Are you sure?

বিজ্ঞান »  ইসলাম ও বিজ্ঞান

সুর্যের আরশের নিচে সেজদাহ করা সক্রান্ত হাদিস সম্পর্কে আলোচনা

 

আমরা প্রতিদিন আকাশে সুর্যকে দেখতে পাই। সুর্য প্রতিদিন পুর্ব দিক হতে উদিত হয়, এবং তা ধীরে ধীরে আকাশে চলতে থাকে, ভ্রমন করতে থাকে। তারপর চলতে চলতে তা একটা সময় পশ্চিম দিকে অস্ত যায়। বাস্তবে আসলেই এমনটা হয়, নাকি হয়না, তা ভিন্ন বিষয়। কিন্ত আমরা আমাদের চক্ষুদ্বয় ও দৃষ্টিশক্তি দ্বারা এটাই দেখতে পাই এবং এতে কোনো সন্দেহ নেই, কোনো সংশয় নেই,এটা অস্বিকার করার কোনো উপায় নেই। এটা একটা সুস্পষ্ট বাস্তবতা, যে আমরা এমনটা দেখতে পাই।

বিজ্ঞান আবিস্কার করেছে যে সুর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরেনা বরং পৃথিবী সুর্যের চারদিকে ঘোরে এবং এটাই বাস্তবতা।বাস্তবতা যাই হোক, আমরা আমাদের চক্ষুদ্বয় ও দৃষ্টিশক্তি দ্বারা এটা দেখতে পাবনা যে পৃথিবী সুর্যের চারদিকে ঘোরছে বরং আমরা দেখতে পাব যে সুর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরছে। অর্থাৎ পৃথিবী সুর্যের চারদিকে ঘোরলেও আমরা পৃথিবী থেকে দেখতে পাব সুর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরছে। বিজ্ঞানের এই আবিস্কার আমাদের দেখা উক্ত বিষয়টিকে ভুল সাব্যস্ত করে কিন্ত আমরা যে এমনটা আমাদের চক্ষু দ্বারা দেখতে পাচ্ছি, এই দেখার বিষয়টাকে বিজ্ঞান অস্বিকার করেনা, অর্থাৎ বিজ্ঞান এইটা বলেনা যে মানুষ পৃথিবী থেকে সুর্যকে পৃথিবীর চারদিকে ভ্রমন করতে বা চলতে দেখেনা, এক্ষেত্রে বিজ্ঞান বলে যে মানুষ পৃথিবী থেকে যা দেখছে তা প্রকৃত বাস্তবতা নয়।

এখন আমি যদি মানুষ যেভাবে বিষয়টা দেখছে, সেটার আলোকে, সেটার অনুসরনে অর্থাৎ পৃথিবীতে থাকা একজন মানুষের দৃষ্টি-সাপেক্ষে বিবেচনা করে সুর্যের ক্ষেত্রে বলি যে তা পৃথিবীর চারদিকে ঘোরছে, তাহলে তা ভুল হবেনা। কেননা আমার এই কথাটি আপেক্ষিতার আলোকে বলা হয়েছে, এখানে আমার প্রসংগবিন্দু হলো মানুষের দৃষ্টি, আমি মানুষের দৃষ্টি সাপেক্ষে কথাটা বলেছি। আমার এই কথাটি দ্বারা সুর্যের প্রকৃত গতি কিরুপ, তা উদ্দেশ্য নয়, বরং আমার এই কথাটি দ্বারা একজন সাধারন মানুষ (layman) সুর্যকে প্রতিদিন আকাশে যেভাবে চলতে দেখছে সেই বিষয়টি উদ্দেশ্য,অর্থাৎ মানুষের দৃষ্টিসাপেক্ষে সুর্যের আপেক্ষিক গতিটা উদ্দেশ্য।

