Are you sure?

ইতিহাস »  বিবিধ ইতিহাস

আবু বকর মুহাম্মাদ বিন জাকারিয়া আল-রাযীর ধর্ম বিশ্বাস কি ছিলো?

بِسْمِ ٱللَّٰهِ ٱلرَّحْمَٰنِ ٱلرَّحِيمِ

এই লেখাটিতে মুসলিম ইতিহাসবিদরা 'আবু-বকর মুহাম্মদ বিন ইয়াহইয়া বিন জাকারিয়া আর-রাযী' এর ব্যাপারে যেসমস্ত তথ্য উল্লেখ্য করেছেন; সেগুলোর উপর ভিত্তি করে আর-রাযীর প্রকৃত ধর্ম বিশ্বাস কি ছিল, তা নির্ণয় করা হবে। এই আলোচনাটিকে আমি তিনটি ভাগে বিন্যাস্ত করব। প্রথম ভাগে আর-রাযীর সহিত যেসমস্ত ইসলাম-বিরোধী গ্রন্থসমূহের সম্পৃক্ততা দাবি করা হয়, সেগুলোর ব্যাপারে আলোচনা করা হবে। দ্বিতীয় ভাগে রাযীর ধর্মবিশ্বাস কি ছিলো, সে ব্যাপারে আলোচনা করা হবে। লেখার তৃতীয় ভাগে আর-রাযী কোন ধর্মে বিশ্বাসী থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরন করেছিলেন, সে ব্যাপারে আলোচনা করা হবে।

 

প্রথম ভাগ - আর-রাযীর দিকে সম্পৃক্ত করা ইসলাম বিরোধী গ্রন্থসমুহ প্রসঙ্গে –

আর-রাযীর দিকে সম্পৃক্ত করা ইসলাম-বিরোধী গ্রন্থসমূহ: 

আর-রাযীর দিকে মোট ৪ টি ইসলাম-বিরোধী গ্রন্থসমূহের সম্পৃক্ততা দাবি করা হয়ে থাকে।

  • . "মাখারিক্বুল আনবিয়া"(مخاريق الأنبياء)। গ্রন্থটির শিরোনাম 'مخاريق الأنبياء' মানে হলো 'নবিদের প্রতারনা-দোষসমূহ'। 'আল-মুতহির বিন তাহির আল-মাকদিসী' তাঁর 'আল-বাদয়ু ওয়াত তারিখ' গ্রন্থে আর-রাযীর দিকে এই গ্রন্থটিকে সম্পৃক্ত করেছেন।[1] 'নিযামুল-মুলক আল-হাসান বিন আলি আত-তুসী' তাঁর 'সিয়াসাত নামাহ' গ্রন্থে আর-রাযীর দিকে উক্ত গ্রন্থটিকে সম্পৃক্ত করেছেন।[2] আর-রাযীর শত্রু 'আলি বিন রিদ্বওয়ান আল-মাসরী' উক্ত গ্রন্থটিকে আর-রাযীর দিকে সম্পৃক্ত করেছেন। এমনটা ইবন আবি-উসাইবায়াহর 'উয়ুনুল আনবা' গ্রন্থে বলা হয়েছে।[3] 
  • ২. হিয়ালুল-মুতানাব্বিইন (حيل المتنبيين)। গ্রন্থটির শিরোনাম 'حيل المتنبيين' মানে হলো 'নবুওয়াত দাবিদারদের কৌশল'। 'আবুর-রাইহান আল-বিরুনী' তাঁর 'রিসালাহ ফি ফাহরাসাতে কুতুবে মুহাম্মদ বিন জাকারিয়া আর-রাযী' গ্রন্থে এই গ্রন্থটিকে আর-রাযীর দিকে 'প্রচলিত বিশ্বাস বিরোধী' একটি গ্রন্থ হিসেবে সম্পৃক্ত করেছেন ও বলেছেন। 'It was claimed as attacking the necessity of the prophets'.[4[5] আধুনিক যুগে যারা আর-রাযীর দিকে উক্ত গ্রন্থটিকে সম্পৃক্ত করেছেন, তাদের অনেকে হিয়ালুল মুতানাব্বিইন ও মাখারিক্বুল আনবিয়া-কে একই গ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করেছেন। অর্থাৎ একটা গ্রন্থের দুইটা নাম, 'হিয়ালুল মুতানাব্বিইন' ও মাখারিক্বুল আনবিয়া।[6]
  • ৩. ফিন-নাবুওয়াত (في النبوات) গ্রন্থটির শিরোনাম 'في النبوات' মানে হলো 'নবুওয়াত সমূহ প্রসঙ্গে। আবুর-রাইহান আল-বিরুনী' তাঁর 'রিসালাহ ফি ফাহরাসাতে কুতুবে মুহাম্মদ বিন জাকারিয়া আর-রাযী' গ্রন্থে এই গ্রন্থটিকে আর-রাযীর দিকে 'প্রচলিত বিশ্বাস বিরোধী' একটি গ্রন্থ হিসেবে সম্পৃক্ত করেছেন ও বলেছেন। 'It was claimed to be against religions.[7]
  • ৪. কিতাব ফিমা ইয়ারিদ বিহি ইযহারু মা ইয়াদআ মিন উয়ুবিল আনবিয়া (كتاب فيما يرد به اظهار مايدعى من عيوب الأنبياء): বইটির শিরোনাম "كتاب فيما يرد به اظهار ما يدعى من عيوب الأنبياء" এর মর্ম হচ্ছে অনেকটা এরকম যে, এমন একটি বই যেখানে নবিদের বহু দোষ-ক্রুটি প্রকাশ ও উল্লেখ্য করা হয়েছে। দাবি করা হয় যে 'আবুল-ফারাজ ইবনুন-নাদিম' তাঁর 'আল-ফাহরাসাত'  গ্রন্থে বলেছেন যে আর-রাযী তাঁর নিজ 'ফাহরাসাত' এ এই বইটির নাম উল্লেখ্য করেছেন।[7]

 

দ্বিতীয় শ্রেনী - আর-রাযীর সহিত উক্ত ৪ টি গ্রন্থের সম্পৃক্ততা ভুল ও মিথ্যা:

