"একজন কাফের বা অমুসলিম, তার সাথে মুসলিমদের কোনোরুপ আহদ বা জিযিয়াচুক্তি নেই। সে কোনো যোদ্ধা নয়, যুদ্ধের সাথে সে সম্পর্কিত নয়, সে একজন সাধারন ব্যাক্তি। তাকে নিকটে পেলে একজন মুসলিমের জন্য তাকে হত্যা করা যায়েয বা বৈধ " - এমনটা অনেকের ধারনা।
কিন্তু এই ধারনা সঠিক নয়। বরং সঠিক কথা হলো একজন হারবি কাফের যদি যোদ্ধা না হয়, যুদ্ধের সাথে কোনোভাবে সম্পর্কিত না হয় - তাহলে তাকে হত্যা করা যায়েয হবেনা। কিন্ত সে যদি যোদ্ধা হয়, যোদ্ধের সাথে সম্পর্কিত হয়, বা মুসলিমদের জন্য ক্ষতিকর কোনো ব্যাক্তি হয় - তখন তাকে হত্যা করা যাবে।
নিম্নে এরপক্ষে কিছু ফকিহদের বক্তব্য উল্লেখ্য করা হলো :
১/সাহাবি উমার ইবনুল-খাত্তাব রা.
আবু-উবাইদ আল-কাসিম, বর্ননা করেছেন :
حَدَّثَنَا إِسْمَاعِيلُ بْنُ إِبْرَاهِيمَ، حَدَّثَنَا أَيُّوبُ السَّخْتِيَانِيُّ، عَنْ نَافِعٍ، عَنْ أَسْلَمَ، مَوْلَى عُمَرَ أَنَّ عُمَرَ كَتَبَ إِلَى أُمَرَاءِ الْأَجْنَادِ: " أَنْ يُقَاتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَلَا يُقَاتِلُوا إِلَّا مَنْ قَاتَلَهُمْ، وَلَا يَقْتُلُوا النِّسَاءَ وَلَا الصِّبْيَانَ، وَلَا يَقْتُلُوا إِلَّا مَنْ جَرَتْ عَلَيْهِ الْمُوسَى، وَكَتَبَ إِلَى أُمَرَاءِ الْأَجْنَادِ: أَنْ يَضْرِبُوا الْجِزْيَةَ، وَلَا يَضْرِبُوهَا عَلَى النِّسَاءِ وَالصِّبْيَانِ وَلَا يَضْرِبُوهَا إِلَّا عَلَى مَنْ جَرَتْ عَلَيْهِ الْمُوسَى [1]
আমাদের ইসমাইল বিন ইব্রাহিম বলেছেন : আমাদের আইয়ুব আস-সাজাস্তানী বলেছেন : নাফে হতে : আসলাম মাওলা উমার হতে : যে উমার (রা) সৈন্যবাহিনীগুলোর সেনাপতিদের প্রতি চিঠিতে লিখেছেন যে 'তারা যেন আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করে, এবং শুধুমাত্র তাদেরকেই হত্যা করে যারা তাদের (মুজাহিদদের) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে, এবং তারা (মুজাহিদরা) যেন নারিদের ও শিশুদের হত্যা না করে, এবং শুধুমাত্র তাদেরকেই হত্যা করে যাদের নাভির নিচে চুল গজিয়েছে ', তিনি সেনাপতিদের নিকট আরো লিখেছেন : 'যে তারা যেন যিযিয়াহ প্রয়োগ করে, এবং নারি ও শিশুদের উপর যেন জিযিয়া প্রয়োগ না করে, এবং শুধুমাত্র তাদের উপরই যিযিয়াহ প্রয়োগ করে যাদের নাভির নিচে চুল গজিয়েছে।
এই বর্ননাটির সনদ - "সহিহ " [2]
২/তাকিউদ্দিন ইবনু তাইমিয়াহ রহ.
