Are you sure?

বিবিধ »  বিবিধ

 আশুরা !

  রবী চন্দ্র বছরের প্রথম মাস মুহাররম ।  মুহাররম হলো ইসলামের  সম্মানিত চার মাসের তৃতীয় মাস । মুহাররম মাসের ১০ তারিখকে “আশুরার দিবস” বা “আশুরাহ” বলা হয় । আশুরাহ একটি আরবী শব্দ যার অর্থ হলো ‘দশ’ ।

আল্লাহর নাবী সায়্যিদীনা মূসা আঃ ও ঈসা আঃ  এর উম্মাতের নাম হলো  ‘বানি ইসরাঈল’ আর এদের   উৎস হতে প্রাপ্ত ঘটনা সমূহ কে বলা হয় ঈসরাইলী রিওয়াত । ঈসরাইলে রিওয়াতে মিথ তথা  অসংখ্য মিথ্যা বা মনগড়া কাহিনীর সাথে মিশ্রিত আংশিক অথবা পূর্ণাঙ্গ কিছু সত্য ঘটনাও রয়েছে ।

মুসলিমরা ঈসরাইলের রিওয়াতের মধ্যকার  কুরআন ও সুন্নাহ সমর্থিত ঘটনাগুলোর উপর ঈমান রাখে ।  

মুহাররমের দশ তারিখে ঈসরাইলের রিওয়াতে  অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার কথা বলা হলেও বিশুদ্ধ  হাদীসে কেবল একটি  ঘটনার সমর্থন পাওয়া  যায়।   আর তা হলো, 

এই দিনে দরিয়ার মধ্যে ক্ষণস্থায়ী পথ সৃষ্টি করে আল্লাহﷻ মূসা আঃ ও তার উম্মাত কে   অত্যাচারী রাজা ফিরাঊনের হাত থেকে নাজাত দেন , মূসা আঃ সেই ক্ষণস্থায়ী পথ দিয়ে উম্মাত নিয়ে নিরাপদে দরিয়া পার হয়ে চলে আসেন এবং তাদের কে তাড়া করে পিছনে আসা ফিরাঊন তার দলবল নিয়ে দরিয়াতে ডুবে ধ্বংস হয়ে যায় ।

এ ঘটনার স্মরণে মুসা আঃ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে সাওম পালন করেন এবং মুসলিমরাও মুসা আঃ এর প্রতি ভালোবাসা ও আল্লাহﷻ এর প্রতি শুকর প্রকাশ করে এই দিন ও আগের বা পরের দিন সাওম পালন করে থাকে ।  যেমন হাদীসে এসেছে,

“ আবূ মা’মার (রহঃ) ... ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় আগমন করে দেখতে পেলেন যে, ইয়াহুদীগণ ‘আশূরা (আশুরা/আসুরা/আসূরা)র দিনে সাওম (রোযা/রোজা/সিয়াম/ছিয়াম) পালন করে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেনঃ কি ব্যাপার? (তোমরা এ দিনে সাওম পালন কর কেন?) তারা বলল, এ অতি উত্তম দিন, এ দিনে আল্লাহ তা’আলা বনী ইসরাঈলকে তাদের শত্রুর কবল হতে নাজাত দান করেন, ফলে এ দিনে মূসা (আলাইহিস সালাম) সাওম পালন করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ আমি তোমাদের অপেক্ষা মূসার অধিক নিকটবর্তী, এরপর তিনি এ দিনে সাওম পালন করেন এবং সাওম পালনের নির্দেশ দেন। ”

📜সহীহ বুখারী ,১৮৭৮ (ইফাউন্ডেশন বাংলাদেশ) ।

অনান্য আরো  হাদীসে এসেছে যে রাসুলুল্লাহ ﷺ  মক্কাতে থাকতেও  আশুরার সাওম পালন করতেন । যেমন হাদীসে এসেছে,

