কাব ইবনু আশরাফের দূর্গের বর্তমান অবস্থা । সুত্র: Islamiclandmarks.com
কাব ইবনু আশরাফের হত্যার ঘটনা বিশ্লেষণের পূর্বে তৎকালীন মাদীনার রাষ্ট্র ব্যাবস্থাপনা ও রাষ্ট্র ব্যাবস্থাপনা প্রতিষ্ঠার ইতিহাস ভালো করে জানা দরকার ।
ইয়াসরীব বা মাদীনার অভিবাসনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস:
তৎকালীন মাদীনার পরিচিত নাম ছিল ইয়াসরীব ।মক্কা থেকে ২০৯ মাইল বা ৩৩৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ইয়াসরিব । শহরটি ভৌগোলিকভাবে ছিল অত্যন্ত সুরক্ষিত ।
এর দক্ষিণ দিকে ঘনবসতি এবং খেজুর বাগান দিয়ে এমন ভাবে পরিবেষ্টিত ছিল ছিল যে অভ্যন্তরীণ সহযোগিতা ছাড়া বাইরে থেকে কেউ আক্রমণ করতে আসলে সে ওখানকার দুর্বুদ্ধ রাস্তাঘাট ও গলিতে ঘুরে ই খেই হারিয়ে ফেলবে ।
নগরীর পূর্বাংশ কে বলা হত ‘হারারায়ে ওয়াকিম’ এবং পশ্চিমের অংশকে বলা হত ‘হাররায়ে ওয়াবারাহ ’ এই স্থানগুলোতে সর্বদা গলিত অগ্নিগিরির লাভা উদগিরনের আশঙ্কা থাকতো । এ কারণে স্থানগুলো দিয়ে সুসজ্জিত কাফেলা ব্যতীত একাকী ভ্রমণ অত্যন্ত কঠিন ছিল।
শুধুমাত্র মাদিনা নগরীর উত্তর দিক উন্মুক্ত ছিল আর সাধারণ কাফেলা যাতায়াত পথ ছিল এদিক দিয়েই আর কোন দুশমনকে আক্রমন করতে হলেও তাদের কে এদিক দিয়েই আক্রমণ করতে হতো । আর এধরনের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য এদিকটাতে অনেকগুলো দুর্গ সাদৃশ্য প্রাচীর নির্মাণ করা হয় যাকে আরবিতে ,‘আতাম’ বলা হতো ।
এখানকার রাজনৈতিক পরিবেশে ছিল মক্কার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন । মক্কাতে যেমন কুরাইশদের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল তেমন এখানে কোন একটি নির্দিষ্ট গোত্রের একচ্ছত্র ক্ষমতা ও অধিপত্য চলতো না।
প্রাচীন ইহুদি আলেমরা তাদের প্রাচীন লিপি থেকে জেনেছিলো যে সর্বশেষ নবী হীজরত করে এমন খেজুরময় স্থানে আসবেন যার দুপাশে ঝলসে যাওয়া উচু ভূমি থাকবে । ইয়াসরীব এই বর্ণনার সাথে পুরোপুরি মিলে যাওয়ায় বহু ইহুদি এখানে বসতি স্থাপন করে । এটাই ছিলো এখানে ইহুদিদের প্রথম আগমন যা আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৫১৩ সনে ।
এর কয়েক শতাব্দী পর যখন ইয়ামানের সুপ্রসিদ্ধ মায়ারীবের বাঁধ ভেঙে যায় এবং বিশাল সাবা নগরী ধ্বংস প্রাপ্ত হয় তখন সেখান থেকে কাহাতানি আরবদের দুটি কাবিলা ইয়াসরিবে স্থানান্তরিত হয় । কাবিলা দুটির একটি নাম ছিল আওস এবং অপরটির নাম ছিল খাজরাজ । ধীরে ধীরে এ দুটি গোত্র অনেক বড় বসতিতে পরিণত হয় । তবে তখন ইহুদীরা সংখ্যালঘু হলেও তাদের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ক্ষমতা বহাল ছিল ।[1]
পরবর্তীতে ৭০ খ্রিস্টাব্দে রোমানরা যখন শামের ইহুদিদের ওপর অকথ্য নির্যাতন শুরু করে তখন দেশত্যাগে বাধ্য ইহুদিদের বহু গুষ্টি ইয়াসরিবে এসে বসতি স্থাপন করে। এরা অধিকাংশই বনি ইসরাইলের বংশধর ছিল না বরং আরব জুযাম গোত্রভুক্ত ইয়াহুদি মতের আনুসারী ছিলো ।