তিনি বলেছেন :
الدَّلِيلُ الأَوَّلُ عَلَى تَحْرِيمِ قَتْلِ الكَافِرِ لمُجَرَّدِ كُفْرِهِ.فَهَذَا الأَصْلُ الَّذِي ذَكَرْنَاهُ - وَهُوَ أَنَّ القِتَالَ لِأَجْلِ الحِرَابِ لَا لِأَجْلِ الكُفْرِ - هُوَ الَّذِي يَدُلُّ عَلَيهِ الكِتَابُ وَالسُّنَّةُ، وَهُوَ مُقْتَضَى الاعتبار…[3]
"শুধুমাত্র কাফের হয়ার কারনে কাওকে হত্যা করা হারাম হয়ার স্বপক্ষে প্রথম দলিল, এইযে নিতীটি আমি উল্লখ্য করলাম, তা হলো এই যে কাওকে হত্যা করা যায় তার যোদ্ধা হয়ার কারনে, তার কাফের হয়ার কারনে নয়। কোরান ও সুন্নাহ এটার দিকেই ইংগিত দেয়। এবং এই বিষয়টা গুরুত্বপুর্ন। "
৩/ আবুল-ফারাজ ইবনুল-যাওযি রহ.
তিনি বলেছেন :
لَا يحسن قتل النِّسَاء لمعنيين: أَحدهمَا: أَنَّهُنَّ لَا يقاتلن فِي الْأَغْلَب، وَفِي قتل من لَا يُقَاتل نوع جور[4]
"(যুদ্ধে) মহিলাদের হত্যা করা ভালো কাজ নয়, দুইটি কারনে : একটি হলো এই যে তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যুদ্ধ করেনা। এবং যে যুদ্ধ করেনা তাকে হত্যা করাটা একটা অন্যায়। "
৪/মাযহারুদ্দিন আয-যাইদানী রহ.
তিনি বলেছেন :
قوله: "ما كانت هذه لتقاتل"؛ أي: لم تكن من المحاربين؛ يعني: إنما يُقتل الكافر المحارب، ولا يقتل مَن ليس بمحاربٍ كالنساء والصبيان[5]
রাসুল (সা) এর কথা "এই মহিলা তো যুদ্ধ করেনা " অর্থাৎ সে যোদ্ধাদের অন্তর্ভুক্ত নয়। অর্থাৎ যোদ্ধা কাফেরকে হত্যা করা হবে, যে যোদ্ধা নয় তাকে হত্যা করা হবেনা, যেমন : নারি, শিশু
৫/ ইবনুল-মালাক আল-কারামানী রহ.
তিনি বলেছেন :
إنما ينبغي أن يُقْتَلَ الكافر المحارب، وهذه ما كانت مِنَ المحاربين
"অবশ্যই হত্যা করা প্রযোজ্য যোদ্ধা কাফেরের জন্য, এবং এই মহিলা যোদ্ধাদের অন্তর্ভুক্ত ছিলনা " …[6]
৬/ নুরুদ্দিন আবুল-হাসান আস-সিনদী রহ.
তিনি বলেছেন :
'ما كانت هذه' أخذ منه أن المبيح للقتل هو الحرب لا الكفر. والأول مذهب الحنفية…[7] [8]
"এই মহিলাত (যোদ্ধা) ছিলনা" এর থেকে পাওয়া যায় যে (অমুসলিম)কাওকে হত্যা করাকে যা বৈধ সাব্যস্ত করে তা হলো 'তার যুদ্ধ করা ', তার কুফুরি করা নয়। এবং প্রথমটি (অর্থাৎ যুদ্ধ করার কারনেই একজন অমুসলিমকে হত্যা করা বৈধ হয়ার ব্যাপারটি) হানাফিদের মাযহাব। "
৭/ "আল-মাওসুয়াতুল ফিকহিয়াতুল কুয়েতিয়াহ" তে বলা হয়েছে :
اتَّفَقَ الْفُقَهَاءُ عَلَى أَنَّ دَمَ الْكَافِرِ الْحَرْبِيِّ - وَهُوَ غَيْرُ الذِّمِّيِّ وَالْمُعَاهَدِ وَالْمُؤَمَّنِ - مُهْدَرٌ، فَإِنْ قَتَلَهُ مُسْلِمٌ فَلاَ تَبِعَةَ عَلَيْهِ إِذَا كَانَ مُقَاتِلاً، أَمَّا إِذَا كَانَ الْكَافِرُ الْحَرْبِيُّ غَيْرَ مُقَاتِلٍ كَالنِّسَاءِ وَالصِّبْيَانِ وَالْعَجَزَةِ وَالرُّهْبَانِ وَغَيْرِهِمْ مِمَّنْ لَيْسُوا أَهْلاً لِلْقِتَال أَوْ لِتَدْبِيرِهَا فَلاَ يَجُوزُ قَتْلُهُ، وَيُعَزَّرُ قَاتِلُهُ، إِلاَّ إِذَا اشْتَرَكَ فِي حَرْبٍ ضِدَّ الْمُسْلِمِينَ أَوْ أَعَانَهُمْ بِرَأْيٍ أَوْ تَدْبِيرٍ أَوْ تَحْرِيضٍ…[9]