এই বিষয়টির আলোকে যদি আমি বলি  "সুর্যোদয় হয়েছে, সুর্যাস্ত হয়েছে", তাহলে এর অর্থ এইনা যে আমি পৃথিবীর চারদিকে সুর্যের ঘুর্ননকে সুর্যের বাস্তব গতি বুঝিয়েছি, বরং এর অর্থ হলো এই যে মানুষ সুর্যের ক্ষেত্রে যা ব্যাহ্যিক দৃষ্টিতে দেখে, আমি তা অনুযায়ি একটি কথা উল্লেখ্য করেছি, বা আমি মানুষের দৃষ্টিসাপেক্ষে সুর্যের আপেক্ষিক গতিটির কথা উল্লেখ্য করেছি। এবং মানুষের দৃষ্টিসাপেক্ষে সুর্যের আপেক্ষিক গতির বিষয়টি কোর'আন ও হাদিসের অনেক স্থানে বর্নিত হয়েছে, উল্লেখিত হয়েছে।

মানুষ সুর্যকে পৃথিবীর চারদিকে চলমান ও প্রদক্ষিনরত দেখতে পায়। কিন্ত মানুষের এই দেখতে পাওয়াটা এটা প্রমান করেনা যে সুর্য আসলেই পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে। বরং মানুষ যা দেখে, তা হলো মানুষের দৃষ্টিসাপেক্ষে সুর্যের আপেক্ষিক গতি। কোর'আন হাদিসের বিভিন্ন অংশ থেকে সুর্যের পৃথিবীর চারদিকে ঘোরা সক্রান্ত যেসব যুক্তিগুলো দেয়া হয়, তার অধিকাংশক্ষেত্রেই সেই যুক্তিগুলোর পক্ষে অবস্থানকারী ব্যাক্তিগন এই সাধারন বিষয়টি অসতর্কতা ও বেখেয়ালির দরুন ভুলে যান কিংবা বিবেচনা করেন না।

"সুর্যের আরশের নিচে সেজদাহ করা" সক্রান্ত হাদিসগুলো বিজ্ঞানসম্মত, নাকি না। এবিষয়ে সামনে যেসব কথাবার্তা আসবে, সেগুলো বুঝার জন্য,অনুধাবনের জন্য উপরে উল্লেখিত বিষিয়গুলো ভালভাবে বুঝে নেয়াটা জরুরি।

হাদিসটির সবগুলো সংস্করন (version) উল্লেখ্য করা হলো : …[1]

عن أبي ذر أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم قَالَ يَوْمًا: أَتَدْرُونَ أَيْنَ تَذْهَبُ هَذِهِ الشَّمْسُ؟ قَالُوا: اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ، قَالَ: إِنَّ هَذِهِ تَجْرِي حَتَّى تَنْتَهِيَ إِلَى مُسْتَقَرِّهَا تَحْتَ الْعَرْشِ، فَتَخِرُّ سَاجِدَةً، وَلَا تَزَالُ كَذَلِكَ حَتَّى يُقَالَ لَهَا: ارْتَفِعِي، ارْجِعِي مِنْ حَيْثُ جِئْتِ، فَتَرْجِعُ، فَتُصْبِحُ طَالِعَةً مِنْ مَطْلِعِهَا، ثُمَّ تَجْرِي حَتَّى تَنْتَهِيَ إِلَى مُسْتَقَرِّهَا تَحْتَ الْعَرْشِ، فَتَخِرُّ سَاجِدَةً، وَلَا تَزَالُ كَذَلِكَ حَتَّى يُقَالَ لَهَا: ارْتَفِعِي، ارْجِعِي مِنْ حَيْثُ جِئْتِ، فَتَرْجِعُ، فَتُصْبِحُ طَالِعَةً مِنْ مَطْلِعِهَا، ثُمَّ تَجْرِي لَا يَسْتَنْكِرُ النَّاسُ مِنْهَا شَيْئًا حَتَّى تَنْتَهِيَ إِلَى مُسْتَقَرِّهَا ذَاكَ تَحْتَ الْعَرْشِ، فَيُقَالُ لَهَا: ارْتَفِعِي، أَصْبِحِي طَالِعَةً مِنْ مَغْرِبِكِ، فَتُصْبِحُ طَالِعَةً مِنْ مَغْرِبِهَا، فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم: أَتَدْرُونَ مَتَى ذَاكُمْ؟ ذَاكَ حِينَ لَا يَنْفَعُ نَفْسًا إِيمَانُهَا لَمْ تَكُنْ آمَنَتْ مِنْ قَبْلُ أَوْ كَسَبَتْ فِي إِيمَانِهَا خَيْرًا.) "