এই চারটি বইয়ের ব্যাপারে নির্দিষ্টভাবে আলোচনা আরম্ভের পূর্বে কিছু সর্বজনীন বিষয় উল্লেখ্য করা প্রয়োজন মনে করছি। আবু-বকর মুহাম্মদ বিন জাকারিয়া আর-রাযী তাঁর নিজের লিখিত গ্রন্থগুলোর ব্যাপারে একটি 'ফাহরাসাত' লিখেছেন। অর্থাৎ তিনি তাঁর নিজের লিখিত গ্রন্থগুলোর নাম উল্লেখ্য করে ছোট বই আকারে একটি তালিকা লিখেছেন।'আবুল-ফারাজ ইবনুন-নাদিম আল-ওয়াররাক্ব' এবং 'জামালুদ্দিন আবুল-হাসান আল-কিফতী' আর-রাযীর লিখিত উক্ত 'ফাহরাসাত' বইটি পেয়েছিলেন। আর-রাযীর লিখিত 'ফাহরাসাত' গ্রন্থে যত বইয়ের নাম আছে; তার সবই ইবনুন-নাদিম তাঁর 'আল-ফাহরাসাত' গ্রন্থে এবং আল-কিফতী তাঁর "ইখবারুল উলামা" গ্রন্থে উল্লেখ্য করেছেন।[8] আর-রাযী তাঁর "ফাহরাসাত" বইয়ে "মাখারিক্বুল আনবিয়া" বা "হিয়ালুল মুতানাব্বিইন " বা "ফিন-নাবুওয়াত" নামের কোনো ইসলাম-বিরোধী বইয়ের কথা উল্লেখ্য করেন নি। এর সহজ অর্থ হলো আর-রাযী জানতেন না যে, তিনি  "মাখারিক্বুল আনবিয়া" বা "হিয়ালুল মুতানাব্বিইন" বা "ফিন-নাবুওয়াত" নামের কোনো গ্রন্থ লিখেছেন। কেননা যদি তিনি জানতেন, তাহলে তিনি এগুলোর নাম তাঁর 'ফাহরাসাত' গ্রন্থে অবশ্যই-অবশ্যই উল্লেখ্য করতেন। 'ফাহরাসাত' এমন কোনো তালিকাগ্রন্থ না; যেখানে কিছু বই না উল্লেখ্য করে থাকা যায়। বরং 'ফাহরাসাত' এ জানতে পারা বা জানা থাকা সকল বইয়ের নামই উল্লেখ্য করা হয় বা করতে হয়। আল-মুতহির, নিযামুল-মুলক, আর-রাযির শত্রু আলি বিন রিদ্বওয়ান-সহ আর-রাযির অন্যান্য কিছু শত্রুরা জানতেন যে, আর-রাযী "মাখারিক্বুল আনবিয়া" লিখেছেন। আল-বিরুনী জানতেন যে, আর-রাযী 'হিয়ালুল মুতানাব্বিইন' ও 'ফিন-নাবুওয়াত' লিখেছেন। কিন্ত আর-রাযী নিজে এটা জানতেন না যে, তিনি এই তিনটি গ্রন্থ লিখেছেন! ব্যাপার‍টা রোমাঞ্চকর না!

অপরদিকে 'আবুল-আব্বাস ইবন আবি-উসাইবায়াহ' তাঁর 'উয়ুনুল আনবা' গ্রন্থে বলেছেন যে, আর-রাযী এমন কোনো ব্যাক্তি ছিলেন না; যে কিনা এই ধরনের ইসলাম-বিরোধী কাজ করার চেষ্টা করতে বা ইসলাম-বিরোধী বই লিখতে পারে।[3]

প্রথম গ্রন্থটি প্রসঙ্গে : 'আল-মুতহির বিন তাহির আল-মাকদিসী' তাঁর 'আল-বাদয়ু ওয়াত তারিখ' গ্রন্থে আর-রাযীর ধর্মবিশ্বাসের ব্যাপারে প্রচন্ড বাজে মন্তব্য করেছেন। তাকে একজন নবুওয়াতবিরোধী নিকৃষ্ট ব্যাক্তি হিসেবে উল্লেখ্য করেছেন। তাছাড়া মাখারিক্বুল আনবিয়া গ্রন্থটিকে আর-রাযীর দিকে সম্পৃক্ত করেছেন।[1] আর-রাযীর ব্যাপারে আল-মুতহিরের উল্লেখিত এসব বিষয় গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ আল-মুতহির বিন তাহির আল-মাকদিসী একজন অজ্ঞাত লেখক। উনার ব্যাপারে কিছুই জানা যায়না। মুসলিম ইতিহাসবিদদের কোন ব্যক্তিই তার বা তার বইয়ের ব্যাপারে কিছু লিখেন নি। আবার বইটির সাথে আল-মুতহির বিন তাহির আল-মাকদিসীর লেখক হিসেবে যেই সম্পৃক্ততা রয়েছে, সেই সম্পৃক্ততাও প্রশ্নবিদ্ধ সংশয়পূর্ন।[9] নিযামুল-মুলকের উক্ত গ্রন্থটিকে আর-রাযীর দিকে সম্পর্কিত করা গ্রহনযোগ্য নয়; কেননা তিনি কোনো ইতিহাসবিদ ছিলেন না। তিনি ছিলেন সেলজুক সাম্রাজ্যের উজির বা মন্ত্রী। আলি বিন রিদ্বওয়ানের উক্ত গ্রন্থটিকে আর-রাযীর দিকে সম্পৃক্ত করা গ্রহণযোগ্য না। কারণ:

এক. আলি বিন রিদ্বওয়ান, আর-রাযীর বাজে চরিত্রের শত্রুদের অন্তর্ভুক্ত একজন ছিলেন।[3]

দুই. আলি বিন রিদ্বওয়ান তাঁর সম-সাময়িক ও তাঁর পূর্বে গত হয়ে যাওয়া প্রচুর সংখ্যাক চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে কথা বলতেন। মানে তিনি প্রায় সবারই বিরোধী ছিলেন।[10]

