অভিযোগ :
সুন্নীদের মধ্যে বড় অংশের আকীদা অনুসারে মুত’আ বিবাহ নিষিদ্ধ হয়ে গেছে, যদিও শিয়াদের মধ্যে বড় অংশ এখনো মুত’আ বিবাহকে বৈধ মনে করে। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের সংকলিত হাদিস গ্রন্থ থেকে সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত যে, নবী মুহাম্মদ নিজেও মুতা বিবাহ করেছিলেন। এমনকি, এটি রীতিমত নবীর সুন্নত।
মুসনাদে আহমাদ
মুসনাদে উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) (উমারের বর্ণিত হাদীস)
পরিচ্ছেদঃ
৩৫১। আবু মূসার ছেলে ইবরাহীম বর্ণনা করেন, আবু মূসা (রাঃ) মুত’আ (অস্থায়ী) বিয়ের পক্ষে ফতোয়া দিতেন। এক ব্যক্তি আবু মূসাকে বললেন, আপনার কিছু কিছু ফতোয়া নিয়ে একটু ধীরে চলুন। কারণ আপনার পরে আমীরুল মু’মিনীন হজ্জের ব্যাপারে কী নতুন ধারা প্রবর্তন করেছেন তা আপনি জানেন না। অবশেষে আবু মূসা উমার (রাঃ) এর সাথে দেখা করে জিজ্ঞাসা করলেন। উমার (রাঃ) তাকে বললেনঃ আমি অবহিত হয়েছি যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার সাহাবীগণ এটা করেছেন। তবে আমার কাছে এটা অপছন্দনীয় যে, লোকেরা তাদের (মুত’আ বিয়ের) স্ত্রীদের সাথে বাসর করতে থাকবে, আর হজ্জে যাবে এমন অবস্থায় যে, তখনো তাদের মাথার চুল গড়িয়ে ফোটা ফোটা পানি টপকাচ্ছে।
(মুসলিম-১২২২)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
মুসনাদে আহমাদ
মুসনাদে উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) (উমারের বর্ণিত হাদীস)
পরিচ্ছেদঃ
৩৪২। আবু মূসা (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, উমার (রাঃ) বলেছেনঃ ওটা অর্থাৎ মুত’আ (অস্থায়ী বিয়ে) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাত। তবে আমার আশঙ্কা হয় যে, লোকেরা এই সব স্ত্রীকে নিয়ে বাবলা গাছের নিছে বাসর করবে, তারপর তাদেরকে নিয়ে হজ্জে যাবে।
(হাদীস নং ৩৫১)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
উপরের হাদিস দুইটি থেকে জানা যায়, মুতা বিবাহ ছিল স্বয়ং নবী মুহাম্মদের সুন্নত। নবী নিজেই সেই কাজটি করেছেন।
জবাব :
প্রথমত, "মুতা" পরিভাষাটির দুইটি ভিন্ন অর্থ, প্রয়োগ ও সংজ্ঞা রয়েছে।
উমার বিন আল-খাত্তাব (رضي اللّٰه عنه) বলেন :
"وَإِنَّهُمَا كَانَتَا مُتْعَتَانِ عَلَى عَهْدِ رَسُولِ اللهِ ﷺ إِحْدَاهُمَا مُتْعَةُ الْحَجِّ، وَالْأُخْرَى مُتْعَةُ النِّسَاءِ"[1]
"অবশ্যই রাসুলুল্লাহ ﷺ এর যুগে দুই ধরনের মুত'আ ছিল। একটা হলো মহিলাদের সাথে মুত'আ (বিবাহ) এবং আরেকটা ছিল হজ্জের মুতআ"।
"হজ্জের মুতা" (مُتْعَةُ الْحَجِّ) বিষয়টার সংজ্ঞা ও অর্থ হলো :
"হজ্জের মাসগুলোতে শুধুমাত্র উমরা দ্বারা যাত্রা আরম্ভ করা। এবং মক্কায় এসে উমরাহর নিয়ম-রিতী পালন করা। তারপর ইহরামমুক্ত হয়ে (ইহরাম অবস্থায় যেসব কাজ হারাম থাকে সেগুলো) হালাল করে নেয়া। এবং ইহরামমুক্ত অবস্থায় মক্কায় অবস্থান করা, তারপর হজ্জের জন্য আবার ইহরাম বাধা এবং হজ্জের কাজগুলো করা। " …[2]