- وفي رواية: تَغِيبُ الشَّمْسُ تَحْتَ الْعَرْشِ، فَيُؤْذَنُ لَهَا فَتَرْجِعُ، فَإِذَا كَانَتْ تِلْكَ اللَّيْلَةُ الَّتِى تَطْلُعُ صَبِيحَتَهَا مِنَ الْمَغْرِبِ لَمْ يُؤْذَنْ لَهَا، فَإِذَا أَصْبَحَتْ، قِيلَ لَهَا: اطْلَعِى مِنْ مَكَانِكِ، ثُمَّ قَرَأَ: "هَلْ يَنْظُرُونَ إِلَاّ أَنْ تَأْتِيَهُمُ الْمَلَائِكَةُ أَوْ يَأْتِيَ رَبُّكَ أَوْ يَأْتِيَ بَعْضُ آيَاتِ رَبِّكَ".

- وفي رواية: قَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم لأَبِي ذَرٍّ حِينَ غَرَبَتِ الشَّمْسُ: تَدْرِي أَيْنَ تَذْهَبُ؟ قُلْتُ: اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ، قَالَ: فَإِنَّهَا تَذْهَبُ حَتَّى تَسْجُدَ تَحْتَ الْعَرْشِ، فَتَسْتَأْذِنَ، فَيُؤْذَنَ لَهَا، وَيُوشِكُ أَنْ تَسْجُدَ فَلَا يُقْبَلَ مِنْهَا، وَتَسْتَأْذِنَ فَلَا يُؤْذَنَ لَهَا، يُقَالُ لَهَا: ارْجِعِى مِنْ حَيْثُ جِئْتِ، فَتَطْلُعُ مِنْ مَغْرِبِهَا، فَذَلِكَ قَوْلُهُ تَعَالَى: "وَالشَّمْسُ تَجْرِي لِمُسْتَقَرٍّ لَهَا ذَلِكَ تَقْدِيرُ الْعَزِيزِ الْعَلِيمِ".) ".

- وفي رواية: دَخَلْتُ الْمَسْجِدَ وَرَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم جَالِسٌ، فَلَمَّا غَرَبَتِ الشَّمْسُ، قَالَ: يَا أَبَا ذَرٍّ، هَلْ تَدْرِي أَيْنَ تَذْهَبُ هَذِهِ؟ قَالَ: قُلْتُ: اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ، قَالَ: فَإِنَّهَا تَذْهَبُ تَسْتَأْذِنُ فِي السُّجُودِ، فَيُؤْذَنُ لَهَا، وَكَأَنَّهَا قَدْ قِيلَ لَهَا: ارْجِعِي مِنْ حَيْثُ جِئْتِ، فَتَطْلُعُ مِنْ مَغْرِبِهَا

ثُمَّ قَرَأَ: "ذَلِكَ مُسْتَقَرٌّ لَهَا فِي قِرَاءَةِ عَبْدِ اللهِ.

- وفي رواية: سَأَلْتُ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم عَنْ قَوْلِهِ تَعَالَى: "وَالشَّمْسُ تَجْرِي لِمُسْتَقَرٍّ لَهَا) قَالَ: مُسْتَقَرُّهَا تَحْتَ الْعَرْشِ.)