ইজরাইলী ইহুদীরা তাদের নামে হিব্রু ভাষার প্রাধান্য দিতো আর আরব ইয়াহুদিদের থাকতো আরবী নাম । আরব জাতীয়তাবাদের প্রভাবে ইহুদি হওয়া সত্ত্বেও ইব্রাহিমি ধর্মের রীতি নীতির প্রতি তারা ছিলো শ্রদ্ধাশীল । তাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিলো তারা যুদ্ধবাজ, কতৃত্ব প্রিয় ও অহংকারী প্রকৃতির হতো । তা ছাড়া আরবদের তুলনায় তাদের নৈতিকতা কম এবং ধূর্ততা ও ব্যাবসায়িক চিন্তা অধিক ছিলো । তারা অসংখ্য দূর্গ ও সামরিক ঘাঁটির ন্যায় বসতি স্থাপন করে থাকতো । প্রথম দিকে ইহুদি এবং আওস ও খাজরাজ গোত্রের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা পূর্ণ মনোভাব থাকলেও এক পর্যায়ে তারা অভ্যন্তরীন কোন্দলে জড়িয়ে একের পর এক যুদ্ধ বিগ্রহে জর্জরিত হতে থাকে । এক্ষেত্রে যুদ্ধ মূলত পারস্পরিক অপরের উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য আওস ও খাজরাজের মধ্যেই হতো অন্যদিকে ইয়াহুদিরা তৃতীয় পক্ষ হিসেবে সুবিধাজনক গোত্রকে যুদ্ধে উস্কানি দিতো এবং চড়া সুদে তাদের উপর অর্থলগ্নিও করতো, এতে ইহুদীদের অর্থনৈতিক প্রাধান্য বজায় থাকতো । [2]
ইয়াসরীব বাসির সাথে ইসলামের শুভ পরিচয় ও রাসুলুল্লাহ ﷺ এর হীজরত :
এমতাবস্থায় রাসুলুল্লাহ ﷺ এর নবু্য়্যাতের ৭ম বর্ষে ইয়াসরিবের আওস গোত্রের শাখা গোত্র 'বানু আব্দুল আশহালে'র কিছু লোক নিজেদের পক্ষে মক্কার কুরাইশদের সাহায্য লাভের আশাই মক্কায় আসে এবং কুরাইশ রা তাদের প্রত্যাখান করে ।
এই দলটির সাথে রাসুলুল্লাহ ﷺ'র সাক্ষাত হয়, তিনি তাদের উদ্দেশ্য শুনে বলেন আমি তোমাদেরকে এর থেকে উত্তম কথা শোনাবো এবং তিনি তাদের কে ইসলামের দাওয়াত দেন , তাদের ভিতর একজন কম বয়সী তরুণ ইয়াস বিন মুয়াজ রা: এই দাওয়াত কবূল করেন কিন্তু অন্যরা নিরব থাকেন । তখন মুয়াজ রা: বলেন,
❝ভাইয়েরা আল্লাহর কসম এই কথা গ্রহণ করে নাও তোমরা যে জন্য এসেছ এটি তার থেকে উত্তম ।❞
তারপরেও অন্যরা নীরবে চলে যায় ।
এর পর সু-প্রসিদ্ধ বুয়াস যুদ্ধে মাদিনার সমাজ ব্যাবস্থা একেবারেই ভেঙ্গে পড়ে । তাদের প্রবীণ নেতারা প্রায় সকলেই নিহত হন । এসময় উভয় গোত্র আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করে ইহুদিরা উভয় দলকে উস্কানি দিয়ে চলেছে উভয় দলকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে কিন্তু তারা সাহায্য করছে কেবলমাত্র শক্তিশালী দলকে । তারা সর্বদা বিজয়ীদের পক্ষে থাকছে । এতে আওস ও খাজরাজের উভয় গোত্র বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ে । তারা ইয়াহুদিদের থেকে বিপদের আভাস পাচ্ছিল । অন্য দিকে ইয়াহুদিরাও যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির ফলে নিজেদের ব্যাবসা বানিজ্য নিয়ে চিন্তিত ছিলো ।
নাবী ﷺ তায়েফ থেকে ফেরার পরপরই ১১তম নববিবর্ষের হাজ্জের সময় তাঁর অভ্যাসমতো হাজ্জ করতে আসা বিভিন্ন গোত্রের নিকট ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার জন্য বাইরে বের হন।
মিনার বড় জামরার নিকটবর্তী পাহাড়ের এক ঘাঁটিতে খাযরাজ গোত্রের কিছু লোকের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। তারা ইয়াসরিব থেকে হজ্জের র উদ্দেশ্যে আগমন করেছিলেন। রাসুলুল্লাহ ﷺ তাদেরকে তাওহিদের দাওয়াত দেন এবং কুরআন কারিম থেকে পড়ে শোনান। ইয়াসরিবের লোকেরা তাদের প্রতিবেশী ইহুদিদের থেকে অনেক শুনেছে যে, খুব শীঘ্রই একজন নবীর আবির্ভাব হবে।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ﷺ'র নুরানি অবয়ব, উন্নত চরিত্র এবং পবিত্র দাওয়াতে তারা অনেক প্রভাবিত হয়।তাদের বিশ্বাস হয় যে তিনিই সেই নাবী, যিনি মানবতার মুক্তির অগ্রদূত হবেন। পাশাপাশি তাদের এটাও অনুভব হয় যে, তাদের পারস্পরিক যুদ্ধের সমাপ্তি, দেশের জীবিকা এবং চাষাবাদের উপর জেঁকে বসা ইহুদিদের থেকে মুক্তি পাওয়ার এটিই একমাত্র পথ যে, আমরা সকলেই নাবীর প্রতি ঈমান আনব। ফলে তারা নবীজি ﷺ কে বলেন