অর্থাৎ হজ্জের মুতা এবং মুতা বিবাহ সম্পুর্ন ভিন্ন জিনিস।
দ্বিতীয়ত, মুতা বিবাহ যেটা, সেটাকে মুহাম্মাদ (ﷺ) ৭ম হিজরি সনে খায়বার যুদ্ধের সময় "হারাম" করে দিয়েছিলেন।
আলি বিন আবি-তালিব (رضي اللّٰه عنه) বলেছেন :
"أنّ رسول اللّٰه ﷺ نَهَى عَنْ مُتْعَةِ النِّسَاءِ يَوْمَ يَوْمَ خَيْبَرَ"[3]
"আল্লাহর রাসুল ﷺ মহিলাদের (সাথে) মুতা (বিবাহ) করাকে খায়বারের দিন নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন "
তৃতীয়ত,এই হাদিসগুলো "হজ্জের মুতা" (مُتْعَةُ الْحَجِّ) সক্রান্ত, এখানে হজ্জের মুতার ব্যাপারে বলা হয়েছে। মুতা বিবাহ (مُتْعَة النِّسَاءِ) এখানে উদ্দেশ্য নয়, কেননা :
(১) আবু-মুসা (رضي اللّٰه عنه) রাসুল (ﷺ) এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ফতুয়া দিবেন, এটা হতেই পারেনা। রাসুল (ﷺ) মুতা বিবাহকে হারাম করেছেন, হজ্জের মুতাকে হারাম করেন নি ; যদি হজ্জের মুতার পক্ষে ফতুয়া দেয়া হয় তাহলে তা রাসুল (ﷺ) এর বক্তব্যের বিরুধি হবেনা, কিন্ত যদি মুতা বিবাহর পক্ষে ফতুয়া দেয়া হয়, তাহলে তা রাসুল (ﷺ) এর বক্তব্যের সরাসরি বিরুদ্ধে যাবে। একজন সাহাবি কখনোই রাসুল (ﷺ) এর বিরুধি বক্তব্য দিতেই পারেনা, সাহাবিরা রাসুল (ﷺ) কে কড়াভাবে অনুসরন করতেন। কাজেই এখানে আবু-মুসা (رضي اللّٰه عنه) হজ্জের মুতা সম্পর্কে ফতুয়া দিয়েছেন, মুতা বিবাহ সম্পর্কে নয়।
(২) হাদিসটি বলা হয়েছে "হজ্জের ব্যাপারে নতুন ধারা প্রবর্তন করেছেন", আরবি ইবারতে আরো সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে "في النسك" তথা "হজ্জের ক্ষেত্রে, হজ্জের মধ্যে"। মুতা বিবাহ এমন কোনো বিষয় না যা হজ্জের হুকুম-আহকামের অন্তর্ভুক্ত, বরং হজ্জের মুতা হলো এমন বিষয় যা হজ্জের হুকুম আহকামের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং এখানে হজ্জের মুতা উদ্দেশ্য, মুতা বিবাহ নয়।
(৩) হাদিসটিতে বলা হয়েছে উমার (رضي اللّٰه عنه) "নতুন ধারা" প্রবর্তন করেছেন। মুতা বিবাহ নিষিদ্ধ হয়া কখনৌই উমার (رضي اللّٰه عنه) এর প্রনিত "নতুন ধারা" হতে পারেনা, কেননা রাসুল (ﷺ) মুতা বিবাহকে নিষিদ্ধ করে গিয়েছেন এবং এটা একটা "পুরাতন" ধারা। হজ্জের মুতা নিষিদ্ধ করাটাই "নতুন ধারা" হতে পারে, কেননা রাসুল (ﷺ) মুতা বিবাহকে হারাম করলেও "হজ্জের মুতা" কে হারাম করেন নি।সুতরাং এখানে হজ্জের মুতা উদ্দেশ্য, মুতা বিবাহ নয়।
