Are you sure?

তুলনামূলক ধর্মতত্ব »  বিবিধ

পর্ব: ৩] প্রোটেস্টাইন ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা মার্টিন লুথার কিং এবং যীশু বনাম সাধু পৌলের বক্তব্য

বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম
খ্রিস্টান বনাম মুসলিম সংলাপ
বিষয়: যীশু কতৃক বিঘোষিত সেই সাহায্যকারী কে? মুহাম্মদ ﷺ নাকি পবিত্র আত্মা?

মানবসভ্যতাকে ধ্বংস থেকে রক্ষা করতে পৌলের উদ্ভাবিত যীশুর নামে প্রচারিত এ ভ্রান্ত মতবাদের স্বরুপ উন্মোচন করা জরুরি। কারণ পৌল পাপাচারের যে দরজা উন্মুক্ত করেছেন তা মানবসভ্যতাকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বের সকল দেশের সকল ধর্মের ধার্মিক মানুষগুলো অন্তত মিথ্যা, নরহত্যা, ব্যভিচার, মাদকতা ও সকল প্রকার মহাপাপ থেকে নিজেদের কে মুক্ত রাখতে চেষ্টা করেন। পক্ষান্তরে পৌলের খ্রিস্টধর্মে এ সকল পাপাচারকে খোলামেলা উৎসাহ দেয়া হয়েছে। বাইবেলের মধ্যে বিদ্যমান আদম আঃ থেকে শুরু করে ঈসা আঃ পর্যন্ত সকল নবীগণ শিক্ষা দিয়েছেন যে:

16. সন্তানের জন্য পিতার, কিম্বা পিতার জন্য সন্তানের প্রাণদণ্ড করা যাইবে না; প্রতিজন আপন আপন পাপপ্রযুক্তই প্রাণদণ্ড ভোগ করিবে।" [১]

এইখানে বলা হয়েছে, সন্তানের জন্য পিতা এবং পিতার জন্য সন্তান পাপের বোঝা বহন করবে না অর্থাৎ যার যার পাপের বোঝা তার তার-ই বহন করতে হবে। আর এটাই লজিক্যাল কথা। আবার বাইবেলের অন্যত্রে (যিহিষ্কেল ১৮ অধ্যায় জুড়ে) "ঈশ্বরের নায্য বিচার ও মন পরিবর্তনার্থে আহ্বান" পুরো শিরোনামে বলা হয়েছে ,"কেউই অপরের পাপের বোঝা বহন করবে না।" [২]

20. যে প্রাণী পাপ করে, সেই মরিবে; পিতার অপরাধ পুত্র বহন করিবে না; ও পুত্রের অপরাধ পিতা বহন করিবে না; ধার্মিকের ধার্মিকতা তাহার উপরে বর্তিবে, ও দুষ্টের দুষ্টতা তাহার উপরে বর্তিবে।" [৩]

এইখানেও একই কথা বলা হয়েছে অর্থাৎ কেউই অপরের পাপের বোঝা বহন করবে। যার যার কর্মফল তার-ই ভোগ করতে হবে। কেউ খারাপ কাজ করলে তার জন্য সে দায়ী এবং ভাল কাজ করলেও সেই দায়ী থাকবে। কিন্তু পৌল এসে বিপরীত থিওরি দিল মানবজাতিকে।

তিনি বলেছেন, "যীশু সকলের পাপের বোঝা বহন করবেন। তিনি ক্রুশকাষ্ঠে প্রাণ দিয়ে খ্রিস্টানদের সমস্ত পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে গিয়েছেন।"

7. কিন্তু ঈশ্বর আমাদের প্রতি তাঁহার নিজের প্রেম প্রদর্শন করিতেছেন; কারণ আমরা যখন পাপী ছিলাম, তখনও খ্রীষ্ট আমাদের নিমিত্ত প্রাণ দিলেন।" [৪]

কিন্তু অনুসারীদের সংখ্যা বাড়াতে ও মানুষদের কে জাহান্নামী করতে পৌল ও তার অনুসারীরা শিক্ষা দিয়েছে যে, আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস ও শরিয়ত পালনের কোন মূল্য নেই বরং শুধু ঈসা তথা যীশুর ক্রুশবিদ্ধ মৃত্যু ও পুনরুত্থানে বিশ্বাস করলেই মুক্তি মিলবে।" [৫]

আসলে পৌল মুক্তি পাওয়ার ভিত্তি বলে দিয়েছেন। আর সেটা হলো যীশু কে মুখে প্রভু বলে স্বীকার করা এবং এটা বিশ্বাস করা যে, ঈশ্বর তাঁকে মৃতদের মধ্যে থেকে আবার জীবিত করেছেন। এটাই হলো পৌলের থিওরি যা মূলত যীশু খ্রিস্টের বক্তব্যের বিরোধী। 