❝আমাদের কওমের মধ্যে যত অনিষ্ট, বিশৃঙ্খলা ও ফ্যাসাদ রয়েছে, তা দুনিয়ার অন্য কোথাও নেই । হতে পারে আল্লাহ তায়ালা আপনার মাধ্যমে আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করবেন।❞
ইয়াসরিবের বরকতময় ছয় ব্যক্তি সর্বপ্রথম ঈমান আনেন । আসআদ বিন যুরারা, আউফ বিন আফরা, রাফি বিন মালিক, জাবির বিন আবদুল্লাহ, কুতবা বিন আমির এবং উকবা বিন আমির (রাদিয়াল্লাহু আনহুমাহ)। তাঁরা দেশে ফিরে ইসলামের দাওয়াত দিতে শুরু করেন। তাঁদের মেহনতে কিছুদিনের মধ্যেই মাদিনা'র সর্বত্র দাওয়াতের প্রচার-প্রসার হয়ে যায় এবং সেখানকার বহুলোক ইসলাম গ্রহণ করে নেন ।
ইয়াসরিবের ঘরে ঘরে আলোচিত হতে থাকে যে, মক্কাতে একজন সত্য নবীর আবির্ভাব হয়েছে। তিনি তার গোত্রের কঠিন নির্যাতন-নিপীড়ন ভোগ করেছেন। তিনি কুরাইশি এবং হাশিমি বংশোদ্ভূত। আবদুল মুত্তালিবের দৌহিত্র এবং আবদুল্লাহর পুত্র। ইয়াসরিববাসীর কাছে এই বংশের পরিচয় অজানা ছিল না। তারা জানত কিছুদিন পূর্বে তাদেরই এক বংশ বনু নাজ্জারের কন্যা সালামা বিন আমর কুরাইশি সরদার হাশিমের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় রাসূল্লাহ ﷺ'র দাদা আব্দুল মুত্তালিব এই দম্পতির সন্তান । তারা এটাও জানত যে, আবদুল মুত্তালিব বাল্যকালে এখানকার অলিগলিতেই খেলাধুলা করে কাটিয়েছেন। এই এলাকারই মেয়ে ফাতিমা বিনতে আমরকে তিনি বিবাহ করেছিলেন। তার গর্ভেই পুত্র আবদুল্লাহ জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বনু নাজ্জারের বয়স্ক নারীদের সেদিনকার কথা মনে আছে, যেদিন আবদুল্লাহ বিন আবদুল মুত্তালিব এখানেই অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন এবং এই এলাকাতেই তাকে দাফন করা হয়। এরপর আমিনা বিনতে ওয়াহাবের স্বামীর কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে আসা, ফিরে যাওয়ার পথে আরওয়াতে মৃত্যুবরণ করার কথাও তারা ভোলেননি। ছয় বছর বয়সি মুহাম্মদ তার সাথেই ছিলেন। আর আজ সেই 'মুহাম্মদ'ই একজন পথপ্রদর্শক ও নবী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। মানুষকে আল্লাহ তায়ালার দিকে আহ্বান করছেন। আসমানি বিধানের প্রতি ডাকছেন; যদিও এটা তাদের আকাঙ্ক্ষা ছিল না, তারপরও তাদের মধ্যে যেন অন্যরকম অন্তরঙ্গতা অনুভূত হচ্ছিল । এই সহজাত আত্মিক টান থেকে মদীনার মানুষ ইসলামের প্রতি আগ্রহী হয়ে পড়ে এর পর ইসলামের উচ্চপর্যায়ের নৈতিকতা তাদের ইসলাম গ্রহণ ত্বরান্বিত করে ।
পরবর্তী বছর ১২ জনের একটি নওমুসলিম দল ইয়াস্রীব থেকে এসে রাসুল্লাহ ﷺ এর সাথে দেখা করেন।
রাসুলুল্লাহ ﷺ তাদেরকে শিরক, চুরি, বাভিচার, আকারনে হত্যা থেকে বেচে থাকা এবং সকল ভালো কাজের আনুগত্য করার প্রতিশ্রুতিতে বায়াত করান। এটাই বিখ্যাত ‘আকাবার প্রথম বায়াত’।
রাসুলুল্লাহ ﷺ তাদের ইসলাম শিক্ষা ও দায়াতে সহযোগিতা করার জন্য মুসায়াব বিন উমাইর রা: ও অন্ধ কারী আব্দুল্লাহ বিন ঊম্মে মাক্তুম রা: কে প্রেরণ করেন। মুসায়াব রা: এর অসামান্য ব্যাক্তিত্ব ও দাওয়াতি দাওয়াতি কার্যক্রমের ফলে আওস ও খাজরাজ উভয় গোত্রের নেতা সহ অধিকাংশ মানুষই ইসলাম গ্রহণ করে নেন।