• তিন. তিনি তার আলোচনা গুলোতে নিজ মূর্খতা ও নির্বুদ্ধিতা-কে জাহির করতেন। কোন ব্যক্তি তাঁর এসব ফালতু কথাবার্তার জবাব দিতে চাইলে; তিনি তাকে গালাগালি করতেন।[10]

চার.  তিনি তাঁর এই গুণটি (তিন নং উল্লেখিত গুণটি) সবচেয়ে বেশি তখনই প্রয়োগ করতেন যখন তিনি আবুল-ফারাজ ইবনুত তাইব ও মুহাম্মদ বিন জাকারিয়া আর-রাযীর বিরুদ্ধে বলতেন। অর্থাৎ এই দুজনের বিরুদ্ধে বলার সময় তিনি সর্বাধিক পরিমান নির্বুদ্ধিতা ও মূর্খতা প্রকাশ করতেন। কোন ব্যক্তি এই দুজনের ব্যাপারে তাঁর বলা এসব ফালতু কথা সমূহের প্রতিউত্তর দিতে চাইলে তিনি তাকে সবচেয়ে বেশি গালাগালি করতেন।[10] আর-রাযীর শত্রুদের উক্ত গ্রন্থটিকে আর-রাযীর সহিত সম্পৃক্ত করাটা গ্রহনযোগ্য নয়। কারণ তারা আর-রাযীর প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ করতেন এবং তাদের চরিত্রও খারাপ ছিলো।[3] অর্থাৎ কোনো নির্ভরযোগ্য মধ্যযুগীয় মুসলিম ইতিহাসবিদ থেকে আর-রাযীর সহিত উক্ত গ্রন্থটির সম্পৃক্ততার উল্লেখ্য পাওয়া যায়না।

আর-রাযীর সহিত 'মাখারিক্বুল আনবিয়া' গ্রন্থটির সম্পৃক্ততা নিম্নে উল্লেখিত কারনসমুহের কারনে ভুল ও মিথ্যা –

এক. কোনো নির্ভরযোগ্য মধ্যযুগীয় মুসলিম ইতিহাসবিদ হতে আর-রাযীর সহিত উক্ত গ্রন্থটির সম্পৃক্ততার উল্লেখ্য পাওয়া যায়না।

দুই. আর-রাযী তাঁর 'ফাহরাসাত' এ এই গ্রন্থটির নাম উল্লেখ্য করেন নি, অর্থাৎ তিনি জানতেন না যে তিনি উক্ত নামের কোনো গ্রন্থ লিখেছেন।

তিন. 'আবুল-আব্বাস ইবন আবি-উসাইবায়াহ' তাঁর 'উয়ুনুল আনবা' গ্রন্থে পরোক্ষভাবে এটা স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে এই গ্রন্থটি আর-রাযী লিখেন নি, বরং আর-রাযীর খারাপ চরিত্রের শত্রুরা এই গ্রন্থটি লিখে সেটাকে আর-রাযীর দিকে সম্পৃক্ত করে দিয়েছে [3]। অর্থাৎ এই  গ্রন্থটি আর-রাযীর নামে বানানো একটি  জাল গ্রন্থ।

দ্বিতীয় ও তৃতীয় গ্রন্থটি প্রসঙ্গে :

নিম্নে উল্লেখিত কারনসমুহের কারনে আল-বেরুনীর 'হিয়ালুল মুতানাব্বিইন' ও 'ফিন-নাবুওয়াত' এদুটি গ্রন্থকে আর-রাযীর সহিত সম্পৃক্ত করাটা গ্রহনযোগ্য নয় :

এক. আবুল-আব্বাস ইবন আবি-উসাইবায়াহ বলেছেন যে আর-রাযী এমন কোনো ব্যাক্তি ছিলেন না, যে কিনা এইধরনের বই লেখতে পারে [3]।

দুই. আর-রাযী এই গ্রন্থদুটির নাম তাঁর 'ফাহরাসাত' এ উল্লেখ্য করেন নি। অর্থাৎ তিনি জানতেন না যে তিনি হিয়ালুল-মুতানাব্বিইন বা ফিন-নাবুওয়াত নামের কোনো বই লিখেছেন।

তিন. আর-রাযীর বহু খারাপ চরিত্রবিশিষ্ট শত্রু ছিলো। [3]

চার.  আল-বেরুনি যেই গ্রন্থে উক্ত দুইটি বইকে আর-রাযীর দিকে সম্পর্কিত করেছেন, সেই একই গ্রন্থে তিনি এই তিনটি বইকেও আর-রাযীর দিকে সম্পর্কিত করেছেন : …[11]

1.Wujub Da‘wat al-Nabi ‘Ala Man Naqara bi al-Nubuwwat = Obligation to Propagate the Teachings of the Holy Prophet (pbuh) Against Those who Denied Prophecies

2.Fi anna li al-Insan Khaliqan Mutqinan Hakiman (That Man has a Wise and Perfect Creator).

3.Fi Wujub al-Du‘a’ Min Tariq al-Hazm (The Obligation of Prayer in Absolute and Sincere Faith).

যে ব্যাক্তি এই তিনটি বই লিখতে পারে, সে কিভাবে ইসলামবিরোধী বই লিখতে পারে? 