যদি কেউ শরিয়ত পালন করে তবে তার জন্য মুক্তির পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে। "ব্যবস্থা বা শরিয়তের" বিরুদ্ধে পৌলের দার্শনিক ও মারফতি বক্তব্য অনেক যা দ্বিতীয় পর্বে আলোচনা করা হয়েছে। [৬]

মন শুদ্ধ হলেই হলো। শরিয়ত তো বিশ্বাস ঠিক করার জন্য; বিশ্বাস ঠিক হলে আর কিছুই লাগে না। এছাড়া মুক্তির এ পথের ব্যাখ্যা করে প্রোটেস্ট্যান খ্রিস্টধর্মের প্রতিষ্ঠাতা মার্টিন লুথার (Martin Luther ,১৪৮২-১৫২৯ খ্রিঃ) বলেন :-

"তোমরা শুধু বিশ্বাস কর। আর সুনিশ্চিতরুপে জেনে রাখো যে ,এতেই তোমাদের মুক্তি লাভ হবে। মুক্তির জন্য কোন উপবাসের কষ্ট করতে হবে না, কোনরুপ সৎকর্ম পালনের চেষ্টা করতে হবে না, সৎ থাকার কষ্ট করতে হবে না, পাপের স্বীকারোক্তি কষ্ট করতে হবে না। খ্রিস্টের জন্য যেমন সুনিশ্চিত মুক্তি, তোমাদের জন্যও ঠিক তেমনি মুক্তি, যাতে কোনরুপ সন্দেহ নেই। তোমরা পাপ কর। পরিপূর্ণ সাহসিকতার সাথে পাপ কর এবং শুধু বিশ্বাস কর। শুধু বিশ্বাসই তোমাদেরকে মুক্তি প্রদান করবে যদিও প্রতিদিন তোমরা এক হাজারবার ব্যভিচার বা হত্যার মতো পাপে লিপ্ত হও। তোমরা শুধু বিশ্বাস কর। আমি তোমাদেরকে বলছি,শুধু বিশ্বাসই তোমাদের মুক্তি দিবে।" [৭]

বাইবেলের মধ্যে নতুন নিয়মের মধ্যে সেন্ট পৌল বলেছেন:

1. হে আমার বৎসেরা, তোমাদিগকে এই সকল লিখিতেছি, যেন তোমরা পাপ না কর। আর যদি কেহ পাপ করে, তবে পিতার কাছে আমাদের এক সহায় আছেন, তিনি ধার্মিক যীশু খ্রীষ্ট।
2. আর তিনিই আমাদের পাপার্থক প্রায়শ্চিত্ত, কেবল আমাদের নয়, কিন্তু সমস্ত জগতেরও পাপার্থক।" [৮]

অর্থাৎ এইখানে বলা হয়েছে যে, তোমরা পাপ করো না কিন্তু যদি পাপ করো এরপরেও কোন চিন্তা নেই। কারণ তোমাদের সকল পাপের প্রায়শ্চিত্ত যীশু বহন করবেন। তোমরা এমনিতেই মুক্তি পেয়ে যাবে, যতোই তোমরা পাপ করো না কেন? এর মানে এটা দ্বারা একদিক থেকে পাপীরাও উৎসাহিত হয়ে পড়ে খোলামেলা পাপ করার ক্ষেত্রে। কারণ সে যতোই পাপ করুক না কেন, যীশু খ্রিস্ট তো আছে। তিনিই তো তার পাপের বোঝা বহন করবেন। তাহলে সমস্যা কোথায় পাপ করাতে? কারণ পাপের মধ্যেই যে সীমাহীন আনন্দ তা উপভোগ করেই যাই। এইভাবে মূলত পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা তথা পাপাচারণের মাত্রাধিক বৃদ্ধি পায়-ই। আর পৌল সেটাই করাতে চেয়েছেন সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কৌশলের মাধ্যমে যা কিনা পশ্চিমা বিশ্বে অহরহ হচ্ছে।

এ জন্যই আমরা দেখি যে মিথ্যা, দুর্নীতি, সুদ, ঘুষ, মদপান, ধর্ষণ, ব্যভিচার ইত্যাদি পাপ খ্রিস্টান চার্চ ও পাদ্রিদের নিয়মিত কর্ম। এমনকি হিটলারের মতো ঠান্ডা মাথায় গ্যাস চেম্বারে লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা করলেও কোন সমস্যা নেই। হিটলার ও তার সমর্থক সকল পোপ পাদ্রির জন্য যীশু জান্নাতের দরজা খুলে বসে রয়েছেন!" [১ যোহন ,২:১-২ দ্রষ্টব্য]