দুই গোত্র ইসলামী ভ্রাতৃত্বের ছায়ায় শত বছরের পুরনো শত্রুতা ভুলে পরস্পরের আপনজন হয়ে ওঠে। রাসূলুল্লাহ ﷺ সমগ্র ইয়াসরিবে অত্যন্ত পরিচিত ও শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার পাত্র হয়ে ওঠেন। তাঁরা বারবার রাসুলুল্লাহ ﷺ কে হিজরত করে তাদের কাছে চলে আসার অনুরোধ জানাতে থাকেন। মক্কার কাফিরদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সাহাবিরা দফায় দফায় হিজরত করতে থাকেন, তবে রাসুলুল্লাহ ﷺ আল্লাহর আদেশের অপেক্ষাতে ছিলেন।
অবশেষে আল্লাহ তাআলার আদেশে রাসুলুল্লাহ ﷺ হিজরতে রওনা হন । এ খবরে ইয়াস্রিবে আনন্দের জোয়ার উঠে। তারা অধির আগ্রহ নিয়ে ফজর থেকে সূর্যের উত্তাপ বাড়ার আগ পর্যন্ত দিগন্তে অনিমেষ নয়নে তাকিয়ে থাকত। [3] অবশেষে রাসুলুল্লাহ ﷺ এসে পৌঁছেন [4] । ইসলাম গ্রহণের পাশাপাশি রাসুলুল্লাহ ﷺ'র প্রতি ইয়াসরিবের আপামর জনসাধারণের গড়ে উঠে প্রচন্ড আস্থা ও ভালোবাসা আর আগেই উল্লেখ করেছি যে সে সময়ে ইয়াসরিবের সামাজিক পরিস্থিতি ছিলো ভয়ংকর অস্থির । আর তাই সে পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পেতে মুহাম্মদ ﷺ'র নেতৃত্ব মেনে নিতে মদিনার পৌত্তলিক থেকে ইহুদী কেওই কোন বিরোধীতা করেনি । সকলে মিলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে সমাজ বিনির্মাণের দায়িত্ব আর্পণ করতে রাজি হয় ।
মাদীনা সনদ ও জাজিরাতুল মাদীনা :
রাসুলুল্লাহ ﷺ মদিনার সকল ধর্মের এবং গোত্রের নেতাদের কাছ থেকে তার প্রতি আনুগত্যতার প্রতিশ্রুতি আদায় করেন। তিনি গোত্রীয় আইন পরিবর্তন করে আন্ত গোত্রীয় উম্মাহ গঠন করেন। মদিনার সকল ধর্ম এবং গোত্রের লোকজন এক উম্মাহ সদস্য বলে প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি তাদের সাথে ৪৭ ধারা সম্বলিত একটি চুক্তিপত্র বা সনদ প্রনয়ণ করেন । এই চুক্তিটিই ইতিহাসের সর্বপ্রথম পূর্ণাঙ্গ লিখিত সংবিধান 'মাদীনা সনদ'। 'ইয়িসরীবে'র নামকরণ করা হয় 'জাজীরা তুল মাদীনা' । আর এই জাজীরা তথা রাষ্ট্রের সংবিধান হিসেবে মাদীনা সনদ কে স্বীকৃতি প্রদান করে মাদীনার সকল ধর্মের ছোট বড় সকল গোত্র তাতে স্বাক্ষর করেন।
পাঠক
সম্ভবত বিরক্তি ও বিষ্ময় নিয়ে ভাবছেন কাবের মৃত্যুদন্ড নিয়ে আলোচনা করতে এসে এতো বৃহৎ ভুমিকার কারন কি ? আসলে এই মৃত্যুদন্ডের স্বরুপ বুঝতে গ���লে মাদীনা রাষ্ট্র ও মাদীনা সনদ এবং ইয়াহুদি গোত্রগুলোর মনোভাব জানা অপরিহার্য । যথা সময়ে পাঠক তা বুঝতে পারবেন ইন'শা'আল্লাহ । তো চলুন আমরা এবারে এই আলোচনার সাথে সম্পৃক্ত মাদীনা সনদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ধারা সম্পর্কে জেনে নেই ।
মাদীনা সনদের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা :
ধারা ১:
সনদের লিখিত বিষয়গুলো রাসুল ও নবি মুহাম্মাদ -এর পক্ষ থেকে। এটি মক্কার কুরাইশ এবং ইয়াসরীবের অধিবাসীদের সঙ্গে সম্পর্কধারী মুসলমান এবং ওই লোকদের মধ্যে গৃহীত হচ্ছে, যাঁরা তাঁর অনুসরণ করেছে, তাঁর সঙ্গে এসে মিলিত হয়েছে এবং তাঁর সঙ্গে মিলে কষ্ট করেছে। বিনিময় অথবা ক্ষতিপূরণ গ্রহণ করা হবে না।
ধারা ২৫:
বনু আউফের ইয়াহুদিদের মুমিনদের সঙ্গে একই জাতি (রাজনৈতিক মিত্র) হিসেবে গণ্য করা হবে। ইয়াহুদিদের জন্য তাদের ধর্ম পালনীয় এবং মুসলমানদের জন্য তাঁদের ধর্ম—আজাদকৃত গোলাম হোক কিংবা স্বাধীন। হ্যাঁ, যে ব্যক্তি অত্যাচার করবে কিংবা কোনো পাপাচারে লিপ্ত হবে সে নিজের সত্তা এবং পরিজন ব্যতীত অন্য কাউকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারবে না।
ধারা ২৬-৩৫ :
এ ধারা সমূহ অনুযায়ী মদিনার অন্য সকল ইয়াহুদি গোত্র এবং তাদের সহযোগী গোত্র গুলো বনু আউফের ন্যায় সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করবে এবং চুক্তি মেনে চলবে । ধারাবাহিক ভাবে এ ধারাগুলোতে মদিনার সকল ইয়াহুদি গোত্র ও তাদের মিত্রদের নাম উল্লেখ করা হয়েছিল ।
ধারা ৩৬:
অঙ্গীকারবদ্ধ কোন গোত্র মোহাম্মদের অনুমতি ব্যতীত থেকে বেরিয়ে যাওয়ার অধিকার রাখবে না ।
ধারা ৩৮:
কোন ব্যক্তি তার সহযোগী পাপের দায় বহন করবে না সর্বাবস্থায় মাজলুমের সহায়তা করা হবে।
ধারা ৪০:
অঙ্গীকারে আবদ্ধ গোত্রগুলোর জন্য ইয়াসরিব তথা মদিনা হারাম ভূমি হিসেবে বিবেচিত হবে। ( সেখানে কোন ধরনের যুদ্ধ, ফ্যাসাদ, কারো সম্মানহানি , কাউকে অপবাদ প্রদানের সূচনা করা যাবে না)
ধারা ৪১:
প্রতিবেশী গোত্রগুলো যদি ক্ষতিকর কিংবা ফ্যাসাদ সৃষ্টিকারী না হয় তাহলে তারা আপনজনদের মতো বিবেচিত হবে । শরণার্থীদের সঙ্গে সেই আচরণ করা হবে, যে আচরণ করা হয়ে থাকে সাধারণ অধিবাসীদের সঙ্গে । কোনোভাবেই কাউকে ক্ষতিগ্রস্ত করা যাবে না ।
ধারা ৪২:
অধীনস্থ কাউকে অভিভাবকের অনুমতি ব্যতীত আশ্রয় প্রদান করা যাবে না ।
ধারা ৪৩:
মদিনায় বসবাসকারী হবে পরস্পর সাহায্যকারী তাদেরকেও মক্কার কুরাইশ বা তাদের মিত্রদের সাহায্যকারী হতে পারবে না এবং সাহায্যকারি বানাতে পারবে না ।
ধারা ৪৬:
অঙ্গীকারের সঠিক গোত্রগুলো পরস্পর বিশ্বস্ত আচরণ প্রদর্শনে বাধ্য থাকবে। অঙ্গীকার সর্বাবস্থায় মেনে চলতে হবে। কোন অবস্থাতেই এই অঙ্গীকার ভঙ্গ করা যাবে না । প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ নিজ কাজের জিম্মাদার হবে ।
ধারা ৪৭:
এই চুক্তি কোন অপরাধী অথবা অত্যাচারিকে নিরাপত্তা প্রদান করবে না । যে ব্যক্তি যুদ্ধের সময় যুদ্ধ করতে যাবে সে নিরাপদ থাকবে, যে ব্যক্তি যুদ্ধের সময় মদিনায় নিজেদের ঘরে বসে থাকবে সেও নিরাপদ থাকবে । কেবল সে সকল লোক নিরাপদ থাকবে না যারা জালিম, অপরাধের শিকার এবং বিশ্বাসঘাতক । নিঃসন্দেহে আল্লাহ মুত্তাকী এবং পুণ্যবাণদের সাহায্যকারী ও নিরাপত্তা বিধায়ক ।[5]
পাঠক পরবর্তী আলোচনাতে দেখতে পাবেন কাব বিন আশরাফ উপরে উল্লেখিত সবগুলো ধারার শর্ত ভঙ্গ করে। ফলে সে পরিণত হয় এমন রাষ্ট্রদ্রোহী বিদ্রোহীতে, মৃত্যুদন্ড ছিলো যার অপরিহার্য শাস্তি।
কাব ইবনু আশরাফের পরিচয় এবং তার বিশ্বাসঘাতকতার স্বরুপ :
কাব ইবনু আশরাফ ছিল আরবের প্রসিদ্ধ বংশ 'তাই' গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। ইসলাম পুর্ব যুগে তার পিতা রক্তপণের দায় নিয়ে মাদদীনায়( তৎকালীন ইয়াসরিব) পালিয়ে আসে। সেখানে সে ইহুদী গোত্র 'বানু নাজীর'র সঙ্গে মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ হয়। পরবর্তীকালে বানু নাজীরের আবুল হুকাইকের কন্যা আকিলার সঙ্গে সে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়। সে সুদ ও বন্ধকি ব্যাবসা, অস্ত্র ও মাদক ও সুগন্ধির ব্যাবসা করে বানু নাদীরের বেশ প্রভাবশালী ব্যাক্তি হয়ে ওঠে এবং পরবর্তীতে তার পুত্র কাব পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে । শুরু থেকেই কাব ছিল ইসলামবিদ্বেষী । ইসলামে তার প্রধান দুটি ব্যাবসা (সুদ ও বন্ধকি) নিষিদ্ধ হবার ফলে তার অসংখ্য মুসলিম ভোক্তা হাতছাড়া হয়ে যায় । ফলে ইসলাম বিদ্বেষী হবার পাশাপাশি সে মুসলিম ও ইসলামকে তার অর্থনীতির জন্য প্রত্যক্ষ হুমকি বিবেচনা করত ।