"ফকিহগন একমত হয়েছেন যে (ফিকহি দৃষ্টিকোনে) হারবি কাফের অর্থাৎ যে যিম্মি নয়, মুয়াহাদ নয়, মু'মিন নয় তার রক্ত(জীবন) অর্থহীন। যদি হারবি কাফের যোদ্ধা হয়ে থাকে, তাহলে তাকে কোনো মুসলিম হত্যা করলে কোনো সমস্যা নেই। কিন্ত যদি সেই হারবি কাফের যোদ্ধা না হয়, যেমন : মহিলা, শিশু, বৃদ্ধ, অক্ষম, সন্যাসী এবং তাদের ব্যাতিত এমন সব ব্যাক্তিরা যাদের সাথে যুদ্ধের কোনো সম্পর্ক নেই বা যুদ্ধের ব্যবস্থাপনায় তাদের কোনো অবদান নেই, তাহলে এইধরনের কোনো ব্যাক্তিকে হত্যা করা বৈধ নয়। কেও তাদের হত্যা করলে শাস্তি পাবে। তবে শর্ত হলো এই ব্যাক্তিরা মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে শরিক হতে পারবেনা, পরামর্শ দেয়ার মাধ্যমে কাফের সৈন্যদের সাহায্য করতে পারবেনা, কাফের সৈন্যদের পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনায় অবদান রাখতে পারবেনা, কাফের সৈন্যদের উৎসাহপ্রদান করতে পারবেনা। " (মর্ম উল্লেখিত)
৮/আব্দুর-রহমান বিন নাসির আস-সাদী রহ.
তিনি বলেছেন :
والنهي عن الاعتداء، يشمل أنواع الاعتداء كلها، من قتل من لا يقاتل، من النساء، والمجانين والأطفال، والرهبان ونحوهم [10]
"সিমালংঘনে নিষেধ রয়েছে। এবং সিমালংঘনের সকল বিষয় এখানে উদ্দেশ্য, যে এমন কাওকে হত্যা করল যে যুদ্ধ করেনা, হত্যাকৃত হতে পারে নারি, পাগল, শিশু, সন্ম্যাসী এবং এইধরনের মানুষরা "(মর্ম উল্লেখিত)
৯/ মাওফিকুদ্দিন ইবনু কুদ্দামাহ আল-হাম্বলী রহ.
তিনি উনার "আল-মুগনী " গ্রন্থে এব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। উনার আলোচনা হতে ইংগিত পাওয়া যায় যে হত্যা তাদেরই করা বৈধ যারা যোদ্ধা [11]
১০/আবুল-হুসাইন আহমদ আল-কুদুরী রহ.
উনি উনার "আত-তাজরিদ " গ্রন্থে এব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। উনার আলোচনা হতে ইংগিত পাওয়া যায় যে হত্যা তাদেরই করা বৈধ যারা যোদ্ধা [12]
১১/আকমালুদ্দিন আবু-আব্দুল্লাহ আল-বাবরাতী রহ.
তিনি তার লিখিত আল-হিদায়ার ব্যাখ্যাগ্রন্থ "আল-ইনায়াহ" তে বলেছেন :
وَقَوْلُهُ (لِأَنَّ الْمُبِيحَ عِنْدَهُ) أَيْ لِلْقِتَالِ هُوَ (الْكُفْرُ) وَعِنْدَنَا هُوَ الْحِرَابُ[13]
এবং তার (হিদায়ার লেখকের) বক্তব্য (কেননা তার নিকট যায়েয হয়ার কারন হলো) অর্থাৎ হত্যা যায়েয হয়ার, (কাফের হয়া) কিন্ত আমাদের নিকট হত্যা যায়েয হয়ার কারন হলো "যোদ্ধা হয়া "।
১২/আল-হুসাইন বিন আলি আস-সাগ্নাক্বী রহ.