বর্তমানে প্রচলিত কথিত ইঞ্জিলের মধ্যে বিদ্যমান মসীহের বক্তব্য পৌলের বচনের সাথে সাংঘর্ষিক। শুধু বিশ্বাসেই মুক্তি মিলবে মসীহ্ এটা বলেন নাই। শত বিশ্বাস থাকলেও সামান্যতম শরিয়ত লঙ্ঘন করলেও তার জান্নাত/স্বর্গ মিলবে না বলে প্রচার করেছেন। যীশু বলেছেন:

17. মনে করিও না যে, আমি ব্যবস্থা কি ভাববাদী গ্রন্থ লোপ করিতে আসিয়াছি; আমি তাহা লোপ করিতে আসি নাই, কিন্তু পূর্ণ করিতে আসিয়াছি।
18. কেননা আমি তোমাদিগকে সত্য কহিতেছি, যে পর্যন্ত আকাশ ও পৃথিবী লুপ্ত না হইবে, সেই পর্যন্ত ব্যবস্থার এক মাত্রা কি এক বিন্দুও লুপ্ত হইবে না, সমস্তই সফল হইবে।
19. অতএব যে কেহ এই সকল ক্ষুদ্রতম আজ্ঞার মধ্যে কোন একটি আজ্ঞা লঙ্ঘন করে, ও লোকদিগকে সেইরূপ শিক্ষা দেয়, তাহাকে স্বর্গরাজ্যে অতি ক্ষুদ্র বলা যাইবে; কিন্তু যে কেহ সেই সকল পালন করে ও শিক্ষা দেয়, তাহাকে স্বর্গ-রাজ্যে মহান বলা যাইবে।
20. কেননা আমি তোমাদিগকে কহিতেছি, অধ্যাপক ও ফরীশীদের অপেক্ষা তোমাদের ধার্মিকতা যদি অধিক না হয়, তবে তোমরা কোন মতে স্বর্গ-রাজ্যে প্রবেশ করিতে পারিবে না।" [৯]

এভাবেই ঈসা আঃ বারংবার বলেছেন যে, আজ্ঞা বা বিধান বা শরিয়ত পালনই জান্নাতের একমাত্র পথ অন্যথায় না। মার্কের ১২ অধ্যায়ের "সর্বপ্রধান আদেশের বিষয়ে শিক্ষা" শিরোনামে বলা হয়েছে:

28. আর অধ্যাপকদের একজন নিকটে আসিয়া তাঁহাদিগকে তর্ক বিতর্ক করিতে শুনিয়া, এবং যীশু তাঁহাদিগকে বিলক্ষণ উত্তর দিয়াছেন জানিয়া, তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিল, সকল আজ্ঞার মধ্যে কোন্‌টি প্রথম?

29. যীশু উত্তর করিলেন, প্রথমটি এই, ‘‘হে ইস্রায়েল, শুন; আমাদের ঈশ্বর প্রভু একই প্রভু;
30. আর তুমি তোমার সমস্ত অন্তঃকরণ, তোমার সমস্ত প্রাণ, তোমার সমস্ত মন ও তোমার সমস্ত শক্তি দিয়া তোমার ঈশ্বর প্রভুকে প্রেম করিবে।” [মার্ক ১২:২৮-৩০]
31. দ্বিতীয়টি এই, ‘‘তোমার প্রতিবাসীকে আপনার মত প্রেম করিবে।” এই দুই আজ্ঞা হইতে বড় আর কোন আজ্ঞা নাই।" [১০]

উল্লেখ্য যে, এই দুইটি বিধানের বিষয়ে বাইবেলের মথির ২২ অধ্যায়ের ৩৪-৪০ নং অনুচ্ছেদে যীশু বলে দিয়েছেন, "সমস্ত বিধি-ব্যবস্থা, ভাববাদীদের সমস্ত শিক্ষা, এই দুটি আদেশের উপর নির্ভর করে৷’"

অর্থাৎ যীশু খ্রিস্টের কথার মূল তাৎপর্য হলো, "মুসার শরিয়তের সবচেয়ে বড় হুকুম -প্রভু, যিনি আমাদের খোদা, তিনি এক, আর তোমার সমস্ত অন্তর প্রাণ, তোমার সমস্ত মন দিয়ে, তোমার প্রভুকে মহব্বত করবে। আর তোমার প্রতিবেশীকে নিজের মত করে মহব্বত করবে। মুসার গোটা শরিয়ত ও এবং নবীদের সমস্ত শিক্ষা [অর্থাৎ হাক্কুল্লাহ ও হাক্কুল ইবাদত] এই দুইটি হুকুমের উপরে নির্ভর করে আছে। (মথি২২:৩৬-৪০; মার্ক ১২:২৯-৩১; লুক ১০:২৫-২৮)।

