Are you sure?

বিজ্ঞান »  ইসলাম ও বিজ্ঞান

আকাশের স্তম্ভ থাকা না থাকা সম্পর্কে আলোচনা

 

 

ইসলামবিরোধীদের অভিযোগ : কোরানের বহুস্থানে আকাশের স্তম্ভ না থাকার কথা এসেছে,আকাশ অর্থাৎ বায়ুমন্ডল শক্ত কঠিন হলেই এর স্তম্ভ থাকা বা না থাকার প্রসঙ্গ আসবে, এরমানে কোরান অনুযায়ী বায়ুমন্ডল হলো শক্ত কোনোকিছু, আর এই শক্ত বায়ুমন্ডল স্তম্ভ ব্যাতিত উপরে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে।

অভিযোগটির জবাব :

বাংলা ভাষায় 'আকাশ' শব্দটির প্রাথমিক সংজ্ঞা হলো : "আকাশ বি. পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের উপরাংশে (বিশেষত ভূপৃষ্ঠ থেকে যেমন দেখায়; আবহাওয়া পরিষ্কার থাকলে দিনের বেলা আকাশকে নীল দেখায়) " _[bangladict.com/আকাশ]

পক্ষান্তরে আরবি ভাষায় 'সামা (سماء)' শব্দটির তথা আরবিতে 'আকাশ' শব্দটির প্রাথমিক সংজ্ঞা হলো : "কোনো জিনিসের উপরে অবস্থিত এক বা একাধিক যেকোনোকিছু বা সকলকিছু সেই জিনিসটির জন্য বা সেই জিনিসটির সাপেক্ষে সামা বা আকাশ "[1]

অর্থাৎ যদি একটি বস্তু A এর উপর দিকে B নামক কোনোকিছু থাকে, তাহলে A এর জন্য বা A এর সাপেক্ষে B হবে সামা বা আকাশ। একইভাবে যদি A এর উপর C, D, E, F থাকে, তাহলে তাদের প্রত্যেকে এককভাবে A এর জন্য সামা বা আকাশ, আবার তারা সকলে মিলে সম্মিলিতভাবেও A এর জন্য সামা বা আকাশ হতে পারে, আবার তাদের মধ্য হতে ১-২ টা (যেমন শুধু C,D কিংবা শুধু F,E) পৃথকভাবে মিলেও A এর জন্য সামা বা আকাশ হতে পারে।

প্রাথমিকভাবে আরবি ভাষাতে সামা বা আকাশ কথাটি ব্যবহৃত হয় 'আল-আর্দ' কে A   ধরে, অর্থাৎ যে জিনিসটির জন্য বা সাপেক্ষে সামা বা আকাশ বলা হবে সেটা ধরে নিয়ে।[2]আল-আর্দ মানে হলো পৃথিবীর পৃষ্ঠদেশ। আল-আর্দ দ্বারা সমগ্র পৃথিবীর পৃষ্ঠও বোঝায়, আবার অনেকসময় পৃথিবীর পৃষ্ঠের কিছু নির্দিষ্ট অংশকেও বোঝায় (এছাড়াও আল-আর্দের আরেকটা অর্থ হয় সরাসরি সমগ্র পৃথিবী)।

যদি আল-আর্দ = A হয়, তাহলে পৃথিবীর পৃষ্ঠের ঠিক উপর থেকে আরম্ভ করে সমগ্র মহাবিশ্ব ও সমগ্র মহাবিশ্বের অন্তর্ভুক্ত সকলকিছুই অথবা এক বা একাধিক যেকোনোকিছুই  সামা বা আকাশ হতে পারে। (কোন ক্ষেত্রে সামা দ্বারা কি উদ্দেশ্য করা হয়েছে, তা বাক্যের প্রসঙ্গের উপর নির্ভরশীল।) তাছারা 'সামা' (আকাশ) শব্দটি অনেকক্ষেত্রে স্বয়ং এরই বহুবচন 'সামাওয়াত' এর সমার্থক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