প্রথম কথা ; এই হাদিসে মানুষের দৃষ্টিসাপেক্ষে সুর্যের আপেক্ষিক গতি উদ্দেশ্য। আমার উক্ত দাবির পক্ষে প্রমান হলো এই যে - হাদিসটিতে মুহাম্মাদ ﷺ সুর্যের চলন বুঝানোর জন্য 
'জারইয়ুন'(جري) শব্দটি ব্যবহার করেছেন। আরবি ভাষাতে এই "জারইয়ুন" শব্দটি যখন সুর্যের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়, তখন তাদ্বারা ব্যাহ্যিক দৃষ্টিতে আমরা দিনের বেলায় সুর্যকে আকাশের মধ্যে যেভাবে ভ্রমন করতে দেখি, সেই ভ্রমন বা চলন কে বুঝানো হয়। অর্থাৎ পুর্ব হতে উদিত হয়ে পশ্চিমে অস্ত যাওয়া পর্যন্ত সুর্যের সেই ভ্রমন যা আমাদের দৃষ্টিসাপেক্ষে ঘটে থাকে, সেটা বুঝানো হয়। ইবন মানযুর, ইবন সিদাহ ও আয-যুবাইদি সুস্পষ্টভাবে এইকথা উনাদের রচিত অভিধানগুলোতে লিখে গিয়েছেন [2][3][4]। এবং কুতরাবের রচিত গ্রন্থ "আল-আযমিনাহ ওয়া তালবিয়াতুল জাহিলিয়াহ" হতে প্রমান পাওয়া যায় যে জাহেলি যুগ থেকেই সুর্যের ক্ষেত্রে 'জারইয়ুন'(جري) শব্দটির এরুপ ব্যবহার হয়ে আসছে [5]। সুতরাং এই হাদিসে যে মানুষের দৃষ্টি সাপেক্ষে সুর্যের আপেক্ষিক গতি উদ্দেশ্য, তা একদম ভাষাগতভাবেই প্রমানিত। অপরদিকে এই হাদিসের আরেকটি রুপ বা version এ সুর্যের ক্ষেত্রে "গায়বুন" (غيب) শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। এবং এই গায়বুন (غيب) শব্দটি দ্বারা "চক্ষু ও দৃষ্টিশক্তি হতে কোনোকিছুর হারিয়ে যাওয়া, গোপন হয়ে যাওয়া " বুঝানো হয় [6]। এরদ্বারা আরো সুস্পষ্টভাবে প্রমানিত হয় যে এখানে মানুষের দৃষ্টি সাপেক্ষে সুর্যের আপেক্ষিক গতি উদ্দেশ্য।

দ্বিতীয় কথা ; 'আরশের নিচে ' সুর্যের জন্য নির্দিষ্ট একটি স্থান (মুস্তারকার) রয়েছে যেখানে গিয়ে সুর্য সেজদাহ করে। কিন্ত 'আরশের নিচ ' বলতে কোনো নির্দিষ্ট স্থান বুঝানো হয়না, কেননা সমগ্র সৃষ্টিজগতই আরশের নিচে অবস্থান করে, সর্বদা করেছিল ও সর্বদা করতে থাকবে। ইবনুল-কাইয়ুম, ইবন তাইমিয়াহ, ইবন কাসির, ইবিন আবিল-আযয, আয-যাহাবী কাযি আইয়ায, এরুপ বলেছেন [7][14]। অর্থাৎ সুর্য যেখানে যেভাবেই থাকুক, তা সর্বদা আরশের নিচেই ছিল আছে ও থাকবে। আরশের নিচে যাওয়ার জন্য তার নির্দিষ্ট কোনো স্থানে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। সুতরাং এটা বলাতে ভুল হবেনা যে সুর্য যেখানে যেভাবে আছে, সেখানেই  স্থির হয়ে সেজদাহ করে এবং তারপর পুনরায় চলতে থাকে।

ইবন কাসির উক্ত হাদিস সম্পর্কে বলেছেন :
"وَلَا يَدُلُّ عَلَى أَنَّهَا تَصْعَدُ إِلَى فَوْقِ السَّمَاوَاتِ مِنْ جِهَتِنَا حَتَّى تَسْجُدَ تَحْتَ الْعَرْشِ بَلْ هِيَ تَغْرُبُ عَنْ أَعْيُنِنَا، وَهِيَ مُسْتَمِرَّةٌ فِي فَلَكِهَا الَّذِي هِيَ فِيهِ"[8]
"এই হাদিস এটা ইংগিত দিচ্ছেনা যে সুর্য আকাশমন্ডলীর উপরে আরোহন করে আরশের নিচে সেজদাহ করে, বরং সুর্য আমাদের দৃষ্টি হতে অস্ত যায় এবং তা তার নিজ কক্ষপথেই সর্বদা বহাল থাকে "