[নোট: এ থেকে একটা বাস্তব মহা সত্য আরো সুস্পষ্ট ভাবে জানা গেল। আর তা হলো প্রথম যে আজ্ঞা/আদেশটি তাওরাত ও সকল ভাববাদীদের গ্রন্থগুলোতে সুস্পষ্ট ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং যা ঈশ্বরের রাজ্যের নৈকট্যের (অর্থাৎ জান্নাতে প্রবেশ করার) মূল কারণ তা হলো একত্ববাদ (but not Trinity) অর্থাৎ এ কথা বিশ্বাস করা যে সদাপ্রভু মহান আল্লাহই বলেন একমাত্র ঈশ্বর বা উপাস্য এবং তিনি ছাড়া দ্বিতীয় কোন উপাস্য নেই।]

যীশু খ্রিস্ট তাঁর আদেশ নিষেধ পালন করা সম্পর্কে বলে দিয়েছেন যে:

24. অতএব যে কেহ আমার এই সকল বাক্য শুনিয়া পালন করে, তাহাকে এমন একজন বুদ্ধিমান লোকের তুল্য বলিতে হইবে, যে পাষাণের উপরে তাহার গৃহ নির্মাণ করিল।
25. পরে বৃষ্টি নামিল, বন্যা আসিল, বায়ু বহিল, এবং সেই গৃহে লাগিল, তথাপি তাহা পড়িল না, কারণ পাষাণের উপরে তাহার ভিত্তিমূল স্থাপিত হইয়াছিল।
26. আর যে কেহ আমার এই সকল বাক্য শুনিয়া পালন না করে, তাহাকে এমন একজন নির্বোধ লোকের তুল্য বলিতে হইবে, যে বালুকার উপরে আপন গৃহ নির্মাণ করিল।
27. পরে বৃষ্টি নামিল, বন্যা আসিল, বায়ু বহিল, এবং সেই গৃহে আঘাত করিল; তাহাতে তাহা পড়িয়া গেল, ও তাহার পতন ঘোরতর হইল।" [১১]

অর্থাৎ যীশু খ্রিস্ট বলে দিলেন, "যে কেউ আমার এই সমস্ত কথা শুনে পালন করে, সে একজন বুদ্ধিমান...। আর যে কেউ আমার এই সমস্ত কথা শুনে পালন করে না সে মূর্খ। (মথি ৭:২৪-২৬)।

বাইবেলের "ধন সম্পর্কে শিক্ষা ও মজুরদের দৃষ্টান্ত" শিরোনামে বলা হয়েছে:

16. একজন লোক (জনৈক ইহুদি) একদিন যীশুর কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘হে সদগুরু, "অনন্ত জীবন পাবার জন্য আমাকে কোন ভাল কাজ করতে হবে?"
17. যীশু তাকে বললেন, ‘কোনটি ভাল একথা তুমি আমায় জিজ্ঞেস করছ কেন? ভাল তো কেবল একজনই আর তিনি ঈশ্বর৷ যাই হোক তুমি যদি অনন্ত জীবন পেতে চাও, তবে তাঁর সব আজ্ঞা পালন কর৷" [১২]

অর্থাৎ যীশু খ্রিস্ট পরিষ্কার ভাষায় বলে দিলেন যে, জান্নাত তথা অনন্ত জীবন পেতে গেলে পূর্ববর্তী বিধান তথা মুসা আঃ এর শরিয়ত সম্পূর্ণ পালন করতে হবে। শরিয়ত পালন বহিভূর্ত অনন্ত জীবন পাওয়া সম্ভব নয়। অপরদিকে এর বিপরীতে সেন্ট পৌল বললেন যে:

9. কারণ তুমি যদি ‘মুখে’ যীশুকে প্রভু বলিয়া স্বীকার কর, এবং ‘হৃদয়ে’ বিশ্বাস কর যে, ঈশ্বর তাঁহাকে মৃতগণের মধ্য হইতে উত্থাপন করিয়াছেন, তবে পরিত্রাণ পাইবে।" [১৩]