তিনি বলেছেন :
لأن نفس الكفر غير مبيح للقتل إذا لم يكن من أهل صلاحية القتال؛ لأن قتل رهابين الكفار وشيوخهم ونسائهم غير مشروع، بل المبيح للقتل كفر المحارب أو صلاحيته[14]
একজন কাফের ব্যাক্তিকে হত্যা করা বৈধ নয়, যদি সে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত-উপযোগি না হয়। কেননা কাফেরদের মধ্যকার সন্ন্যাসী, বৃদ্ধ ও নাড়িদের হত্যা করা শরিয়ত পরিপন্থি, বরং কাফেরকে হত্যা করা যায়েব হবে তখন যখন সে যোদ্ধা হয় অথবা যুদ্ধের জন্য প্রস্তত উপযুক্ত হয়
১৩/ শামসুল-আয়িম্মা আবু-বকর আস-সারখাসী রহ.
তিনি বলেছেন :
لِأَنَّ الْمُبِيحَ لِلْقَتْلِ شَرُّهُمْ مِنْ حَيْثُ الْمُحَارَبَةُ، فَإِذَا أَغْلَقُوا الْبَابَ عَلَى أَنْفُسِهِمْ انْدَفَعَ شَرُّهُمْ مُبَاشَرَةً وَتَسْبِيبًا…[15]
"কাফেরদের হত্যা করাকে বৈধ সাব্যস্তকারি বিষয়টি হলো যুদ্ধে তাদের নিকট হতে অর্জিত ক্ষতি, তবে যদি তারা নিজেদেরকে ঘড়বন্দি করে নেয় তাহলে তাদের ক্ষতি করার সম্ভাবনা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দূর হয়ে যায়। "
১৪/বুরহানুদ্দিন আল-ফারগানী আল-মারগিনানী রহ.
তিনি বলেছেন :
لأن المبيح للقتل عندنا هو الحراب[16]
কাফেরদের হত্যা করা বৈধ সাব্যস্তকারি বিষয়টি হলো 'যোদ্ধা হয়া '
১৫/বদরুদ্দিন আল-আইনী রহ.
তিনি আল-হিদায়াহর ব্যাখ্যাগ্রন্থ "আল-বিনায়াহ" তে আল-মারগিয়ানির বক্তব্যের সমর্থন দিয়েছেন [17]
১৬/কামালুদ্দিন আস-সাইওয়াসী রহ.
তিনিও আল-মারগিনানির সিদ্ধান্তের পক্ষে বলেছেন [18]
১৭/ যাইনুদ্দিন ইব্রাহিম আল-হানাফী রহ.
তিনি বলেছেন :
أَيْ نُهِينَا عَنْ قَتْلِ هَؤُلَاءِ؛ لِأَنَّ الْمُبِيحَ لِلْقَتْلِ عِنْدَنَا هُوَ الْحِرَابُ[19]
অর্থাৎ আমাদেরকে এদের হত্যা করতে নিষেধ করা হয়েছে। কেননা আমাদের নিকট কোনো কাফেরকে হত্যা করা বৈধ সাব্যস্তকারি বিষয়টি হলো 'যুদ্ধ করা '
টিকাসমুহ :
[1]আল-আমওয়াল (হা/93)
[2]ইরওয়াউল গালিল (5/96)
[3]কাইদাতুন মুখতাসারাহ ফি কিতালিল কুফফার (পৃ/188)
[4]কাশফুল মুশকিল (2/569)
[5]আল-মাফাতিহ ফি শারহিল মাসাবিহ (4/408)
[6]শারহুল মাসাবিহ(4/397)
[7]ফাতহুল উদুদ (3/122)
[8]হাশিয়াহ আলা সুনানে ইবন মাজাহ (2/195)
[9]আল-মাওসুয়াতুল ফিকহিয়াতুল কুয়েতিয়াহ (42/198)
[10]তাফসিরুস সা'দী (পৃ/89)
[11]আল-মুগনী (13/175-180)
[12]আত-তাজরিদ (12/6146)
[13]আল-ইনায়াহ (5/453)
[14]আল-কাফি শারহুল বাযুদী (2/958)
[15]শারহুস সিইরিল কাবির (পৃ/41)
[16]আল-হিদায়াহ (2/380)
[17]আল-বিনায়াহ (7/109)
[18]ফাতহুল কাদির আলাল হিদায়াহ (5/453)
[19]আল-বাহরুর রাইক (5/84)