পাচ. শুধুমাত্র আল-বেরুনিই উক্ত গ্রন্থদুটিকে আর-রাযীর দিকে সম্পর্কিত করেছেন। তিনি ব্যাতিত, আর কেওই এদুটি গ্রন্থকে আর-রাযীর দিকে সম্পর্কিত করেন নি।

চতুর্থ গ্রন্থটি প্রসঙ্গে :

ইবনুন-নাদিমের "আল-ফাহরাসাতে" উল্লেখিত "كتاب فيما يرد به اظهار ما يدعى من عيوب الأنبياء" লেখাটিতে মুদ্রনজনিত ভুল আছে। এখানে "الأنبياء " হবেনা, এটা ভুল, সঠিকটা হবে 'الأولياء'। অর্থাৎ মুল লেখাটার সঠিক সংস্করন হবে এরুপ "كتاب فيما يرد به اظهار ما يدعى من عيوب الأولياء"। আর সঠিক সংস্করনটির মর্ম হবে এরুপ : "এমন একটি বই যেখানে আওলিয়াদের বহু দোষ-ক্রুটি প্রকাশ ও উল্লেখ্য করা হয়েছে"।

আমার এই দাবির পক্ষে প্রমান হলো :

এক. 'জামালুদ্দিন আবুল-হাসান আল-কিফতী' তাঁর 'ইখবারুল উলামা' গ্রন্থে ইবনুন-নাদিমের 'আল-ফাহরাসাত' থেকে ইবনুন-নাদিম কর্তৃক উল্লেখিত আর-রাযীর বইয়ের তালিকাটি নকল করেছেন। সেখানে উক্ত গ্রন্থের নামের বেলায় الأنبياء এর বদলে الأولياء শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে …[12]।

দুই. 'আবুল-আব্বাস ইবন আবি-উসাইবায়াহ' আর-রাযীর উক্ত গ্রন্থটির নাম তাঁর 'উয়ুনুল আনবা' গ্রন্থে উল্লেখ্য করেছেন। সেখানে উক্ত গ্রন্থের নামের বেলায় الأنبياء এর বদলে الأولياء শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে [13]।

তিন. 'ইসমাঈল বিন মুহাম্মদ আমিন আল-বাবানী' তাঁর "হিদায়াতুল আরিফিন" গ্রন্থে আর-রাযীর উক্ত গ্রন্থটির নাম উল্লেখ্য করেছেন। সেখানে উক্ত গ্রন্থের নামের বেলায় الأنبياء এর বদলে الأولياء শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে [14]।

প্রথম ভাগের আলোচনা এখানে এসে সমাপ্ত হলো। এবার দ্বিতীয় ভাগের আলোচনা আরম্ভ করা যাক।

দ্বিতীয় ভাগ - 'আর-রাযীর ধর্মবিশ্বাস প্রসঙ্গে' :

এই ভাগে তিনটি উপশ্রেনী থাকবে। প্রথম উপশ্রেনীতে আর-রাযীর ধর্মবিশ্বাসের উপর আসা  বড় ধরনের সমালোচনাগুলোর ব্যাপারে আলোচনা করা হবে, যেই সমালোচনাগুলো আর-রাযীর মুসলিম হয়াকে তীব্রভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে।দ্বিতীয় উপশ্রেনীতে আর-রাযীর উপর আসা মাঝারি মানের সমালোচনাগুলোর ব্যাপারে আলোচনা করা হবে। এবং তৃতীয় উপশ্রেনীতে আর-রাযী কোন ধর্মে বিশ্বাস করতেন সেব্যাপারে আলোচনা করা হবে।

প্রথম উপশ্রেনী - 'আর-রাযীর ধর্মবিশ্বাসের উপর আসা বড় ধরনের সমালোচনা প্রসঙ্গে ':

আর-রাযীর ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে কিছু মধ্যযুগীয় লেখক বড় ধরনের অভিযোগ এনেছেন, এই অভিযোগ গুলো আর-রাযীর মুসলিম হয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। আর-রাযীর ধর্মবিশ্বাসের উপর এই ধরনের অভিযোগ আনা মোট ৫ জন লেখক সম্পর্কে আমি জানতে পেরেছি। তারা হলেন :

১.  আল-মুতহির বিন তাহির আল-মাকদিসী
২.  আবু-হাতিম আর-রাযী আল-ইসমাঈলী
৩.  হামিদুদ্দিন আহমদ আল-কিরামানী
৪ . আবুর-রাইহান মুহাম্মদ আল-বেরুনী
৫.  আবুল-ক্বাসিম সঈদ আল-আন্দালুসী

এবার, বিস্তারিত …

১.  আল-মুতহির বিন তাহির এর সমালোচনা প্রসঙ্গে :

আল-মুতহির বিন তাহির তাঁর 'আল-বাদয়ু ওয়াত তারিখ' গ্রন্থে আর-রাযীকে নবিদের প্রতি  ঘৃনা-বিদ্বেষ পোষনকারী  ব্যাক্তি হিসেবে উল্লেখ্য করেছেন। [1]

জবাব : আল-মুতহিরের এই বক্তব্য গ্রহনযোগ্য নয়, কেননা আল-মুতহির বিন তাহির আল-মাকদিসী একজন অজ্ঞাত লেখক। উনার ব্যাপারে কিছুই জানা যায়না। মুসলিম ইতিহাসবিদদের কেওই উনার বা উনার বইয়ের ব্যাপারে কিছু লিখেন নি। আবার বইটির সাথে আল-মুতহির বিন তাহির আল-মাকদিসীর লেখক হিসেবে যেই সম্পৃক্ততা রয়েছে, সেই সম্পৃক্ততাও প্রশ্নবিদ্ধ সংশয়পুর্ন। [9]

২. আবু-হাতেম আর-রাযী আল-ইসমাঈলী এর সমালোচনা প্রসঙ্গে :

ইসমাঈলি শিয়া দাঈ ও দার্শনিক আবু-হাতেম আহমদ বিন হামদান আর-রাযী আল-ওয়ারসামী  'أعلام النبوة' (আ'লামুন নাবুওয়াহ) নামের একটি গ্রন্থ লিখেছেন। সেই গ্রন্থে তিনি তাঁর ও আর-রাযীর মাঝে সংঘটিত হয়া বিতর্কগুলোর বিবরন দিয়েছেন। সেখানে তিনি আর-রাযীকে একজন 'নাস্তিক' হিসেবে সম্বোধন করেছেন, এই বিতর্কের বিবরন অনুযায়ি আর-রাযী একজন কট্টর ইসলাম ও নবুওত বিরোধী ব্যাক্তি ছিলেন।

জবাব :