প্রাথমিকভাবে আকাশ বলতে ২ টা জিনিস উদ্দেশ্য করা হতে পারে, যথা : এক. বায়ুমন্ডল ও  দুই.আকাশের সাতটি শক্ত স্তর। কাজেই কোরানের আকাশের স্তম্ভ থাকা না থাকা সক্রান্ত আয়াতের বেলায় ধরে নিচ্ছি যে আকাশ বলতে হয় বায়ুমন্ডল উদ্দেশ্য, আর নাহয় সাতটা শক্ত স্তর উদ্দেশ্য।

এবার, কোরানে আকাশের স্তম্ভ না থাকার আয়াতগুলোর ব্যাখ্যা নিয়ে উলামাদের মাঝে মতভেদ হয়েছে।

আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা) সহ একদল আলেম 'আকাশের স্তম্ভ নেই' বিষয়টিকে এই বলে ব্যাখ্যা করেছেন যে "আকাশের কোনো দৃশ্যমান স্তম্ভ নেই, কিন্ত এমন স্তম্ভ আছে যা মানুষ চোখে দেখতে পায়না অর্থাৎ আকাশের অদৃশ্য স্তম্ভ আছে"। পক্ষান্তরে আরেকদল মুফাসসিরের মতে 'আকাশের স্তম্ভ নেই ' মানে আকাশের কোনো স্তম্ভ নেই, দৃশ্যমান স্তম্ভও নেই, অদৃশ্য স্তম্ভও নেই, কোনো ধরনেরই স্তম্ভ নেই। _[3][4]

এদুটি মতের মধ্যে কোনটি অধিক সঠিক তথা অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত, তা অনেক জটিল ও লম্বা আলোচনার বিষয়, কিন্ত এখানে সেই আলোচনায় যাওয়ার কোনো দরকার পড়বেনা।

যদি ধরে নেই যে আকাশের স্তম্ভ না থাকার ব্যাখ্যা হিসেবে আকাশের কোনো ধরনেরই কোনো সম্ভ না থাকার মতটি সঠিক, সেক্ষেত্রে 'আকাশ' বলতে এখানে দুরকম অর্থ উদ্দেশ্য হতে পারে। হয় আকাশ দ্বারা 'বায়ুমন্ডল' উদ্দেশ্য, আর নাহয় 'সাত আসমান' উদ্দেশ্য।

যদি বায়ুমন্ডল উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে বলা হবে যে আকাশের স্তম্ভ নেই এমনটা বলে দেয়া দ্বারা উদ্দেশ্য ছিলো আকাশের স্তম্ভ আছে এমর্মে আহলুল-কিতাবদের মাঝে প্রচলিত বিশ্বাসটিকে খন্ডন করা, বাতিল করা । কেননা তৎকালীন সময়ে বহু ইহুদি খ্রিষ্টানরা আকাশের স্তম্ভ থাকাতে বিশ্বাসী ছিলো এবং কোরান-সুন্নাহর একটি বৈশিষ্ট হলো এই যে তা কিছু ইসরাইলি তথ্যকে খন্ডন করেছে [5]। একদল লোক বিশ্বাস করত যে আকাশ পিলারের উপর দাঁড়িয়ে আছে, এখন তাদের এই বিশ্বাসের বিরোধিতাস্বরুপ কোরান বলল যে আকাশের স্তম্ভ নেই। "যেখানে বায়ুমন্ডল কোনো শক্ত জিনিসই না সেখানে তার স্তম্ভ থাকা বা না থাকার প্রশ্নই বা আসে কিভাবে? " এরকম কথা এইখানে খাটবেনা, কারণ তৎকালীন আহলুল কিতাবরা বিশ্বাস ও প্রচার করতো যে আকাশের স্তম্ভ আছে, যার ফলে বায়ুমন্ডল শক্ত না হয়া সত্ত্বেও আকাশের স্তম্ভ থাকা বা না থাকার প্রশ্ন এসেছিল।যদি বায়ুমন্ডল না হয়ে সাত আসমান উদ্দেশ্য হয়ে থাকে সেক্ষেত্রেত ব্যাপারটা আরো সহজ। সাত আসমান হলো পৃথিবী হতে অকল্পনীয় দুরত্বে অবস্থিত মহাশুন্যের সাতটি কঠিন বা কঠিনের ন্যায় আচরণকারী স্তর। এসব স্তর কোনো ধরনের স্তম্ভ ব্যাতিত টিকে আছে ও সমগ্র মহাবিশ্বকে ঘিরে রেখেছে।