তৃতীয় কথা ; বিশ্বের একেক প্রান্তে একেক সময় সুর্যের অবস্থা একেক রকম দেখায়, কিছু স্থানে যখন সুর্যাস্ত হয়, কিছু স্থানে তখন সুর্যোদয় হয়, আবার কিছুস্থানে তখন সুর্য আকাশে বহাল থাকে। এবিষয়টি তখনিই সম্ভব যখন পৃথিবী গোল হবে। এবং  "পৃথিবী গোল ", এব্যাপারে অধিকাংশ উলামাগন একমত হয়েছেন [9]। পৃথিবী যদি গোল হয়, তাহলে একই সময়ে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে সুর্যের অবস্থা ভিন্ন ভিন্ন হতে বাধ্য, পৃথিবী গোল হলে এটা হতেই হবে। এবং আলেমদের কেও কেও এবিষয়টিও বিশেষভাবে উল্লেখ্য করেছেন [10]। স্থানভেদে আকাশে সুর্যের অবস্থার ভিন্নতার বিষয়টি একটি বাস্তবতা, এটি অস্বিকার করার কোনো সুযোগ নেই।

এই হাদিসটি উক্ত বাস্তবতাকে অস্বিকার করেনা, উক্ত বাস্তবতার বিরুদ্ধে কিছু বলেনা [11]। হাদিসটি হতে জানা যাচ্ছে যে সুর্য তখন সেজদাহ করে যখন অস্ত যায়। অর্থাৎ মানুষের ব্যাহ্যিক দৃষ্টি সাপেক্ষে যখন তা পশ্চিম দিকে অস্ত যায়, তখন তা সেজদাহ করে। সুর্যের অস্ত কিভাবে হয়, কেন হয়, কখন হয়, কোথায় হয় _ এই ধরনের কিছুই হাদিসে বলা হয়নি, সুতরাং সুর্যাস্তের সময় সুর্যের সেজদাহ করার ব্যাপারটি দ্বারা স্থানভেদে একই সময়ে সুর্যের অবস্থা একেক রকম হয়ার বাস্তবতাটি ভুল সাব্যস্ত হয়না। হাদিসটিতে শুধুমাত্র সুর্যাস্ত ও সুর্যোদয়ের কথা উল্লেখ্য আছে, কিন্ত উক্ত বাস্তবতাটি সম্পর্কে কোনো কথা উল্লেখ্য নেই, হাদিসটিতে এমন কিছুই নেই যা উক্ত বাস্তবতাকে অস্বিকার করে কিংবা সমর্থন করে। এই বাস্তবতা সম্পর্কে হাদিসটি নিরব অর্থাৎ কিছু বলেনি।

যেখানে হাদিসটি উক্ত বাস্তবতা সম্পর্কে কোনো মন্তব্যই করেনি, সেখানে উক্ত বাস্তবতা আর উক্ত হাদিসের মাঝে কোনো বিরোধ থাকতে পারেনা, থাকা সম্ভব না। আর বাস্তবেও তা নেই। কিছু লোক দাবি করে যে উক্ত বাস্তবতার সাথে হাদিসটির বিরোধ আছে, কিন্ত তাদের এই দাবির ভিত্তি হলো তাদের নিজস্ব কল্পনা ও আবোল-তাবোল চিন্তাভাবনা, হাদিসটিতে এমন কিছুই নেই যা তাদের দাবিটির ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