চতুর্থত, "হজ্জের মুতা" প্রয়োগ করলে হজ্জের পুর্বে ইহরাম মুক্ত থাকা যায়। ইহরাম বাধা থাকা অবস্থায় স্ত্রী-সহবাস সহ অন্যান্য অনেক কাজই ইহরামের দরুন হারাম হয়ে যায়, এবং ইহরামমুক্ত হয়ার আগ পর্যন্ত তা হারাম থাকে, ও ইহরাম মুক্ত হলে সেসকল কাজ পুনরায় হালাল হয়ে যায় । যদি হজ্জের মুতা প্রয়োগ হয়, তবে লোকজন হজ্জের সময়ের আগে সহবাসকে হালাল হিসেবে বিবেচনা করবে, এবং এর ফলে তারা হজ্জ শুরু করার পুর্বে তাদের স্ত্রীদের সাথে সহবাস আরম্ভ করে দিতে পারে - উমার (رضي اللّٰه عنه) এর নিকট এই ব্যাপারটা হজ্জের ভাবমুর্তি ও সৌন্দর্য নষ্ট করে বলে মনে হয়েছিল। তাই তিনি এমনটা বলেছেন। এখানে এটা উদ্দেশ্য নয় যে মুতা বিবাহ করে বাসর করবে, তারপর হজ্জে যাবে।
পঞ্চমত, আমি উপরে যা কিছুই বলেছি সবই মুহাদ্দিস ও ফকিহদের বক্তব্য অনুযায়ী বলেছি, মুহাদ্দিস-ফকিহরা হাদিসটিকে এভাবেই বুঝেছেন, অনুধাবন করেছেন, এভাবেই ব্যাখ্যা করেছেন। মুহাদ্দিস ও ফকিহদের সকলেই উল্লেখিত হাদিসগুলোকে "হজ্জের মুতা" সক্রান্ত হিসেবেই বিবেচনা করেছেন। এবং কেওই দ্বিমত করে এটা দাবি করেন নি যে এখানে মুতা বিবাহ উদ্দেশ্য।_[4]
ষষ্ঠত, যদি অভিযোগকারিরা দাবি করে যে : না না! এসব যুক্তি ভুল! সব মুহাদ্দিস ফকিহরা সবাই ভুল,এরা এই হাদিস বুঝেনাই ! সবার বুঝ ভুল! শুধুমাত্র আমরা (ইসলামবিদ্বেষীরা) যা বুঝেছি তাই সঠিক! তাহলে এর উত্তরে তাকে বলা হবে : এই হাদিসটিকে উমার (رضي اللّٰه عنه) এর সময়কার সাধারন লোকজন ও সাহাবি তাবেঈরাও এভাবেই বুঝেছেন, উনারাও এর দ্বারা "হজ্জের মুতা" কে বুঝেছেন, "মুতা বিবাহ" কে নয়![5] । এখন আমার পালটা প্রশ্ন : উমার (رضي اللّٰه عنه) এর সময়কার সাহাবি-তাবেঈরা এই হাদিসটি বুঝেন নি, যে এখানে "মুতা বিবাহ " বুঝানো হয়েছে। অথচ ১৪০০ বছর পর কিছু লোক এসে বুঝে ফেলল এখানে "মুতা বিবাহ" বুঝানো হয়েছে, এইটা কিভাবে সম্ভব?!
সপ্তমত, যদি কেও বলে : অনুবাদেত সুস্পষ্ট "মুতা বিবাহ" বলা হয়েছে! আপনেকি অনুবাদকের চেয়ে বেশি বুঝেন? তাহলে তাকে উত্তরে বলা হবে: এই অনুবাদ ভুল, এই অনুবাদে খুবই বড় ধরনের ভুল আছে। যারা এই হাদিসটিতে মুতা বলতে "মুতা বিবাহ" নয়, বরং "হজ্জের মুতা" বুঝেছেন ; তাদের কয়েকজনের নাম উল্লেখ্য করলাম_ [4]
(১) মুহাম্মাদ আল-আমিন আল-হারারী
(২) সফিউর রহমান আল-মোবারকপুরী
(৩) আল-কাযী আইয়াদ্ব বিন মুসা
(৪) ইমাম মুহিউদ্দিন আন-নববী
(৫) বদরুদ্দিন আল-আইনী
(৬) মুহাম্মাদ বিন আলি আল-মাযিরী
(৭) মুহাম্মাদ আয-যুরক্বানী
(৮) ইবন হাজার আল-আসকালানী
(৯) আব্দুল আযিয আর-রাজিহী
(১০) আবুল-আববাস আল-কুরতুবী
(১১) মোল্লা আলি আল-কারী
(১২) মুহাম্মাদ বিন আলি আল-ইথিওবী
(১৩) আনওয়ার শাহ আল-কাশ্মিরী
(১৪) উস্তায ডক্টর মুসা শাহিন লাশিন
(১৫) আহমাদ আল-কাস্তালানী
(১৬) জালালুদ্দিন আস-সুয়ুতী
(১৭) শামসুদ্দিন আয-যারকাশী
(১৮) আল-কামাল ইবনুল হুমাম
(১৯) আল-কাদ্বী আবু-ইয়ালা আল-ফাররা
(২০) ইবন আবি-উমার আল-মাকদেসী
(২১) ইবন-কুদ্দামাহ আল-মাকদেসী
(২২) আবু-বকর আল-বায়হাকী
…(রহিমাহুমুল্লাহ)
এখন আমার পালটা প্রশ্ন, এই ১-২ জন বাংলা অনুবাদক কি উক্ত ২২ জন বড় বড় মুহাদ্দিসের চেয়ে বেশি হাদিস বুঝেন?