‘আবদুল্লাহ ইবনু মাসলামা (রহঃ) ... ‘আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, জাহিলিয়্যাতের যুগে কুরাইশগণ ‘আশূরা (আশুরা/আসুরা/আসূরা)র সাওম (রোযা/রোজা/সিয়াম/ছিয়াম) পালন করত এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও এ সাওম পালন করতেন। যখন তিনি মদিনায় আগমন করেন তখনও এ সাওম পালন করেন এবং তা পালনের নির্দেশ দেন। যখন রমযানের সাওম ফরয করা হল তখন ‘আশূরার সাওম ছেড়ে দেয়া হল, যার ইচ্ছা সে পালন করবে আর যার ইচ্ছা পালন করবে না।

📜সহীহ বুখারী ১৮৭৬ (ইসলামিক ফাউন্ডেশন‌ বাংলাদেশ )

আশুরার সাওম রাসুলুল্লাহ ﷺ অত্যাধিক গুরুত্বপূর্ণ আমল হিসেবে বিবেচনা করতেন যেমন হাদীসে এসেছে,

‘উবায়দুল্লাহ ইবনু মূসা (রহঃ) ... ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে ‘আশূরা (আশুরা/আসুরা/আসূরা)র দিনের সাওমের উপরে অন্য দিনের সাওম (রোযা/রোজা/সিয়াম/ছিয়াম) কে প্রাধান্য প্রদান করতে দেখি নাই এবং এ মাস অর্থাৎ রমযান মাস (এর উপর অন্য মাসের গুরুত্ব প্রদান করতেও দেখি নাই)।

📜সহীহ বুখারী, ১৮৮০ (ইসলামি ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ২০১১ইং )

ঈসরাইলের রিওয়াতে আশুরার দিনে কিয়ামত সংগঠিত হবে মর্মে যে বর্ণনা পাওয়া যায় তার  কোনো ভিত্তি নেই, নির্ভরযোগ্য কোনো বর্ণনায় এ কথার কোনো আলোচনা আসেনি। আবার কোনো কোনো হাদীসে  বলা হয়, আশুরার দিনে হজরত আদম আলাইহিস সালামের তওবা কবুল হয়েছে।  কিন্তু এই হাদীস গুলোর সবগুলোরই  সনদ হয়  খুবই দুর্বল  (যাইফ ) অথবা জাল  ( মাওযু)   অপর একটি রিওয়াতে আছে হজরত নূহ আলাইহিস সালামের কিশতি যেদিন জুদি পাহাড়ে থেমেছিল সেই দিনটি ছিল আশুরার দিন এটাও খুব দূর্বল রিওয়াত ।   আর হজরত ঈসা আলাইহিস সালামের জন্ম আশুরার দিন হয়েছে মর্মেও অপ্রমাণিত রিওয়াত আছে । 

অর্থাৎ নির্ভরযোগ্য রিওয়াতে কেবল মূসা আঃ ও ফিরাঊনের ঘটনার সাথেই এই দিনটির সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায় । তাই আহলূস সুন্নাহর অধিকাংশ স্কলার  সর্বসম্মতিক্রমে এ ইজমাতে উপনীত হয়েছেন যে  আশুরাহ তথা মুহাররমের দশ তারিখের   আমল কেবলমাত্র মুসা আঃ ও ফিরাঊনের ঘটনার স্মরণে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনার্থে পালিত হয় ‌ ।    

 

  কাকতালীয় ভাবে ইসলামের ইতিহাসের একটি মর্মান্তিক ঘটনা আশুরার দিনেই সংঘটিত হয় । যে দিনে রাসুলুল্লাহ ﷺ এর  নাতী খলিফা আলী রাঃ ও নবী তনয়া ফাতিমা রাঃ এর সন্তান ঈমাম হুসাইন রাঃ মুনাফিকদের চক্রান্তের স্বিকার হয়ে এই দিনেই ফোরাৎ নদীর তীরে অবস্থিত কারবালা নামক স্থানে কয়েকজন সঙ্গী সাথী সহ শহীদ হয়েছিলেন ।

বি: দ্র:  কারবালার ঘটনা বুঝাতে গেলে অত্যন্ত দীর্ঘ ইতিহাস বর্ণনা করতে হবে আলোচনার সংক্ষিপ্ততার জন্য এখানে এই বিষয়ে বিশেষ কিছু বলছি না । পরবর্তীতে দীর্ঘ কলেবরে এ বিষয়ে  বিস্তারিত আলোচনা করার ইচ্ছা আছে,  ইনশাআল্লাহ ।