এখন প্রশ্ন হলো সবসময়ইত পৃথিবীর কোনো না কোনো স্থানে সুর্যাস্ত হতে থাকে, তাহলে সুর্য কোন সময় সেজদাহ করে?এক্ষেত্রে বাস্তবতা ও উক্ত হাদিস হতে প্রাপ্ত তথ্যের সমন্বয় করে একটি উত্তর দেয়া যায়। হাদিসটি আমাদের জানাচ্ছে যে যখন সুর্যাস্ত হয়, তখন সুর্য সেজদাহ করে, আবার বাস্তবতা আমাদের জানাচ্ছে যে সবসময়ই পৃথিবীর কোনো না কোনো প্রান্তে সুর্যাস্ত হচ্ছে। সুতরাং মানুষদের দৃষ্টি সাপেক্ষে সুর্যাস্ত হয়া অনুযায়ি হিসেব করলে সুর্য সবসময়ই সেজদাহ করছে। অর্থাৎ সুর্য ততবার সেজদাহ করে যাচ্ছে যতবার পৃথিবীর কোনো না কোনো প্রান্তের মানুষের দৃষ্টি সাপেক্ষে তা অস্ত যাচ্ছে। আমার এই কথাটির সমর্থনকারি হিসেবে কিছু আলেমদের বক্তব্যও আছে, যেমন : ইবন তাইমিয়াহ [12],ইবন আশুর [15],আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ আল-গুনাইমান[13]।

চতুর্থ কথা ; হাদিসটিতে বলা হয়েছে যে সুর্য আমাদের দৃষ্টিসাপেক্ষে চলতে থাকে, এবং যখন তা অস্ত যায় তখন সেটা তার মুস্তাকারে গিয়ে স্থির হয়, স্থির হয়ে সেজদাহ করে। সেজদাহ করার পর তাকে পুর্বের অবস্থায় ফিরে যেতে বলা হয়, ফলে সুর্য সেজদাহরত অবস্থা হতে পৃথক হয়ে নিজের পুর্বের অবস্থায় ফিরে আসে এবং পুনরায় আমাদের দৃষ্টিসাপেক্ষে চলতে থাকে, উদিত হয়, অস্ত যায়, উদিত হয় _ এভাবে বিষয়টা চলতে থাকে।

সুর্যের স্থির হয়া, স্থির হয়ে সেজদাহ করা, সেজদাহরত অবস্থা হতে পৃথক হয়া, পৃথক হয়ে আবার পুর্বের অবস্থায় ফিরে যাওয়া _ এইবিষয়গুলো হচ্ছে ইলমুল গায়েব এর অন্তর্ভুক্ত বিষয়। অর্থাৎ এগুলো এমন বিষয় যা মানবজাতির পক্ষে কখনৌই কোনোভাবেই পর্যবেক্ষন করা বা আবিষ্কার করা সম্ভব না। এটাই মুহাদ্দিসদের ব্যাখ্যা ও সিদ্ধান্ত, বহু মহাদ্দিস এই ব্যাখ্যার সমর্থন দিয়েছেন,তাদের মধ্যে আছেন : আল-খাত্তাবী, আত-তাইবী, মোল্লা আলি আল-কারী, আবু-মুহাম্মাদ আলবাগভি,আব্দুল্লাহ আল-গুফাইলি,আয-যাইদানি,আল-বায়হাকী, আল-মুবারকপুরী, যাইনুদ্দিন আল-ইরাকি, ইবনুল মালাক, বদরুদ্দিন আল-আইনী, আল-বিরমাওই, আদ-দামামিনী, শামসুদ্দিন আল-কিরামানী [16]।

যে বিষয়টি মানুষদের পক্ষে কোনোভাবেই পর্যবেক্ষন করা বা আবিস্কার করা সম্ভব নয়, সেটার বৈজ্ঞানিক-অবৈজ্ঞানিক হয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলাটাই অযৌক্তিক।

পঞ্চম কথা ; হাদিসটিতে বলা হয়েছে যে একসময় আল্লাহ সুর্যকে পশ্চিম দিক হতে উদিত হয়ার আদেশ দিবেন। এই বিষয়টিও মানুষের দৃষ্টি সাপেক্ষে সুর্যের আপেক্ষিক গতির উপর ভিত্তি করে বলা হয়েছে। এখানে সুর্যের পশ্চিমে উদিত হয়া দ্বারা মহাবিশ্বের সমস্ত  নিয়মকানুন ও শৃংখলার মধ্যে ব্যাঘাত ও সমস্যা সৃষ্টি হয়ার বিষয়টি উদ্দেশ্য, মহাবিশ্বের সকল নিয়মকানুন ও শৃংখলার মধ্যে ব্যাঘাত ও সমস্যা সৃষ্টি হবে, ফলে মানুষের দৃষ্টি সাপেক্ষে সুর্যের আপেক্ষিক গতিতেও ব্যাঘ্যাত ও সমস্যা সৃষ্টি হবে, ফলে সুর্য পশ্চিম দিক হতে উদিত হবে।