বদর যুদ্ধে কাফীরদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের বিজয় তাকে ক্ষেপিয়ে তোলে। সে মুলত মাদীনাতে মক্কার মুশরিকদের গুপ্তচর হিসেবে কাজ করতো।
এছাড়া তার উপর মক্কার মুশরিকদের নিকট অস্ত্র বিক্রয়ের অভিযোগ ছিলো।
তার তথ্যের ভিত্তিতেই তৎকালীন মক্কার মুশরিক নেতা আবু সুফিয়ান গোপনে ২০০ সৈন্য নিয়ে মদিনায় ঝটিকা আক্রমণ করে। যা রাসুলুল্লাহ ﷺ জানতে পেরে তড়িৎ পাল্টা আক্রমণের জন্য এগিয়ে আসেন। ফলে এই ঝটিকা বাহিনী শহরে ঢুকতে পারেনি। তারা মাদীনার উপকণ্ঠে 'আরজ' নামক স্থানে কয়েকটি গাছ কাটে ও আগুন লাগিয়ে দেয় এবং দুইজন আনসারকে হত্যা করে এরপ্র মুসলিম বাহিনী কে ক্ষিপ্র গতিতে ছুটে আসতে দেখে আবু সুফিয়ান ও তার দলবল পালিয়ে যায়। এই ঘটনা ইতিহাসে সাভিকের যুদ্ধ নামে পরিচিত। এই ঘটনার তদন্তে কা'ব বিন আশরাফের কার্যকলাপের গুরুত্বের বিষয়টা সামনে আসে ।
ঐতিহাসিক ইবনে ইসহাকের বর্ণনা অনুযায়ী, মুহাম্মদ ﷺ কাবকে হত্যা করার জন্য তার অনুসারীদেরকে নির্দেশনা দেন, এর কারণ; কাবের প্রেরিত একটি চিঠি বদর যুদ্ধের পর মক্কায় পৌঁছেছিলো এবং তা মুহাম্মদ সা.-এর বিরুদ্ধে কুয়াইশদেরকে ক্ষেপিয়ে দিয়েছিল। সে মুসলিমদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করে এবং প্রতিশোধ গ্রহণে কুরাইশদের উন্মত্ত করে তোলে। [6]
পরবর্তীকালে সে নিজে মক্কায় গিয়ে বদরযুদ্ধে কুরাইশদের নিহতদের উদ্দেশে শোকগাথা আবৃত্তির মাধ্যমে সে রাসুল ও তাঁর সঙ্গীদের বিরুদ্ধে তাদের উসকানি দিতে থাকে। সেসব কবিতায় মুসলমানদের হত্যার মাধ্যমে বদরযুদ্ধে নিহত কুরাইশদের প্রতিশোধ গ্রহণ করা কুরাইশদের একটি মহান দায়িত্ব বলে উল্লেখ করে।
বদরের নিহত নেতাদের নিয়ে তার কিছু পক্তি—
বদরের ময়দান ময়দান বদরবাসীকে খুব নিষ্পেষিত করেছে।
বদরের মতো সমস্যায় কান্নাকাটি ও শোক করা উচিত।
শহরের নেতৃবৃন্দকে সেখানকার কূপের কিনারে হত্যা করা হয়েছে। এটি কোনো অসাধারণ ঘটনা নয়, নেতাদের সাথে এমনটি অহরহই ঘটে।
শুভ্র সুন্দর নেতৃবৃন্দকে সেখানে হত্যা করা হয়েছে, যাদের কাছে কত অসহায় মানুষ বিভিন্ন সময় আশ্রয় নিয়েছিল।
যে সকল লোকের অসন্তুষ্টি আমার জন্য লাঞ্ছনার কারণ হয়েছে, তারা বলছে যে, আশরাফপুত্র কাব ধৈর্যহীনতার প্রদর্শনী করছে।
তারা সত্যিই বলছে, হায়! যখন তাদের হত্যা করা হয়েছিল, তখন যদি পৃথিবী ধসে যেত।
আমি সংবাদ পেয়েছি, বনু কিনানার সকল লোক আবু ওয়ালিদের কথা মেনে নিয়েছে এবং তারা নিজেদের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কেটে নিয়েছে । [7]
কাব ইবনু আশরাফ নিয়মিতভাবেই মুসলমানদের কুৎসা রটনা ও কুরাইশদের উস্কানি দিতে থাকে । আবু সুফিয়ান এসে তাকে বলে,
‘ আমি তোমাকে আল্লাহর শপথ দিয়ে জিজ্ঞেস করছি আল্লাহর কাছে আমাদের ধর্ম অধিক প্রিয় নাকি মুহাম্মদের ধর্ম ’
সে উত্তরে বলে:
তোমরা মোহাম্মদের ধর্মের চাইতে অধিক সঠিক ধর্মের অনুসারী ।