প্রথমত, দার্শনিক আবু-হাতেমের 'أعلام النبوة' গ্রন্থের মুল পান্ডুলিপির কোথাও এটা উল্লেখ্য করা হয়নি যে সেই গ্রন্থে তিনি যেই নাস্তিকের সাথে তাঁর হয়ে যাওয়া বিতর্কের বিবরন দিয়েছেন, সেই নাস্তিকটি 'আবু-বকর মুহাম্মদ বিন জাকারিয়া আর-রাযী' ই। বরং তিনি উক্ত গ্রন্থে কোন নাস্তিকের কথা বলেছেন, তা অজানা ; আর তা জানা সম্ভবও না। বরং পরবর্তিতে (আধুনিক যুগে) অনেকে ধরে নিয়েছেন যে আবু-হাতেম যেই নাস্তিকের কথা বলছেন তিনি আর-রাযী ই। [15]

দ্বিতীয়ত, যদি ধরে নেই যে আবু-হাতেম এখানে আর-রাযিকেই বুঝিয়েছেন। তবুও তাঁর এই 'أعلام النبوة' গ্রন্থটির উপর নির্ভর করে আর-রাযীর ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া গ্রহনযোগ্য হবেনা।

কেননা আবু-হাতেমের ব্যাপারে 'ইবন হাজার আল-আসকালানী' বলেছেন :

كان من أهل الفضل والأدب والمعرفة باللغة وسمع الحديث كثيرا وله تصانيف ثم أظهر القول بالإلحاد وصار من دعاة الإسماعيلية وأضل جماعة من الأكابر [16]

'তিনি সম্মানিত, সাহিত্যিক ও ভাষা সম্পর্কে ভালো জ্ঞান রাখা ব্যাক্তিদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। এবং তিনি প্রচুর হাদিস শ্রবন করেছেন, এবং তাঁর বহু বই রয়েছে। অতপর তিনি নাস্তিকিয় কথাবার্তা বলা আরম্ভ করেন, এবং ইসমাইঈলিয়াহর দাঈদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যান, এবং বড় বড় ব্যাক্তিদের এক জামাতকে পথভ্রষ্ট করেন '

আবু-হাতেম 'أعلام النبوة'  গ্রন্থটি তখন লিখেছেন যখন তিনি ইসমাঈলী দাঈ ছিলেন। এর প্রমান হলো তাঁর এই গ্রন্থে শিয়াদের ইমাম-তত্ত্বের পক্ষে বেশকিছু কথা বলা হয়েছে।

৩. হামিদুদ্দিন আহমদ আল-কিরামানী এর  সমালোচনা প্রসঙ্গে :

হামিদুদ্দিন আহমদ আল-কিরামানী আর-রাযীর বিরুদ্ধে 'الأقوال الذهبية ' নামক একটি বই লিখেন। সেখানে তিনি আর-রাযীকে নবুওত অস্বীকারকারী হিসেবে অভিযুক্ত করেন [17]।

জবাব : হামিদুদ্দিন আহমদ আল-কিরামানী ছিলেন একজন কট্টর ইসমাঈলী শিয়া দাঈ, যাকে পুর্বদিকে ইসমাইঈলিইজম প্রচার করার জন্য নিযুক্ত করা হয়েছিল [18]। কাজেই আর-রাযীর ব্যাপারে হামিদুদ্দিনের কোনো বক্তব্য গ্রহনযোগ্য বা নির্ভরযোগ্য না।

৪.  আবুর-রাইহান আল-বেরুনী এর সমালোচনা প্রসঙ্গে :

আবুর-রাইহান আল-বেরুনী, আর-রাযীর ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেছেন, যা আর-রাযীর মুসলিম হয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।[19]

জবাব : আল-বেরুনী, আর-রাযীর ব্যাপারে সমালোচনা উল্লেখ্য করার পর বলেছেন :

"The proof of what I say can be found at the end of his book On Prophecies " _[19]

এখানে 'On Prophecies' দ্বারা আর-রাযীর গ্রন্থ 'ফিন-নাবুওয়াত' উদ্দেশ্য। আর ফিন-নাবুওয়াত বইটির সাথে আর-রাযীর সম্পৃক্ততা মিথ্যা ও ভুল হয়ার ব্যাপারে আলোচনা গত হয়েছে। অর্থাৎ আল-বেরুনী যেই প্রমানের উপর ভিত্তি করে উক্ত সমালোচনাটি করেছেন সেই প্রমানটি অগ্রহনযোগ্য। সুতরাং আল-বেরুনীর এই সমালোচনা গ্রহনযোগ্য নয়।

৫.  আবুল-ক্বাসিম সঈদ আল-আন্দালুসী এর সমালোচনা প্রসঙ্গে :

সঈদ আল-আন্দালুসী তাঁর 'তবাকাতুল উমাম' গ্রন্থে আর-রাযীর ব্যাপারে বলেছেন যে আর-রাযীর 'আল-ইলমুল ইলাহি', 'আত-তিব্বুর রুহানী' ও  তাঁর অন্যান্য কিছু গ্রন্থ হতে এমনটা ইংগিত পাওয়া যায় যে তিনি শির্ক করার ক্ষেত্রে ছানাওইয়াহদের দৃষ্টিভংগি, নবুওত অস্বিকার করার ক্ষেত্রে বারাহিমাহদের দৃষ্টিভংগিসমুহ এবং এক জিবদেহ হতে অন্য জীবদেহে আত্নার স্থানান্তরের ক্ষেত্রে অধিকাংশ সাবেঈদের আকিদাহ-বিশ্বাস  কে 'পছন্দ' করেছিলেন।[20]

জবাব : সঈদ আল-আন্দালুসী এই সমালোচনাটি উল্লেখ্য করার পরে বলেছেন :

"ولو أن الرازي وفقه اللّٰه تعالی  للرشد…"[20]

'যদিও আর-রাযীকে আল্লাহ তা'য়ালা হেদায়েতের জন্য দিক-নির্দেশনা দিয়েছিলেন…'

সুতরাং সঈদের এই সমালোচনা সঈদের বক্তব্য দ্বারাই খন্ডিত হয়ে গেলো।

যদি কেও বলে : সঈদ এখানে তামান্নি বুঝাচ্ছেন, এর সঠিক অর্থ হবে 'যদি এমনটা হতো, যে আর-রাযীকে আল্লাহ তা'য়ালা হেদায়াতের জন্য দিক-নির্দেশনা দিতেন'। অর্থাৎ এখানে সঈদ আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করছেন এই বলে 'যদি এমনটা হতো'। এরদ্বারা এটা স্পষ্ট হয়না যে এমনটাই হয়েছে।

