"তাফসির সম্পর্কে ইবন আববাস (রা) এর দিকে সম্পর্কিত করা বইটি তার (রা) উপর বানোয়াট মিথ্যাচার"
লেখক : শায়খ মুহাম্মাদ সালিহ আল-মুনাজ্জিদ
অনুবাদক : সামিঈ আল-হাসান তবিব আল-ইনফিরাদী
প্রশ্ন : সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবন আববাস (রা) কি 'তাফসিরে ইবন আববাস ' লিখেছেন? এবং "আল-গারানিক"এর যেই ঘটনা (কাহিনী) ফাতহুল বারি তে উল্লেখ্য আছে তা কি (সহিহভাবে) প্রমানিত?
উত্তর:
আল-হামদুলিল্লাহ
- প্রথমত,
এই যে কিতাবটা "তাফসিরে ইবন আববাস " নামে পরিচিত, এটা একটা বানোয়াট ও জাল গ্রন্থ। এই কিতাবটির নিসবত ইবন আববাস (রা) পর্যন্ত সহিহ নয়, প্রমানিত নয়। ইবন আববাস (রা) সম্পর্কে এমন কিছুই জানা যায়না যে তিনি তাফসির বা অন্য কোনো বিষয়ে কোনো বই লিখেছেন।
শায়খুল ইসলাম ইবন তাইমিয়াহ রহিমাহুল্লাহ বলেছেন :
"এবং মুসা বিন আব্দুর-রহমান এই লোকটা, সে আছ-ছিকাফী আস-সান'আনী, যে মিথ্যুকদের একজন। আবু আহমাদ বিন আদি এই লোক সম্পর্কে বলেছেন : মুনকারুল হাদিস, এবং আবু হাতেম বিন হিব্বান বলেছেন : সে দাজজাল(মহামিথ্যুক), জ্বাল হাদিস বানায়। সে ইবন জুরাইজ ও আতা হতে ইবন আববাস (রা) হতে তাফসিরের একটি জাল কিতাব বানিয়েছে, সেই কিতাবটি সংকলন করেছে আল-কালবি ও মুকাতিল এর বক্তব্য থেকে "_ বক্তব্য সমাপ্ত "মাজমুয়ুল ফাতাওয়া"(1/259) থেকে।
আস-সুয়ুতি রহিমাহুল্লাহ বলেছেন :
"ইবনে আববাস (রা) হতে বর্নিত তাফসিরের সুত্রগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বাজে সুত্রটি হলো আল-কালবি, আবি সালেহ হতে, তিনি ইবন আববাস (রা) হতে। মুহাম্মাদ বিন মারওয়ান আস-সুদ্দী আস-সাগির এর বর্ননাগুলো এই সুত্রের অন্তর্ভুক্ত হয়ে এর সাথে মিলিত হয়েছে। সুতরাং ইহা একটি মিথ্যার চেইন। "বক্তব্য সমাপ্ত "আল-ইতকান ফি উলুমিল কোরআন
"(2/497-498) হতে।।
শায়খ মুহাম্মাদ হুসাইন আয-যাহাবী রহিমাহুল্লাহ বলেছেন:
"ইবন আববাস (রা) এর দিকে তাফসিরে একটি বিশাল অংশকে সম্পর্কিত করা হয়। মিসরে এটি একাধিকবার 'তানওইরুল মিকবাস মিন তাফসিরে ইবন আববাস' নামে ছাপা হয়েছে ও প্রকাশিত হয়েছে। আল-কামুসুল মুহিত গ্রন্থের লেখক আবু-তাহির মুহাম্মাদ বিন ইয়াকুব আল-ফিরুযাবাদী আশ-শাফেঈ এটি সংকলন করেছেন। আমি এই তাফসির ঘেটে দেখেছি। আমি পেয়েছি যে এর সংকলক বিসমিল্লাহ এর পর থেকে কথা এগিয়ে নিয়েছেন ইবন আববাস হতে এই সনদে রিওয়ায়েত এনে : "আমাদের খবর দিয়েছেন আব্দুল্লাহ আছ-ছিকাহ বিন আল-মা'মুন আল-হারাওই, তিনি বলেছেন আমাদের খবর দিয়েছেন আমার পিতা , তিনি বলেছেন আমাদের খবর দিয়েছেন আবু-আব্দুল্লাহ মাহমুদ বিন মুহাম্মাদ আর-রাযী, তিনি বলেছেন আমাদের খবর দিয়েছেন আমমার বিন আব্দিল-মাজিদ আল-হারাওই, তিনি বলেছেন আমাদের খবর দিয়েছেন আলি বিন ইসহাক আস-সামাকান্দী, মুহাম্মাদ বিন মারওয়ান হতে, তিনি আল-কালবী হতে, তিনি আবু সালেহ হতে,তিনি ইবন আববাস (রা) হতে। সুরা বাকারাহর শুরুর দিকে আমি পেয়েছি যে তিনি কথা এগিয়ে নিয়েছেন আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারাক পর্যন্ত এই সনদের