অর্থাৎ শরিয়ত পালন না করলেও হবে; কেবলমাত্র যীশুকে মুখে এবং হৃদয় থেকে প্রভু বলে স্বীকার + তিনি যে মৃতগণের মধ্যে থেকে জীবিত হয়েছেন এটা বিশ্বাস করলেই মুক্তি তথা জান্নাত মিলবে। এর বিপরীতেও যীশু তথা ঈসা আঃ এর বক্তব্য আছে যেখানে বলা হয়েছে:

21. যাহারা আমাকে হে প্রভু, হে প্রভু বলে, তাহারা সকলেই যে স্বর্গ-রাজ্যে প্রবেশ করিতে পারিবে, এমন নয়, কিন্তু যে ব্যক্তি আমার স্বর্গস্থ পিতার ইচ্ছা পালন করে, সেই পারিবে।
22. সেই দিন অনেকে আমাকে বলিবে, হে প্রভু, হে প্রভু, আপনার নামেই আমরা কি ভাববাণী বলি নাই? আপনার নামেই কি ভূত ছাড়াই নাই? আপনার নামেই কি অনেক পরাক্রম-কার্য করি নাই?
23. তখন আমি তাহাদিগকে স্পষ্টই বলিব, আমি কখনও তোমাদিগকে জানি নাই; হে অধর্মাচারীরা, আমার নিকট হইতে দূর হও।" [১৪]

সম্মানিত পাঠক বন্ধুরা, একটু বিবেচনা করুন। যারা তাকে (ঈসা আঃ) 'হে প্রভু' 'হে প্রভু' বলেন তারা অবশ্যই তাকে প্রভু বলে বিশ্বাস করেছেন এবং মুখে এভাবে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। উপরন্তু তাঁর নামে "পবিত্র আত্মার" প্রেরণা লাভের দাবি করেছেন, ধর্ম প্রচার করেছেন এবং বিভিন্ন কেরামতি দেখিয়েছেন। কিন্তু তারপরও তারা জান্নাত লাভ করবেন না; কারণ ঈসা মসিহকে প্রভু বলে বিশ্বাস ও স্বীকার করলে অনেক শয়তানী কেরামত হাসিল হতে পারে কিন্তু তাওহিদে বিশুদ্ধ বিশ্বাস ও শরিয়ত পূর্ণ পালন না করলে স্বয়ং ঈসা মসিহও তার জন্য সুপারিশ করবেন না। পৌল যীশুর এই সকল বক্তব্য প্রচারকারীদেরকে অভিশপ্ত বলে ঘোষণা করেছেন; কারণ তারা পৌলের ইঞ্জিলের বিপরীত ইঞ্জিল প্রচার করেন। তিনি বলেছেন:

8. কিন্তু আমরা তোমাদের নিকটে যে সুসমাচার প্রচার করিয়াছি, তাহা ছাড়া অন্য সুসমাচার যদি কেহ প্রচার করে- আমরাই করি, কিম্বা স্বর্গ হইতে আগত কোন দূতই করুক- তবে সে শাপগ্রস্ত হউক।" [১৫]

এরপরও যীশুর অনেক বক্তব্য মানুষের কাছে পৌছাত। এজন্য পৌল ও তাঁর অনুসারীরা অপব্যাখ্যার আশ্রয় নেন। যেমন তিনি ইয়াহুদিদের ভয়ে মানুষে বুঝবে না বলে এগুলো বলেছিলেন। এভাবেই তারা ঈসা আঃ কে বুঝাতে অক্ষম বা মুনাফিক হিসেবে চিহ্নিত করেন (নাঊযুবিল্লাহ মিনযালিক)। এমনকি সাধু পৌল যীশুর শিক্ষাকে প্রাথমিক, আদিম ও পূর্ণতার পরিপন্থী বলে ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেন:

1. Therefore leaving the principles of the doctrine (teachings) of Christ, let us go on unto perfection; not laying again the foundation of repentance from dead works, and of faith toward God." [১৬]

অর্থাৎ তাই খ্রীষ্টের মতবাদের নীতিগুলি ছেড়ে, আসুন আমরা পরিপূর্ণতার দিকে এগিয়ে যাই।"

[ফুটনোট: বাংলা অনুবাদে কারসাজি বিদ্যমান করা হয়েছে]