পক্ষান্তরে, যদি ধরে নেই যে আকাশের স্তম্ভ না থাকার ব্যাখ্যা হিসেবে "আকাশের কোনো দৃশ্যমান স্তম্ভ নেই, কিন্ত এমন স্তম্ভ আছে যা মানুষ চোখে দেখতে পায়না অর্থাৎ আকাশের অদৃশ্য স্তম্ভ আছে" এ মতটি সঠিক। সেক্ষেত্রেও এখানে 'আকাশ' বলতে দুরকম বিষয় উদ্দেশ্য হতে পারে। হয় এরদ্বারা 'বায়ুমন্ডল' উদ্দেশ্য, আর নাহয় 'সাত আসমান উদ্দেশ্য'।
উল্লেখ্য, এই মতটিতে বর্ণিত 'এমন স্তম্ভ বা মানুষ চোখে দেখতে পায়না ' বা 'অদৃশ্য স্তম্ভ' মানে এইনা যে একদম শাব্দিক অর্থেরই স্তম্ভ আছে যা কিনা অদৃশ্য। বরং 'অদৃশ্য স্তম্ভ' বলতে এমতটিতে উদ্দেশ্য 'আল্লাহর কুদরত ' তথা আল্লাহর ক্ষমতা [6]

এখন যদি এক্ষেত্রে বায়ুমন্ডল উদ্দেশ্য হয়, সেক্ষেত্রে ব্যাপারটার মর্ম দারাবে এই যে বায়ুমন্ডল ভুপৃষ্ঠের উপর আল্লাহর অদৃশ্য ক্ষমতার সাহায্যে টিকে আছে। আবার যদি এক্ষেত্রে সাত আসমান উদ্দেশ্য হয়, সেক্ষেত্রে ব্যাপারটার মর্ম দারাবে এই যে সাত আসমান আল্লাহর অদৃশ্য ক্ষমতার সাহায্যে টিকে আছে।

সুতরাং কোরানে আকাশের স্তম্ভ না থাকার বিষয়টি উল্লেখ্য করাদ্বারা এটা প্রমাণ হয়না যে কোরান অনুযায়ী বায়ুমন্ডল শক্ত কোনোকিছু।

টিকাসমুহ :

[1] আবু-জাফর ইবনু জারির আত-তাবারী তাঁর 'জামিউল বায়ান'(1/388) গ্রন্থে সামা এর উক্ত সংজ্ঞাটি বর্ণনা করেছেন।

[2]আল-কিরাফী, নাফাইসুল উসুল (2/796)

[3]আল-মাওরিদী, আন-নুকতু ওয়াল উয়ুন (3/92)