তাহলে তাকে উত্তরে বলব : সঈদ ولو এর পরে যা উল্লেখ্য করেছেন, তার একটা ক্ষুদ্র অংশ আমি এখানে এনেছি।  যদি তাঁর ولو এর পর উল্লেখ্য করা সম্পুর্ন কথাটির দিকে দৃষ্টিপাত করা হয়, তাহলে দেখা যাবে তিনি সেখানে যেই মুল বিষয়টা বলেছেন ; সেই একই বিষয়কে অন্যান্য একাধিক-সংখ্যাক মুসলিম ইতিহাসবিদরা আর-রাযীর সাথে সম্পর্কিত একটি তথ্য হিসেবে উল্লেখ্য করেছেন যে এমনটাই হয়েছে। যা হয়ে গিয়েছে, সঈদ সেটা হওয়ার আকাঙ্ক্ষা কেন প্রকাশ করতে যাবেন? সুতরাং এখানে সঈদ আকাঙ্ক্ষা বুঝান নি, বরং এখানে তিনি ولو কে দুটি ভিন্ন বাক্যের মাঝে সংযোগ সৃষ্টিকারী একটি অব্যয়ের ন্যায় ব্যবহার করেছেন, তামান্নী তথা আকাঙ্ক্ষা প্রকাশের জন্য ব্যবহার করেন নি।

দ্বিতীয় উপশ্রেনী - 'আর-রাযীর ধর্মবিশ্বাসের উপর আসা মাঝারী ধরনের সমালোচনা প্রসঙ্গে' :

আর-রাযীর ব্যাপারে আরেকটি সমালোচনা আছে, তা এরুপ :

"আর-রাযী ঈশ্বরের (God) সাথে সম্পর্কিত শাস্ত্রে গভিরভাবে প্রবেশ করেন নি। এবং তিনি উক্ত শাস্ত্রের বিষয়বস্তুসমুহ পরিপুর্নভাবে বুঝে উঠতে পারেন নি। যার ফল-স্বরুপ উনার দৃষ্টিভংগিতে বিকৃতি দেখা দেয়, তিনি বহু নির্বুদ্ধিতাপুর্ন দৃষ্টিভংগির অন্ধ অনুসরন করতে থাকেন, এবং বহু নিকৃষ্ট মতবাদকে গ্রহন করেন, এবং তিনি ঠিকমত না জেনে ও না বুঝেই বহু দলকে অপমান করেন "

আর-রাযীর ব্যাপারে এই সমালোচনাটি বহু মুসলিম ইতিহাসবিদ উল্লেখ্য করেছেন।উদাহরনস্বরুপ  : _[21]

১.আবুল-ক্বাসিম সঈদ আল-আন্দালুসী
২.আবুল-আব্বাস ইবন আবি-উসাইবায়াহ
৩.ইবন ফাদ্বলিল্লাহ আল-আমরী
৪.জামালুদ্দিন আবুল-হাসান আল-কিফতী
৫.সিদ্দিক হাসান খান আল-কিন্নুজী

(এছারাও আরো অনেকে ……) 

এখন প্রশ্ন হলো - এই সমালোচনাটি কি আর-রাযীকে অমুসলিম সাব্যস্ত করে? বা তাঁর মুসলিম হয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করে? এর উত্তর হলো : না! এই সমালোচনাটি আর-রাযীর মুসলিম হয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করেনা! 

"এই সমালোচনাটির মাত্রা বা মান এতটাও শক্তিশালি বা তীব্র নয়, যে এরদ্বারা আর-রাযীর মুসলিম হয়া প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাবে। "

আমার উক্ত দাবিকে যে বিষয়টি সঠিক সাব্যস্ত করে তা হলো এই যে : আর-রাযীর ব্যাপারে এই সমালোচনা যেইসব ইতিহাসবিদরা উল্লেখ্য করেছেন, তাদের অনেকে আর-রাযীকে 'মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত একজন' হিসেবে গন্য করেছেন। যেমন :

১.জামালুদ্দিন আল-কিফতী : তিনি আর-রাযী সম্পর্কে এই সমালোচনাটি উল্লেখ্য করেছেন। অপরদিকে তিনি আর-রাযীকে 'মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত চিকিৎসক' উপাধি দিয়েছেন, এবং ইবন জুলজুলের সুত্র ধরে আর-রাযীকে 'ধর্মবিশ্বাসের দিক দিয়ে মুসলিম' বলেছেন। _[22]

২. ইবন ফাদ্বলিল্লাহ আল-আমরী : তিনি আর-রাযী সম্পর্কে এই সমালোচনাটি উল্লেখ্য করেছেন। অপরদিকে তিনি আর-রাযীকে 'মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত চিকিৎসক' উপাধি দিয়েছেন। _[23]

৩. সিদ্দিক হাসান খান আল-কিন্নুজী : তিনি আর-রাযী সম্পর্কে এই সমালোচনাটি উল্লেখ্য করেছেন। অপরদিকে তিনি আর-রাযীকে 'মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত চিকিৎসক' উপাধি দিয়েছেন। _[24]

তাছারা আর-রাযীর দর্শনচর্চার ব্যাপারে একটি ইতিবাচক বিষয়ও আছে, তা এরুপ :

"আর-রাযী দর্শনশাস্ত্র ও চিকিৎসাবিদ্যা অধ্যয়ন আরম্ভ করেন। তিনি দর্শনশাস্ত্রের একদম গভিরে চলে যান। তিনি দর্শনের সঠিক ও বিশুদ্ধ বিষয়গুলোর উপর বিশ্বাস স্থাপন করেন, এবং সমস্যাযুক্ত বিষয়গুলোকে ক্রুটিপুর্ন সাব্যস্ত করেন।"