পোলের এই মন্তব্য দ্বারা বোঝা যাচ্ছে যে, যীশু খ্রিস্টের শিক্ষাগুলো প্রাথমিক ও অপরিপূর্ণ। তাঁর শিক্ষা প্রাইমারীর আর পৌলের শিক্ষা হাইস্কুলের। অবশ্যই ত্রিত্ববাদীদের জন্য মসীহের শিক্ষাকে অপরিপক্ক বলা ছাড়া উপায়ই নেই। তাদের ধর্মের একটি আকীদাও মসিহের শিক্ষার মধ্যে সুস্পষ্ট নেই। কাজেই তাকে অপূর্ণ এবং পৌলকে পূর্ণ বলা ছাড়া উপায় নেই তাদের। মানবতাবিরোধী এ মতবাদকে প্রতিষ্ঠা করতে পৌল দাবী করলেন যে, মানুষ জন্মগত ভাবে পাপী এবং যীশুর মাধ্যমেই মানুষ মুক্তি পায়। এ বিশ্বাসের মূল বিষয় নিন্মরুপ:-

"আদম নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণ করে মহাপাপ করেন। এজন্য কিয়ামত পর্যন্ত সকল আদম সন্তানের শাস্তি ও অনন্ত মৃত্যু পাওনা হয়। "পিতার অপরাধে সকল সন্তানের নরক গমনের" -এ "দয়াময় " ব্যবস্থায় দয়াময় স্রস্টা অত্যন্ত ব্যথিত হয়ে পড়েন। বিনা রক্তপাতে ক্ষমা করতে অক্ষম হয়ে তিনি নিজের পুত্রকে কুরবানী করার সিদ্ধান্ত নেন। কারণ পাপের জন্য পাপী নিজের বা পাপীর সন্তানগণ রক্তপাত করলে হবে না। বরং নিরপরাধ নিষ্পাপ কাউকে ধরে কুরবানী দিতে হবে। এজন্য স্রস্টা নিজের আপন পুত্রকে কুরবানী হিসেবে পৃথিবীতে পাঠান। তিনি ক্রুশে মরে অভিশপ্ত হয়ে তিনদিন নরক যন্ত্রণা ভোগ করেন এবং শয়তানের হাত থেকে নরকের চাবি কেড়ে নিয়ে মানুষদেরকে চিরতরে মুক্তি করে দেন। এখন মানুষ যত পাপই করুক না কেন যীশুর ঈশ্বরত্বে ও কুরবানীতে বিশ্বাস করলেই নরক থেকে চিরমুক্তি। পৌলের ভাষায়:-"...একটা পাপের মধ্যে দিয়ে যেমন সমস্ত মানুষকেই আযাব পাবার যোগ্য বলে ধরা হয়েছে, তেমনি একটা নায্যকাজের মধ্যে দিয়ে সমস্ত মানুষকেই নির্দোষ বলে গ্রহণ করবার ব্যবস্থাও করা হয়েছে।...যেমন একজন মানুষের (হযরত আদম আঃ) অবাধ্যতার মধ্যে দিয়ে অনেকেই পাপী হয়েছিল ,তেমনি একজন মানুষের (হযরত ঈসা আঃ) বাধ্যতার মধ্যে দিয়ে অনেকেই নির্দোষ বলে গ্রহণ করা হবে।" [(রোমীয় ৫:১৮-১৯), "রক্তপাত না হলে পাপের ক্ষমা হয় না।" (ইব্রীয়: ৯:২২) পুনশ্চ: (রোমীয় ৪/২৫, ১৬; ১০/৯; গালাতীয় ৩/১০-১৩; ইফিষীয় ১/৭; ১ করিন্থীয় ১৫/২১-২২)]

পৌলের এ উদ্ভট আকিদাগুলো ভিত্তিহীন অসত্য। কারণ
ক) একের পাপে অন্যের শাস্তি ও একের ত্যাগে অন্যের মুক্তি এবং
খ) রক্তপাত ছাড়া পাপ মুক্তি হয় না।

কারণ বাইবেলের পুরাতন নিয়মের বিধান যা মানতে বাধ্য তাতে বলা হয়েছে :-" প্রত্যেকে নিজের পাপের জন্যই মরবে; যে টক আঙ্গুর খাবে তারই দাঁত টকে যাবে" (যিরমিয় ৩১:৩০)। এছাড়া (যিরমিয় ৩১:২৯-৩০)-তে উত্তম একটা উপমা বর্ণনা করা হয়েছে। যাই হোক এখানে উদ্ধৃতিতে বোঝা যাচ্ছে যে কেউই নিজের ছাড়া অন্যের পাপ বহন করবে না এবং অন্যের পাপ নিয়ে মরবে না। যে পাপ করবে সেই পাপী হবে। আবার অন্যত্র বলা হয়েছে:-"যে প্রাণী পাপ করে, সেই মরবে" (যিহিস্কেল ১৮:৪; দ্বিতীয় বিবরণ ২৪:১৬; ২ রাজাবলি ১৪:৬; ২ বংশাবলি ২৫:৪)।