হাদিসটির সুর্যের পশ্চিমে উদিত হয়ার অংশটি সম্পর্কে :

মুহাম্মাদ আল-আমিন আল-হারারী বলেছেন :
"إشعارًا بانتهاء الدنيا وخرابها وتغير نظامها المعتاد" [17]
"ইহা হলো সমগ্র জগতের ধ্বংস, ক্ষতি ও স্বাভাবিক নিয়ম-শৃংখলার বিকৃতি ঘটার ঘোষনাস্বরুপ "

যাইনুদ্দিন আল-ইরাকী বলেছেন :
سَبَبُ ذَلِكَ أَنَّ هَذَا أَوَّلُ قِيَامِ السَّاعَةِ وَبُدُوِّ التَّغَيُّرَاتِ فِي الْعَالَمِ الْعُلْوِيِّ[18]
"এর কারন হলো এই যে এটা কিয়ামত সংঘটিত হয়ার প্রথম পর্যায় বা ঘটনা, এবং উর্ধ্বজগতের নিয়ম-শৃংখলাসমুহের বিকৃতির সুচনা হয়া "

মুহাম্মাদ আত-তাহির বিন আশুর বলেছেন :

اي حين ينقطع سير الأرض حول شعاعها [19]
"অর্থাৎ যখন সুর্যের কিরনকে কেন্দ্র করে পৃথিবীর ভ্রমনে ব্যাঘ্যাত দেখা দিবে"

প্রমানসমুহ :

[1]আল-মুসনাদুল জামে (16/209-210)

[2]ইবন সিদাহ,আল-মুহকাম (7/504)

[3]ইবন মানযুর, লিসানুল আরব (14/141)

[4]আয-যুবাইদী,তাজুল উরুস (37/344)

[5]কুতরাব,আল-আযমিনাহ (পৃ/16) 

[6]ইবন ফারিস, মাকাইসুল লুগাহ (4/403)

[7]যাদুল মা'আদ(4/203), মাজমুয়ুল ফাতাওয়া(6/581)&(25/1998),আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়াহ (1/9-11),শারহুল আকিদাতিত ত্বহাওইয়া (1/311),আল-আরশ (1/327)

[8]আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ (1/70)

[9]https://islamqa.info/ar/118698

[10]ইবন তাইমিয়াহ, মাজমুয়ুল ফাতাওয়া (8/586) 

[11]https://www.islamweb.net/ar/fatwa/99520/

[12]ইবন তাইমিয়াহ, বায়ানু তালবিসিজ জাহমিয়াহ (2/228)

[13]আল-গুনাইমান,শারহুকিতাবিত তাওহিদ মিন সহিহিল বুখারি (1/411)

[14]ইকমালুল মু'লিম (1/478)

[15]আত-তাহরির ওয়াত তানওইর (23/20)

[16]আ'লামুল হাদিস (পৃ/1893),শারহুল মিশকাহ (11/3450), মিরকাতুল মাফাতিহ (8/3452),আশরাতুস সা'আহ (পৃ/144),শারহুস সুন্নাহ (14/95), আলমাফাতিহ(5/40), আলয়াসমা ওয়াস সিফাত  (2/274), তুহফাতুল আহওয়াযি (3/349), তারহুত তাছরিব (8/259), শারহুল মাসাবিহ (5/559), উমদাতুল কারি (15/120), আল'লামেউস সাবিহ (12/372), মাসাবিহুল জামে (7/44),আল-কাওয়াকিবুদ দারারি (18/62)

[17]আল-কাওকাবুও ওয়াহহাজ (4/121)

[18]তাহরুত তাছরিব (8/259)

[19]আত-তাহরির ওয়াত তানওইর (23/21)