পরিশিষ্ট : হজ্জের মুতা রহিত নয়, হজ্জের মুতা হালাল, হজ্জের মুতা রাসুল (ﷺ) এর সুন্নত। এবং হজ্জের মুতার সাথে মুতা বিবাহর কোনো মিল নেই, শব্দগত সাদৃশ্যতা থাকলেও অর্থগত ও সংজ্ঞার দিক দিয়ে কোনো মিল নেই। সুতরাং কেও যদি না বুঝে হজ্জের মুতা ও মুতা বিবাহকে গুলিয়ে ফেলে রাসুল (ﷺ) সম্পর্কে অভিযোগ করে, তাহলে এটা হবে তার অজ্ঞতা ও মুর্খতার বহিঃপ্রকাশ, এবং কেও যদি জানা ও বুঝা সত্ত্বেও হজ্জের মুতা ও মুতা বিবাহকে গুলিয়ে ফেলে রাসুল (ﷺ) সম্পর্কে অভিযোগ করে, তাহলে এটা ডাহা মিথ্যাচার হিসেবে গন্য হবে।
প্রমানসমুহ :
[1]মুসনাদ আহমাদ -রিসালাহ (1/437)। আদিল মুরশিদ ও শুয়াইব আল-আরনাওত 2 নং টিকায় এর সনদ সম্পর্কে বলেছেন বলেছেন "এর সনদ বুখারি মুসলিমের শর্তে সহিহ"।
[2]আল-মাওসুয়াতুল ফিকহিয়াতুল কুয়েতিয়াহ (17/43)
[3]সহিহ মুসলিম (হা/1407)
[4]আল-কাওকাবুও ওয়াহহাজ (14/78),মাননাতুল মু'লিম (2/265),শারহুন নববী আলামুসলিম (8/200),শারহুয যুরক্বানী আলাল মুয়াত্তা (2/396),ফাতহুল বারী (3/418)
,তাওফিকুর রাব্বিল মুনইম (3/481),আল-মুফহাম (3/347), শারহু মুসনাদে আবি-হানিফাহ (2/111),আল-বাহরুল মুহিতুস সাজ্জাজ (23/174), ফায়যুল বারী (3/194)
,ফাতহুল মুনইম (5/239), ইরশাদুস সারী(3/123), শারহু সুনানে ইবন মাজাহ (পৃ/214)
,শারহুয যারকাশী আলা মুখাতাসারিল খারকী (3/223),ফাতহুল কাদির (2/521),
আত-তা'লিকাতুল কাবিরাহ (1/217), আশ-শারহুল কাবির আলাল মুনকিঈ (8/157-159)
,আল-মুগনী (3/260), উমদাতুল কারী (9/189),আস-সুনানুল কুবরা (14/395)
[5]আবু-বকর আল-বায়হাকী "আস-সুনানুল কুবরা (5/30)" তে একটি বর্ননা উল্লেখ্য করেছেন যা একথার প্রমান। উক্ত বর্ননাটির সনদকে ড. মুসা শাহিন লাশিন "ফাতহুল মুনইম (5/239)" এ "সহিহ" বলেছেন।