বাইবেলের অন্যত্র বলা হয়েছে:-

19. কিন্তু তোমার বলছ, “সেই ছেলে কেন বাবার অপরাধ বহন করে না?” সেই ছেলে তো ন্যায় ও ধার্মিকতার আচরণ করেছে এবং আমার বিধি সব রক্ষা করেছে, সে সব পালন করেছে; সে অবশ্য বাঁচবে।
20. যে কেউ পাপ করে, সে মরবে; বাবার অপরাধ ছেলে বহন করবে না ও ছেলের অপরাধ বাবা বহন করবে না; ধার্ম্মিকের ধার্ম্মিকতা তার ওপরে আসবে ও দুষ্টের দুষ্টতা তার ওপরে আসবে।
21. কিন্তু দুষ্ট লোক যদি নিজের করা সমস্ত পাপ থেকে ফেরে ও আমার নিয়ম সব পালন করে এবং ন্যায় ও ধার্মিকতার আচরণ করে, তবে সে অবশ্য বাঁচবে; সে মরবে না।
22. তার আগে করা সব অধর্ম্ম তার বলে মনে করবে না; সে যে ধার্মিকতার আচরণ করেছে, তাতে বাঁচবে।
23. “দুষ্টদের মৃত্যুতে কি আমি খুব আনন্দিত হই?” এটা প্রভু সদাপ্রভু বলেন; “বরং সে নিজের পথ থেকে ফিরে বাঁচে।" [১৭]

এখানে উপরোল্লিখিত তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে প্রমান হয় যে (ক) একের পাপে অন্যের শাস্তি ও একের ত্যাগে অন্যের মুক্তির দাবি 100% মিথ্যা এবং সর্বশক্তিমান ঈশ্বর মহান আল্লাহ্ সুবাহানাহু ওয়াতা'আলার নামে বে-ইনসাফির মিথ্যা অপবাদ ও (খ)পাপীর মুক্তির জন্য কাফ্ফারা বা রক্তপাত নিষ্প্রয়োজন; তওবা ও যথার্থ ধর্ম পালনই যথেষ্ট আর এটাই তো মহান আল্লাহর ইনসাফ, দয়া ও মমতার প্রকাশ।

কিন্তু পাঠক বন্ধুগণ পৌলীয় ধর্মের ঈশ্বরের মহানুভবতা দেখুন ও লক্ষ্য করুন। শাস্তির ক্ষেত্রে অকৃপণ ও মহানুভব হলেও মুক্তির ক্ষেত্রে কৃপণ (নাঊযুবিল্লাহ মিনযালিক; আস্তাগফিরুল্লাহ)। হযরত আদম আঃ এর পাপের কারণে শাস্তি পেতে কোন মানুষের কোন বিশ্বাস বা স্বীকারোক্তির প্রয়োজন নেই। ফ্রি শাস্তি! তবে যীশুর ত্যাগের কারণে মুক্তিটা ফ্রি নয়! বরং বিশ্বাস ও স্বীকারোক্তি লাগবে। পৌল ও তাঁর অনুসারীরা দাবি করলেন যে, ঈসা আঃ পাপীর পাপ বহন করবেন; কাজেই তাঁর আত্মত্যাগে বিশ্বাস করলেই মুক্তি সুনিশ্চিত। পক্ষান্তরে আমরা দেখলাম যে, ঈসা মাসীহ বললেন:-"ইমান ও শরিয়ত পালন না করলে শত বিশ্বাসেও মুক্তি মিলবে না। তিনি কোন পাপই বহন করবেন না। যীশু খ্রিস্ট তথা ঈসা আঃ আরো বলেন:-

28. কিন্তু আমি তোমাদের বলছি কেউ যদি কোন স্ত্রীলোকের দিকে লালসাপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় তবে সে মনে মনে তার সঙ্গে যৌন পাপ করল৷
29. সেই রকম তোমার ডান চোখ যদি পাপ করার জন্য তোমায় প্ররোচিত করে তবে তা উপড়ে ফেলে দাও৷ সমস্ত দেহ নিয়ে নরকে যাওয়ার চেয়ে বরং তার একটা অংশ হারানো তোমার পক্ষে ভালো৷
30. যদি তোমার ডান হাত পাপ করতে প্ররোচিত করে, তবে তা কেটে ফেলে দাও৷ তোমার সমস্ত শরীর নরকে যাওয়ার চেয়ে বরং তার একটা অঙ্গ নষ্ট হওয়া তোমার পক্ষে ভালো৷" [১৮]