এই ইতিবাচক বিষয়টিও অনেক মুসলিম ইতিহাসবিদরা উল্লেখ্য করেছেন। উদাহরনস্বরুপ : সিদ্দিক হাসান খান, ইবন খালিক্কান, আস-সিফদী [25](এছারাও আরো অনেকেই ……)

তৃতীয় উপশ্রেনী - 'আর-রাযী কোন ধর্মের ছিলেন?' :

আর-রাযীর ধর্মবিশ্বাসের দিক দিয়ে মুসলিম ছিলেন। অনেক মুসলিম ইতিহাসবিদ এমনটা উল্লেখ্য করেছেন। উদাহরনস্বরুপ :

১. 'আবু-দাউদ ইবন জুলজুল আল-আন্দালুসী' একদম সুস্পষ্টভাবে বলেছেন যে 'মুহাম্মদ বিন জাকারিয়া আর-রাযী ধর্মবিশ্বাসের দিক দিয়ে মুসলিম' [26]

২.  'জামালুদ্দিন আবুল-হাসান আল-কিফতী' আর-রাযীকে 'মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত চিকিৎসক' উপাধি দিয়েছেন এবং ইবন জুলজুল হতে উল্লেখ্য করেছেন যে আর-রাযী ধর্মবিশ্বাসের দিক দিয়ে মুসলিম ছিলেন।[22]

৩. 'ইবন ফাদ্বলিল্লাহ আল-আমরী' আর-রাযীকে 'মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত চিকিৎসক' উপাধি দিয়েছেন। [23]

৪. 'সিদ্দিক হাসান খান আল-কিন্নুজী' আর-রাযীকে 'মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত চিকিৎসক' উপাধি দিয়েছেন।[24]

৫. 'আহমদ ইবন খাল্লিকান আল-বারমাকী' আর-রাযীর জন্য রহমতের দোয়া করেছেন, যা কিনা শুধুমাত্র মুসলিমদের জন্যই করা যায় [27]।

তৃতীয় ভাগ - 'আর-রাযী কোন ধর্মে বিশ্বাসী থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরন করেছিলেন?'

এই ভাগটিতে দুইটি উপশ্রেনী থাকবে, প্রথম উপশ্রেনীতে আর-রাযীর একটি ছোট কবিতা নিয়ে সৃষ্টি হয়া জটিলতা নিয়ে আলোচনা করা হবে, এবং দ্বিতীয় উপশ্রেনীতে আর-রাযী আসলে কোন ধর্মে বিশ্বাসী থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরন করেছিলেন, সেব্যাপারে আলোচনা করা হবে।

প্রথম উপশ্রেনী - আর-রাযীর একটি ছোট কবিতা নিয়ে সৃষ্টি হয়া জটিলতা প্রসঙ্গে :

আর-রাযীর একটি বিখ্যাত ছোট কবিতা আছে, যা আর-রাযী তাঁর মৃত্যুর নিকটবর্তি সময়ে নিজের ব্যাপারে পাঠ করেছিলেন। কবিতাটি হলো এই  : …[28]

لعمري ما أدري وقد آذَن البِلَى ... بعاجلِ ترحالِي إلى أين ترحالي

وأين محلُّ الرُّوح بعد خُروجِه ... مِنَ الجسد المنحلِّ والهيكل البالي

উচ্চারন :

লি-উমরি মা আদরি ওয়া ক্বদ আ~যানাল বিলা
… বি-আজিলি তারহালী ইলা আইনা তারহালী

ওয়া-আইনা মাহাল্লুর রুহ বা'দা খুরুজিহি
… মিনাল জাসাদিল মুনহাল্লি ওয়াল হাইকালিল বালী

অর্থ :

আমার জিবনের জন্য আমি যা জানি, মৃত্যু খুবই নিকটবর্তি হয়ে গিয়েছে
… শীঘ্রই আমার প্রস্থান হবে, কিন্ত আমার যাত্রা কোন দিকে হবে? 

এবং কোথায় রুহের স্থান হয়, নির্গত হয়ে যাওয়ার পর
…দুর্বল দেহ ও ক্ষয়প্রাপ্ত কাঠামো হতে ?

ইবনুল-কাইয়ুম তাঁর 'মাদারিজুস সালিকিন' গ্রন্থে উল্লেখ্য করেছেন যে : কবিতা সম্পর্কে ভালো ধারনা রাখা কিছু ব্যাক্তিরা আর-রাযীর এই কবিতাটি উল্লেখ্য করেছেন এবং কবিতাটি প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন যে তারা নাকি  জানেন যে আর-রাযী জাহান্নামে যাবেন ;কেননা (তাদের মতে)  আর-রাযী নাকি একজন কাফের! [29]

জবাব :

আর-রাযীর উক্ত কবিতাটির মর্ম হচ্ছে এরুপ :

"আর-রাযী জানেন না যে তিনি মৃত্যুর পর জাহান্নামে যাবেন, নাকি জান্নাতে। তবে তিনি তা জানতে চান। এবং তিনি জাহান্নামের আযাবের প্রতি ভীত হয়ে আছেন। " [30]

অর্থাৎ এই কবিতাতে এমন কিছুই নেই, যা আর-রাযীর কাফের হয়ার দিকে ইংগিত দেয়।

কিছু অপরিচিত নাম না জানা কবিতা সম্পর্কে ভালো জ্ঞান রাখা ব্যাক্তিদের আর-রাযীকে কাফের বলা গ্রহনযোগ্য নয়, নির্ভরযোগ্য নয়। কেননা কাব্যচর্চা কাওকে ইতিহাসবিদ বানায় না। মুসলিম ইতিহাসবিদদের মধ্যে হতে প্রচুর সংখ্যাক ইতিহাসবিদ আর-রাযীর ব্যাপারে কম-বেশি আলোচনা করেছেন, কেও কেও তাকে মুসলিম হিসেবে গন্য করেছেন, কিন্ত কেও তাকে কাফের বলেন নি। মুহাম্মদ বিন জাকারিয়া আর-রাযী কাফের ছিলেন, এমন কোনো তথ্য মুসলিম ইতিহাসবিদদের নিকট জানা ছিলোনা।