অতঃপর মুসলিমদের বিরুদ্ধে কুরাইশদের প্রতিশোধ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিশ্চিত করে সে মদিনায় ফিরে যায় । মদিনা এসে স্পষ্টভাবে সে ইসলামের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান তুলে ধরে এবং মুসলিমদের বিরুদ্ধে কুৎসা মূলক কাব্য রচনা করতে থাকে । এমনকি সে তার নোংরা কাব্যে মুসলিম নারীদের চরিত্র হনন ও তাদের নিয়ে অশ্লিল কবিতা প্রচার করা শুরু করে । [৮]এর মধ্যে আব্বাস রাঃ এর স্ত্রী উম্মুল ফজল বিনতু হারিস রাঃ কে নিয়ে তার একটি কবিতার উপস্থাপন করার মতো অপেক্ষাকৃত কম অশ্লিল অংশ উদাহরণ হিসেবে পেশ করা হলো,
তুমি মর্যাদাহীন হয়েই উম্মুল ফজলকে মক্কার ভূমিতে একাকী নিঃসঙ্গ ছেড়ে চলে যাচ্ছো
মেহেদীর আভা মিশ্রিত সুরঞ্জনা ঘ্রাণযুক্ত নারী যাকে আয়নায় বাধাই করে রাখা সম্ভব ।
সে বনু আমিরের একমাত্র নারী যার প্রতি আমার আসক্তি জন্মায় ।
সে যদি চায় কাবকে প্রেম রোগ থেকে মুক্তি দিতে পারে ।
রাতের আঁধারে তাকে দেখার পর আর কখনো রাতের বেলায় সূর্য দর্শন পায়নি । -[8]
ঐ সময় কবিতার শক্তি ছিলো আজকালের প্রচার মিডিয়ার মত শক্তিশালী তারা কবিতার মাধ্যমে যে কোন ব্যক্তির চরিত্র হননে সিদ্ধহস্ত ছিলো। আরবে বৈরী কাব্যিক প্রচারণা সামরিক পরাজয়ের মত বিপর্যয়কর হয়ে দাড়াতে পারে। যে সব কবি ঐ সময়ে মুহাম্মদ ﷺ ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে কবিতা রচনা করেছিলো তাদের প্রতি মুহাম্মদ ﷺ এর কঠোরতার বিষয়টি বিবেচনার সময় সেকালে কবিতার দ্বারা যুদ্ধ প্রচেষ্টা এই দিকটির কথা বিবেচনায় রাখতে হবে। তখন কবিদের কবিতায় নিছক ব্যঙ্গ বিদ্রূপ ছিলোনা তাতে ছিলো বিদ্রোহের মত অপরাধের ইন্ধন এবং যার উদ্দেশ্য ছিলো রাষ্ট্রের ভিতর বিদ্রোহ এর মত ফ্যাসাদ ছড়িয়ে দিয়ে রাষ্ট্রের ধ্বংস সাধন।
কাব ইবনু আশরাফের মৃত্যুদন্ড:
কাব ইবনু আশরাফ বহুবিধ অপরাধে জড়িয়ে ছিল। মুসলিম সাধ্বী নারীদের চরিত্র হনন করে কাব্যরচনা ও মুসলিমদের কুৎসা রটনার পাশাপাশি, এমনসব কাজ সে করে আসছিল, যা ছিল স্পষ্ট প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের শামিল।
প্রতিটি অপরাধের জন্য সে সে আলাদা আলাদাভাবে মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার উপযুক্ত ছিল। কারন তার প্রতিটা অপরাধ মদিনা সনদের পরিপন্থি এবং এই সনদের ৪৭ নং ধারা অনুযায়ী তার মৃত্যুদন্ডের কারন ইসলামের শত্রুদের সঙ্গে সখ্য, মুসলমানদের বিরুদ্ধে উসকানি প্রদান, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ ও বিদ্রোহের মতো হত্যার উপযুক্ত হওয়ায় রাসুল তাকে হত্যার আদেশ দেন।[9] তার হত্যা সম্পর্কে ঐতিহাসিক গণ ও হাদিস সংকলকরা বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার উল্লেখিত অপরাধের শাস্তি স্বরুপ এবং তার ক্ষতি হতে মদিনা কে রক্ষার জন্য ও তার দুর্ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকে মৃত্যু দন্ড প্রদান করেন । কা‘ব ইবনু আশরাফের হত্যার ব্যাপারে যে সব বর্ণনা রয়েছে ওগুলোর সারমর্ম হচ্ছে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন বললেন,
‘কা‘ব ইবনু আশরাফকে কে হত্যা করতে পারে? সে আল্লাহ এবং তার রাসূল্লাহ (ﷺ)-কে কষ্ট দিয়েছে।’
তখন মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ (রাঃ) উঠে আরয করলেন,
‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমি প্রস্তুত আছি। আমি তাকে হত্যা করব এটা কি আপনি চান?’
