Are you sure?

হাদিস »  ফিকহ

“নারী খৎনা” বনাম “FGM” – ইসলামের অবস্থান কুরআন, হাদীস ও ফিকহের আলোকে একটি একাডেমিক পর্যালোচনা ।

✦ ভূমিকা
বর্তমান সময়ে “FGM” (Female Genital Mutilation) তথা "নারী যৌন অঙ্গ বিকৃতি" নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনা চলছে। অনেক সময় ইসলামী শরিয়তের “নারী খিতান”-এর সঙ্গে FGM কে গুলিয়ে ফেলা হয়, যার ফলে ইসলাম সম্পর্কে ভুল ধারণা ছড়ায়। এই প্রবন্ধে  মূলত আলোচনা করা হবে:
১.নারী খিতানের প্রকৃতি ও ইসলামি অবস্থান 
২. FGM-এর প্রকৃতি ও ইসলামি বিধান 
৩. কুরআন, হাদীস ও ফিকহের আলোকে তুলনামূলক বিশ্লেষণ

✦ নারী খিতান:

ইসলামী পরিভাষা ও উৎস:
খিতান (الختان) আরবি مصدر, যার শাব্দিক অর্থ “কর্তন”। পুরুষের ক্ষেত্রে এটি ওয়াজিব বা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা হিসেবে বিবেচিত। নারীর ক্ষেত্রে, হাদীসসমূহের আলোকে এটি একটি মুস্তাহাব (প্রশংসনীয়) কাজ, কিন্তু ওয়াজিব নয়। অধিকাংশ ফকিহের মতে এটা বৈধ তবে আবশ্যক কিছু নয় বরং নারীর ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল । 

✦ নারীদের খিতান সম্পর্কে হাদীসসমূহ ও সনদ এবং  বিশ্লেষণ:

নারীদের খিতান নিয়ে কয়েকটি হাদীস পাওয়া যায়, তবে মুহাদ্দিসদের বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই হাদীসগুলোর মধ্যে কোনটিই সনদ ও মতন—উভয়দিক থেকে সম্পূর্ণভাবে নির্ভুল (صحيح لذاته) নয়। অধিকাংশই হয় ضعيف (দুর্বল) বা حسن لغيره (অন্যান্য সূত্রে কিছুটা গ্রহণযোগ্য) হিসেবে চিহ্নিত। এখানে   তুলনামূলক ভাবে  সবথেকে বিশুদ্ধ দুটি হাদীস বিশ্লেষন করা হলো । 

📜 হাদীস:
«الْخِتَانُ سُنَّةٌ لِلرِّجَالِ، مَكْرُمَةٌ لِلنِّسَاءِ»
“পুরুষের জন্য খিতান হলো সুন্নাত, নারীর জন্য সম্মানজনক।”
— (মুসনাদ আহমদ: 19774; বায়হাকী, আল-কুবরা: 19070)

সনদ বিশ্লেষণ:
ইমাম বায়হাকী ও অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ বলেছেন, সনদ দুর্বল (ضعيف) কারণ এতে “حجاج بن أرطاة” নামক একজন দুর্বল রাবি রয়েছেন।


📜 অন্য একটি বর্ণনা:
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মদিনার এক নারী খাতনকারীকে বললেন:
«أَشِمِّي وَلَا تُنْهِكِي، فَإِنَّهُ أَنْضَرُ لِلْوَجْهِ وَأَحْظَى عِنْدَ الزَّوْجِ»
“হালকা কর্তন করো, অঙ্গহানি করো না। এটা মুখের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করে এবং স্বামীর নিকট প্রিয় করে তোলে।”
— (সুনান আবু দাউদ: 5271; সনদ মতভেদ পূর্ন )

সনদ বিশ্লেষণ:
ইমাম আবু দাউদ নিজেই বলেন, “هذا الحديث ضعيف”।
এতে রয়েছে “أم عطية” নামের মহিলা রাবি, যাঁর পরিচয় স্পষ্ট নয়, ফলে ইমাম নববী, আলবানী প্রমুখ হাদীসটিকে ضعيف (দুর্বল) বলেছেন।

🔍 বিশ্লেষণ:
এই দূর্বল  দীসদ্বয়ের মাধ্যমেও স্পষ্ট হয় — নারীর খিতান হালকা কর্তনের মাধ্যমে করতে বলা হয়েছে, যেন ক্ষতি না হয়। এতে অঙ্গহানি নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

✦ FGM (Female Genital Mutilation) এর সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য:

WHO (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা) FGM কে সংজ্ঞায়িত করেছে:
“All procedures involving partial or total removal of the external female genitalia or other injury to the female genital organs for non-medical reasons.”

✦ FGM-এর প্রকারভেদ:
1. Type I – Clitoris-এর কিছু অংশ বা সম্পূর্ণ কাটা 
2. Type II – Labia minora ও labia majora অপসারণ 
3. Type III – Vulva সেলাই করে বন্ধ করে দেওয়া (infibulation) 
4. Type IV – অন্যান্য ক্ষতিকর পদ্ধতি (burning, piercing)

✦  ইসলাম কি FGM সমর্থন করে?

না, ইসলাম FGM সমর্থন করে না। কারণ:
১. রাসূল ﷺ বলেছেন: “তোমরা (খৎনার সময়) অঙ্গহানি করো না।” – FGM-এ অঙ্গহানি হয়, যা নিষিদ্ধ।
২. ইসলাম চায় “لا ضرر ولا ضرار” – “কোনো ক্ষতি করা যাবে না।” – (ইবন মাজাহ: 2340)
৩. শরিয়তের মূলনীতি: الضرر يزال – “ক্ষতি দূর করা আবশ্যক”
৪. ফিকহবিদদের মতে: নারী খিতান অনুমোদনযোগ্য, তবে সীমা অতিক্রম করে ক্ষতিকর কিছু করা হারাম।

✦  তুলনামূলক ফিকহী ব্যাখ্যা ও সমর্থন:

মাজহাব নারী খিতান FGM সম্পর্কে মতামত 
হানাফি মুস্তাহাব অঙ্গহানি হারাম
মালিকি সম্মানজনক  ক্ষতি হলে হারাম 
শাফেয়ি  ওয়াজিব (মতভেদ আছে) সীমালঙ্ঘন হারাম
হাম্বলি মুস্তাহাব হারাম হওয়া উচিত

✦ উপসংহার
নারী খিতান একটি ইসলামী আমল  হতে পারে, তবে তা হতে হবে সীমিত, নিরাপদ এবং অঙ্গহানি ছাড়া এবং নারীর নিজ ইচ্ছা অনুসারে । ইসলামী মূলনীতি “لا ضرر” অনুযায়ী FGM-এর মতো ধ্বংসাত্মক ও ক্ষতিকর প্রথা শরিয়তের পরিপন্থী এবং তা হারাম।
ইসলামের নামে অমানবিক আচরণ বা সাংস্কৃতিক বিকৃতি কখনোই সমর্থনযোগ্য নয়।

✦ গ্রন্থপঞ্জি ও সূত্র
1. সুনান আবু দাউদ – হাদীস: 5271 
2. মুসনাদ আহমদ – হাদীস: 19774 
3. আল-মাওসূ‘আ আল-ফিকহিয়া, কুয়েত 
4. Al-Nawawi, Sharh al-Muhadhdhab, Dar al-Fikr 
5. WHO – Guidelines on FGM, 2023 
6. Fiqh al-Islami wa Adillatuh, ড. ওয়াহবা যুহাইলী