দ্বিতীয় উপশ্রেনী - 'আর-রাযী কোন ধর্মে থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরন করেছিলেন?' :

আর-রাযীর ব্যাপারে মুসলিম বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ইতিহাসবিদদের মধ্যে অন্যতম 'শামসুদ্দিন আবুল-আব্বাস আহমদ ইবন খাল্লিকান আল-বারমাকী' বলেছেন :

"وتوفی سنة إحدی عشرة ثلثمائة رحمه اللّٰه تعالی "[27]

'এবং তিনি (আর-রাযী) তিনশত এগারো (হিজরি) সনে মৃত্যুবরন করেন, রহিমাহুল্লাহু তা'য়ালা (আল্লাহ তাঁর প্রতি রহম করুক)'

এটা সবার জানা, যে "রহিমাহুল্লাহহু তা'য়ালা" দোয়াটি শুধুমাত্র তাদের জন্যই ব্যবহার করা যায় যারা কিনা মুসলিম থাকা অবস্থায় মারা গিয়েছেন। সুতরাং প্রমানিত হলো যে আর-রাযী মুসলিম অবস্থায় মারা গিয়েছেন।

প্রমানসমুহ :

[1]আল-মুতহির, আত-বাদয়ু ওয়াত তারিখ (3/110)

[2]নিযামুল-মুলক,সিয়াসাত নামাহ (পৃ/257)

[3]ইবন আবি-উসাইবায়াহ,উয়ুনুল আনবা (পৃ/426)

[4]Risalat al-Biruni fi Fihrist Kutub al-Razi: A Comprehensive Bibliography of the Works of Abu Bakr al-Rāzī (D. 313 A.H/925) and al-Birūni (D. 443/1051) by "Nurdeng Deuraseh"

https://ejournal.um.edu.my/index.php/afkar/article/view/5872/3596

[5]চতুর্থ টিকাতে উল্লেখিত উৎসের পৃষ্ঠা নম্বর 74

[6]যেমন :'ডক্টর মুহাম্মদ আস-সুলাইমানি',কানুনুত তা'ওইলের দারাসাহ ও তাহকিকে (পৃ/336) এমনটা উল্লেখ্য করেছেন। আহমদ হাসান আয-যাইয়াত পাশা তাঁর একটি লেখাতে এমনটা উল্লেখ্য করেছেন (https://shamela.ws/book/29674/14354)। একদল লেখকের সম্মিলিতভাবে লিখিত 'মুওজিযু দাইরাতিল মায়ারিফিল ইসলামিয়াহ' গ্রন্থে (16/5053) এমনটা উল্লেখ্য আছে।

[7]ইবনুন-নাদিম, আল-ফাহরাসাত (পৃ/363)

[8]আল-ফাহরাসাত (পৃ/361-364),ইখবারুল উলামা (পৃ/207-210)

[9]আর-যিরকিলী,আল-আ'লাম (7/253)

[10]ইবন আবি-উয়সাইবায়াহ,উয়ুনুল আনবা (পৃ/563)

[11]চতুর্থ টিকাতে উল্লেখিত উৎসের পৃষ্ঠা নম্বর 72

[12]আল-কিফতী,ইখবারুল উলামা (পৃ/209)

[13]ইবন আবি-উসাইবায়াহ,উয়ুনুল আনবা (পৃ/426)

[14]আল-বাবানী,হিদায়াতুল আরিফিন (2/28)

[15] 'আব্দুল-লাতিফ আল-আব্দ' তাঁর গবেষণামুলক প্রবন্ধ 'فلسفة أبي بكر الرازي' তে এমনটা উল্লেখ্য করেছেন।

[16]ইবন হাজার, লিসানুল মিযান (1/164)

[17]আমির আন-নাজ্জার, দারাসাহ ওয়া তাহকিক : উয়ুনিল আনবা (1/67)

[18]আয-যিরকিলী, আল-আ'লাম (1/156)

[19]চতুর্থ টিকাতে উল্লেখিত উৎসের পৃষ্ঠা নম্বর 58-59

[20] সঈদ, তবাকাতুল উমাম (পৃ/33)

[21]দেখুন : ইবন আবি-উসাইবায়াহ,উয়ুনুল আনবা (পৃ/416) ; ইবন ফাদ্বলিল্লাহ, মাসালিকুল আবসার (9/56);  আল-কিফতী,ইখবারুল উলামা (পৃ/206); সিদ্দিক হাসান,আবজাদুল উলুম (পৃ/632)।

[22]আল-কিফতী,ইখবারুল উলামা (পৃ/206)

[23]ইবন ফাদ্বলিল্লাহ,মাসালিকুল আবসার (5/55)

[24]সিদ্দিক হাসান, আবজাদুল উলুম (পৃ/632)

[25]দেখুন: সিদ্দিক হাসান,আবজাদুল উলুম (পৃ/632) ;ইবন খাল্লিকান,ওয়াফইয়াতুল আ'ইয়ান (5/158); আস-সিফদী, নুকতুল হুমইয়ান (পৃ/235) &আল-ওয়াফী বিল-ওয়াফিয়াত (3/62)।

[26]ইবন জুলজুল,তবাকাতুল আত্তিবা (পৃ/77)

[27]ইবন খাল্লিকান,ওয়াফইয়াতুল আ'ইয়ান (5/159)

[28]ইবন ফাদ্বলিল্লাহ, মাসালিকুল আবসার (9/59) ;ইবনুল কাইয়ুম, মাদারিজুস সালিকিন (4/191) ;আস-সাখাওই, আজ-জাওয়াহির ওয়াদ দুরার (1/384) :আস-সিফদী, আল-ওয়াফী বিল-ওয়াফিয়াত (3/63) & নুকতুল হামইয়ান (পৃ/236);ইবন আবি-উসাইবায়াহ, উয়ুনুল আনবা (পৃ/421);হাজি খালিফাহ, কাশফুয যুনুন (1/160)।

[29]ইবনুল-কাইয়ুম,মাদারিজুস সালিকিন (4/191)

[30]আস-সাখাওই, আজ-জাওয়াহির ওয়াদ দুরার (1/384)