[4]অনেকে বলতে পারেন বা ভাবতে পারেন যে যেহেতু ইবনু আব্বাস (রা) অদৃশ্য স্তম্ভের মতটির পক্ষে, এরমানে অবশ্যই এমতটিই অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত অধিকসঠিক, ইবনু আব্বাসের (রা) চেয়ে বেশি তাফসির আর কারাই বা বোঝতে পারে? প্রাথমিকভাবে যদিও এই লজিকটা ঠিকই হয়ার কথা ছিলো, কিন্ত এক্ষেত্রে এই বক্তব্য বা ভাবনাটা সম্পুর্ণ ভুল ও সমস্যাজনক। কেননা এখানে একটি নির্দিষ্ট বিশেষ পরিস্থিতি আছে যা সাহাবি হিসেবে ইবনু আব্বাসের (রা) ব্যাখ্যার যেই বিশেষ মুল্য রয়েছে সেই বিশেষ মুল্যেকে বিলুপ্ত করে দেয়। পরিস্থিতিটা হচ্ছে এই যে : জৈনিক কোনো ব্যাক্তি বলছিলো যে আকাশের স্তম্ভ আছে, ইবনু আব্বাসের (রা) নিকট যখন বলা হয় যে একজন লোক এমনটা বলছে, তখন তিনি সেই লোকের সাথে একমত হোন, সেই লোকের দ্বারা প্রভাবিত হন, এবং কোরানের আয়াতকে সেই লোকের উক্ত মত অনুযায়ী ব্যাখ্যা করেন ও বলেন যে হ্যা, আকাশের স্তম্ভ আছে, আর কোরানের আয়াতগুলোতে বোঝানো হয়েছে যে আকাশের কোনো দৃশ্যমান স্তম্ভ নেই বরং অদৃশ্য স্তম্ভ রয়েছে।{১} এখন ইবনু আব্বাসের (রা) যুগে আকাশের দৃশ্যমান বা অদৃশ্য স্তম্ভ থাকার ধারনা প্রচার করতো আরবের আহলুল-কিতাবরা এবং ইসরাইলি জ্ঞানভান্ডার সম্পর্কে জ্ঞানী মুসলিমরা, {২}কাজেই অবশ্যই তিনি (রা) যেই লোকের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এই মতটি দিয়েছেন সেই লোক ইসরাইলি তথ্যভান্ডার হতে প্রভাবিত হয়েই এমনটা বলছিলো যে আকাশের স্তম্ভ আছে, পক্ষান্তরে ইবনু আব্বাস (রা) ইসরাইলি তথ্য সমুহদ্বারা কোরানকে ব্যাখ্যার করার ক্ষেত্রে খাসভাবে মশহুর ছিলেন। কাজেই চুড়ান্ত ফলাফল দাড়ায় এই যে ইবনু আব্বাস (রা) আকাশের এই অদৃশ্য স্তম্ভ থাকার ধারনাটি ব্যাক্ত করেছেন ইসরাইলি তথ্যভান্ডার হতে গৃহীত তথ্যের অনুকূলে বা আলোকে কোরানকে ব্যাখ্যা করার মাধ্যমে, আর এই ধরনের ইসরাইলি তথ্যদ্বারা প্রভাবিত ব্যাখ্যা অকাট্য কোনোকিছুনা বরং ভুলও হতে পারে, কেননা গৃহীত ইসরাইলি তথ্যটারই ভুল হয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকে, ব্যাখ্যাকারী সাহাবী হোক, তাবেঈ হোক, তাবে তাবেঈ হোক, যেই হোক, ইসরাইলি তথ্যের ক্ষেত্রে এই নিতী সবার জন্যই প্রযোজ্য। →উপটিকাসমুহ :{১} আত-তাবারী, জামিউল বায়ান (13/409) {২} সুনান সাইদ বিন মানছুর - তাকমিলাতুত তাফসির (7/219)

[5]https://binbaz.org.sa/audios/1323/%D8%AD%D9%83%D9%85-%D8%A7%D9%84%D8%A7%D8%B3%D8%B1%D8%A7%D9%89%D9%8A%D9%84%D9%8A%D8%A7%D8%AA

[6]আল-জাযযায, মায়ানিয়ুল কোরান ওয়া ইরাবুহু (4/195) ; আল-কুরতুবী, আল-জামি লিয়াহকামিল কোরান (9/279)