
[16]ইবনু খালদুন, দিওয়ানুল মুবতাদা (1/655-656,696,633) এবং আল-মুকাদ্দিমাহ (2/251)
[17] ইবনুন-নাদিম, আল-ফিহরিসিত (পৃ/436-438)
[18]আস-সিফদী, আল-ওয়াফি বিল ওয়াফিইয়াত (11/27-28)
[19]ইবনু তাইমিয়াহ, মাজমুয়ুল ফাতাওয়া (29/374)
[20]ইবনুন-নাদিম, আল-ফিহরিসিত (পৃ/435)
[21]ইবনু শাকির, ফাওয়াতুল ওয়াফিইয়াত (1/275)