দুঃখের বিষয় বর্তমানে আমাদের দেশ সহ বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন মিডিয়ায়  আশুরাকে এমন ভাবে উপস্থাপন করা হয়  যেনো আশুরাতে  শুধু কারবালার ঘটনাই ঘটেছে, যেনো আশুরা তাৎপর্যময় হয়েছে কারবালার কারণে।

এটা সম্পূর্ণ ভুল বিশ্বাস ও মিথ্যা প্রচারণা । সাবাইআহ ও তাদের থেকে উদ্ভুত উসমানি , রাফেজি প্রমূখ ফিরকাবাজরা এ দিন নিয়ে যে সকল কার্যক্রম যেমন মাতম,আহজারী, শোক পালন , শোক মিছিল, হায় হোসেন মিছিল প্রভৃতি যা কিছু করে তার সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই ।

 

কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ﷺ  ওফাতের প্রায় ৫০ বছর পর ৬১ হিজরির ১০ মহররমে কারবালায় হজরত হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাতের ঘটনা ঘটে। এ দিনের ঘটনা  আশুরার দিনের সঙ্গে মিলে যাওয়া একটি কাকতালীয় ঘটনা বিশেষ। আশুরার আমলের সঙ্গে সম্পৃক্ত কোনো বিষয় নয়।  রাসূলুল্লাহ ﷺ এর  ওফাতের পূর্বেই  আমাদের দ্বীন পূর্ণ হয়ে গিয়েছে। কিয়ামত পর্যন্ত এই দ্বিন  পূর্ণাঙ্গরূপে সংরক্ষিত থাকবে। এই দ্বীনের শরিয়তের আমলের বিধান  যেভাবে আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে আজ পর্যন্ত সেভাবেই সংরক্ষিত আছে। তাতে কোনো ধরনের সংযোজন-বিয়োজনের সুযোগ নেই।  হজরত রাসূলুল্লাহﷺ এর ওফাতের  পরে সংঘটিত কোনো বিপদ বা আনন্দের ঘটনাকে কেন্দ্র করে কোনো দিন বা কোনো মাসের নতুন কোনো ফজিলত বা নতুন কোনো বিধান আবিষ্কার করা ইসলাম পরিপন্থী । বিদয়াত, পথভ্রষ্টতা ।

কুরআনে আল্লাহ ﷻ বলেন, 

“ আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে তাদেরকে মৃত বলো না। প্রকৃতপক্ষে তারা জীবিত, কিন্তু তোমরা (তাদের জীবিত থাকার বিষয়টা) উপলব্ধি করতে পারো না। আর আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব (কখনও) কিছুটা ভয়-ভীতি দ্বারা, (কখনও) জানমাল ও ফল-ফসলের ক্ষয়ক্ষতির দ্বারা। সুসংবাদ শোনাও তাদেরকে, যারা (এরূপ অবস্থায়) সবরের পরিচয় দেয়। যারা কোনো মসিবত দেখা দিলে বলে ওঠে, আমরা সকলে আল্লাহরই এবং আমাদেরকে তার কাছেই ফিরে যেতে হবে। এরাই তারা, যাদের প্রতি তাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে বিশেষ করুণা ও দয়া রয়েছে এবং এরাই আছে হেদায়েতের ওপর।”