এর মানে যে কেউ কোন স্ত্রী লোকের দিকে কুনজরে তাকায়, সে তখনই মনে মনে তার সাথে ব্যভিচার করলো। তোমার ডান চোখ যদি তোমাকে পাপ করায়, তবে তা উপড়ে ফেলে দাও। তোমার সমস্ত দেহ আগুনে পুড়বার চেয়ে বরং তার একটা অংশ নষ্ট হওয়া তোমার পক্ষে ভালো। এইখানে যীশু কোথাও বলে নাই যে, একের পাপ অন্যজন বহন করবে বরং বলেছেন তুমি পাপ করলে তুমিই শাস্তি পাবে। তাহলে ত্রিত্ববাদী খ্রিস্টানগণ কিভাবে যীশু খ্রিস্টের নামে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে পৌলের মতবাদ প্রচার করে? এটা তো লজ্জার কথা।

কৃতজ্ঞতান্তে: মুহাম্মদ আবদুল হাই 


তথ্যসূত্রঃ
➤[০১] দ্বিতীয় বিবরণ ২৪:১৬
https://bible.com/bible/1791/deu.24.16.ROVU
➤[০২] "ঈশ্বরের নায্য বিচার ও মন পরিবর্তনার্থে আহ্বান"
https://bible.com/bible/1791/ezk.18.1-32.ROVU
➤[০৩] যিহিষ্কেল ১৮:২০
https://bible.com/bible/1791/ezk.18.20.ROVU
➤[০৪] রোমীয় ৫:৮; এমন কথা আরো বলা হয়েছে ৬,৮-১০, ৪:২৫;...এক কথায় এই অধ্যায় জুড়েই পৌল মূলত এই শিক্ষা দিয়েছেন যে,"একের পাপের বোঝা অন্যজন বহন করে অর্থাৎ যীশু সকলের পাপের বোঝা বহন করেছেন" এই শিক্ষা দিয়েছেন তিনি, যা মূলত পূর্ববর্তী ভাব্বাদীদের বিপরীত শিক্ষা। অনলাইন সোর্স থেকে পড়তে ক্লিক করুন: রোমীয় ৫:৮
https://bible.com/bible/1791/rom.5.8.ROVU ;
আরো পড়ুন: রোমীয় ৫:১২-১৯
https://bible.com/bible/1791/rom.5.12-19.ROVU
➤[০৫] রোমীয় ১০:৯
https://bible.com/bible/1791/rom.10.9.ROVU ]
➤[০৬] যীশু খ্রিস্টের বিপরীত শিক্ষা পৌলের
https://islamicauthors.com/article/286
➤[০৭] ক্যাথলিক হেরাল্ড ,ভলিউম ৯,পৃষ্ঠা ২৭৭
➤[০৮] ১ যোহন ২:১-২
https://bible.com/bible/1791/1jn.2.1-2.ROVU
➤[০৯] মথি ৫:১৭-২০
https://bible.com/bible/1791/mat.5.17-20.ROVU
➤[১০] মার্ক ১২:২৮-৩১
https://bible.com/bible/1791/mrk.12.28-31.ROVU
➤[১১] মথি ৭:২৪-২৭

https://bible.com/bible/1791/mat.7.24-27.ROVU

➤[১২] "ধন সম্পর্কে শিক্ষা ও মজুরদের দৃষ্টান্ত" মথি ১৯:১৬-১৭; আরো দেখুন, লুক ১৮:১৮-১৯; বিস্তারিত পড়তে পারেন: কেরি ভার্সন
https://bible.com/bible/1791/mat.19.16-26.ROVU
➤[১৩] রোমীয় ১০:৯
https://bible.com/bible/1791/rom.10.9.ROVU
➤[১৪] মথি ৭:২১-২৩
https://bible.com/bible/1791/mat.7.21-23.ROVU
➤[১৫] গালাতীয় ১:৮
https://bible.com/bible/1791/gal.1.8.ROVU
➤[১৬] Hebrews 6:1 KJV
https://bible.com/bible/1/heb.6.1.KJV
গ্রিক টেক্সট দেখতে ক্লিক করুন:
https://biblehub.com/text/hebrews/6-1.htm
➤[১৭] যিহিস্কেল ১৮:১৯-২৩
https://www.wordproject.org/bibles/ben/26/18.htm#0
➤[১৮] মথি ৫:২৮-৩০
https://www.wordproject.org/bibles/ben/40/5.htm#0
Online source: King James Version Bible
https://bible.com/bible/1/mat.5.28-30.KJV

খ্রিস্টধর্ম বিষয়ক আরো পড়তে পারেন:
➤[১৯] খ্রিস্টানদের কিছু মিথ্যা দাবি + যীশুর ভবিষ্যদ্বাণী
https://islamicauthors.com/article/269