মাধ্যমে, যে তিনি আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারাক বলেছেন আমাকে আলি বিন ইসহাক আস-সামারকান্দী বলেছেন, মুহাম্মাদ বিন মারওয়ান হতে, তিনি আল-কালবী হতে, তিনি আবু-সালেহ হতে,তিনি ইবন আববাস (রা) হতে। এবং বাকি প্রত্যেক সুরার শুরুতে তিনি বলেছেন 'এবং সেই সনদে ইবনে আববাস (রা) হতে '। …ফলে আমাদের নিকট একদম সুস্পষ্ট ভাবে প্রকাশিত হচ্ছে যে এই গ্রন্থটিতে (তাফসিরে ইবনে আববাস-এ) ইবন আববাস (রা) হতে যা কিছুই বর্ননা করা হয়েছে তা গিয়ে চুরান্তভাবে এই সুত্রে মিলিত হয় : মুহাম্মাদ বিন মারওয়ান আস-সুদ্দী আস-সাগীর, মুহাম্মাদ ইবনুস সাইব আল-কালবী থেকে, তিনি আবু সালেহ হতে, তিনি ইবন আববাস (রা) হতে। " বক্তব্য সমাপ্ত "আত-তাফসির ওয়াল মুফাসসিরুন" (2/20) থেকে।
মুহাম্মাদ হুসাইন আয-যাহাবী আরো বলেছেন :
"বিরুধিতাকারির জন্য এটা সঠিক নয় যে তিনি তাফসিরে ইবন আববাস এর উপর নির্ভর করে আমাদের বিরুধিতা করবেন, কেননা অবশ্যই এই গ্রন্থটির ইবনে আববাসের দিকের নিসবত সহিহ নয়। বরং আল-ফিরুজাবাদী এই বইটি সংকলন করেছেন, এবং সেখানে ইবন আববাসের দিকের নিসবতটির ভিত্তি হলো পরিতাজ্য ভুল রেওয়ায়েত।, এটা হলো মুহাম্মাদ বিন মারওয়ান আস-সুদ্দীর রেওয়ায়েতকৃত, তিনি বর্ননা করেছেন আল-কালবি থেকে, তিনি আবু-সালেহ থেকে, তিনি ইবন আববাস (রা) থেকে "। বক্তব্য সমাপ্ত "আত-তাফসির ওয়াল মুফাসসিরুন " (2/26) থেকে।
আদ্বওয়াউল বায়ান গ্রন্থের লেখকের ছেলে শায়খ আব্দুল্লাহ আল-আমিন আশ-শানকিতিঈ এর বক্তব্য নক্বল করা হয়েছে যে (তার মতে) এই তাফসিরটির সংকলক আলফিরুজাবাদী নন, বরং এর পান্ডুলিপি আল-ফিরুজাবাদীর পুর্বেও পাওয়া গিয়েছে।
এই লিংকটি দেখা যেতে পারে : www.ahlalhdeeth.com
এবং আস-সুদ্দী, এই লোক সম্পর্কে আয-যাহাবি তার (আস-সুদ্দীর) জিবনিতে বলেছেন : "মুহাম্মাদ বিন মারওয়ান আস-সুদ্দী আল-কুফি, এবং সে হলো আস-সুদ্দী আস-সাগির, সে হিশাম বিন আরওয়াহ ও আল-আ'মাশ হতে বর্ননা করেছে, মুহাদ্দিসগন তাকে পরিতাজ্য বিবেচনা করেছেন এবং তাকে কেও কেও মিথ্যার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন। এবং সে আল-কালবীর সংগী "। বক্তব্য সমাপ্ত, "মিযানুল ই'তিদাল"(4/32)
অপরদিকে আল-কালবি, সে হলো মুহাম্মাদ ইবনুস সাইব আল-কালবী, আবুন-নাদ্বার আল-কুফি আল-মুফাসসির, সে একজন মশহুর হাদিস জালকারী ব্যাক্তি। সুফিয়ান বলেছেন : আমাকে আল-কালবি (নিজেই) বলেছেন : 'আমি আবু-সালেহ হতে তোমার নিকট যা কিছুই বর্ননা করেছি তার সবই মিথ্যা '। আহমাদ বিন যুহাইর বলেছেন : আমি আহমাদ বিন হাম্বলকে বললাম : 'আল-কালবির তাফসিরের দিকে নযর দেয়াকি বৈধ হবে '? তিনি (আহমাদ) বললেন : 'না'। দ্বীনের ক্ষেত্রে তার মাযহাব ও প্রকাশ্য মিথ্যা বলা, তার ক্ষেত্রে স্পষ্ট করে দিয়েছে যে কারো জন্যে (তারদ্বারা) দলিল পেশ করাটা মুলত তার অবস্থা নিয়ে বাড়াবাড়ি করা, সে আবু-সালেহ এর সুত্র ধরে ইবন আববাস (রা) হতে তাফসির বর্ননা করেছে, অথচ আবু-সালেহ ইবন আববাসকে দেখেন নি, এবং আল-কালবি নিজেও আবু-সালেহ হতে কিছু শ্রবন করেন নি, শুধুমাত্র আরবি হরফগুলো ধারাবাহিকভাবে শুনেছিল (অর্থাৎ আলিফ বা তা ছা এসব শুনেছিল)। এই লোকের কথা বিভিন্ন গ্রন্থে উল্লেখ্য করাটাই বৈধ নয়! তাহলে তার দ্বারা কিভাবে দলিল দেয়া হবে! । (দেখুন:) "মিযানুল ই'তিদাল"(3/557-559)