📖 সম্ভাব্য ভাবানুবাদ , সূরা বাকারা: ১৫৪-১৫৭

এ আয়াতের আলোকে বুঝা যায় যে , কারবালাতে  হজরত হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাতের ঘটনার ন্যায়  আমাদের জন্য বিপদ ও মুসিবতের ঘটনা সামনে আসলে  এক্ষেত্রে ইসলামি শরিয়তের হুকুম হলো, বিপদগ্রস্ত লোকেরা সবর করবে। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন পড়বে এবং আল্লাহতায়ালার কাছে উত্তম প্রতিদানের  আশা করবে।  কারও শাহাদাতে  শরিয়তের হুকুম হলো সবর করা অর্থাৎ ধৈর্যধারণ করা। অধৈর্য হয়ে অভিযোগপূর্ণ কোনো কথা বলা, বিলাপ করা, হাত পা ও বুক চাপড়ানো, চেহারা খামচানো, শোকের পোশাক পরা ইত্যাদি জাহেলী আচারণ ইসলামে সম্পূর্ণ হারাম। ইসলামি শরিয়তে খুব কঠোরভাবে তা থেকে বারণ করা হয়েছে। 

হাদিসে ইরশাদ হয়েছে,

যে ব্যক্তি মুখে আঘাত করে, জামার বুক ছিঁড়ে, জাহিলি যুগের (মতো) বিলাপ করে; সে আমাদের দলভুক্ত নয়। 

📜সহিহ বুখারি, ১/১৭২( দারুস সালাম, আরবী ২০০৯ইং সংস্করণ)

অন্য এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, 

“আমি ওই ব্যক্তি থেকে মুক্ত, যে শোকের সময়  মাথা মুণ্ডায়, বুক চাপড়ায় ও কাপড় ছিঁড়ে। ”

📜সহিহ মুসলিম, ১৬৭( দারুস সালাম, আরবী ২০০৯ইং সংস্করণ)

হজরত হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাতের পর থেকে তিন শত’ বছর পর্যন্ত ১০ মুহাররমে মাতম, কান্নাকাটি, আহাজারি, চিৎকার ও বুক চাপড়ানো প্রথার কোনো অস্তিত্ব ছিলো না।

সর্বপ্রথম ৩৫২ হিজরিতে মুঈযযুদ দাওলা দাইলামি (একজন রাফেজী শিয়া) দশ মহররমে শুধু বাগদাদে হজরত হুসাইন (রা.)-এর জন্য মাতম করার হুকুম জারি করে। এরপর ৩৬৩ হিজরিতে মিশরেও এই অনৈসলামিক প্রথা প্রচলিত হয়ে যায় ‌,  সেই থেকে কোনো কোনো সম্প্রদায়ের মাঝে এই প্রথা চলে আসছে । যা একটি মনগড়া ভ্রান্ত ও মিথ্যা আমল এবং জাহেলী যুগের এমন আচারণ যা ইসলাম প্রত্যাক্ষাণ করে ‌ ।

 

মৃতের জন্য বিলাপ মাতম ইসলাম পরিপন্থী কুফরী যেমন হাদীসে এসেছে ,  

“ আবূ বাকর ইবনু শাইবাহ ও ইবনু নুমায়র (রহঃ) ..... আবূ হুরাইরাহ (রাযিঃ) বলেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, দু'টাে স্বভাব মানুষের মাঝে রয়েছে, যা কুফুর বলে গণ্য বংশের প্রতি কটাক্ষ করা* এবং মৃত ব্যক্তির জন্য উচ্চস্বরে বিলাপ করা**।”

📜সহীহ মুসলিম, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১৩১, ইসলামিক সেন্টারঃ ১৩৫।

উপরের আলোচনাতে  প্রমাণ করা হলো, 

“ বিশুদ্ধ রিওয়াত অনুযায়ী মুহাররমের ১০ তারিখের আমল কেবল মুসা আঃ ও ফিরাঊনের ঘটনার সাথে সম্পর্কিত এবং এ আমলের উদ্দেশ্য কেবল আল্লাহর প্রতি কৃজ্ঞতা জ্ঞাপন । ইসলামে শোক দিবস বলে কিছু নেই , কারবালার ঘটনার জন্য মুহাররমে কোন ইবাদত ইসলামে নেই । মৃতের শোকে মাতম করা , অপ্রকৃতিস্থ আচারণ, বুকচাপড়ানো, কাপড় ছেড়া ইত্যাদি কাজ হারাম ও কুফরী । ”

আল্লাহ আমাদেরকে আশুরার এই জাহেলিয়াত হতে বেচে থাকার তাওফীক দান করুন ‌ ।