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জবাবে বললেন,
‘হ্যাঁ’। তিনি বললেন, ‘তাহলে আপনি আমাকে অস্বাভাবিক কিছু বলার অনুমতি দিচ্ছেন কি?’
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উত্তরে বলেন,
‘হ্যাঁ’ তুমি বলতে পার।’
এরপর মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামা (রাঃ) কা‘ব ইবনু আশরাফির নিকট গমন করলেন তার সহযোগী হিসেবে আরো ছিলেন আব্বাদ ইবনু বিশর (রাঃ), আবূ নায়িলাহ (রাঃ) তার নাম সিলকান বিন সালামাহ যিনি ছিলেন কা’বের দুধ ভাই, হারিস ইবনু আউস (রাঃ) এবং আবূ আবস ইবনু জাবর (রাঃ) । তারা কাবকে কৌশলে হত্যা করেন এবং এই বিশ্বাসঘাতক কে তার পরিণতির কাছে পৌঁছে দেয় ।
এদিকে ইহুদীরা যখন কা‘ব ইবনু আশরাফের হত্যার খবর জানতে পারল তখন তাদের শঠতাপূর্ণ অন্তরে ভীতি ও সন্ত্রাসের ঢেউ খেলে গেল। তারা তখন বুঝতে পারল যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন অনুধাবন করবেন যে, শান্তি ভঙ্গকারী, গন্ডগোল ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারী এবং প্রতিজ্ঞা ও অঙ্গীকার ভঙ্গকারীদেরকে উপদেশ দিয়ে কোন ফল হচ্ছেনা তখন তিনি তাদের উপর শক্তি প্রয়োগ করতেও দ্বিধাবোধ করবেন না। এ জন্যেই তারা এ হত্যার প্রতিবাদে কোন কিছু করার সাহস করলনা, বরং একেবারে সোজা হয়ে গেল। তারা অঙ্গীকার পূরণের স্বীকৃতি দান করল এবং মুসলিমদের বিরুদ্ধাচরণের সাহস সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে ফেলল। এভাবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মদীনার বিরুদ্ধে বহিরাক্রমণের মোকাবেলা করার অপূর্ব সুযোগ লাভ করলেন এবং মুসলিমরা অভ্যন্তরীণ গোলযোগ হতে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হয়ে গেলেন যে গোলযোগের তাঁরা আশঙ্কা করছিলেন এবং যার গন্ধ তাঁরা মাঝে মাঝে পাচ্ছিলেন। [10]
এই রাষ্ট্রদ্রোহী ও বিশ্বাসঘাতক কাবের প্রতি যারা সহানুভূতিশীল তাদের নৈতিক অবস্থান বুঝতে খুব বেশী বেগ পেতে হয় না ।
তথ্যসুত্র:
- ⇧ তারিখে ইবনে খালাদুন, আল মিরাজুয জামান।
- ⇧ মু'জামুল বুলদান, তারিখে ইয়াকুবী
- ⇧ সাহিহ বুখারীর ৩৯০৬ নং হাদীস ।
- ⇧ তারিখুল ইসলাম, আনসাবুল আশরাফ প্রথম খন্ড , সিরাতে ইবনে হিশাম, তারিখে তাবারী, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, সিরাতে মুস্তাফা, সিরাত বিশ্বকোষ (ইসলামি ফাউন্ডেশন), সিয়ারু নুবালা আলামিন, বায়হাকি ।
- ⇧ মাজমুআতুল ওয়াসায়িকিস সিয়াসিয়্যাহ ।
- ⇧ ইবনু হিশাম ২য় খন্ড , আল লুলু ওয়াল মারজান হাদীস নম্বর -১১৭৯, সহীহুল বুখারী ১ম , ২য় খন্ড , আউনুল মা’বূদ ২য় খন্ড, যা’দুল মাআ’দ ২য় খন্ড, তারিখে দিমাশক প্রথম খন্ড, সিয়ারু নুবালা আলামিন, বায়হাকি ।
- ⇧ তারিখুল ইসলাম লিজ জাহাবী - ১৫৮
- ⇧ তারিখুল ইসলাম লিজ জাহাবী - ১৫৮, জুরকানি- ২:৮
- ⇧ তারিখুল ইসলাম লিজ জাহাবী - ১৬০, আস সিরাত্যূল নবাবিয়্যাহ- ৩/৪৫
- ⇧ আস সুরা মাআল ইয়াহুদ, আবু ফারিস ১/১১১। আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যাহ, ইবনু হিশাম : ৩/৫৯১