ইবন মুয়াইন বলেছেন : ইরাকে একটি কিতাব আছে যা যতদ্রুতসম্ভব দাফন করে দেয়া উচিত, সেটি হলো 'তাফসিরুল কালবী আন আবি-সালিহ '। "মিযানুল ই'তিদাল"(1/645)
কিছু উপকারী গ্রন্থ ও কাজ আছে যেখানে ইবনে আববাস (রা) হতে বর্নিত বিভিন্ন তাফসির সংকলন করা হয়েছে। এইধরনের মিথ্যা বইয়ের তুলনায় এসব ভালো বই ই যথেস্ট ও সন্তোষজনক। এসব ভালো বইয়ের মধ্যে আছে : "তাফসির ইবন আববাস ওয়া মারওইয়াতুহি ফিত-তাফসির মিন কুতুবিস সুন্নাহ ", এর লেখক হলেন : আব্দুল-আযিয বিন আব্দুল্লাহ আল-হুমাইদী। আরেকটি বই আছে "ইবন আববাস ওয়া মানহাজুহু ফিত তাফসির, ওয়া তাফসিরাতুহুস সহিহাহ ফিস সুলুসিল আওয়াল মিনাল কোর'আন ", এর লেখক হলেন : আদম মুহাম্মাদ আলি।
দ্বিতীয়ত,
আল-গারানিক এর কাহিনী, এব্যাপারে আলেমদের মাঝে মতভেদ হয়েছে কেও এক্ষেত্রে হ্যা বলেছেন কেও আবার না বলেছেন। এই খবরটি একাধিক তাবেঈ হতে সহিহভাবে প্রমানিত আছে। এদের মধ্যে আছেন সাইদ বিন জুবাইর, আবু-বকর বিন আব্দির-রহমান বিন আল-হারেস, আবুল-আলিয়াহ, কাতাদাহ, আয-যুহরী। কিন্ত কোনো সাহাবি হতে সনদ ধরে সহিহভাবে এই খবরের উল্লেখ্য আপনি খুজে পাবেন না।
ইবন কাসির রহিমাহুল্লাহ বলেছেন : "মুফাসসিরদের অনেকেই এখানে আল-গারানিক এর কাহিনী উল্লেখ্য করেছেন যে কুরাইশদের মুশরেকরা ইসলাম গ্রহন করেছে এরুপ ধারনার কারনে মুহাজিরদের মধ্যে অনেকে হাবশাহ হতে ফিরে এসেছিলেন, কিন্ত এর সবগুলো সুত্রই মুরসাল, এবং আমি এইমর্মে একটাও সহিহভাবে প্রমানিত সনদ পাইনি। আল্লাহই ভালো জানেন "। বক্তব্য সমাপ্ত "তাফসির ইবন কাসির "(5/441) হতে।
বলা হয় যে : এই কাহিনীটি খুবই বড় একটা ব্যাপার। যদি এটা প্রমানিত হত তাহলে এটি নক্বল করার কারন বা উদ্দেশ্য প্রয়োজন হতো, যেখানে কিনা এটি একটাও সহিহ সনদে বর্নিত হয়নি, তাহলে অবশ্যই এরক্ষেত্রে এই হুকুম লাগানোটাই যথেস্ট ও পর্যাপ্ত হবে যে এর সঠিকতা ও নির্ভরযোগ্যতার কোনো প্রমান নেই।
এবং আরো বলা হয় যে : এর নির্ভরযোগ্যতা প্রমানের জন্য এটাই যথেস্ট যে একাধিক সালাফদের নিকট হতে সহিহ সনদে এটি বর্নিত আছে। আবার অনেকে তাদের নিকট হতে এটি বহু যইফ সনদেও বর্ননা করেছেন। এবং এটা ইংগিত দিচ্ছে যে এই কাহিনীটির নির্ভরযোগ্য ভিত্তি রয়েছে।
মধ্যমপন্থা অবলম্বন করে আরো বলা হয় যে : এটি যদি অবশ্যই প্রমানিত হয়ে থাকে, তাহলে এমনটাও হতে পারে যে ইহার মুল উৎস এমন কেও যাকে শয়তান উক্ত কাহিনীটি কাফেরদের মুখে প্রচলিত ও তাদের দ্বারা শ্রবনকৃত বিষয়গুলো হতে দান করেছে, এবং এই কাহিনী রাসুলুল্লাহ (সা) এর মুখে বলা কোনো কিছু নয়।
এব্যাপারে এই প্রশ্মোত্তরগুলো দেখা উচিত
https://islamqa.info/ar/4135
https://islamqa.info/ar/103304
এবং আল্লাহ তা'য়ালাই ভালো জানেন
[মুল লেখার লিংক : https://islamqa.info/ar/179020]